মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ২]

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: রবি, ২৫/১১/২০১২ - ১২:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভাসুরের ভাত খাইতে আসে নাই কুন্তী হস্তিনাপুর; যদিও আগে যিনি আছিলেন পাণ্ডুর পোষ্য তার পোষ্য এখন পাণ্ডরাজার বৌ পোলাপান; বনবাসের আগে যিনি আছিলেন নিঃসন্তান আন্ধা মানুষ তিনি এখন শতপোলার অংহকারী বাপ ধৃতরাষ্ট্র মহারাজ...

কুন্তীর পোলারা এখনো বেশ জংলি; যাদের রাজ্যশিক্ষা-অস্ত্রশিক্ষা কিংবা বুদ্ধি কোনোটাই নাই। অন্যদিকে রাজনীতির ঘনিষ্ঠ থাইকা ধৃতের পোলা দুর্যোধন প্রায় প্রস্তুত বাপের পরে সিংহাসনে বসার; যদিও কুরুবুড়া ভীষ্ম মোটেও দেখতে পারেন না তারে। কিন্তু ধৃতের পোলারা বড়ো হইবার পরে ভীষ্ম এখন শুধুই বংশের এক বৃদ্ধ মানুষ। আইনত এখনো তিনি সেনাবাহিনী প্রধান; কিন্তু তরতর করে বাড়া ধৃতের একশো পোলা যেখানে সারা দেশ দাবড়াইয়া বেড়ায় সেইখানে বাড়িতে বইসা তিনি জানেনও না তার সৈন্য সংখ্যা কত আর হাতিঘোড়াই বা আস্তাবলে আছে কি নাই...

ভীষ্মের সেই দিন আর নাই। যারে তিনি ছোট ভাইয়ের রাজ্যের ভার দিছিলেন; পোলারা বড়ো হইবার পর এখন সে সার্বভৌম রাজা। বাড়ির মুরব্বি আর সাক্ষাত জ্যাঠা বইলা এখনো ভীষ্মরে সে উপদেষ্টা আর সেনাপতির পদ থাইকা বরখাস্ত করে নাই; কোনোকিছু কইলে প্রকাশ্যে বিরোধিতাও করে না সত্য; কিন্তু আড়ালে গিয়া সে সকল সিদ্ধান্তই নেয় বড়োপোলা দুর্যোধনের লগে... ধৃতের এই পোলটা বড়োই বেয়াদব। প্রকাশ্যেই সে কয় শান্তনু থাইকা শুরু কইরা কুরুবংশের সব রাজাই নাকি আছিল মেরুদণ্ডহীন; তাই ইচ্ছামতো রাজাগোরে তিনি কান ধইরা উঠাইছেন বসাইছেন। কিন্তু দুর্যোধনের উপরে সেইটা চলত না। কারণ দুর্যোধন তার বাপের মতো আন্ধাও না; পাণ্ড কাকার মতো অথর্বও না....

দুর্যোধনটা বড়ো তরতর কইরা বাড়তাছে। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই এই পোলা বুদ্ধিতে-রাজকাজে আর জনপ্রিয়তায় শান্তনু বংশের যে কোনো রাজার থাইকা বহুগুন উপ্রে উইঠা গেছে। ভীষ্মের লাইগা এইটা মাইনা নেওয়া কঠিন। যদিও তার বেশি কিছু বলাবার নাই। ব্রহ্মচারী হইয়াও সারাজীবন রাজপুত্তুরের মতো মাখন ঘি খাইছেন তিনি; এখন ভাতিজার চাকরি ছাইড়া দিয়া শেষ জীবনে তার পক্ষে জঙ্গলে তপস্যা করাও কঠিন। তাই কুন্তী তার পোলাগো নিয়া ফিরা আসায় ভীষ্মের ছানিপড়া চোখে একটু ঝিলিক লাগে। দুর্যোধনরে এইবার একটু টাইট দেওয়া যাবে...

ভীম মারে পাইকারি হারে। যখন তখন যার তার লগে কুস্তি ধরে মাটিতে পইড়া যায়। অর্জুন মারে বাইছা বাইছা নিজেরে বাচাইয়া। নকুল-সহদেব ভীম আর অর্জুনরে লাঠিসোঁটা আগাইয়া দেয়। আর যুধিষ্ঠির আড়ালে খাড়াইয়া ভান করে গাছ-লতা-পাতা-আকাশ-প্রকৃতি দেখার। যদি দেখে ভীম ধৃতের পোলাগোরে কিলাইয়া সিধা কইরা ফালাইছে তাইলে আড়ালে থাইকাই মুচকি মুচকি হাসে। আর যদি দেখে ধৃতের পোলারা ভীমেরে চাইপা ধরছে তয় দৌড়াইয়া গিয়া মারামারি ভাঙায়- আরে করো কী? করো কী? আমরা সবাই ভাই ভাই। ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি করলে বাইরের শত্তুরে সুযোগ পায়...

কুন্তীর পোলাগো এই কৌশল ভীষ্মের খুব পছন্দ হয়। ভীমের লাইগা ধৃতের পোলার বেশ চাপের মধ্যে আছে। কিন্তু খালি ভীমের কিলাকিলি দিয়াই তো পুরাটা হইব না। তাই তিনি কৌশলে কুন্তীর বড়ো পোলা যুধিষ্ঠিরের উপর গুরুত্ব বাড়াইয়া দেন। পাণ্ডুর এই পোলা ধৃত-পাণ্ড দুইজনের পোলাদের মইধ্যে বড়ো; সুতরাং আইনত সেই হইব পরবর্তী রাজা...

ধৃতরাষ্ট্রের আপাতত এইসব নিয়া মাথাব্যথা নাই। রাজাগোজা হইবার বয়সে যাইতে পোলাপানের এখনো অনেক দেরি। বুড়া জ্যাঠার আপাতত যা ভাল্লাগে তাই করুক; সে আর বাঁচবেই বা কতদিন?

কুন্তী এই বিষয়ে এক্কেবারে চুপচাপ থাকে। যতদিন তার পোলাগো উপর ভীষ্মের নেকনজর আছে আর যতদিন না তারা আরেকটু শক্তপোক্ত হইয়া উঠছে ততদিন প্রকাশ্যে তার কিছু বলা ঠিক না। পোলাদের খালি সে বলে মুরব্বিদের একটু বেশি দাম দিতে। দাম কইমা যাওয়া বুড়ারা কারো কাছে দাম পাইলে তার লাইগা জান ধইরা দেন। তয় ভীমের লাইগা সে একটু চিন্তিত। পোলাটার মাথা গরম; মাইর খাইব না দিতে পারব সেই হিসাব না কইরাই সে কিলাকিলি শুরু কইরা দেয়। বহুবার ধৃতের পোলারা তারে মাইরা চ্যাপটা বানাইয়া ফালাইছিল। এর উপরে আছে তার খানাপিনার লোভ। যার লগে অত মারামারি সেই দুর্যোধনই যখন তারে কইল- আয় ভাই খাবি? তোর লাইগা বহুত খানাদানা রেডি করছি আমি...

আগামাথা না ভাইবাই ভীম গিয়া শুরু করল খাওয়া। বিষ মিশানো খাবার খাইয়া সে বেহুঁশ হইয়া পড়লে দুর্যোধন তারে গঙ্গায় ভাসাইয়া দিছিল। পরে কুন্তী বিদুরের লগে গিয়া বেহুঁশ ভীমেরে তুইলা আনে ঘরে। ওষুধ পত্র দিবার পরেও বিষের ঘোরে টানা আটদিন কোনো হুঁশবুদ্ধি আছিল না তার...

মুরব্বি হিসাবে মারামারি করার লাইগা মাঝে মাঝে ধৃতরাষ্ট্র অবশ্য তার পোলাদের বকাঝকা করেন। কিন্তু কুন্তী জানে ধৃত চান তার পরে দুর্যোধনই হোক রাজা। বড়ো ভাই হইয়াও তিনি আন্ধা বইলা রাজা হইতে পারেন নাই; বড়োই সম্মানহীন তার রাজত্ব জীবন। তিনি রাজা না; ছোটভাইর আসনে ভীষ্ম তারে বসাইছেন ভারপ্রাপ্ত কইরা। সকলে মহারাজ কইলেও এইটা কেউ ভোলে না যে পাণ্ডুর পোলারা বড়ো হইলে রাজ্যটা তাদের ফিরাইয়া দিতে প্রতিজ্ঞা করছেন তিনি... তাই কুন্তীর পোলাগো বড়ো হওয়া দেখলে তার ভয় ভয় লাগে; কোনদিন না তারা বাপের সিংহাসন দাবি কইরা বসে...

রাজপুত্রদের শিক্ষাদীক্ষার মতো নিরীহ বিষয়গুলাতে এখনো ভীষ্ম একাই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্র শিক্ষার দায়িত্ব ছিল কৃপাচার্যের। বড়োই শান্তশিষ্ট এই মানুষটা গুরু হিসাবে ঠিকাছেন। কিন্তু অস্ত্রবিদ্যার গুরু হিসাবে একটু হিংসুটে আর লোভী মানুষ বেশি উপযোগী। কারণ ভিতরে হিংসা আর লোভই যদি না থাকে তবে অস্ত্র দিয়া মানুষ মাইনসেরে মারবেই বা কেন?

দ্রোণ। জাতে ব্রাহ্মণ কিন্তু ধর্ম না কইরা করেন অস্ত্রের চর্চা। ছোটবেলার বন্ধু পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদের কাছে ব্রাহ্মণ দক্ষিণা না চাইয়া চাইছিলেন তার রাজ্যের অর্ধেক। ব্রাহ্মণরে খানাপিনা দিতে পারে; কিন্তু চাইলেই রাজ্য দিয়া দিব এইটা কি হয়? রাজ্য দিলো না বইলা পাঞ্চাল রাজারে দেখাইয়া দিবার প্রতিজ্ঞা কইরা তিনি এখন আইসা উঠছেন তার বৌয়ের বড়ো ভাই কৃপাচার্যের ঘরে। কুন্তীর পোলাগো লাইগা লোভী আর হিংসুটে এই দ্রোণই হইতে পারেন উপযুক্ত শিক্ষক... সে গান্ধারীর পোলাদেরও অস্ত্র শিক্ষা দিব কিছু না কিছু; কারণ তার বেতনটা তো যাইব আবার ধৃতরাষ্ট্রের কোষাগার থেকে...

কুন্তীর সময় এখনো আসে নাই। সে মাঝে মাঝে খালি ভীষ্মেরে গিয়া কয়- আপনের নাতিগো কেমনে ভালো হইব সেইটা আপনেই ভালো বুঝেন জ্যাঠা। আমি এক বিধবা নারী; স্বামীও নাই যে তার লগে পরামর্শ করতে পারি পোলাগো ভবিষ্যৎ নিয়া। তাই আপনেই আমার এতিম পোলাগো একমাত্র ভরসা। সে ধৃতরাষ্ট্রের কাছেও যায়- বাপমরা আপনের ছোটোভাইয়ের পোলাগো অভিভাবক তো আপনেই মহারাজ। বাপের অবর্তমানে আপনিই তাগোর বাপ। ওদের ভুলত্র“টি হইলে ক্ষমা কইরা সংশোধন কইরা দিয়েন...

শ্বশুর দ্বৈপায়ন সাঁইত্রিশখান পুস্তক লিখছেন এখন পর্যন্ত। বেদের ব্যাখ্যা দিয়া তিনি রচনা করছেন বেদান্ত দর্শন। বাকি ছত্রিশখান পুরাণ আর পাতিপুরাণ লিখছেন দেবতা অবতার আর ঋষিগো নিয়া; তার মধ্যে তার বাপ মুনি পরাশররে নিয়াও আছে একখান পুরাণ। এইবার তিনি সিদ্ধান্ত নিছেন মায়েরে নিয়া একখানা গ্রন্থ রচনার। মায়ে তার মুনিঋষি আছিলেন না। মা সত্যবতী তার পাটনিঘরে জন্মাইলেও বড়ো হইয়া হইছেন রাজবাড়ির মানুষ। তাই মায়েরে নিয়া যে পুরাণ রচনার সিদ্ধান্ত নিছেন তিনি; সেইখানে থাকব ইতিহাস রাজনীতি আর যুদ্ধের ঘটনা-বিষয়। এইটাতে তিনি বয়ান করবেন মানুষের ইতিহাস- যুদ্ধ-রাজনীতি আর দেশ চালনার নিয়ম কানুন। মায়েরে নিয়া রচিত এই গ্রন্থে তিনি মায়ের বংশধরদের কথাও লিপিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিছেন। সেইখানে তার পোলা জ্ঞানী বিদুরের কথা লিখবেন তিনি; ধর্মপরায়ণ গান্ধারীর কথাও লিখবেন আবার তার একশো পোলার জাউরামির কথাও বাদ দিবেন না। কুন্তীরে তিনি কইছেন- কুন্তীর ধৈর্যের কাহিনী বিস্তারিত কইরা বর্ণনা করবেন তিনি তার সেই গ্রন্থ রচনায়। তিনি দেখাইতে চান ধৈর্য ধরলে জয়লাভ সম্ভব। সেই কারণে সেই পুস্তকখানার নামও তিনি ঠিক কইরা রাখছেন ‘জয়’....

ইতিহাস আর ধর্ম জানেন দ্বৈপায়ন। তাই ধর্ম আর সত্যবতী পরিবারের কথা নিজেই লিখবেন তিনি। কিন্তু তিনি কোনোদিন রাজনীতি করেন নাই। তাই সৎভাই ভীষ্মরে তিনি দায়িত্ব দিছেন এই পুস্তকের রাজনীতি আর দেশ পরিচালনার নিয়মকানুনগুলা লিপিবদ্ধ কইরা দিতে....

রাজনীতিতে ভীষ্মের অভিজ্ঞতার তুলনা নাই সত্য; কিন্তু তার তো আবার লেখালেখির অভ্যাস নাই। তাই তিনি বৈকালে যুধিষ্ঠিররে ডাকেন- মনে করো তুমি একজন নতুন রাজা। রাজা হইছ ঠিকই কিন্তু তুমি জানো না কেমনে রাজ্য চালাইতে হয়... তো এইবার তুমি আমারে রাজ্য চালনা বিষয়ে একটা একটা কইরা প্রশ্ন করো; আমি উত্তর দিমু। আর তুমি প্রশ্নগুলাসহ আমার উত্তরগুলা সব লিখা রাখবা। পরে এইগুলা তোমার কালোদাদা দ্বৈপায়নের পুস্তকের শেষে রাজনীতির অংশে সংযোজিত হইব... আমি তারে এই অনুরোধও করব যে তিনি যেন দণ্ডনীতির এই অংশটা তার পুস্তকে তোমার-আমার প্রশ্নোত্তর হিসাবেই অন্তর্ভুক্ত করেন...

এই পুস্তকে যুদ্ধনীতি আর কলাকৌশল নিয়াও একটা অংশ থাকব; সেই অংশটা তিনি লিখার দায়িত্ব দিছেন কুন্তীর ভাতিজা কৃষ্ণরে; কৃষ্ণ যুদ্ধগুরু ঋষি উশনা; মানে শুক্রাচার্যের মেয়ের দিকের বংশধর। শুক্রাচার্য নিজেও আছিলেন মদ্যমাতাল আর দাম্ভিক; এর লাইগা তারে বহুত খেসারতও দিতে হইছে জীবনে। কিন্তু তিনি যখন দেখলেন যে তার মেয়ের বংশধররাও তার এই দোষ পাইছে; তখন তিনি নিজেই আইন কইরা তার মেয়ের বংশধরদের রাজা হইবার নিয়ম বন্ধ কইরা দিছিলেন। সেই কারণে যযাতি রাজার বড়ো পোলা হইয়াও শুক্রের নাতি যদু রাজা হইতে পারে নাই। সেই হিসাবে যদুর বংশে কুন্তীই প্রথম রাজরানি হইছে। যদুর বংশে কোনো রাজা না থাকলেও বংশটা শুক্রের মতোই সব সময় রাজনীতি চালায়। যে শুক্রাচার্য খালি বুদ্ধি আর কৌশল দিয়া অসুরদের দেবতাগো বিরুদ্ধে একলাই টিকাইয়া রাখছিলেন... যার সময়ে দেবতারা যুদ্ধে যাইবার আগে প্রতিপক্ষের অস্ত্র আর সৈনিকের হিসাব না লইয়া সন্ধান নিতো সেই পক্ষের লগে শুক্রাচার্যের যোগাযোগ আছে কি নাই। যদি জানত প্রতিপক্ষের লগে শুক্র আছেন; তবে যুদ্ধের চিন্তা বাদ দিয়া অস্ত্রপাতি গুটাইয়া তারা বইসা থাকত ভয়ে... সেই বংশের পোলা কৃষ্ণ; বয়সে সে ভীমের থাইকা কয়েকমাসের ছোট আর অর্জুনের কয়েক মাসে মাত্র বড়ো হইলেও এই বয়সেই সে শুক্রের যুদ্ধকৌশলগুলা যেমন আয়ত্ব করছে; তেমনি নিজে নিজেও আরো বহু কৌশল আর অস্ত্র আবিষ্কার করছে সে। যেখানেই সে যুদ্ধের সংবাদ পায়; যে কোনো এক পক্ষের হইয়া সে গিয়া হাজির হয়; ওগোর পরামর্শ দিয়া তার কৌশল আর অস্ত্র প্রয়োগ কইরা দেখে কতটা কাজ করে না করে...

সকল দেশে রাজাদের শাসন থাকলেও কৃষ্ণের দেশ দ্বারকায় কিন্তু রাজা নাই। দেশের অভিজাত লোকজন এখন সেই দেশটা চালায়। দ্বারকার রাজা কংসরে মাইরা কৃষ্ণ সেইখানে চালু করছে অভিজাতের শাসন। সেই কৃষ্ণরে দ্বৈপায়ন দায়িত্ব দিছেন যুদ্ধনীতির অংশটা লিখা দিতে। সঙ্গে এইটাও কইয়া দিছেন যে; যুদ্ধবাজ মাইনসেরে পাব্লিক খুব একটা পছন্দ করে না; তাই কৃষ্ণের মাহাত্ম্য বর্ণনা কইরা তার পুস্তকে তিনি নিজেই আরো কিছু কথাবার্তা জুইড়া দিবেন যাতে কৃষ্ণের কাজগুলারে মাইনসে ধর্মসম্মত কাজ বইলা মাইনা নিতে পারে....

দ্বৈপায়নের পুস্তক রচনা করতে গিয়া কুন্তীর পোলা যুধিষ্ঠির বুইঝা নিতাছে রাজনীতির নিয়ম আর ভাতিজা কৃষ্ণ ঝালাই করতাছে যুদ্ধের কৌশল... চলুক। শ্বশুর দ্বৈপায়ন কইছেন কুন্তীর ধৈর্যের কথা সেই পুস্তকে লিখবেন তিনি। কুন্তী ধৈর্যই ধরবে; যাতে দ্বৈপায়ন পুস্তকের ‘জয়’ নামটা কুন্তীর ধৈর্যের জয় হিসাবেই মানুষ গণ্য করতে পারে...

সিংহাসন বিষয়ে একটাও টু শব্দ না কইরা হস্তিনাপুরে আটখান বচ্ছর পার কইরা দেয় কুন্তী । এখন তার পোলারা বেশ শক্তপোক্ত হইছে। অস্ত্রশিক্ষা- যুদ্ধশিক্ষার লগে রাজনীতির হালচালও ভীম ছাড়া বাকিরা বেশ ভালোই বোঝে। যতদূর পারা যায় কৌরবদের লগে ভীমের কিলাকিলিরে কিলাকিলি হিসাবেই রাখতে পারছে সে; যুদ্ধ পর্যন্ত পৌছাইতে দেয় নাই... তবে কিছু কিলাকিলিও দরকার আছিল; না হইলে বেশি নরম পাইয়া অত্যাচার বাইড়া যাইত ধৃতের পোলাদের। ...কিন্তু বিদুর কিছুটা যেন হতাশ যুধিষ্ঠিররে নিয়া- আমাগো পোলাটা যে রাজা হইবার তুলনায় একটু বেশিই বেকুব...

বিদুরের কথায় কুন্তী হাসে- ভীষ্মের আশীর্বাদ পাওয়ার লাইগা বেকুবই তো সব থাইকা উপযুক্ত বিদুর। যার উপরে তিনি লাঠি ঘুরাইতে পারবেন না তারে তিনি সমর্থন করবেন ক্যান?

এইবার কুন্তী আরেকটু আগায়। ভীষ্মের সামনে গিয়া প্রণাম কইরা খাড়ায়- জ্যাঠা। আপনের বড়ো নাতির চব্বিশ বচ্ছর বয়স হইব অতি শিগ্গির। এখনতো আস্তে আস্তে তার রাজকার্যও বুইঝা নিবার সময়। খালি কি অস্ত্র আর ধর্মশিক্ষা কইরা দিন যাইব তার?

ভীষ্মও অঙ্ক করেন। একধাপে কিছু করতে গেলে সামলানো নাও যাইতে পারে। বিদুরেরও সেই মত। সকল কিছু ভাবনা চিন্তিয়া তিনি প্রকাশ্য রাজকীয় সভায় প্রস্তাব তোলেন যুধিষ্ঠিররে যুবরাজের পদে অভিষিক্ত করার...

সামনে যার আইনত রাজা হইবার কথা তারে যুবরাজ করার লাইগা কুরুবুড়ার যুক্তিসংগত প্রস্তাব; প্রধানমন্ত্রী বিদুরও যা সমর্থন করেন; ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে তা অস্বীকার করা মানে পাত্র-অমাত্য প্রজাদের কাছে নিজেরে প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী হিসাবে চিহ্নিত করা। ...হউক তাইলে সে যুবরাজ। যদিও যুবরাজ পদটা রাজা হইবার প্রস্তুতিমূলক পদ তবু যুবরাজ হইলেই যে সবাই রাজা হইতে পারে না তার প্রমাণ তো ভীষ্মদেব নিজে...

যুধিষ্ঠিরের লাইগা আপাতত যুবরাজ পদটাই ভালো। এক লাফে রাজা হইয়া গেলে সব বিপদ আপদ সামাল দিতে হইব তার; যার জন্য এখনো যুধিষ্ঠির উপযুক্ত না। তার চেয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ছাতার তলে থাইকা সব ঝুট ঝামেলা তার ঘাড়ে ফেইলা নির্ঝঞ্ঝাট সময়ে পরে রাজা হইবার লাইগা পা বাড়ান যাবে। কিন্তু তার পাঁচ পোলার মধ্যে কারোই একসাথে সৈন্য আর রাজ্য চালানোর বুদ্ধি নাই; যেইটা আছে দুর্যোধনের। তাই কুন্তী যা ভাবছিল তাই ঘটে; দুর্যোধন খেইপা উঠে যুধিষ্ঠিরের যুবরাজ হওয়ার কথা শুনে...

ধৃতরাষ্ট্র প্রকাশ্যে দুর্যোধনরে কিছু বকাঝকা করলেও কুন্তী জানে আড়ালে গিয়া আন্ধা রাজা তার এই পোলার বুদ্ধিতেই চলেন। এই ক্ষেত্রেও তাই হইল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ধৃতরাষ্ট্র বিধান পাঠাইলেন- শান্তনু বংশের সকলেই জীবনে একবারের লাইগা হইলেও বারণাবতে গিয়া পশুপতি শিবের উৎসব দর্শন করা নিয়ম। যেহেতু পঞ্চ পাণ্ডব ছাড়া বংশের সকলেই বারণাবতে শিবের উৎসবে গেছে; আর যেহেতু যুবরাজ যুধিষ্ঠির রাজকার্যে ব্যস্ত হইয়া পড়লে তার পক্ষে আর অতদূর গিয়া তীর্থদর্শন সম্ভব না; তাই এখনই তার উপযুক্ত সময় ভাইগোরে নিয়া বারণাবতে যাইয়া পশুপতি উৎসব দেইখা আসা...

তিনি শুধু বিধানই দেন নাই; বারণাবতে যুবরাজের থাকার ব্যবস্থা করতে পুরোচনরে আদেশ দিয়া বিদুরের উপর দিছেন তীর্থযাত্রা আয়োজনের ভার...

কুন্তীর মনে হয় ভাইদের সাথে যুধিষ্ঠিররে সরানোর লাইগা ধৃতরাষ্ট্র কোনো একটা চিরস্থায়ী উপায় ভাবতাছেন তীর্থযাত্রার নামে। কিন্তু তীর্থ যাত্রার কথা বইলা ধৃতরাষ্ট্র যে যুক্তি বাইর করছেন তাতে যুবরাজের না করার সুযোগ নাই। বারণাবতে যাইতেই হইব তাদের। ...কুন্তী সিদ্ধান্ত নেয়- চল আমিও যামু তোর লগে...

বিদুরের লগে দ্রুত কিছু কথাবার্তা বইলা নেয় কুন্তী। তারপর রাস্তায় নাইমা যুধিষ্ঠিররে ডাকে- শোনো পোলা। তিনদিনের যুবরাজ হইয়া নিজেরে বুদ্ধিমান আর অভিভাবক ভাইব না তুমি। আমি যা বলি তা মনোযোগ দিয়া শুনবা। হইলে এমনও হইতে পারে যে হস্তিনাপুরের আর কোনোদিনও ফিরা আসা হইব না তোমার...

যুধিষ্ঠিরের একটা বড়ো গুণ হইল ভয় দেখাইলে সে ভয় পায়। এই একই কথা যদি কুন্তী ভীমরে কইত তবে সে এখনই গদা নিয়া হস্তিনাপুর ফিরা যাইত ধৃতরাষ্ট্র আর তার পোলাপানগো মাইরা ভর্তা বানাইতে। তাতে কী ফল হইত সে ভাবত না। অর্জুনরে কইলে জায়গায় খাড়াইয়া কারে কোন অস্ত্র দিয়া মারব সেইটা বর্ণনা করতে করতে ফেনা তুইলা ফালাইত। ...যুধিষ্ঠিরের বুদ্ধি ভীমের থাইকা কিঞ্চিৎ বেশি আর ভড়ং অর্জুন থাইকা কম। তাই সে হাতপা গুটাইয়া মায়ের কাছে আইসা খাড়ায়- মা তুমি যা কও তাই হইব...

আর কোনো কথা হয় না। সকলে আগায়। ভীম সর্বদাই কুন্তীর পাশে। ভীমটা তার সংসারী পোলা। ধর্মকর্ম রাজনীতি কোনোটাই বোঝে না বা বুঝতে চায়ও না। কিন্তু কুন্তীর সংসারে তার একমাত্র সহকারী হাত এই মাইজা পোলা ভীম। মায়েরে সে যেমন আগলাইয়া রাখে তেমনি ভাইদেরও আগলাইয়া রাখে ভীম...

যুবরাজ আর তার ভাইগো লাইগা পুরোচন শিব নামে যে ঘরটা বানাইতাছে তা বড়োই মনোহর শণের চাল দেয়া কাঠের চারচালা ঘর। কিন্তু ঘরটার কাজ এখনো পুরাপুরি শেষ হয় নাই তাই প্রথম দশদিন যুবরাজরে মা ভাইদের নিয়া অন্য একটা ঘরে থাকতে হয়। দশ দিন পর যুবরাজের বাড়ি নির্মাণ শেষ হইলে কুন্তী তার পোলাগো নিয়া সেই ঘরে গিয়া উঠে পুরোচনরে জানিয়ে দেয়- মহারাজ পাণ্ডর রানি যেই ঘরে থাকেন সেই ঘরে আত্মীয় স্বজন ছাড়া অন্য কোনো রাজকর্মচারীর প্রবেশ নিষেধ। কিছু দরকার পড়লে তুমি বাইরে খাড়াইয়া আওয়াজ দিবা...

বিদুরের পাঠানো লোকটা ঠিক সময়েই আইসা পৌঁছায়। নতুন ঘরে উইঠা কুন্তী পুরোচনরে কিছু কাজ দিয়া বাড়ির বাইরে পাঠাইয়া লোকটারে ভিতরে নিয়া আসে। এই লোকটা প্রাচীন নিয়মে মাটির গুহার ভিতর ঘরবাড়ি বানানোর কাজে ওস্তাদ। কুন্তীর পোলারা তারে জোগালি দেয় আর লোকটা দ্রুত ঘরের মেঝে খুঁড়ে একটা গুপ্ত গুহাঘর বানাইয়া তার সুড়ঙ্গমুখ বাইর কইরা দেয় বাড়ির পিছনে জঙ্গলের ভিতর। দুর্যোধন যদি এই বাড়ি আক্রমণ করে কিংবা শণ-কাঠের ঘরে আগুন ধরাইয়া দেয় তবে কুন্তী তার পাঁচ পোলাসহ নিশ্চিন্তে সুড়ঙ্গ দিয়া পলাইতে পারব জঙ্গলের দিকে...

কুন্তীর পোলারা দিনে শিকার টিকার করে আর রাইতে মাটির নীচে গুহার মধ্যে ঘুমায়। এর মধ্যে কুন্তীর কাছে পাঠানো বিদুরের সংবাদ সুবিধার না। ধৃতরাষ্ট্র তার পোলারেই যুবরাজ করার আয়োজন করতাছেন। তার মানে যুবরাজ হইবার আগেই কুন্তীর পোলাদের সরাইয়া দিতে হইব দুর্যোধনের। বারণাবত থাইকা পোলাগো নিয়া এখন সইরা যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু এমনি পলাইয়া গেলে তাদের খুইজা বাইর করতে দুর্যোধনের বিন্দুমাত্র কষ্ট হওয়ার কথা না। সুতরাং পলাইতে হইব অন্য উপায়ে...

কুন্তী গিয়া পুরোচনরে কয়- জানো তো বাপ। আমাগো লগে আছেন হস্তিনাপুরের যুবরাজ যুধিষ্ঠির। রাজপদে থাকা মানুষের দায়িত্ব হইল মাঝেমধ্যে লোকজনরে আপ্যায়ন করা। আমরা এক বচ্ছর ধইরা এইখানে আছি কিন্তু প্রজাদের একদিনও নিমন্ত্রণ করি নাই; এতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের বদনাম। ...তো বাপ তুমি আশপাশের সবাইরে মহারাজ পাণ্ডর মহিষী কুন্তী আর হস্তিনাপুরের যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের পক্ষ থাইকা আগামীকাল ভোজনের নিমন্ত্রণ কইরা আসো। আর শোনো; সবাই যেন তৃপ্তি ভইরা পান করতে পারে সেইজন্য বেশি বেশি মদও সংগ্রহ করবা সকলের কলসি ভইরা...

পাণ্ডবেরা হরিণ মাইরা আনে। ভীম রান্না করে কুন্তীর লগে। খানাপিনা শুরুর আগে কুন্তী যুধিষ্ঠিররে ডাকে- আমার বয়েসি এক নারী আর তোগো পাঁচ ভাইয়ের মতো দেখতে পাঁচটা জোয়ান পোলারে আলাদা কইরা চিনা রাখবি। এই ছয়জনরে বেশি বেশি খাতির যতœ কইরা মাতাল বানাইবি যাতে বেশি নড়তে চড়তে না পারে। আর পুরোচনরেও মদ গিলাইবি গলা পর্যন্ত...

বনের আশপাশের বহু মানুষ আসে। কিছু ব্রাহ্মণ বাদে বাকিরা কাঠুরে-চাষি আর গোয়ালা পরিবার। সকলেই পেট পুরে মাংস খায় আর গলা পর্যন্ত টানে মদ। কুন্তী নির্বাচিত পাঁচ তরুণ আর এক নারীর কাছে গিয়ে বারে বারে মদ আর মাংস তুলে দেয়- খাও খাও। তুমি দেখতে আমার বড়ো পোলা যুধিষ্ঠিরের মতো। ...তুমি আরেক গেলাস খাও। তোমার শইলডাতো এক্কেবারে ভীমের মতো। তুমি অত কম খাও কেন? আরে বেটা বড়ো শইলে দানাপানি দুইটাই যদি বেশি বেশি না দেও তবে তা টিকব কেমনে? আরে খাও; তুমিতো আমার বইনের মতো। তোমার বইনপুতেরা নিমন্ত্রণ করছে তোমারে। খাও। ...বাড়িতে যাইতে হইব এমন কী কথা? পাণ্ডুরাজার বৌপোলাপান যেখানে থাকে; সেইখানে থাকার অধিকার তোমারও আছে। তুমি থাকো আইজ আমাগো লগে। সকালেই না হয় ধীরেসুস্থে যাবা....

পুরোচনরেও গলা পর্যন্ত খাওয়ায় কুন্তী আর যুধিষ্ঠির। খাওয়া-দাওয়া শেষে বাকিরা বিদায় হইলে মাতাল হইয়া ঝিমায় কুন্তীর বয়সী এক চাষি বৌ আর পাঁচটা জোয়ান মানুষ। দরজার সামনে পুরোচনও ঝিমায়। আশপাশ ভালো কইরা দেখে কুন্তী ভীমেরে ইশারা করে। ভীম একজন একজন কইরা তুইলা আইনা ঘরের মধ্যে শোয়ায়- ঘুমাও ভাই। ঘরের ভিতরে ঘুমাও; বাইরে মশায় কামড়াইতে পারে... তারপর তারা নিশ্চিন্তে ঘুমানোর আয়োজন করতে গেলে এক হেঁচকা টানে ভীম তাদের ঘাড়ের ঘেটি ভাইঙ্গা উপরে কাঁথা টাইনা দেয়। কেউ কোনো শব্দ করে না। শুধু ভীমের হাতে মট মট করে শব্দ হয় একটার পর একটা। মায়ের বয়েসি সেই নারীরেও ভীম নিয়া আসে ঘরে- আইস মাসি। নিশ্চিন্তে ঘুমাও...

পঞ্চ পাণ্ডব ঘুমাইত সারি হইয়া। কুন্তী ঘুমাইত তাদের শিয়রের কাছে। ঠিক সেইমতো পাঁচ মাতাল তরুণ আর চাষি নারীর লাশ সাজাইয়া থুইয়া ভীম গিয়া মট কইরা ভাইঙ্গা দেয় টাল পুরোচনের ঘাড়। তারপর বাকি পাণ্ডবদের মালপত্র গোছানো শেষ হইলে ভীম বড়ির চাইরপাশ ঘুরে লাগাইয়া দেয় মশালের আগুন...

অমাবস্যার রাইতে কুন্তীরে কাঁধে নিয়া গঙ্গার দিকে দৌড়ায় ভীম। তার লগে দৌড়াইতে গিয়া নকুল সহদেব হুমড়ি খাইয়া পড়লে দৌড়াইতে দৌড়াইতেই তাগোরে সে টান দিয়া তোলে। আরো কিছুদূর গিয়া যুধিষ্ঠির আর অর্জুন উস্টা খাইয়া পড়লে থাবা দিয়া ভীম তাদেরও তুইলা নিয়া দৌড়ায় নৌকার দিকে। বিদুরের পাঠানো নৌকা নিয়া একজন মাঝি লুকাইয়া আছে গঙ্গার তীরে...

অন্ধকারে পাল তোলা নৌকায় পোলাগো নিয়া কুন্তী ভাসে পুব দিক বরাবর। পরের সন্ধ্যায় গঙ্গার দক্ষিণ তীরে এক জঙ্গলের কাছে তাদের নামাইয়া দিয়া ফিরা যায় বিদুরের মাঝি। ওইদিকে বারণাবতের লোকজন সকালে আইসা দেখে যেই ঘরে কুন্তী আর তার পাঁচ পোলা ছিল সেইখানে পাঁচটা পুরুষ মাইনসের পোড়া লাশ আর তার পাশে একজন মাইয়া মানুষ। পুরোচনের পোড়া লাশও পইড়া আছে তার ঘরের দাওয়ায়...

হস্তিনাপুরে সংবাদ যায়। ভাতিজাগো মৃত্যুর সংবাদ শুইনা কান্দেন ধৃতরাষ্ট্র মহারাজ। বুক বাইন্ধা করেন শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান- তোগোরে ক্ষমতা দিবার চাই নাই ঠিক; কিন্তু বাপ মরণ তো চাই নাই কারো...

গঙ্গাপাড়ের জঙ্গলের ভিতর দিয়া দক্ষিণ দিকে আউগায় কুন্তী আর তার পোলাপান। কিছু কিছু যায়; তারপর কিছুদিন থামে। তারপর আবার সামনে আগায়। রাস্তাঘাটে ভীম বরাবরের মতো কিছু মারামারিও করে। কিন্তু হঠাৎই একদিন সে অন্যরকম একটা ঘটনা ঘটায়; নিজের পঁচিশ বছর বয়সে কাউরে কিছু না কইয়া সাঁওতাল দুহিতা হিড়িম্বারে ভীম বিবাহ কইরা ফালায়...

এইখানে বোধহয় কিছু তথ্য-তালাশ দিয়া যাওয়া ভালো। কুন্তী যেই বারণাবত থাইকা পলাইয়া আসছে সেইটারে বর্তমান বিহারের বরৌনি শহর কইতে চান ড. অতুল সুর তার ‘মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা’ পুস্তকে। আর বারণাবত থাইকা পূর্বদিকে ভাইসা গিয়া পরের সন্ধ্যায় গঙ্গার দক্ষিণ তীরের যে জঙ্গলে কুন্তী নামছিল সেইটারে তিনি বলেন বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাজমহল কিংবা তার আশপাশ কোনো স্থান। আবার রাজমহল থাইকা দক্ষিণ দিকে যে ঘোর অরণ্যের মধ্য দিয়া কুন্তীরা আগাইতেছিল সেই জায়গাটারে বর্তমান সাঁওতাল পরগনা বইলা তিনি চিহ্নিত করেন...

তাই যদি হয় তবে আমার হিসাবে হিড়িম্বা সাঁওতাল দুহিতাই বটে। সাঁওতাল জাতি নিজেরা কোনোদিন সাঁওতাল কয় না নিজেদের; কয় ‘হড়’ জাতি। আর মহাভারতে আমরা দেখি সেই এলাকার মানুষদের ডাকা হইতাছে হিড়িম্ব-হিড়িম্বা কইয়া। হড়-হিড়িম্ব-হিড়িম্বা কেমন জানি মিল মিল লাগে। তাই মনে হয় হিড়িম্বা-হিড়িম্ব এইগুলা বোধহয় ভীমের বৌ কিংবা হউরের পুতের মূল নাম নয়; জাতির নাম ধইরাই মহাভারতে ডাকা হইছে তাদের যেমন কইরা মাদ্রী আর গান্ধারীরে আগাগোড়া ডাকা হইছে জাতি নাম দিয়া...

তো যাই হোক। ভীম তো ঘটাইয়া ফালাইছে ঘটনা। কুন্তী যখন ঘটনা জানল তখন হিড়িম্বা রীতিমতো গর্ভবতী। এখন কেমনে কী করে? তার পোলা পাঁচটা ঠিক; কিন্তু অবলম্বন একলাই ভীম। কিন্তু বিপদের বিষয় হইল; মায়ের অন্ধভক্ত পোলারা বৌরেও অন্ধভাবে আগলাইয়া রাখে। এরা মা আর বৌ দুইজনরে একলগে সামলাইতে গিয়া একবার এইদিক আরেকবার ওইদিকে যায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনোদিকই আর সামলাইতে পারে না। শেষকালে হয় তারে মা ছাড়তে হয়; না হইলে বৌ তারে ছাইড়া পলায়...

কিন্তু এইটা হইতে দেওয়া যাবে না। ভীম ছাড়া পাণ্ডবেরা অচল। বাকি চাইরজনরে ধৃতরাষ্ট্রের পোলারা পাছা দিয়াও পুছব না লগে যদি ভীম না থাকে। কুন্তীর সংসারও অচল হইয়া পড়ব ভীম যদি ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু পাঁচটা জোয়ান পোলার মইধ্যে একজন বৌ নিয়া মাস্তি করব আর বাকি চাইরজন থাকব ব্রহ্মচারী; এইটাও একটা অস্বাভাবিক বিষয়। দুই মায়ের পাঁচ পোলারে কুন্তী অতদিন এক হাতের পাঁচ আঙুলের মতো একলগে বড়ো করছে; কাউরে বেশি সুবিধা দেয় নাই যাতে অন্য কেউ কম সুবিধার লাইগা মন খারাপ করে। এখন এক মাইয়ার লাইগা কোনোভাবেই পোলাগো সে আলদা হইবার দিতে পারে না...

কুন্তী ভীমের বিবাহ মাইনা লয়। কিন্তু তারে জানাইয়া দেয়- মনে রাখিস তোগোরে গেরস্ত করার লাইগা আমি বনে আসি নাই। আমি বনবাসী হইছি তোদেরকে তোদের পিতার রাজ্য ফিরাইয়া দিবার প্রতিজ্ঞায়। ...বিবাহ করছ ঠিকাছে। কিন্তু আপাতত তোমার বৌরে নিজের লগে রাখতে পারবা না তুমি। আমরা রাজ্য ফিরা পাইলে তোমার লগে সে সংসার করব হস্তিনাপুর গিয়া। তবে যেহেতু তোমার বৌ এখন গর্ভবতী। সেহেতু বাচ্চা জন্মানো পর্যন্ত আমরা এইখানে থাকব; যাতে বাচ্চার মুখ তুমি দেইখা যাইতে পারো...

ভীমের মতোই দেখতে ভীমের একটা পোলা জন্মায়। হিড়িম্বা তার নাম রাখে ঘটোৎকচ। ভীম পোলারে কোলে নিয়া কুন্তীর সামনে খাড়ায়- মা। তোমার পয়লা নাতি...

ভীমের হাত থাইকা নাতিরে কোলে নিয়া কুন্তী হিড়িম্বার দিকে তাকায়- ভীমের বড়ো ভাই এখনো বিয়া করে নাই। কিন্তু তারপরেও আমি ভীমের বিবাহ মাইনা নিছি খালি এই নাতির কথা ভেবে। পাণ্ডব বংশের বড়ো পোলা হিসাবে বাপ-চাচার পরে এই ঘটোৎকচই হইব হস্তিনাপুরের রাজা। কিন্তু ছেলেদের যদি এখনই আমি বনে জঙ্গলে নিজেগো মতো সংসার পাইতা বসতে দেই তবে আর হস্তিনাপুরে রাজা হইবার স্বপ্ন দেখতে হইব না কারো। সেই সাথে তোমার পোলারেও সারাজীবন থাকতে হইব কোনো কাঠুরের পোলা হয়ে। তাই আমার সিদ্ধান্ত শোনো; যদি রাজ্য উদ্ধার হয় তবে যুবরানি হইয়া তুমি হস্তিনাপুর যাইবা পাণ্ডব বংশের জ্যেষ্ঠ পোলারে নিয়া। আপাতত তুমি তোমার বাপের ঘরে থাইকা ঘটারে মানুষ করো...

কুন্তী ঘটোৎকচের কপালে চুমু খায়- বড়ো হইলে হতভাগি দাদির বিপদে তুই সহায় হইস দাদুভাই... যা। মায়ের কাছে থাইকা বড়ো হ...

হিড়িম্বার কোলে ঘটোৎকচরে ফিরাইয়া দিয়া কুন্তী ভীমের দিকে তাকায়- চল বাপ। সামনে আগাই....

২০১২.১১.১০ শনিবার-২০১২. ১১.১৭ শনিবার

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক লীলেন ভাই। খুবই ভালো হচ্ছে।

ফারাসাত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

লালকমল এর ছবি

জাস্ট অসাম !
ছুডোকালের কথা মনে করিয়া দিলেন। তখন শুধু মহাভারতের ভিতরের ছবি দেখে কাহিনী বলে দিতে পারতাম। আমার দাদুর মহাভারত, ভাগবত মুখস্ত ছিল। আর ঘটোৎকচের চেহারা এখনও মনে আছে। বেটার শরীরের নিচে চাপা পরে কয়েক হাজার সৈন্য মারা যায়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চিন্তা নাই
ঘটোৎকচ আরো কয়েকবার আসবে মানবিক চেহারা নিয়ে

০২

মহাভারতের ছবিগুলা আমারও দারুণ লাগে; এখনো মাঝে মাঝে উল্টে দেখি

খেকশিয়াল এর ছবি

চলুক চলুক চলুক
হিহিহি লীলেনদা "জয়"রে তো পুরা ক্যাক কইরা ধরছেন, শেষ না করলে কিন্তু আম্রাঊ ছাড়ুম না।
তবে এইটা সিরিজ শেষ হইলে কৃষ্ণ নিয়া একটা লেখা আপনার কাছে দাবী রাইখা গেলাম।

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দ্বৈপায়ন প্রথম যে পুস্তক লেখেন তার নাম কিন্তু ছিল 'জয়' পরে তা বহু আওয়ামী-বিম্পির হাতে পড়ে হয় মহাভারত...

০২

কৃষ্ণরে নিয়া লিখতে তো লোভ হয়। কিন্তু যেইটা লেখা শুরু করছি সেইটাই সামলাতে পারছি না;
কুন্তীরে নিয়া লিখতে গিয়া দেখি মহাভারতের প্রায় পুরাটাই লিখতে হচ্ছে আমার... আগে এইটা শেষ করি তারপর সাহসে কুলালে একখান কৃষ্ণচরিতে হয়ত রচনা করব

রণদীপম বসু এর ছবি

আলাদা করে কৃষ্ণচরিত রচনা করতে হবে না ! যে সপ্তবুহ্যে ঢুকেছেন, এইখানেই কৃষ্ণরেও সাইজ করতে হইবো ! আপনার জন্যে দুঃখ হইতেছে, মজাও লাগতেছে ! হা হা হা !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

খেকশিয়াল এর ছবি

হ জয়ের ব্যাপারটা জানি। রণদা ঠিকই কইসে, এইখানেই কৃষ্ণের যে রাজনীতি নিয়া আপনারে দৌড়ঝাপ করতে হবে তার লেইগা আগাম শুভকামনা দেঁতো হাসি

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

রণদার কথা অবশ্য ঠিক। কৃষ্ণের কালি না মাইখা কিংবা কৃষ্ণরে কালি না মাখাইয়া মহাভারত নিয়া কেমনে লিখি

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

দ্বৈপায়ন প্রথম যে পুস্তক লেখেন তার নাম কিন্তু ছিল 'জয়' পরে তা বহু আওয়ামী-বিম্পির হাতে পড়ে হয় মহাভারত

হো হো হো

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

সত্যপীর এর ছবি

বাপরে কি দারুণ লেখা! পাঁচতারা দিয়া কুলানো যাইব নাহ।

"যুধিষ্ঠিরের একটা বড়ো গুণ হইল ভয় দেখাইলে সে ভয় পায়।"
হো হো হো গড়াগড়ি দিয়া হাসি

..................................................................
#Banshibir.

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। ভয় দেখাইলে যে ভয় পায় না সে বড়োজোর ভীম হইতে পারে; কিন্তু রাজা হইব কেমনে?

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাসুরের ভাত খাইতে আসে নাই কুন্তী হস্তিনাপুর; যদিও আগে যিনি আছিলেন পাণ্ডুর পোষ্য তার পোষ্য এখন পাণ্ডরাজার বৌ পোলাপান; বনবাসের আগে যিনি আছিলেন নিঃসন্তান আন্ধা মানুষ তিনি এখন শতপোলার অংহকারী বাপ ধৃতরাষ্ট্র মহারাজ...

#শুরুটাতেই মনযোগ আটকে ফেলছেন, বিশেষভাবে যে ল্যাঙ্গোয়েজে বর্ণনা চলছে সেটা একদম দুর্ধর্ষ গুল্লি

#প্রতিটি প্যারার সূচনা লাইনগুলিও দারুন তবে কুন্তী নির্বাচিত পাঁচ তরুণ আর এক নারীর কাছে গিয়ে বারে বারে মদ আর মাংস তুলে দেয়- খাও খাও। তুমি দেখতে আমার বড়ো পোলা যুধিষ্ঠিরের মতো। ...তুমি আরেক গেলাস খাও। তোমার শইলডাতো এক্কেবারে ভীমের মতো। তুমি অত কম খাও কেন? আরে বেটা বড়ো শইলে দানাপানি দুইটাই যদি বেশি বেশি না দেও তবে তা টিকব কেমনে? আরে খাও; এ অংশটুকুর বর্ণনা পড়ে খাওয়ার ইচ্ছেটা একদম জেগে গেল। হাসি

#প্রতিটি অংশ পড়ারসময়ই মনে হচ্ছিল এই বুঝি খটমট কোন শব্দের মোকাবেলা করলাম, তবে প্রতিটি প্যারা পড়ার সাথে সাথে হাসি আটকাতে পারিনি, এক কথায়দারুন উত্তম জাঝা!

আশরাফুল কবীর

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

লেখাটায় গতিময়তা বেশি। এটা পড়ার আগে মহাভারত সম্পর্কে কিছু জ্ঞান থাকা জরুরী মনে হচ্ছে। তা না হলে কে যে কার কে এটা গুলিয়ে যায় হাসি
সাহস করে বলেই ফেলি। এটা যখন লিখছেনই তখন খুব সংক্ষেপে মহাভারত নিয়ে একটা লেখা তৈরি করবেন?
স্রেফ যারা কম জানি বা একবারেই জানিনা তাদের জন্য খাইছে

খেকশিয়াল এর ছবি

ক্যান, উপেন্দ্রকিশোরের 'ছেলেদের মহাভারত'টা পইড়া ফালান, নাম দেইখা হিংসা কইরেন না, মেয়েরাউ পড়তে পারবেন খাইছে

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। ছেলেদের মহাভারত মেয়েরাও পড়তে পারে- বুড়ারাও পারে... কোনো অসুবিধা নাই

০২

তবে আমি যেভাবে লিখছি সেভাবে মহাভারতের গল্পগুলারে সাজাতে গেলে আমার কাজকর্ম ছেড়ে না খেয়ে মরতে হবে... দেখি; কিছু একটা আগে হোক; তারপরে বাকিটা ভাবার সুযোগ হয় কি না দেখি

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

জনাব মাহবুব লীলেন, বিস্তারিত লিখেন। ভুলে যাওয়া অনেক কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। আর রণদীপম বসুর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, বিস্তারিত কথনে কৃষ্ণও ঘুরে ফিরে আসবে। চলুক
ভাল থাকুন। আনন্দে থাকুন।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আপনি মাঝে মাঝে কিছু সূত্রটুত্র ধরিয়ে দিয়েন স্যার। এ বিষয়ে আপনার জানাশোনাগুলোও একটু যোগ কইরেন

অতিথি লেখক এর ছবি

হিড়িম্ব হিড়িম্বার সাঁওতাল জাতিভূক্ত হওয়ার ষোলআনা সম্ভাবনাই আছে, মহাভারতের সংশ্লিষ্ট অংশগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই তা বোঝা যায়। কিন্তু ভীম তো মা-ভাইয়ের পুনঃ পুন অনুরোধেই তারে বিয়া করছে। ঘটনার অলৌকিকত্ব বর্জন করলে তার যে রুপ দাঁড়ায় তাতে মনে হয় সবার অজান্তে হিরিম্বার সাথে ভীম একটা লটরপটর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ভাই হিড়িম্ব সেটা মেনে নিতে পারে নাই, সে কারনে তার ভীমের সাথে সংঘাত এবং মৃত্যু। পরে হিড়িম্বার কাতর বাক্যে কুন্তি এবং ভ্রাতৃসকলের হৃদয় বিগলিত, বিশেষতঃ মাইয়া ইতোমধ্যেই অন্তঃসত্বা। অন্তঃসত্বা, কারন অতি সত্বর হিড়িম্বা কতৃক সন্তান প্রসব।
ছেলেবেলায় মাসুদরানার এক ভারতীয় চরিত্রের নাম ঘটোৎকচ পড়ে হাসতে হাসতে শেষ, নির্বোধের হাসি। আসলে ভীম ও হিড়িম্বার পুত্র ঘটোৎকচের উৎকচ অর্থাৎ চুল ছিল খাড়া খাড়া, চিরুনী দিয়া আচরাইলেও সোজা না হইয়া ঘটের ন্যায় দাঁড়াইয়া থাকিত। সেটা দেখে ভীম তার নাম রাখলো ঘটোৎকচ!
বরাবরের মতই মজাদার উপস্থাপন, চলুক

আব্দুল্লাহ এ.এম.

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ ঠিকৈ কইছেন। তয় কাহিনীটা তো কুন্তীর তাই ভীমের ক্যারিকেচারে বেশি যাইতাছি না

০২

ঘটোৎকচের পোলার নাম কিন্তু অঞ্জনপর্বা; ঘটামটা না... সে কিন্তু আবার বীরভূম এলাকার রাজা আছিল

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

খামাখা অতো কষ্টমষ্ট করে ইয়া মোটা মহাভারত পড়সিলাম!
তারচেয়ে এই লেখাগুলা মনে রাখা অনেক সহজ মনে হচ্ছে।
আপনি আসলেই একটা জিনিয়াস! হাসি

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মহাভারতের মোটা কাহিনীর জন্য ওই মোটা বই পড়া ছাড়া কিন্তু বিকল্প নাই
আমি খালি সেখান থেকে কয়েক চামচ তুলে এনে নতুন চায়ের কাপে নাড়াচাড়া করছি
এইটারে মহাভারতের অনুলিখন ভাবলে মুশকিল হইব

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অনুলিখন না ভাবলাম।
কিন্তু ইম্পর্ট্যান্ট ক্যারেকটার বা ঘটনাগুলো তো চামচে করে তুলে আনবেন!
ইনাফ।

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

তাও না
আমি খালি মহাভারতের তিন ‌'সুলতানা' সত্যবতী কুন্তী আর দ্রৌপদীরে নিয়াই একটু নাড়াচাড়া করতে আছি;
বাকি সুলতান আর গোলামগুর্বাদের জান্তে হইলে মোটা বইয়ের পাতাই উল্টাইতে হইব

পুতুল এর ছবি

বাকি সুলতান আর গোলামগুর্বাদের জান্তে হইলে মোটা বইয়ের পাতাই উল্টাইতে হইব

কন কী!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

রেগে টং

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

কৌস্তুভ এর ছবি

এ তো পুরোই ব্লাসফেমি! অ্যাঁ

ফাইয়াজ জামাল এর ছবি

যতদুর পড়েছিলাম, ওই ঘর তৈরির সময় দুর্যোধনের বুদ্ধিতে দাহ্য পদার্থের ব্যবহার করা হয়েছিল, আর দুর্যোধনের লোকজনই ঘরে আগুন লাগায়, কিন্তু বিদুরের কাছ থেকে প্রাপ্ত পূর্বসতর্কতা পান্ডবদের বাঁচিয়ে দেয়। কিন্তু আপনার লেখায় মনে হলো এই আগুন লাগানো পান্ডবদেরই একটি চাল, আর নিরীহ ৬ জন মানুষকে মরতে হয়েছিল কুন্তির বুদ্ধিতে। এই interpretetion, যা আসলে আরো যৌক্তিক, কি আপনার নিজস্ব ?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

না স্যার
মহাভারতের কোনো ভার্সনেই পাইনি যে দুর্যোধন ওটা পুড়িয়েছে বা পোড়াতে চেয়েছে
সবখানেই আছে কুন্তীর নির্দেশে যুধিষ্ঠির পাঁচ ছেলেসহ এক কৃষক বৌকে নির্বাচিত করে আর ভীম আগুন লাগায়
আগুন লাগানোর আগে পুরোচনের হাত বাধেঁ

০২

পুরোচোনকে সব জায়গায় দুরাত্মা মুরাত্মা বলা হলেও কোথাও কিন্তু তার দূরাত্মাগিরির কোনো প্রমাণ নেই
তাকে বলা হয় দুর্যোধনের চ্যালা। সে নাকি অস্ত্র সংগ্রহ করছিল
কিন্তু টানা এক বছর সে পাণ্ডবদের সেবা করে। কোথাও কোনো ঝামেলা নেই
সে পোড়াতে চাইলে এক বছর অপেক্ষা করার দরকার ছিল না
বারণাবতে বাসের পুরোটাই যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের ভয়ে কুকড়ে থাকত... এরকম শত শত কথা আছে
শেষ পর্যন্ত তারা গর্তে ঢুকে ঘুমায় তাও দুর্যোধনের ঘরেই....

আমার মনে হয় পুরোচোন অতি সাধারণ এক কর্মচারি ছিল; মারা গেছে নিরীহ হিসাবেই; অন্য ছয়জনের মতো

০৩

ঘর নির্মাণে মম এবং চর্বির ব্যবহার সম্ভবত সেইসময় অভিজাত বাড়িঘর নির্মাণের অংশই ছিল
দুটো কারণে হতে পারে (১) কাটের বেড়ার ফাঁকা বন্ধ করা; যাতে বর্ষায় পানি ঢুকতে পারে না এবং শীতে ঢুকতে পারে না বাতাস আর (২) কাঁচা কাঠ দেয় বাড়িঘর বানাবার পর রোদে শুকিয়ে কাঠগুলো যাতে ফেটে না যায় তার জন্য ইলাস্টিসিটি তৈরির উদ্দেশ্যে....

ঘরটার চাল ছিল শণের। বেড়া ছিল কাঠের সুতরাং এমন ঘর পোড়ানোর জন্য আলাদা দাহ্য কিছু লাগে না। ওইটা বাড়ির নির্মাণ শৈলির অংশই ছিল

০৪

মহাভারত অনুযায়ীই জতুগৃহ পোড়ানোর কুন্তীর পরিকল্পিত কাজ। বিদুরের সাথে আলোচান করেই সে করেছে; বারণাতবত থেকে পালিয়ে যাবার জন্য গঙ্গায় তাদের জন্য নৌকা পাঠিয়েছে বিদুর

অতিথি লেখক এর ছবি

মাহবুব ভাই,
কাশীরাম দাসের মহাভারত অনুযায়ী জতুগৃহ নির্মানের এবং সে গৃহে কুন্তি সহ পঞ্চপান্ডবকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা দুর্য্যোধনের। দু্র্য্যোধনই গোপনে পুরোচনকে অনুরুপ একটা ঘর নির্মানের দায়িত্ব দেয় এবং সময়মত পুড়িয়ে মারতে নির্দেশ দেয়।

দু্র্য্যোধন পুরোচনকে বলছে-

উত্তম করিয়া স্থল করিয়া আলয়
অগ্নিগৃহ বিরচিবে ব্যক্ত নাহি হয়
স্তম্ভ বিরচিয়া তাহে পুরাইবে ঘৃতে
স্বর্ণ নিয়োজিয়া গৃহ করিবে তাহাতে
................................................
জতুগৃহে কদাচিত নহিবেক ত্রান
অস্ত্রগৃহে অস্ত্রবাজি হারাইবে প্রান
......................................
সময় বুঝিয়া অগ্নি দিবে সে আলয়ে
...................................
এই মহাভারতে পুরোচনকে দু্র্য্যোধনের একান্ত বিশ্বাসী একজন যবন মন্ত্রী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

আব্দুল্লাহ এ.এম.

মাহবুব লীলেন এর ছবি


বর্ণনাখান ওইরকমই আছে কিন্তু পুরোচনের কোনো উদ্যোগ দেখি নাই এক বছর ধইরা
বিদুরই কুন্তীরে একটা সংবাদ পাঠায়- অমুক অমাবস্যায় পুরোচন ঠিক করছে ঘরে আগুন দিবার...
তারপর ঘটনা ঘটে

পুরোচনের মনে যদি আগুনই দিবার ইচ্ছা থাকত তবে এক বছর দেরি করা কেন?
আর আগুন দিয়া পুড়াইয়া মারার লাইগা অস্ত্র সংগ্রহই বা কেন?

হিসাব মিলে না

০২

আমার মনে হয় কুন্তী আর পাচ পাণ্ডবের এই কাজ জায়েজ করার লাইগা পাব্লিকে পুরোচনরে দুর্যোধনের লগে পেচাইছে... এ ছাড়া অন্য কিছু না; কারণ তার এক বছর ধইরা তার কাজকর্ম বড়োই নিরীহ...

দুর্দান্ত এর ছবি

মাইকেল উড বলতে চায় যে কুশান কনিষ্ক হইল গিয়া কংসরাজা। এতে সমস্যা হইল, মহাভারতের হরিবংশ অধ্যায় বয়েসে মহাভারতের চাইতে কয়েক শতাব্দি কনিষ্ঠ হইয়া পড়ে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এইরকম আরো ঝামেলা আছে স্যার....
এইদিকে দেখা যায় ভীমের ছেলে ঘটা হলো বীরভূমের মানুষ; তার ছেলে অঞ্জনপর্বা ওখানকার রাজা
কিন্তু
ঘটার আরেক ছেলের নাম 'বারবারিকা' যিনি আবার রাজস্থানে 'খাতুস্বামীজি' নামে পরিচিত... কেমনে কী?

০২

ইউরোপিয় কানে ভারতীয় নামগুলোর উচ্চারণ শুনে অনেকেই গুলিয়ে ফেলে বলে আমার মনে হয়
কিন্তু কংস আর কুশান এক না; ভারতে দুইটা নামই কিন্তু আলাদা আলাদা রাখা হয

০৩

আর বয়স হিসাব বড়োই মুশকিলের বিষয়
মহাভাতের ঘটনাগুরোর সন তারিখ নিয়ে কাজ করেছেন দুজন প্রাচীন গনিতবিদ; আর্যভট্ট আর বরাহমিহির;
বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা আমার আছে; কিন্তু পড়ে বুঝতে গেলে বেশ কষ্ট করতে হয়; তার উপর সন তারিখ লিখা কল্যাব্দে; সবগুলা কনভার্ট করার চেষ্টা করছি খৃষ্টাব্দে
কিন্তু সবগুলোর সিরিয়াল সাজানো সম্ভব হবে বলে মনে হয় না

০২

মনে হয় মহাভরতের চরিত্রগুলোর নাম দিয়ে আগে ভাষাতাত্ত্বিক কোনো গবেষণা হওয়া দরকার
তাতে এদের অঞ্চলগুলো পাওয়া যাবে; এবং তখন হয়তো অন্যকিছু খুজে বের করা যাবে
নাম দেখে কোনোভাবেই মনে হয় না এরা এক এলাকার মানুষ

কীর্তিনাশা এর ছবি

গত রাতে এই লেখাটা পড়ে ঘুমাইতে গেলাম। তারপর সারাটা রাত আপনে ব্ল‌্যাকবোর্ডের সামনে খাড়ায়া, ডাস্টার আর চক হাতে মহাভারতের বিভিন্ন চরিত্রের উপর লেকচার দিলেন। আমিও শুনলাম মন দিয়া। আহা, এরাম ঘটনা যদি সত্যি সত্যিই ঘটতো !!

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

শান্ত শান এর ছবি

ভাই কিছু বলার নাই। এই মহাভারত যদি সবটা লিখতে পারেন তাহলে স্বর্গ আপনার নিশ্চিত। দেখেন কোন ভাবে যদি লিখতে পারেন। আর আপনার লিখা মহাভারত পড়ে যদি আমরাও একটূ স্বগ দর্শন করতে পারি।

বটতলার উকিল এর ছবি

দ্বারকায় রাজাহীন এবং অভিজাতদের রাজ্য পরিচালনা দেখেই কি সুশীলদের দিয়ে তত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা আমদানি করা হয়েছিল?

বটতলার উকিল ৷

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।