মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ৩]

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: শুক্র, ৩০/১১/২০১২ - ৯:৩৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তার পোলা যদি তার পোলার মায়ায় আটকাইয়া যায় তবে সবকিছু ভেসে যাবে তার। তাই ভীমেরে সংসারছাড়া কইরা কুন্তী পলায়। কই যাইব কোথায় যাইব কিছু ভাবে নাই; বিদুরের লগেও যোগাযোগ বন্ধ বহুদিন... কিন্তু কোনো একজন মানুষের পরামর্শ এখন দরকার তার। আর এই জঙ্গলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ছাড়া কোনো বান্ধব নাই কুন্তীর...

বন বদলাইয়া কুন্তী গিয়া হাজির হয় শ্বশুর দ্বৈপায়নরে ডেরায়- পিতা। বড়োবেশি বেচইন আছি সবকিছু নিয়া...

সবকিছু শুইনা দ্বৈপায়ন চোখ পিটপিট করেন- বনে বাদাড়ে ঘুইরা কেমনে তুমি রাজ্য উদ্ধার করবা? রাজ্য উদ্ধারের লাইগা কোনো না কোনো রাজ্যের কাছেই থাকতে হইব তোমার। ...আহো আমার লগে...

কুন্তী আর তার পোলাদের ব্রাহ্মণের বেশ দিয়া কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন নিজে নিয়া রাইখা আসেন একচক্রা নগরে তার এক শিষ্য ব্রাহ্মণের ঘরে- তোরা এইখানে থাইকা চেষ্টা কর পাশের দেশ পাঞ্চালের লগে মিত্রতা করার...

জটাজুটধারী ব্রাহ্মণ সাইজা একচক্রায় কুন্তীর পোলারা পাঞ্চালের সংবাদ দুঃসংবাদে কান খাড়া কইরা দশগ্রামে ভিক্ষা মাইগা খায় এবং একটা উপযুক্ত দিনে সংবাদ পায় যে পাঞ্চাল রাজা ঘোষণা দিছেন তার মাইয়া দ্রৌপদীর বিবাহ হইব স্বয়ংবরা দিয়া...

নিজের পোলার লগে দ্রুপদের মাইয়ার বিবাহ; দ্রুপদের লগে খাতির জমানোর লাইগা এর থেকে সহজ পন্থা আর কী হইতে পারে? এর মইধ্যে আরোও সুখের সংবাদ হইল; দ্রুপদকন্যার স্বয়ংবরা নাকি হইব তীর ধনুকের প্রতিযোগিতা দিয়া; তাও আবার গাণ্ডিব ধনু; যা গন্ডারের পঞ্জরের হাড় দিয়া তৈয়ার হয় বইলা এই নাম। এই ধনু দিয়া তীর মারা তো দূরের কথা; গন্ডারের হাড্ডি নুয়াইয়া এই ধনুতে গুণ পরাইতে গেলেই বেশিরভাগ পাব্লিকের নাকের বাতাস শইলের তল দিয়া সশব্দে নির্গত হয় কিন্তু দ্রোণের শিষ্য অর্জুন আবার এই গাণ্ডিবে মহা ধনুর্ধর। ধইরা নেওয়া যায় তার জিতার সম্ভাবনা পুরাটাই আছে...

কিন্তু কুন্তীর সংকট তো সেইখানে না। হিড়িম্বার বেলায় সে যা করছে তা যদি দ্রুপদের মাইয়ার লগেও করে; মানে বিবাহের পর মাইয়ারে যদি বাপের বাড়িতেই থুইয়া আসা লাগে তাইলে তো আর সম্পর্কের উন্নতি হইল না দ্রুপদের লগে। আর যদি মাইয়ারে ঘরে আইনা অর্জুনের লগে সংসার করতে দেয় তবে তো আবারও সেই পুরান ঝামেলা; একপোলা সংসারী- বাকিরা বিরান... শুধু তাই না; অর্জুনরে সংসার করতে দিলে ভীম যদি খেইপা গিয়া আবার নিজের বৌপোলারে নিজের কাছে নিয়া আসে তখন?...

তখন তো বাকি পোলাগোরে বিয়াশাদি করাইয়া কুন্তীর নাতিপুতি নিয়া বনবাসে সংসার করা ছাড়া আর বিকল্প থাকব না কোনো...

এইটা হইতে পারে না; কুন্তী এইখানে পোলাদের সংসার করাইতে নিয়া আসে নাই। কুন্তীর অন্য কোনো বুদ্ধিমান সমাধান চাই যা একমাত্র শ্বশুর দ্বৈপায়নই পারেন দিতে...

বিস্তারিত সংকট বুইঝা দ্বৈপায়ন কুন্তীরে অভয় দেন- তুমি খালি মাইয়াডারে ঘরে আনার ব্যবস্থা করো; বাকিটা দেখব নে আমি... আমি তোমার পাঁচ পোলারেই এক মাইয়ার লগে বিবাহ দিমু। তখন কাউরে যেমন ব্রহ্মচারী হইতে হইব না আবার কেউই সুযোগ পাইব না বৌ নিয়া মইজা থাকার। দুই মায়ের পাঁচ পোলা এক বৌয়ের পাঁচ স্বামী হইলে আরো কাছাকাছি আইসা পৌছাইব নিজেদের...

শ্বশুরের বিধান কুন্তীর পছন্দ হইলেও সে ছটফট করে- অব্বাজান। বোঝেনই তো; আপাতত জঙ্গলে থাকলেও পোলাবৌ আর পোলাদের নিয়া আমার সমাজে ফিরতে হইব। পাঁচ পোলার ঘরে এক বৌ তোলার লাইগা সমাজে একটা কঠিন ধর্মব্যাখ্যা লাগব আমার। ...আপনি যা কইলেন; যদি তার পক্ষে আমারে একটা ধর্মের কাহিনী রচনা কইরা শোনান তাইলে বুকে বল পাই...

কুন্তীর মুখে দুশ্চিন্তা দেইখা কালা মুখে হলুদ দাঁত খুইলা হাসেন দ্বৈপায়ন- ধর্ম কাহিনী কোনো বিষয় হইল? মাইয়ার জন্ম কাহিনী আমি পাল্টাইয়া দিমু। কইয়া দিমু পূর্বজন্মে শিব তারে বর দিছেন পঞ্চস্বামীর। আর শিব একবার যে বর দিছেন সেইখানে সমাজ তো নস্যি; স্বয়ং শিবেরও শক্তি নাই সেই বর ফিরাইয়া নেওয়ার...

কথাখান ঠিক। শিব কারে কী বর দিছেন না দিছেন সেইটা তো দ্বৈপায়ন থাইকা অন্য কেউ বেশি জানে না। কারণ শিব পুরাণখান তো তিনিই লিখছেন। কিন্তু দ্বৈপায়নের মুখে শিবের বন্দনা শুনলে কুন্তীর হাসি পায়। একসময় বিষ্ণুভক্ত এই দ্বৈপায়নের কামই ছিল নেংটুভেংটু জংলি বইলা শিবেরে গালাগালি দেওয়া। তার কথায় বহু শিবভক্ত হর ছাইড়া হরির ভক্ত হইছে। কারণ এতবড়ো ঋষি; তার লগে তর্ক করার সাহস যেমন কারো নাই তেমনি তার কথা ফালাইয়া দিবার সাধ্যও কারো নাই। কিন্তু একদিন এক পুঁচকা ঋষি শৌনিক তারে কয়- আপনি যদি বারাণসী গিয়াও শিবের নিন্দা করতে পারেন তয় আমিও আপনের লগে হরিভক্ত হমু...
- বারাণসী আবার কোন ছার? লও যাই। তোমার কাশীতীর্থে গিয়াই শিবেরে এক হাত লই...

কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের চুলদাড়ি পায়ের পাতা পর্যন্ত লম্বা আছিল সেইটা তো সকলেই জানে। কিন্তু তার নাপিতবিহীন জীবনে বগলের লোমও নাকি বাড়তে বাড়তে আইসা পৌছাইছিল হাঁটু পর্যন্ত। ...তো তিনি চুল দাড়ি বগলের লোম ঝাঁকাইয়া দলবল পুথিপুস্তক নিয়া বারাণসীর কাশীতীর্থে আইসাও হুংকার দেন- আসো আসো। নেংটুভেংটু তাড়িখোর জংলি শিবেরে ছাইড়া আসো সুশীল বিষ্ণুর কোলে...

বারাণসী হইল শিবভক্ত নন্দী বংশের বাস। দ্বৈপায়ন ভাবছিলেন বোধহয় শৌনিকের মতো কোনো চ্যাংড়া ঋষি আইসা তার লগে শিবের গুণ গাইয়া তক্কমক্ত করব। কিন্তু নন্দী কোনো তর্কেমর্কে নাই। শিবনিন্দা শুইনা হর হর মহাদেব কইয়া কিলাইতে কিলাইতে তারা দ্বৈপায়নরে শুয়াইয়া ফালায়। তারপর তার দুই বগলের লোম দিয়া একটা গাছের লগে বাইন্ধা থুয় তারে...

এতো বড়ো ঋষি; যার অলৌকিক ক্ষমতারও অভাব নাই; সেই দ্বৈপায়নরে এমন প্যাদানি খাইতে দেইখা চ্যালা চামুণ্ডারা যে যেদিকে পারে পালায় আর খানিক দুরে খাড়াইয়া শৌনিক কয়- হর হর মহাদেব...

দ্বৈপায়ন কান্দেন। নারায়ন নারায়ন ডাইকা দাড়ি ভিজাইয়া কান্দে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন- এমন বিপদের দিনে তুমি ছাড়া মোর কেউ নাই নারায়ণ...

দ্বৈপায়নের কান্দন শুইনা নাকি স্বয়ং বিষ্ণু হাজির হইছিল সেদিন। কিন্তু আইসা তিনি কইয়া গেছেন নন্দীর বান্ধন খুইলা দিবার ক্ষেমতা তার নাই। তার মুক্তির একমাত্র উপায় হইল শিবের গীত গাওয়া...

কী আর করেন দ্বৈপায়ন। যে শিবেরে তিনি অত গালাগালি দিছেন; এখন চিপায় পইড়া চোখ বন্ধ কইরা সেই দ্বৈপায়নই শুরু করেন শিব পুরাণের শোলোক রচনা- সকল দেবতার যে দেব; তারে কয় মহাদেব; বুড়াশিব আদি অধীশ্বর...

সেই থাইকা দ্বৈপায়নের কাম হইল শিবের গীত গাওয়া আর শিবেরে নিয়া কাব্য করা। যদিও নন্দীর উপরে ঝাল মিটাইতে গিয়া শিব পুরাণে তিনি লেইখা থুইছেন- নন্দী কোনো মাইনসের জাত না; ওইটা একটা গরু...

গরু হোক আর যাই হোক। কিলাইয়া গুতাইয়া তো হরিভক্ত দ্বৈপায়নরে হরভক্ত বানাইছিল সে। আর এই দ্বৈপায়নের কৃপায় শিবের ভক্ত এখন বেশিরভাগ মানুষ। তিনি যদি শিবের নাম ধইরা একখান কাহিনী রচেন তো দ্রৌপদীর বাপেরও সাধ্য নাই কুন্তীরে ঠেকায়। কিন্তু তার কথার মইধ্যে একখান যদি রাইখা দিছেন তিনি- যদি তুমি মাইয়ারে নিজের ঘরে আনবার পারো...

দ্রুপদের মাইয়ারে আনতে হইলে তার দেশের আরো কাছাকাছি যাওয়া লাগে তাই ব্রাহ্মণবেশী পাঁচ পোলারে নিয়া একদিন এক রাত্রি হাইটা কুন্তী আইসা পৌঁছায় দ্রোণাচার্যের দখল কইরা নেওয়া দক্ষিণ পাঞ্চালের অহিচ্ছত্র দেশে। ...কুরু-পাণ্ডবের শিক্ষা শেষে দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা হিসাবে শিষ্যদের কাছে আব্দার করছিলেন দ্রুপদরে ধইরা আনার। গুরুদক্ষিণা মিটাইবার লাইগা কুরুপাণ্ডব মিলা হঠাৎ আক্রমণ কইরা সেদিন জেন্দা দ্রুপদরে ধইরা নিয়া দ্রোণের কাছে দেয়। ভরদ্বাজ মুনির পোলা দ্রোণ নাকি নির্লোভ মানুষ। তবুও তিনি দ্রুপদরে ছাইড়া দেওয়ার বিনিময়ে সেদিন মুক্তিপণ হিসাবে রাইখা দেন দ্রুপদের রাজ্যের অর্ধেক। সেই থাইকা গঙ্গার দক্ষিণে চর্মন্বতী নদী পর্যন্ত অংশটা গেছে দ্রুপদের অধীন; যা বর্তমানের ভাগলপুর জেলার আশেপাশে কোথাও হইলেও হইতে পারে...

স্বয়ংবরার ষোলোদিন আগে দক্ষিণ পাঞ্চালে আইসাও তারা ভিক্ষাটিক্কা করে আর সংবাদ সংগ্রহ করে- প্রতিযোগিতায় কারা কারা আছে আর আসার সম্ভাবনা আছে কার...

ধৃতের পোলা দুর্যোধন আসব ভাইবেরাদর নিয়া। অসুবিধা নাই। গদার লড়াই হইলে তারে ভয় পাওয়া লাগত কিন্তু তীর ধনুকে তারে পাত্তা দিবার কিছু নাই। আর ধৃতের বাকি পোলারা স্বয়ংবরা সভায় দর্শকের সংখ্যা বাড়ান ছাড়া করতে পারব না কিছুই; সুতরাং ওইগুলাও বাদ...

দ্রোণের পোলা অশ্বত্থামাও আসছে। খড়গ চালানোয় সে কঠিন মানুষ হইলেও তীর ধনুকে সে অর্জুন থাইকা কম। আর দ্রুপদের মাইয়া নিশ্চয়ই মালা ঝুলাইতে যাইবা না শত্র“পোলার গলায়। সুতরাং এইটাও বাদ...

কিছু বুড়াধুড়া আর বিয়াইত্যা রাজা আছে। তাদের পয়সাপাতি আর বীরত্ব দুইটাই বেশি কিন্তু মনে হয় না বুইড়া রাজার আঠারো নম্বর বিবি হইতে রাজি হইব দ্রুপদের মেয়ে; যদিও এর মাঝে দুয়েকজন তীর ধনুকে অর্জুনরেও কাবু কইরা ফালাইতে পারে...

রাজপুত্র না হইলেও তার দুই ভাতিজা কৃষ্ণ আর বলরাম নাম লেখাইছে রাজকন্যার স্বয়ংবরায়। ...বলরামরে নিয়া চিন্তার কিছু নাই। কৃষ্ণরে নিয়া তীর ধনুকে চিন্তার বেশি কিছু না থাকলেও বিষয় হইল; প্রতিযোগিতায় যখন আইসাই পড়ছে তখন সে খালি হাতে যাইবার মানুষ না...। হাইরা গেলে দ্রুপদের মাইয়া সে কাইড়াও নিয়া যেতে পারে...

রাজকার্যে দূতিয়ালির লাইগা একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিত লাগে। নিজেরা ফকির সাইজা থাকলেও পাঞ্চালে আসার পথে পাণ্ডবেরা উৎকোচক তীর্থ থাইকা ধৌম্যরে নিজেদের পুরোহিত বানাইয়া আনছে লগে। কুন্তী গিয়া ধৌম্যরে কয়- তোমারে এইখানে কেউ চিনে না। এইখানে তোমার পয়লা কাজ হইল কৃষ্ণ আর বলাইরে গিয়া কওয়া যে তাগো বাপের বইন কুন্তীপিসি পোলাগো নিয়া পলাইয়া আছে পাঞ্চাল দেশে। আর এইটাও জানাইয়া দিবা যে তাগোর ছোট ভাই অর্জুন দ্রৌপদীরে পাইতে চায়। আর যেহেতু ওরা দুইজন আগেই বিয়াশাদি করছে একাধিকবার আর ছুডুভাই এখনো একটাও করে নাই। তাই পিসি তাদের কোনো ঝামেলা করতে নিষেধ করছে স্বয়ংবরা সভায়। ...আর শোনো। ওগোরে ভালো কইরা বুঝাইয়া আসবা দ্রুপদের সভায় পাণ্ডবগো দেখলে যেন তারা কোনো সাড়াশব্দ না করে। কারণ ছদ্মবেশ ধইরাই অর্জুন তার ভাইয়েগো লগে স্বয়ংবরায় যাবে। ...আর দুই ভাতিজারে কইবা যেন কাজকর্ম শেষে তারা অবশ্যই পিসির লগে দেখা কইরা যায়; তাগো লগে বহুত কথা আছে কুন্তী পিসির...

ধৌম্যরে কৃষ্ণের কাছে পাঠাইয়া মোটামুটি নিশ্চিন্ত হইলেও একজনের বিষয়ে দুশ্চিন্তায় কুন্তী ছটফট করে। কুন্তীর সংবাদ পাইলে কৃষ্ণ হয়ত ঝামেলা নাও করতে পারে। বাকিদের বেশিরভাগই প্রতিযোগিতায় টিকব না। কাউরে কাউরে দ্রুপদই খেদাইয়া দিব। বুড়াধুড়াগুলারে দ্রৌপদী মালা দিবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু তার পরেও বাকি থাইকা যায় একজন; যারে দ্রুপদের না আছে খেদানোর কোনো কারণ; না আছে দ্রৌপদীর অপছন্দ করার কোনো কারণ; না আছে তার প্রতিযোগিতায় হাইরা যাওয়ার কোনো কারণ। সে কর্ণ। কুন্তীর প্রথম সন্তান...

কুন্তীর কষ্টের জায়গাটা এখানেই। ধৃতের পোলাদের লগে লড়াই করতে গিয়া বারবারই তার নিজের পোলাদের মুখোমুখি হইতে হয় নিজের অন্য এক পোলার... এখন কী করে কুন্তী? হস্তিনাপুরে পাণ্ডবগণের অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শনীর দিন কৃপাচার্যরে সাহায্যে সে আটকাইতে পারছিল অর্জুন কর্ণের যুদ্ধ- কোনো ছোটলোকের পোলার লগে লড়াই করে না অর্জুন... কৃপের এই কথায় লড়াই থাইকা ঠিকই বাদ পড়ছিল কর্ণ... কিন্তু সকলে যেখানে ভাবছিল ছোটলোকের পোলা হইবার লজ্জায় মাটির সাথে মিশা যাইব কর্ণ; সেইখানে ঘটল তার উল্টা ঘটনা। কম্পিটিশন থাইকা বাদ পড়ার পর সকলের সামনে কর্ণ তার পালকপিতা অধিরথের পায়ে প্রণাম কইরা উইঠা খাড়াইল মাথা উঁচা কইরা। যেন কইতে চায়- রাজকুলনারী কুন্তী নয়; নমশূদ্র অধিরথ আর রাধার সন্তান হিসাবেই গর্বিত আমি... এমন অহংকার শুধু দুর্বাসার রক্তেই মানায়...

তবে কি কুন্তী কর্ণের কাছে ধৌম্যরে পাঠাবে? নাকি নিজেই যাইব? অনুরোধ করলে কর্ণ অনুরোধ রাখে এইটা সকলেই জানে। নাকি গিয়া তারে মায়ের পরিচয় দিয়া বলবে- আয় বাপ ঘরে আয়? ...কিন্তু যুধিষ্ঠির যদি জানে যে কর্ণ তার বড়ো ভাই তাইলে সে হিসাব কইরা দেখব যে রাজ্য জয় হলে রাজা হইব কর্ণ। কর্ণের সিংহাসনের লাইগা সে ক্যান কষ্ট করতে যাবে? আর কর্ণ যদি আইসা যোগ হয় কুন্তীর ঘরে তবে যুধিষ্ঠিরের ধর্মের গর্র্ব; ভীমের গদার বড়াই আর অর্জুনের খ্যাতি তিনটাই বড়ো বেশি ম্লান হইয়া পড়ব এক কর্ণের কাছে। ...দুর্যোধন ঠিকই কইছিল সেদিন- সমস্ত দুনিয়ারই রাজা হইবার যোগ্য এই কর্ণ...

নাহ। যারে ফালাইয়া দিছি তারে আর না কুড়ানোই ভালো। বাইচা থাক তুই। সইরা থাক বাপ...

কুন্তী আবার ধৌম্যরে ডাকে- এইবার তুমি রাজা দ্রুপদের কাছে যাবা সৌজন্য সাক্ষাতে আর ব্রাহ্মণ হিসাবে তার মাইয়ারে কিছু উপদেশ দিতে। তুমি দ্রুপদরে বলবা যে পুরাকালের মহান নারীগণের স্বয়ংবরার ইতিহাস তুমি তার কইন্যারে শুনাইতে চাও তার নিজের স্বয়ংবরার আগে। এইটা স্বয়ংবরা করতে যাওয়া নারীর লাইগা পুণ্যের কাম। তারপর কাহিনী শুনাইবার ফাঁকে তুমি তারে সব প্রতিযোগী সম্পর্কে ভালো কইরা বুঝাবা। কইবা তার মতো রাজকইন্যা যদি বিয়াইত্তা রাজাগো বিয়া করে তবে সারাজীবন তারে অন্য রানিদের দাসীবান্দি হইয়া কাটাইতে হবে। তার পোলাপানও রাজা হওয়ার সিরিয়াল পাইব না কোনোদিন। ...যাদব বংশের পোলারে বিশ্বাস নাই। তাই কৃষ্ণের বিষয়েও তারে একটু ধারণা দিবা। কইবা এর শতে শতে বৌ আর পুরা বংশটাই মাতাল। কইবা এদের কোনো ্আদব-কায়দা মায়াদয়া নাই। এই কৃষ্ণ বড়ো হইছে যে মামার ভাত খাইয়া; সেই মামারেই সে খুন করছে তুচ্ছ একটা কারণে। এমন পোলারে বর হিসাবে চিন্তা করার আগে যেন ভালো কইরা ভাবে। আর অশ্বত্থামা যে তার বাপের শত্র“র পোলা সেইটা বোধ হয় এক কথাতেই বুঝব সে...

ফাঁকে ফুকে একটু অর্জুনের কথাও কইবা। কইবা সকলে যদিও জানে যে অর্জুন মা ভাইয়ের লগে আগুনে পুইড়া মরছে। কিন্তু তোমার মনে হয় সে ছদ্মবেশে আছে আর এই স্বয়ংবরায়ও আসতে পারে ব্রাহ্মণ কিংবা ভিখারির সাজে। ...তবে সবচে বড়ো কথা। অন্য কিছু কও না কও। তুমি পরিষ্কার কইরা কর্ণের পরিচয় দিয়া আসবা তারে। কইবা সে বীর তাতে সন্দেহ নাই। প্রতিযোগিতাও সে টপকাইয়া যাবে এইটা নিশ্চিত। কিন্তু সে এক নমশূদ্র ধোপানির পোলা। এখন সে যদি দ্রৌপদীরে জয় কইরা নেয় তবে পাঞ্চাল রাজকইন্যার বাকি জীবন কাটাইতে হবে মাইনসের ময়লা কাপড় ধুয়ে... কথাটা যেন সে ভাইবা দেখে। ...কইবা কর্ণরে যদি বাদ দিতে হয় তবে প্রতিযোগিতার আগেই বাদ দেওয়া ভালো। প্রতিযোগিতার পরে উল্টাসিধা কিছু করতে গেলে ভয়ানক হাঙ্গামা হইতে পারে। আর সেইক্ষেত্রে হয়ত সভা থাইকা ছিনাইয়া নিয়া তারে বুড়া রাজা জরাসন্ধই বিয়া কইরা ফালাইতে পারে...

কোনো ধোপার পোলারে বিবাহ করব না আমি...

দ্রৌপদীর এক কথায় তীর মারতে গিয়াও প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়ে যায় কর্ণ। কৃষ্ণ সইরা যায় বলরামরে নিয়া। অন্যরা গাণ্ডিবে গুণ পরাইতে গিয়া হুড়িমুড়ি খাইয়া পড়ে। আর সবাইরে বেক্কল বানাইয়া এক ব্রাহ্মণ জিতা নেয় দ্রৌপদীর মালা...

নকুল আর সহদেবরে নিয়া যুধিষ্ঠির দৌড় লাগায় মায়েরে সংবাদ দিতে। অর্জুনের সাথে থাকে ভীম। রাজা বাদ দিয়া ফকির ব্রাহ্মণরে মালা দিবার কারণে কিছু রাজা কিছু ঝামেলা করে কিন্তু ভীম গদা আর অর্জুন তীর দিয়া ঠিকই পাঞ্চালীরে নিয়া কুমারের বাড়ি যাইবার পথ তৈয়ার কইরা নেয়...

ভীম আর অর্জুন আসতাছে পাঞ্চালী নিয়া। এইবার কুন্তীর পালা কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের বিধান বাস্তবায়ন। যুধিষ্ঠির আগেই রেডি। নকুল সহদেবও জানে। ভীম অর্জুনেরও জানা আছে তাগোর ভূমিকা। এখন খালি দরকার দ্রৌপদীরে সিস্টেমে ফেলা...

কুন্তী ঘরের ভিতরে চইলা যায়। নিত্যদিন পোলারা ভিক্ষা শেষে ফিরা আসার সময় সে যেমন টুকটাক কাজে থাকে তেমনি সে ঘটমটো কিছু কাজ শুরু করে। যুধিষ্ঠির নকুল সহদেবও ঘরে যাইয়া ঘাপটি মাইরা বসে। এমন সময় প্রতিদিন বাড়ির উঠানে আইসা ভীম যেমন চিক্কুর দেয়- তোমার পোলারা ফিরা আসছে মা...। আইজও ঠিক সেরকমই চিক্কুর দেয়। কিন্তু কুন্তী আইজ একটা ব্যতিক্রম ঘটায় নিত্য দিনের। আইজ সে ভিতর থাইকাই চিক্কুর দিয়া কয়- যা কিছু নিয়া আসছ বাপধন তা সুমান ভাগে ভোগ করো পঞ্চ ভ্রাতায়...

এইটা কুন্তীর কওয়ার কথা না। কারণ ভিক্ষা কইরা পোলারা যা পায় বরাবর তা দুইভাগ কইরা একলাই একভাগ খায় ভীম। বাকি অর্ধেক খায় কুন্তী আর বাকি চাইর পাণ্ডব। কিন্তু ভাগাভাগির সেই হিসাব আইজ করতে গেলে তো দ্রৌপদীর অর্ধেক পায় একলাই ভীম। তাই আইজকে ভাগাভাগির এই আলাদা নিয়ম...

ভিতরে আওয়াজ দিয়া বরাবরের মতো আইজকেও পোলারা কী আনছে তা দেখতে বাইরে আসে কুন্তী। যদিও অন্যদিন পাঁচ পোলাই একলগে বাড়ি আসে। আইজ তিন পোলায় আগেই বাড়িতে বইসা আছে। মায়ের লগে লগে তারাও আইসা উঠানে খাড়ায়। কিন্তু বাইরে আইসাই কুন্তী ভীম আর অর্জুনের লগে দ্রৌপদীরে দেইখা জিবে একটা কইসা কামড় দেয়। যুধিষ্ঠির নকুল সহদেবও কামড়াইয়া জিব লাল কইরা ফালায়- হায় হায়...

ভীম আর অর্জুন খাড়াইয়া থাকে বটগাছের মতো। কুন্তী অস্থির হইয়া দ্রৌপদীর হাত টাইনা লয়- আমারে তুই মাপ কইরা দে মা। আমি একটা ভুল কইরা ফালাইছি। আমি মনে করছি ওরা ভিক্ষা নিয়া ফিরছে কিন্তু... কিন্তু আমার পোলারা তো আবার আমার সকল কথাই সত্য বইলা মানে... এখন কী করি? ...এক মাইয়ারে পাঁচ ভাই ভাগ কইরা নেওয়া তো অধর্মের কাজ। আবার মায়ের কথা না রাখলেও পোলাগো অধর্ম হয়...। তুমি চলো আমার বড়োপোলার কাছে। সে ধর্মকর্ম খুব বেশি কইরা বুঝে। সেই কইতে পারব কী করলে ধর্মও থাকে আবার মায়েরও না কোনো অসম্মান হয়...

দ্রৌপদীরে নিয়া কুন্তী যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়া কাইন্দা পড়ে- বাজান রে...। তোর দুই ছুডুভাই এই মাইয়ারে আমার কাছে নিয়া আসছে আইজ। কিন্তু আমি ভুল কইরা কইয়া দিছি- তোমরা পাঁচ ভাইয়ে এরে ভাগ কইরা লও। এখন বাজান ধর্মের বিধান তুমিই ভালো জানো। তুমিই কও এখন কী করলে তোমার মায়েরও মিথ্যা কওয়ার পাপে না পড়তে হয়; আবার মায়ের কথা না শোনার পাপে তোমার ভাইয়েদেরও না কোনো অধর্ম হয়...

যুধিষ্ঠির পাঞ্চাল সভাতেই দ্রৌপদীরে দেখছিল। এইবার আগাগোড়া আরেকবার ভালো কইরা দেইখা ধর্মের উপযুক্ত বিধান সন্ধান করে। মনে মনে হিসাব করে পাঁচ ভাইয়ে বিবাহ করলে বড়ো ভাই হিসাবে দ্রৌপদী সর্বাগ্রে তার নিজের ভাগেই যাবে। বহুক্ষণ এইভাবে দ্রৌপদীসন্ধান কইরা যুধিষ্ঠির উচ্চারণ করে ধর্মের বিধান- মায়ের বাণীর স্থান হইল হগগল ধর্মের উপর। মায়ে যেহেতু কইছে সবাইরে ভাগ কইরা নিতে সেহেতু এই নারী আমাগের সবারই ভার্যা হইবেন। ...ধর্মেও এর কোনো বিরোধ নাই; ইতিহাসেও এমন উদাহরণ কিছু কিছু আছে...

দ্রৌপদী অর্জুনের দিকে তাকাইয়া দেখে সে তাকাইয়া আছে আকাশের দিকে। কুন্তী পাইয়া গেছে ধর্মের ব্যাখ্যা। এবার সে দ্রৌপদীরে ঘরের ভিতরে টাইনা নিয়া সরাসরি জিগায়- তুমি কার গলায় মালা দিছো জানো? মালা দিছো এক ফকিন্নির পোলারে। ধনুক চালাইতে পারে ঠিক; কিন্তু কোনো চালচুলা নাই; দেশে দেশে ভিক্ষা কইরা খায়। এখন তুমি যদি খালি অর্জুনরে চাও তবে তারে নিয়া সংসার পাইতা তোমারে সারাজীবন ফকিরার বৌ হইয়া কাটাইতে হইব। আর যদি আমার পাঁচ পোলার বৌ হইয়া তাগোরে একলগে রাখবার পারো। তা হইলে হস্তিনাপুরের মহারানি হইতেও পারো তুমি...

একটু পরেই আইসা হাজির কুন্তীর দুই ভাতিজা কৃষ্ণ আর বলাই। ঘরে নতুন বৌ বেক্কল হইয়া আছে পাঁচ স্বামী নিয়া। কুন্তী বেশি কিছু কয় না। সংক্ষেপে বিত্তান্ত বয়ান কইরা কয়- এখন ধৃতরাষ্ট্রেরে জানান দেওয়া দরকার যে পাঁচ পোলা নিয়া কুন্তী খালি বাইচাই নাই; পাঞ্চাল রাজা দ্রুপদ এখন তার পাঁচ পোলার শ্বশুর আর যাদব গোষ্ঠীও এখন আছে কুন্তীর লগে...

কৃষ্ণও কথা বাড়ায় না। খালি কয়- তোমাগো পরিচয় প্রকাশ এখনো সুবিধার হইব না পিসি। এক মাইয়ার পাঁচ স্বামী কেমনে হয় সেইটা দ্রুপদরে আগে না বুঝাইয়া আউগান ঠিক না। দ্রুপদ রাজা আমারে সম্মান করেন কিন্তু এই বিষয়ে যুক্তি দিয়া আমি তারে পটাইতে পারুম না। যুধিষ্ঠিরের বিধান ছোট ভাইয়েগো লাইগা ঠিকাছে। কিন্তু পাঁচ পোলার এক বৌ জায়েজ করার লাইগা দ্বৈপায়নের মতো একজন শক্ত ঋষির স্বীকৃতি লাগব তোমার...

কুন্তী হাসে- কী মনে করছ পিসিরে তোর? কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন আমার সাক্ষাত শ্বশুর আর আমার পোলারা তার নাতি। মাইনসে যত দেবতার কাহিনী জানে তার সকলই জানে তার কলমের কৃপায়; তোর কি মনে হয় নাতিগো বিবাহ জায়েজ করার লাইগা তারে দিয়া কোনো কাহিনী না করাইয়াই অতবড়ো কাম করছি আমি? ওইটা নিয়া তুই চিন্তা করিস না। তিনি নিজে খাড়াইয়াই পোলাগো বিবাহ দিবেন... তরে ডাকছি আমি অন্য কারণে... সেইটা হইল তোর ভাইয়েরা একটু নাদান কিসিমের; তুই তাগো লগে থাকলে তারা একটু বুকে বল পায়...

কর্ণরে যেমন পাঞ্চালী সরাইয়া দিছে ধোপার পোলা কইয়া। তেমনি পাঁচ ভূতের ভাগে পড়বে জানলে হয়ত অর্জুনরেও সরাইয়া দিতো ভিক্ষুক বামুন বিয়া করব না কইয়া। কিন্তু এখন বহুত দেরি হইয়া গেছে। এখন সে অর্জুনের সম্পত্তি। অর্জুন তারে জয় কইরা আনছে তাই এখন সে তারে যার কাছে ইচ্ছা দান কইরা দিতে পারে। ...দেখা যাক...

প্রতিযোগিতার নামে কি মাইয়াডারে কোনো ছোটলোকের হাতে তুইলা দিলাম? এই চিন্তায় বেক্কল বইনা গেছিল পাঞ্চাল রাজ দ্রুপদ আর তার পোলা ধৃষ্টদ্যুু। তাই পাঞ্চালপুত্র আড়ালে আড়ালে পাঞ্চালীর পিছনে ধাওয়া দিছিল অর্জুনের সাকিন সাবুদ বুইঝা নিতে। কিন্তু সংবাদ নিয়া বাপের কাছে গিয়া মাথায় হাত দিয়া বইসা পড়ে পাঞ্চাল যুবরাজ- এইটা কী দেখলাম বাজান। পাঞ্চালীরে একলগেই বিয়া করছে সেই পোলা আর তার বাকি চাইর ভাই... কৃষ্ণ বলাইরেও দেখলাম তাগো ময়ের লগে কী যেন ফুসুর ফাসুর করে। আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়...

এক মায়ের পাঁচ পোলা। তার মাঝে একটা তিরন্দাজ আরেকটা পেটুক গদাধর। দ্রুপদেরও সন্দেহ হয় এরাই মনে লয় নিখোঁজ পাঁচ পাণ্ডব। সেইটা না হয় হইল। কিন্তু কথা হইল এক মাইয়ারে পাঁচ ভাইয়ে বিবাহের বিধানটা কী?

পরের দিনই দ্রুপদ নিজের পুরোহিতরে পাণ্ডবগো কাছে পাঠায় তার বাড়ি খাওনের নিমন্ত্রণ দিয়া। তার সাথে কইয়া দেয়- আমি চাই আমার মাইয়ারে যে পোলায় জয় করছে ধর্মের বিধান মতে সে একাই আমার জামাতা হউক। ...যুধিষ্ঠির নিমন্ত্রণ রাইখা বাকি বিষয়ে কোনো ট্যাফে না কইরা কয়- আইচ্চা তাই হবে...

দ্রুপদ এদের বেশি বিশ্বাস করতে পারেন নাই। তাই নিমন্ত্রণের দিন কন্যার আনুষ্ঠানিক বিবাহেরও আয়োজন কইরা রাখছেন তিনি। কিন্তু যখন তিনি যুধিষ্ঠিররে কইলেন- আসেন আপনের যে ভাই আমার মাইয়ারে জয় করছে তার লগে কৃষ্ণার আনুষ্ঠানিক বিবাহটা সাইরা ফালাই। তখন যুধিষ্ঠিরে কয়- মহারাজ আপনের মাইয়ার লগে তো আমাগের পাঁচ ভাইয়েরই বিবাহ হইছে। এখন অনুষ্ঠান করতে হইলে সিরিয়াল মতো পয়লা আমার লগে তারপর ভীমের লগে তারপর অর্জুন আর তারপর নকুল সহদেবের সাথে করা লাগে...

পাঞ্চাল রাজা খেইপা উঠে যুধিষ্ঠিরের কথায়- ফাইজলামি করো মিয়া? পরিচয় দিতাছো তুমি পাণ্ডু পোলা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আর কথা কইতাছ অধর্মের? এক মাইয়ার লগে পাঁচ ভাইয়ের বিবাহ?

যুধিষ্ঠির যতই বোঝাইতে চায় যে দ্রৌপদীরে বিবাহ করার কোনো ইচ্ছাই তার নাই কিন্তু সেইটা সে করতে বাধ্য মায়ের সম্মান রাখতে গিয়া। আর এই সম্পর্কে ধর্মের ব্যাখ্যা আর উদাহরণ দুইটাই ইতিহাসে আছে...। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সারা রাজবাড়ি পুরা হাউকাউ। একদিকে পাঁচ পাণ্ডব আর অন্যদিকে দুনিয়ার সব পাব্লিক। একজন ব্যাখ্যা চায় তো আরেকজন যায় থাপড় বাগাইয়া। এইদিকে দ্বৈপায়নের আসার কথা থাকলেও তিনি এখনো আইসা পৌঁছান নাই। কুন্তীর ভয় লাগে দ্রুপদ না তার মাইয়ারে ঘরে আটকাইয়া কয়- যা বেটা ভাগ তোরা ফকিন্নির পুত। আমার মাইয়ারে বিয়া দিব না আমি...

কুন্তী একবার মাইনসের হাউকাউ শোনে আরেকবার তাকায় রাস্তায়। কুন্তীর সন্দেহ হয় একবার নন্দীর হাতে মাইর খাওয়া দ্বৈপায়ন ঋষি আইজ না আবার পাব্লিকের অবস্থা বুইঝা কাট মাইরা দিলেন। কিন্তু না... তিনি আসছেন...

হেইলা দুইলা দাড়ি নাচাইয়া চুল ঝাঁকাইয়া দ্রুপদের আঙিনায় আইসা খাড়ান কবি দ্বৈপায়ন। কুন্তী দৌড়াইয়া গিয়া পড়ে তার পায়- আব্বাজান অবস্থা তো খুবই খারাপ। এক মাইয়ার পাঁচ স্বামী কেউ মানে না। এখন পাঞ্চালী যদি এক পোলারে বিবাহ করে তবে তো আমার কথা মিথ্যা হইয়া যায়। আমারে কি তবে মিথ্যা বলার পাপে পাপী হইতে হইব পিতা?

দ্বৈপায়ন একটু বিরক্ত হন- তোমারে পাপপুণ্য বিচারের দায়িত্ব দিছে কেডায়?

ঋষি দ্বৈপায়নরে দেইখা দ্রুপদও পেন্নাম দিয়া তার সামনে খাড়ায়- দেখেন তো ঋষি। এইডা কোন ধরনের কথা? পাঁচ ভাইয়ে একলগে একটা মাইয়ারে বিবাহ করতে চায়?
- তুমি কেডা?
উত্তর না দিয়া দ্বৈপায়নের উল্টা প্রশ্নে দ্রুপদ হাত জোড় কইরা কয়- আমি মাইয়ার বাপ। পাঞ্চাল দেশের রাজা...

দ্বৈপায়ন হাত তুইলা তারে থামাইয়া দেন- রাজপরিচয় লাগব না। মাইয়ার বাপ কইছ সেইডাই যথেষ্ট। তুমি আমার নিকটে খাড়াও; আমি দেখতাছি...

দ্বৈপায়নরে দেইখা অন্যরাও আইসা তারে ঘিরা ধরে। ধৃষ্টদ্যুম্ন নমস্কার কইরা কয়- আমি পাত্রীর বড়ো ভাই কবি...
- আইচ্ছা ঠিকাছে। ...তা কোনো বক্তব্য আছে তোমার?

ধৃষ্টদ্যুম্ন হাত কচলায়। তারপর যুধিষ্ঠিররে দেখাইয়া বলে- কবিবর। আমার বইনের বিবাহ ঠিক হইছে এই বেডার ছোড ভাইয়ের লগে। এই বেডা নিজেরে ধার্মিক হিসাবে পরিচয় দেয়; অথচ নিজের ছোটভাইয়ের বৌয়েরে সে বিবাহ করতে চায়... এইডা কেমন কথা বলেন তো ঋষি?

দ্বৈপায়ন তারেও থামাইয়া দেন- দুইজনে দুইভাবে কইলা কিন্তু কথা তো সেই একই হইল। ...তা এর বাইরে আর কোনো কথা আছে কারো?

ধৃষ্টদ্যুম্ন চুপসাইয়া গেলে যুধিষ্ঠির পেন্নাম কইরা খাড়ায়- দাদাজান। আমি কতভাবে এগোরে বুঝাইতে চাইলাম যে পুরাণে জটিলা নামে একজন নারীর সাতজন পতি আছিল। মুনিকইন্যা বার্ক্ষীর আছিল একলগে দশজন পতি; আর আমরা তো সাতও না দশও না; মাত্র পাঁচখান ভাই পাঞ্চালীরে বিবাহ করতে চাই...
- তোমারে অত বকবক করতে কইছে কেডায়? কথা কম কইয়া চুপচাপ খাড়াইয়া থাকো। ...আর মাইয়ার ভাই তোমার লোকজনরে কও চিল্লাচিল্লি বন্ধ করতে। আমি মাইয়ার বাপের লগে একটু নিরালায় কথা বলতে চাই... মাইয়ার বাপ এইদিকে আসো... কী যেন নাম তোমার?
- আইজ্ঞা দ্রুপদ। পৃষতের পোলা
- ঠিকাছে। পৃষতরে আমি ভালো কইরা চিনতাম। আইস আমার লগে
- আইজ্ঞা হ। তিনি আপনের ভক্ত আছিলেন... এই দিকে আসেন

হাতে ধইরা দ্রুপদের নিয়া অন্যদিকে চইলা যান দ্বৈপায়ন। আড়ালে নিয়া কন- আমি এইখানে আসছি কেন তুমি জানো?
- না গুরুদেব
- আমি আসছি তোমার মাইয়ার বিবাহের পুরোহিত হইতে

দ্রুপদ এইবার আভূমি প্রণাম কইরা কয়- এইটাতো খালি আমার মাইয়ার সৌভাগ্য না গুরুদেব। আমার বংশেরও সাত জন্মের সৌভাগ্য যে মহাঋষি দ্বৈপায়ন আমার মাইয়ার বিবাহে পুরোহিত হইবেন...

দ্বৈপায়ন দাঁত বাইর কইরা হাসেন- তোমার সৌভাগ্য কি না জানি না। তয় এইটা আমার প্রতি শিবের নির্দেশ
- শিবের নির্দেশ?
- হ। শিবের নির্দেশ। কারণ তুমি যে মাইয়ারে নিজের মাইয়া বইলা জানো; সে আসোলে তোমার মাইয়া না। পূর্বজন্মে সে আছিল এক ঋষির মাইয়া যারে একলগে পাঁচ স্বামীর কথা দিছিলেন শিব... সেই কারণেই তিনি আমারে দর্শন দিয়া কইলেন- তুই যা; পাঞ্চালীর বিবাহের পুরোহিত হ। অন্য কোনো ঘটি ব্রাহ্মণে পাঞ্চালীর বিবাহ দিলে আমার বর মিথ্যা হইয়া যাইতে পারে... সেই কারণেই আমি এইখানে আসলাম... বুঝলা? আর আরেকখান কথা। তুমি যদি মনে করো যে স্বয়ংবরায় তোমার মাইয়াই তার স্বামী নির্বাচন করছে; তাইলে সেইটাও ভুল। তোমার মাইয়ার বিবাহের ঘটক আসলে স্বয়ং মহাদেব শিব। তিনিই পূর্বজন্মে তোমার মাইয়ার লাইগা স্বামীদের ঠিক কইরা রাখছিলেন; ...ওরাও আছিল দেবতা; খালি তোমার মাইয়ারে একলগে বিবাহ করার লাইগা শিবের নির্দেশে তারা মর্তে মানুষ হইয়া জন্মাইছে... এক নারীর একাধিক স্বামীর বিধান প্রচলিত না থাকলেও বিশেষে ক্ষেত্রে কিন্তু তা হইতেই পারে। বিশেষত শিব আগেই যে বিবাহের কথা দিয়া রাখছেন...। এখন শিবের কথার উপ্রে আর কোনো কথা আছে তোমার?
- আইজ্ঞা না। আপনের কথার উপ্রে আবার কীসের কথা?

বেদ ভাইঙ্গা যিনি তিন টুকরা করছেন; তিনিই কইতাছেন এই বিধান বৈদিক। শিবের জীবনী যিনি লিখছেন; তিনিই কইতাছেন এই বিবাহ শৈব। সুতরাং দ্বৈপায়নের কথার পরে আর কোনো টু শব্দ করে না কেউ। দ্রুপদও বাইচা যায় নিজের ঘাড় থেকে এমন ঝামেলা নাইমা যাওয়ায়। তারপর ঋষি দ্বৈপায়ন নিজে পুরোহিত হইয়া পাঁচ নাতির লগে পরপর পাঁচ দিন ধইরা বিবাহ পড়াইয়া দেন পাঞ্চাল কন্যা দ্রৌপদীর...

সংবাদ পৌছাইয়া যায় ধৃতরাষ্ট্রের কানে। এখন কী করা যায়?

ধৃতরাষ্ট্রের এমন বেচইন প্রশ্নে ভীষ্ম নইড়া চইড়া আবার তার তামাদি হিসাব খোলেন- করার তো কিছু নাই। বংশের নিখোঁজ পোলাগো আবার খোঁজ পাওয়া গেছে। তাগোরে বাড়ি আসতে কও...

দ্রোণের অংকটা একটু বেশি জটিল। ধৃতরাষ্ট্রের লগে যদি পঞ্চ পাণ্ডবের গিয়াঞ্জাম হয় তবে পাণ্ডবশ্বশুর দ্রুপদ অবশ্যই থাকব পাণ্ডবদের লগে। অন্যদিকে দুর্যোধন আর কর্ণ ব্যস্ত থাকব পাঞ্চাল-পাণ্ডবগো আক্রমণ থাইকা হস্তিনাপুর বাচাইবার ধান্দায়। ...যুদ্ধটা যেহেতু হইব হস্তিনাপুর সেইহেতু দ্রোণের দক্ষিণ পাঞ্চাল পইড়া থাকব এক্কেবারে খালি। সেই সুযোগে পয়লা ধাক্কাতেই জামাইগো নিয়া দ্রুপদ উদ্ধার কইরা নিবো দ্রোণের হাতে বেদখল হইয়া যাওয়া তার দক্ষিণ পাঞ্চাল। কারণ ধৃতের চাকুরিজীবী হিসাবে দ্রোণেরেও তখন থাকতে হইব হস্তিনাপুর...। তাই সবচে বুদ্ধিমানের কাম হইল যুদ্ধমুদ্ধ এড়াইয়া যাওয়া। ধৃতের ভাতিজারা হস্তিনাপুর আইসা তার পোলাগো লগে মারামারি করুক তাতে তার কী? কিন্তু কোনোভাবেই দ্রুপদরে যুদ্ধের সুযোগ দিয়া নিজের রাজ্য হারানোর ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হইব না। তাই সবকিছু ভাইবা চিন্তা দ্রুপদও সিদ্ধান্ত জানায়- মুরব্বি ভীষ্মের কথাই আমার কথা মহারাজ। বিদুরও ভীষ্মরে সমর্থন জানায়- জ্যাঠায় যা কইছে সেইটাই আমার মত... ওগোরে ফিরা আসতে কন...

তিনজনের কথাই এক লাইনে যাওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র কর্ণের দিকে তাকান। কর্ণের সোজাসাপ্টা কথা- অতদিন যারা মরার ভান কইরা লুকাইয়া আছিল; এইবার আদেশ করেন ওগোরে সত্যিকার মরার স্বাদ দেই...

ধৃতরাষ্ট্র কর্ণের টোপটা গিলা ফালাইতে পারেন দেইখা বিদুর এইবার রাজারে ভয় দেখান শুরু করে- ওগোর লগে কিন্তুক এখন যাউরা যাদব বংশের প্যাক্ট হইছে মহারাজ। বলরাম আর সাত্যকির শক্তির কথা তো আপনি জানেন। আর যুদ্ধ জিতার বিষয়ে কৃষ্ণের বুদ্ধির কাহিনীও তো আপনি বহুত শুনছেন মহারাজ। আর পাণ্ডবগো শ্বশুর রাজা দ্রুপদরে আপনি কোন যুক্তি দিয়া দুব্বল কইবেন; যেখানে ধৃষ্টদ্যুম্ন আর শিখণ্ডীর মতো দুইটা পোলা আছে তার? ...বুইঝা দেখেন মহারাজ একলা কর্ণরে দিয়া অতকিছু সামলান যাইব কি না? তার চেয়ে আমার পরামর্শ হইল অভিভাবক হিসাবে নিজের পজিশন ঠিক রাখার লাইগা বৌসহ পিতৃহীন ভাতিজাগোরে আপনি সাদরে গ্রহণ কইরা লন। তাতে আপনার সম্মান বৃদ্ধি হইব...

বিদুরের কথায় ধৃতরাষ্ট্ররে ভয় খাইতে দেইখা ভীষ্ম গলা খাঁকারি দেন- আমি কই কি... যুবরাজ টুবরাজ পদ দিয়া এখন আর তুমি ঝামেলা মিটাইতে পারবা না। তুমি বরং তাগোরে অর্ধেক রাজ্য দিয়া দেও... তাতে তোমার পোলাগো লগে তাগো দেখা সাক্ষাতও হইব না; রেশারেশিও থাকব না...

যারা মইরা গেছে শুনে কাইন্দা কাইটা ধৃতরাষ্ট্র শেষকৃত্য কইরা ফালাইছেন বহুদিন আগে; এইবার তাগোর কাছেই তিনি সংবাদ পাঠান- ভাতিজাগণ। ছোটভাইয়ের পোলা হিসাবে তোমরা আমারও পোলাপান। অতদিন কই ছিলি বাপ? আয় বাপ আয়। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরা আয় বৌ আর মায়েরে নিয়া...

দ্রুপদ আর কৃষ্ণের লগে শলা কইরা পাঁচ বছর পর কুন্তী আবার আইসা পাণ্ডুর প্রাসাদে প্রবেশ করে তার পোলা আর পোলাবৌ নিয়া...

কয়েকদিনের মধ্যেই ভীষ্মের সালিশে রাজ্য ভাগাভাগি হইলে পাণ্ডবরা পায় রাজ্যের আকাটা জঙ্গলের অংশ খাণ্ডব প্রস্থ। তাতেই সই। তারা কৃষ্ণেরে নিয়া সেই বনে গিয়া লোকাল পাব্লিকরে মাইরা ধইরা আগুন দিয়া খেদাইয়া বানায় ইন্দ্রপ্রস্থ নগর। তারপর হাইলা জাইলা প্রজাগোর সম্পদেও ফসলে ছয়ভাগের একভাগ খাজনা বসাইয়া যুধিষ্ঠির হয় সেই রাজ্যের রাজা; যুবরাজ ভীমের দায়িত্বে থাকে রাজ্যের মঙ্গল অমঙ্গল দেখা আর পয়সা কড়ির হিসাব; যুদ্ধ আর বিদেশ বিষয়ে থাকে অর্জুনের এখতিয়ার; বড়ো তিন ভাইর সার্বক্ষণিক এসিস্ট্যান্ট হয় নকুল সহদেব; আর সবার উপরে থাকে মামাতো ভাই কৃষ্ণের উপদেষ্টা পদ...

এর মাঝে দ্রৌপদীর ঘরে পাঁচটা নাতিও পাইছে কুন্তী; প্রতিবিন্ধ্য- সুতসোম- শ্র“তকর্মা- শতানীক আর শ্র“তসেন। ভীম ছাড়া বাকি সবাই আরো কিছু বিয়া শাদিও করছে। অর্জুন তো কৃষ্ণের বইন শুভদ্রাসহ বিবাহ করছে আরো তিনখান। সেইসব ঘরেও নাতিপুতি আছে; উলুপির ঘরের নাতি ইরাবান; চিত্রাঙ্গদার ঘরে বভ্রুবাহন; সুভদ্রার ঘরে অভিমন্যু। ...অন্যরা ইন্দ্রপ্রস্থে থাকলেও সতিনের লগে ঘর করব না বইলা বংশের বড়ো বৌ হিড়িম্বা তার পোলারে নিয়া সেই জঙ্গলেই থাকে। বড়ো নাতি ঘটোৎকচও বিয়াশাদি কইরা এখন এক পোলার বাপ। পোলারে ঘাড়ে কইরা বৌয়ের হাত ধইরা আশীর্বাদ নিতে কুন্তীর কাছে আসছিল ঘটা- দেখো দাদি। পয়লা নাতির ঘরে তোমার পয়লা নাতিবৌ অহিলাবতী। আর এই অঞ্জনপর্বা হইল তোমার পয়লা পোতা; পাণ্ডবগো পরথম নাতি...

ঘটোৎকচের বৌটা খুবই চটপটা আর বুদ্ধিমান। পয়লা দিন আইসাই সে কুন্তীরে কয়- রাজনীতির লাইগা শ্বশুররে যেমন তার সংসার থাইকা তুমি কাইড়া নিছিলা; আমার স্বামীরে নিয়া সেইরকম ঘিরিঙ্গি করলে আমি কিন্তু তোমারে খাইয়া ফালামু বুড়ি... মনে রাইখ আমি নাগ বংশের মাইয়া...

ঘটার ছেলেরে কোলে নিয়া কুন্তী হাসে- আমার যখন করার সময় আছিল তখন ভালোমন্দ নিজের বুদ্ধিতে যা কুলায় তা করছি। এখন নাতিপুতিগো লগে সময় কাটান ছাড়া আমার তো আর কিছু করার দরকার দেখি না বইন। এখন তোগো সময়; ভালোমন্দ যা করার তোরাই করবি...

কুন্তীর আর কিছুই করার দরকার ছিল না সত্য। পাণ্ডর গলায় মালা পরাইয়া যে কুন্তী একলা আসছিল হস্তিনাপুর; সেই কুন্তীর এখন নাতিপুতি নিয়া বিশাল বাজার। আশপাশের ছোটখাট সব রাজারে কায়দা কানুন কইরা ভীম আর অর্জুনে মিলা এই কয়দিনে বিশাল এক অর্থের ভাণ্ডারও গইড়া তুলছে ইন্দ্রপ্রস্থ দেশে... বিপদে আপদে কৃষ্ণ ছায়ার মতো আছে ভাইয়েদের লগে। এখন ধনে-জনে-বুদ্ধিতে কুন্তীরে হুমকি দিবার মতো আর কেউ নাই...

কথাটা সবার আগে যুধিষ্ঠিরের মাথাতেই খেলে- কই? কাউরে তো দেখি না আমার সমান। তাইলে আমি কেন খালি রাজা হইয়া বইসা থাকুম? সম্রাট হইতে অসুবিধা কই আমার?
- অসুবিধা নাই। কিন্তু মনে রাইখ তুমি যা দেখো না সেইখানেও দেখার মতো বহুকিছু আছে। আশেপাশের বহুত ছোট রাজারে ভীম-অর্জুনে মিলা বশ করছে সত্য কিন্তু জরাসন্ধ বাইচা থাকতে তুমি সম্রাট হইবা কেমনে? সে তো তোমারে কর দিব না আর টানা তিন শো বছর ধইরা যুদ্ধ করলেও তারে হারাইতে পারবা না তুমি...
- আইচ্ছা তাইলে থাক। সম্রাট হইবার কাম নাই আমার...

কৃষ্ণের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাসের লগে নিজের খায়েশ বিসর্জন দিয়া যুধিষ্ঠির চুপসাইয়া যায়। কিন্তু কৃষ্ণের মনে হয়- অসুবিধা কী? একবার দেখি না টেরাই দিয়া তারে সম্রাট বানাইতে পারি কি না। ...জরাসন্ধরে যুদ্ধ কইরা হারানো অসম্ভব। কিন্তু যার লগে যুদ্ধে পারা যাইব না তার লগে যুদ্ধ করার কী কাম? তারে অন্যভাবেও তো সরাইয়া দেওন যায়...

ব্রাহ্মণভক্ত জরাসন্ধের বাড়িতে ভীমেরে নিয়া ব্রাহ্মণ সাইজা হাজির হয় কৃষ্ণ। তারপর যা হবার তা হয়। জরাসন্ধ করে ব্রাহ্মণ সেবা আর কৃষ্ণ ভীমেরে দেখাইয়া দেয় কীভাবে হত্যা করতে হবে তারে...

জরাসন্ধরে মাইরা ফালানের পর যুধিষ্ঠিরের সামনে আর তেমন কেউ থাকে না যে তারে সম্রাট হইতে বাধা দিতে পারে। অল্প দিনেই বাকিদের বশ কইরা সম্রাট হইবার লাইগা রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে যুধিষ্ঠির... সেইখানে অবশ্য একটু ঝামেলা হয়। কৃষ্ণের দাবি ছিল যজ্ঞের অর্ঘ্যটা তারেই দিতে হবে; যদিও যজ্ঞের অর্ঘ্য পাইবার জন্য যোগ্য হইল ছয় দল মানুষ; গুরু-পুরোহিত-সম্বন্ধী- øাতক- সুহৃদ এবং রাজা। গুরু-পুরোহিত-øাতক এবং রাজা; এই চারদলে কোনোদলেই কৃষ্ণ নাই। তারে পাণ্ডবগো সম্বন্ধী এবং সুহৃদ কওয়া গেলেও এই দলে এখনো তার থাইকা বেশি অগ্রাধিকারের মাইনসের অভাব নাই...

কিন্তু যুধিষ্ঠিরের তাতে কোনো অসুবিধা নাই। নিয়মে পড়ুক না পড়ুক কৃষ্ণ যেহেতু চাইছে সেইহেতু সেইটা তারে দিতে হইব। ভীষ্মও তা মাইনা লন কারণ কৃষ্ণের বিরোধিতা কইরা শেষ বয়সে অপমান হইতে চান না তিনি। শুধু তাই না; আরেক ধাপ আগাইয়া যুধিষ্ঠিরের পক্ষে কুরুবুড়া তিনিই যজ্ঞের অর্ঘ্য নিবেদন করেন কৃষ্ণের পায়ে...

কিন্তু অনেকেই খেইপা উঠে এই আচরণে। কৃষ্ণরে কেন দেয়া হবে যজ্ঞের পূজা? ...সব থিকা বেশি খেইপা উঠে কৃষ্ণের আরেক পিসির পোলা শিশুপাল; যার প্রেমিকা রুক্সীণীরে ছিনতাই কইরা বিবাহ করছিল কৃষ্ণ। কিন্তু এইরকম পতঙ্গের আস্ফালন পছন্দ হইবার কথা না যজ্ঞের পূজা পাইয়া দেবতার মর্যাদায় উইঠা যাওয়া কৃষ্ণের; হোক তার ভাই কিন্তু চক্র ছুইড়া ভরা সভায় তার মাথা নামাইয়া দিতে এক মুহূর্তও বিলম্ব করে না সে...

তারপরে আর কেউ কোনো শব্দ করে না। শুধু কুন্তীর মনে হয়; যে কৃষ্ণ এক পিসির পোলারে মারতে পারে সে তার অন্য পিসির পোলাগোরে মারতেও দেরি করব না যদি তারা তার কথার অন্যথা করে... যদিও আপাতত সেইটা হইবার সম্ভাবনা কম; কারণ যুধিষ্ঠিরের বুদ্ধিশুদ্ধি কম থাকলেও শক্তিমান মাইনসের লগে কেমনে আচরণ করতে হয় তা তার খুব ভালো কইরা জানা...

রাজসূয় যজ্ঞ কইরা কুন্তীর ছিচল্লিশ বছর বয়সী বড়ো বড়োপোলা যুধিষ্ঠির এখন সম্রাট। কুন্তীর সত্যই এখন নাতিপুতি নিয়া খেলা করা ছাড়া আর কিছুই করার দরকার নাই। কিন্তু ঝামেলাটা আসলো যুধিষ্ঠিরের সম্রাট হইবার সূত্র থেকেই। যুধিষ্ঠিররে সম্রাট হইতে দেখে গায়ে জ্বলা উঠায় দুর্যোধন গিয়া তার মামা শকুনির লগে শলা কইরা যুধিষ্ঠিররে শকুনির লগে পাশা খেলার আমন্ত্রণ পাঠায়। পাশা খেলার বাজি রাখা হইল রাজ্য... যুধিষ্ঠির জিতা গেলে সে পাইব দুর্যোধনের রাজ্য আর হাইরা গেলে তার রাজ্য পাইব দুর্যোধন...

পোলাটা খালি মূর্খ না। লোভীও বটে। পাশা খেইলা দুর্যোধনের রাজ্য পাইবার লোভে সে নিজের রাজ্য তো হারাইলই; তার সাথে পাশায় হাইরা তার সব ভাই; সে নিজে এবং দ্রৌপদীরেও বানাইয়া ফেলল দুর্যোধনের কৃতদাস। রাজ সভায় দ্রৌপদীর মতো মাইয়ার নগ্ন হইবার মতো অপমানও সহ্য করতে হইল এই এক মূর্খের কারণে...

বিপদটা অবশ্য তখনো অত বেশি বড়ো হয় নাই। খেলায় হাইরা যাবার পরেও কুরুবুড়াদের কথায় ধৃতরাষ্ট্র নিজের ক্ষমতা খাটাইয়া সবকিছুই তাদের ফিরাইয়া দিছিলেন। কিন্তু মূর্খটা আবারও পরের দিন শকুনির লগে পাশা খেলতে গেলো নতুন এক বাজি নিয়া- খেলায় হাইরা গেলে চার ভাই আর দ্রৌপদীরে নিয়া তারে যাইতে হইব বারো বচ্ছর বনবাস আর এক বচ্ছরের অজ্ঞাতবাসে...

যা হবার তাই হইল। যারে নিজের আঁচলে আগলাইয়া তিরিশ বছর বয়সে রাজা বানাইছিল কুন্তী। তারপর ষোলো বছর ধরে তিল তিল করে চাইর ভাই আর কৃষ্ণ যারে পৌঁছাইয়া দিছিল সম্রাটের সিংহাসন পর্যন্ত। সেই সম্রাট যুধিষ্ঠির নিজের লোভ আর বেকুবির লাইগা হাইরা বসল শকুনির কাছে...

এখন? এখন এই ছিচল্লিশ বছরের পোলা আর তার পোষ্যদের আরো তেরো বছর বনে জঙ্গলে আগলাইয়া রাখার শক্তি কি কুন্তীর অবশিষ্ট আছে?

ক্ষতি যা হবার তা হইয়া গেছে। এখন বাকিটা সামলানো দরকার। বহু বছর পর আবার নিজের মেরুদণ্ড সোজা কইরা খাড়ায় কুন্তী- পাঁচ পাণ্ডবের লগে শুধু দ্রৌপদীই যাইব বনে। বাকি বৌবিনিরা নিজেগো পোলা মাইয়া নিয়া নিজের বাপের বাড়ি গিয়া থাকো... দ্রৌপদীর পাঁচ পোলারেও পাঠাইয়া দাও নানাবাড়ি পাঞ্চাল দেশে...

এই প্রথমবার কুন্তীর নিজেরে এক ভেঙে পড়া বৃদ্ধ মানুষ মনে হয়। সে অতি ধীরে দ্রৌপদীরে ধইরা নিজেরে খাড়া কইরা রাখে- বনে জঙ্গলে থাইকা; পথে পথে ভিক্ষা কইরা যে পোলারে রাজা বানাইছিলাম আমি। নিজের কর্মদোষে সেই পোলা এখন সবাইরে নিয়া পথের ফকির... তোরে আমার কিচ্ছু কওয়ার নাইরে মা। শুধু কই; যদি পারিস পাঁচটা পোলারে এক মুঠায় রাইখা দেখ কিছু করতে পারস কি না...

২০১২.১১.১০-১৭

মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ২]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ২। কুন্তী [পর্ব ১]
মহাভারতে তিন রাজনৈতিক নারী। ১। সত্যবতী


মন্তব্য

pothik এর ছবি

ভাই আপনি কি ঘটনা ঘটার সময় ছিলেন!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

সবখানে থাকতে পারি নাই তবে সিসি ক্যামেরা ফিট কইরা রাখছিলাম

প্রণব এর ছবি

অসাধারণ। জানা ইতিহাসও আপনার লেখায় অনন্য লাগছে

শুভেচ্ছা রইল লীলেন ভাই

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ পড়ার জন্য

অতিথি লেখক এর ছবি

একেই বলে রাজনীতি। দুর্দান্ত হচ্ছে লীলেন ভাই। পারলে আরেকটু বড় করে দিয়েন।

ফারাসাত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। আরো বড়ো! এইটা করতেই জান বের হয়ে যাচ্ছে

আকাশ চৌধুরী এর ছবি

এই কৃষ্ণ বড়ো হইছে যে মামার ভাত খাইয়া; সেই মামারেই সে খুন করছে তুচ্ছ একটা কারণে।

এইটা কি বললেন? কৃষ্ণ বড় হইছে বৃন্দাবনে না? আর মামারে সে কি খুন করছে?

আমি তো কোন বইয়ে জানি (মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ- নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী কি?)পড়ছিলাম যে, কংসরে সরানোর ব্যবস্থা করসিলো দ্বারকার অভিজাতেরাই, কৃষ্ণরে 'শিখণ্ডী' বানাইয়া। পরে কৃষ্ণ তার কূটনৈতিক বুদ্ধি আর ম্যাগনেটিক চার্ম দিয়া ভারতের রাজনীতিতে এমন এক ফ্যাক্টর বনে যায়, যে তার জীবদ্দশাতেই তারে নিয়া তৈরি হয় নানারকম মিথ। যুদ্ধ না কইরাও মহাভারতের যুদ্ধের প্রধানতম খেলোয়াড় বইনা যায় সে, বাকিদের নাচায় ঘুঁটি বানায়া‍‍.....

আপনার লেখা নিয়া কি বলব আর। বরাবরের মতই অসাধারণ। না, কম বলা হল। চালিয়ে যান।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই তো মারলেন; রেফারেন্স দিতে গেলে তো বহুত কাহিনী কওয়া লাগে। তয় সংক্ষেপে হইল কৃষ্ণ সম্পর্কে এই ঘটনাটা আমি নিছি শিশুপাল থাইকা। শিশুপাল যখন তারে গালাগালি করে তখন তার সম্পর্কে বহুত কাহিনী বলে; বলারই তো কথা। কারণ অর্জুন যেমন কৃষ্ণের পিসির ছেলে; শিশুপালও তেমনি আরেক পিসির ছেলে...

দুর্যোধনও তারে কংসের দাস কইয়া বহুবার গালাগাল করার সময় যদ্দুর মনে পড়ে এই তথ্য দেয়...

০২

নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ীর বইগুলো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ... ঘটনাগুলোকে বিশ্লেষণ করে তিনি উপসংহার টেনেছেন...
মহাভারতীয় রাজনীতির একাডেমিক পাঠের জন্য তার লেখাগুলো অবশ্যই অথেনটিক; তবে আমারখান হইল গিয়া গপ্প; কিছুটা মশলাপাতি দিয়া চচ্চড়ি ভাজা আরকি...

এরিক এর ছবি

অসাধারণ। ঘটনা ঘটার সময় আপনি কই ছিলেন জাতি জানতে চায় চিন্তিত

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমি ওইখানেই ছিলাম দ্বৈপায়নের এসিস্ট্যান্ট হিসাবে

পুতুল এর ছবি

আমার ধারণা; লর্ড ক্লইভ মহা ভারত পড়ে সিরাজদৌলাকে পরাজিত করেছিল।

আচ্ছা এই কৃষ্ণ কী-ই "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, হরে হরে রাম রাম, রাম রাম হরে হরে?"

তো হরিভক্ত দ্বৈপায়নরে হরভক্ত বানাইছিল সে।

হরিভক্ত এবং হরভক্তের পার্থক্য কী? হরে শব্দটা কী এই হরি বা হর থেকে এসেছে?
বোকার মতো প্রশ্ন হয়ে গেল, কিন্তু আমি এই শব্দগুলোর ভেদাভেদ সত্যিই জানি না।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মাফ করেন। মহাভারতের লগে বহুত কিছুর সম্পর্ক ঘাইটা আমি প্রায় পাগলা অবস্থায় আছি; লর্ড ক্লাইব পর্যন্ত আর যাইতে চাই না....

০২

এই কৃষ্ণই হরে কৃষ্ণ। ভগবান কৃষ্ণ। যার শতে শতে নাম। কৃষ্ণের খালি নাম জপের জন্যই আলাদা অনুষ্ঠান হয় কিন্তু...

হরে কৃষ্ণের সাথে যে হরে রাম বলা হয় সেই রাম কিন্তু রামায়ণের রাম

কৃষ্ণ আর রাম দুইজনই বিষ্ণুর অবতার। সব থেকে বিখ্যাত অবতার। তাই বিষ্ণু ভক্ত বা বৈষ্ণবরা 'হরে কৃষ্ণ হরে রাম' বলে মূলত বিষ্ণুর মানবিক রূপকেই স্মরণ করে...
[আরো ব্যাখ্যা আছে কিন্তু...]

০৩
হরি হচ্ছেন নারায়ণ বা বিষ্ণু। আর হর হচেছ শিব বা মহাদেব। দুইজন কিন্তু আবার পরিপূরক আর খুবই ঘনিষ্ঠ। যার লাইগা লাঠার মতো বন্ধুত্বরে মাইনসে কয় 'হরিহর আত্মা'

[দুইজনেরই কিন্তুক আরো বহু নাম আছে]

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

সনাতন ধর্মে 'ত্রিদেব' অর্থাৎ তিন মাথা এক দেহে ব্রহ্মা = সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু = রক্ষাকর্তা ও শিব = বিনাশকর্তা, এরকম একটি ধারনা প্রচলিত আছে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

শিব কিন্তু আবার বিশ্বপিতাও

পুতুল এর ছবি

যার লাইগা লাঠার মতো বন্ধুত্বরে মাইনসে কয় 'হরিহর আত্মা'

হরিহর আত্মা শব্দটা নিজেই ব্যবহার করেছি কতবার, এর উৎপত্তাটা জানলাম আজ। ধন্যবাদ।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

কীর্তিনাশা এর ছবি

দারুণ উপভোগ‌‌্য হয়েছে এ পর্বটাও। পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় অধীর !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পরের পর্বে দ্রৌপদী। তার পরে আবার কুন্তী আসবে স্যার

অতিথি লেখক এর ছবি

দ্রৌপদীকে একসংগে পাঁচ ভাইয়ের বৌ বানানোর জন্য আপনার ব্যাখ্যাটা দারুন, কৃষ্ণের ব্যাখ্যাতেই বরং বেশ কিছু গলদ আছে। যাই হোক, এ পর্বটিও যথারীতি অসাধারন, পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় রইলাম।

আব্দুল্লাহ এ.এম.

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দ্রৌপদীরে পাঁচ ভাইয়ের বৌ বানানো ঘটনার সিকোয়েন্সটা কিন্তু আমি হুবহু নিয়েছি মহাভারত থেকে খালি ধৌম্যকে পাঠানোটা আমার

কৃষ্ণের ব্যাখ্যার গলদগুলা ধরিয়ে দিলে সংশোধন করতে সুবিধা হতো

guest_write এর ছবি

বেশ ভাল লিখেচেন। বেশ উপভোগ্য।
kazirhut

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ

রণদীপম বসু এর ছবি

হুমম !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হুম কইলে হইব না স্যার
আমি সংস্কৃত জানা মাত্র দুইজন মানুষকে চিনতাম
এর মধ্যে একজন মৃদুল চক্রবর্তীকে এক হাজার টাকার জন্য ল্যাব এইড মাইরা ফালাইছে
বাকি আছেন আপনি
আপানার জন্য এক হাজার টাকার ইন্সুরেন্স করে আমি শিগগিরই হাজির হচ্ছি কিন্তু সংস্কৃত পুস্তক নিয়ে

রণদীপম বসু এর ছবি


আমার স্কুলপাঠ্যে সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণীর সংস্কৃতজ্ঞানকে যদি আপনি সংস্কৃত জানা বলতে চান, তাহলে আমি আতঙ্কিত যে, প্রয়াত মৃদুল দা'র প্রতি ভয়ঙ্কর অন্যায় হয়ে যাচ্ছে তাঁর সাথে আমাকে পঙক্তিতে বসিয়ে !
আসলে বর্তমানে আমার অনধিকারসুলভ দর্শন চর্চায় তর্জমাসহ যে সংস্কৃতের ব্যবহার দেখছেন, তার সবই কিন্তু ধার করা জ্ঞান। ওতে আমার বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব নেই, কেবল চয়ন করাটুকু ছাড়া !

এরপরও যদি আপনি এ বিষয়ে আপনার অবস্থান পরিবর্তন না করেন তো আমাকে এবার ভীমরতি শব্দের গূঢ়ার্থ খুঁজতে হবে কোন সংস্কৃত উৎস থেকে, হা হা হা ! যদিও গতকাল আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের উৎসগ্রন্থ চরক-সংহিতার পাঁচটি খণ্ডই তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, কোথাও এটির টিকিটির সন্ধান পাই কিনা ! প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।


প্রাচীন 'অর্থশাস্ত্র'-এর প্রণেতা কৌটিল্যের নামকরণের অন্যতম ব্যাখ্যা হলো, কারো কারো মতো, তিনি কূটিলা গোত্রের বংশধর ছিলেন। সেই গোত্রনামটিকে অমর করতেই তাঁর এই অন্যতম নামধারণ। কিন্তু আপনার এই মহাভারতের বর্তমান চিন্তাদৃষ্টির বয়ান পড়ে জানতে ইচ্ছে হচ্ছে, সেই কুটিলা গোত্রের সাথে আপনার অতি দূরবর্তী হলেও কোন সংযোগ রয়ে গেছে কিনা ! কূটবুদ্ধি না থাকলে এমন কূটগ্রন্থির জট খোলা সত্যিই অভূতপূর্ব ! হা হা হা !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

খেকশিয়াল এর ছবি

সত্যশেখর ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'দীপায়ন' প্রকাশিত চরকসংহিতার খবর পাইলাম এইখান থিকা http://www.clicktobuyboi.in/catalog/product/view/id/9959/

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

পুতুল এর ছবি

খেকশিয়াল ভাই, ঐ লিংকে তো বইটা দেখাচ্ছে না।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

খেকশিয়াল এর ছবি

পাইছি!! মুহাহাহা! এই সাইটটা অনেক রিচ, অনেক পুরান বই পাওয়া যায়। মহাভারতের অনেকগুলা ভার্শনও এইখানে পাইবেন http://dspace.wbpublibnet.gov.in:8080/dspace/handle/10689/2246

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

পুতুল এর ছবি

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের উৎসগ্রন্থ চরক-সংহিতার পাঁচটি খণ্ডই তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি, কোথাও এটির টিকিটির সন্ধান পাই কিনা ! প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

গুরু আয়ূর্বেদ শাস্ত্র বা তার উৎসগ্রন্থ নিয়ে একটা পোস্ট চাই।

আমার স্কুলপাঠ্যে সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণীর সংস্কৃতজ্ঞানকে যদি আপনি সংস্কৃত জানা বলতে চান

বাক্যংশটি আমাদের শিক্ষা ব্যাস্থার উপর একটা চেপেটাঘাট। মাত্র দু'বছর সংস্কৃত শেখানো হয়েছে আপনাকে সেজন্য তো বটেও; কিন্তু তার চেয়ে বড় আক্ষেপ আমি মুসলমান বলে বাধ্যতামূলক আরবী ভাষা শিখতে হয়েছে। অথচ আরবী তখনো কিছু বুঝতামনা এখনো কিছু বোঝিনা। আমার মনে হয় সংস্কৃতি যদি এতটুকুও জানতাম বা তার সাথে মোটামোটি পরিচয় থাকতো, তাহলে বাংলা ভাষা ভাল লিখতে বলতে এবং পড়তে পারতাম। আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থা এই দিকটি নিয়ে একটু ভাবলে ভাল হতো।

জার্মান ভাষায় লেখা সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার বই পাওয়া যায় এবং আমার সংগ্রহে একটি আছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শিক্ষার কোন বই আমি যোগার করতে পারিনি। যাই হোক, শিবীরে গীতে তো আর পাপ নেই, তাই একটু গেয়ে ফেললাম!

এই মৃদুলদার তাহলে এই অবস্থা!

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ইসকুলে দোষ দিয়া লাভ নাই
যারা ধর্ম দিয়া দেশ ভাগ করছে তারাই পরে হইছে ইস্কুলের মাস্টার আর পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা
তাই ইস্কুল শিক্ষা আর ধর্মশিক্ষার মধ্যে তারা পার্থক্য করতে পারে নাই; এখনো পারে না
একটা উদাহরণ দেই

বর্তমানেও ইস্কুলের বিজ্ঞান বই বলে- সকল শক্তির উৎস আলো...
সমাজ বই বলে সকল শক্তির উৎস জনগণ
ধর্ম বই বলে সকল শক্তির উৎস আল্লা/ভগবান...

এইবার ইস্কুলের বই পইড়া কোন হালায় বলতে পারব যে আসোলে শক্তির উৎস কী?

০২

জর্মনরা শুনেছি সংস্কৃতের বেশ ভক্ত আছিল। গ্যাটে ফাউস্টের বেশ কিছু অনুপ্রেরণাও নাকি নিয়েছিলেন কালিদাস থেকে...

০৩

তবে 'শর্ট কোর্সে' সংস্কৃত পড়তে না যাওয়াই ভালো
ভাষাটার শব্দগুলো খুব বেশি বহুমাত্রিক অর্থ ধারণ করে
আউলাইয়া যাইবার সম্ভাবিলিটি একশো ভাগ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এমনিতেই বাচি না আপানি আবার নিয়ে আসলেন কৌটিল্য
মহাভারতের গপ্প না হয় করা যায় এদিক সেদিক যে কোনো দিক দিয়া যার তার লগে
কিন্তু কৌটিল্য নিয়া কথা বলতে গেলে তো অমর্ত মুহিত ইউনূস আগে দিয়ে সার্টিফিকেট আনতে হবে- ওস্তাদ যা বুঝছি তা ঠিক বুঝছি তো?

০২

আচ্ছা কৌটিল্য থেকেই কি কূটনীতি শব্দটা এসেছে?

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যা, কৌকিল্য থেকেই কূটনীতি শব্দটি এসেছে। চাণক্য ছিলেন প্রথম মণ্ত্রনাদাতা। যিনি মগধের ঐক্য ভেঙে সে বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যে্র রাজত্বকে নিশ্চিত করেণ।এ কাজে তিনি দূত বা কূটনীতিক কাজে লাগান। মৌর্য বংশের পত্তন মূলত একটা প্রতিশোধ স্পৃহা হতে হয়েছিল। মৌর্য বংশের নাম চন্দ্রগুপ্তের মায়ের নামানুসারে। আর কিছু লিখছি না, কারণ স্মৃতি খুবই প্রতারক। এর মাঝেও ভুল হলে কেউ বলবেন নিশ্চয়। তবে ইতিহাসটা মোটামুটি এরকম।

স্বয়ম

অতিথি লেখক এর ছবি

বেুঝলাম না, েএকটা জবাব দিলাম, এটা কি মডারেশন এ আটকাইছে নাকি? চাণক্য লেখা অথৃশাস্ত্রই কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র নামে পরিচিত। তিনি সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যে্র প্রধান মন্ত্রনাদাতা ছিলেন। তিনিউ প্রথম (অন্তত ইতিহাসমতে) প্রথম র্কটনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। রেফারেন্স। তার নাম থেকেই র্কটনীতি শব্দের উদ্ভব বলে মত দিয়েছেন অনেকেই। রেফারেন্স মেনশন করতে পারছি না এই মূহুর্তে। চাণক্য আরো অনেক কারনেই স্মরণযোগ্য। প্রথম কূটনৈতিক তৎপরতার সাথে মগধ জড়িত আছে। মগধ তখন সমৃদ্ধশালী অঞ্চল ছিল। পরবর্তীতেও এই অঞ্চল বিশেষ গুরুত্ব বহন করেছে বিশেষত তার লোহার খনির কারণে এবং নৌ যোগাযোগের কারণে। সব শাসককেই কম বেশি মগধ নিয়ে উৎসাহী হতে দেখা গেছে শক্তির প্রশ্নে।

স্বয়ম

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চাণক্য বেশি ধারণা নাই; টুকটাক জানি। মহাভারতের পাণ্ডবদের মধ্যে একমাত্র অর্জুন অর্থনীতি বুঝত; অর্থনীতি নিয়ে তার কথাবার্তাগুলো অনেকটাই চাণক্যসূত্রের সাথে মিলে যায়
হতে পারে একটা পরবর্তী সংযোজন আবার হতে পারে অর্জুন এবং চাণক্য দুজনই অর্থনীতির যে প্রাচীন সূত্র ব্যবহার করেছেন তার উৎস বৃহস্পতি এবং শুক্রাচার্য

০২

চাণক্য তার অর্থশাস্ত্র শুক্রাচার্যকে প্রণাম দিয়ে শুরু করেছিলেন না?
কোথাও শুনেছিলাম যার বেশি সে বেশি দেবে/যার কম সে দেবে কম এই পদ্ধতিটা নাকি শুক্র উদভাবন করেছিলেন...
করের বিনিময়ে প্রজাসেবাও প্রচলনও নাকি শুক্রের?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ভীমরতির সন্ধান পাইছি

ভীমরতি [ bhīma-rati ] বি.
১. বার্ধক্যজনিত ঈষত্ বুদ্ধিভ্রংশ বা খ্যাপামি;
২. ৭৭ বছর ৭ মাস বয়সের সপ্তম রাত্রি (বর্ত. এই অর্থ অপ্র.)।

[সং. ভীমরথী? < ভ্রমার্তি ?]।

লিংক
http://bangladictionary.evergreenbangla.com/22755

খেকশিয়াল এর ছবি

যাউরা যাদব বংশ

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মাহবুব লীলেন এর ছবি

হ। মাত্র তো শুরু হইছে কৃষ্ণের কৃষ্ণলীলা; নিজের ভাগিনারে রাজা বানাইবার লাইগা দেখো না পাণ্ডবগো কত পোলাপান আর নাতিপুতি সে মাইরা ফালায়

মন মাঝি এর ছবি

পিটার ব্রুকের "মহাভারত" (সাড়ে তিন ঘন্টা)

****************************************

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এইখান দেখছি। এই ফিলমের সবচে ভালো লেগেছে যে বিষয়টা তা হলো মহাভারতকে ব্রুক- পলিটিক্যাল হিস্টরি অব ম্যানকাইন্ড' হিসেবেই দেখাতে চেয়েছেন

মন মাঝি এর ছবি

হ্যাঁ, কিন্তু সেটাই আবার অনেক ভারতীয়র পছন্দ হয় নাই। তাছাড়া এই ছবিটা অনেক ভিনদেশি বা ভিন সংস্কৃতির মানুষের কাছে মহাভারতকে অনেক সহজগম্য করে পরিবেশন করেছে। ফলে এটা যতটা বিদেশি বা ভিন সংস্কৃতির মানুষের কাছে প্রিয় হয়েছে, ততটা বোধহয় ভারতে হয়নি।

আমি অবশ্য এটাই (বা এই ছবিরই সাড়ে ৫ ঘন্টার দীর্ঘতর সংস্করণ) সম্পূর্ণ দেখেছি, দূরদর্শনেরটা কয়েক সেকেণ্ডের বেশি দেখতে পারি নাই! মন খারাপ

****************************************

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই ছবিটার নির্মাণে সবচে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বিষয়ের মধ্যে একটা হলো একই ফ্রেমে এবং পরিবারে বহুবর্ণের মানুষের সন্নিবেশ ঘটানো

আর দ্বিতীয়টা হলো প্রতিটি পৌরাণিক বাস্তবতায় বাস্তব/থিয়েট্রিক প্রয়োগ
অতবার মহাভারত পড়েও আমার মাথায় ঢুকত না একলব্যের সপ্তবাণ; যা দিয়ে সে অর্জুনের কুকুরের বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল

কিন্তু এখানে দেখলাম; স্রেফ পরপর একই বিন্দুতে সাতটা তীর মারা; আর তখনই মনে হলো আরে! তাই তো?

আরেকটা অদ্ভুত উপস্থাপনা ছিল অভিমন্যুর ব্যূহ ভেদ করা; এবং সেই ব্যূহ আবার বন্ধ হয়ে যাওয়া
ব্যূহ জিনিসটা যে ব্লকিং সেইটা বোধহয় পিটার ব্রুক না দেখলে আমার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব হতো না...

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রথম থেকেই পর্বগুলো ফরেঅ করছি। অসাধারণ। গোটা লেখাটা শেষ হলে দেবত্ব বিষয়ক প্রামাণ্য লেখা চাই। এটা দাবী অথবা অনুরোধ। পর্বগুলো আগে শেষ হোক তারপর চাওয়াটা বিস্তারিত বলব।

স্বয়ম

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ পড়ার জন্য
কিন্তু দেবত্ব বিষয়ক প্রামণ্য লেখা মানে যদি হয় কারো দেবত্ব প্রমাণ করা তবে আমারে মাফ করতে হবে
আমি ধর্মহীন মানুষ; পুরাণে আমি গপ্প রাজনীতি আর ইতিহাস খুঁজি...

০২

ভারতীয় দেবতাদের সম্পর্কে অনেক গবেষণাধর্মী বই আছে; কীভাবে কখন এবং কোথায় কোন চরিত্র দেবতা হয়ে উঠল

তবে বৈদিক সংস্কৃতিতে 'দেবতা' কিন্তু দেবত্বপ্রাপ্ত দেবতা ছিলেন না; 'দেবতা' ছিল একদল মানুষের নাম; যার রাজা ছিলেন ইন্দ্র। অন্যদিকে যেমন 'অসুর' আরেকদল মানুষের নাম
সেই যুগের 'দেবতা' গোত্রের অনেক মানুষই পরে দেবত্ব পেয়েছেন কিন্তু দেবত্বের দিক থেকে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি; এখন পর্যন্ত যত পূজা হয় তা কিন্তু অবৈদিক ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব ঘরানার দেব দেবিদেরই হয়
সাধারণত যাদের পূজা হয় তাদেরকে সম্বোধন করা হয় 'ভগবান' বা ঠাকুর হিসেবে

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

'দিবি আরোহন' বলে একটি কথা আছে। দিবি আরোহন, মানুষেরই দেবত্ব লাভের কথা। উত্তম মানুষ প্রতিলোম ক্রিয়ায় দেবতা হন। প্রতিলোম ক্রিয়ার আশ্চর্য সূত্র হলো, উত্তম মানুষ প্রথমে মানুষ রূপেই পুজিত হন, তারপরে তিনি দেবতা হন, তারপরে তাঁকে জ্যোতিষ্ক রূপে কল্পনা করা হয়।
দেবতা 'ইন্দ্র' একাধিক এবং সকল ইন্দ্রই প্রথমে মানুষ ছিলেন, পরে দেবতা তারপরে সূর্য। ঋকবেদে, মানুষ, দেবতা আর সূর্য এই তিন রূপেই ইন্দ্রের কীর্তিকলাপ বর্ণিত হয়েছে।
কৃষ্ণ মানুষ, কৃষ্ণ নারায়ন, আবার কৃষ্ণই সূর্য।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমিও ধর্মহীন মানুষ। আমি মূলত ইতিহাসের প্রামাণ্যে জানতে চাই। যেমন যতদূর জানি, আর্যরা এই অংশে এসেছিল, তিনজন দেবতা নিয়ে, যার প্রধান ছিল ইন্দ্র, যাকে বলা হতো পুরন্দর। পুরন্দর মানে, যে পুর বা স্থঅপনা ভাঙে। আর্যরা যাযাবর ছিল, তারা এই অংশে এসে একানকার স্থাপনা ভাঙা এবং নগর ধ্বংশ করে। আর্য সেনাপতিকে বা বড় যোদ্ধাকে পুরন্দর অভিধা দেয়া হতো তাদের সেরা যোদ্ধঅর স্মরণে। সেই থেকে পুরন্দর, সেই থেকে ইন্দ্র। এরকম। এখানে রেফারেন্সটা দিতে পারছি না, মনে পড়লে দেব। যতদূর চানি ইতিহাস থেকে কিংবদন্তি, আর কিংবদন্তি থেকে মিথ খোনে দেব-দেবীর রাজত্ব। আমি মিথের তলায চাপা পড়া ইতিহাসটা জানতে চাই।
প্রত্যুত্তরের জন্য ধন্যবাদ।

স্বয়ম

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কথা ঠিক
পুরন্দর থেকে পুরোবাসী
ড. অতুল সুরের রচনাগুলো দেখতে পারেন
এই বিষয়গুলো বেশ তথ্যসহ আলোচনা করেছেন। সন তারিখ সহ

০২

প্রথম ইন্দ্রকে দেবরাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন সম্ভবত ঋষি অঙ্গিরা। খৃপূ ২ হাজার ২ শ সালের দিকে বক্ষু উপত্যকায় (আমু দারিয়া) বর্তমান তাজিকিস্তান
ইন্দ্র সেখানকার লোকজনকে খেদিয়ে দিয়েছিল। যারা পরবর্তীতে পরিচিত হয়েছে পার্শব বা পার্সিয়ান হিসেবে

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

২০০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের কাছাকাছি কোন এক সময়ে আর্যদের কয়েকটি গোত্র একত্রিত হয়ে 'ইন্দ্র' নামক এক সেনানায়কের নেতৃত্বে পরশুজন ও নিম্নমাদ্রজনের উপর আক্রমন করে তাদের অনেক পুরুষ এবং শিশুদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং রমনীগণকে তাদের অধীন করে নেয়।
কয়েক শতাব্দি পরে এই 'ইন্দ্র' দেবতা হিসাবে পূজিত হতে থাকে।

অনেক পার্শব ও নিম্নমাদ্র নরনারী প্রান বাঁচিয়ে বক্ষু উপত্যকা (তাজিকিস্তান) ছেড়ে পশ্চিম দিকে পালিয়ে যায়। তাদের বংশধরেরা পরবর্তিতে পার্শব (পার্সিয়ান বা ইরানী) এবং মাদ্র (মিডিয়ান) নামে পরিচিতি লাভ করে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ঠিক কথা
মাদ্রী ছাড়া মহাভারতে মিডিয়ানদের আর কোনো পাত্তা পাওয়া যায় না
কিন্তু পার্শবরা পুরা রাজত্ব করে মহাভারত জুড়ে
ভৃগু বংশের পুরোটাই পার্শব- শুক্র- চ্যাব- জমদগ্নী- পরশুরাম [পারস্যরাম?] এবং তার পরে শুক্রের মেয়ে দেবযানীর বংশধর কৃষ্ণ- কুন্তী- সুভদ্রা

এই বংশেই আরো হাজার বছর পরে আসেন জরথ্রুস্থ... পার্শিয়ান ধর্মের প্রবক্তা; যিনি অঙ্গিরা প্রবর্তীত পন্থাকে বলতেন 'অঙ্গর মৈনু/অশুভ পন্থা'

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ধন্যবাদ, মাহবুব লীলেন, বিস্তারিত লিখবার জন্য। আপনার বিশ্লেষণ থেকে নতুন দৃষ্টিকোন থেকে মহাভারতের পাঠ চলছে। চলুক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ধন্যবাদ স্যার

মন মাঝি এর ছবি

'মহাভারতের' কোন অনুবাদ বা ভাষ্যই পড়া হয়নি আগে পিটার ব্রুকের ছবিটা দেখা ছাড়া, এখন আপনারটা পড়ছি। চলুক

তবে জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেকুলার হিউম্যানিস্ট দৃষ্টিকোন থেকে লেখা মহাভারত, রামায়ন আর ভগবদ্‌গীতার উপর গবেষণা/প্রবন্ধ-ধর্মী তিনটা দারুন বই পড়েছিলাম এক সময়। পড়েছেন? আপনার লেখাটা শেষ করে (সবগুলি পর্ব) আবার পড়ব ভাবছি।

****************************************

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ওই বইটা পড়া হয়নি; আমি মূলত ইতিহাস আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বইগুলোকেই বেশি ঘাটাঘাটি করছি অতদিন

ওডিন এর ছবি

এক দফা এক দাবী

বই চাই। হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ডাক্তরসাব কি জানো যে কৃষ্ণ একজন উচ্চ মানের ডাক্তারও ছিল? অভিমন্যুর ছেলে যখন জন্মের পর নড়ে চড়ে না; কান্দেও না; তখন কিন্তু কৃষ্ণকেই ডেকে আনা হয়েছিল তাকে বাঁচানোর জন্য...

সেই যুগের সবচে বিখ্যাত সার্জনের নাম শুক্রাচার্য; যে আবার লোহার অস্ত্রের আঘাতে হওয়া ইনফেকশনের চিকিৎসা আবিষ্কার করেছিল; যাকে পুরাণে বলা হয়েছে মৃতসঞ্জীবনী; যা আবার দেবতারা জানত না বলে তাদের লোক মরচে পড়া তীরের একটু আঘাত পেলেই সগ্গবাসী হতো; আর শুক্রের দলের লোক চিকিৎসা নিয়ে আবার দৌড়াতো যুদ্ধের মাঠে...

তার বড়ো ভাই চ্যাবন; তার ভেষজ ওষুধ এখনো মানুষ ব্যবহার করে...

০২
বহুত সূত্র দিলাম। এইবার প্রাচীন হাড়জোড়া পদ্ধতির উপর একখান বই নামাইয়া ফালাও

অতিথি লেখক এর ছবি

বরং আমার দাবীটা সোজা, আলোচনা, এবং মূল লেখার সমন্বয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ বই হোক। এই তথ্যগুলো জানতাম না। ধন্যবাদ।

স্বয়ম

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দেখা যাক। দিল্লি এখনো বহু দূর

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

যারে ফালাইয়া দিছি তারে আর না কুড়ানোই ভালো-বড়োই হিসেবী চিন্তা। মন খারাপ
আর লেখার ব্যাপারে কী বলব? পিএইচডি, পোস্ট ডক পরে যদি আরও কিছু থাকে সেগুলোও বোধ হয় আপনার শেষ হয়ে গেছে এই মহাভারত নিয়ে.. অ্যাঁ

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আরে না। কিছু মানুষের রচনা পড়লে মনে হয় এখনো মহাভারতে সাতরাচ্ছি... কূল কিনারা পেতে আরো বহু দেরি

রিক্তা এর ছবি

এই সিরিজটা মনদিয়ে অনুসরন করছি। একটা অনুরোধ: রেফারেন্স গুলো একটু কষ্ট করে লেখার শেষে দেওয়া যায়? আর একটা প্রশ্ন: "..." এর ব্যবহার একটু বেশি মনে হলো। সেটা কি ইচ্ছাকৃত?

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দুয়েকটা জায়গায় রেফারেন্স দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু গপ্পের মাঝখানে ব্রাকেট দিতে বেখাপ্পা লাগে বলে আপাতত দিচ্ছি না..
একসাথে সব দিয়ে দেবো নে লেখা শেষ হলে। তবে লাইনে লাইনে দিমু না

০২

দাড়ি কমার ব্যবহার জানি না তো তাই ডট ডট দিয়া চইলা যাই; যাতে পণ্ডিতরা ইচ্ছামতো প্রুফ দেইখা নিতে পারে

রু এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে আমার মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আপনি লিখেন কীভাবে কে জানে। তার থেকেও বড় কথা প্রথম এই জিনিস যার মাথা থেকে বের হলো সে নিজে কী জিনিস ছিল!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই জিনিস যার মাথা থাইকা বাইর হইছে তার সম্পর্কে জানতে হলে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর 'মহাভারতের ছয় প্রবীণ; বইয়ের প্রথম অধ্যায় 'কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন' পইড়া নেন। আর তারপর ৩৮খান পুস্তক নিয়া তার রচনাবলী পইড়া নিতে পারেন [১৮খান পুরাণ; ১৮ খান উপপুরাণ; বেদান্ত এবং মহাভারত]

অতিথি লেখক এর ছবি

গুরু দারুণ হইছে

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এক বছর আগে লিখছিলাম কুন্তীরে নিয়া তৃতীয় পর্ব। চতুর্থ পর্ব শেষ করলাম আজ...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।