একটি বিলম্বিত স্মৃতিচারণ যা ২৩ বা ২৪ এপ্রিলে করা যেতো

মাহবুবুল হক এর ছবি
লিখেছেন মাহবুবুল হক (তারিখ: শনি, ২৬/০৪/২০১৪ - ৪:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ব্রুসলি অথবা কৈশোরের নায়কের বিদায়:

মাঝারির চেয়ে একটু খাটো হালকা গড়নের মানুষটা শর্টস্লিভ গেঞ্জি পরতো। চোখে সানগ্লাস, পায়ে কেডস। হাতে থাকতো ব্রেসলেট। বেশ দুলিয়ে দুলিয়ে চলতো। একটু বেশি-ই। এই চলাটা পছন্দ করতো না অনেকেই। বিশেষ করে যারা সমবয়সী বা বড় তাদের চোখে এতটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলা রীতিমত মাস্তানী বা বেয়াদবির পর্যায়েই পড়তো। কিন্ত ছেলেটা নির্বিকার,ডোন্ট-কেয়ার ভাব সবসময়। তার সামান্যতম বাড়তি মেদহীন শরীর মার্শাল আর্টের কিংবদন্তী নায়ক ব্রুসলীর কথা মনে করিয়ে দিত। ছেলেটা দুর্দান্ত কারাতে জানতো কিন্তু স্বভাবে বিনয়ী, অসম্ভব লাজুক। বিকেলে কখনো, কখনো তীব্র রোদে দুপুরের খাঁখাঁ মাঠে দুজনকে দেখা যেত হাত-পায়ের শৈল্পিক ওঠা-নামা আর শরীরের এ্যাক্রোবেটিক লাফ-ঝাঁপে এক অশান্ত অবর্ণনীয় পরিবেশ তৈরি করতে। দ্বিতীয় জন তার একাত্মা বন্ধু টিপু, শিষ্যও বটে। বন্ধুত্ব মানে একেবারে একমেবদ্বিতীয়ম্। এ পাড়া ও পাড়ার মানুষ মনে করে নাজির-টিপু শুধু মারামারি করে বেড়ায়। মনে করে টোঁ টোঁ করে ঘুরে বেড়ানোই তাদের কাজ, ভবঘুরের খাতায় নাম লেখানো শুধু বাকি। তবু সেই স্টাইলিস্ট ছেলেটাকে ছায়ার মত অনুসরণ করে এক মুগ্ধ কিশোর। নাজির-টিপুকে একসাথে কারাতের এ্যাকশনে দেখা তো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। যেন রূপালি পর্দার চরিত্রগুলো চোখের সামনে নড়ছে; হঠাৎ সামনে এসে পড়েছে স্বপ্নের ব্রুসলি, জিম ক্যালি, চাক-অরিস। এসব নাম সে নাজিরের মুখ থেকেই শুনেছে। শুনেছে আরো অনেক কাহিনি। তার কতটা সত্যি! সবটাই। অন্তত সেই সময় যখন ব্রুসলির ভিউকার্ড কিনতে ২টাকা লাগতো এবং মা-র কাছে তা চাইবার মত বয়সই সেই কিশোরের হয়নি । তাই নাজিরই তার কাছে ব্রুসলির সাক্ষাৎ অবতার। টিপু জিমক্যালির হুবহু নকল। কতবার নাজিরের সুঠাম পেশি আর শূন্যে পা ছোঁড়ার কারুকাজ দেখতে গিয়ে সেই কিশোর তাঁর বন্ধু-বান্ধবের গণ্ডী পেরিয়ে, বাবা-মার শাসনের ভয় এড়িয়ে চলে গেছে দূরে বা এমন কোথাও যেখানে সে অবাঞ্ছিত। কিন্তু এক নিষিদ্ধ শক্তি অর্জনের হাতছানি বা এমন কিছু একটা সেই কিশোরকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে নানান অলিগলিতে, বিচিত্র সব ঘেরাওয়ের মধ্যে অচেনা আকাশের নিচে। সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা আজ আর নেই। গত বৃহষ্পতিবার (২৪/৪/১৪) আমার অজেয় ব্রুসলি,নাজির ভাই, ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে আবার জানিয়ে দিয়ে গেছে, অসাধারণ সে-ই যে মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারে।

বিপ্রতীক ফারুক সিদ্দিকী

ফারুক সিদ্দিকীকে খুব মনে পড়ে। প্রায় সব পাকা চুলের ধীরগামী এক বৃদ্ধ মফঃস্বলের মন্থরতা গায়ে মেখে সাতমাথা থেকে শেরপুর রোডের দিকে এগিয়ে আসছেন। মুখে পান থাকতো মনে হয়। আজ এতটা স্পষ্ট করে বলতে পারছি না। তবে দেখা হলেই যে লেখালেখির খবরটা নিতেন তাতে কোন ভুল নেই। ফারুক ভাই বহু বছর ধরে ‘বিপ্রতীক’ নামে একটা সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন। আমরা আধুনিকতার মোড়কে যাকে লিটলম্যাগ বলে জাতে তুলেছি তেমন একটি পত্রিকা, আহামরি কিছু নয়। কিন্তু প্রথম যখন সরকার আশরাফের মাধ্যমে তার সাথে আমার পরিচয় তখন এই ‘বিপ্রতীক’ সম্পাদক পরিচয়টিই আমাকে বিস্মিত করেছিল। কারণ ফারুক ভাইয়ের বয়স বিবেচনায় লিটলম্যাগ প্রকাশের কাজটি ঠিক মেলে না। আরো অবাক হয়েছিলাম যখন জানলাম পত্রিকাটা তিনি প্রায় ২৫-৩০ বছর ধরে বের করছিলেন, অবশ্য অনিয়মিত। আমি এমন এক প্রৌঢ়াবয়ব যুবকের উদ্যম ও উৎসাহ দেখে অবাক হয়েছিলাম। যে কেউই হতো। ২০০৭ সালে প্রথম জাতীয় লিটল ম্যাগ উৎসব ও মেলায় আজীবন সম্মাননা পুরস্কার দেয়া হয় ফারুক সিদ্দিকীকে। আমি পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠানে ইতস্তত ঘুরছি। ভাবলাম ফারুক ভাইয়ের সাথে অনেক দিন পর দেখা হচ্ছে তাহলে। কিন্তু আমাকে যখন জানানো হল. ‘ফারুক ভাই আসেননি অসুস্থতাবশত, পুরস্কারটি তাঁর পক্ষে আমাকে নিতে হবে’ আমি তখন যুগপৎ হতাশ ও গর্বিত হয়েছিলাম। লিটলম্যাগ সম্পাদনা শুধু নয়, একটি সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশের জন্য তাঁর নিরন্তর অান্তরতাড়না, মমতা আর দায়িত্ববোধের যৌথত্বে অপূর্ব । ফারুক ভাইয়ের সেই মুখ দেখিনি প্রায় এক যুগ। আর দেখবোও না কখনও। এই তো সেদিন খবর এলো তিনি একপ্রকার নিঃসঙ্গ, সেবাপরিজনহীন জীবনের সীমা অতিক্রম করেছেন। ফারুক সিদ্দিকীকে আমার লেখা দেয়া হলো না কখনো, বিপ্রতীক-এর শেষ সংখ্যাটি বেরিয়ে গেছে।


মন্তব্য

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

বি দায়....

ভালো লিখেছেন।

এক লহমা এর ছবি

শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

শ্রদ্ধা

____________________________

মেঘলা মানুষ এর ছবি

যদিও তাঁদের দেখিনি, চিনিনি; তবুও আপনার বর্ণনা থেকে বোঝা যায় কতটা প্রাণশক্তিতে ভরা ছিল তাদের মন।
শ্রদ্ধা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।