দ্য অ্যালকেমিস্ট-৭

মামুন হক এর ছবি
লিখেছেন মামুন হক (তারিখ: বিষ্যুদ, ০১/১০/২০০৯ - ৪:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

the_alchemist

দ্য অ্যালকেমিস্ট-৬

কেউ একজন তাকে ধাক্কিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিল। বাজারের মাঝেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সময় হয়ে গেছে বাজার আবার বসার।

চারদিকে তাকিয়ে পুরানো অভ্যাসবশত ভেড়ার পালের সন্ধানে চোখ বুলাতে গিয়ে তার মনে পড়ল সে এখন অন্য এক পৃথিবীর বাসিন্দা। কিন্তু তাতে করে কষ্ট পাওয়ার বদলে সে খানিকটা আনন্দিতই হলো। তাকে আর কোনদিন ভেড়া গুলোর জন্য ঘাস-পানি ইত্যাদির খোঁজে ব্যস্ত হতে হবেনা, বরং নিজের ভাগ্য বদলের গুপ্তধনের অভিযানে মনপ্রাণ দিয়ে খাটতে পারবে। তার পকেটে ফুটো পয়সাটিও নেই, কিন্তু অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। গত রাতেই সে নিজের সাথে ফয়সালা করেছে, বইয়ে পড়া গল্পের চরিত্রগুলোর মতোই সে একজন দুঃসাহসী অভিযাত্রী হবে।

ছেলেটি ধীর পায়ে বাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। দোকানীরা এখনও দোকান সাজাতে ব্যস্ত। সে একজন মিঠাইওয়ালাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। মিঠাইওয়ালার মুখে হাসি, সুখী চেহারা –সে বাঁচার মর্ম বোঝে এবং আরও একটা ব্যস্ত দিনের জন্য প্রস্তুত। তার হাসিমুখ ছেলেটিকে সেই বৃদ্ধ রাজার কথা মনে করিয়ে দিল।

‘মিঠাইওয়ালা নিশ্চয়ই মিষ্টি এ কারণে বানায় না যাতে করে সে আরেকজন দোকানীর মেয়েকে বিয়ে করতে পারবে, সে বানায় কারণ এটাই তার করতে ভালো লাগে,’ –ছেলেটি ভাবে।

তার মনে হলো বৃদ্ধ রাজার মতো মানুষের ভবিষ্যত সে নিজেও যেন খানিকটা বুঝে নিতে পারছে—তাদের দিকে এক পলক তাকিয়েই। ব্যাপারটা জটিল কিছুনা, যদিও আমি এ ধরনের কিছু আগে কখনই করিনি—সে উপলদ্ধি করে।

দোকান সাজানো হয়ে গেলে মিঠাইওয়ালা ছেলেটিকে দিনের প্রথম মিষ্টিটি খেতে দিল। দোকানীকে ধন্যবাদ জানিয়ে মিষ্টিটা খেয়ে সে আবার পথে নামল। অল্প কিছুদূর গিয়ে তার মনে পড়ে যে দোকান সাজানোর সময় তাদের একজন কথা বলছিল স্প্যানিশে আর আরেকজন আরবীতে।

কিন্তু তারা পরিস্কারভাবে একে অপরকে বুঝতে পারছিল।

নিশ্চয়ই এমন ভাষাও পৃথিবীতে রয়েছে যা শব্দের উপর নির্ভর করেনা, তার মাথায় ভাবনা ভর করে। ভেড়ার পালের সাথে আগেই আমার সে ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর এখন তা ঘটছে মানুষের সাথেও।

সে নতুন অনেক কিছু শিখছিল। কিছু কিছু জিনিষের অভিজ্ঞতা তার আগেই হয়েছে, কিন্তু উপলদ্ধি হয়নি। হয়তো অভ্যস্ততার কারণেই সেগুলো তার মনে তেমন ভাবে দাগ কাটেনি। এখন সে বুঝতে পারছেঃ যদি আমি শব্দের ঘেরাটোপের বাইরে গিয়েও ভাষাকে বুঝতে পারি, আমি গোটা পৃথিবীটাকেই বুঝতে শিখে যাব।

‘এক পর্যায়ে সবকিছু মিলে এক হয়ে যায়’—বৃদ্ধ রাজা বলেছিলেন।

***
স্ফটিক ব্যবসায়ী সেদিন সকালেও আর সব দিনের মতো একঘেয়ে উদ্বেগ নিয়ে ঘুম থেকে উঠলেন। একই জায়গায় তার গত ত্রিশটা বছর কেটে গেছেঃ পাহাড়ি রাস্তার চূড়ায় বসানো তার দোকানে, যেখানে কালেভদ্রে দু’একজন খদ্দেরের পা পড়ে। এখন আর কোন কিছু অদল বদল করার সময় নেই, এতকাল ধরে তিনি কেবল একটি কাজই শিখেছেন—স্ফটিক বা পুরু কাচের তৈরী তৈজসপত্রের বিকিকিনি। একটা সময়ে তার দোকান খদ্দেরে সরগরম থাকতঃ আরব ব্যবসায়ী, ফরাসী এবং ইংরেজ ভূতত্ত্ববিজ্ঞানী, সুসজ্জিত জার্মান সৈন্য—আরও অনেকে। ঐ দিনগুলিতে কাচের জিনিষের ব্যবসা ছিল জমজমাট, ধনী হবার আর সুন্দরী স্ত্রীকে পাশে নিয়ে জীবন কাটানোর সুখ স্বপ্ন তার হাতের একেবারে নাগালে বলে মনে হতো।

কিন্তু সময়ের সাথে তাঞ্জিয়ের অনেক বদলে গেছে। পাশের শহর সেউতা উন্নতিতে তাঞ্জিয়েরকে পেছনে ফেলে দুদ্দাড় সামনে চলে যাওয়াতে এখানকার ব্যবসা মার খেয়ে যায়। প্রতিবেশীরা অনেকেই ঐ শহরে চলে গেছেন, পড়ে রয়েছে শুধু দু’চারটা ছোট ছোট দোকানপাট। রয়ে যাওয়া মাত্র গুটি কয়েক দোকানে কেনাকাটা করতে খদ্দেররা আর পাহাড় ডিঙ্গাতে উৎসাহী নন।

কিন্তু স্ফটিক ব্যবসায়ীর আর কোন উপায় ছিলনা। ত্রিশ বছর ধরে এক ধরনের ব্যবসা চালানোর পর হুট করে নতুন কিছু শুরু করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি সারা সকাল ধরে দোকানের সামনের রাস্তায় ইতস্তত পথচারীদের চলাফেরা তাকিয়ে দেখলেন । আজ অনেক বছর যাবৎ তিনি তাদের আসা-যাওয়া দেখে আসছেন, কে কখন কোথায় যায় তাও তার জানা হয়ে গেছে। কিন্তু দুপুরের খাবারের বিরতির ঠিক সামান্য আগে, অচেনা একটি ছেলে এসে দোকানের সামনে থামলো। ছেলেটির গায়ের পোষাক চলনসই, কিন্তু অভিজ্ঞ চোখে তাকিয়ে ব্যবসায়ী বুঝতে পারলেন যে কেনাকাটার সামর্থ তার নেই। তবুও তিনি ছেলেটার চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে সিদ্ধান্ত নিলেন।

***
দোকানের দরজায় এখানে বহুভাষা চর্চার একটা ঘোষনা ঝোলানো আছে। ছেলেটি লেনদেনের জায়গাতে ব্যবসায়ীকে দেখতে পেল।

‘আপনি চাইলে আমি জানালার পাশের ঐ কাচের জিনিষগুলোকে ঝেড়ে-মুছে পরিস্কার করে দিতে পারি। এ রকম ধূলোমাখা অবস্থায় পড়ে থাকলে ওগুলো কেউ কিনতে চাইবে বলে মনে হয়না’—ছেলেটি বলে।

ব্যবসায়ী কোন জবাব দিলেন না।

‘এর বদলে আমাকে কিছু খেতে দিলেই চলবে’ ।

এবারও কোন জবাব আসলনা। ছেলেটু বুঝতে পারল যে তার নিজেকেই এখন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার ব্যাগ থেকে মরুভূমিতে প্রয়োজন পড়বেনা এমন একটা কাপড় বের করে সে কাচগুলো মুছতে শুরু করল। আধা ঘন্টার মধ্যেই সে জানালার পাশের তাকের সব কাচের জিনিষ মুছে ফেলল, আর মোছামুছি চলার সময়টাতেই দুইজন খদ্দের এসে কিছু কেনাকাটা করলেন।

পরিস্কার করা হয়ে গেলে সে লোকটিকে জানালো যে সে ক্ষুধার্ত।

‘চলো কিছু খেয়ে আসা যাক’—ব্যবসায়ী এবার মুখ খুললেন।

খাবারের বিরতির নোটিশ দরজার ঝুলিয়ে তারা পাশের একটা ছোট সরাইখানায় গেল। তারা একটা টেবিল খুঁজে নিয়ে বসতেই স্ফটিক ব্যবসায়ী হেসে ফেললেন।

‘তোমার এত কষ্ট করার কোন দরকার ছিলনা, কোরান আমাকে এমনিতেই ক্ষুধার্তকে খাওয়াতে নির্দেশ করে’ –তিনি বললেন।

‘তাহলে আপনি আমাকে থামালেন না কেন?’—ছেলেটি জানতে চাইল।

‘কারণ কাচগুলো ছিল ধূলোয় ঢাকা । আর আমাদের দুজনের মন থেকেই বাজে ভাবনাগুলোকে দূর করার প্রয়োজন ছিল’ ।

খেতে খেতে হঠাৎ ব্যবসায়ী ছেলেটিকে বললেন, ‘ আমি তোমাকে আমার দোকানে কাজ দিতে চাই। তুমি ঝাড়-মোছ করার সময়টাতে দু’জন ক্রেতা এসেছিলেন, এটা একটা শুভ লক্ষণ’ ।

লোকেরা বুঝুক বা না বুঝুক, দৈব ইশারা নিয়ে অনেক কথা বলে—রাখাল ছেলেটি ভাবল। আমি যেমন বুঝিনি যে এত বছর যাবৎ আমি আমার ভেড়ার পালের সাথে শব্দহীন এক ভাষায় আলাপ করে এসেছি।

‘তুমি কি আমার দোকানে কাজ করবে’?—ব্যবসায়ী প্রশ্ন করলেন।

‘আমি আজকের পুরো দিনটা কাজ করতে পারি। প্রয়োজনে সারারাত কাজ করে প্রতিটা কাচের জিনিষ মুছে পরিস্কার করে দেব, কিন্তু বিনিময়ে আমাকে আগামীকাল ভোরে মিশরে যাবার পথখরচ দিতে হবে’ --ছেলেটি জবাব দেয়।

ব্যবসায়ী হেসে উঠলেন। ‘ তুমি যদি আগামী পুরো এক বছর আমার দোকানে কাজ কর, এমনকি আমি যদি তোমাকে প্রতিটা কাচের জিনিষ বিক্রির উপরে লাভের অংশও দেই, তবুও মিশরে যাবার খরচ যোগাতে তোমাকে ধার কর্জ করতে হবে। মিশর এখান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে’ ।

মুহূর্তের জন্য দু’জনের মাঝে এমন গভীর নিস্তব্ধতা নেমে এলো যে মনে হচ্ছিল পুরো শহরটাই ঘুমিয়ে গেছে। বাজারে শুনশান নীরবতা, দোকানীদের মাঝের তর্ক-বিতর্ক থেমে গেছে, মিনারে মুয়াজ্জ্বিনও মৌন। আর কোন আশা নেই, দুঃসাহসিক অভিযাত্রা নেই, নেই কোন বৃদ্ধ রাজা বা নিয়তির ডাক, গুপ্তধন নেই, এবং কোন পিরামিডও নেই— মনে হলো ছেলেটির আত্মার মতো সমস্ত পৃথিবীও নীরব হয়ে গেছে। সে নির্বাক চোখে সরাইখানার দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল, মনে হলো এভাবে তিলে তিলে কষ্ট পাওয়ার চাইতে মরে গেলেই বোধহয় সব যন্ত্রণার স্থায়ী অবসান ঘটত।

ব্যবসায়ী উদ্বিগ্নচোখে ছেলেটির দিকে তাকালেন, পুরোদিনের আনন্দ যেন এক নিমেষেই হারিয়ে গেছে ওর চোখ-মুখ থেকে।

‘আমি তোমাকে দেশে ফিরে যাবার খরচপাতি দিতে পারি বাবা’—তিনি স্নেহভরে বললেন।

ছেলেটি কোন কথা বললনা, উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ হাতে নিল।

‘আমি কাজ করব আপনার দোকানে’ ।

তারপর আরেকটা অস্বস্তিকর নাতিদীর্ঘ নীরবতার পর সে যোগ করল—‘ভেড়ার পাল কিনতে আমার কিছু টাকার দরকার’।
( প্রথম খন্ড সমাপ্ত)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো। দারুণ হয়েছে, দ্বিতীয় খন্ডের অপেক্ষায় থাকলাম।

ধন্যবাদ।

দলছুট।

মামুন হক এর ছবি

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ হাসি

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

নতুন করে তেমন কিছুই বলার নেই। শুরু থেকে তো ব'লেই আসছি এটা নিয়ে অনেক কিছু!
জানিয়ে গেলাম যে প'ড়ে গেলাম। আর ভালোও লাগলোই। পাওলো মামা'য় এত বেশি মিস্টিক! ইয়ে, মানে...

___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

মামুন হক এর ছবি

আপনে আশে পাশে আছেন বলেই না এইসব হাবিজাবি লেখার সাহস পাই, জানি ভুল ত্রুটি দেখলে শুধরে দেবেন।

রেনেসাঁ [অতিথি] এর ছবি

দারুণ। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

মামুন হক এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

পড়লাম শুরু থেকে। একদম শেষ করেন। তারপর ডিটেইল আলোচনা করবো।

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

মামুন হক এর ছবি

ওকে ব্রো, তাই হোক।

সাইফ তাহসিন এর ছবি

ভালো লাগল, তাড়াতাড়ি দেন পরের পর্ব। খালি ভুলে যাই, আগে কি হইছিল

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

মামুন হক এর ছবি

সচলে আর আসবেনা এই অনুবাদ, বাকিটা একবারে পাইবা। তখন আর কষ্ট হবেনা হাসি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

ছেলেটার সাথে আমার মিল পাই, সেই ছোটবেলা থেকেই আমারও মিসর যাওয়ার শখ। পিরামিড, স্ফিংক্স দেখতে চাই। জানি না সেই (সৌ)ভাগ্য আদৌ হবে নাকি...

অনুবাদ ভাল্লাগল। কিন্তু এতো দেরিতে পোস্ট দিলে, আগের কাহিনী সত্যিই মনে থাকে না পুরাপুরি। অখণ্ড পিডিএফ আকারে চাই, দাবি জানাইলাম। সেইটা পড়ার পর একদম বিস্তারিত একটা মন্তব্য করার আশা রাখি। হাসি

মামুন হক এর ছবি

এই ছেলেটার সাথে আমি আমারও মিল পাই হাসি
সচলে আপাতত আর এই অনুবাদ দেবনা, বাকী অংশটুকু শেষ করে ঘষা মাজা শেষে জায়গা মতো পৌছে দেব।

এনকিদু এর ছবি

Omen এর বাংলা 'দৈব ইশারা' টা খুব ভাল হয়েছে । আজকেই প্রথম খেয়াল করলাম ব্যপারটা ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

মামুন হক এর ছবি

যাক তোমার কাছ থেকে অবশেষে একটা প্রশংসা পাওয়া গেল হাসি
ধন্যবাদ কদু ভাই!

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

পুরাটা লেখে পাঠায়া দিস দোস্ত। তোর বই না পড়লেও শেলফে থাকা দরকার, কি বলিস হো হো হো

মজা করলাম। প্রথম দিকের কয়েকটা পড়েছিলাম, ভালো লাগছে। তাই বাকীটা অবশ্যই পড়তে চাই।

মামুন হক এর ছবি

আচ্ছা দোস্ত পাঠিয়ে দিব হাসি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমি পুরাডা একবারে পড়ুম...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মামুন হক এর ছবি

আইচ্ছা...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।