স্মৃতিতে মন্টু ভাই

মামুন হক এর ছবি
লিখেছেন মামুন হক (তারিখ: শনি, ২৭/০৩/২০১০ - ১০:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচন। ঢাকা ছয় আসনে জামাতের প্রার্থী ছিল আব্বাস আলী খান। তার শেষ নামের সাথে একটা অতিরিক্ত ‘কি’ যোগ করে অ্যান্টি জামাত মিছিল করতাম আমরা পাড়ার পুঁচকেরা। মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ি এতটা রাজনৈতিক সচেতনতা বা গালি বিষয়ক সৃজনশীলতা আমাদের থাকার কথা না, কিন্তু যার বদৌলতে আমরা কচিকাঁচারা দলবেঁধে রাস্তায় নেমে এসেছিলাম তিনি আমাদের মন্টু ভাই।

মন্টু ভাই শরীয়তপুরের লোক, অনেকটা ধুমকেতুর মতোই তার আবির্ভাব ঘটেছিল আমাদের পাড়ায়। আমরা থাকতাম ঢাকার গোড়ানে। মন্টু ভাই আমার বাল্যবন্ধু রাসেলের খালাতো ভাই। কথ্য ভাষায় কথা বলতেন, বিস্তর মুখ খারাপ করতেন, আর মুখের আগে প্রায়ই হাত চলতো তার। উনি এসেই মফস্বলী কায়দায় পাড়ার আণ্ডা-বাচ্চাদের সব একসাথে করে ফেললেন। পিপি তোর মনে আছে কিনা জানিনা, তুই যেই বাসায় ছিলি কিছুদিন, সে গলির শেষ মাথায় একটা মজা পুকুরের পাশে খানিকটা খালি জায়গা ছিল। মন্টু ভাই সেখানে আমাদের দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করিয়ে ব্যাডমিন্টনের কোর্ট কাটালেন। তারপর নভেম্বর মাস আসতেই সেখানে চলতো জমজমাট টুর্নামেন্ট। আমাদের আরেক বন্ধু ছিল লুৎফর নামে, সে ছোটবেলা থেকেই নাটক লেখা, অভিনয় ইত্যাদিতে খুব উৎসাহী ছিল। মন্টু ভাই তাকে দিয়ে লেখাতেন বিজয় দিবসের নাটক, আমরা সবাই মিলে গাছতলায় সেই নাটকের মঞ্চায়ন করতাম, সত্যিকার মঞ্চ ছাড়াই।

ফেব্রুয়ারী মাস আসলে শহীদ মিনার বানানো, ফুল জোগাড় করা, দেয়াল পত্রিকা লেখা, আঁকা ইত্যাদি নিয়ে রাত জাগার অনুমতি মিলতো মন্টু ভাইয়ের দেন দরবারে। উনি ঘরে ঘরে গিয়ে বলতেন আমার সাথে থাকবে, আমি দেখে রাখবো। আমাদের বাবা-মায়েরাও তাকে খুব ভালোবাসতেন, তার হাতে আমাদের দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতেন। সেই দিনগুলিতে ২০শে ফেব্রুয়ারীতে সারারাত জাগার যে উত্তেজনা, আর প্রভাতফেরীর যে আনন্দ তার বর্ণনা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।

মন্টু ভাই জানতেন যে ছেলেপেলেদের সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে না পারলে ওরা বখে যেতে পারে। তাই উনি আমাদের নিয়ে ফুটবল ক্লাব বানালেন, পাঁচ নাম্বার মিকাসা বল, ক্রিকেটের সত্যিকারের ব্যাট আর ‘কাঠের’ বল কিনে দিলেন। আমি শুরুর দিকে খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না, কিন্তু এক বিষ্যুদবারে স্কুলে যাবার পথে মন্টু ভাই পাকড়াও করলেন। পাড়ায় অনুর্ধ্ব ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি ছেলেদের ফাইভ এ সাইড ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছে, ওনার দলে একজন প্লেয়ার শর্ট। আমাকে বললেন একদিন স্কুল কামাই দিলে কিছু হয়না, তুই মাঠে চল। আমি মাঠে গেলাম, নোক্কা শটে ( টো কিক) কীভাবে যেন একটা গোল করে দলকে জিতিয়েও দিলাম। খেলাশেষে আমাকে বিশেষ একটা পুরুষ্কার দেয়া হলো , ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের কাপ। ভেতরে দু’টা চকলেট। আমি কী যে খুশী হয়েছিলাম। সে শুরু, এর পর থেকে আমি খুব নিয়মিতভাবে খেলতে নামতাম। মন্টু ভাই আমার প্রতিভা দেখে নিয়ে গেলেন বাসাবো ক্লাবে, ওখানে প্রায় বছর দুয়েক সিরিয়াস প্রশিক্ষন নেই। সে আরেক ইতিহাস, আরেকদিন বলা যাবে।

আমাদের পাড়ায় হুট করে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে অল্পদিনেই অনেক শত্রু দাঁড়িয়ে গেল। মন্টু ভাই পাঁড় আওয়ামী লীগার ছিলেন। শরিয়তপুরে ছাত্রলীগের নেতা, বঙ্গবন্ধুর নামে অজ্ঞান। তাকে বলতে শুনেছি... ‘বুকের উপরে দিয়া পাঁচটনী ট্রাক গেলেও বলুম জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। তার বিরুদ্ধে পাড়ার বিএনপি পন্থী এবং জামাত সমর্থকেরা অনেকটা একজোট হয়ে নানা কথা ছড়াতে লাগলো। এর মধ্যে কিছু সীমাহীন নোংরামিও ছিল (যেমন ওনাকে শিশুকামী বলে প্রচার করা), এখনও মনে পড়লে রাগে গা রি রি করে। তবে এমনিতে উনি খুব মারদাঙ্গা ধরনের লোক থাকায় কেউ সরাসরি কিছু করতে বা বলতে সাহস পেতনা। একটা ঘটনা আমার মনে গভীর ছাপ রেখে গেছে। আমার বাবা সরকারী চাকরি করতেন, ওয়াসাতে। তো তাকে প্রায়ই বিভিন্ন জায়গায় পানির লাইন স্থাপন, সংস্কার ইত্যাদি কাজের দেখভাল করতে হতো। একবার তার দায়িত্ব পড়লো আমাদের পাড়ার পাশেই। কিন্তু কাজ আধাআধি অবস্থায় বাবা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন, স্থানীয় গুণ্ডারা চাঁদা না দিলে লাশ ফেলে দিবে জাতীয় হুমকি দেয়ায়। মন্টু ভাই সব শুনে আমাদের বাসায় আসলেন। এসে বাবাকে বললেন, দাদা আপনি চলেন আমার সাথে, আমি দাঁড়ানো থাকবো আপনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত। দেখি কোন বাপের ব্যাটা আসে ঝামেলা করতে।

মনে হয় সেইদিনের ঘটনা। অথচ ২৩ বছর পেরিয়ে গেছে। মনে পড়ে মন্টু ভাই তার সাদা লুঙ্গীতে কাটা রাইফেল লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, আর আমার বাবা ভীত চোখে চারদিকে নজর রাখছেন। কেউ আসেনি ঝামেলা করতে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে মন্টু ভাই তার শত্রু সংখ্যা আরও অনেক বাড়িয়ে ফেললেন।

যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি , তখন হঠাৎ করে খেয়াল করলাম পাড়ায় শিবিরের ছেলেপেলের ব্যাপক আনাগোনা। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ছেলেপেলেদের ধরে ধরে মসজিদে নিয়ে যাচ্ছে। হামদ , নাত, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদির প্রতিযোগিতার আয়োজন করে দারুণ সব পুরুষ্কার দিচ্ছে। আমি নিজেও গিয়েছিলাম সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতায়। কিন্তু পুরুষ্কারের বইয়ের সাথে দেয়া হলো একটা সদস্য ফর্ম। সেটা দেখে মন্টু ভাই জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মতো আমাকে চড় মারলেন, খুব গালি গালাজও করলেন। মনে আছে বরিশালের ভাষায় বলেছিলেন, ‘ তুই ওহনে গেছ কা হালার পো হালা? কারে জিগাইয়া গেছ? আবার যদি দেহি কোনদিন গেছ তাইলে টেংরি ভাইঙ্গা হাতে ধরাইয়া দিমু।’ গালাগাল আর চড় খেয়ে মন খারাপ করে বাড়ি চলে এসেছিলাম, আর কোনদিন মসজিদে কোন অনুষ্ঠানে যাবনা, মন্টু ভাইয়ের কাছেও যাবনা সিদ্ধান্ত নিয়ে। না মেরে বুঝিয়ে বললেও পারতেন। তাও আবার মারছিলেন পাড়ার মুদী দোকানের সামনে।

সন্ধ্যায় উনি আমাদের বাসায় আসলেন। বাবার সাথে অনেক কথা হলো। তারপর দুইজনে মিলে আমাকে ডেকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় বোঝালেন যে শিবিরের কার্যকলাপ খুবই জঘন্য, এরা রাজাকারের বংশধর, আমি এবং আমার বন্ধুরা যেন এদের থেকে শতহাত দূরে থাকি। আমি সায় দিলে, বাইরে নিয়ে গিয়ে ভাপাপিঠা আর চা খাওয়ালেন।

কিন্তু এর পরের বছরগুলোতে শিবিরের দৌরাত্ম আরও বাড়তে লাগলো। আর ওদের সাথে আমাদের তিক্ততা প্রাথমিক গালাগালির পর্যায় ছেড়ে হাতাহাতিতে রূপ নিতে থাকলো। দুঃখজনক ঘটনা হলো ছোটবেলার অনেক খেলার সাথীই রাস্তা হারিয়ে শিবিরের সাথী হয়ে গেল, আর ওদের চোখে মন্টু ভাই আর আমরা সব সাক্ষাৎ শয়তানের চ্যালা। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে গেল যে আমরা একা একা চলাফেরাই বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলাম। একবার আমাকে একা পেয়ে ওদের কয়েকজন মারধোর করলো, আবার আমি ওদের একজনকে সুযোগমতো পেয়ে শোধ তুললাম। এখন যেমন এক ব্লগের লোকজন অন্য ব্লগে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে, তখন সে ধরনের সুযোগও ছিলনা, এক ব্লকের ছেলেপেলে অন্য ব্লকে গেলেই ছ্যাচা। মন্টু ভাই পাড়ায় ‘অনিকেত সংসদ’ নামে একটা ক্লাব করেছিলেন, আমরা খেলাধুলার সরঞ্জামের পাশাপাশি হকিষ্টিক, নান চাকু ইত্যাদির মজুদ রাখতাম।

সাতাশি না অষ্টাশি সাল থেকেই শিবিরের পাশাপাশি আরেকটা নতুন উপদ্রবের আবির্ভাব হয় ঢাকা শহরে, ফ্রিডম পার্টি নামে। কর্ণেল ফারুক-রশিদের সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল ছিল সেটা। ষণ্ডা-পাণ্ডা গোছের কেউ ওদের কাছে গেলেই অস্ত্রপাতি ধরিয়ে দেয়া হতো। আয়রনিক হলেও সত্য ঐ সময়ে গোড়ান-খিলগাঁও-শাহজাহানপুরে ফ্রীডম পার্টির টপ সন্ত্রাসীর নাম ছিল মামুন, আবার আমাদের পাড়ার শিবিরের পাতি নেতার নামও ছিল মামুন। এরা নিজেদের মধ্যে যোগসাজশে বিপুল আগ্নেয়াস্ত্রের যোগান পেয়ে গেল। আমরাও ভাবতে শুরু করেছিলাম পিস্তল বা রিভলভার যোগাড় করার ব্যাপারে। কিন্তু মন্টু ভাই এক ধমকে আমাদের থামিয়ে দিয়েছিলেন। ‘ তোগো কাম পড়ালেহা করা তাই করবি, ঐ হালারা এদিকে আইলে আমি বাইরামু কুড়াল লইয়া , তোরা ঘরে থাকবি।’ আমরা ঘরেই ছিলাম, থাকতাম। সে সময়টা বড়ই অস্থির ছিল। চারদিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি, কুখ্যাত সব গুণ্ডার অধিকারে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অঞ্চল। ৭০’ দশকের হিন্দি সিনেমার স্টাইলে এক মহল্লার গুণ্ডারা আরেক মহল্লায় রেইড দিত। পঞ্চাশ থেকে একশজনের বাহিনী নিয়ে, লুটতরাজ করতো, ভাঙচুর করতো। সেসব নিয়েও আরেকদিন লেখা যাবে। অনেক কথা।

৯০ এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও মন্টু ভাই ছিলেন সক্রিয়। আসলে আমাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল অনেক দিন, প্রায় পুরো ৮৯ সালটাই। ওনার খোঁজে আর্মি না মিলিশিয়া কারা যেন এসেছিলো শোনার পর উনি আর পাড়ায় ফেরেননি। এরশাদ পতনের পর আমরাও গ্রাম থেকে ফিরলাম আর উনিও পাড়ায় ফিরে আসলেন। জানালেন ইউনিভার্সিটির কোন হলে থেকে আন্দোলনের অংশ হয়ে ছিলেন এতদিন। ফেরার পরেও তার ব্যস্ততা কমলোনা। আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে তখন যে যার মতো মরিয়া। শিবিরের পাণ্ডারাও কাছা খুলে মাঠে ময়দানে। আমাদের সাথে টুকটাক ঝগড়াঝাঁটি, হম্বি তম্বি ইত্যাদি ঘটলেও রক্তারক্তি তখনো ঘটেনি।

৯১ এর নির্বাচনে এসে শিবির তার লুকানো দাঁত-নখ বের করতে থাকে। এর আগে ৮৬ এর নির্বাচনের সময় আমরা যেমন প্রকাশ্য বিনাবাধায় জামাত বিরোধী মিছিল করতাম, সেটা আর করা যাচ্ছিলনা। মানে নিরাপত্তার কোন নিশ্চয়তা ছিলনা। একটা ক্লাস ফাইভের ছেলেও ককটেল বানাতে জানতো। ডেইলী ককটেল ফুটতো এখানে সেখানে পটকাবাজির মতো। দশ পনেরো টাকা খরচ করলেই একটা জর্দার ডিব্বার ককটেল বানিয়ে ফেলা যেত। তো আমার ওখানে ওয়ার্ড কমিশনার ছিলেন আওয়ামী লীগের, তার ছত্রছায়ায় মন্টু ভাই পাড়ায় নৌকা মার্কার প্রচারে কয়েকটা ক্যাম্প খুলে ফেললেন। তখন একটু আধটু বিড়ি ফুঁকতে শিখেছি। প্রতিদিন বিকেলে ক্যাম্পে গেলেই চা আর সিগারেট ফ্রী। আমরা এমনিতে মন্টু ভাইয়ের কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নিতামনা। তবে বলা মাত্রই মিছিলে যেতাম, পোস্টার লাগাতাম, দেয়াল লিখতাম, ঘরে ঘরে গিয়ে লিফলেট দিয়ে আসতাম। মূলতঃ এই নির্বাচনের প্রচারের সময়েই মন্টু ভাই বিএনপি-জামাতের নির্মম রোষাণলে পড়েন। ওনার একটা সিডি হান্ড্রেড হোণ্ডা মটর সাইকেল ছিল, সেটাতে চড়ে পুরো এলাকায় টহল দিতেন রাত দিন। এমন দিন গেছে, সকালে কোথাও মারামারি, বিকেলে আরেক জায়গায়, অন্ধকার হলে তো ছিলই। রক্তারক্তি হলেও খুনোখুনি কোথাও ঘটেনি। অন্তত তদব্ধি।

নির্বাচনের ঠিক আগে আগে জামাতের কেন্দ্রীয় কমাণ্ড থেকে তাদের চ্যালাদের জানানো হয় বি এন পিতে ভোট দিতে। ফলে পুরো সময় জনমত জরীপে এগিয়ে থেকেও নৌকা মার্কার প্রার্থী , মোজাফফর হোসেন পল্টু ভাই হেরে যান। ক্ষমতায় আসে বিএনপি, আমাদের সাংসদ নির্বাচিত হয় মির্জা আব্বাস। মন্টু ভাই খুব, খুবই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। বেশ কিছুদিন ঘর থেকে বেরই হননি। রাজনৈতিক ব্যাপারেও আগ্রহী হারিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাইলেও বেশিদিন তা সম্ভব হয়নি, ওয়ার্ড কমিশনার আর স্থানীয় নেতাদের আহবানে আবার ফিরে যান সাংগঠনিক দায়িত্বে। আমরা পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আগের মতো আর তার সাথে সময় দিতে পারতাম না।
মাঝে সাঝে দেখা সাক্ষাত হতো, উনিও নতুন শুরু করা ঠিকাদারী ব্যবসা নিয়ে বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

মন্টু ভাই অক্লান্তভাবে খাটতে পারতেন। যে কাজে হাত দিতেন সেটা শেষ না করে উঠতেন না। মানুষকে ঠকাতেন না, লাভের জন্য সত্য মিথ্যা এক করার অভ্যাসও তার ছিলনা। এসব গুণের কারণেই তার ঠিকাদারী ব্যবসাও বেশ জমে উঠেছিল। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারী টেন্ডার ধরার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য সব ঠিকাদারের মতো চাইলেই মন্টু ভাইকে হুমকি ধমকি দিয়ে টেণ্ডার সাবমিট করা থেকে বিরত রাখা যেতনা, উনি বরং অনেক সময় সরকারী পাণ্ডাদের পালটা হুমকি দিয়ে আসতেন। এভাবে রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসাতেও তিনি অনেকের চক্ষুশূল হয়ে গেলেন। তবে তিনি তার পরোয়া মোটেও করতেন না, আত্মীয় স্বজন সবাই অনেকবার সাবধান করলেও কারও কথাকে পাত্তা দিতেন না। অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস আর দুঃসাহস নিয়ে নিজের কাজ করে যেতেন।

সে বছরেই মন্টু ভাই এর বিয়ের কথা চলছিল। যদ্দুর মনে পড়ে আমরা তার গায়ে হলুদ বা পান চিনি এ জাতীয় কোন একটা অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলাম। আলাদা একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন, নতুন সংসার গুছিয়ে নিতে। সে বাসায় বিয়ের প্রস্তুতি দেখভাল করতে তার ছোটবোনও এসে উঠেছিল। বিয়ের বোধহয় সপ্তাহ দুয়েক আগে এক রাতে, মাঝরাতের দিকে সেই বাসায় এসে মন্টু ভাই এর খোঁজ করে কয়েকটা অচেনা ছেলে। ভাই ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তবুও শুনে ছেলেগুলোর কাছে জানতে চাইলেন কী দরকার। তারা জানালো ব্যবসায়িক আলাপ আছে জরুরী, তবে বাইরে গিয়ে বলতে হবে। মন্টু ভাই গায়ে জামা চড়িয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন দেখে তার বোন তাকে নিষেধ করে, দাদা এত রাতে বাইরে যাইস না...কিন্তু তিনি হাতের ইশারায় বোনের কথাকে হেলায় উড়িয়ে দিলেন।

ছেলেগুলো মন্টু ভাইকে নিয়ে কথা বলতে বলতে গলির শেষ মাথায় চলে গেল। বেশ অন্ধকার থাকতো তখন জায়গাটা। ওখানে নিয়ে গিয়ে কোন রকম আভাস ছাড়াই একজন কোমর থেকে পিস্তল বের করে মন্টু ভাইয়ের থুতনীর নীচে ঠেকিয়ে গুলি করে। গুলির শব্দে আশপাশের বাড়িঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে আসতে চাইলে খুনীরা আরও কয়েক রাউণ্ড এলোপাথারী গুলি চালিয়ে সবাইকে বাতি নিভিয়ে যার যার ঘরে থাকতে বলে। বন্দুকের গুলিই নাকি শক্তি উৎস—সে কথা প্রমাণ করে দিয়ে যে যার ডেরায় ফিরে গেলেন। খুনীরা বিনা বাধায় দৌড়ে পালিয়ে গেল। পেছনে পড়ে রইলো মন্টু ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ শরীর।

আত্মরক্ষায় বিন্দুমাত্র সুযোগ না পেলেও মন্টু ভাই বিনা চেষ্টায় হুট করে মরে যাননি। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে গোঙাতে গোঙাতে, ছটফট করতে করতে আস্তে আস্তে থেমে যান আমাদের মন্টু ভাই। কেউ এগিয়ে আসেনি তাকে বাঁচাতে। তিনি থেমে যেতে চাননি, তাকে জোর করে থামিয়ে দেয়া হয়।

মন্টু ভাইয়ের লাশ আমি দেখতে পাইনি। আমার তখন টেস্ট পরীক্ষা চলছিল। সবাই চেপে যায় খবরটা আমার কাছ থেকে। আমি নিজেও তখন বাসা থেকে বেরোতাম না একদম। পরীক্ষা শেষে যখন জানি মন্টু ভাই ততদিনে শুয়ে আছেন কবরের গহবরে, শরিয়তপুরে তার গ্রামের বাড়িতে। খবরটা শোনার পরে বিশ্বাস হয়নি, সত্যি বলতে গেলে আজও বিশ্বাস হয়না।

তার মৃত্যুকে রাজনৈতিক বলে স্বীকারই করতে চায়নি প্রশাসন। যদিও আমরা নিশ্চিত ছিলাম, আছি সেটা একটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ছিল। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তার হত্যা মামলাটি শেষ পর্যন্ত খারিজ হয়ে যায়। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বলে কথা।

ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজন ছাড়া মন্টু ভাইয়ের কথা আর কেউ মনে রাখেনি। মনে রাখার কথাও না। কিন্তু আজ এত বছর পরেও তার কথা মনে পড়লে আমার শরীর ভারী হয়ে আসে, চোখ ভিজে ওঠে। আমি তাকে ভুলিনি, কোনদিন ভুলবোও না। তার স্মরণে আমি প্রতিবছর তাইওয়ানে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট স্পন্সর করি। এ বছরের খেলা সপ্তাহ দুয়েক পরে। সেটার যোগাড় যন্ত্র করতে গিয়েই মন্টু ভাই চলে আসলেন স্মৃতির পাতা থেকে চোখের জলে।

আমি নিশ্চিত আমাকে এ অবস্থায় দেখলে মন্টু ভাই পীঠে চাপড় দিয়ে বলতেন, ‘ যা ব্যাডা মাইগ্যা মার্কা হালার পো, কান্দন বাদ্দিয়া কাম কর।’


মন্তব্য

অনিকেত এর ছবি

মামুন বস,

এইগুলোই তোমার সেরা লেখা!
লেখাটা পড়ে কিছুখন স্তব্ধ হয়েছিলাম।
মন্টু নামের একটা সাধারন আটপৌড়ে নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একজন সরল কিন্তু সাহসী মানুষ। সারা বিশ্ব বদলে দেবার স্বপ্ন নিয়ে তিনি পথে নামেন নি। কিন্তু সবার অলক্ষ্যে স্পর্শ করে গেলেন কিছু কিছু কিশোরের মন।

তোমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করা উচিত এমন একজন লোকের সান্নিধ্য পাবার জন্য। এঁর মত লোকেরাই সবার আড়ালে আমাদের হাতে ধরিয়ে দেন আলোর মশাল-----

মন্টু ভাই কে সেলাম!

মামুন হক এর ছবি

ধন্যবাদ বস। মন্টু ভাইয়ের কথা আমাদের সাথের ছেলেপেলেরা কেউ ভোলেনি, ভুলে গেছে পাড়া প্রতিবেশীরা, রাজনীতির লোকেরা। উনি একটা আশ্রয় হয়ে ছিলেন আমাদের কাছে। কেউ মার খেয়ে আসলে জানাও মন্টু ভাইকে, কারও রেজাল্ট খারাপ হয়েছে, বাসায় যেতে সাহস পাচ্ছেনা--মন্টু ভাইকে সাথে নিয়ে যাও, আমরা পিকনিক করবো, টাকার শর্ট পুরোটা চাপিয়ে দাও মন্টু ভাইয়ের ঘাড়ে। বিস্তর গালিগালাজ করে উনি মানিব্যাগ খুলতেন, পাঁচশ-হাজার টাকা যাই লাগতো দিয়ে দিতেন।

ওনার মৃত্যুর পর এই ঘটনার জের চলে অনেক বছর। ৯২ থেকে ৯৪ ইরাক-ইরান যুদ্ধের মতো লড়াই চলে শিবির সমর্থিত, ফেন্সিডিল ব্যবসায়ী সন্ত্রাসীদের সাথে আমাদের। আমি নিজে আসল ময়দান থেকে অনেক বছর দূরে, অনেক কথাই ভুলে গেছি, আবার ব্লগেও অপেক্ষাকৃত নতুন। জানিনা কতটুকু এখানে শেয়ার করা সঙ্গত হবে। কোন গাইডলাইন থাকলে জানিও।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

এরকম লেখা দরকার, খুবই দরকার।
এসবই আমাদের ইতিহাস, এসবই আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের বেড়ে উঠা।

মামুন হক এর ছবি

আমিতো লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে ভেবে কাটছাঁট করলাম। ৮২ থেকে ৯৪ এর ঢাকা শহরের অনেক কথাই স্পষ্টভাবে মনে আছে। কিন্তু কতটুকু খোলামেলাভাবে লেখা যাবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

ফ্রীডম পার্টির কথা আপনার মনে আছে?

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

অতীতের অনেক কিছু মনে পড়ে গেল রে। লেখাটা দারুণ মায়াময়। মন্টু ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাক।

গোরানে ছিলাম অল্প কিছুদিন। এত কিছু আমার জানার কথা নয়। আমি যেখানে থাকতাম তার পাশে বা সামনে একটা বিশাল মজা পুকুর ছিল। তাতে ছিল বড় বড় কচুরীপানা। এটুকুই মনে আছে। দেশে গেলে ওখান দিয়ে একবার ঢুঁ মেরে আসবো।

মামুন হক এর ছবি

দোস্ত সেই মজা পুকুরটা খুব মজার ছিল। ছিপ ফেললেই মাছ ধরা পড়তো টপাটপ। কত দুপুর যে ওখানে কাটিয়েছি। আর এখন গেলে বোধহয় কিছুই চিনতে পারবিনা। আমি দেশে গেলেও আর ইচ্ছা করেই যাইনা ঐদিকে। এত ভারী ভারী সব স্মৃতি নিয়ে হাঁটাই মুশকিল হয়ে যায়।

নাশতারান এর ছবি

শ্রদ্ধা

আর কিছু বলার নেই।

▀ ▄

b

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

মামুন হক এর ছবি

আসলেই আর কিছু বলার থাকেনা। জীবন বড় নির্মম সময়ে সময়ে

গৌরীশ রায় [অতিথি] এর ছবি

মন ছুঁয়ে গেল ।
মন্টু ভায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ...

মামুন হক এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

let_there_be_light এর ছবি

আমি গোড়ান এলাকার ই ছেলে। লিখাটা মন ছুয়ে গেল।

মামুন হক এর ছবি

আপনি কি এখনও গোড়ানে থাকেন? থাকলে বর্তমান পরিস্থিতি একটু জানাবেন দয়া করে। পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ...

সূর্যগ্রহণ [অতিথি] এর ছবি

গুড় ছিটালে, পিপড়া আসবেই। আপিনও খুব চমতকার লিখেছেন। তাই আমিও পড়তে আসেছি।মাস ছয়েক আগে, আমিও দেশ ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছি পড়াশোনার জন্য। এখন গোড়ানের অবস্থা খুব বেশি ভাল না হলেও, আপনাদের সময়ের মত মারামারি- কাটাকাটি অবস্থাটা আর নেই। আপনার লেখায় গোড়ান এলাকার অতিত সময়ের কথা আরো জানতে চাই... ধন্যবাদ ।

মামুন হক এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই। লিখবো সময় করে, নিজের জন্য হলেও পুরানা দিনের কথাগুলো লিখে রাখা দরকার। চোখ রাখুন সচলের পাতায় হাসি

তিথীডোর এর ছবি

শ্রদ্ধা

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

মামুন হক এর ছবি

ধন্যবাদ তিথী হাসি

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

সেদিন মুখে বললেন, আজ লেখা পড়লাম। এইসব লেখা অব্যাহত রাখেন।

মামুন হক এর ছবি

হ, রাখব। কিন্তু সব লিখতে গেলে যে সাত কাহন হয়ে যায়। আপনার না আমাকে এই বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেয়ার কথা, তার কী হলো বস?

সাইফ তাহসিন এর ছবি

কি কমু বস, স্তব্ধ হয়ে আছি

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

মামুন হক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সাইফ

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গোড়ান আর গাবতলী, ঢাকার দুপ্রান্তে হলেও সময়ের ঘটনাগুলোতে কতো মিল। তখন বুঝি সব পাড়াতেই মন্টু ভাই থাকতো একজন করে... আর আমরা বড় হয়ে তাদের ভুলেই যেতাম... দীর্ঘশ্বাস...

আমাদের সময়ের দুইটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা নব্বইয়ের গণআন্দোলন আর ফ্রিডম পার্টি। ফ্রিডম পার্টি দেশে অস্ত্রের বিস্তার ঘটাইছিলো। অস্ত্র তখন খুবই সহজলভ্য ছিলো। এর আগ পর্যন্ত হকিস্টিক, রামদা, ক্ষুর এগুলাই ছিলো বড় অস্ত্র। কিন্তু ফ্রিডম পার্টি আসার পর আগ্নেয়াস্ত্র বেড়ে গেলো। পাড়ায় মহল্লায় পোলাপানের হাতে অস্ত্র। ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দিলেই কাফি। বহু তরুণ ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দিলো শুধু অস্ত্রের লোভে। ছোট সাইজের চাইনিজ কুড়াল খুব জনপ্রিয় হইলো। আমাদের বন্ধুরা শিখে গেলো কাটা রাইফেল বানাতে। একটা লেদ মেশিন থাকলেই কাটা রাইফেল বানানো পানির মতো সহজ। ছোট সাইজের একটা চাইনিজ কাটা রাইফেলও বেশ চালু ছিলো।
ককটেল বানানো আরো সহজ। সাভার থেকে মসল্লা আনো আর ভর... সন্ধ্যা হলে গুলি ককটেলের শব্দ নিত্যসঙ্গী...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মামুন হক এর ছবি

হ, ফ্রিডম পার্টি এসে ঢাকা শহরের গুণ্ডামীকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছিল। অস্ত্রপাতি নিয়া আর কিছু না কইলাম হাসি তবে ককটেলের মশল্লা শনির আখড়াতেও পাওয়া যেত।

ঐসব দিন গুলো নিয়ে আরও লেখা দরকার।

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদের সমাজে মন্টু ভাইয়ের মত মহান মানুষরা আছে বলেই আমরা এখনো সংগ্রাম করতে পারি। এমন হাজারও মন্টু ভাই আমাদের মাঝে ফিরে আসুক বারবার। ওনার মত মানুষ যে আজ আমাদের প্রয়োজন। মন্টু ভাইয়ের বিদেহী আত্মা শান্তিতে থাকুক। ধন্যবাদ।

=============
কামরুজ্জামান স্বাধীন

মামুন হক এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ

অনিন্দ্য রহমান এর ছবি

আমি এর চেয়ে ভালো লেখা অনেক দিন ধরে পড়ি নাই। আর কী বলব . . .


রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটুক

মামুন হক এর ছবি

আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমি আনন্দিত অনিন্দ্য হাসি

সাফি এর ছবি

আমার কাছে পুরোটাই সিনেমার মতন লাগল। মন্টু ভাইয়েরাই মরে যায় আর সালেহীরা বেঁচে থাকে

মামুন হক এর ছবি

হ, কালে কালে মন্টু ভাইয়েরাই খালি মরে যায়...

সংসপ্তক এর ছবি

অসাধারণ লাগলো।
.........
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

মামুন হক এর ছবি

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ...

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

আগেও তো বলসি ভাইয়া, আবারও বলি, এই ধরনের লেখাগুলাই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। ছুঁয়ে যায় খুব। একটানে পড়ে গেলাম। মন্টু ভাইয়ের জন্য শ্রদ্ধা। আর এমন লেখা যেনো না থামে। নিয়মিত আসুক। হাসি

মামুন হক এর ছবি

ধন্যবাদ প্রহরী। আসবে আশাকরি হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ছুঁয়ে গেলো লেখাটা আর তার বিষয়। কিন্তু কেন যেন প্রথম থেকেই মনে হচ্ছিল পরিণতিটা ফ্রাঙ্কেস্টাইনের হাতেই হবে

০২

ওই সময়টা পার হয়ে এসে এখন ওদিকে তাকালে প্রচুর বিভ্রান্তি চোখে পড়ে
অস্ত্র হাতে এগোতে এগোতে অস্ত্রের ধাক্কায় পড়ে যাচ্ছে একেকটা মানুষ
তাদের কেউ কেউ হয়ত আমার প্রচণ্ড ঘনিষ্ঠ মন্টুভাই
কিন্তু তার হাতের অস্ত্রই বলে দেয় সে সবার কাছে সমান মন্টুভাই নয়
তার বুলেটটাও বিদ্ধ করছে অন্য কারো অন্য কোনো মন্টু ভাইয়ের বুক; যতদিন না অন্য কোনো বুলেটের ধাক্কায় এই মন্টুভাই পড়ে যাচ্ছে মুখ থুবড়ে

০৩

ঠিক এই রকম
খুবই খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল কয়েকজন আমার
তাদের বেশিরভাগই নেই
যে দুচারজন বেঁচে আছে তারা বেঁচে আছে দেশান্তরী হয়ে

০৪

আমার কেন জানি মনে হয় পুরোপুরি রাজনৈতিক মগজ ধোলাইয়ের শিকার এই জেনারশেনটা
রাজনীতিতে মাথার ব্যবহার না করে যারা শুধুই করে গেছে অস্ত্র আর প্রাণের ব্যবহার

০৫

অফুরন্ত প্রাণের এই মহাঅবক্ষয়ের জন্য আফসোস

মামুন হক এর ছবি

লীলেন ভাই, আমি আসলে কখনোই ওভাবে ভাবিনি। মন্টু ভাই আমাদের ছোট্ট সার্কেলে কাছে এক ক্ষণজন্মা মহানায়ক হয়ে আছেন, আর তার দোষ-ত্রুটি নিয়ে খুঁটিয়ে ভাবার মতো অবকাশও আমাদের মেলেনি। আমরা তার দুর্দমনীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম, এখনও আছি।

মন্টু ভাইয়ের হত্যাকারীরা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন কীভাবে হলো বুঝতে পারলাম না।

তবে আপনার কথাগুলো সত্যিই আমাকে ভাবাচ্ছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

একেবারে চিত্রনাট্য।
ভালো লাগলো লেখাটা।
-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

মামুন হক এর ছবি

ধন্যবাদ ভাইজান

নিবিড় এর ছবি
মামুন হক এর ছবি

হাসি

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আমাদের সবকিছু কেমন যেনো অসম্পূর্ন থেকে যায়।
ঘাতক-দালালদের বিচার হয়তো হবে সত্যিই কিন্তু একসময় অসম্ভব হয়ে উঠা এই বিষয়টি সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে নেয়ার পেছনে দীর্ঘবছর ধরে মন্টু ভাইদের কতো শত মানুষদের যে অবদান। তিনটা দশক ধরে কতো নৃশংসতা, আন্দোলন, প্রতিরোধ, কতো মানুষের প্রান!

এইসব ইতিহাসের পাতায় উঠে আসবেনা।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মামুন হক এর ছবি

তিনটা দশক ধরে কতো নৃশংসতা, আন্দোলন, প্রতিরোধ, কতো মানুষের প্রান!
এইসব ইতিহাসের পাতায় উঠে আসবেনা।

--কষ্টদায়ক হলেও সত্যি কথা হাসান ভাই। সব ভুলে গেলেও মন্টু ভায়ের শেখানো জামাত বিরোধী শ্লোগান কোনদিন ভুলবনা। ছেলে বুড়ো সবার মুখে মুখে ফিরত এটাঃ-

যা করে আল্লায়
হাইগা দিমু পাল্লায়

আরও কিছু আছে, তবে সেগুলা পাব্লিকলি কহতব্য নহে হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরা আসলে মন্টু ভাইয়ের বিপরীতধর্মী খাসি মোরগজাতীয় জীবনযাপন করছি।

অনেকের হাতেই অস্ত্র থাকে, সবাই মন্টু ভাই হতে পারে না।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও শক্তি লাগে, সাহস লাগে।

ড্রয়িংরুমে গলাবাজি করে সেটা সবসময় হয় না।

আপনার শ্রদ্ধা নিবেদনে আমারও কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন।

---মহাস্থবির---

মামুন হক এর ছবি

আমরা আসলে মন্টু ভাইয়ের বিপরীতধর্মী খাসি মোরগজাতীয় জীবনযাপন করছি।

--আমাদের সময়/সুযোগ শেষ হয়ে যায়নি ভাই। চাইলে আমরাও মন্টু ভাইয়ের মতো সাহসী, প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারব আশাকরি।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

লেখাটা পড়ে বেশ কিছু সময় চুপচাপ বসে রইলাম। মনে হচ্ছিল যেন মন্টু ভাইকে দেখতে পাচ্ছিলাম।

মামুন হক এর ছবি

ধন্যবাদ নিয়াজ ভাই। মন্টু ভাইকে আমি এখনো চোখ বুজলেই দেখি। কিছু কিছু মানুষ মরে গিয়ে চিরদিনের জন্য বেঁচে যান।

আপনার ডাবলিন নিয়ে লেখার অপেক্ষায় আছি।

রবিন [অতিথি] এর ছবি

পড়ে একদম স্তব্দ হয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। মনে হল সিনেমা হলে বসে আছি আর চোখের সামনের পর্দায় সব ফুটে উঠছে।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আসলেই খুব সুন্দর বর্ণনা, শব্দ দিয়ে একেবারে সিনেমা বানিয়ে ফেললেন, আর আমরা দর্শকরা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম, দেখে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকলাম।

চলুক
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।