ড্যানসবর্গ দূর্গ, থারাঙ্গাম্বাড়ি, দক্ষিণ ভারত। জুলাই ১৬৪৪।
কুঠিসর্দার উইলেম অবিশ্বাসের স্বরে বললেন, পুরা নাঙ্গা?
পাশের লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, অবশ্যই পুরা নাঙ্গা। গায়ে সুতাটাও নাই, একবারে নাঙ্গাপুতু। আর হাতে খোলা তলোয়ার।
তারপর?
রোববারে হাট বসে। হাঁসমুরগী ডিম নারিকেল এইগুলি নিয়ে আসে লোকে, আর আনে ঘি। নানান ফলফ্রুট মশলা পান হাঁড়িকুঁড়ি এইগুলান তো আছেই। এর মধ্যে পাদ্রীসায়েব পুরা নাঙ্গা হয়ে তলোয়ার হাতে ছুটাছুটি করলে কি ব্যাপক ভেজাল ভেবে দেখেন!
ভুরু কুঁচকে উইলেম সায় দিলেন। ব্যাপক ভেজালই বটে, এরকম পাগলা পাদ্রীর কথা কে কবে শুনেছে? ন্যাংটো হয়ে হাটের ভিতর দৌড়াদৌড়ি ছি ছি। পাশের পর্তুগীজ বলে চলে, হাটের মধ্যে সাঁই সাঁই তলোয়ার ঘুরিয়ে ঠা ঠা করে সায়েবকে হাসতে দেখে লোকজন ভয়ে দিল এদিকওদিক দৌড়! লাত্থি দিয়ে মাটির হাঁড়িকুঁড়ির হল দফারফা, ক্যাঁকোক্যাঁকো শব্দে হাঁসমুরগি দিল ছুট। একটা পেয়াদা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পাদ্রী তারেও দিল ধাওয়া। একবারে বেড়াছেড়া পরিস্থিতি। তারপরে সব যখন পালিয়ে পগারপার তখন পাদ্রী রাগ সামলাতে গিয়ে একটা বুড়া ঘোড়ার গলায় দিল কোপ। ঘোড়া সেইখানেই অক্কা!
বিরক্ত গভর্নর উইলেম লেয়েল মাথা নাড়লেন অল্প। ক্রিসচিয়ান্সন জাহাজে তার আগের বছরেই ভারত এসেছেন তিনি, সাধের কলোনি ট্রাঙ্কেবারের এই অবস্থা কে জানত। ইয়োরোপে সেসময় যুদ্ধ লেগেই আছে, সুইডেনের সাথে গ্যাঞ্জামে ২৯ বছর একটা জাহাজও ডেনমার্ক থেকে ভারত আসেনি! ২৯ বছর লম্বা সময়, দেনার দায়ে কলোনির অবস্থা কেরোসিন। আগের গভর্নর পেসার্ট নানান ঝামেলা করার চেষ্টা দিয়েছিল যখন উইলেম এসে ভারত পৌঁছান, পরে না পেরে পয়সাকড়ি যা ছিল নিয়ে ড্যানসবর্গ দূর্গ ছেড়ে পালিয়ে যায়।
রামছাগলটা একবারে আকামের গভর্নর ছিল, ভাবলেন উইলেম, এইসব কিভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে তা উইলেমের চিন্তার বাইরে! ভারত আসা অব্দি তিনি নানাজনের কাছ থেকে শুনছেন দুষ্টপাদ্রী নীলসের গল্প। বজ্জাতটার দুই চোখ সারাক্ষণ দেশী কড়া আরক খেয়ে থাকত কড়া লাল। এক শনিবার রাতে নীলস বোতলকে বোতল মদ খেয়েই যাচ্ছিল দেখে কোম্পানীর এক অফিসার ডেকে বলল ওহে পাদ্রীমশায়, কালকে রোববার সকাল গীর্জে আছেনা? এত গিললে চলবে?
খুব চলবে, নীলস উত্তর দিয়েছিল, ও এক আধ বোতলে আমার কিসসুটি হবে না।
পরদিন সকালে গীর্জায় সে ঠিকই কিভাবে কিভাবে চৌকিতে উঠে বাইবেল পড়তে আরম্ভ করে দেয়, তবে ঢুলতে ঢুলতে উল্টাপুল্টা কি যে সে বলতে থাকে বাকিরা ধরতেই পারছিলনা। সকলে স্যুটকোট পরে এসেছে গীর্জেয়, পাদ্রীর এই অবস্থা দেখে তারা ব্যাপক মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকল। একটু পরে পাদ্রী বিড়বিড় করে ভুলবকা থামিয়ে সটান শুয়ে পড়ল সেখানেই আর ভারি আরামে নাক ডাকতে শুরু করল।এই দেখে এক সিপাই গিয়ে তার কাঁধে টোকা দিতেই পাদ্রী ধড়মড় করে উঠে বসে আর চেঁচিয়ে বলে, “হো! এয়েছিস? দে দে পাত্তর ভরে দে আর চল যাই হের স্ট্যাকেনবর্গের বাড়ি!” বাকিরা তখন হেসে কুটিকুটি।
এইসব কাহিনী শুনে শুনে ক্লান্ত গভর্নর মহাখাপ্পা হয়ে হুকুম দিলেন একে চেন দিয়ে বেঁধে আনা হোক, বিচার বসবে।
বসল বিচার। অক্টোবর ১৬৪৫ এর কথা। পাদ্রী নীলস অ্যান্ডারসেনের বিচারে কাউন্সিলের সামনে পর্তুগীজ রমণী অ্যানা সালাজার বলতে থাকেন কিভাবে তার ঘরে ঢুকে দাসী ফ্রান্সিস্কাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তক্তা করে নীলস, মাটিতে ফেলে পেটে লাথি মারতে থাকে যতক্ষণ না সে চুপ হয়ে যায়। আরেকজন সাক্ষ্য দেয় যে মে জিওমার বলে একজনকে একদিন আতকা কোন কারন ছাড়াই লাঠি দিয়ে নীলস এমন পেটায় যে তার হাত পায়ের হাড্ডি ভেঙ্গে একাকার অবস্থা! মে বছরখানেক ভুগে মারাই গিয়েছিল। ফিলিপা তাহেরার নামও বলল কেউ, গর্ভবতী অবস্থায় নীলসের লাঠির বাড়ি খেয়ে তার না হওয়া বাচ্চাটা মরে গেছিল।এরকম অনেকেই লিখিত এবং মৌখিক স্বাক্ষ্য দিল পাদ্রী নীলসের নামে, ভয়ংকর একেকটা কাহিনী।
কিছুদিন পর রায় ঘোষিত হলঃ
“...এই সকল কারণে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী কাউন্সিলরবৃন্দ, মহান ডেনমার্কের রাজার প্রণীত আইন অনুসারে পাদ্রী নীলস অ্যান্ডারসেন উডবিনেডারকে ভারি পাথরভর্তি ছালার ভিতর ভরিয়া ড্যানসবর্গ দূর্গের অপর পার্শ্বের রাস্তা সংলগ্ন সমুদ্রে নিক্ষেপ করিয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করিবার হুকুম দিলাম।
“এই হুকুম সকল কুঠিবাসীর সামনে দৃষ্টান্ত হইয়া থাকিবে যেন এইরূপ অসদাচরণ করিতে আর কেহ উদ্যত না হয়। পাদ্রী নীলস অ্যান্ডারসেন উডবিনেডারের সকল বেতন বাজেয়াফত করে রাজার কোষাগারে জমা করার হুকুম করা হইল এবং তাহার বাদবাকি সহায়সম্পত্তি স্ত্রী মনিকার ভোগে যাইবে।
“আদেশক্রমে ভারতের করমন্ডল ঊপকূলের ড্যানসবর্গ দূর্গে অবস্থানরত উইলেম লেয়েল, ইয়োর্গেন হ্যান্সেন, পল নীলসেন, অ্যান্ডার্স নীলসেন, সাইমন ইয়ানসেন এবং আমন ওলফসেন। ৩রা অক্টোবর ১৬৪৫।”
(শেষ)
টিপ্পনিঃ সকল চরিত্র কাল্পনিক নয়। দুষ্টপাদ্রী নীলস অ্যান্ডারসেন নিয়ে উৎসাহীরা এইখানে টিবি দিয়ে দেখতে পারেন। অষ্টম অধ্যায়, দ্য ক্লার্জিমেন। তার মৃত্যুদণ্ড শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি, বিশেষ বিবেচনায় তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মন্তব্য
নাহ, আমি তো ভাবলাম জম্পেশ একটা ক্লাইম্যাক্স হবে। পড়ে বুঝলাম ক্লাইম্যাক্সের ঘটনাটা দিয়েই শুরু করেছেন।
..................................................................
#Banshibir.
আমি এই শেষ টিপ্পনি পড়ে পুরোই হতাশ হয়ে গেলাম! যুগে যুগে কালে কালে আসলে এই হয়েছে মনে হয়। যথাযোগ্য শাস্তি আসলে অপরাধী কখনোই পায় না যা তার প্রাপ্য ছিল!
--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি
হ, বিশেষ বিবেচনায় তার শাস্তি মকুব করে দেয়া হইছিল কারন সে নাকি যখন মাতাল থাকত না তখন খুবই ভালোমানুষ আছিল। এইটা কোন অজুহাত হইল?
..................................................................
#Banshibir.
একসময় বলতাম- মাতাল, কবি আর প্রেমিকের সাতখুন মাফ...
এখন বলি না
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
খুন জখম না কর্লেই হইল, তাইলে মাতালে অসুবিধা নাই।
..................................................................
#Banshibir.
মৃত্যুদন্ডের বদলে যাবজ্জীবন দেখি অনেক প্রাচীন গল্প
জটিল কইছেন বস
..................................................................
#Banshibir.
দেইল্লা নীলস ভাই ভাই ... এক দড়িতে ...
খাড়ান, নীলসরে ছাইড়া দিছিল কিন্তু পরে। দেইল্লারে ছাড়লে চলবে না।
..................................................................
#Banshibir.
আম্রিকার দালালেরা এখন দেশের আসছে মানবতাকে রক্ষার বিশেষ মিশন নিয়ে। আর যাই হোক মানবতা তো জলাঞ্জলি দেওয়া যায় না।
একটা মজার জিনিস হইল যে বইটার রেফারেন্স দিসি ওইটাতে ড্যানিশ পর্তুগীজ ওলন্দাজ ইংরেজ ফিরিঙ্গি কতরকম মানুষের কথা আসে, কিন্তু কোন ভারতীয়র কথা নাই। ফট করে পড়া ধরলে মনে হয় ভারতে তখন ভারতীয় বইলাই কিছু ছিলনা, খালি কয়টা বুকা রাজাগজা। এখনো তাই, এই মার্কিন সায়েবরা নিজেরা যা খুশি করব আফগানিস্তান ইরাক গুয়ান্তানামো বে তে কিন্তু আমরা বিচারসালিশ করতে গেলেই নানান উপদেশ আর হুমকিধামকি আরম্ভ হয়া যায়। আমরা কি আর তাদের সমান সমান কন?
হালায়।
..................................................................
#Banshibir.
facebook
..................................................................
#Banshibir.
আপনি কি প্রায় সময়ই ইতিহাসভিত্তিক ফিকশন লিখেন ? যাই হোক, ফিরিঙ্গির মত এটাও ভালো লাগলো । চলুক ।
তালেব মাষ্টার
না হে তালেব মাস্টার (বিদেশী শব্দে ষ হয়না মনে হয়, চেক কইরেন তো একটু), প্রায় সময় লিখিনা। যখন যেইটা মনে চায় লিখি। ইদানিং সচল হয়ে গেছি মডুমামার হাত ঘুইরা যাইতে হয়না, আবজাব যা লিখি ছাপা হয়ে যায় হাহাহাহাহাহা।
ভালো থাকেন।
..................................................................
#Banshibir.
হেহ হেহ.....আমার কেমুন জানি সন্দ হইতাছে......এই পাদ্রী আমগো মখা মামু'র পুর্বপুরুষ ছিলো নিকি? গবেষণার বিষয়!!!
আরে নাহ মখা কি আর খুনজখম কর্ছে? সে ভিঞ্জাতীয় উন্মাদ।
..................................................................
#Banshibir.
------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।
..................................................................
#Banshibir.
হ ভাই, মাতাল আর পাগলের সব মাফ।
কইলেই হইল?
..................................................................
#Banshibir.
পরের গল্পটুকুও আপনিই বলে দিন না।
আমি বড়ই অলস।
আপনে কিডা গো?
..................................................................
#Banshibir.
বলুম না।
আমি আপনার খুফিয়া ফ্যান।
এরম ডুব মারলে চলবে? লেখালুখা ছাড়েন।
..................................................................
#Banshibir.
বুঝলাম না তেমন, তবে ভাল লাগল।
এখনও না পড়ে থাকলে, আমার মতে আপনার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর প্রমথনাথ বিশীর ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসগুলি অতি অবশ্য পড়া উচিৎ!
****************************************
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় খতম দেওয়া আছে, বিশী পড়িনাই অবশ্য.
ইয়ে বোঝেন নাই কোন জায়গাটা?
..................................................................
#Banshibir.
এজন্যেই আপনার ইতিহাসভিত্তিক গল্পগুলির মধ্যে একটু নারায়ণী ফ্লেভার বা এ্যাঙ্গেল পাওয়া যায় মনে হয়। তবে বিশীর 'লালকেল্লা' যেমনে হোক পড়েন! আপনার বর্তমান আগ্রহের প্রেক্ষিতে আমি বাজি ধরে বলতেছি - বিশী পড়লে আপনি ভারতীয় ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসের জন্য একেবারে বেচাইন দিওয়ানা হয়ে যাবেন। 'লালকেল্লা' দিয়ে ধরেন - যদ্দুর মনে পড়ে এটা সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের শাসন-ও-পতনকালীণ দিল্লীকে নিয়ে লেখা। দুর্দান্ত একখান বই। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উপন্যাসটা ঐতিহাসিক তথ্যে আনডিউলি ভারাক্রান্ত না করেই ইতিহাসের রোমাঞ্চকর এগজটিক আবহ, পরিবেশ আর ইতিহাসগন্ধী ঘটনা-দুর্ঘটনার ঘনঘটায় ঘনীভূত রূদ্ধশ্বাস গল্পে আপনাকে আপনার অজান্তেই আপাদমস্তক আত্নস্থ করে নিবে। মজা পাবেন নিঃসন্দেহে, শেখারও পেতে পারেন অনেক কিছু!
****************************************
বিশী যোগাড় হইতেছে। অশেষ ধইন্যবাদ
..................................................................
#Banshibir.
বিশী-র ইবুক জোগাড়ের কোন উপায় কী জানা আছে? পড়বার ইচ্ছা হচ্ছে।
নতুন মন্তব্য করুন