ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা'০৯

রাফি এর ছবি
লিখেছেন রাফি (তারিখ: শনি, ১৯/১২/২০০৯ - ৫:৩০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢাকাবাসী হিসেবে ঢাকায় পা রাখি ২০০১ সালে, আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে। দিনটি মনে রাখার অনেকগুলো কারণ আছে তবে সবচেয়ে বড় কারণটি হচ্ছে কলেজের নবীনবরণ। সুতরাং ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস ছাড়া বইমেলা তেমনভাবে ঘুরে দেখা হয় নি আমার। যতদূর মনে পড়ে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলার জমকালো আয়োজনের পাশে শেরেবাংলা নগরে ঢাকা বইমেলার আয়োজন ছিল; কিন্তু বইমেলা দেখতে গিয়ে ধূলোর উড়াউড়ি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে নি। এরপর কয়েকবার মেলার সময় পরিবর্তন করা হয়, সর্বশেষ গতবছর মেলার স্থানও। ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আয়োজিত হয়েছিল ঢাকা বইমেলা; আর এবছর আর একদফা জায়গা পরিবর্তন করে আনা হয়েছে বাংলা একাডেমি'র উল্টোদিকে সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানে। বই দেখতে আমার ভালই লাগে, এমনকি লোভনীয় প্রচ্ছদে খুব ভালো একটা সঙ্কলন না কিনতে পারার আফসোসটুকুও আমি উপভোগ করি,হয়ত দু'হাত ভরে বই কেনার তৃপ্তিটুকুর মতোই। তাই কমবেশি সববারই ঢাকা বইমেলায় যাই। এবারো গিয়েছিলাম ১৩ ডিসেম্বর।

আয়োজক কমিটির ভিন্নতা আমলে না আনলে একজন দর্শনার্থী হিসেবে আমার কাছে একুশে বইমেলার সাথে ঢাকা বইমেলা অথবা ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলার পার্থক্য মূলত দু'টো। প্রথমত প্রবেশ টিকিটের আনুষ্ঠানিকতা আর দ্বিতীয়ত পেশাদারিত্বের ঘাটতি। প্রতিবার ১৫ দিন স্থায়ী ঢাকা বইমেলার মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় আয়োজক প্রতিষ্ঠান এবং প্রকাশনা সংস্থাগুলোর হাহাকার চোখে পড়ে; ক্রেতা নেই, দর্শক নেই বলে বই বের করা যাচ্ছে না, মেলার ভবিষ্যত অনিশ্চিত এসব নানা মায়াকান্না শোনা যায় ফি-বছরই। প্রতিবার বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাই, ঢাকা বইমেলায় ঘুরাঘুরিটাই মূখ্য হয়ে উঠে, বই বড় একটা কেনা হয় না; বই কেনার জন্য একুশে বইমেলা তো আছেই।

কিন্তু এবার মেলায় গিয়েছিলাম বই কেনার উদ্দেশে। আগামী বছর একুশে বইমেলায় উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়ত হবে না এই আশঙ্কায় সংগ্রহ তালিকায় কিছু বই বাড়াবার আশায় ১৩ই ডিসেম্বর ঘন্টা দু'য়েক মেলায় কাটিয়ে এলাম; হাতে সময় ছিল অনেক, অনেকক্ষণ থাকার পরিকল্পনাও ছিল কিন্তু সময় কাটাবার উপাদান পেলাম না।

মেলায় ঢুকলাম ৩.৩০ টার দিকে, ২.০০ টা থেকে মেলা শুরু হবার কথা। প্রথমেই টিকিট কাউন্টারে গিয়ে দেখি তিনটা কাউন্টারের সবকয়টিই ফাঁকা। আমার মত হতভাগা আরো আটজন অপেক্ষা করে আছেন, মিনিটদু'য়েক হাঁকডাকের পর একপাশ থেকে একজন বিরক্তিভরে উঁকি দিলেন; টিকেট দিয়ে ধন্য করলেন আমাদের।
দূর থেকেই খেয়াল করছিলাম অধিকাংশ স্টলের পর্দা নামানো। চারটার মধ্যে লাঞ্চব্রেক মোটামুটি শেষ হল(!!!), অন্তত সবগুলি স্টল ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হল। কোন স্টলেই নতুন আসা বইয়ের কোন তালিকা বা প্রচ্ছদ দেখতে পেলাম না; এমনকি কারণে-অকারণে বইপ্রকাশ করে ফেলা অন্যপ্রকাশের স্টলেও না। একুশে বইমেলার যে স্টলের ধারেকাছে যেতে অবিরাম পেশীশক্তির প্রদর্শনী করতে হয় তাদের স্টলও শূণ্য, ক্রেতার দিক থেকে তো বটেই, বইয়ের দিক থেকেও। হুমায়ূন আহমেদ এর হরেক কিসিমের সমগ্র বাদে আর কোন বই আমার চোখে পড়েনি। নিয়মিত প্রকাশনী নয়, মেলায় দাপট দেখলাম নীলক্ষেত প্রিন্টেড বইগুলোর। ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসা নীলক্ষেতের ফুটপাতের বইগুলোর অনেককেই মেলায় ফিরে পেলাম, তবে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে উনারা বিক্রি হচ্ছেন গায়ের দামের ২৫% কমিশনে।মেলার চমক ছিল 'প্রথমা'। আজিজ মার্কেট ছাড়া এই প্রথম ওদের স্টল দেখলাম, প্রথমার স্টলে ওপার বাংলার চমৎকার কিছু বই আছে; তবে ওদের নিজেদের বই সামান্যই। প্রমথ চৌধুরীর 'প্রবন্ধ সংগ্রহ' আর উৎপলকুমার বসুর 'শ্রেষ্ঠকবিতা সমগ্র' কেনা হলো ওদের কারণেই। জনান্তিক এর স্টল থেকে 'শালুক; এর শহীদুল জহির স্মরণ সংখ্যাটা কিনে ফেললাম, UPL থেকে 'প্রদোষে প্রাকৃতজন'। পুরো মেলা ঘুরে কেনার মত আর কোন বই চোখে পড়ল না।

লেখাটা লিখতে শুরু করেছিলাম একটা ক্ষোভের কথা জানাতে, সেটাই লেখা হলো না। শ'দুয়েক স্টল ঘুরে কেনার মত একটিও নতুন বই দিতে না পারা দায়সারা এই বইমেলা আয়োজনের কি আদৌ কোন প্রয়োজন আছে? দর্শনার্থী বাড়াতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মেলা স্থানান্তর করা ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ভাল সিদ্ধান্ত কিন্তু বইয়ের ক্রেতা আর প্রকাশনা বাড়াতে কতটুকু দূরদর্শী??? আমার মতে ঢাকা বইমেলার সময় এবং স্থান একুশে বইমেলার মত স্থির করে দেয়া হোক এবং তা অবশ্যই বছরের মাঝামাঝি সময়ে। তাহলে সারা বছরব্যাপী নতুন-বইয়ের প্রকাশনা আর বিক্রি অব্যাহত থাকবে।আগে থেকে না জানানোর কারণে যারা আসতে পারছে না সেই বিদেশী প্রকাশনাসংস্থাগুলোও তাহলে আসতে শুরু করবে নিয়মিত। আর পছন্দের বই কিনতে ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না পাঠক-ক্রেতাদের।


মন্তব্য

হিমু এর ছবি
সাবিহ ওমর এর ছবি

ভাইয়া আপনি এগুলা নিয়ে যাবেন, নাকি এর মধ্যেই পড়ে শেষ করার প্ল্যান করতেসেন o.O

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- এটা একটা ভালো পয়েন্ট যে এক মাসের ব্যবধানে দুইটা মেলা আয়োজন না করে বরং বেশ কিছুটা সময় নিয়ে করা হলে তাতে পাঠক, ক্রেতা, প্রকাশক— সবারই মনোনিবেশের সুযোগ থাকবে।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

গৌতম এর ছবি

বিজয় দিবসের দিন দুপুরে গেলাম ঘুরতে। আমার মতো বাদাইম্যা ছাড়া আর কাউকে সেখানে দেখলাম না! একটা স্টলে তো দুজনকেই দেখলাম পড়ে পড়ে ঘুমাতে। বইটই নিয়া আসলে টেরও পেত না!

আমি খুঁজছিলাম আহমদ ছফার একটা বই- কোনো দোকানে পেলাম না। এই বইমেলাটা কেন যে আয়োজন করা হয়, সেটাই আজ পর্যন্ত বুঝলাম না। আবার নাম দিয়েছে ঢাকা আন্তর্জাতিক বইমেলা!

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

শিক্ষাবিষয়ক সাইট ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

হিমু এর ছবি

ঢাকাস্থ ফেনী সমিতি বইমেলা আয়োজন করলেও ঐখানে বেশি জমজমাট হৈত।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- ফেনী সমিতি বিশাল বড়। ঐ অঞ্চলের বেশ বড় একটা সংখ্যার জনগণ ঢাকায় থাকে। খালি আল্লা আল্লা কর, তারা জানি ঢাকায় বইসা স্বাধীনতা না চাইয়া বসে!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

হিমু এর ছবি

হে হে হে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানরে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা কইরা বসতে পারে। তখন ফাসফর্ট ছাড়া ফ্রবেশ ফুরাই ফ্রহিবিঠেড হবে রে মনিরা!



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

দ্রোহী এর ছবি

আমি আজকেই ঘুরে এলাম। লোকজনের ভীড় নেই তেমন একটা, ধুলোর পরিমাণ ও কম। সব মিলিয়ে খারাপ কাটে নাই সময়টা।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

এই ঢাকা বইমেলা কিন্তু আমরা স্কুলে পড়াকালীন সময়ে খুব জমজমাট হতো। শেরেবাংলা নগরে মেলাটা থেকে ভালোই বই কিনেছিলাম- তাই মন আছে...।

অফটপিকঃ রাফি ভাই, যাওয়া হলো না। আপনার হলে 'রাফি' নামে আপনার এক মিতা আছে- আমার ব্যাচমেট। তার কাছ থেকে আপনার প্রশংসা শুনলুম। দেঁতো হাসি

_________________________________________

সেরিওজা

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এই বইমেলা নিয়ে একটা লেখা লিখবো বলে ভেবে রেখেছি এক সপ্তাহ যাবত। হচ্ছিলো না। মেলায় যাওয়াও হয় নাই এবার একবারও।

আপাতত পড়ে গেলাম। সময় সুযোগ করে এই মেলাটা নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা আছে আমার
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

উহুঁ। এই জাতীয় গ্রন্থমেলার পুরো আইডিয়াটাই নামানো হয়েছিল ঢাকা বইমেলাকে বাঁশ দিতে। একুশের বইমেলা একুশের চেতনাকে ঘিরেই বেঁচে আছে। তাই একুশে বইমেলা বিএনপি-জামাত ঘরানার কোমল অন্তরে কঠিন আঘাত এবং অনেক নির্ঘুম রাতের কারণ হয়েছে বহুকাল ধরে।
একুশে বইমেলাকে বসিয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই এই ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলা। যেন এই মেলা থেকে বই কেনার পর পাঠকের হাতে আর কোনো টাকা না থাকে নতুন বই কেনার, আর কোনো আগ্রহ না থাকে বাংলা একাডেমীতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে নতুন বইয়ের গন্ধ শোঁকার।
বিপুল পরিসরে অনেক টাকা খরচ করে মেলার পুরো প্যাভিলিয়নের জায়গা সাজানো হয়েছিল। বাণিজ্যমেলার মতো করেই। বাণিজ্যমেলার মতোই গ্রন্থমেলাও খুব নামডাক পাবে এই আশায়।
কিন্তু গ্রন্থমেলার অবস্থান বাংলা ভাষার পাঠকরাই ঠিক করে দিয়েছে। তার অস্তিত্ব আজ ডারউইন সাহেবের গবেষণার বিষয়।
--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

রাফি এর ছবি

হিমু ভাই, ধুগোদা, সুহান, গৌতম দা, দ্রোহী দা, নজরুল ভাই, মৃদুল ভাই
সবাইকে পড়বার এবং মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।

@ SO,
জ্বী জনাব সবগুলাই দেশে বসেই শেষ করে এসেছি দেঁতো হাসি

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।