ভূপেন বাবু, খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৬/১১/২০১১ - ৯:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভূপেন বাবু,
আমি নিশ্চিত জানি, এ চিঠি আপনি কখনোই পাবেননা। সেখানেই চলে গেলেন আপনি, যেখানে গেলে কোন চিঠি কেউ পায় না কোনদিন। তবুও, আমার সবসময়ের প্রিয় গায়ক, আপনাকে নিয়ে, দু-চার কথা লিখতে ইচ্ছে হল।

সেই ছোটবেলায় আমার বাসার টেপরেকর্ডারে শোনার জন্য মাত্র দু-তিনটে ভাল ক্যাসেট ছিল। এগুলোই বারবার শুনে নিতাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। এর একটা ছিল আপনার। বারোটা গান ছিল ক্যাসেটটায়। আপনার এই দরাজ কন্ঠের গানগুলোই আমার শৈশবের গান শোনার চমৎকার স্মৃতি।
ক্যাসেট প্লেয়ারটা এখন কই জানিনা, রূপালী ফিতার ক্যাসেটটাও নাই হাতের কাছে। কিন্তু, আজ এত বছর পরেও, অনেক গান বহুদিন না শোনার পরেও, গানের কলি ভুলিনি আমি। গুণগুণ করলেই শৈশব থেকে মিষ্টি সব সুর ভেসে আসে। এলোমেলো হাওয়ায় চোখে স্বপ্ন আনে আপনার গান।
আমার সবচে প্রিয় গান 'মোর গাঁয়ের সীমানার পাহাড়ের ওপারে/নিশীথ রাত্রির প্রতিধ্বনি শুনি...জেগে ওঠা মানুষের হাজার চিৎকারে/আকাশ ছোঁয়া অনেক বাঁধার পাহাড় ভেঙে পড়ে...'। এই প্রতিধ্বনি কান পেতে শুনতাম, চোখ মেলে দেখতাম আর চোখ বুজে ভাবতাম।

‘পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর’ – কী রোমান্টিসিজম না ছিল গানের এই কলিটায়! রঙের খনিতে মনটাকে রাঙ্গিয়ে নিয়ে আর পথের টানে পথকে আপন করে নিয়ে যাযাবর হয়ে যেতে ইচ্ছে করত সেসময়। গঙ্গা, মিসিসিপি, ভল্গা, অটোয়া, অস্ট্রিয়া, প্যারিস, ইলোরা, শিকাগো, তাসখন্দের মিনারে ঘুরে এসেছি কল্পনায় আপনার গানের সাথে।

আপনার গানের প্রতি শব্দে রক্তিম এক উত্তাপ ছিল, প্রচন্ড প্রতাপ ছিল, ছিল ‘ভয়ার্ত মানুষের না ফোটা আর্তনাদ’। কী গভীর জীবনবোধ লুকিয়ে ছিল গানের কথায় কথায় ! আপনার গান শুনে আমি ‘কখনো তো হইনাই ক্লান্ত’’।
আপনি চেয়েছিলেন, আপনার গান হোক ‘বহু আস্থাহীনতার বিপরীতে এক গভীর আস্থা’, ‘কল্পনাবিলাসের বিপরীতে এক সত্য প্রশস্তি’, যেন ‘সেই গানে জাগুক জনৈক সংগ্রামী সৈনিকের মহাপ্রাণ’।

গানের মধ্য দিয়ে বলে গিয়েছেন সবসময়ের জন্য কিছু সত্য। এখনো ‘মানুষের মৃগয়ায় মানুষ কাঁদে, বাঁচার লড়াই নিয়ে প্রতিযোগিতা’য়, আর আমাদের করতে হয় ‘জন্মের ঋণ শোধ মৃত্যু দিয়ে’। আজও ‘মানুষ মানুষকে পণ্য করে, জীবিকা করে’ - পুরোনো ইতিহাস আমাদের লজ্জা দেয় না। আপনিই কেবল বৃথা ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গেয়ে যান। এখনো গগনচুম্বী অট্টালিকার ছায়াতে গৃহহীন নরনারীরা আশ্রয় খুঁজে। থরে থরে ফুটে থাকা গোলাপ-বকুলের পাশেই না ফোটা ফুলের কলিরা অনাদরে ঝরে যায়। প্রেমহীন ভালবাসায় দেশে দেশে সুখের ঘর ভেঙ্গে যায়। জমিদার আর বর্গীরা হানা দেয় না এখন, তবু স্বাধীন এদেশ জুড়ে এখনো নিত্য হাহাকার।

আমাদের ঘামে ভেজা শরীরের বিনিময়ে আঁকাবাঁকা পথে আমরা রাজা-মহারাজাদের কাঁধে নিয়ে ছুটে যাই আজও। এত অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও, নৈতিকতার স্খলন, মানবতার পতন দেখেও নির্লজ্জ অলসভাবে বয়ে যায় গঙ্গা, নিঃশব্দে, নীরবে।
বুভুক্ষু শিশুদের আর্তনাদ তিল তিল মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে আসে। সেই সংবাদ শুনেও আমরা বধির থাকি, শেষ প্রতিবাদটুকু করি না। আপনি জানিয়েছিলেন, সংগ্রাম জীবনের আরেক নাম। তাই ত্রাস ভুলে দানবের নাশ করতে ডেকেছিলেন সজাগ জনতাদের।

অন্য কারো কন্ঠে মানুষের জন্য এতটা আর্তনাদ দেখিনি আমি! তাই শুনে কষ্ট পেয়েছিলাম, সারাজীবন সবহারাদের অধিকারের জন্য গেয়ে যাওয়া, পরের সুখে কাঁদতে চাওয়া আপনি সাম্প্রদায়িক বিজেপিতে যখন যোগ দেন। জানিনা, কি ভেবে গিয়েছিলেন এই ভুল পথে।

মানুষের গান শুনিয়েছিলেন আপনি আমায়। হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল, এক হাতে অগ্নিবীণা আর কন্ঠে গীতাঞ্জলি নিয়ে প্রতিকূল হাওয়ায় পথ চলতে বলেছিলেন। একই রক্ত-মাংসে গড়া আর প্রেম-প্রীতি দিয়ে হৃদয় ভরা, একই আকাশ-বাতাসে শ্বাস নেয়া, একই আশা-ভালোবাসা-কান্না হাসির একই ভাষার এসব মানুষের মাঝে ভেদাভেদ না করতে শিখিয়েছিলেন।
হাসি নিয়ে, বাঁশি নিয়ে, ফাগুন ফুলের আনন্দ নিয়ে, মনের চড়ুই পাখিটির বাঁধন খুলে দিয়ে, হাজার বন্ধ দুয়ার ভেঙ্গে, নতুন আলোর দিগন্তে জীবন খুঁজে নিতে ছুটে আসতে বলেছিলেন।

আপনার সুর অজস্র মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছিল একদিন। প্রভাত আনতে পারা একেকটি অমর গানের জন্য আপনি বেঁচে থাকবেন বাংলার আকাশে।

সারাজীবন, সবসময় আপনার এই কয়টা লাইন সবাইকে শুনিয়ে যাব-

“এই পৃথিবীর ধর্ম যত তুমি বিচার কর
দেখবে সেথায় একই কথা
উর্ধ্বে সবার মানবতা...
সেই কথাটাই বলে সবাই বড়াই কর
আবার কেন লড়াই কর?”

ইতি-
আপনার গানের একজন মুগ্ধ ভক্ত

প্রিয়ম

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03am

মন্তব্য

তাপস শর্মা  এর ছবি

চির অম্লান। সঙ্গীতের মহাকাশে ......

হাসিব এর ছবি

জানিনা, কি ভেবে গিয়েছিলেন এই ভুল পথে।

এইখানে কিছু পাবেন।

"The BJP has proved to be the most stable party. I wanted and saw that the field of art (under the Vajpayee government) should be seen as an instrument of social change."

He said that if Hindutva was to be rightly interpreted 'then BJP has done wonders for the prestige of India'.

প্রিয়ম এর ছবি

খুব অল্প তথ্য লিঙ্কটায় ! নতুন দলে যোগদানের পর তো সবাই এই কথাগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে ।

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

বিতর্কের উর্ধ্বে থাকাটা খুব কঠিন মন খারাপ

তারপরেও আশা করি গায়কের ঠাঁই মনের রিজার্ভ বেঞ্চিতে না হলেও গানগুলো জায়গা করে নেবে মনমাঠে, সবারই...

প্রিয়ম এর ছবি

একদিন তো ভালবেসেছিলাম এসব গান !

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

শ্রদ্ধা

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

আশফাক আহমেদ এর ছবি

ভাল্লাগলো বদ্দা

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

প্রিয়ম এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

উনার রাজনীতি সম্পর্কে জানা নাই। গান দিয়েই তিনি শ্রদ্ধার আসনে। মৃত্যু নিয়ে পোস্টগুলোয় মন্তব্য করতে ইচ্ছে করে না কিছু করতে না পারার অসহায়ত্বে। মন খারাপ

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

KamrulHasan এর ছবি

শ্রদ্ধা

শীতেরও শিশির ভেজা রাতে, শিশিরে ভেজানো রাতে বস্ত্রবিহীন কোন ক্ষেতমজুরের ভেঙ্গেপড়া কুটিরের ধিকি ধিকি জ্বলে থাকা তুষে ঢাকা আগুণের রক্তিম যেন এক উত্তাপ হই..

... সচলের কাছে ব্যানার আশা করেছিলাম।

প্রিয়ম এর ছবি

আমি-ও।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গানে গানে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলে যাবেন আর ব্যক্তি জীবনে পালন করবেন ধর্মন্ধতা!
স্যরি... ভূপেন হাজারিকার জন্য আমার কোনো মোমবাতি জ্বলবে না

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

প্রিয়ম এর ছবি

গান সব গেয়েছিলেন তিনি রাজনৈতিক মতবাদ পরিবর্তনের আগে। আর, শুনেছি, তিনি শেষদিকে বিজেপি-তে যোগ দেয়াকে জীবনের বড় এক ভুল বলে স্বীকার করেছিলেন।

KamrulHasan এর ছবি

উর্ধে উঠতে হবে বস! সংকীর্ণতার একটু উর্ধে...

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

স্যরি বস! আমি কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংকীর্ণই থাকতে চাই...
খুব প্রিয় কোনো শিল্পী যদি জামাতের সাপোর্টার হয়, তাইলে সেই শিল্পীরে আমি শিল্পী মনে করি না

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

KamrulHasan এর ছবি

হে হে...

তারেক অণু এর ছবি
shuvro shokal এর ছবি

দারুণ লিখেছিস...ভালো লাগলো...

সাফি এর ছবি

ভূপেন এর গান ভাল লাগত, বিশেষ করে 'বিস্তির্ণ দুপারে' খুবই প্রিয়। তবে শেষ দিকে তার বিজেপিতে যোগদানের খবরে হতবাক হয়ে গেছিলাম।

শারমীন এর ছবি

ভূপেন হাজারিকা, সুমন চট্টোপাধ্যায় আমার প্রিয় গায়ক ছিল। তাদের গান আমার রুমে সারাদিন বাজত। কিন্তু এখন দুজনকেই আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। সমস্ত বাড়ি খুজলে একটা ক্যাসেটও পাওয়া যাবে না। সব নদীতে ফেলে দিয়েছি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।