মিক্সড টেপ

ওডিন এর ছবি
লিখেছেন ওডিন (তারিখ: বুধ, ১৪/০৩/২০১২ - ১০:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাইড 'এ'

মিক্সড টেপ জিনিসটার ব্যপারে আপনাদের ধারণা আছে কি না জানিনা। আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে বেড়ে উঠেছি তাদের কাছে জিনিসটা অবশ্য অপরিচিত থাকার কথা না। একটা সনি বা টিডিকে নব্বুই মিনিটের ক্যাসেটের দুই পিঠে অনেকগুলো গান ঠেসে দেয়া। হয়তো একটা ব্যান্ডেরই, বা অনেকগুলো ব্যান্ডের। গানের বিষয় এক হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। একেবারে র্যান্ডম সিলেকশান থাকাটাও অসম্ভব না। এই শেষের ব্যপারটা অবশ্য আমার ক্ষেত্রে খুব বেশি ঘটতো।

সেই সময়টাতে (এবং এখনো) আমার অনেক সন্ধেবেলার আড্ডার জায়গা ছিলো এলিফেন্ট রোডের রেকর্ডিং এর দোকান 'রেইনবো'। আমি অবশ্য যখন রেইনবোতে যাওয়া শুরু করি কিংবদন্তীসম ব্যক্তিত্ব কবির ভাই তখন অস্ট্রেলিয়া যাই যাই করছেন। তবে প্রদীপ নিভে যাওয়ার ঠিক আগে হঠাত একটু বেশি করে যেমন জ্বলে ওঠে, সেইরকম রেইনবোর বিখ্যাত আড্ডাও মনে হয় শেষবারের মতো পুরো শক্তিতে চলছিলো ওই সময়টায়। আমাকে হেভি আর থ্রাশ মেটাল শোনার থেকে বাইরে টেনে বের করে এনেছিলেন কবির ভাই-ই। পিচ্চি অপোগন্ড একটা ছেলে ছিলাম। ফরমায়েশ করতাম আয়রন মেইডেনের 'এইসেস হাই' আর 'পাওয়ারস্লেভ' এলপি দুটো, একটা একটা টিডিকে নব্বই মিনিটের ক্যাসেটের দুই পিঠে। উনি বেঁচে যাওয়া জায়গায় দুটো থিন লিযি'র গান গুঁজে দিতেন। 'এদের শুনে দ্যাখ, ফিল লিনট খালি গায়ক না, ব্যাটায় কিন্তু একজন পাবলিশড কবিও'। একদিন নিজেই একটা ক্যাসেটে ইউরায়াহ হিপের মিক্সড টেপ করে দিয়েছিলেন, 'এইটা শুনিস রে পাগলা'। ওনার পাল্লায় পড়েই আমি এখনও জেথরো টাল শুনি। চুরানব্বই, পঁচানব্বই, ছিয়ানব্বই। গত শতকের কথা। মনে হয় পুরো একটা জীবন আগে ।

বাসায় এসে আমি আবার ওইসব ক্যাসেট থেকে আরেক দফা মিক্সড টেপ করতাম। একটা পুরোনো সনি ক্যাসেট ডেক ছিলো। পুরনো ক্যাসেট টেপের ওপর করো আরেকবার রেকর্ডিং। রিকোয়ারমেন্ট এইবার একটু আলাদা। পড়ার সময় শোনার জন্য একটা করা হলো। বন্ধু আরিফের ঝরঝরে মাইক্রোবাসে চন্দ্রার জঙ্গলে যাব, পথে শোনার জন্য করো আরেকটা বা আরো দুইটা মিক্সড টেপ। লেনার্ড স্কাইনার্ডের 'ফ্রিবার্ড' থাকতে হবেই এইটাতে। পরীক্ষার আগে মাথা গরম- পড়ালেখা বাদ্দিয়ে আরেকটা টেপ বানাও, এইবার থ্রাশ মেটাল। সব জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়ার গান।

তবে সবচে মজা লাগতো এলোপাথাড়িভাবে বানানো টেপগুলোকে শুনতে। ক্যাসেটের একটা গানের সাথে আরেকটা গানের কোন মিলই নেই। শুরু হয়তো হলো ব্ল্যাক সাবাথের 'চিলড্রেন অফ দ্য সি' দিয়ে, এর পরেই গ্রাঞ্জ, সাউন্ডগার্ডেনের 'ব্ল্যাক হোল সান'। তারপরের গানটাই দেখা গেলো ড্রিম থিয়েটারের ঘুমপাড়ানি গান 'ওয়েট ফর দ্য স্লিপ'। এই সবের মাঝেই হয়তো একটা বৃষ্টিমুখর দিনের গান, ইউরায়াহ হিপের 'রেইন'। শেষমেষ দেখি ডিপ পার্পলের 'উওমেন ফ্রম টোকিও।'

এখনো কয়েকটা ক্যাসেট রয়ে গেছে কিভাবে জানি। মাঝে মাঝে শেলফ থেকে বের করে ধুলো ঝাড়ি। পুরোনো ক্যাসেট ডেকটায় বাজিয়ে শুনি। এইরকম একটা ক্যাসেটই আজকে সন্ধ্যেবেলায় খুঁজে পেলাম। ধুলো ঝাড়লাম। ফাঙ্গাস পরিষ্কার করলাম। এখন লিখছি আর শুনছি। কি আজব একটা কালেকশন। কোন আগামাথা নেই। ছিয়ানব্বই সালের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এইগুলোই শুনছিলাম আমি? বরিশালে থাকতাম তখন। অনেক ঠান্ডা ছিল সেইবার, মনে আছে। জন্মদিনে ফেলুদা'র সাতটা বই গিফট করেছিলো আমার এক বন্ধু। সদর রোডের বুক ভিলা থেকে কেনা। তার মধ্যে আমার প্রিয় 'রয়েল বেঙ্গল রহস্য' এ লেখা ছিলো, 'চোদ্দে পড়ে অন্তত তোর বুদ্ধি খুলবে, এই আশায়...'

এখনো আমি মিক্সড টেপ করি। ইনফ্যাক্ট এখনি একটা করার প্ল্যান করছি। লেখাটা পোস্ট করেই কাজ শুরু করবো। স্টিভ-ভাই-স্যাত্রিয়ানি-ভিনি মুর। তবে টেপের বদলে এখন সিডিতে করা হবে। আশি মিনিটের মিতসুবিশি ফোনো আর সিডিতে। ডিস্কগুলো দেখতে সেই আদ্যিকালের এলপি রেকর্ডগুলোর মতো।

ডায়রিটায়রি লেখা কক্ষনো আসে না আমার। বেশি 'ইয়ে' মনে হয়। 'ইয়ে' মানে সেন্টিমেন্টাল আরকি। সবসময়েই নিজেকে বলি- 'আই নেভার লুক ব্যাক,আনলেস দেয়ার'স আ গুড ভিউ'। তবে আজকাল ক্যানো জানি মনে হয়, এই মিক্সড টেপগুলোই রয়ে যাবে আমার কক্ষনো না লেখা দিনলিপি হিসেবে। হয়তো আজকে এই সন্ধ্যার মতোই , অনেক অনেক অনেক দিন পরে, অন্য আরেকটা কোন সন্ধ্যায় আজকের করা 'টেপ' টা শুনতে শুনতে মনে হবে -একসময় আরেকটা জীবন ছিল আমার।

সাইড 'বি'

আর, একটা গান।

[চোদ্দই মার্চ, বুধবার, রাত দশটা। ]


মন্তব্য

তাপস শর্মা এর ছবি

সাধু সাধু্‌...., উঁহু, হল না তো। সাধু সাধু বললে হপে না, বলছি ওডিন ব্যাং ব্যাং।

আমিও বড় হয়ে প্রচুর মেটাল শুনব। থিক থিক। বাই দ্য ওয়ে ফ্রিবার্ড এর সাথে ফেলুদাকে মিক্স করে দেন - পুরাই সেরাম। দেঁতো হাসি

তাসনীম এর ছবি

স্মৃতি জাগানিয়া লেখা।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

রণদীপম বসু এর ছবি

এই সন্ধ্যার মতোই , অনেক অনেক অনেক দিন পরে, অন্য আরেকটা কোন সন্ধ্যায় আজকের করা 'টেপ' টা শুনতে শুনতে মনে হবে -একসময় আরেকটা জীবন ছিল আমার।

চমৎকার কোবতে হয়েছে দিকি !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

শিশিরকণা এর ছবি

গানের রুচি না মিললে‌ও মিক্সড টেপের স্মৃতি মিলে গেল। ব্ল্যাঙ্ক টিডিকে ক্যাসেটের অনেক দাম ছিল, তাই হিন্দি গানের শস্তা ক্যাসেট কিনে তার উপর রেডিও থেকে বিকাল ৩টার ওয়র্ল্ড মিউজিকের অনুষ্ঠান থেকে প্রিয় গান রেকর্ড করে রাখতাম। অনেকগুলো ক্যাসেট হয়েছিল সেই ৯৮ থেকে ২০০১ সময়ে।

আরেক রকম মিক্সড টেপ বানানো হতো স্কুলের ডিসপ্লের মিউজিকের জন্য। এই গানের এক চিমটি, ঐ গানের এক মুঠা আর আরেকটা গানের এক সের নিয়ে ঘুটা দিয়ে ৪-৫ মিনিটের একটা ট্র্যাক।

~!~ আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল ~!~

অমিত এর ছবি

রেইনবোতে সেইসময় সন্ধ্যাগুলো মনে হত অন্য একটা পৃথিবী। ভেতরে ঢোকার আগে একটু দমবন্ধ করে তাকিয়ে থাকতাম। থরে থরে এলপি সাজানো, দেয়ালে পোস্টার (ডিও'র ছিল মনে হয় একটা), এসি রুমটা একটু ধোঁয়া ধোঁয়া, ভিতরে লম্বা চুল দাড়ির কবির ভাই।
কাঁচের দরজাটা ছিল আমার ওয়ান্ডারল্যান্ডে ঢোকার র‌্যাবিট হোল।
প্রথম মিক্সড টেপ করার সময় রেইনবো সময় নিয়েছিল ৫ মাস, শেষে সেটা হল এক সপ্তাহের মতন।
রেইনবো + সিং + সুর বিচিত্রা + রিদম মিলিয়ে টেপ হয়েছিল দেড়শর উপরে। একটাও নাই এখন।
মিডনাইট ইন প্যারিস মুভিটার মতনই হয়ত সেই টেপগুলা অন্য কোনও সময়ে সেই এলিফ্যান্ট রোডের সন্ধ্যার রেইনবোতে কবির ভাইয়ের কাছে আছে। আমার শুধু রাস্তা খুঁজে নিয়ে আসা বাকি।

ফাহিম এর ছবি

অনেক বেশি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি মনে হয়। পুরোনো কথাগুলো কেন যে এতো বেশি মনে পড়ে ইদানিং...

=======================
কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

নেমেসিসের 'কবে' গানটি আমার খুব প্রিয়।

খেকশিয়াল এর ছবি

আহারে মিক্সড টেপ! আহা আহা!

আমার দাদা রেকর্ড কইরা নিয়া আসতো রেইনবো থেকে, আমি যখন গ্যাদা, সেই সময় থেকে। আর বাবার ছিল দারুণ সব বাংলা গানের কালেকশন, তবে সেগুলো বেশিরভাগই বেশ সাজানো গুছানোভাবে রেকর্ড করা।

এখন আর একটাও নাই, কই দেখি নাতো ঘরের কোথাও

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

আহারে! সেই গ্যাদাকালে মামা ক্যাসেট করে আনতো রেইনবো থেকে। এক পাড়াতো বড় আপু স্টেয়ারওয়ে টু হেভেনের মানে বুঝিয়েছিলো! একেবারেই গ্যাদা তখন। একেবারেই ছোট!। তখন থেকে মাথার কোনও এক অংশে মিক্সড টেপ বাজে, এখন ধুলোময় ব্যাড সেক্টর হয়তো তা। ফাঙ্গাস সরানো যায় তবুও, এতো জ্বলজ্বলে স্মৃতি সব।

আমার সব অ্যালবাম আছে, আম্মু মাঝে মাঝে ক্যাসেটগুলো ফেলে দিতে চায়! তাও আছে! ফেলতে দেইনাই, দেবোনা! হাসি

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

জি.এম.তানিম এর ছবি

কী অসাধারণ একটা লেখা লিখলেন। এই নিমেষে নিয়ে গেলেন সেই কবেকার কোন দিনে!

পড়তে পড়তে ভাবছিলাম বি পিঠের গান টাই... কবে কথাগুলো গাবো সুরে...?

-----------------------------------------------------------------
কাচের জগে, বালতি-মগে, চায়ের কাপে ছাই,
অন্ধকারে ভূতের কোরাস, “মুন্ডু কেটে খাই” ।

সুমাদ্রি এর ছবি

স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। চট্টগ্রাম শহরের মেহেদিবাগের ছোট্ট একটা দোকান, রেকর্ডস। অনেক চেষ্টা করেও ভাইয়ার নামটা মনে করতে পারছিনা। ইংরেজি গান বিশেষ করে রক, মেটাল এধরনের গানের ভাল কালেকশন ছিল রেকর্ডসে। আমার অবশ্য ভাল লাগত ক্ল্যাসিকাল মিউজিক, টিডিকে অথবা সনি ক্যাসেটের দুপিঠে রেকর্ড করিয়ে আনতাম মোজার্ট, বিটোফেন, শোপাঁ বা শ্যুম্যান। নিউমার্কেটের চারতলায় ছিল টেলিটোন। পুরোনো দিনের হিন্দি গানের দুর্দান্ত কালেকশন ছিল ওদের কাছে। আপনার লেখাটা পড়ে ওই সময়টাতে চলে গিয়েছিলাম। ক্যাসেটগুলো প্রায়ই আছে, তবে ক্যাসেট প্লেয়ার নেই।

তানভীর এর ছবি

আমারও প্রথম ভালোবাসা রেকর্ডস! তবে রেকর্ডসের লোকগুলো কবির ভাইয়ের মতো অমন হাসি-খুশি ছিলো না। তাই শ্রীকান্ত ছাড়া আর কারো নাম আমার কখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি। এই যে এখানে একটু রেকর্ডসের স্মৃতিচারণঃ
http://tanveerislam.wordpress.com/2012/03/16/রেকর্ডস/

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

খুলনায় আমাদের ছিলো আশরাফ ভাই, লিজেন্ড টাইপের মানুষ। এখন অবশ্য এই ব্যবসা আর করে না। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কিছু শয়তানী করতাম। যেমন একবার একটা মিক্সড ক্যাসেট বানালাম যার প্রথম দুটো গান ছিলো-

১। বিট ইট (মাইকেল জ্যাকসন)
২। গোলাপ হয়ে উঠুক ফুঁটে তোমার রাঙা বদনখানি (কেএল সায়গল)

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগলো খুব।
আমাদের ঘরে আর কোনো ক্যাসেট নাই। সব ফেলে দেয়া হয়ে গেছে।

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

পাপড়ি এর ছবি

ফ্ল্যাশব্যাকের মত কতগুলি শব্দ ভেসে আসছে চোখের সামনে......রেইনবো...কবির ভাই...মিক্সড টেপ...৩:০৫-এ ওয়ার্ল্ড মিউজিক... ভিডিও হিটস এর লিরিকস ম্যাগাজিন...সত্যিই আরেকটা জীবন ছিল...তন্ময়, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে মধুর দিনগুলোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ।

ওডিন এর ছবি

যাঁরা পড়েছেন আর মন্তব্য করেছেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ আর নমস্কার। ভালো থাইকেন সবাই।

তারেক এর ছবি

আমি ক্যাসেট টেপ কালেকশন করছি । যদি কারো ক্যাসেট ফেলে দেবার মত পরিস্থিতি হয় তাহলে বান্দাকে স্মরণ করবেন। নিজে গিয়ে নিয়ে আসব। যত্ন করে রাখব কালের রোমন্থন ক্যাসেট টেপগুলো।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।