আমাদের মুমিত

পরিবর্তনশীল এর ছবি
লিখেছেন পরিবর্তনশীল (তারিখ: সোম, ১০/০৩/২০০৮ - ৯:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মুমিতের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে আমার কৃত্রিম ঝগড়া হত। কৃত্রিম ঝগড়ার ক্ষেত্রে বিষয় তেমন একটা গুরুত্ব পায় না। তাই আমাদের বিষয় ছিল একটা মেয়ে। ক্যাডেট কলেজে- গেমস টাইমে কিংবা ডিনার থেকে একাডেমিক ব্লকে আসার সময় আমরা সেই মেয়েকে নিয়ে আলোচনা করতাম। মুমিত তার বাচ্চা বাচ্চা হাসিটা নিয়ে আমাকে বলত-
- মহিব, এসব ছাড়। বুঝলি?
তারপর একদিন মেয়েটা আমাকে চিঠি লিখল। চিঠিটা মুমিতের হাতে দিয়ে আমি একটা গা জ্বালানো হাসি দিলাম। কিন্তু মুমিতের মুখের বাচ্চা বাচ্চা হাসিটা আমি মুছে যেতে দেখলাম না।
চার বছর পর সেই বালিকাকে যখন শেষ চিঠিটা লিখলাম- মুমিত আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিল।
- দোস্ত। মন খারাপ করিস্‌ না।
সেটাই ছিল আমার কাঁধে মুমিতের শেষ হাত রাখা। মুমিত আমার বন্ধু ছিল। মুমিত আমার ভাই ছিল।

ক্যাডেট কলেজে আমরা বাবা-মা থেকে দূরে থাকতাম। সে বয়সের একটা ছেলে- কষ্টের কোন মুহুর্তে বাবা-মা'র কোলে আশ্রয় খুঁজে। আর আমাদের আশ্রয় ছিল বন্ধুরা। তাই বোধহয় আমাদের সম্পর্কটা শুধুমাত্র নাম-সর্বস্ব বন্ধুত্বকেও ছাড়িয়ে যেত।
মুমিত আমাদের একজন ছিল।

ইন্টার পরীক্ষার পর ঢাকায় আসলাম ভর্তি পরীক্ষার কোচিং করতে। পান্থপথে আমাদের কলেজের ছয়জন একটা বাসায় উঠলাম। আমি, বাহা, শাফায়াত, জামিল, তানিম আর কায়সার। প্রথম কয়েকদিন সবাই খুব ভাব নিয়ে কোচিং-এ গেলাম। ভর্তি পরীক্ষায় কোন ধরণের প্রশ্ন হয় সেটা নিয়ে ব্যপক আলোচনা করলাম। কোন ভার্সিটির পরীক্ষা কখন হবে- সেটার খবরাখবর নিতে লাগলাম। এবং একদিন সবাই লেখাপড়া সম্পর্কিত সবকিছু বাক্সবন্দী করে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

মুমিত ওর কোন এক আত্নীয়ের বাসায় থাকত। আর্মির জন্য কোচিং করত। কোচিং-টা ছিল আমাদের বাসার সামনে। তাই প্রায়সময়ই আসত। আমরা একসাথে কার্ড খেলতাম কিংবা চায়ের দোকানে বসে বসে আড্ডা দিতাম।

আমার আবোল-তাবোল গানগুলো মুমিত খুব মনোযোগ দিয়ে শুনত। নতুন কোন গান লিখলেই আমি আমার খুব কম শ্রোতাদের একজন- মুমিতের কাছে যেতাম। আর খুব লজ্জার ভান করে মুমিতকে বলতাম।
- দোস্ত। একটা গান লিখছি।
মুমিত তার বাচ্চা বাচ্চা হাসিটা মুখে এনে বলত।
- শোনা।

এরই মধ্যে মুমিত আইএসএসবি'তে চান্স পেল। আমার এখনো মনে আছে আইএসএসবি বোর্ড থেকে বের হয়েই আমাদের বাসায় এসেছিল। আর আমাদের জড়িয়ে ধরে সে কী কান্না। আমি বললাম।
- ঐ গাধা, কাঁদিস কেন? তুই তো এখন আর্মি অফিসার। আর্মি অফিসার কাঁদলে কী দেখতে ভালো লাগে?

মুমিতের সাথে শেষ দেখা হলো ওর শেষ জন্মদিনে। একদিন বিকেলে বাসায় বসে আছি। হঠাৎ দেখি মুমিত সাতটা বার্গার নিয়ে হাজির হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম।
- ব্যাপার কী? হঠাৎ খাওয়া-দাওয়া।
তানিম বলল- আজকে মুমিতের বার্থডে।

৮ নভেম্বর ২০০৫।
দুইদিন পর বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা। সকাল আটটার দিকে নাস্তা করে সবাই- এতদিনের জমে থাকা পড়াগুলো কিছুটা লাইনে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। এমন সময় তানিমের মোবাইলে ফোন এল। হঠাৎ আমরা তানিমের চিৎকার শুনতে পেলাম। আমরা তানিমের কাছে ছুটে গেলাম। দেখলাম তানিমের চোখ থেকে পানি নেমে প্রায় পুরো মুখটাই ভিজে গেছে। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল।
- তানিম, কী হইছে?
- দোস্ত। মুমিত মারা গেছে।
সেদিন সকালে- আর্মির জন্য মুমিত বাসার পাশের পুকুরে সাঁতার প্রাকটিস করছিল। সাথে ছিল ওর বড় ভাই। হঠাৎ-ই মুমিত ডুবে যায়। মুমিত বাঁচার জন্য অনেক চিৎকার করেছিল। কিন্তু আশেপাশের মানুষজন তাকে বাঁচাতে সাহস পায় নি। পুকুরটায় ঐ মাসেই নাকি আরো দুইজন ডুবে মরেছে। পুকুরটার দোষ আছে।
মুমিত যেদিন মারা গেল তার আগের রাতে তানিমের মোবাইলে এসএমএস করেছিল।
এসএমএসটার বাংলা করলে এমন হয়ঃ
''যখন কোটি কোটি মানুষ তোদের মিস করে- আমি তাদের মধ্যে একজন। যখন হাজারো মানুষ তোদের মিস করে- আমি তাদের মধ্যে একজন। যখন কেউ তোদের মিস করে না- তখন জেনে নিস- আমি এই পৃথিবীতে নেই...''
পৃথিবীতে নাকি মাঝে মধ্যে কাকতালীয় সব ঘটনা ঘটে। তবে এই ঘটনার ব্যাখ্যা আমি এখনো খুঁজে পাই নি।

আমরা তখনই চট্টগ্রাম গেলাম। মুমিতের জানাজা পড়লাম। মুমিতের কবরে মাটি দিলাম। শেষবারের মত কাফনের কাপড় সরিয়ে মুমিতের মুখ দেখলাম- মৃত্যুও মুমিতের মুখের সেই বাচ্চা-বাচ্চা হাসিটা কেড়ে নিতে পারে নি।

মুমিতের কবর- চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ঠিক পাশে। গত বছর ৮ নভেম্বর আমাদের কলেজে অনেকেই চট্টগ্রাম ছিলাম। হয়ত দুই একবার কোন কাজে পাঁচলাইশ থানার দিকে গিয়েছিলাম। কিন্তু মুমিতের কবরের কাছে যাওয়ার কথা আমাদের মনে হয় নি।

মুমিত অসম্ভব সুন্দর ছবি আঁকত। মুমিতের আঁকা ছবি দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে যেতাম। মারা যাওয়ার কয়েকদিন মুমিতকে বলেছিলাম।
- দোস্ত। আমার ব্যান্ডের ফার্স্ট এলবামের প্রচ্ছদ তুই আঁকবি।
আমার কেন যেন মনে হয়- মৃত্যুর পরের জগতে মুমিতের হাতের কাছে সবসময় রঙ- তুলি- ক্যানভাস থাকে। যখন ইচ্ছা হয় মুমিত অদ্ভুত সব ছবি আঁকে- যেমন আঁকতে দেখেছি ক্যাডেট কলেজের ছয়টা বছর। পরকালের রহস্যময় জগতে- মুমিতের সঙ্গে আমার দেখা হবে। আমি মুমিতকে জিজ্ঞেস করব।
- দোস্ত। প্রচ্ছদটা আঁকছিস?
মুমিত তার চিরাচরিত বাচ্চা বাচ্চা হাসিটা মুখে নিয়ে- অসম্ভব সুন্দর একটা ছবি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলবে।
- তোরা আমাকে ভুলে গেছিস। তাই বলে আমিও তোদের ভুলে যাব- সেটা ভাবলি কী করে?


মন্তব্য

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

দিলেন তো মন খারাপ করিয়ে !

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আপনার এই ''মন খারাপ'' হওয়া নিশ্চয়ই এতক্ষণে মুমিতের কাছে ভালোবাসা হয়ে পৌঁছে গেছে

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

স্বপ্নাহত এর ছবি

যতদূর গেলে পলায়ন হয়,ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে...

(নির্বাসিত দা,এই লাইনটার সাথে পরিচয় আপনার হাত ধরে।সবার আগে এ কথাটাই মনে হল।লিখে দিলাম।আশা করি কিছু মনে করবেন না)

মুমিতও পারবেনা।তোর,আমার,সবার ভালবাসায় বেঁচে থাকবে।

যদি কখনো পালিয়ে যায় তবে তার দায়ভার আমাদেরকেই নিতে হবে।
প্রার্থনা করি অন্তত একটি বারের মত যেন নিজেদেরকে দায়ী না ভাবতে হয়।

মুমিত ভাল থাকুক...

=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=-=
বুকের মধ্যে আস্ত একটা নদী নিয়ে ঘুরি

---------------------------------

বাঁইচ্যা আছি

জাহিদ হোসেন এর ছবি

লাইনটি দেখি বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে আপনাদের কল্যাণে। আহা-এর লেখকের নামটি যদি মনে থাকতো আজ।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

জিহাদ এর ছবি

লাইনটা আমারও পছন্দ হয়ে গ্যাসে।কিছু করার নাই।ব্যাপারটা আর হাতে নাই...

পরিবর্তনশীল এর ছবি

লাইনটা সত্যিই অসাধারণ...
এক লাইনে অনেক কথা বলে দেওয়া যায়।

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

রায়হান আবীর এর ছবি

এভাবে চলে যাওয়া ঠিক না...

---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...

পরিবর্তনশীল এর ছবি

হুম... খুব বেশি অন্যায়।
যে অন্যায়ের কারণে আমাদেরই কষ্ট পেতে হয়।

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অতিথি লেখক এর ছবি

মুমিতের আত্তার শান্তি কামনায়॥

অসম্ভব সুন্দর একটা লেখা।

############################

শুভ রহমান

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আমাদের ভালোবাসা মুমিতকে কষ্ট পেতে দেবে না
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

শিক্ষানবিস এর ছবি

তবুও চলে যেতে হয়। একবার গেলে আর ফিরে আসা যায় না। আসলেই কোথাও চলে যায় কি-না তাও কেউ জানে না। ক্যামনে কি?

---------------------------------
মুহাম্মদ

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আসলেই কোথাও চলে যায় কি-না তাও কেউ জানে না

খুব ভালো লাগল কথাটা
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

জাহিদ হোসেন এর ছবি

চোখে পানি নিয়ে লিখছি এখন।
সব মৃত্যুই শোকের, তবুও কেন জানিনে বন্ধুর মৃত্যুকে মেনে নিতে বড় কষ্ট হয়। আমি বিশ্বাস করি যে এই পরিচয়টি মৃত্যুর সাথে সাথেই মুছে যায়না। দেখা হবে, অবশ্যই দেখা হবে একদিন। (শীর্ষেন্দুর একটি ছোট গল্প আছে, নাম খুব সম্ভবতঃ 'দেখা হবে'। পড়ে দেখবেন।)
মুমিতকে হারিয়ে যেতে দেবেন না।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের জন্য মানুষের চোখে পানি আসে।
মানুষ কী অদ্ভুত! মানুষ কী অসাধারণ
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

................................................................................
objects in the rear view mirror may appear closer than they are ...

পরিবর্তনশীল এর ছবি

ফাহিম ভাই...আপনি দেখি ডুমুরের ফুল হয়ে গেলেন।
আর অনেকদিন পর আসলেও কোন কথা বলেন না।
খালি ইংরেজীতে কী একটা ডায়ালগ দিলেন।
যেটা আমার এন্টেনার ওপর দিয়ে যায়
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

জিফরান খালেদ এর ছবি

বড় খারাপ লাগলো...।

এমনো কতো বিষাদময় আখ্যান নিয়ে বেঁচে থাকা আমাদের ...

পরিবর্তনশীল এর ছবি

এমনো কতো বিষাদময় আখ্যান নিয়ে বেঁচে থাকা আমাদের ...

এটাই বোধহয় আমাদের সার্থকতা
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক কষ্ট হচ্ছে পোষ্টটা পড়ে। আমার এক বন্ধু বলেছিল মনে রাখিস, একজন বন্ধু আরেকজন বন্ধুর জন্য তার নিজের মধ্যে সব ধরনের সম্পর্ক ধারন করে যেমন বাবা-মা, ভাই-বোন আরো অনেক এবং অকৃপনভাবে বন্ধু এই সম্পর্কের আদর, মমতা, ভালবাসা বিলিয়ে দেয়.

আমিও সেই সৌভাগ্যেদের মধ্যে একজন যার একজন উপরোক্ত গুন সম্পূর্ন বন্ধু আছে। আমি যখন আমার বন্ধুর সাথে থাকি তখন আমার বয়স কমে পাঁচ বছর হয়ে যায় আর অবলীলায় আমার বন্ধু আমার সকলছেলেমানুষী যন্ত্রনাগুলো সহ্য করে যায়। মাঝে মাঝে আমি ভাবতে থাকি "ওর সহ্যের ক্ষমতা কত"!!

মুমিত তো আর ফিরে আসতে পারবেন না কিন্তু কামনা করি আপনাদের স্মুতির মাঝে তিনি চিরদিন অমলিন হয়ে বেঁচে থাকবেন।

কল্পনা আক্তার

............................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাচেঁনা

পরিবর্তনশীল এর ছবি

বন্ধু সবুজ চিরদিন
বন্ধুত্বের বয়স বাড়ে না।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

লেখাটি মন ছুঁয়েছে।
মুমিত ভালো থাকুক, যেখানেই থাকুক।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

আমি জানি মুমিত ভালো আছে।
মুমিত তো দেখতে পাচ্ছে-
তার জন্য এতগুলো মানুষের ভালোবাসা
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

নজমুল আলবাব এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

মুমিতেরা বেচে থাকবে অনন্তকাল

মুমিতেরা কখনো হারিয়ে যায় না। আমাদের মনের গহীন কোনে ওদের বাস।

আমরাই তাদের বাচিয়ে রাখবো...............

-মাছরাঙগা
web: http://machranga.blogspot.com
mail:

কনফুসিয়াস এর ছবি

............।
-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।