দেশ বিভাগ - সুফল ও কুফল

রাগিব এর ছবি
লিখেছেন রাগিব (তারিখ: বুধ, ০৪/০৭/২০০৭ - ১:৫০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto

মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে কিছু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ছাত্র ছাত্রী রয়েছে। ওদের সাথে নিয়মিত দেখা হলেই আমরা প্রাণ খুলে বাংলায় কথা বলি। যদিও কথার আঞ্চলিক টান দুই বাংলায় দুই রকম, তবু বাংলা ভাষার এই পুরানো বন্ধন এক করে রাখে বাঙালিদের।

তাই মাঝে মাঝে মনে হয়, ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ আমাদের কী সুফল দিয়েছে, আর কী সর্বনাশ ডেকেছে।

সুফলের মধ্যে প্রথমেই আসে পূর্ববঙ্গের উন্নতি। হ্যাঁ, পাকিস্তানী আমলে কিছুটা সমস্যা হয়েছে, কিন্তু তবুও তো পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় একটা দুটো করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বুয়েট একটা স্থানীয় কলেজ হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে। কলকাতাকেন্দ্রীক রাজনীতির জন্য পূর্ববঙ্গ সব সময় অবহেলিত হয়েছিলো, নগরায়ন, শিল্পায়ন সব দিকেই পিছিয়ে ছিলো। অন্তত সে দিক হতে আলাদা হয়ে পূর্ববঙ্গ নতুন দিক নির্দেশনা পেয়েছে। এখানকার সংখ্যালঘুদের অনেক সমস্যা হয়েছে, কিন্তু পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের ব্যাপক সামাজিক, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক উন্নতি হয়েছে। আজকেই প্রথম আলোতে আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা পড়ছিলাম, উনি লিখেছেন, দেশভাগের পরে পঞ্চাশের দশক হয়েছিলো বাঙালি মুসলমানের বাঙালি হয়ে ওঠার সময়, আত্মপরিচয় ফিরে পাওয়ার সূচনার সময়।

এবার আসি কী সর্বনাশ হয়েছে। পূর্ববঙ্গের এক বিশাল বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশ ভাগের সময় ও পরের বছরগুলোতে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। নিজের দেশ ছাড়তে তাঁদের কী পরিমাণ কষ্ট হয়েছে, তা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব না কোনোদিনই। আজো অনেক পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির সাথে কথা হলে তাঁরা আমাকে বলেন, তাঁদের বাবা বা মার বাড়ি চট্টগ্রাম, বা বরিশাল, আজো তাদের বাবা-মায়েরা পূর্ববঙ্গের দেশের বাড়ির কথা বলেন। আমরা হারিয়েছি জীবনানন্দ দাশ, অমর্ত্য সেন, মেঘনাদ সাহা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, এদের। পশ্চিমবাংলার বর্তমানের প্রচন্ড খ্যাতনামা অনেক সাহিত্যিকের বাড়িই কিন্তু পূর্ববঙ্গে।

আরবানার টেগোর ফেস্টিভ্যালে সুনীল আর মমতাজউদ্দিন এসেছিলেন। দুজনের কথাতেই এই বেদনার প্রকাশ ঘটলো। সুনীলের বাড়ি ফরিদপুরে, আর মমতাজউদ্দিনের বাড়ি মালদহে। ৪৭ এর দেশ বিভাগের পরে দুজনেই নিজের মাটি ছেড়ে চলে গেছেন পরদেশে। সুনীলকে কাছ থেকে দেখে সহজেই দেখতে পেলাম, সেই বাঙ্গাল চেহারার ছাপ। কথাতেও আজও কলকাতার প্রভাব অতটা লাগেনি।

অমর্ত্য সেনের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাড়ি পুরানো ঢাকায়। সেরকমই জ্যোতি বসুর বাড়ি।

এভাবে দেশ ভাগের ফলে আমাদের বাঙালি সত্ত্বা দ্বিখন্ডিত হয়ে পড়েছে আজ।

অবশ্য, সুফল কুফল বিচার করে দেশ বিভাগ না হলে কী হতো, তা বলাও কঠিন। দেশ ভাগ না হলে অমর্ত্য সেন হয়তো ঢাকার অর্থনীতিবিদ হিসাবে আমাদের খুব কাছে থাকতেন, কিন্তু দুলা মিঞা সওদাগরের ছেলে মুহাম্মদ ইউনুস হয়তো ডঃ ইউনুস হতে পারতেন না, সুযোগের অভাবে।

যাহোক, অনেক লম্বা করে ফেললাম কথা। আসলে একটু আগে আমার অ্যালবামে সুনীল আর মমতাজউদ্দিনের সেই ব্যথিত চাহনির ছবিগুলো চোখে পড়লো, তাই এতো কথা এলো মনের মাঝে। হাজার পাসপোর্ট আর কাঁটা তারের বেড়া সত্ত্বেও দুজনেই বাঙালি, বাংলার মাটির সাথেই নাড়ির টান

(ম্যাপটি ১৮৯৩ সালের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ম্যাপ, উইকিপিডিয়া হতে মুক্ত লাইসেন্সে প্রাপ্ত)।

(first published in SomewhereinBlog, February 27, 2007)


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

দেশবিভাগের সময় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আর্থিক অসামঞ্জস্য ছিলো, টাকার অঙ্কটা ভুলে গেছি। কলকাতা বা লাহোর, দু'টি শহরের একটি দিয়ে তার ভারসাম্য রক্ষার প্রস্তাব করা হয়। বাঙালি আবেদন জানিয়েছিলো কলকাতার জন্য। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বাঙালি নেতাদের কথায় কর্ণপাত করেননি, তিনি তার নস্টালজিয়ামাখা লাহোর শহর বেছে নেন মথ-ইটেন পাকিস্তানের জন্য। সূত্র, হস্তান্তর, শংকর ঘোষ।


হাঁটুপানির জলদস্যু

হাসিব এর ছবি

অফ টপিক, কেউ কি বাংলাদেশের ম্যাপের কোন অফিশিয়াল সোর্স দিতে পারবেন ?


আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে

রাগিব এর ছবি

http://commons.wikimedia.org/wiki/Category:Maps_of_Bangladesh

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

হযবরল এর ছবি

এখানে কোলকাতার কিছু বন্ধুদের দেখেছি, বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা কতখানি উচ্ছসিত। ভিন্নমতের মানুষ ও আছে প্রচুর। তবে একটা বড় অংশ আছে যারা বাংলা ভাষাভাষীদের নেতৃত্বদানের জন্য বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে আনন্দিত। তবে ভারতের অনেক মানুষ ভাবে আমরা উর্দুতে কথা বলি। এই ধরণের কিছু ভুল ধারণা ওদের আছে আমাদের নিয়ে। আমার মনে হয়েছে দুদেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়টা কোলকাতা-বাংলাদেশ না হয়ে ভারত-বাংলাদেশ হওয়া দরকার। তেমনি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের উচিত ছবি প্রদর্শনের সময় মনে রাখা যে বলিঊড বাদেও ভারতে ছবি তৈরি হয় এবং ভাল ছবিই তৈরি হয়।

এস্কিমো এর ছবি

বিষয়টা এখানেও ঘটে।
কলকাতার লোকজন ভারতীয়দের চেয়ে আমাদের সাথেই বেশী স্বাচ্ছন্ধ্য বোধ করে।

যাই হোক ...দেশ বিভাগের পর ২৪ বছর পাকি শাসন বাদ দিলে কিন্তু আমাদের লাভের পাল্লাটা ভারী। বিশেষ করে বাংলাভাষা আর সংস্কৃতির বিষয়টা বিবেচনা করলে ভয় হয় - যদি এখনও অখন্ড ভারত থাকতো হয়তো আমরা এভাবে এই ব্লগে বাংলায় লিখতাম না - সেটা বাস্তবতার কারনেই।

লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?

সিরাত এর ছবি

কলকাতার লোকজন ভারতীয়দের চেয়ে আমাদের সাথেই বেশী স্বাচ্ছন্ধ্য বোধ করে।

এটা কতটা ঠিক?

উৎস এর ছবি

অনেক কিছুই হতে পারত, আবার অনেক কিছুই হতো না এই আর কি। লাভ ক্ষতি দুরকমই আছে।

সিরাত এর ছবি

দারুণ লাগলো। এরকম একটি টপিক নিয়ে আমার নিজেরও লেখার ইচ্ছা বহুদিন ধরেই।

রাগিব এর ছবি

আপনি হয়তো আরো ভালো ও ইন্টারেস্টিং দিক খুঁজে পাবেন। ভেবে দেখুন স্ট্রাটেজি গেইমের মতো করে, ১৯৪৭ এ অখন্ড ভারত বর্ষ হলো, কিংবা অখন্ড বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হলো। মনে মনে সিম্যুলেট করুন নিজের বাপ-দাদার অবস্থা দিয়ে।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | কুহুকুহু

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

সিরাত এর ছবি

সেটাই।

এরকম বিশাল একটা টপিক নিয়ে লেখার একটা সমস্যা হল, বহুৎ খাটা-খাটনি করে, চিন্তা করে লিখতে হবে। তারপরও বহু লোক এমনিতেই ফাউ পছন্দ করবে না।

তারপরও, কেবল নিজের মজার জন্য হলেও ভাবা, লেখা দরকার। আর একটু জ্ঞান আহরণ করি, তারপর!

সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুর এর ছবি

দেশ বিভাগের মধ্য দিয়ে এসেছে বহু প্রতিক্ষীত স্বাধীনতা এবং তার সঙ্গে এসেছে ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলার অজস্র ছিন্নমুল সর্বহারা মানুষের স্রোত। হাজার হাজার বাঙ্গালী বনেদী পরিবার মিশে গেছে মাটিতে। নিজের জমি নিজের ঘর নিজের শৈশব ফেলে যাদের চলে যেতে হয়েছে অন্য দেশে সেখানে তাদের ধর্ম ছাড়া আর কিছুই নেই। হয় জলের দরে অথবা ভয়ে সব কিছু ছেড়ে দিয়ে এসেছে তারা। কেউ কেউ জেদ করে রয়েও গেছে নিজের বাপ ঠাকুরদ্দার ভিটে আকড়ে ধরে। এক পিড়ীত বৃদ্ধা ছেড়ে যান নি তার বাড়ি। হুজুগের বাজারে ধরতে পারেন নি পারিপার্শ্বিক অবস্থা। ছেলে মেয়ে নাতী নাত্নী চলে গেলো দেশ ছেড়ে। ৪ দিন পর সেই বৃদ্ধা পাওয়া গেলো মেঘনার বুকে। যে ঘড়ে এক সময় নিত্যদিন পুজো হতো, কোন নারী এসে পুজো দিতো কুল দেবতাকে। রাত গভীর হলে শুরু হতো সঙ্গীতের সুর লাহরী আর সুরার পাত্রের ঠোকাঠূকির শব্দ। সে ঘরে এখন তা আর হয়না এই দেখার জন্যই কি এতো মানুষ মরলো? ঐ সময় অনেক শিশু জন্মেছিলো তারা আজ বৃদ্ধ। তাদের কাছে আজ প্রশ্ন করলে হয়তো দোষারপ করবে তাদের পুর্ব পুরুষদের। ভগৎ সিং, সূর্য সেন, তিতুমীর, হাবিলদার রজব আলীরা কি এই দুটো দেশ দেখার জন্য ই প্রাণ দিয়েছিলেন। না কি অবিভক্ত ভারতের স্বপ্ন ও তাদের মাঝে ছিলো। যে স্বপ্ন তাদের নিয়ে গিয়েছিলো ফাসির মঞ্চের দিকে। তাদের সবাই ভুলে গেলো শুধু তৈরী হলো কিছু ছার পোকার মতো দল, দেখা দিলো সুবিধাবাদী মানুষ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।