স্টেরিওটাইপের কথকতা

রাগিব এর ছবি
লিখেছেন রাগিব (তারিখ: মঙ্গল, ২৫/০৩/২০০৮ - ২:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্টেরিওটাইপ শব্দটা মূলত ঋণাত্মক অর্থেই ব্যবহৃত হয় ... কাউকে তার কোনো বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ঢালাও ভাবে কিছু একটা ভাবাই এর অর্থ। কমেডি ঘরাণার মূল কৌশলগুলোর মধ্যে এটি একটা ... ভাঁড় গোছের চরিত্রকে দিয়ে ভাড়ামি করাতে হলে তাকে স্টেরিওটাইপড করে ফেলা যায়, আর যে গোষ্ঠীর মধ্যে ফেলা, তাদের দুর্নাম যেকারণে, তা দেখিয়ে দর্শকদের (যারা আবার ঐ গোত্রে পড়েনা) বিস্তর আমোদ দেয়া চলে।

বাংলা নাটকে এই রকম স্টেরিওটাইপের ছড়াছড়ি। আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যেসব নাটক হতো, তার নাট্যকারেরা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে আসতেন বলে মনে হয় (হয়তোবা আমিও এখানে স্টেরিওটাইপে ফেলছি তাদের)। সেজন্য অধিকাংশ নাটকেই কমিক রিলিফ চরিত্রটি হতো নোয়াখালী বা চট্টগ্রামের, অবোধ্য অমার্জিত শব্দ চয়নে যাদের বিমল আনন্দ। নাটকের ঘটক হবে গোলটুপী পরা, বাম গালে একটা বড় আঁচিল থাকবে, হাতে একটা ছাতা। আদিবাসী কাউকে দেখাতে হলে তার নাম হবে মলুয়া, কথা বলবে “বটেক”, “বাবু”, “হামি” এরকম ভাষাতে। গ্রামবাসী নায়ক নায়িকার মা কথা বলবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রংপুরের ভাষাতে, অথবা নিতান্তই “শুদ্ধ” ভাষাতে। মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রটি হবে হতদরিদ্র, এবং অধুনা-ক্ষমতাধর-পূর্বে রাজাকার মোড়লের হাতে নিগৃহীত। নাটক থেকে সিনেমাতেও আসবে এসব স্টেরিওটাইপ, নায়িকার বড়লোক বাবার নাম হবে অবধারিত ভাবে “চৌধুরী সাহেব”, বাড়ির ভেতরে পরবেন ড্রেসিং গাউন, ধুমপানের পাইপ হাতে সিঁড়ি বেয়ে নামবেন। নায়ক গরীব কিন্তু শিক্ষিত হলে নির্ঘাত হবে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। বাংলা নাট্যকারদের দোষ দেই কীভাবে, স্বয়ং শেক্সপিয়ারের নাটকে স্টেরিওটাইপের ছড়াছড়ি ... ইহুদি শাইলক হয় ভিলেন, চার্লস ডিকেন্সের অলিভার টুইস্টের ঘৃণ্য ভিলেন ফ্যাগিনকেও দেখানো হয়েছে ইহুদি। সেরকম হালের মারদাঙ্গা টাইপের হলিউডী ছবিতে ভিলেনটা হয় আরব মুসলমান।

নাটক-সিনেমা থেকে বাস্তবতার মধ্যেও একই দশা। হিন্দু হলেই ধরে নেয়া হবে, ব্যাটা একটু পরেই সব কিছু পাচার করে দেবে ভারতে, অথবা আওয়ামী লীগের সমর্থক হবে। কারো মাথায় টুপি থাকলে, বা মুঠোখানেক দাড়ি থাকলে সন্দেহ হবে, জামাত-শিবির কি না। চারুকলা কিংবা স্থাপত্যের ছাত্রদের হতে হবে লম্বা এলোমেলো চুলের সিগারেট ফোঁকা চেহারা, আর বুয়েটের প্রকৌশলবিদ্যার কারিগরেরা হবে চশমাপরা নিরীহ চেহারার বিশিষ্ট আঁতেল। বুদ্ধিজীবীরা হবে ফতুয়া বা পাঞ্জাবী পরা, কাঁধে শাল। সাফারি সুট কিংবা মুজিব কোটে বেরিয়ে আসবে রাজনৈতিক পরিচয়।

এহেন মানসিকতা অব্যাহত থাকবে দেশের বাইরে এলেও। কৃষ্ণাঙ্গ দেখলেই সন্দেহ হবে, ছিনতাই করবে নির্ঘাত এখনই। (আমার এক বাঙালি বন্ধু এই সমস্যাতে পড়ে প্রায়ই ... হুডতোলা জ্যাকেট পরে ক্যাম্পাসের রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যায় হেঁটে গেলে নাকি উলটো দিক থেকে আসা ছেলে মেয়েরা সবাই ভয় পেয়ে রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকে হাঁটে)।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় বা পাকিস্তানীদের স্টেরিওটাইপ কিছুদিন আগে পর্যন্তও ছিলো মুদী দোকানদার হিসাবে ... ইদানিং অবশ্য গাদায় গাদায় দক্ষিণ এশীয় প্রকৌশলীদের দেখে সেটা কমেছে। ভিলেনের স্টেরিওটাইপের ব্যাপারটা কালে কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালটে গেছে ... বর্ণবাদের আমলে ভিলেন হতো কৃষ্ণাঙ্গরা ... তাদের “পাশবিকতা” দেখানো হতো, আর শ্বেতাঙ্গ নায়ক অসহায় নায়িকাকে উদ্ধার করতো এই কৃষ্ণাঙ্গ ভিলেনের কবল থেকে। বিংশ শতকের শুরুতে ইতালীয়দের অভিবাসন বেড়ে যায়, আর দরিদ্র ইতালীয় অভিবাসীরা অনেক শ্বেতাঙ্গ মার্কিনীর কাজ আরো কম বেতনে করে হাতিয়ে নেয়। ফলে সে সময়কার গল্প নাটকে সিনেমাতে ভিলেনের স্টেরিওটাইপে এসে পড়ে ইতালীয়রা। ইহুদীবিদ্বেষ অব্যাহত থাকায় ধনী ভিলেন দেখানো হতো এই ধর্মাবলম্বী কাউকে। সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশক জুড়ে জাপানি ব্যবসায়ীরা নবলব্ধ বিত্তে কিনতে থাকে আমেরিকার সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এ সময়ের এশীয়-বিরোধী স্টেরিওটাইপিংটাও লক্ষ্যনীয়। গল্প সিনেমাতে এশীয় পুরুষ হলেই হতো গ্যাংস্টার, ধুর্ত ব্যবসায়ী, কিংবা বেকুব গোছের বোকাসোকা দোকানদার – মূল নায়কের সাথে ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বোল বলে হাসির পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই তার কাজ।

অবশ্য স্টেরিওটাইপ নিয়ে মস্করাও কম করা হয় না টিভি/সিনেমাতে। জনপ্রিয় মার্কিন কার্টুন দ্য সিম্পসন্সের সবগুলো চরিত্রই ইচ্ছাকৃতভাবে চরম স্টেরিওটাইপড। ভারতীয় মুদী-দোকানী অপু, কুটকৌশলী ব্যবসায়ী মিস্টার বার্ন্স, হোমার সিম্পসন নিজেই – সবই বিভিন্ন স্টেরিওটাইপ, আর ইচ্ছা করেই তাদের বিভিন্ন আচরণ দেখিয়ে স্টেরিওটাইপিংকেই মস্করা করা হয়। একই ব্যাপার দেখি আরেক জনপ্রিয় কার্টুন “ফ্যামিলি গাই”-তে, সবাই সেখানে স্টেরিওটাইপড, সবার কাজই স্টেরিওটাইপ অনুসারে।

স্টেরিওটাইপিং নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক না কেনো, হয়তো এটা থেকে বেরুনো সম্ভব না আমাদের কারো পক্ষেই। অনেক চিন্তা করে যা মনে হয়, এটা মানুষের অবচেতনে প্রোথিত একটা ব্যাপার – সেই আদিম কালে মানুষ যখন প্রকৃতি আর অন্য প্রাণীদের সাথে সংগ্রামে ব্যস্ত, তখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হতো এক মুহুর্তেই যে, সামনে যা এসেছে তা শত্রু না মিত্র। আর সেই ক্ষণিক-সিদ্ধান্ত নিতে হলে চেহারা দেখে আন্দাজ করাটাই একমাত্র কৌশল ... আচরণ-বিচার করার সময় কোথায়।

পূর্বপুরুষদের সেই প্রবৃত্তি আজও হয়তো রয়েছে আমাদের মনের গহীনে, তাই দেখামাত্র কাউকে ফেলে দেই স্টেরিওটাইপে, লেবেল লাগিয়ে দেই ইচ্ছে মতো। হয়তো এই প্রবৃত্তির কবল থেকে মুক্তি নেই আমাদের, যতোই চেষ্টা কসরত করি না কেনো।

হয়তোবা এ আমাদের মানবিক সীমাবদ্ধতা।


মন্তব্য

দিগন্ত এর ছবি

এ আমাদের মানবিক সীমাবদ্ধতা।

আমার এটাই কারণ বলে মনে হয়েছে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

চমৎকার বিশ্লেষণ
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

রায়হান আবীর এর ছবি

আমাদের সবারই চোখে লাগে ব্যাপারটা...আবার চর্চাও আমরা সবাই করি। মুক্তি নাই...এর থেকে মুক্তি নাই...
---------------------------------
এসো খেলি নতুন এক খেলা
দু'দলের হেরে যাবার প্রতিযোগিতা...

রাগিব এর ছবি

আসলেই মুক্তি নাই। লিখতে শুরু করার সময়ে ভেবেছিলাম, স্টেরিওটাইপের সমস্যা নিয়ে লিখবো, কিন্তু শেষ মাথায় এসে দেখি আমরা নিজেরাও স্টেরিওটাইপিং করি সব সময় মন খারাপ

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

দুর্দান্ত এর ছবি

লন্ডনের ব্যাঙ্কপাড়ায় - গাঢ় রঙের সুট, যুতসই টাই আর চকচকে জুতা - এর যে কোন একটা বাদে সামনে একটা বাক্স মেলে ধরে রাস্তার মোড়ে মিনিট পনের দাঁড়িয়ে থাকুন - ওইদিনের খাওয়ার খরচ উঠে যাবে।

হেগ এর কোন পরব পার্টিতে আবার ওই একই গাঢ় রঙের স্যূট গায়ে চড়িয়ে আসুন, দরজা খুলে কুশল দেয়ানেয়ার পর গৃহস্থ জানতে চাইবে আপনার কোন আত্মীয় মরেছেন কি না...

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

মজার লেখা । চলুক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এটা এক ধরনের আইকনোগ্রাফি
একেকটা গোষ্ঠীকে একেকটা লাইভ আইকনে ফেলে তাকে চিনে নিয়ে সহজে রিকল করার ব্যবস্থা করা

প্রতিটি ব্যক্তি মানুষই এটা করে তার নিজের সুবিধার জন্য। আর অন্যের কাছে সহজে কিছুর পরিচিতি দেবার জন্য আমরাও করি
শুনেছি এখও অনেক বাঙালি আছেন যারা দেশের বাইরে নিজেদেরকে পরিচয় দেবার সময় বলেন ইন্ডিয়ান

ইন্ডিয়ান বললে বিদেশীদের চোখে বন্যা-মেলেরিয়া আর এক্সোটিজম মিলে মিশে একটা প্রাচীন ইমেজ উঠে আসে
যা দিয়ে তারা সহজেই চিনে নিতে পারে আমাকে কিংবা আমার মতো অনেককে
যদিও সেই ইমেজ আমাদের বিপরীতেই যায় বেশিরভাগ সময়

কনফুসিয়াস এর ছবি

চমৎকার একটা লেখা। একদম মনের কথা বলেছেন।

-----------------------------------
... করি বাংলায় চিৎকার ...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

শিক্ষানবিস এর ছবি

স্টেরিওটাইপ! ব্যাপারটা খুব ভালো বুঝে গেলাম। আসলেই স্টেরিওটাইপ থেকে মুক্তি নেই। আমাদের দেশের বুদ্ধিমান মহল এরকম প্রচুর স্টেরিওটাইপ তৈরী করেন নিজেদের সুবিধার জন্য।

কোন একটা বিষয় হয়তো জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল যা কোন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী মহলের আদর্শ বিরোধী। তখন তারা সেই বিশেষ কিছু একটার একটা বিশেষ নাম দিয়ে দিলেন। নামের সাথে আবার ঘৃণীত কিছু একটার সম্পর্ক দেখিয়ে দিলেন। তারপর সভা-সমিতি-পত্রিকা আর গণমাধ্যমে ঢালাওভাবে প্রচার করলেন সেটা। ব্যাস, জঘণ্য একটা স্টেরিওটাইপ হয়ে গেল।

রাগিব এর ছবি

আমার মনে হয় কেবল বুদ্ধিজীবীরা না, আমরা সবাইই স্টেরিওটাইপ তৈরী করি। গ্রামের লোকে কেমন হবে, নোয়াখালী নিবাসীরা কী করে কথা বলবে, চাটগেঁয়েরা কীভাবে দুর্বোধ্য ভাষায় কলকল করবে, এসব আমাদের মধ্যেই তৈরী হয়ে যায়।
----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
http://www.ragibhasan.com

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

শিক্ষানবিস এর ছবি

হ্যা। আসলে আমরা সবাই করি। এ থেকে মুক্তি নেই যেন। তবে একটা নিয়ম মেনে চললে বোধহয় মুক্তি পাওয়া যাবে। কলেজে থাকতে একবার এক নৃতাত্ত্বিক গেস্ট স্পিকার হিসেবে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন। নৃতত্ত্ব তিনিই শিখিয়েছেন আমাকে। আমাদের প্রিন্সিপাল বলতেন, "আমি পান খাই আর তুমি খাও না, এটাই নৃতত্ত্ব"।

তিনি বলেছিলেন, যে যেমন তাকে তেমন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করার নামই নৃতত্ত্ব। নৃতত্ত্বে কোন স্ট্যান্ডার্ড নেই যার ভিত্তিতে বিচার করতে হবে। এজন্যই নৃতাত্ত্বিকেরা গভীর জঙ্গলে গিয়ে উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর সাথে মিশে যান তাদেরকে বোঝার জন্য। এই নীতি মানতে পারলে অনেকটাই সমাধান সম্ভব।

রাশেদ এর ছবি

ভাল্লাগছে।

Bappy এর ছবি

ভাল লাগল। আমি নিজে অনেক "স্টেরিওটাইপড" আচরণ থেকে মুক্ত এমনটাই ভাবতাম! এখন দেখি না!!
আমিও কম স্টেরিওটাইপড না!

ভাইয়া আমি একজন বুয়েটিয়ান! cse তে পড়ি।

বাপ্পি
http://prometheandreamer.blogspot.com

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।