গল্প প্রচেষ্টা-২২

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: সোম, ০৮/১০/২০১২ - ২:৩২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঠাঁই

সদরঘাট থেকে কলাকোপা-বান্দুরাগামী লঞ্চগুলোকে যেসব স্টেশন ধরে যেতে হয় তার একটাতে যদি পন্টুন থাকে তাহলে তার ঠিক পরেরটাতে পন্টুন থাকেনা। যেমন, প্রথম স্টেশন ফতুল্লাতে পন্টুন থাকলেও পরের স্টেশন সাপের চরে পন্টুন নেই। সাপের চরের পরে রামকৃষ্ণদীতে পন্টুন আছে, কিন্তু এর পরের গাবেরপাড়াতে নেই। এই এক্কা-দোক্কার হিসেব এরপরে যথাক্রমে সৈয়দপুর, আলমপুর, কলাকোপা, বান্দুরার জন্য প্রযোজ্য। এই হিসেবের কারণ কি সরকারের তহবিলে ঘাটতি, নাকি জনপ্রতিনিধিদের অবহেলা, নাকি অন্য কিছু সেটা জানা নেই। পন্টুনবিহীন স্টেশনগুলোতে এমভি মুন্নী বা এমভি মামুনের মতো বড় লঞ্চগুলো থামে না। সেখানে এমএল বাবলী বা এমএল দয়াল খাজা’র মতো ছোট লঞ্চেরা কাঠের সিঁড়ি করে যাত্রী উঠা-নামা করায়।

কী কারণে যেনো ধলেশ্বরী নদীর পাড়ের গাবেরপাড়া স্টেশনটা একদিন উঠে যায়। স্টেশন তখন আরো বামে কুইচ্ছামারাতে চলে আসে। তবে তাতেও তার ভাগ্যে পন্টুন জোটে না। আরো পরে পোস্তগোলাতে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর চীন সরকারের সহায়তায় সেতু তৈরি হয়ে গেলে, ঢাকা থেকে খুলনা যাবার জন্য পোস্তগোলা থেকে আবদুল্লাহ্‌পুর হয়ে পদ্মাপাড়ের মাওয়া পর্যন্ত মহাসড়ক তৈরি হয়ে যায়। এর কিছুদিনের মধ্যে গাবেরপাড়া বা কুইচ্ছামারা কোন লঞ্চ স্টেশনই আর থাকে না, কারণ ঐ রুটের লঞ্চ সার্ভিসই বন্ধ হয়ে যায়। এর জন্য মহাসড়কের দায় না যতটুকু তারচেয়ে বেশি দায় পাওয়ার টিলারের বা শ্যালো পাম্পের ইঞ্জিন খুলে বানানো দ্রুতগামী যান্ত্রিক নৌকাগুলোর। এগুলো দিয়ে কম সময়ে, কম ভাড়ায় যে কোনখানে উঠা-নামা করা যায়, কখন লঞ্চ আসবে অমন হা পিত্যেশ করে বসে থাকা নেই। তাই এদের আবির্ভাবে সদরঘাট টু বান্দুরা লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ হয়ে যেতে সময় লাগে না।

গাবেরপাড়া বা কুইচ্ছামারার বরাবর লঞ্চ আসলে নদীর উত্তর পাড়ের দিকে তাকালে একটা বিষয় লক্ষ করা যেতো। নদীর দক্ষিণ পাড়টি যেহেতু খাড়া তাই এর উত্তর পাড়টি এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি অনুযায়ী নিচু। এই নিচু পাড় প্রায় দুই কিলোমিটারের মতো গিয়ে হঠাৎ পনের-বিশ ফুট উঁচু হয়ে গেছে। এই হঠাৎ উঁচু হয়ে যাওয়া গ্রামটার নাম বাঘাপুর। গ্রামের ভিটি উঁচু হবার কারণ আর কিছুই না - বন্যার হাত থেকে বসতবাড়ি রক্ষা করা। বর্ষায় বাঘাপুরের মানুষ গাবেরপাড়া বা কুইচ্ছামারা স্টেশনে নামলে কোষা নৌকায় করে সোজা নিজের বাড়ির ঘাটে নামতে পারে। ধলেশ্বরীর পাড় থেকে বাঘাপুরের দিকে ভালো করে লক্ষ করলে দিগন্তপ্রসারী ফসলের ক্ষেতের পরে গ্রামের যে ছবি দেখা যায় তাতে একটা সামান্য ব্যতিক্রমী ব্যাপার দেখা যায়। ছোট একটা জায়গায় গ্রামটা যেন একটু বেশি এগিয়ে এসেছে। আরো ভালো করে দেখলে সেই বর্ধিত অংশে কয়েকটা শিমুল গাছও দেখা যায়। চোত-বোশেখে শিমুল গাছগুলোর মাথায় রঙের আগুন লাগলে তখন গাছগুলোকে আরো ষ্পষ্ট দেখায়। কাছে গেলে বোঝা যায় এই বর্ধিত অংশটা মূল গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন ছোট একটা ভূমি - এটা একটা কবরস্থান। মোট তিনটা কবর আছে সেখানে। একটা কবর সামছু’র - আত্মহত্যা করেছিল সে। তাই গ্রামের সাধারণ কবরস্থানে তার ঠাঁই হয়নি। দ্বিতীয় কবরটা আফিয়া’র - একজন কুমারী মা। সামাজিক আর ধর্মীয় আচারকে অস্বীকার করেছিল সে, তাই তারও পরিণতি হয়েছে সামছু’র মতো। তৃতীয় কবরটা ইসকান্দর মিয়া’র। সে অবশ্য বাকি দু’জনের মতো সমাজপরিত্যক্ত নয়, বরং গ্রামে এখনো তার ব্যাপক সুনাম আছে। সবার কাছে সে ইসকান্দর মাস্টার নামে পরিচিত। এই গ্রাম তো বটেই আশেপাশের দু’দশটা গ্রামের মধ্যে প্রথম স্কুল স্থাপনের কৃতিত্বটা তার। তাহলে তার ঠাঁই এখানে হলো কেন? কারণ এই জায়গাটার মালিক সে। প্রথমে তার কবরই হয়েছিল এখানে, বাকি দু’জন সাধারণ কবরস্থানে ঠাঁই না পেয়ে পরে এখানে ঠাঁই পেয়েছে।

কবরস্থানের পর যে একটু নাবাল জমি আছে সেটা, এবং তারপর যে বাড়িটা সেটাও ইসকান্দর মাস্টারের। মাস্টারের বাড়িতে তার পরিবারের কেউ আর এখন থাকে না। মাস্টারের পুরো বাড়ি, নাবাল জমি আর অন্যান্য ফসলী জমি এখন কাদির মিয়া আর তার ছেলেমেয়েদের ভোগদখলে। কাদির মিয়া দূরসম্পর্কে মাস্টারের শ্যালক হয়। সে কবে এই গ্রামে এসেছিল আর কীভাবে এই বাড়িতে জায়গা করে নিয়েছিল সেটা আজকে কেউ আর ঠিক মনে করতে পারবে না। তবে সবাই এ’টুকু জানে যে, কাদির মিয়া মাস্টারের আশ্রয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে করে বউ-বাচ্চা নিয়ে এই বাড়িতেই থানা গেঁড়ে বসেছে।

ইসকান্দর মাস্টার স্বশিক্ষিত, নিজে গড়ে ওঠা মানুষ। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ইসকান্দর তরুণ বয়সী, বাবা-মা হারা, আয়-রোজগারবিহীন। একদিন রুহিতপুর বাজারে ঘোরাফেরা করার সময় শুনতে পায় ফৌজে লোক নেয়া হচ্ছে। থাকা-খাওয়া, কাপড়-চোপর সব বিনিপয়সায় তার ওপর মাস শেষে কুড়ি টাকা বেতন পাওয়া যাবে। এছাড়া ফৌজে চাকুরী করলে দেশ-বিদেশ ঘোরার সুযোগ আছে। এমন সুবর্ণসুযোগ ইসকান্দর হারাতে রাজী ছিল না। এরপর ইসকান্দর কী করে কোলকাতা পৌঁছায়, কী করে বাঙালী পল্টনে যোগ দেয়, কী করে তিন বছর ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যে কাটায় তার বিস্তারিত বৃত্তান্ত আর জানা যায়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ফৌজের রমরমা শেষ হয়ে যায়। সাধারণ জওয়ানদের অনেকেই ফৌজ ছেড়ে কৃষিকাজে বা পৈত্রিক ব্যবসায় ফেরত যায়। ফেরার জন্য ইসকান্দরের অমন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও বাঘাপুরের মটরশুঁটি আর মাসকলাইয়ের ক্ষেত, ধলেশ্বরী নদী আর রাজার হাটের মিষ্টির জন্য তার মন কাঁদতে থাকে। ফলে একদিন সন্ধ্যায় ফৌজী পোশাকপরা ইসকান্দর একটা টিনের ট্রাঙ্ক হাতে, নৌকা করে বাঘাপুরে চলে আসে। সে আর ফৌজে ফেরত যায়নি। ফৌজের লোকেরা তাকে খুঁজে পাবার কোন সম্ভাবনা ছিল না, কারণ ফৌজে ভর্তির সময় আড়কাঠি কোলকাতার একটা ঠিকানা লিখে দিয়েছিল।

যুদ্ধফেরত ইসকান্দরের সাথে আগের ইসকান্দরের কোন মিলই ছিল না। আগের ফুর্তিবাজ-ছটফটে মানুষটা পালটে গিয়ে ধীর-স্থির, নম্র কিন্তু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একটা মানুষে পরিণত হয়েছে। ফৌজ থেকে পাওয়া টাকা-পয়সার একাংশ দিয়ে প্রথমে সে কিছু জমি কিনে বর্গা দিয়ে দিল। আরো কিছু টাকা দিয়ে বাড়িঘর সারিয়ে বিয়ে করে ফেললো। কনে সোহাগীদের বাড়ি একটু দূরে - কলাতিয়ায়। তাদের বাড়ির অবস্থা ভালো না। বিয়েতে তাই ইসকান্দরের বরাতে নগদ কিছু জোটেনি। নতুন বউ সোহাগীর মুখ দেখতে এসে পাড়াতো বুবু-ভাবী-খালা-চাচী-নানী-দাদীদের কেউ কেউ কোন প্রকার সঙ্কোচ না করে সবাইকে শুনিয়েই বলে বসে,
- ইসকান্দর কইত্থেইকা এই হাড়গিলাটারে বিয়া কইরা আনছে! এর না আছে চেহারা-ছবি, না আছে ঢক-পদ, না আছে শইল-স্বাইস্থ্য। বাপে বলে কিছু দেয়-থোয়অ নাই!
ইসকান্দরের যা আর্থিক সঙ্গতি তাতে অনায়াসে সে এই গ্রামেই সোহাগীর চেয়ে দেখতে সুন্দরী বা স্বচ্ছল পরিবারের কন্যা বিয়ে করতে পারতো। কী ভেবে ইসকান্দর এমন একটা বিয়ে করলো সেটা কারো বুদ্ধিতে কুলালো না।

বিয়ের পর সবাই ভেবেছিল ইসকান্দর বুঝি ভাওয়ারভিটি বাজার বা রাজার হাটে দোকান দেবে অথবা বর্গাদারদের কাছ থেকে জমি ফিরিয়ে নিয়ে নিজেই চাষবাস করবে। কিন্তু ইসকান্দর ওসব কিছু না করে গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে ছোট এক টুকরো জমি কিনে তাতে বাঁশ-শণের চালা তুলে স্কুল খুলে ফেললো। স্কুল দেয়াতে গ্রামের সবাই যতোটা না অবাক হয়েছিল তার চেয়ে বেশি ইসকান্দরের জন্য দুঃখিত হয়েছিল। কারণ, এই গ্রামে ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর মতো সামর্থ্যবান মানুষের সংখ্যা কম। যাদের আর্থিক সঙ্গতি আছে তাদের মধ্যে ‘স্কুলের শিক্ষার আদৌ দরকার আছে কিনা’ এমন ভাবনার মানুষের সংখ্যা বেশি। খুব অল্প যে কয়জনের আর্থিক সঙ্গতির পাশাপাশি ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর মানসিকতা আছে তারা আবার ইসকান্দরের মতো অর্ধশিক্ষিত লোকের কাছে ছেলেকে পড়াবে না - সোজা ঢাকার কোন স্কুলে পড়তে পাঠিয়ে দেবে। ছাত্র আর টাকা-পয়সার অভাবে স্কুলটা যে অচিরেই বন্ধ হয়ে যাবে এটা নিয়ে কারো সংশয় ছিল না।

কিন্তু সবার আশংকাকে মিথ্যে প্রমাণ করে ইসকান্দর স্কুলটাকে মোটামুটি দাঁড় করিয়ে ফেললো। শিশুদেরকে বাংলা-ইংরেজী-অংক পড়ানোর জন্য হিন্দু পরিবারগুলোতে কিছু আগ্রহ থাকলেও মুসলিম পরিবারগুলোর আগ্রহ একেবারেই ছিল না। তারা মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে কায়দা-আমপারা-আলিফলাম হয়ে কোরান শরীফ পড়তে পারাটাকেই যথেষ্ট মনে করতো। কিন্তু ইসকান্দর কেমন করে যেনো সেইসব অনিচ্ছুক মুসলমান কৃষকদের পরিবার থেকেও কিছু ছাত্র জোগাড় করে ফেললো। আরো আশ্চর্যের বিষয় যে, ইসকান্দরের বউ সোহাগী নিজেদের ঘরের বারান্দায় আশেপাশের বাড়ির শিশুকন্যাদের নিয়ে বাংলা শেখার মক্তব খুলে ফেললো। বিয়ের কিছুদিন পর পাড়া-প্রতিবেশীরা এইটুকু শুধু জানতে পেরেছিল যে, সোহাগী বাংলা বই পড়তে বা চিঠি লিখতে পারে। কিন্তু সেও যে তার আধপাগলা স্বামীর মতো স্কুল খুলে পড়াতে পারবে সেটা কেউ ভাবেনি। মেয়েদেরকে সোহাগীর কাছে পড়তে পাঠাতে কোন বাবাই রাজী ছিল না। তবু কোন কোন মায়ের উৎসাহে বা সোহাগীর বোঝানোর ফলে কয়েকটি পরিবার তাদের মেয়েদেরকে সোহাগীর কাছে পাঠানো শুরু করলো।

এরপরের গল্প অতি দীর্ঘ - সে সব না জানলেও চলে। এই দেশে ইসকান্দর মাস্টার বা তার বউ সোহাগীর মতো মানুষ বিরল নয়, তাই তাদের গল্পগুলো আমাদের অজানা নয়। তাদের স্কুল টিকে যায়, দেশভাগের পর সেখানে আরো শিক্ষক নিযুক্ত হন, সরকারের অনুমোদন পাওয়া যায়, এমনকি বাড়ির বারান্দায় পড়ুয়া মেয়েদের কেউ কেউ সেই স্কুলে ছেলেদের সাথে ক্লাস করাও শুরু করে। ইসকান্দর মাস্টারও স্কুলের পাশাপাশি রাস্তা বাঁধানো, সাঁকো মেরামত করা, পুকুরের কচুরীপানা সাফ করা, গরীব ঘরের মেয়েদের বিয়ে দেয়া, দুঃস্থ রোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এমনসব কাজ করা শুরু করে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ালে গ্রামে শত্রু গজাতে সময় লাগে না। ইসকান্দরও কঠিন কিছু শত্রু জুটিয়ে ফেললো। শত্রুদের কেউ কেউ বাড়িতে চুরি করানো, খড়ের গাদায় আগুন লাগানো, সবজি ক্ষেতে গরু ছেড়ে দেয়া, স্কুলের চাপকল খুলে নিয়ে যাওয়ার মতো ছোট মাপের যন্ত্রণা করলেও বড় আঘাতটা আসে আব্দুন নূর মোল্লার কাছ থেকে। দেশভাগ হওয়ায় এতদিন নেতৃত্বে থাকা হিন্দু নেতাদের অনেকে দেশত্যাগ করায় ক্ষমতাপ্রত্যাশী মোল্লার কাছে ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হবার স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দেবার সুযোগ নাগালে চলে আসে। এমন সময় বাতাসে গুজব ওঠে ইসকান্দর মাস্টারও চেয়ারম্যান পদপ্রত্যাশী। সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদে মাস্টার অমন কোন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিলেও মোল্লা তাতে সন্তুষ্ট হয় না। তার কাছে মনে হয় এ’টা মাস্টারের একটা কৌশল, এখন মুখে না বললেও সে নিশ্চয়ই নির্বাচনের সময় হলে দাঁড়িয়ে পড়বে। মোল্লা এই ঘটনায় চরম বিরক্ত হয়। কিন্তু মাস্টারকে আচ্ছামত শায়েস্তা করার কোন মওকা খুঁজে পায় না।

দেশে এছলামী জমহুরিয়াত কায়েম হবার মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের জন্য দেশের আজাদী, তরক্কী ইত্যাদি হুমকীর মুখে পড়ে যাবার কথা শোনা যেতে থাকে। আওয়াম ও কওমের ভালাইয়ের জন্য এই সময় সদরে আলা দয়া করে তখ্‌তে বসে ফৌজী কানুন জারী করে তিনি ছোট-বড় সব অপরাধের জন্য ‘সাযায়ে মওত’-এর হুকুম দেন। দেশে ‘সাযায়ে মওত’-এর মওসম শুরু হয়ে যায়। মোল্লা এই ঘটনাকে মাস্টারকে চিরতরে সরিয়ে দেবার একটা সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে দেখে। কাউকে না জানিয়ে সে গোপনে একদিন স্থানীয় ফৌজী দফতরে গিয়ে মাস্টারের বিরূদ্ধে স্কুলের তহবিল তছরুপের নালিশ ঠুকে দেয়। ফৌজী আদালতে মামলা উঠলে তদন্ত করতে যখন গ্রামে পুলিশ আসে তখন ঘটনা সবার কাছে জানাজানি হয়ে যায়। এই অপরাধে মাস্টারের যে মৃত্যুদণ্ড হবে সে ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকে না। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কেউ যে কারো এতবড় ক্ষতি করতে পারে বাঘাপুরের কেউ সেটা মানতে পারে না। সামাজিকভাবে মোল্লা চাপের মুখে পড়ে যায়। মোল্লা বুঝতে পারে এতে মাস্টারকে পথ থেকে সরাতে পারলেও অন্যদের ক্ষোভের মুখে তার পক্ষে বিডি মেম্বার হওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। অবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মামলা প্রত্যাহার করা সম্ভব হয়। এতে মোল্লার বিডি মেম্বার হওয়া সুনিশ্চিত হবার পাশাপাশি মাস্টারের ধানী জমির অর্ধেক বিক্রি হয়ে যায়।

এইসব ডামাডোলের মধ্যে কোন এক সময়ে কাদির মিয়া ইস্কান্দর মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় পায়। মাস্টারের বাড়িতে কাদির মিয়া শুরুতে মুনিসের কাজ করা শুরু করলেও অচিরেই জমিজমার বিলি-বন্দোবস্ত, ফসল কেনা-বেচা এসব নিজের আয়ত্বে এনে ফেলে। বয়স হয়ে যাওয়ায় মাস্টার স্কুলের কাজের বাইরে ধর্ম-কর্মে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়লে কাদিরের পোয়াবারো হয়। সে বিয়ে করে, আঙিনার দক্ষিণ দিকে ঘর তুলে থাকা শুরু করে। মাস্টারের একমাত্র মেয়ে জোহরার দূরের ফতুল্লায় বিয়ে হওয়ায় কাদির মিয়া ইসকান্দরের সব জমিজমার মালিক হবার স্বপ্ন দেখা শুরু করে।

মাস্টারের ইচ্ছে ছিল তার বসতবাড়িতে স্কুলের কিছু শিক্ষক আর ছাত্রদের জন্য থাকার একটা ব্যবস্থা করার। যাতে একটু দূর থেকে হলেও ভালো শিক্ষক এনে রাখা যায় আর অতিদরিদ্র পরিবারের ছেলেদের এখানে রেখে পড়ানো যায়। এই শিক্ষক-ছাত্র নিবাসের ব্যয় নির্বাহের জন্য সে তার ফসলী জমিগুলি ‘হেবানামা’ করে দিতেও ইচ্ছুক ছিল। এই ব্যবস্থাতে সোহাগীর আপত্তি না থাকলেও কাদির মিয়ার প্রবল আপত্তি ছিল। সে মাস্টারকে সরাসরি কিছু না বললেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলো এই প্রকার ব্যবস্থা হলে বৃদ্ধ বয়সে ইসকান্দর ও সোহাগীর আশ্রয় কোথায় হবে, তাদের ব্যয় কীভাবে নির্বাহ হবে, তাছাড়া পৈত্রিক ভিটা থেকে জোহরাকে উৎখাত করার ব্যাপারে জোহরার মতামত নেয়া হচ্ছে না কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এ’সবের জবাবে মাস্টার জানালেন - তিনি ও সোহাগী আমৃত্যু এই বাড়িতেই থাকবেন। এমনকি মৃত্যুর পর তাদের দু’জনের কবরও হবে এই বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তের উঁচু ভিটিটাতে। বাড়ির উঠোন, পেছনের আঙ্গিনাতে আর নাবাল জমি ভরাট করে ছাত্রাবাস হবে। ক্ষেতের ফসল থেকে প্রাপ্ত আয়ের সামান্য অংশেই তাদের দু’জনের চলে যাবে, বাকিটা ছাত্রাবাসের জন্য ব্যয় করা হবে।

এমনটা হলে সপরিবারে কাদির মিয়া কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? মাস্টারের সেই ভাবনা নেই। তিনি বলেন, “তুমি জুয়ান মানুষ। তুমি নিজের একটা ব্যবস্তা কইরা লইতে পারবা”। নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নেবার ইচ্ছা কাদির মিয়ার ছিল না। তাছাড়া অপুত্রক ইসকান্দরের জমিজমার ভাগ সে পাবে না এটাও সে হতে দিতে পারে না। তাই তহশিল অফিসের লোকজনকে হাত করে কাদির ইসকান্দর মাস্টারের জমিজমার খাজনা আদায়, নামজারী আর সি এস রেকর্ডে নানা গ্যাঞ্জাম লাগিয়ে দিলো। কোত্থেকে জন দুই জমির ভূঁইফোঁড় দাবীদার এসেও হাজির হলো। হঠাৎ করে জমিজমার বিষয়ে এতোসব সমস্যা কী করে উপস্থিত হলো মাস্টার সেটা ঠাহর করে উঠতে পারেনি। তবে এ’সব নিয়ে থানা সদর আর জেলা ভূমি অফিসে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে তার শরীর খারাপ করে। ফলে হেবানামার ব্যাপারটা আপাতত ধামাচাপা পড়ে যায়।

দেশ স্বাধীন হবার আগে যে সাধারণ নির্বাচনটা হয়েছিল তার উত্তাপে যখন দেশ উত্তাল তখন কার্তিক মাসের শেষ সপ্তাহে মাত্র দুই দিনের জ্বরে ভুগে মাস্টার ইন্তেকাল করে। মাস্টারের শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী তাকে বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তের উঁচু ভিটিতে কবরস্থ করার উদ্যোগ নেয়া হলে কাদির মিয়া তাতে বাদ সাধে। কাদির মিয়া জানে কোন জমিতে একবার কারো কবর হয়ে গেলে সেই জমিতে চাষাবাদ কর, ঘর তোলা বা বিক্রি করে দেয়া সম্ভব হবে না। তবু গ্রামের সবার চাপে মাস্টারকে দক্ষিণের উঁচু ভিটিতেই কবরস্থ করা হয়।

স্বামী মারা যাবার পর সোহাগীর জীবন আর আগের মতো থাকে না। বাড়ির বারান্দার পাঠশালাটা উঠে যায়। কাদির মিয়ার বদৌলতে দিন দিন তার আর্থিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তার শরীরটাও দুর্বল-অশক্ত হয়ে পড়তে থাকে। দেশ স্বাধীন হবার দশ বছর পর সোহাগী মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে সেই যে শয্যা নেয় - আর উঠতে পারে না। মাসখানেক জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অচেতন অবস্থায় থেকে একদিন দুপুরে নিঃশব্দে সে বিদায় নেয়। মেয়ে জোহরার ইচ্ছে ছিল তার বাবার অন্তিম ইচ্ছে অনুযায়ী তার মায়ের কবর বাবার কবরের পাশেই হবে। কিন্তু জোহরার স্বামী-সন্তানরা অতদূর লাশ বয়ে নিতে রাজী ছিল না - ব্যাপারটা কিঞ্চিত ঝামেলার এবং ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে ফতুল্লা কবরস্থানেই সোহাগীকে অন্তিম শয়ানে শুইয়ে দেয়া হয়।

সোহাগীর মৃত্যুর পর কাদির মিয়া জোহরার বাড়ি বেড়াতে গেলে তাকে বাঘাপুর চলে আসার জন্য বলে। কিন্তু সবাই জানে সেটা আর সম্ভব নয়। জোহরার পক্ষে বাঘাপুর গিয়ে থাকা তো দূরে থাক বছরে একবার বাবার কবর জিয়ারতে যাওয়াটাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রথম প্রথম কাদির মিয়া বা তার বড় ছেলে আজিজুল বা মেজ ছেলে আতাউল কিছু শাকসবজী অথবা ফলমূল নিয়ে ন’মাসে-ছ’মাসে জোহরার বাড়িতে যেতো। একসময় সে যাতায়তও বন্ধ হয়ে যায়। বাঘাপুরের লোকজনও মাস্টার ও তার পরিবারের কথা ভুলে গিয়ে কাদির মিয়াকে ঐ বাড়ির বৈধ উত্তরাধিকার হিসাবে মেনে নেয়।

কাদির মিয়ার মেয়ে জায়েদার স্বামী যে’বার দ্বিতীয় বিয়ে করলো, সে’বারই সে দড়িগাঁওয়ে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে একেবারে বাপের বাড়ি এসে উঠলো। কাদির মিয়া তার মেয়েকে সোহাগীর পরিত্যক্ত ঘরটাতে এনে তুললো। এই ঘটনায় বড় ছেলে আজিজুল বেশ মনক্ষুণ্ন হল। একে তো বোন বাড়িতে এসে থানা গেড়েছে তার ওপর তাকে আলাদা ঘর দেয়া হয়েছে। আজিজুলের ইচ্ছে ছিল বিয়ে করে বউ নিয়ে ঐ ঘরে ওঠার। স্বামী পরিত্যক্ত ননদ যে বাড়িতে আছে সেই বাড়িতে মেয়ে বিয়ে দিতে গ্রামের মানুষের একটু আপত্তি আছে। কারণ এতে নতুন বউকে শ্বাশুড়ির পাশাপাশি ননদের গঞ্জনাও সহ্য করতে হয়। তারওপর নতুন ঘর তুলে বিয়ে করতে গেলে আজিজুলকে নগদ আরো কিছু ব্যয় করতে হবে। মোটের ওপর ব্যাপারটা আজিজুলের জন্য একটু অসুবিধার হয়ে গেল। ফলে জায়েদার সাথে তার নিত্যই ঠোকাঠুকি লাগা শুরু হয়ে গেল।

কার্তিকের এক সন্ধ্যায় দুই ভাইবোনের ঝগড়ায় বিরক্ত হয়ে কাদির মিয়া যখন বাড়ির দক্ষিণ ঢালে বসে গাঁজাভরা বিড়িতে দম দিচ্ছিল তখন আধো অন্ধকার আর হালকা কুয়াশার মাঝে তার মনে হল কবরস্থানের শিমুল গাছের নিচে কেউ একজন বসে আছে। “কেডা? কেডা রে ঐহানঅ” বলে কাদির মিয়া যখন চেঁচিয়ে উঠলো তখন দেখা গেলো গাছের নিচের লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে মুখ করে হেসে উঠেছে। হঠাৎ করেই কাদির মিয়ার মনে হয় লোকটা ইসকান্দর মাস্টার ছাড়া অন্য কেউ নয়। প্রাণভেদী চিৎকার দিয়ে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। সবার শুশ্রষায় সে যখন জ্ঞান ফিরে পায় তখন সবার প্রশ্নে মুখে তার আসলে কী হয়েছিল সেসব কিছুই বলে না। বাকি সবাই সরে পড়ে তাকে একা বিশ্রাম করতে দিলে কাদির মিয়া অনুচ্চস্বরে তার বউকে গোটা ঘটনা খুলে বলে। তার বউ ব্যাপারটিকে একেবারেই পাত্তা দেয় না। গাঁজার নেশায় সে কী দেখেছে সেটাকে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। তাছাড়া ঐ লোকটা ইসকান্দর মাস্টারই ছিল এমনটা মেনে নেবারও উপায় নেই। তাই বউ তাকে এ’সব আজেবাজে কথা না ভেবে ঘুমানোর পরামর্শ দেয়।

পরদিন রোদ উঠতে দেখা যায় শিমুল গাছগুলোর ডালভর্তি অনেকগুলো শকুন। গাঁয়ে শকুনকে সব সময় অশুভের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। তাই গাছভর্তি শকুন দেখে কাদির মিয়া তো বটেই তার বাড়ির বাকী সদস্যরাও অজানা শঙ্কায় কেঁপে ওঠে। কেউ কেউ ভেবেছিল আশেপাশে কোথাও মরা গরু-ছাগল বা কুকুর আছে তাই বুঝি মৃতভোজী পাখিদের আগমন। কিন্তু আশেপাশে কোন মৃত জন্তু না থাকায় এবং পরবর্তী সপ্তাহখানেকেও শকুনের দল শিমুল গাছে অনড় অবস্থানে থাকায় সেই ভাবনাটা আর ধোপে টেকে না। এক সময় বাকি সবাই শকুনের উপস্থিতিকে অগ্রাহ্য করা শুরু করলেও কাদির বোধাতীত এক ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে। প্রায় সন্ধ্যায়ই সে কবরস্থানের শিমুল গাছের নিচে কাউকে বসে থাকতে দেখে। কেউ বিশ্বাস করবে না বলে সে আর কিছু বলে না। শুধু সন্ধ্যার পর ঘরের বাইরে যাওয়া বা বাইরে যেতে বাধ্য হলে বাড়ির দক্ষিণ দিকে যাওয়া সে বন্ধ করে দেয়।

মাস্টারের জমিজমা সব নিজের আয়ত্বে আসায় কাদির মিয়ার অবস্থা ফিরে গিয়েছিল। বড় ছেলে আজিজুল তরিতরকারীর ব্যবসায় নামে আর মেজ ছেলে আতাউল গ্রামের আদম ব্যাপারী লাট্টু মিয়ার সহযোগিতায় একবার ধরা খেয়ে দ্বিতীয় বারে সৌদী আরবে ক্লিনারের কাজে চলে যায়। আজিজুল সাধারণত সপ্তাহে দুই দিন কমরগঞ্জ হাট থেকে সবজী কিনে শ্যালো নৌকায় ভরে ঢাকার শ্যামবাজারে ওহাব মোল্লার আড়তে বিক্রি করতো। ওহাব মোল্লার বাড়ি রামকৃষ্ণদীতে হলেও তারা লতায়-পাতায় কীভাবে যেন কাদির মিয়ার আত্মীয় হয়। তাই ওহাব মোল্লার আড়তে মাল সাপ্লাই দিলে টাকা মার যাবার ভয় ছিল না। আজিজুল প্রতি শনিবার আর মঙ্গলবার দুপুরে খেয়েদেয়ে কমরগঞ্জ চলে যেতো। রাতটা হাটে কাটিয়ে পরদিন সকাল সকাল মাল কিনে নৌকা বোঝাই করে ফেলতো, যাতে সন্ধ্যা নাগাদ শ্যামবাজারে পৌঁছানো যায়। হিসাব-নিকাশ শেষ করে তার পরদিন সকালে আবার শ্যামবাজার থেকে বাড়ির দিকে রওনা হয়।

পৌষ মাসের এক শনিবারে নলডুগ শীম আর খাট্টা বিলাতী বেগুন কিনতে কমরগঞ্জ পৌঁছে আজিজুল দেখে হাটে ব্যাপক উত্তেজনা - নদীর অপর পাড়ের বাহ্রাঘাটে যাত্রার আসর বসেছে। ঢাকা থেকে প্রিন্সেস লাকী খানকে আনা হয়েছে। আসরে কী পালা অভিনীত হবে সেটার ব্যাপারে আজিজুলের ইয়ার-দোস্তরা আগ্রহী নয়। তাদের আলোচনার বিষয় প্রিন্সেস লাকী খান আর তার পোশাক-আশাক। কারো কারো আগ্রহ যাত্রার ছাউনির কাছে বসা কান্নিভালের জুয়ার বোর্ডের ব্যাপারে। আবার কেউ কেউ এই সুযোগে প্রাণভরে পেটমোটা কাচের বোতলেপোরা মাহিগঞ্জ ঔষধালয়ের বানানো ‘অগ্নিসুধা’ গলায় ঢালতে আগ্রহী। হেমন্তে ঘরে ফসল উঠলে নগদ টাকার গরমে ছটফট করা কৃষককুলকে ঠাণ্ডা করতে দূরদর্শী মহাজনেরা শীতকালে যাত্রাপালার আবডালে এইসব আয়োজন করে থাকে। তারা জানে যাত্রাপালা করতে স্থানীয় নেতা, মাস্তান, পুলিশ, মোল্লাদের সন্তুষ্ট করার পর নিউ বাবুল অপেরা বা রূপালী অপেরাকে যে পরিমাণ টাকা দিতে হবে সেটা যাত্রার টিকিট বেচে আয় হবে না। মোট খরচের টাকার পরেও নিজেদের জন্য মোটা লাভের টাকা কান্নিভালের বোর্ড থেকে, ‘অগ্নিসুধা’র বোতল থেকে, প্রিন্সেস আর তার সঙ্গিনীদের বিছানা থেকে আয়ের বন্দোবস্ত করতে হয়। তাই আয়োজনে কোন খামতি নেই। ট্যাঁকভর্তি টাকা নিয়ে রাতবিরেতে যাত্রা দেখতে যাওয়াটা নিরাপদ ব্যাপার নয়। আবার ট্যাঁকখালির জমিদার হয়ে যাত্রায় যাওয়াটারও কোন অর্থ হয় না। তাই অধিকাংশ টাকা সুবল হালুইকরের কাছে গচ্ছিত রেখে পঞ্চাশ টাকার দশটা নোট আর একশ’ টাকার পাঁচটা নোট নিয়ে আজিজুল দলবলের সাথে বাহ্রাঘাট রওনা হয়।

মাঝরাত পার হবার পর ‘অগ্নিসুধা’ পান করে প্রিন্সেসের নাচ দেখতে দেখতে আজিজুলের বোধোদয় হয় যে এবার ওঠা দরকার। নয়তো আগামীকাল সকালে নলডুগ শীম আর খাট্টা বিলাতী বেগুন কেনা বা মাল নিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ শ্যামবাজারে পৌঁছানো যাবে না। আজিজুলের ওঠার প্রস্তাবে বেশির ভাগ জন আপত্তি জানায়। শেষে দু’তিন জন রাজী হলে তাদের সাথে আজিজুল নদী পার হয়ে দক্ষিণ-পূর্বের কমরগঞ্জ হাটের এলাকায় চলে আসে। ‘অগ্নিসুধা’র প্রভাবে দলের সবাই তখন নেশার তুঙ্গে। তাই একেক জনের হাঁটার গতি একেক রকম হল। নদীর পাড়ে মটরশুঁটির ক্ষেতের কোথাও কোথাও ছোট ছোট খড়ের স্তুপ - মটরশুঁটি পুড়িয়ে খাবার জন্য গ্রামের ছোট ছেলেরা এই খড়ের স্তুপ বানিয়ে রাখে। হাঁটতে গিয়ে আজিজুল অমন একটা স্তুপে পা জড়িয়ে পড়ে যায়। উঠতে গিয়ে দেখে খড়ের স্তুপে কে যেন আধশোয়া হয়ে আছে। তার পরণে সাদা আলখাল্লা মতো, মুখভর্তি সাদা দাঁড়িও বোঝা যাচ্ছে। সবচে’ আশ্চর্যের বিষয় তার চোখ দুটো জ্বলন্ত কাঠকয়লার মতো লাল হয়ে জ্বলছে। আজিজুল তীব্র আতঙ্কে “ও মাগো!” বলে চিৎকার দিয়ে পালাতে চাইলো। হঠাৎ মনে হলো আধশোয়া মানুষটা খট্‌খট্‌ করে হেসে উঠছে আর কোথায় যেন কাপড় ছেঁড়ার মতো ফ্যাঁৎ ফ্যাঁৎ শব্দ হচ্ছে। আজিজুলের চিৎকারে দলের বাকিদের নেশা টুটে যায়। তারা “ঐ কি অইসে! ওই আজিজুল তর কি অইসে!” বলে ছুটে আসে। ভয়ে স্তব্ধ আজিজুল কোন শব্দ করতে পারে না। হাটে ফিরে ধাতস্থ হলে আজিজুল সব খুলে বলে। বোধগম্য কারণে কেউ আজিজুলের কথা পাত্তা দেয় না। ‘অগ্নিসুধা’র প্রভাবে চোখে অমন দেখা বা কানে অমন শোনা খুবই সম্ভব। দু’দিন পর বাড়ি ফিরে আজিজুল যাত্রাপালা আর অগ্নিসুধার কথা কাটছাঁট করে গল্পটা বাড়ির সবাইকে বললে তার মা বোঝে ছেলে তখন মাতাল ছিল। কিন্তু কাদির মিয়া সব শুনে গম্ভীর হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে শিমুল গাছের তলায় বসে থাকা জন কমরগঞ্জ হাট অবদি গিয়ে পৌঁছেছে।

সেবার পৌষের শেষের দিক থেকে শীত একটু জোরেশোরে পড়তে থাকে। শীতকালে একটু বেশি ঠাণ্ডা পড়লে গ্রামের বুড়োদের মধ্যে নাকি মড়ক লাগে। কথাটার সত্যতা যাই হোক না কেন মাঘ মাসের ৩ তারিখে তুলসীখালিতে থাকা কাদির মিয়ার চাচাশ্বশুর সত্যি সত্যি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল আশির ওপরে তাই তার মৃত্যু নিয়ে পরিবারে বিশেষ আহাজারী ছিল না। তার অবস্থাপন্ন ছেলেরা বেশ ঘটা করে ফয়তা’র আয়োজন করলো। কাছে-দূরের সব আত্মীয়-স্বজন আর তুলসীখালি গ্রামের সবাইকে দাওয়াত দেয়া হলো মাঘ মাসের ৬ তারিখ বাদ জুম্মা ফয়তার মিলাদে আসার জন্য। দুটো বুড়ো হালের-বলদ জবাই করে ফয়তা’র ভোজ আয়োজন করা হলো। তুলসীখালী থেকে বাঘাপুর ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা থাকলেও ভোজের লোভ কাদির মিয়া উপেক্ষা করতে পারলো না। ছোট ছেলে শামসুল সাথে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু অনেকটা পথ হাঁটতে হবে ভেবে কাদির মিয়া তাকে বাদ দিয়ে একাই ফয়তা খেতে গেলো। ভোজে এত লোক হয়েছিল যে কাদির মিয়া শেষ ব্যাচের আগে খাবার সুযোগ পেল না। মাংস ততক্ষণে তলানীতে ঠেকেছে - কেবল হাড়, ঝোল আর আলু। কাদিরের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কম মাংস খেতে পাবার অভাবটা সে কবজী ডুবিয়ে খেজুরের গুড়ের পায়েস খেয়ে পুষিয়ে নিল। খাবার পর পান খেতে গিয়ে পুরনো বন্ধু লোকমানের সাথে দেখা হয়ে যায়। লোকমানের সাথে পান-তামাক খেয়ে গল্প করতে করতে ছোট দিনের বিকেল শেষ হয়ে ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে পড়ে। সন্ধ্যা হতেই তার হুঁশ হয়। লোকমান আর চাচাশ্বশুরের ছেলেদের কাছে বিদায় নিয়ে সে রওনা হয়ে পড়ে।

মেজবানী বাড়ি থেকে বের হয়ে গ্রামের আলপথে পা চালাতে গিয়ে কাদির মিয়ার পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। পথে সুযোগ পাওয়া যাবে না ভেবে সে একটু উলটো পথে নদীর পাড়ে চলে যায়। নদী পাড় এদিকে একটু খাড়া। ঢাল বেয়ে নেমে হালকা হবার পর ধোয়াধুয়ির জন্য কাদির মিয়া নদীতে নামে। নদী থেকে উঠতে গিয়েই দেখা গেল সাদা আলখাল্লা পরা, লম্বা দাঁড়িওয়ালা এক বুড়ো - হাতে তার কাঠের মোটা লাঠি। বুড়োর দিকে এক লহমা তাকিয়েই কাদির মিয়া বুঝতে পারলো লোকটা আর কেউ নয় - স্বয়ং ইসকান্দর মাস্টার। সে কোন চিৎকার দেবার বা দৌড়ে পালাবার আগেই লোকটা হাতের লাঠিটা উঁচু করে সজোরে তার মাথায় মেরে বসে। কাদির মিয়া অস্ফুট শব্দ করে পেছনে ঢলে নদীতে পড়ে যায়।

মরিচ্যা গ্রামের চৌকিদার গফুর আলী সকালে বাড়ি থেকে বের হবার আগেই প্রতিবেশি হাফিজের ছেলে সেন্টু খবর দিলো, “কাক্কা, গাঙ্গের পারে যেই নতুন চর ওটছে হেই জাগাত একটা লাশ পইড়া আছে”। সকাল বেলাতেই এমন খবর শুনে গফুর আলীর মেজাজ খিঁচড়ে ওঠে। তাড়াতাড়ি দুই মুঠো মুড়ি আর চা খেয়ে ইউনিফর্ম পরে বেতের লাঠিটা হাতে নিয়ে নতুন চরের দিকে ছুট দেয়। ঘটনাস্থলে দেখা গেলো সত্যি সত্যি একটা লাশ পড়ে আছে কিন্তু তার কাছে কৌতুহলী লোকজনের ভীড় নেই। মাসখানেক আগে ফুটবল খেলা নিয়ে সামান্য বিতন্ডায় মরিচ্যা গ্রামের লোকজন পাশের খরসুল গ্রামের লোকজনের সাথে ভয়ানক মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। দুই দিন ব্যাপী মারামারিতে মরিচ্যার কারো একজনের ট্যাঁটার আঘাতে খরসুলের একজন নিহত হলে পুলিশী তৎপরতায় মরিচ্যা সপ্তাহ দুয়েকের জন্য পুরুষশূন্য হয়ে পড়ে। সম্ভবত সেই ঘটনা স্মরণ করে পুলিশের ভয়ে আজকে কেউ লাশের কাছে ভীড় জমায়নি। গফুর আলী একটু দূর থেকে লাশটাকে দেখে শেখরনগর পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেবার জন্য নৌকার খোঁজ করতে থাকে। নৌকা পেতে পেতে দুপুর গড়িয়ে যায়। শেখরনগর পৌঁছে দেখা গেলো ফাঁড়িতে ভারপ্রাপ্ত সাব-ইনসপেক্টর সাহেব কোন এক তদন্তে গেছেন। ফলে তার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। সন্ধ্যায় সাব-ইনসপেক্টর সাহেব ফিরলে সবকিছু শুনে তিনি গফুর আলীকে মরিচ্যা ফিরে গিয়ে লাশ পাহারা দিতে বলেন আর দুই জন সিপাইকে পরদিন নৌকা নিয়ে লাশ আনতে বলেন।

রাতের বেলা লাশ পাহারা দেবার কোন ইচ্ছেই গফুর আলীর ছিল না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লাশ পাহারা না দিলে কেউ এসে লাশ তুলে নিয়ে যেতে পারে বা শিয়াল এসে লাশ খেয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে গফুর আলীকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হবে সেটা ভেবে বিকল্প একটা উপায় বের করে। লাশের কাছে কাঁচা-শুকনা ডালপালা, নলখাগড়া, লতাঝোপ জ্বালিয়ে কয়েকটা অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে দিয়ে গফুর আলী বাড়ি চলে যায়। খুব ভোরে উঠে চরে এসে দেখে অগ্নিকুণ্ড অনেক আগেই নিভে গেছে কিন্তু লাশ এখনো অক্ষত আছে। শেখরনগর থেকে সিপাইদের আসতে আসতে বিকাল হয়ে গেল। সিপাই দুইজন, নৌকার মাঝি আর গফুর আলী লাশটাকে ধরাধরি করে নৌকায় তুলতে গেলে দেখা গেলো লাশের শরীর হিমশীতল নয়, শরীর শক্ত হয়েও যায়নি। সন্দেহ নিরসনের জন্য একজন সিপাই লাশের বুকে কান পাততে স্পষ্ট হৃদকম্পন শুনতে পেল। সে “আরে! এইডা ত মরে নাই, অহনঅ জান আছে” বলতে বাকিরাও পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয় লোকটা সত্যি জীবিত আছে। লোকটা বেঁচে থাকায় তাকে পুলিশ ফাঁড়িতে না নিলেও চলে, কিন্তু তাহলে তার শুশ্রষাটা কে করবে সেটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। সিপাইদের সাথে গফুর আলীর কিঞ্চিত বাদানুবাদের পর সাব্যস্ত হয় লোকটাকে শেখরনগর ফাঁড়িতেই নিয়ে যাওয়া হবে।

গোটা ঘটনা শুনে এই উটকো ঝামেলা ঘাড়ে নেবার জন্য সাব-ইনসপেক্টর রকিবুল আলম সিপাই দুজন আর গফুর আলীকে যথেচ্ছ গালাগালি করেন। লোকটার কপালের কাছে আঘাতের কারণে সৃষ্ট গভীর ক্ষত থাকায় জ্ঞান ফিরলে তাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত হয়। সিপাইরা আহত লোকটার ভেজা জামা-কাপড় খুলে বাতাসে মেলে দেয়। লোকটাকে একটা গামছা পরিয়ে ফাঁড়ির বারান্দায় শুইয়ে চট দিয়ে গা ঢেকে দেয়। কপালের কাছের ক্ষতটা পরিষ্কার করে একটা পুরনো গামছা দিয়ে বেঁধে দেয়। সারা রাত লোকটা নিঃসাড়ে ঘুমায়। সকালে গায়ে রোদ পড়তে লোকটা উঠে বসে চারপাশে অবাক বিস্ময়ে তাকায়। একজন সিপাই এগিয়ে এসে তাকে ঘটনা খুলে বললে লোকটা বলে ওঠে,
- বাইত যামু।
- বাইত তো যাইবাই। আগে ছারে তোমারে জিজ্ঞাসাবাদ কইরা লউক। অহন আমাগো লগে নাস্তা খাও।

লোকটা তার শুকিয়ে যাওয়া জামা-কাপড় পরে সিপাইদের সাথে নাস্তা খায়। সাব-ইনসপেক্টর রকিবুল আলম সিরাজদিখান থানায় একটা জরুরী কাজে চলে যাওয়ায় আর সে’বেলা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় না। সেও সারা দিন ফাঁড়ির বারান্দায় চুপচাপ শুয়ে থাকে। দুপুরে সিপাইদের দেয়া রুটি-ডাল খায়। সন্ধ্যায় সাব-ইনসপেক্টর আসলে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়।
- নাম কী?
- কাদির মিয়া।
- বাপের নাম?
- কোব্বাদ মিয়া।
- বাড়ি কই?
- বাঘাপুর।
- কোন্‌ বাঘাপুর?
- বাস্তা ইউনিয়ন, কেরানীগঞ্জ উপজেলা।
- ঘটনা কী হইসিলো কও দেখি।
কাদির ঘটনা সব খুলে বলে। শুধু আততায়ী যে ইসকান্দর মাস্টার সে’কথা বলে না। শুধু বলে,
- আন্ধাইরে চেহেরা খ্যা’ল করতে পারি নাই।
আরো জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় কাদির মিয়ার এমন কোন শত্রু নেই যে তাকে খুন করতে চাইবে। ঘটনাটিকে ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের চেষ্টা বলেই মনে হয়। কাদির মিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী যেহেতু ঘটনাস্থল মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান থানায় নয়, বরং ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানায় তাই ভিন্ন জেলা ও ভিন্ন উপজেলার ঘটনাকে রকিবুল আলম স্থানীয় থানায় পাঠিয়ে জিডি বা এফআইআর করার উপায় দেখেন না। তিনি ঠিক করেন রাতটা ফাঁড়িতে রেখে কাদির মিয়াকে পরদিন সকালে কেরানীগঞ্জ বা ঢাকাগামী কোন একটা নৌকায় তুলে দিয়ে কুইচ্ছামারাতে নামিয়ে দেয়া হবে। এই প্রস্তাবে কাদির মিয়াও রাজী হয়।

কাদির মিয়ার মাথা কতোটা ঠিক আছে সেটা পরীক্ষা করতে রকিবুল আলম তাকে আবার জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করেন।
- ঘটনা কবেকার?
- মাগ মাসের ৬ তারিক শুক্কুরবার।
- আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। শুক্রবার তো আগামীকাল, তারমানে গত শুক্রবারের কথা বলছো! অবশ্য সে দিনটা মাঘ মাসের কতো তারিখ সেটা বলতে পারবো না। এই তোমরা কেউ বলতে পারবে আজকে বাংলা কত তারিখ?
সিপাইদের মধ্যে একজন বলে,
- আইজকা মাগ মাসের ৫ তারিক।
রকিবুল আলম কিঞ্চিত বিভ্রান্ত বোধ করেন। তার বিভ্রান্তি আরো বাড়ে যখন বাংলা তারিখ খুঁজতে বিকেলে পাওয়া সে’দিনের ‘দৈনিক ইত্তেফাক’টা তুলে নেন। সেখানে ডেট প্যানেলে স্পষ্ট লেখা আছে “ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ জানুয়ারী ২০১১, ৫ মাঘ ১৪১৭”। সবার ভাষ্য মিলালে বোঝা যায় চৌকিদার গফুর আলী যেদিন সকালে কাদিরকে নতুন চরে দেখেছিল তার কমপক্ষে আগের সন্ধ্যায় সে মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে নদীতে পড়েছিল। তার মানে গফুর আলী তাকে দেখেছে ঘটনার দ্বিতীয় দিনে। কাদিরকে শেখরনগর পুলিশ ফাঁড়িতে আনা হয়েছে ঘটনার তৃতীয় দিনে। আর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এখন - মানে ঘটনার চতুর্থ দিনে।
- শোন সবাই, কাদিরের ভাষ্য অনুযায়ী ঘটনা মাঘ মাসের ৬ তারিখ শুক্রবার হলে আজ ৯ই মাঘ সোমবার হবার কথা। কিন্তু আজ তো সোমবার নয়, বৃহস্পতিবার। সুতরাং কাদিরের বলা দিন-তারিখ ঠিক না।
- ছার, আমি মাথাত বাড়ি খাইলেঅ আমার কোন বুল অয় নাই। মাগ মাসের ৬ তারিক শুক্কুরবারঐ আমার দাওয়াত আছিল। আমার চাছ্‌ত সম্বন্ধী পষ্ট কইরা কইয়া দাওয়াত দিয়া গেছিল। আমিও হেইদিন তুলসীখালি গিয়া জুম্মার নামাজ পড়ছি।

রকিবুল আলম আবার হিসেব করে দেখেন, আজ মাঘ মাসের ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার আর কাদির মাথায় আঘাত পেয়েছে তার তিন দিন আগে, মানে মাঘ মাসের ২ তারিখ সোমবার। কিন্তু এদিকে কাদির হলফ করে বলছে ঘটনা মাঘ মাসের ৬ তারিখ শুক্রবারের। তারমানে কেউ না কেউ ভুল করছে। যেহেতু একজন সিপাই আর ইত্তেফাকের ভাষ্য অনুযায়ী আজ মাঘ মাসের ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার, সুতরাং কাদির মিয়াই দিন-তারিখ ভুল করছে।
- আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। দিন-তারিখ নিয়ে আর মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এখন রাতটা বারান্দায় থাকো কাল সকালে তোমাকে কেরানীগঞ্জ বা ঢাকা যাবার একটা নৌকায় তুলে দেয়া হবে। নৌকা তোমাকে কুইচ্ছামারাতে নামিয়ে দেবে।
সিপাইরা বুঝতে পারে লাঠির বাড়ি খেয়ে কাদির মিয়ার মাথায় কিঞ্চিত গোলমাল দেখা দিয়েছে, যেটা খুবই স্বাভাবিক। তাই কেউ আর কথা বাড়ায় না। রকিবুল আলম বাসায় চলে গেলে সিপাইরা কাদির মিয়াকে নিয়ে খেতে বসে। খাওয়া শেষ হলে তিনজন সিপাই ছাড়া বাকিরা বাড়ি চলে যায়। কাদির ফাঁড়ির বারান্দায় চটমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে।

খুব ভোরবেলা একজন সিপাই দেখলো কাদির মিয়া ঘুম থেকে উঠে ফাঁড়ির পাশের ঢালের দিকে যাচ্ছে।
- ঐ মিয়া! কই যাও?
- পেশাব কইরা আহি।
- আইচ্ছা।
কিন্তু পেশাব করতে গিয়ে কাদির মিয়া আর ফেরে না। সকালে ফাঁড়িতে এসে রকিবুল আলম ঘটনা শুনে কর্তব্যরত সিপাইদের অবহেলার জন্য বাপান্ত করেন। যেহেতু ঘটনার কোন রেকর্ড নেই তাই আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তিনি দিনের কাজে মন দেন।

রাতে কাদির মিয়া শুয়ে পড়ে কিন্তু ঘুমায়নি। সে সারা রাত ভেবেছে - কে ঠিক? সে, নাকি পুলিশের লোকজন? সে নিশ্চিতভাবে জানে ঘটনা মাঘ মাসের ৬ তারিখ শুক্রবারের। কিন্তু খবরের কাগজে নাকি লেখা আছে আজকে মাঘ মাসের ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার। সেক্ষেত্রে মাঝখানের ৩টা দিন কোথায় গেল? সে-ই বা একদিন আগে চলে আসলো কী করে? সারা রাত ভাবতে ভাবতে এক সময় গোটা ব্যাপারটা কাদির মিয়ার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। মাস্টার তাকে মাঘ মাসের ৬ তারিখ শুক্রবার সন্ধ্যায় মাথায় বাড়ি মারলেও অজ্ঞান হবার পর তাকে চার দিন আগের দিনে নিয়ে যায়। ফলে আজকের দিনটা মাঘ মাসের ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার হয়। এভাবে কাউকে আগের দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব মনে হলেও মরা মানুষের অতৃপ্ত আত্মা এটা করতেই পারে। হঠাৎ একটা কথা ভেবে তীব্র আতঙ্কে কাদির মিয়ার শরীর জমে বরফ হয়ে যায়। কাল সকালে সে বাঘাপুর ফিরলে বাড়িতে তিন দিন অনুপস্থিত থাকার কী কৈফিয়ত দেবে? আর আজ মাঘ মাসের ৫ তারিখ বৃহস্পতিবার হলে আগামী কাল মাঘ মাসের ৬ তারিখ শুক্রবার। তাহলে আগামীকাল আবার তাকে চাচাশ্বশুরের ফয়তা খেতে যেতে হবে। তার মানে হচ্ছে আবার একই দুর্ঘটনা ঘটবে। সে একটা অচ্ছেদ্য কালচক্রে পড়তে যাচ্ছে বুঝতে পেরে কাদির মিয়া সিদ্ধান্ত নেয় সে পুলিশের কাছ থেকে পালাবে আর কখনোই বাঘাপুরে ফিরে যাবে না।

পেশাব করার নাম করে শেখরনগর ফাঁড়ির ঢালে নেমে কাদির এক ছুট লাগায়। কাদির মিয়া ছুটছে - কোনদিকে ছুটছে সে নিজেও জানে না। সে শুধু জানে তাকে পুলিশের কাছ থেকে দূরে পালাতে হবে, বাঘাপুর থেকে দূরে পালাতে হবে, সর্বোপরি ইসকান্দর মাস্টারের সর্বনাশা প্রতিশোধচক্র থেকে বাঁচতে হবে। মাস্টারের বংশকে ঠাঁই নাড়া করতে গিয়ে সে নিজেই ঠাঁই হারিয়ে ফেলেছে। কাদির মিয়া দৌড়ায় আর হাঁপায়, মাঝে দাঁড়িয়ে একটু বিশ্রাম নেয় আবার দৌড় দেয়।


মন্তব্য

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

ভালো লাগলো গল্পটি !
আমার কাছে মনে হয়েছে এটি বিবেকের গল্প হলে বেশী ভালো লাগত।
কিন্তু তারিখ নিয়ে কাদির মিয়া যে জটিলতার মধ্যে পড়েছে তাতে এটি একটি ভৌতিক গল্প, ঠিক তো পাণ্ডবদা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। একেবারে বিবেকহীন মানুষ তো হয় না। কাদির মিয়ার বিবেক কিছুটা হলেও কাজ করায় পরিণতিটা এমন হয়েছে। তবে সেটাই সব নয়।

এবং এটি কোনভাবেই ভৌতিক গল্প নয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

হাততালি
অসাধারণ গল্প। অনবদ্য কথার গাথুঁনি আর বর্ণনা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রিসালাত বারী এর ছবি

পাণ্ডবদা, এইটা একটা উপন্যাস হতে পারতো মনে হয়। চলুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। যাদের উপন্যাস লেখার ক্ষমতা আছে তাদের কারো মাথায় এই প্লটটা এলে হয়তো উপন্যাস বানাতে পারতেন। আমার কাছে এই মাপটাই জুতসই লেগেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তাপস শর্মা এর ছবি

বরাবরের মতোই ঠাসা বর্ণনামুখী গল্প। মাঝখানে সামান্য একঘেয়ে লাগে। অবশ্য সেটা বর্ণনার জন্য নয় ব্যাক্তিগতভাবে যায়গা কিংবা ঘটনাগুলির সাথে রিলেট করতে না পারার জন্যে

০২

ভৌতিক কিংবা লৌকিক-বহির্ভূত একটা ভাব থাকলেও মূল সুরটা ধরা যায় অনায়াসেই। পাশাপাশি একটা বিশাল সময়ের ব্যপ্তি গল্পটাকে ছড়িয়ে দেয় বহুদূর এক নিরাকার অতলের দিকে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পাঠকের কাছে লেখা একঘেঁয়ে লাগলে তার দায়টা লেখকেরই বটে। যে জায়গা আর ঘটনাগুলোর কথা বলা হয়েছে সেগুলো সবই কাল্পনিক। পাঠক যদি সেটার সাথে ঠিকমতো রিলেট করতে না পারলে তার দায়ও লেখকের ওপরেই বর্তায়।

সময়ের ফ্রেমটা বেশ বড় - প্রায় একশ' বছর। স্থানের ক্যানভাসটা তেমন বড় নয়। তবে এখানে ভৌতিক বা অলৌকিক কিছু নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সত্যপীর এর ছবি

" ট্যাঁকখালির জমিদার" হা হা হা হা।

অসাধারন গল্প।

..................................................................
#Banshibir.

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আপনার গল্পের একটা অংশ আমার অভিজ্ঞতার সাথে মিলে গেল। আমার গ্রামে কোন হাই স্কুল ছিলনা। ছেলেমেয়েরা চার মাইল দুরের একটা স্কুলে যেত। আমি, গ্রামের কিছু লোকজনের সাথে আলাপ করে একটা হাই স্কুল করবার উদ্যোগ নিলাম। বোর্ডের নিয়মানুযায়ী হাই স্কুল করতে হলে তখন চার বিঘা জমি স্কুলের বরাবরে রেজিষ্ট্রি করে দিতে হতো। যাহোক, আমি পাকা রাস্তার পাশে চার বিঘা জমি স্কুলের নামে লিখে দিলাম। গ্রামের বেশ কিছু উৎসাহী লোক মিলে স্কুলের কাজ শুরু করলাম। কিন্তু, রাজনৈতিক নেতারা এটাকে ভাল ভাবে নিলনা। হ্যাঁ, আমি দুঃস্থ রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতাম। স্কুলের গরিব মেধাবী ছাত্রদের পরীক্ষার ফিসের টাকাও দিতাম। যাহোক, নেতারা অনেক রকম বাগড়া দিলো। ঐ স্কুলটি এখন দোতলা। অনেকদিন আগেই এমপিও ভুক্ত হয়েছে। ব্রাকের সহায়তায় একটা পাঠাগারও হয়েছে। বিভিন্ন অনুদানের চারটি কম্পিউটারও আছে। কিন্তু এখনও রাজনীতিকেরা আমার সম্পর্কে বাঁকা কথা বলে। আমি কিন্তু রাজনীতির বাইরে থেকেই যা কিছু করার চেষ্টা করেছি। কখনই বিডি মেম্বর হতে চাইনি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রথমেই আপনাকে অভিবাদন। এমন একটা কাজ করতে পারলে আমৃত্যু গর্ব করা যায়।

কামনা করি আপনি দীর্ঘায়ু লাভ করুন এবং অন্যদের জন্য এমনসব কাজের আরো দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্যাম এর ছবি

প্রৌঢ় ভাবনা কে অভিবাদন!!!

রংতুলি এর ছবি

চলুক

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

স্যালুট আপনাকে।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার জন্য অন্তরের অন্তস্থল থেকে উৎসারিট অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
-অয়ন

দিগন্ত বাহার এর ছবি

চলুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পুতুল এর ছবি

মন্তব্য করার আগে ভাবি এক রকম, আর মন্তব্য টাইপ করার সময় করি অন্য রকম। আজকে যেমন ভাবছি তেমনটাই টাইপ করার চেষ্টা করব।

আমাদের শহীদ নগর বাজারে একজন চা বিক্রেতা ছিল। নাম দেন্দা রোশইন্যা। দেন্দা মানে কালা। চা বানাত চমৎকার। বাজারের সব লোক বিদেয় হলে চুলার শেষ আগুনে শেষ চা-টা বানাত সে নিজের আর তার বন্ধুদের জন্য। আমি মাঝে মাঝে পথ ভুলে সেখানে হাজির হতাম।
রোশইন্যা দেন্দার বন্ধু ছিল ওহেদ আলী বয়াতী। তারও গান ক্লান্ত দিনের শেষে রোশইন্যা দেন্দার চাটা বেশ ভাল লাগত। টা হিসাবে রোশইন্যা দেন্দার ছিল গাঁজার কল্কী।
চায়ে চুমুক দিয়ে বয়াতী ধরল >> সেই পাড়ে তোর বসত বাড়ি রে<<
এর মধ্যে গাঁজা ধরিয়ে টানের উপযোগী করে ফেলেছে রোশইন্যা ধেন্দা। মানুষ আমরা তিন জন। বয়াতীর গান তখনো শেষ হয়নি। নিজের জন্য গাইছে বয়াতী গভীর দরদ দিয়ে।
কল্কে আসে আমার হাতে। ডান হাতের সব আঙ্গুল গুলো ফুলের পাঁপড়ির মতো করে লাল তেনার ভেজা কাপড় বুড়ো আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে ঠোঁটে লাগানোর জন্য ধরেছি। যতটা সম্ভব নিশ্ছিদ্র করতে ডান হাতের পাপড়ি প্যাচিয়ে ধরেছি বাঁ হাতে। কল্কী কপালে ঠেকিয়ে দিলাম টান।
দম নিতে পুরো ধোঁয়া ছেড়ে দিলাম। হায় হায় করে উঠল রোশইন্যা। এত মূল্যবান ধোঁয়াটা ছেড়ে দেয়ায়।
আমি এখন হায় হায় করছি; এত সুন্দর একটা উপন্যাস আপনি ছোট গল্পে শেষ করে দেয়ায়। অনুরোধ করছি; আর অন্তত একবার ভেবে দেখুন। লেখাটা তো হয়েই আছে। কিছু কিছু বর্ণনা-ঘটনা একটু বিস্তারিত ভাবে লিখতে হবে কেবল।

**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!

ক্রেসিডা এর ছবি

চলুক

__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রথমে আপনাকে মাইনাস দিলাম দেন্দা রোশইন্যার মজমার গল্পটা এভাবে মন্তব্যে লিখে নষ্ট করার জন্য। এর ক্ষতিপূরণ হিসেবে আপনি ঐ আসর নিয়ে একটা আস্ত গল্প লিখে পোস্ট করুন।

উপন্যাস লেখার সক্ষমতা এখনো অর্জন করিনি বস্‌! যে'দিন সেই ক্ষমতা অর্জন করবো সেদিন আমার লেখা অনেকগুলো ছোট গল্পই উপন্যাসে বিলীন হয়ে যাবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্যাম এর ছবি

সহমত

পথিক পরাণ এর ছবি

খুব বড় একটা সময়ের পরিসর ধরে অন্তিমে নেমে আসা একটা গল্প। গল্পের চরিত্র আজিজুল বা সোহাগীদের কথা খুব ঘটা করে না এলেও এটিকে প্রায় তিন প্রজন্মের পরিবর্তিত সমাজচিত্র বলা যায়।

ইসকান্দর মাস্টারের ফৌজিতে নাম লেখানো, সেখান থেকে পালিয়ে আসা, গ্রামে স্কুল খোলা, বিয়ে করে আধা সংসারী হওয়া, গ্রামের সহজাত এবং আদিম 'ভিলেজ পলিটিক্স' এ আক্রান্ত হওয়া, নিজের দূর সম্পর্কের আত্মীয়কে সংসারে ঠাই দেয়া, শেষমেশ ভূমি অফিসের জালিয়াতির দৌড়াত্মের শিকার হওয়া- এইসব কিছুর ভেতর খুব অল্প কথায় অনেক বড় একটি সময়ের মানুষের ছায়া ফুটে উঠে।

ছেলে সন্তানহীন ভগ্নিপতির সম্পত্তি আত্মসাতের লোভে কাদেরের কুটিলতায় খুব সহজ গ্রাম্য একটা ছবি ধরা পড়ে। তার শাস্তি পাবার ধরণটি একেবারেই চমকপ্রদ।

গল্পের শুরুতে তথ্য একটু ভারী মনে হয়ে উঠছিল আমার কাছে। যদিও তৃতীয় প্যারায় খুব ভালমতই থিতু হওয়া গেছে গল্পের ভেতর। আপনার গল্পে যেটি সবথেকে উপভোগ করি, সেটি হচ্ছে খুঁটিনাটি বর্ণণার সাথে বাস্তবের তুমুল সাযুজ্য। ঘাট আর গ্রামের ধারাবাহিকতা, হেবা নামার পরে সি এস রেকর্ড, নামজারির মত বিষয়গুলো, এমনকি শেখরনগরের ফাঁড়ির ইনচার্জে যে একজন এস আই থাকেন, সেই তথ্যটি পর্যন্ত পরম যত্নে তুলে এনেছেন।

একটা ছোট্ট বিষয়। মিউটেশনকেই বাংলায় নামজারি/জমাখারিজ বুঝানো হয়, যেখানে একজন মালিকের নাম কেটে বা বদলে তাঁর নামের বদলে আরেকজনের নাম লিখে জমির দখল স্বত্ব প্রচার করা হয়। আর আপনি মনে হয় সি এস রেকর্ড বলতে চেয়েছিলেন।

পুরো গল্পটা পরে একটা চমৎকার উপন্যাসের আভাস পাচ্ছি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্পটা আসলে ইসকান্দর মাস্টারের বা ইসকান্দর মাস্টার ও কাদির মিয়ার। তাই অন্য চরিত্রগুলো বিশেষ ব্যপ্তিলাভ করেনি। মোট সময়কাল প্রায় সাতানব্বই বছর - অর্থাৎ তিন প্রজন্ম পার হয়ে প্রায় চার প্রজন্ম। প্রজন্মান্তরের বিকাশটা বোঝানোর জন্য প্রথম দুই অনুচ্ছেদ বা এমন আরো কিছু আপাত অদরকারী বিষয় লিখতে হয়েছে। এক প্রজন্মের ভেতরে এই বিকাশটা বোঝানোর জন্য হয়তো গল্পের বিস্তার আরো বাড়ানো যেতো, তবে তাতে ব্লগের পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতো। আমি দেখেছি, পঁচিশ পৃষ্ঠা ছাপানো লেখা পড়তে ক্লান্তিবোধ করি না, কিন্তু যত আকর্ষনীয় হোক একটা ব্লগে সাত-আট পৃষ্ঠার সমান লেখা পড়তেই হাঁফ ধরে যায়। আমি একাধিক পর্বে গল্প দেবার বিরুদ্ধে তাই পরিসরটা এমনই রাখলাম। কখনো ছাপানোর কথা ভাবলে এই গল্প আরেকটু বড় হতে পারে।

মিউটেশন আর সি, এস, রেকর্ড সংশোধন করা হলো। উপন্যাস নিয়ে ভাবনার কথা উপরে অন্য মন্তব্যগুলোতে বলেছি।

বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মুস্তাফিজ এর ছবি

কাদির মিয়া রাজাকারীতে নাম লিখায় নাই?

...........................
Every Picture Tells a Story

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যতদূর জানি, না। বাঘাপুরে মিলিটারীর উপদ্রব কম ছিল। তাই ফেউয়ের সংখ্যাও কম ছিল। আর ঐ সময়টাতে মাস্টার মারা যাওয়ায় কাদির মিয়া তার জায়গা-সম্পত্তি দখলের পরিকল্পনায় ব্যস্ত ছিল।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্যাম এর ছবি

আমারতো খুব ই ভাল লাগল! আমার কাছে এরকম লেখা পড়তে ভাল লাগে যে লেখাগুলো পড়ার সময় মনে মনে ভিডিও দেখা যায় হাসি - গল্পটি পড়ার সময় সব দেখতে পাচ্ছিলাম ! সোহাগীর জন্য কস্ট হল সবচেয়ে বেশী---- তিন কবরের বর্ননার পর সোহাগীর কথা যখন আসলো তখনি বিভিন্ন প্রশ্ন মনে হয়েছিল - বেচারা----

অসাধারণ পান্ডব দা!

(ফয়তা শব্দটি অনেদিন পর শুনলাম। জায়েদা একবার জাহেদা হয়ে আছে।)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মনোযোগ দিয়ে পড়া ও মন্তব্য করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। নামের ভুল ঠিক করলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রংতুলি এর ছবি

ভালো লাগলো দাদা, আপনার গল্পে কালের গ্যাপ সত্ত্বেও বর্ণনা এত নিখুঁত যে মনে হচ্ছিলো সত্যি কোনো উপন্যাস পড়ছি, একটু পুরনো প্লট কিন্তু উপস্থাপন এত জীবন্ত যে নিজেকে স্থান-কাল-পাত্রের সাথে সংযুক্ত করতে কোনো অসুবিধা হয়নি।

যাইহোক, ইসকান্দর মাস্টারের অতৃপ্ত আত্মা মৃত্যুর এতদিন পরে প্রতিশোধপরায়ণ হলো, নাকি কাদির মিয়া-র ভেতরে থাকা গিল্টি কনশাস ধীরে ধীরে বয়সের সাথে মানসিক বিকারগ্রস্ততায় পরিণত হলো? আমার মতে দ্বিতীয়টা হলে বেশী ভালো হয়, সেক্ষেত্রে একজন মানুষের নিজের ভেতর সময় ভেদে মানসিক টানাপোড়নের রূপটা ফুটে উঠে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কিছু বিষয় আছে যেগুলো পুরনো হলেও মাঝে মাঝে ফিরে আসে। এই বিষয়টা অমনই। গল্পের সাথে পাঠক যখন নিজেকে যুক্ত করতে পারে তখন লেখকের প্রচেষ্টা সার্থক হয়। অসংখ্য ধন্যবাদ।

গল্পটার ব্যাখ্যা আসলে কী সেটা পাঠক নিজেই নির্ধারণ করবেন। আপনার বলা দুইটা ব্যাখ্যার মধ্যে যেটা আপনার কাছে ঠিক মনে হবে সেটাই আপনার জন্য ঠিক। তবে এটা ভৌতিক গল্প না - এ'টুকু বলতে পারি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

একটু একটু করে খুলে দেখিয়েছ। দারুণ লাগলো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শুরু আর শেষ ঠিক রেখে মাঝখানে গল্পটা আরো বাড়তে পারতো। কিন্তু ব্লগের পাঠকদের কথা ভেবে কয়েক জায়গায় ব্রেক টেনেছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার লাগলো। তবে শুরুর বর্ণনা যেভাবে আস্তে আস্তে ঘুরে গিয়ে মূল গল্পে গেলো তাতে করে আরো বড় গল্প আশা করেছিলাম। শুরুর সাথে তুলনা করলে শেষটায় তাড়াহুড়ো হয়ে গেছে।

-অয়ন

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ। ব্লগে আসলে বড় গল্প দেয়া যায় না। পাঠক স্ক্রলডাউন করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। কখনো ছাপানোর সুযোগ হলে এই গল্পটা নিয়ে আবার ভাববো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

অসাধারণ সিঁধু জ্যাঠা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সিধুতে চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে আমার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি নিশ্চিত করলেন দেখছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

দেঁতো হাসি
উকে! সিধু জ্যাঠা অনলি!!

স্যাম এর ছবি

আজকের ব্যনার এর ছবিটা ইসকান্দর মাস্টারের অথা মনে করিয়ে দিল।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।