অনিঃশেষ ইভ টিজিং

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বুধ, ২৫/০৪/২০১৮ - ১১:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘নয়নশ্যামা’ খুব একটা আলোচিত উপন্যাস নয়। এই উপন্যাসকে ভিত্তি করে ১৯৮৩ সালে নীতিশ মুখোপাধ্যায়ের বানানো সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়, প্রবীর রায়, সন্তু মুখোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিক প্রমুখ অভিনীত ‘নয়ন শ্যামা’ চলচ্চিত্রটি আরও অনালোচিত, কারণ সেটি সিনেমা হলে কখনো রিলিজ হয়নি। উপন্যাসটি কোনও এক শারদীয় পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, পরে ‘রামায়ণী প্রকাশ ভবন’ এটি বই আকারে প্রকাশ করে। ওই শারদীয় পত্রিকা প্রকাশের তারিখ বা রামায়ণী সংস্করণ প্রকাশের তারিখ জানতে পারিনি। ‘অঙ্কুর পুস্তকালয়’ থেকে প্রকাশিত উপন্যাসটির যে সংস্করণটি আমি পড়েছি তাতে প্রকাশের তারিখ লেখা আছে ২০ এপ্রিল, ১৯৪১! মরি, মরি! ১৯৪১ সালে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বয়স ছিল ৬!! ‘পুস্তক বিপণি’ থেকে প্রকাশিত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘উপন্যাস সমগ্র’র দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথম উপন্যাস ‘নয়নশ্যামা’। সেই খণ্ডের ভূমিকায় খোদ লেখক বলছেন, “নয়নশ্যামা যখন লিখি তখন আমি মধ্য তিরিশ পেরিয়ে গেছি’। সেই হিসেবে উপন্যাসটি ১৯৭০ সালের পরে লেখা। উপন্যাসে পারিপার্শ্বিকের যা বিবরণ পাওয়া যায়, টাকার মূল্যমান যা দেখানো হয়েছে তাতে কাহিনী সত্তরের দশকের বলেই মনে হয়।

এই লেখার উদ্দেশ্য ‘নয়নশ্যামা’র কাহিনীকাল বা প্রকাশকাল নির্ণয় নয়; এমনকি এই লেখা তার রিভিউ বা পাঠপ্রতিক্রিয়াও নয়। এখানে ‘নয়নশ্যামা’ নিমিত্ত মাত্র।

+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+

উপন্যাসের নাম ‘নয়নশ্যামা’ অনেকটা ‘শিরিঁ-ফরহাদ’, ‘লায়লী-মজনু’, ‘হীর-রনঝাঁ’, ‘সইফুল মুল্‌ক্‌-বদিউজ্জামাল’ ধরনের, যদিও এখানে নয়ন আর শ্যামার নামের মাঝে কোন হাইফেন নেই। এহেন নাম দেখে পাঠক যদি ভাবেন এটাও ঐসব ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনীর মতো কিছু তাহলে তিনি ঠকবেন। উপন্যাসে নয়ন নামে একরোখা এক প্রেমিক আছে বটে তবে উপন্যাসের আরেক চরিত্র শ্যামা মোটেও তার প্রেমে পড়েনি। নয়ন যতোটা না প্রেমিক তারচেয়ে বহু বহু গুণে বেশি ‘ইভ টিজার’ — নাছোড়বান্দা, একগুঁয়ে, নির্মম, নিষ্ঠুর এক ইভ টিজার। তার সাথে শ্যামার যেটুকু যোগাযোগ প্রচেষ্টা সেটা নয়নের ব্ল্যাকমেইলিং-এর ফল, তার ক্ষতিসাধনের চেষ্টাকে নিবৃত্ত করার জন্য শ্যামার করুণ প্রচেষ্টা। নির্ঘুম রাত কাটানো, পড়াশোনায় ড্রপআউট, একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা, ধনী উকিলের বখাটে পুত্র নয়ন হয়তো মানসিক রোগী; কিন্তু শ্যামার জীবনে সে এক অনিঃশেষ ত্রাসের উৎস। আতঙ্কে রেখে, উত্যক্ত করে নয়ন শ্যামাকে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে খুন করে চলে।

উপন্যাসটি নিয়ে লেখকের বক্তব্য হচ্ছে — “এখানে প্রেমটি রাহুগ্রস্থ, একপেশে এবং মোটেই সুস্বাদু নয়। তা বলে নয়নকে ভিলেন ভাবিনি কখনো, বরং ওর বেদনার সঙ্গে আমার সংক্ষুদ্ধ যৌবনের বেদনার একটা যোগ আছে”। সংক্ষুদ্ধ যৌবনে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কী করেছিলেন বা তাঁর বেদনাটা কী সেটা আমরা জানি না, তবে নয়ন চরিত্রটি কী সেটা আমাদের কাছে যথেষ্ট স্পষ্ট। নয়নের এই বখাটেপনার জন্য যদি তাকে স্রেফ একটা বখাটে হিসেবে দেখানো হতো তাহলে সেটা নিয়ে বলার কিছু ছিলো না, কিন্তু নয়নকে বখাটে হিসেবে তিরস্কারযোগ্য চরিত্র হিসেবে দেখানোর চেয়ে তার প্রতি সহানুভূতি টানার একটা প্রয়াস আছে যেটা লেখকের বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়। নয়নকে যদি মানসিক রোগী হিসেবে দেখানো হতো তাহলেও বলার কিছু ছিল না। নয়নের সুগঠিত ও সুপরিকল্পিত চিন্তাভাবনা, কর্মদক্ষতা, কার্যকারণ বিচারের সূক্ষ্ম ক্ষমতা প্রমাণ করে সে মানসিক রোগী নয়। তার মাঝে যে উৎকেন্দ্রিকতা, জিগীষা ও জিঘাংসা আছে সেটা সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেও থাকতে পারে। শেষ প্রান্তে নয়নের আত্মহত্যা করার একটা সম্ভাবনার যে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে সেটাও খুব অস্বাভাবিক কিছু না, সব নেশাগ্রস্থই এমন ভাবনায় তাড়িত হয়। উপন্যাসে নয়ন যা কিছু করেছে তা ভেবে-চিন্তে, পরিকল্পনা করেই করেছে। তার কর্মতৎপরতা শ্যামাকে কতটুকু বিপর্যস্ত করে সেটা জেনে বুঝেই করেছে। নয়ন যে নাছোড়বান্দা প্রেমিক নয় সেটা স্পষ্ট হয় শেষ প্রান্তে যখন বলা হয় — “সে বুঝতে পারে, শ্যামা নয়, কিছু নয়, একটু ঘুম ছাড়া সে আর কিছু চায় না”। বস্তুত শ্যামার প্রতি কোন শ্রদ্ধা তার মধ্যে ছিল না, থাকলে শ্যামাকে একা পেয়ে যৌন হয়রানীর চেষ্টা সে করতো না। নয়নের ধর্ষক প্রবৃত্তির উদাহরণ আরও আছে। ঐতিহাসিক প্রেমিকজুটিদের কায়দায় লেখক উপন্যাসের নাম ‘নয়নশ্যামা’ দিলেও বা ব্যক্তিগতভাবে তাকে ‘ভিলেন’ না ভাবলেও নারীর প্রতি অশ্রদ্ধাশীল, ইভ টিজার, ধর্ষক প্রবণতার নয়নকে পাঠকের পক্ষে ভিলেন ভাবাটাই সঙ্গত।

+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+

‘নয়নশ্যামা’র মতো শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অনালোচিত, অনুল্লেখযোগ্য উপন্যাস নিয়ে আলোচনা ফাঁদার চেষ্টার কারণটি হচ্ছে বাংলা শিল্প-সাহিত্যে বহুল চর্চ্চিত একটি বিষয় — ‘ইভ টিজিং’। ইংরেজি ‘eve teasing’ শব্দটির ভালো কোন বাংলা নেই। সর্বত্র এটাকে ‘ইভ টিজিং’ বলেই চালানো হচ্ছে। ‘বিরক্ত করা’, ‘উত্যক্ত করা’, ‘যৌন হয়রানী’ কোনটা দিয়েই ‘ইভ টিজিং’-কে ঠিক ঠিক বোঝানো যায় না। তাহলে কি এদেশে সাহেবদের আসার আগে এটা ছিল না? আলবত ছিল। এই দেশের লোক সাহিত্য লক্ষ করলে সেখানে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। গাছতলায় দাঁড়িয়ে থেকে পথচলতি নারীকে উত্যক্ত করা, মধ্যরাতে বাঁশি বাজিয়ে গৃহমধ্যস্থ নারীকে উত্যক্ত করা, জলাশয়ে স্নানরত নারীর পোশাক চুরি করে তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা, গাছে উঠে স্নানরত নারীকে লক্ষ করা, সিক্তবসনা নারীর পথরোধ করে তাকে বিব্রত করা, নানা ছুতোনাতায় নারীর আঁচল/ওড়না ধরে টানা, নারীকে শারিরীকভাবে আঘাত করা, জনসমক্ষে নারীকে অপদস্থ করা – কী নেই আমাদের লোক সাহিত্যে! এবং প্রায়ই এগুলো আখ্যানের ‘ভিলেন’-এর কাজ নয়, ‘হিরো’র কাজ। সেই ‘হিরো’ আবার আমাদের চোখে প্রেমিক, কেউ কেউ মহান প্রেমিক।

বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক আলোচিত ‘প্রেমের উপন্যাস’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’। এই উপন্যাসে অনেক কিছু পাওয়া গেলেও ‘নায়ক’ দেবদাসের ‘নায়িকা’ পার্বতীর প্রতি প্রেমপূর্ণ উক্তি, প্রিয় সম্ভাষণ, সোহাগ, বিশেষ যত্ন ইত্যাদি প্রেমের প্রকাশমূলক কিছু পাওয়া যায় না। পার্বতীর জন্য দেবদাসের কোন ত্যাগের কথাও জানা যায় না। বরং উপন্যাসের শুরু থেকে দেবদাসকে দেখা যায় ক্রমাগতভাবে পার্বতীতে হাত, বেত, ছিপ, বাক্য দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে যেতে। দেবদাস আঘাত করে বিবাহলগ্না পার্বতীর কপালও কেটে দিয়েছে। দেবদাস পার্বতীকে গ্রহন করার সাহস দেখায়নি, তার জন্য অসবর্ণ বিবাহ করেনি, পরিবার ও তথাকথিত সমাজের বিপক্ষে দাঁড়ায়নি। দেবদাস পার্বতীকে একজন কৃতদাসীর চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি। তাই পার্বতীর অন্যত্র বিবাহ হয়ে গেলে দেবদাস সেটাকে নিজের পরাজয় হিসাবে দেখে। পার্বতীকে হারানোর শোকে নয়, নিজের পরাজয়ের শোকে দেবদাস নিজেকে মদ্যপান ও বেশ্যাগমনে ডোবায়। নারীকে ক্রমাগত শারিরীক-মানসিক আঘাত করা দেবদাস আমাদের কাছে মহান প্রেমিক। তার এই প্রকার আচরণ নিন্দার্হ এমনটা বলা দূরে থাক, আমরা তা ভাবিও না; বরং এমন আচরণকেই প্রেম বলে চালানোর চেষ্টা আমাদের থাকে।

সাহিত্যে এই চর্চ্চা যে কেবল ‘আগের আমলে’ হতো এমনটা নয়। আধুনিক কবিতাতেও উচ্চারিত হয় — “জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছো”। পুরুষ কবি নিজের ভাবনাকে নারীর ভাবনা বলে চালাতে চাইলে এমন পংক্তি মিলবে। পুরুষের ভাবনাকে নারীর ভাবনা হিসাবে চালানোর ভালো উদাহরণ খোদ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘দ্বিচারিনী’-তে পাওয়া যাবে। সেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘সুন্দরী’ মধুরিমা ভাবে, “বললে লোকে বিশ্বাস করবে না, মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে দু-তিনজন সোলজার এসে আমাকে রেপ করুক”। মধুরিমার ‘অসুন্দরী’ বান্ধবী গঙ্গার ভাষ্য আরও ভয়াবহ — “গঙ্গা অবশ্য দুঃখ করে বলল, আর আমি যা কুচ্ছিত দেখতে, কেউ আমাকে রেপও করবে না”। ধর্ষণ কতোটা বীভৎস ও ভয়াবহ ব্যাপার সেটা জ্ঞানসম্পন্ন প্রত্যেকটা নারী জানেন। ধর্ষণের ট্রমা যে একজন ধর্ষিতাকে সারা জীবন পদে পদে তাড়িত করে সেটাও নারীরা জানেন। তাই কোন নারীর পক্ষে ‘সোলজার দিয়ে গ্যাং রেপড্‌’ হবার স্বপ্ন দেখা সম্ভব না, অথবা নিজে ‘ধর্ষণযোগ্যা’ না অমনটা ভেবে দুঃখ করার কথা না। এমন ভাবনা কোন কোন পুরুষের ভাবনাসঞ্জাত। সাহিত্যে এমন ভাবনার প্রকাশের ফলে কোন কোন পুরুষ পাঠক এমন ভাবতে পারে যে, নারীদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ধর্ষিতা হতে আগ্রহী। অমন কোন পুরুষ পাঠক ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ হলে তাকে প্রেষণা দেবার দায় কি ঐসব সাহিত্যিকদের ওপরেও বর্তায় না?

+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+

যে কোন কালের বাংলা চলচ্চিত্রের বৃহদাংশে নায়কের প্রধানতম কাজ হচ্ছে নায়িকাকে ক্রমাগত উত্যক্ত করে ‘প্রেমে ফেলানো’। উত্যক্ত করে যদি না পারা যায় তাহলে নায়িকাকে ব্ল্যাকমেইল করে হলেও তাকে ‘প্রেমে ফেলানো’। এতে নায়িকা আসলেই নায়কের প্রেমে পড়ে কিনা আমরা নিশ্চিত না, তবে শেষমেশ নায়িকাকে যে নায়কের বাহুডোরে ধরা দিতে বাধ্য করা হয় এমনটা দেখতে পাই। এই প্রকার চলচ্চিত্রের কোন কোনটার নাম যে ‘তোকে ভালোবাসতেই হবে’, ‘ভালোবাসা দিবি কিনা বল', 'তুই শুধু আমার’, 'জোর যার মুল্লুক তার', ‘তোমাকে বউ বানাবো’ ইত্যাদি হবে এটা আর বিচিত্র কী! নায়কের এই ইভ টিজিং যে কেবল আজগুবী কাহিনীর তথাকথিত বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে দেখা যায় তা নয়; সামাজিক ধারার বহুল প্রশংসিত চলচ্চিত্রগুলোতেও এমনটা আকছার দেখা যায়। চলচ্চিত্রে ইভ টিজিং-এর এহেন ধনাত্মক উপস্থাপনা প্রমাণ করে আমাদের সংস্কৃতিতে ইভ টিজিংকে কোর্টশীপের সমার্থক বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। তাই পথচলতি নায়িকাকে ক্রমাগত উত্যক্ত করে যাওয়া (এক পর্যায়ে নায়িকাকে জাপটে ধরেও) নায়কের গাওয়া “সুন্দরী চলেছে একা পথে, সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে”-কে ‘প্রেমের গান’ হিসাবে চালানো হয়। নারীকে উত্যক্তকারী এই প্রকার তথাকথিত ‘প্রেমের গান’ বাংলা ভাষায় অগণিত।

বাংলা চলচ্চিত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী বলেনন,”মানুষ এগুলোকে এখন স্বাভাবিক মনে করছে। দীর্ঘদিন ধরে নারীকে দুর্বল, নির্ভরশীলভাবে উপস্থাপনের ফলে এটা হয়েছে। সেই সঙ্গে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। সিনেমা বা নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখা থেকে, পরিচালনা, ক্যামেরা চালানো — সবই হয় পুরুষের দৃষ্টিতে। ফলে পুরুষ যেভাবে দেখতে চায়,তেমনটাই দেখানো হয়। এর মধ্যে নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এটা একদিনে হয়নি,দিনের পর দিন নারীকে ওভাবেই চিত্রায়ন করা হয়েছে। নাটক সিনেমায় উপস্থাপিত নানা ধরণের ঘটনা বাস্তবে অনুকরণ ও অনুসরনের চেষ্টা করে মানুষ। এর ফলে অনেক সময় পরোক্ষভাবে সমাজে নির্যাতন এবং হয়রানিকে উৎসাহিত করে”। একই প্রসঙ্গে অভিনেত্রী অপু বিশ্বাস বলেন, “আমাদেরকে যেভাবে যে চরিত্র করতে বলা হয়, যে 'অ্যাটিচুড' করতে বলা হয়, আমরা তাই করি। এই উপস্থাপন কেবলই বিনোদন। তবে সমাজে এ ধরণের চিত্রায়নের প্রভাব পড়ে”।
(সিনেমা ও নাটকে নারীর উপস্থাপন কি নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতনকে স্বাভাবিক করে? বিবিসি বাংলা; ৫ অক্টোবর, ২০১৭)

ইভ টিজং-এর মতো বিষয়কে যারা বিনোদন ভাবে, এবং যারা এটাকে বিনোদন হিসাবে উপস্থাপনা করে তারা অসুস্থ চিন্তার মানুষ। এমন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও দর্শক উভয়েই সমাজের জন্য ক্ষতিকর। নারীকে উত্যক্ত করা এমন কাহিনী/দৃশ্য/গান সম্ভবত সেন্সর বোর্ডের কাছে আপত্তিকর মনে হয় না। যদি তাদের কাছে ওসব আপত্তিকর মনে হতো তাহলে সেসব আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছাতো না। এই ব্যাপারে সেন্সর বোর্ডের সদস্যদের দোষারোপ করার কিছু নেই। তারা এই সমাজেরই মানুষ, সুতরাং তাদের মানস এই সমাজের শিক্ষা সঞ্জাত।

+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+

সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্রের মতো টেলিভিশনের নাটক-চলচ্চিত্রেও ইভ টিজিং বা নারীর প্রতি সহিংসতা সরবে উপস্থিত। টেলিভিশনে জনৈক আদিবাসি মিজানের রচনা ও পরিচালনায় নির্মিত ‘হাত বদল’ নাটকটিতে দেখা যায় অভিনেতা ফারুক আহমেদ তার স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয়কারী নারীটিকে ক্রমাগত সজোরে আঘাত করছেন এবং জঘন্য আচরণ করছেন। নাটকের শেষের দিকে ফারুক আহমেদ তার এমন আচরণের জন্য অনুতাপ প্রকাশ বা ক্ষমা চাইতে দেখা যায় না; বরং সে তার এই প্রকার আচরণকে ‘ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ’ হিসাবে ব্যাখ্যা করে। নারীকে অবমাননা করা, আঘাত করা এই প্রকার নাটক টেলিভিশনে হরহামেশা দেখা যায়। টেলিভিশনে বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে নারীকে স্রেফ নারীদেহ হিসাবে দেখানোর অভিযোগ অতি পুরাতন; ক্ষোভের বিষয় হচ্ছে কিছু কিছু বিজ্ঞাপনে ইভ টিজিংও বিদ্যমান। যেখানে নারীকে একজন মানুষ হিসাবে সম্মানের চোখে না দেখিয়ে ‘মাংস’ হিসাবে দেখানো হয় সেখানে ইভ টিজিং দেখানোটা স্বাভাবিক ব্যাপার।

+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+

অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ আর ম্যাকমিলানের অভিধানে ‘eve teasing’ শব্দটির উৎস দেখানো হয়েছে ভারত বা ভারতীয় ইংলিশকে। অন্যত্র ব্যবহারিক বিবেচনায় একে দক্ষিণ এশীয় বলা হয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টির ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে সংশ্লিষ্টতা অতি গভীর। ‘টাইম’ পত্রিকার ১৯৬০ সালের ১২ সেপ্টেম্বরের সংখ্যায় ভারতের ইভ টিজিং নিয়ে ‘Eve-Teasing‘ শিরোনামে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তার মানে এই টার্মটির ব্যবহারও খুব নতুন নয়। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যায় ‘ইভ টিজিং’ টার্মটিই আপত্তিকর। ভিকটিম নারীকে ‘ইভ’ হিসেবে চিহ্নিত করার মাধ্যমে নারীটির পক্ষ থেকে পুরুষকে আমন্ত্রণ জানানোর একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত আছে। এতে ঘটনার দায় নারীর ওপরে চাপানোর কৌশলী চেষ্টাও বিদ্যমান। ঘটনার পরে ভিকটিম নারীর পোশাক ঠিক নেই, চালচলন ভালো না, গায়ে পড়া স্বভাব, নষ্ট স্বভাব ইত্যাদি কথাগুলো যে প্রতিনিয়ত শুনতে হয় তার কারণ আমাদের সামাজিক মননে ইভ টিজিং-কে গুরুতর অপরাধ নয়, পুরুষের অধিকার হিসেবে দেখা হয়।

অথচ কোন বিচারেই ইভ টিজিং পুরুষের অধিকার নয় বা এটি কোন হালকা বিষয় নয়। ব্র্যাকের এক জরীপে জানা যায়, ২০১৬ সালে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়েসী মেয়েশিশুদের ৬২ শতাংশ রাস্তায় উত্ত্যক্ত করা, প্রেমে সাড়া না দেয়ায় হুমকি, অপহরণ এবং ধর্ষণের শিকারসহ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
(সিনেমা ও নাটকে নারীর উপস্থাপন কি নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতনকে স্বাভাবিক করে? বিবিসি বাংলা; ৫ অক্টোবর, ২০১৭)

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের করা এক গবেষণা থেকে জানা যায় ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে, অর্থাৎ আড়াই বছরে, বাংলাদেশে ইভ টিজিং-এর শিকার হয়ে প্রায় ৪০ জন মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এই সময়কালে ৭৫৪টি ইভ টিজিং-এর ঘটনার খবর মিডিয়াতে এসেছে, কিন্তু এসব ঘটনায় বিচারের হার খুব নগণ্য। মিডিয়াতে যতটা খবর হয়,ইভ টিজিং-এর ঘটনা তার চাইতে অনেক গুণ বেশি ঘটে। সব ঘটনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করা বা মামলা করাও হয় না।
(বাংলাদেশে 'ইভ টিজিং-এর শিকার হয়ে' আড়াই বছরে ৪০ মেয়ের আত্মহত্যা; বিবিসি বাংলা; ১৩ জুন, ২০১৭)

+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+-+

সাহিত্য-সঙ্গীত-নাটক-চলচ্চিত্র-শিল্প জীবনের প্রতিচ্ছবি। তাই আমাদের বাস্তব জীবনে ইভ টিজিং-এর মতো জঘন্য বিষয় বিদ্যমান বলে আমাদের সৃষ্টিশীল কর্মে তার উপস্থিতি থাকতে পারে। সৃষ্টিশীল কর্মে ইভ টিজিং-এর এই উপস্থিতি ভুল বা অনুচিত কিছু নয়। আপত্তিকর হচ্ছে এসব মাধ্যমে ইভ টিজিংকে খাটো করে বা গ্রাহ্য বলে বা পুরুষের অধিকার হিসাবে বা অনিন্দনীয় হিসাবে দেখানো।

এককালে ক্ষুধার্ত হিংস্র পশুর খাঁচায় জীবন্ত বন্দীকে ছেড়ে দেবার যে রীতি ছিল সেই কালে ঐ রীতির মহিমা গেয়ে বা সমর্থন করে কোন সঙ্গীত-নাটক রচিত হওয়াটা অসম্ভব কিছু না। আমরা নিজেদেরকে ঐ আমলের মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি মানবিক, যৌক্তিক, সভ্য ও সংস্কৃতিবান বলে দাবী করি; তাহলে আমাদের সৃজনশীল কর্ম কেন ঐ আমলের মানুষের কোন কোন কাজের মতো অসভ্য, অমানবিক হবে!


মন্তব্য

দময়ন্তী এর ছবি

চলুক
একদম ঠিক জায়গাটায় ধরেছেন। শীর্ষেন্দুর লেখায় তো এত এত পচা জিনিষপত্র থাকে, চরম রেসিস্ট, সেক্সিস্ট, মিসোজিনিস্ট একটা লোক। ক্র্যাফটসম্যানশিপ যদিও অসাধারণ।

ভারী ভাল বিশ্লেষণ

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শীর্ষেন্দু আর তার লেখা নিয়ে আপনি যে সব বিশেষণ ব্যবহার করলেন সেগুলোর ভুরি ভুরি উদাহরণ তার লেখাগুলোতে ছড়িয়ে আছে। মুগ্ধ পাঠকের চশমাটা খুলে রাখলেই সেগুলো চোখে পড়ে। সমসাময়িক গদ্যকার সুনীল-শ্যামলদের সাথে তার লেখার তুলনা করলে সেটা আরও স্পষ্ট হয়। আপনার মতো আমিও স্বীকার করি তার ক্র্যাফটসম্যানশীপ অসাধারণ।

এই প্রকার বিষয়ে আপনার লেখালেখির পরিমাণ তো খুব কম না। সচলের পাঠকদের পাতেও কিছু দিন। আমরা এখানে আলোচনা করি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইয়ামেন এর ছবি

চমৎকার এবং আমার মতে যথার্থ বিশ্লেষণ।
ইভটিজিং, এবিউজ, এবং যাবতীয় সেক্সিস্ট জিনিস যেভাবে আমাদের নাটক/চলচ্চিত্র/উপন্যাস/হালের মিউজিক ভিডিও সবকিছুতে ইনিয়েবিনিয়ে মহিমান্বিত করে দেখানো হয় তাতে দেশের মানুষ এমন ব্যাবহারকেই স্বাভাবিক মনে করবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। একটা ছেলে যখন নিজের হাতে ছুরি দিয়ে কেটে একটা মেয়ের নাম লিখে, বা মেয়ের সামনে লাইটার জ্বালিয়ে হাতের তালুতে ধরে বলে 'তুমি যতক্ষন পর্যন্ত না বলছ ভালোবাসি আমার হাত পুড়তেই থাকবে', এসবকে আমরা প্রেমের নিদর্শন হিসেবে দেখতে পছন্দ করি। কিন্তু একটা মেয়েকে কি পরিমান মানসিক চাপে ফেলে 'প্রেমে পড়তে' বাধ্য করা হচ্ছে, এবং এভাবে 'প্রেমে পড়াটাকে' আসলেই ভালোবাসা বলা যায় কিনা, সেই বিষয়ে খুব একটা ভাবা হয় না।

অনেকদিন পর আবার আপনার লেখা পেয়ে ভালো লাগলো পাণ্ডব-দা। হাসি

--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সব বেদনা মুছে যাক স্থিরতায়
হৃদয় ভরে যাক অস্তিত্বের আনন্দে...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমাদের দেশে বিয়েকে অনেক শারিরীক, মানসিক, আচরণগত সমস্যার সমাধান হিসাবে ভাবা হয়। এজন্য ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক, অথবা প্রস্তুতি থাকুক বা না থাকুক অনেককে জোরজার করে বিয়ে দেয়া হয়। এই জোর করে বিয়ে করার/করানোর মধ্যে যে সব ধন্বন্তরি সমাধান আছে বলে লোকে বিশ্বাস করে তার মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা একটা। তারা বিশ্বাস করে বিয়ে দিলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম হবেই। এই প্রকার বিশ্বাস থেকে লোকে অনিচ্ছুক নারীকে উত্যক্ত করে, জোর করে অধিকার করার চেষ্টা করে।
অমন বিয়ে ভেঙে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার সুযোগ খুব কম জনের হয়, বাকিরা আমৃত্যু অন্তত চিতায় জ্বলতে থাকে।

পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ ইয়ামেন! লেখালেখিতে নিয়মিত হবার চেষ্টায় আছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

চমৎকার বিশ্লেষণ, বিশেষকরে, জনপ্রিয় লেখকের লেখায়, কিংবা জনপ্রিয় চলচিত্রে এর অসংবেদনশীল প্রয়োগের যে উদহরণগুলি দিলেন। ।

যদিও বর্তমান শিল্পেও এর সরব উপস্থিতি রয়েছে, তবে আমার মনে হয় সাহিত্যে, চলচিত্রে এবং সংশ্লিষ্ট মাধ্যমে ‘ইভ-টিজিঙকে’ মহিমান্বিত করার উদাহরণ ধীরে ধীরে কমে আসছে। সংবেদনশীল পাঠক এজন্য ধন্যবাদ পেতেই পারে।

আপনি যেমনটি বলেছেন, ‘ইভ-টিজিং’ শব্দটাই আপত্তিকর। ভারতে দেখলাম সেই আশির দশকেই ন্যাশানেল কমিশন ফর ওমেন আইনে এই শব্দ প্রয়োগের এর বিরোধিতা করেছিল।

তবে মজার ব্যপার হল, সত্তরের দশকের ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ ওর্ডিন্যান্সের ৭৬ ধারায় “ওমেন-টিজিং’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। অবশ্য কঠোরতার দিক দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (এবং ২০০৩ এ সংশোধিত) অনেক শক্তিশালী এবং যুগোপযোগী।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ইন্টারনেটের আবির্ভাবে মত প্রকাশের সার্বজনীন যে সুযোগ এসেছে তাতে সৃষ্টিশীল কর্মে এহেন বিষয়ের উপস্থিতিকে সংবেদনশীল পাঠকের পক্ষ থেকে তীব্র সমালোচনা করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে সৃষ্টিশীল কর্মে ইভ টিজিংকে মহিমান্বিত করার হার হয়তো কমে এসেছে, তবে একে স্বাভাবিকভাবে দেখানোর বা একে কোর্টশীপ/ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে দেখানোর ইতর প্রবণতা এখনো আছে।

বাংলাদেশ বা ভারতে এই প্রকার বিষয়ে বিদ্যমান আইনগুলো বেশ ভালো। সমস্যা হচ্ছে এই বিষয়ে সমাজের মানসটা নারীর পক্ষে না। ফলে আইন প্রয়োগের দায়িত্ব যাদের ওপর তাদের আচরণও প্রায়ই ভিকটিম নারীর বিপক্ষে যায়। সাহস করে কোন ভিকটিম নারী তাদের কাছে পৌঁছাতে পারলেও তাদের ঐপ্রকার মানসের জন্য নারীটি আর সুবিচার পায় না। আর ঘটনাকালে 'সাপের খেলা' দেখতে আসা চারপাশের সাধারণ নাগরিকদের আচরণের কথা যতো কম বলা যায় আমাদের লজ্জার পরিমাণ ততো কম হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কনফুসিয়াস এর ছবি

এইসব বিষয়গুলো নিয়ে নানা রকম সংশয় বা দ্বন্ধ কাজ করে মনে। শীর্ষেন্দুকে নিয়ে অনেক অভিযোগ শুনেছি, কিন্তু ফিকশানের বাইরে তাঁর লেখা তেমন পড়িনি বলে কিছু জানি ও না। আমি অবশ্য এই ব্যাপারটা মেনে চলি, লেখক, কবি বা যে কোন শিল্পীকে তাঁদের শিল্প মাধ্যম দিয়েই চিনি জানি পড়ি বা শুনি। আমি দেখেছি ব্যক্তি মানুষকে নিয়ে জানতে গেলে নানা ঝামেলা হয়ে যায়। সেটা হুমায়ুনই হোক ( আহমেদ কিংবা আজাদ), লতা মুঙ্গেশকর হোক, কবির সুমন বা সৈয়দ হক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জয়জয়কারময় দুনিয়ায় এই এক বিষম বিড়ম্বনা।
হুমায়ুন আহমেদের নানা চরিত্রের সংলাপ বা ভাবনাকে তাঁর নামে কোট করে প্রচার হচ্ছে দেখলাম। গল্পের চরিত্রের ভাবনার দায় লেখককে নিতে হলে মুশকিল আসলে। সৈয়দ হক আসলেই খেলারাম খেলে যার-র বাবর আলী কি না, এটা নিয়ে ভাবতে চাই না। সত্যজিতের লেখা বা আঁকায় নারী চরিত্র কম, এটা টের পেয়েছি যখন, তখন নিজেই বুঝে নিয়েছি হয়তো এই দিকটায় তিনি আনকমফোর্টেবল, বা আরেকটু বেশি গিয়ে বলি, অপটু। নারীবিদ্বেষী কখনওই মনে হয়নি।
এটা আমারই দুর্বলতা হয়তো, কিন্তু আমি সত্যিই গল্প বা উপন্যাস পড়তে গিয়ে সেগুলোর চরিত্রের ভেতরে লেখককে খুঁজি না। ওই চরিত্রগুলোই মাথায় থাকে বেশি। যেমন উপরে মধুরিমা-র রেপড হতে চাওয়ার বাসনা-টুকু অদ্ভুত, অস্বাভাবিক, গা শিউরে ওঠার মত। কিন্তু এটা তারপরেও আমার কাছে কেবলই মধুরিমা-র বক্তব্য, শীর্ষেন্দুর নয়। এটা যতটুকু অদ্ভুত এবং অস্বাভাবিক, তেমনি করে আমি যতক্ষণ এই গল্পের পাঠক আমার কাছে এটা মধুরিমা-র বক্তব্য হিসেবে একই রকম সত্য।
অথবা কে জানে, আমি হয়তো সত্যিই ভুল। হয়তো এদের অনেকেই সত্যিই নারীবিদ্বেষী , সত্যিই ধর্ষকামী, সত্যিই বর্ণবাদী। আমি হয়তো বোকার মতই তাঁদের ক্রাফটম্যানশীপের দক্ষতায় ভুলে বসে আছি। ভেবে নিচ্ছি, কাব্য পড়ে যেমন ভাবি, কবি তেমন নয় গো। হাসি
সেই ঘুরে ফিরে স্কয়ার ওয়ান। সেই সংশয়, সেই দ্বিধা।
লেখাটা ভালো লেগেছে পান্ডবদা। অনেক ধন্যবাদ। হাসি

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

নৈষাদ এর ছবি

মজার বিতর্ক। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ গোলমেলে মনে হয়।

আমি নিজেও কখনও গল্প বা উপন্যাস পড়তে গিয়ে সেগুলোর চরিত্রের ভেতরে কোনভাবেই লেখককে খুঁজি না। এবং আরেকটা বিতর্ক – লেখক কি সমসাময়িক সমাজের অবস্থাটা তুলে ধরবে না তাঁর চরিত্রের মধ্যে দিয়ে? নাকি তাঁর ‘পলিটেক্যালি কারেক্ট’ হবার একটা বাধ্যবাধকতা আছে? একটা উদাহরণ দেই - একটা ভারতীয় বাংলা চলচিত্র ‘প্রাক্তন’ দেখলাম কয়দিন আগে। ভাল লাগেনাই। নারীকে প্রচন্ডভাবে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেই স্টেরিওটাইপ উপস্থাপন।

তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, নির্মাতা কি সমসাময়িক অবস্থাকে তুলে না ধরে একটা ইউফোরিক অবস্থা দেখাবে চলচিত্রে? এই বিতর্ক হয়ত শিল্পীর জন্য।

আমার দৃষ্টিকোণ থেকে অন্তিমে সিদ্ধান্তটা সহজ। জনপ্রিয় লেখক কখনই অপরাধকে বা অসংবেদনশীল আচরণকে মহিমান্বিত করতে পারে না – এই দায়টা তার থেকেই যায়। (যেমন এখানে ইভ-টিজিং)

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গণমাধ্যমে প্রচারিত ফিকশনে পলিটিক্যাল কারেক্টনেস রাখার একটা অলিখিত বিধান আছে, কিন্তু সাধারণত কোন সৃষ্টিশীল কর্মের ক্ষেত্রে অমন বাধ্যবাধকতা নেই। সৃষ্টিশীল কর্মটি যখন জনগণের পাতে এসে পড়ে তখন সেটাকে জনগণ ফালা ফালা করে দেখবেন এমনটাই স্বাভাবিক। সেখানে স্বাভাবিকের বা সাধারণের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু থাকলেই যে তা অগ্রহনযোগ্য হবে তা নয়। এখন কোন কর্মে যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে হেয় করার বা আঘাত দেবার মতো কিছু থাকে তাহলে সেটা নিয়ে আপত্তি তোলাটাও স্বাভাবিক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই বিতর্কটা অনেক পুরনো যে, গল্পের চরিত্রগুলোর কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের দায় লেখকের ওপর বর্তায় কি না। যেহেতু বাস্তবে প্রচুর বাজে লোক বা দুরাচার বিদ্যমান তাই গল্পে অমন চরিত্র থাকা স্বাভাবিক। বাস্তবে লোকে হরহামেশা বাজে কথা বলে, বাজে কাজ করে — সুতরাং গল্পের চরিত্রদের কেউ কেউ অমন বাজে কথা বলবে বা বাজে কাজ করবে। এটা নিয়ে আপত্তিও করার কিছু নেই। আপত্তিটা ওঠে তখন যখন লেখক সরাসরি বা ইনিয়ে বিনিয়ে ঐ বাজে কথা বা বাজে কাজগুলো জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেন। একজন লেখকের একটা লেখায় এমন কিছু হলে সেটা হয়তো উপেক্ষা করা যায় কিন্তু এই ঘটনা বার বার ঘটতে থাকলে সেটা উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে যায়। আমার পঠিত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের সংখ্যা ১৫০-এর কিঞ্চিত এদিক ওদিক। তাকে নিয়ে আমার পোস্টে বা উপরে দমুদি’র করা মন্তব্যের প্রত্যুত্তরে বলা কথাগুলোর ভিত্তি হচ্ছে তার ঐ ১৫০+/- বই। একজন লেখকের এতগুলো বইয়ের কনটেন্ট থেকেও কি তার চিন্তামানস ধরা যাবে না?

একজন মানুষ হিসাবে প্রতিটি লেখকের নিজস্ব জীবনদর্শন আছে, সমাজ-জীবন-সভ্যতা-রীতি নিয়ে নিজস্ব ভাবনা আছে; এবং অতি অবশ্যই ভাব প্রকাশের তার নিজস্ব স্টাইল আছে। ফিকশন লেখকের লেখায় তার চিন্তা-দর্শন ফুটে ওঠে বলে তার চিন্তামানসের রূপরেখা পাঠকের কাছে অস্পষ্ট থাকে না। ফলে পাঠক মোটা দাগে আঁচ করতে পারেন একটা বিষয়ে একজন বিশেষ লেখকের অবস্থান কেমন হতে পারে। এখান থেকে আমরা জানি, পাকিস্তান বা মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে হুমায়ুন আজাদের লেখায় কী প্রকার বক্তব্য পাওয়া যাবে। স্টাইল থেকে আমরা বলতে পারি সত্যজিৎ রায়ের কিশোর গল্পে কিশোরীরা প্রায় অনুপস্থিত থাকবে। যেহেতু সত্যজিৎ রায় তাঁর লেখায় নারীবিদ্বেষী কিছু লেখেননি তাই নারী চরিত্র চিত্রণে তাঁর কুণ্ঠা থাকলেও তাঁকে নারীবিদ্বেষী বলার উপায় নেই।

আমি ব্যক্তি লেখককে তার সৃষ্ট কোন চরিত্রের সাথে মেলানোর চেষ্টা করি না। সেটা সঙ্গতও নয়। এখানে লেখকের সাথে তার সৃষ্ট চরিত্রকে মেলানো সংক্রান্ত বক্তব্যটি খোদ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের। আমি সেটা উল্লেখ করেছি বটে কিন্তু মূল আলোচনায় সেটিকে ধর্তব্য দেখাইনি।

ধর্ষণ নিয়ে নারীরা কী ভাবেন সেটা আমরা সবাই বহু বহু বার বহু বহু জায়গায় পড়েছি, শুনেছি। সেটা নিয়ে কারো দ্বিধা থাকার কথা না। মধুরিমা বা গঙ্গার মতো কোন মেয়ে কখনো ধর্ষিতা হবার স্বপ্ন দেখে কিনা সেটা আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন বয়সী নারীকে জিজ্ঞেস করে জানার চেষ্টা করেছি। তাদের মধ্যে যাদের বয়স অল্প তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল — এই প্রকার ইতর চিন্তা আমার মাথায় আসলো কী করে! তখন আমি তাদেরকে প্রেক্ষিতটা বই খুলে দেখিয়েছি। যাদের বয়স বেশি ছিল তাদের কেউ কেউ বলেছেন, একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে এক জন নারী তার কাঙ্খিত মানুষের সাথে শারিরীকভাবে মিলিত হবার স্বপ্ন দেখেন, কখনো কখনো ধর্ষিতা হবার দুঃস্বপ্নও দেখে থাকতে পারেন; কিন্তু ধর্ষণ কখনোই একজন নারীর কাম্য বিষয় নয়। এখন যদি কেউ বলেন, আপনি কি সারা দুনিয়ার ৩.৮ বিলিয়ন নারীকে ইন্টারভিউ করেছেন যে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন? সেক্ষেত্রে আমার উত্তর হচ্ছে কিছু কিছু বিষয় হচ্ছে বোধের, সেগুলোকে নিজের বোধ দিয়ে বুঝতে হবে।

ঠিক এই মুহূর্তেও বাজারে এমন শত-সহস্র ফিকশন আছে যেগুলোর পরতে পরতে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, নারীবিদ্বেষ, জাতবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ, শ্রেণীশ্রেষ্ঠতার মতো বিষাক্ত আবর্জনা আছে। ঐসব ফিকশনের লেখকদের বেলায়ও কি আমরা একইভাবে ডিসকাউন্ট করতে পারবো? সৃষ্টিশীল কর্ম যদি বলা হয় তাহলে শুধু ফিকশন কেন? নাটক-চলচ্চিত্র-সঙ্গীত-চিত্রকর্ম-শিল্পকর্ম ইত্যাদিতেও কি অনুরূপ বিষাক্ত আবর্জনাকে ডিসকাউন্ট করতে পারবো? আর শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করলেও পুরীষ পুরীষই থাকবে।

বিস্তারিত মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ কনফুসিয়াস। আপনার লেখা গল্প আমরা সবাই মিস করি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তিথীডোর এর ছবি

চমৎকার লেখা, অতি চমৎকার মন্তব্য।
কাছের ঠাকুর পড়ার পর থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে ছেড়েছি।

পাঁচ তারা, মন্তব্যে!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ভক্ত অথবা পাঠক সবার 'কাছের ঠাকুর' পড়া দরকার। তাতে উনার লেখার অনেক কিছু পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

চলুক

নারীর প্রতি ধারাবাহিক, অনিঃশেষ সহিংসতার নানা হাতিয়ারের একটি - ‘ইভ টিজিং’। হাতিয়ার-টা ভয়ংকর কারণ এটা উপস্থাপনায় সাদামাটা - কি আর এমন, ‘টীজ’ করা-ই তো, আসলে এটা সীমাহীন দুঃস্বপ্ন-তে ঢুকিয়ে দেওয়ার অস্ত্র। আর সেই অস্ত্র নিয়ে শিকার চালিয়ে যাওয়ার নিষ্ঠুরতাটাকেই শিল্প-সুষমায় মহান করে তোলা - হ্যাঁ খুব-ই চেনা ছবি।

"সাহিত্য-সঙ্গীত-নাটক-চলচ্চিত্র-শিল্প জীবনের প্রতিচ্ছবি।" - কথা হচ্ছে, এই প্রতিচ্ছবিটা কে তুলে ধরছে। এক-ই ঘটনা পুরুষ লেখকের হাতে নায়কের মহিমা কীর্তনে তাকে দেবতার আসনে বসায়। আর নারী লেখকের লেখায় মহাপুরুষের মহিমা ম্লান হয়ে গিয়ে ফুটে ওঠে নারীর লাঞ্ছনা-বেদনার গাথা। ইতিহাসে ধরতে পারা সময়ের বেশীরভাগটা জুড়ে শিল্প-সাহিত্য পুরুষের হাতে তৈরী। প্রাচীন ধ্রুপদী থেকে হালের নোবেল-পাওয়ারা - নারী সেখানে লাভ করার, লোভ করার ‘বস্তু’। তার সাথে বলা আছে - যুদ্ধে ও প্রেমে সকল-ই জায়েজ। আর কি চাই! আবার পুরুষের হাতে গড়া এই শিল্প-সাহিত্য কেনার পয়সা যোগান দেওয়ার পকেট-টাও পুরুষের পোষাকে। স্রষ্টা-ভোক্তার এই চক্র তাই অনিঃশেষ - যতদিন না নারী নিজে আর্থ-সামাজিক ক্ষমতার সেই অবস্থানে পৌঁছায় যেখানে এই চক্র তার সম্মতির উপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়।

শীর্ষেন্দু - লেখক থেকে ব্যক্তি। তোমার এবং দমুদির অবস্থানের সাথে সহমত। হয়ত অন্য স্রষ্টাদের সাথে তুলনা এবং নির্দিষ্ট করে কোন গল্পের আলোচনায় কিছু ভিন্নতা আসতে পারে। কিন্তু সেটা-তে খুব একটা তফাৎ ঘটবে না। যেমন - মধুরিমার ভাবনা। যৌন মর্ষকাম বিশৃঙ্খলা-তে আক্রান্ত চরিত্রকে নিয়ে গল্প লিখতে চাইলে সেই চরিত্রের মুখে ওইরকম উক্তি আসা অস্বাভাবিক নাও হতে পারে। তবে সেখানেও তোমার সাথে পূর্ণ সহমত যে গন্ডগোল-টা বাধে চরিত্রের উপস্থাপনা নিয়ে। মধুরিমার সাথে গঙ্গা-কে এনে যে ছবি আঁকা হল - যেটা নগণ্য অংশের ভাবনা সেটার সাধারণীকরণ - এইটা ভয়াবহ।

অতিদীর্ঘ অবিচার-অনাচারকে কাটিয়ে ওঠার সফরটাও দীর্ঘ-ই হবে। যৌবনে গাইতাম - পথেই এবার নামো সাথী, পথেই হবে সে পথ চেনা। প্রতিবাদী চেতনার এই লেখা সেই পথ চলার অংশ।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ বস্‌! আপনার ভাবনার সাথে প্রবল সহমত।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সোহেল ইমাম এর ছবি

চমৎকার লেখা। ইভ টিজিং সম্পর্কে সামাজিক একটা প্রশ্রয় আছে সেটা অনেকেই চেপে যান। আপনার লেখা মানেই অন্য কিছু হবে এটা ভেবেই বড় লেখাটা পড়ে ফেলেছি, হতাশ হইনি। হাততালি

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পোস্ট পড়া আর মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সবুজ এর ছবি

দেবদাসের এমন বিশ্লেষণে হতাশ হলাম।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় সবুজ, পোস্টে বলা আমার যে কোন মতের বিপক্ষে আপনার মত থাকতে পারে। অর্থাৎ, যে কোন বিষয়ে মতদ্বৈততার পূর্ণ অধিকার আপনার আছে। সে হিসাবে 'দেবদাস' বিষয়ে আমার বিশ্লেষণ আপনি না-ই মানতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি 'দেবদাস' বিষয়ে আপনার মতটি না জানিয়ে কেবল হতাশা প্রকাশ করেন তাহলে পাঠককূল কী করে বুঝবেন আপনার যুক্তিগুলো কী?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

শী মু বাবুর প্রায় প্রতিটি বড়দের উপন্যাসে, প্রচুর বড়দের ছোটোগল্পে ব্যতিক্রমহীনভাবে পুরুষই শ্রেষ্ঠ ও সুমহান, নারী বস্তু বা ব্যবহার্য্য সামগ্রীমাত্র, জাতপাত, জাতপাত মিলিয়ে বিয়ে করা, ব্রাহ্মণ-পুরুষের চারটি স্ত্রী(ব্রাহ্মণকন্যা, ক্ষত্রিয়কন্যা, বৈশ্যকন্যা ও শূদ্রকন্যা এই অর্ডারে), ক্ষত্রিয় পুরুষের তিনটি স্ত্রী(টপটি বাদে বাকী তিন, একই অর্ডার), বৈশ্য(টপ দুটি বাদে বাকী দুই, একই অর্ডার) পুরুষের দুটি স্ত্রী আর শূদ্র পুরুষের একটি স্ত্রী(আবশ্যিকভাবে শূদ্রকন্যা) থাকা উচিত ইত্যাদি প্রভৃতি বক্তব্য থাকে। কারণ ওঁর ঠাকুর বলে গিয়েছেন প্রতিলোম বিবাহ(উচ্চবর্ণা মহিলা ও নিম্নবর্ণ পুরুষ) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, অনুলোম(উচ্চবর্ণ পুরুষ ও নিম্নবর্ণা মহিলা) চলা উচিত, উহা পুরুষের অধিকার ও কর্তব্য, মানবজাতির উন্নতিকল্পে। আর হ্যাঁ, সন্তানরা সম্পুর্ণই পিতার বর্ণ পাবেন।
আমি এমনকি শী মু বাবুর কল্পবিজ্ঞান পর্যন্ত পড়ে দেখেছি, লোকে গ্রহে গ্রহান্তরে কালে কালান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু বিয়ে করার বেলা কে বৈশ্য কে ক্ষত্রিয় সব হিসেব একেবারে রেডি। প্রতিটি কাহিনিতে এইসব জাতপাত নারীপুরুষ নিয়ে এক বা একাধিক উপপাদ্য উনি প্রমাণ করে থাকেন।
যে কটা পড়লাম, পারাপার দিয়ে শুরু করেছিলাম, তারপর পার্থিব, মানবজমিন, সাঁতারু ও জলকন্যা, চক্র, হ্যানো ত্যানো যাই পড়ি না কেন, হয়ে গেল, ঘুরে ফিরে সেই ঠাকুরীয় উপপাদ্য প্রমাণ।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঠাকুরের ঋত্বিক/অনুসারী হওয়া বা না হওয়া যার যার নিজস্ব অভিরুচি, কিন্তু ঠাকুরের বানীকে চিনির প্রলেপ দিয়ে সাহিত্যে চালালে সেটা পার্টিজান সাহিত্যের মতো আবর্জনায় পরিণত হয়। পার্টিজান সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে নিকোলাই দুবোভ, নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি, ভেরা পানোভা, আন্তন মাকারেঙ্কো'র মতো অনেক অসম্ভব ক্ষমতাবান সাহিত্যিক এমন কিছু আবর্জনা উৎপাদন করেছেন। এগুলো লেখকের পক্ষে ক্ষমতার অপচয় আর পাঠকের পক্ষে সময়ের অপচয়।

বাংলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক কল্প সাহিত্য পড়তে গেলে দেখি নানা প্রশ্নে কিছু লেখকের ঝোলা খুলে যায়। প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা, গোঁড়া মানসিকতা, প্রগতিবিরুদ্ধতা, সনাতন রীতিবিরোধী কোন কিছু না থাকা ইত্যাদি এমনভাবে চলে আসে যে তাতে প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা সত্যকে যদি ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে হয় তাও নির্দ্বিধায় করে ফেলেন। সবার তো সব কিছু করার দরকার নেই, তবু যদি কেউ সেটা করতেই চান তাহলে জায়গামতো কাছা সামলে রাখা দরকার।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

একেবারেই তাই। লেখাগুলোর বেশিরভাগের ভিতরেই লুকোনো অ্যাজেন্ডা। আমার সন্দেহ, একসময় না একসময় পাঠকেরা এই অ্যাজেন্ডাসাহিত্যের চালাকিটা ধরে ফেলবেন। তারপরেও, হয়তো একদল পাঠক রয়ে যাবে, যারা তাঁর ঠাকুরের শিষ্যসামন্ত। কিন্তু বাকীরা অনেকেই নির্মোহ হয়ে যাবেন।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

তারপরেও, হয়তো একদল পাঠক রয়ে যাবে, যারা তাঁর ঠাকুরের শিষ্যসামন্ত। কিন্তু বাকীরা অনেকেই নির্মোহ হয়ে যাবেন।

- হয়তো, তবে অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য না হয়ে শীর্ষেন্দু ঠাকুরের শিষ্য হয়ে গেছেন এমন পাঠকের সংখ্যা বিপুল। তাদের দৃষ্টিতে, অনুকূল ঠাকুর কী বলেছেন সেটা ধর্তব্য না, শীর্ষেন্দু ঠাকুর যা লিখেছেন সেগুলো সঠিক। ভয়টা এখানে, আপত্তিটাও এখানে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তুলিরেখা এর ছবি

সেটাই। এত জনপ্রিয় এবং তথাকথিত "সফল" লেখকের প্রায় প্রতিটি লেখার ভেতরে লুকোনো অ্যাজেন্ডা, আর সেটা ঘোর বর্ণবাদী, পুরুষপ্রাধান্যবাদী, জাতপাতবাদী অ্যাজেন্ডা। এমনিতেই যেখানে সমাজের অসংখ্য অনুশাসন, কুসংস্কার, ভুল ধারণা ইত্যাদি আমাদের যেকোনো প্রগতিশীলতার গলা টিপে মারতে চায়, সেখানে এই ধরণের লেখা আরও বেশি বিপজ্জনক। সবচেয়ে অসহ্য যেটা লাগে সেটা হল মানুষে মানুষে সম্পর্কের মধ্যে বিধিনিষেধ আরোপ, প্রতিলোমবিবাহ জাত সন্তানরা নাকি মানুষ না, "রাক্ষস" বা ওইরকম কিছু। অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিরপরাধ কিছু মানুষ পুড়ে যাবে সমাজের আগুনে। এটা মনুষ্যত্ববিরোধী তো বটেই, বিজ্ঞানবিরোধী ও।

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সবাক অতিথি এর ছবি

অনেক দিন পর লেখাটা আবার পড়লাম, তাও আবার গুগলে সার্চ দিয়ে, মানুষ হয় এসব ভুলে যায় অথবা ভুলে থাকতে পছন্দ করে। "এসব" মানে আমি এই অসংবেদনশীল এবং দায়ভার এড়ানো "নামী" সাহিত্যিক দের "কালজয়ী" সাহিত্যকর্মের "বেঁচে যাওয়া" কে বোঝাচ্ছি।
এই মুখার্জিসাহেব অনেকটা সময় জুড়ে বাংলা সাহিত্য পাঠকসমাজ কে "জাস্টিফায়েড" মিসোজনির ঘোল খাইয়ে "টাইট" রেখেছিলেন। সে পুরুষ পাঠকদের ভুলিয়েছে তাদের ইগোতে সুড়সুড়ি দিয়ে, তাদের তাবৎ বদস্বভাবকে জাস্টিফাই করে, আর মোটামুটি সব ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী বা স্বাবলম্বী হতে চাওয়া শিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত নারীদের ভিলেন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, আর নারী পাঠকদের (একাংশ) কে ভুলিয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে অবনত, পরনির্ভরশীল, ভীত নারীচরিত্রদের "মহিমান্বিত" করে - এই সবকটা "গুণ" ই কিন্তু আসলে প্রবল পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে নারীসমাজের প্রাথমিক অসহায় আত্মসমর্পণ - তাঁদেরই এই চরিত্রগুলোর প্রতি সমর্থন তৈরি হয় যারা নিজেরাও ওই অসহায়ত্ব কাটিয়ে উঠবার সুযোগ বা সামর্থ অর্জন করতে পারেন না। আর এর বাইরে আছে অগুনতি নারী ও পুরুষ পাঠক যাঁরা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাবে মুখার্জিসাহেবের এই ক্রূর, ধূর্ত , সুলিখিত মিসোজনির সমালোচনা করেছেন। কিন্তু নেগেটিভ পাবলিসিটির ধার বরাবরই পজিটিভ পাবলিসিটির ধার থেকে বেশি। তাই তাতে মুখার্জিসাহেবের সাপে বর-ই হয়েছে। আমি তো শুধু মিসোজনির কথা বললাম, এই লোকের লেখায় জাতবিভেদও ফুটে বেরোয়! ইদানিংকালে তার পরিচিতি হয়ে উঠেছে গোয়েন্দা ঔপন্যাসিক হিসেবে, প্রোমো টোমো তে সাক্ষাতকারও দিতে দেখা যায়, তখন যদি কখনোবা তার ওই মিসোজনি আর জাতভেদে বিজবিজ করা উপন্যাসগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা যায়, সে সুকৌশলে উত্তর দিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়, সেও বোধ হয় বোঝে, এখন এরকম রগরগে জাতভেদ আর মিসোজনি অচল, একটু "সাজ" পরিয়ে, কৌশলে পাঠকের মন বিষাতে হয়।

থ্রেডে আরেকটা আলোচনা দেখলাম, অনেকে বলতে চান, লেখকের সৃষ্ট চরিত্রগুলো কি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে? চরিত্র হয়তো করে না, কিন্তু চরিত্রের পরিণতি, পুরো সাহিত্যকর্মের অন্তর্নিহিত বক্তব্য - এগুলো অবশ্যই করে। তিলোত্তমা মজুমদারও অনেক মিসোজনিস্ট, ভয়ঙ্কর জাতপাত মানা পুরুষচরিত্র, লোভী, বিকৃতমানস নারীচরিত্রের সংযোজন করেন তার অনেক উপন্যাসে, বিশেষ করে রাজপাট-এ। কিন্তু সেখানে এই চরিত্রগুলোর পরিণতি বা ন্যারেশনে ওই গদগদ প্রশস্ত্বি ছিলো না যেটা মুখার্জিসাহেব করে থাকেন। কথাটা এখানেই। মুখার্জি বলতে চায় এই চরিত্রগুলোই ভালো, এরাই আমার নমস্য, মজুমদার পাঠককে বুঝে নিতে বলছেন "ভেবে দেখুন, কে ভালো কে মন্দ"। সাহিত্যিক, বিশেষ করে প্রতিথযশা সাহিত্যিক কখনোই তার সাহিত্যকর্মের সামাজিক প্রভাবের দায়ভার এড়াতে পারেন না।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যখনই হোক, পোস্ট পড়া এবং বিস্তারিত মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ সবাক অতিথি।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণের সাথে একমত পোষণ করছি। তিলোত্তমা মজুমদারের লেখার ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না, কারণ আমি তাঁর লেখা বিশেষ কিছু পড়িনি। পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় তাঁর যেসব লেখা পড়েছি সেসবের কিছু মনে নেই।

লেখক ও তাঁর লেখা অথবা সৃষ্ট চরিত্র সম্পর্কে আমার একটি সতর্ক অবস্থান আছে। একটি বড় গল্প বা উপন্যাসে অনেক চরিত্রের যেমন সমাবেশ থাকে তেমন ছোট-বড় অনেক আখ্যানও থাকে। একটি চরিত্র সংশ্লিষ্ট আখ্যানের চাহিদা অনুযায়ী সঠিকভাবে নির্মিত হলে চরিত্রটি যেমনই হোক সেটির জন্য লেখকের সামাজিক দায় থাকে না। আবার আখ্যানটি বাস্তবানুগ হলে অথবা মানবতাবিরোধী না হলে সেখানেও লেখক দায়মুক্ত থাকেন। মানবতাবিরোধী আখ্যানের দায়ভার পুরোটা লেখকের ওপর বর্তায়, সেখানে বর্ণিত অসভ্য চরিত্রগুলোর দায়ও লেখকের। এই প্রকার আখ্যান আকাশ থেকে পড়ে না, এগুলো লেখকের সচেতন বা অবচেতন অবস্থান ও বিশ্বাসের প্রতিফলন। পার্টিজান সাহিত্য এর ভালো উদাহরণ। জাতভেদ, জাতিভেদ, বর্ণভেদ, গাত্রবর্ণভেদ, লিঙ্গভেদ, শ্রেণীভেদ ইত্যাদি অসভ্য বিষয়গুলোর এক বা একাধিকটি নিজের মধ্যে ধারণ করা লেখকের লেখায় ফুটে উঠতে বাধ্য। এর দায় সংশ্লিষ্ট লেখককে বহন করতে হবে।

যারা বলেন লেখা হয়ে গেলে লিখিত আখ্যান/বাক্য/শব্দ ইত্যাদি লেখকের সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় তাদের এই প্রকার দাবির পেছনে নৈরাজ্যবাদকে সমর্থনের এবং তৎসৃষ্ট অপরাধের দায় অস্বীকার করার স্পষ্ট মতলব আছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।