বহিরঙ্গ ||| ৪ |||

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: বুধ, ১৩/০১/২০১০ - ৪:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইন্টেলেকচুয়াল শব্দের বাংলা অনুবাদ ‘বুদ্ধিজীবি’। শব্দটিতে কিভাবে জীবিকা ঢুকে পড়েছে-সমর সেন তাঁর একটি প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন। উল্লেখ করা দরকার, আন্তেনিও গ্রামসি তাঁর ‘প্রিজন নোটবুকস্’ বইয়ে ইন্টেলেকচুয়ালের ধরণ এবং তাঁদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। জীবিকার সাথে কেন এখানে বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা জুড়ে যায়? …

‘ইন্টেলেকচুয়াল’ কথাটায় জীবিকার প্রসঙ্গ এসে পড়ে না। ‘বুদ্ধিজীবি’ সেই হিসেবে সঠিক অনুবাদ নয়। হয়ত বা আমাদের পুরনো ব্রাহ্মণ ঐতিহ্যের রেশ এই ভাষান্তরে এসেছে, ব্রাহ্মণরা ছিলেন বুদ্ধি ও সংস্কৃতির রক্ষক এবং বুদ্ধি ভাঙিয়ে তাঁদের জীবিকা চলতো। বহুদিন পরে ইংরেজদের প্রয়োজনে যে শ্রেণী আবার সংস্কৃতির ধারক হলেন তাঁরা শিক্ষাকে জীবিকার কাজে লাগাতেন। সাহেবরা গ্রামের খালে বজরা বা নৌকা ভিড়োলে মাঝে মাঝে অনেক যুবক ইংরেজি স্কুল স্থাপনের জন্য ব্যাকুল অনুরোধ করতেন। অনেক যেটাকে মুৎসুদ্দি সংস্কৃতি বলেন সেই সংস্কৃতিতে বুদ্ধি ও জীবিকার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তাই সম্ভবত বুদ্ধিজীবি কথাটার এত প্রচলন।

আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবিদের মানসিক দ্বন্ধের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হ’ল কাজের সঙ্গে বিরোধ। অর্থাৎ যে কাজ, চাকরি করি তার সঙ্গে আমাদের মূল্যবোধ খাপ খায়না। ফলে বিবেকদংশন দেখা দেয়। অনেকে নানা জোড়াতালি দিয়ে শেষ পর্যন্ত অবস্থাটা সইয়ে নেন, অল্প-সংখ্যক ব্যক্তি সেটা পারেন না, তাঁরা না ঘরের, না বাইরের।

আমাদের বুদ্ধিজীবিরা বরাবর বহির্বিশ্বের বিষয়ে অতীব ওয়াকিবহাল। কাকদ্বীপ, তেলেঙ্গানা ইত্যাদি তাঁদের বিশেষ স্পর্শ করে না, তাঁদের রচনায় বিশেষ স্থান পায়না। চীনের সাথে বিরোধের সময় কিন্তু তাঁরা অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে পড়লেন। প্রায় সব শেয়ালের এক রব।

সমর সেনের বর্ণনায় বুদ্ধিজীবিদের সুবিধাবাদী চরিত্রের মুখোশ খুলে যায়। বুদ্ধিজীবিরা কেন সহজ কথা সহজ করে না বলে নানা প্যাঁচের আশ্রয় নেন তার মূল কারণ তাঁদের আসল চেহারা লুকিয়ে রাখা। প্রবন্ধটির নাম ‘চন্দ্রবিন্দু’। কারণ বুদ্ধিজীবিদের এটা খুব দরকার। মেহনতি জনতার এর দরকার পড়ে না। অন্য এক প্রবন্ধে সমর সেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। …

এখানে বঙ্কিমচন্দ্রের কথাটা বিশেষভাবে ওঠা উচিত, কেননা তাঁর ‘আনন্দমঠ’ তথাকথিত জাতীয় আন্দোলনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে এবং ‘আনন্দমঠ’-এ আছে বন্দে মাতরম্, অবশ্য দেশমাতাকে। সামাজিক উপন্যাসে, অর্থাৎ তাঁর প্রথম দিকের রচনায়, বঙ্কিমচন্দ্রের ক্ষমতা অসাধারণ। কিন্তু ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর অবনতি শুরু হয় ‘আনন্দমঠ’ থেকে, কেননা তিনি তখন ইংরেজ-ঘেঁষা রাজনীতির রূপ দিতে শুরু করেন সাহিত্যে। সে রাজনীতির বৈশিষ্ট্য ছিল মুসলমান বিদ্বেষ (যবন বধের পর ‘বন্দে মাতরম্’ গাওয়া হয়), ইংরেজদের সঙ্গে আপোশ এবং হিন্দুধর্ম সংস্কার করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা।

মহাপুরুষ সত্যানন্দকে বললে, … হে বুদ্ধিমন্- ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে নিরস্ত্র হইয়া আমার অনুসরণ কর … ব্রত সফল হইয়াছে- মা’র মঙ্গলসাধন করিয়াছ- ইংরেজরাজ্য স্থাপিত করিয়াছ।’ …
সত্যানন্দের চক্ষু হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইল। তিনি বলিলেন – ‘শত্রুশোণিতে সিক্ত করিয়া মাতাকে শস্যশালিনী করিব।’
মহাপুরুষ।‘শত্রু কে? শত্রু আর নাই। ইংরেজ মিত্ররাজ্য। আর ইংরেজের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়, এমন শক্তি কাহার ও নাই।’

রমেশচন্দ্র দত্ত এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা-র ‘বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেনঃ … But though the Ananda Math is an form an apology for the loyal acceptance of British rule, it is none the less inspired by the ideal of restoration, sooner or later, of a Hindu Kingdom in India. This is especially evident in the occasional verses in the book, of which the Bande Mataram is the most famous.

হিস্টিংস লাট হলেন ১৭৭২-এ। ‘মনে রাখিতে হইবে যে, ‘দেবী চৌধুরাণী’র জন্য কাল ও স্থান, এই দুইটিই বিদ্রোহের সম্পূর্ণ উপযোগী করিয়া বাছিয়া লওয়া হইয়াছে। কাল, তখন মুঘল সাম্রাজ্যের দেশব্যাপী শান্তি ও শৃঙ্খলিত শাসনপদ্ধতি অস্ত গিয়াছে, অথচ নবীন ব্রিটিশ শাসন দেশে স্থাপিত হয় নাই- এই দুই মহাযুগের সন্ধিস্থল; রাজনৈতিক গোধূলি অরাজকতার বিশেষ সহায়ক।’- যদুনাথ সরকার

অরাজকতার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানী নামলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রফুল্লের মুখে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র কী বাণী শোনালেন? ‘আনন্দমঠ’-র মুসলমান বধ, ইংরেজ রাজ প্রতিষ্ঠা আমাদের, হিন্দুধর্মের, ঐতিহাসিক কর্তব্য। কিন্তু ইংরেজদের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ? এটা ঐশ্বরিক ব্যাপার হিন্দু মানুষের কাজ নয়। ‘ঠেঙ্গা লাঠির দ্বারা পরোপকার হয় না। দুষ্টের দমন রাজা না করেন, “ ঈশ্বর করিবেন- তুমি আমি কে?” শিষ্টের পালনের ভার লইও- কিন্তু দুষ্টের দমনের ভার ঈশ্বরের উপরে রাখিও।’

‘আনন্দমঠ’-এ যে বিষবৃক্ষের বীজ, রামরাজ্যবাদী গান্ধীজীর সমধর্মী আন্দোলনের মাধ্যমে তার পরিচয় ঘটে দেশবিভাগে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম দিকের নারী চরিত্রে সামাজিক বিদ্রোহের আভাস আছে। কিন্তু ‘আনন্দমঠ’-এর পর তাঁর রাজনৈতিক ঐতিহাসিক কাহিনীগুলিতে যে-সব বীরাঙ্গনার আবির্ভাব ঘটে তাদের অনেকে অবাস্তব। তাদের ক্রিয়াকলাপ মাঝে মাঝে পুরুষোচিত, অতীব বীরত্বব্যঞ্জক। শক্তির ধারিকা এই নায়িকারা হিন্দি সিনেমার কথা মনে করিয়ে দেয়। যে বিভ্রান্ত রাজনীতি বন্দে মাতরম্ গানের পিছনে, যে মনোভাবের ফলে মাতৃমূর্তির এত প্রচলন, সে রাজনীতি ও মনোভাব এখনো আমাদের মধ্যে বর্তমান বলে আজকাল রাস্তাঘাট বন্দে মাতরম্ ধ্বনিতে যখন-তখন মুখরিত হয়, কিন্তু এই মাতা অবাস্তব। একদিকে ছিল বহুবিবাহ, সতীদাহ, অন্যদিকে মা নিয়ে আবেগ। আর একটি আশ্চর্য ব্যাপার, বঙ্কিমচন্দ্রের বিরূপ সমালোচনা নকশালপন্থীরা পর্যন্ত করেন নি।

বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে আলোচ্য প্রবন্ধের নাম ‘বন্দে মাতরম্’। ‘ট্র্যাম থেকে থানায়’, ‘প্রস্তুতি পর্ব’, ‘নির্বাচন মার্চ, ১৯৭৭’, ‘জরুরী অবস্থায় বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা’, ‘শত্রুমিত্র’, ‘ইন্দিরা চরিত’- এই প্রবন্ধগুলো নিয়ে আলোচনা করলে এই কিস্তি দৈর্ঘ্যে অনেক বেড়ে যাবে।তাই সেদিকে গেলাম না। সমর সেনের সিনেমা দেখা নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। বার বছর বয়েস হতে চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহ। নির্বাক যুগের অনেক সিনেমা তিনি দেখেছেন। সবাক যুগের সিনেমা দেখা শুরু করেন ‘বাইসাইকেল থিভস্’, ‘ওপেন সিটি’, ‘মিরাকল অব মিলান’ দিয়ে। সত্যজিৎ রায় আর ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে ঋত্বিকের দিকে সমর সেনের ঝোঁক বেশি ছিল।ঋত্বিক ঘটকের কাজে মার্কসবাদী চিন্তা কতটা ছিল সেই বিষয়ে সমর সেন নিঃসন্দেহ ছিলেন না।…

সত্যজিৎ রায় পথিকৃৎ নিশ্চয়ই। কিন্তু ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’ অনেক বছর পরে দেখে মনে হল যে ১৯৫২-তে তোলা ছবিটি আগে মুক্তিলাভ করলে পথিকৃৎ তাঁকেই বলা হতো। অবশ্য ঋত্বিক ঘটক স্টেজ থেকে সিনেমায় যাওয়াতে প্রথম ও অন্যান্য দু-একটি ছবিতে অতি-নাটকীয়তা আছে। ‘নাগরিক’-এর নানা চরিত্র ও সামাজিক বক্তব্য ঋত্বিকের পরের কয়েকটি ছবিতে নানাভাবে এসেছে- ‘অযান্ত্রিক’ ও ‘তিতাস’ বাদে। ঋত্বিকের ভঙ্গি প্রখর, সরব, এদিক থেকে ‘অযান্ত্রিক’ ও ‘তিতাস’ ব্যতিক্রম। বিরাট পটভূমিকায় তোলা ‘তিতাস’-এর মতো ছবি আমাদের দেশে বিরল। ঋত্বিকের শারীরিক ও মানসিক অবস্থা যে অবস্থায় পৌঁছিয়েছিল তখন ‘তিতাস’ ও অন্তত কয়েকটি অংশে ‘যুক্তি তক্‌কো ও গপ্‌পো’র মতো ছবি তিনি কীভাবে তুলতে পেরেছিলেন সেটা বিস্ময়কর। সিনেমা তো গল্প কবিতা বা সম্পাদকীয় লেখার ব্যাপার নয়। নিদারুণ শারীরিক বিপর্যয়ের মধ্যেও Flowers of Evil লেখা যায়, কিন্তু সিনেমা একটি জটিল ও যৌথ ব্যাপার যেখানে সংগঠনের শক্তি থাকা চাই; মাত্র একান্ন বছর বয়সে জীবনের অত্যন্ত যন্ত্রণাকর প্রান্তে এসে ও-ধরণের ছবি যিনি তুলতে পারেন তাঁর অসাধারণ প্রতিভা ও প্রাণশক্তি অনস্বীকার্য।

‘বাবু বৃত্তান্ত’ বইয়ে সমর সেনের আত্মকথা ও প্রবন্ধের পরে আছে উড়ো খৈ নামের প্রায়-প্রবন্ধ, পরিশিষ্ট এবং সর্বশেষে সংযোজন। সমর সেন পারেন অল্পে কথা সাড়া আর সেখানে স্যাটায়ার ঢুকিয়ে দেয়া। অনেক জায়গায় ঘটনার গভীরে ঢুকতে চান না। কিছু তথ্য দিয়ে দেন কথা বলার ফাঁকে। বুদ্ধিমান পাঠক বুঝে নিবেন, আর না নিলেই বা কী। …

পশ্চিমবঙ্গের নানা সমস্যার আলোচনা করা এই প্রবন্ধ-লেখকের ক্ষমতার বাইরে। কেননা কোন জিনিসের ‘গভীরে’ ঢোকা আমার স্বভাবে নেই। বেশ কিছুদিন ধরে বাঙালিরা ফিচ্‌লে, আড্ডাবাজ ও উন্নাসিক।

উড়ো খৈ নামের প্রায়-প্রবন্ধগুলোর লেখার সময়কাল ১৯৭৭ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর। জনতা পার্টির মোরারজি দেশাই তখন প্রধানমন্ত্রী। সেই বছরের ২৪ মার্চ মাত্র ক্ষমতা ছেড়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। পশ্চিমবঙ্গে তখন নানা সমস্যা। এর মধ্যেই জনতা পার্টির হরেক খুঁত জনতার সামনে ধরা পড়ছিল। কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছিল। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যা প্রকট আকার নিয়েছে।…

বিপদের কথা উঠত না যদি কংগ্রেস বা জনতার বিকল্প কোন বামপন্থী পার্টি মাথা তুলে দাঁড়াত। অন্যথা বিভিন্ন জায়গায় খণ্ডযুদ্ধের সম্ভাবনা আছে। ইতিমধ্যে দু-একটা জায়গায় নাকি চলছে। এটা অন্য পথ। সাংবিধানিক পথ নয়। তবু হয়ত শেষ পর্যন্ত জনগণ এই পথের দিকেই ঝুঁকবে। পশ্চিমবঙ্গ ব্যতিক্রম নয়।

পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা, কাগজে পড়েছি ৪০ লক্ষ। এখান থেকে কতজন পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছেন? এখানকার উদ্বাস্তুরা সবাই কলকাতায় বা আশেপাশে নেই, অনেককে বাইরে পাঠানো হয়েছে, যেমন দণ্ডকারণ্যে। অবশ্য অনুর্বর জমিতে, কঠিন পরিবেশে যেখানে ডাল ভাত ইলিশ মাছ খাওয়া নদীনির্ভর প্রাণীদের জীবনযাত্রা দুরূহ। উদ্বাস্তুদের আগমন পশ্চিমবঙ্গের ওপর চাপসৃষ্টি করে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৯৭১ সালে, ইন্দিরা গান্ধীর মতে, এক কোটি শরণার্থী এখানে হু হু করে এসেছিলেন। বিয়ের দিনে, জামাইষষ্ঠীতে যেখানে বাজারদর হু হু করে চড়ে সেখানে এক কোটি বাড়তি লোক সত্ত্বেও জিনিসপত্রের দাম তেমন বাড়েনি। এটা ভাববার বিষয়।

সমর সেন স্তালিনের ভক্ত ছিলেন। মাও সে তুং-য়ের লেখা যত না পড়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি পড়েছেন স্তালিনের লেখা। রাশিয়ার সেই লৌহমানবের অজস্র খারাপ গুণ থাকার পর ও রাশিয়ার জন্য এই ধরণের লোকের প্রয়োজন ছিল বলে তিনি মনে করেন। মস্কোতে চাকরি নিয়ে যাবার পর রুশিদের কাছে সে কথা গোপন করেন নি।কিন্তু যে আশা নিয়ে রাশিয়াকে দেখেছিলেন বাস্তবে তার দেখা না পেয়ে কয়েক বছর পরে নিজের দেশে ফিরে এসেছিলেন। কম্যুনিজমের পতন, নকশালপন্থী আন্দোলনের লেজে গোবরে অবস্থা দেখে কলকাতায় আশার আলো দেখছিলেন না। আরো অনেক প্রসঙ্গে কথা লিখে গেছেন। গড়পড়তা বাঙালি ছেলেদের হাল নিয়ে ও বলেছেন। …

কৈশোরে ও যৌবনে নানা প্রত্যাশা ছিল। ব্যক্তিগত আশা-অভীপ্সার কথা তোলা বোধহয় নিরর্থক, কেননা সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের ভাবনা-চিন্তায় বিশেষ ফারাক থাকে না। পরীক্ষা পাশ করা, ভালো চাকরি পাওয়া, সুন্দরী স্ত্রী (ফরসা রঙ মানে আমাদের দেশে সুন্দরী) , ছেলেপিলে বেশি নয়, কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব (অন্দরে তাদের ঘন ঘন আনাগোনা অবশ্য উচিত নয়), বার্ধক্যে পেনশন, অল্পদিন ভুগে মহাপ্রস্থান ইত্যাদি। এ-সব আশা-অভীপ্সা, অনেকের জীবনে বাস্তবে পরিণত হয় না, শেষেরটা বাদে। বাস্তব বড়ো হিসেবী, নির্মম। বাস্তবকে বদলানো মানে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো বদলানো। ভাবতে ভালো লাগে কিন্তু অনেকের সাধ্যে কুলোয় না।

শারীরিক কারণে যৌবন বড়ো যন্ত্রণার কাল। তখন ফ্রয়েডকে ঋষি মনে হয়, কিন্তু বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের চাপে সে-যন্ত্রণা কেটে যায়, সঙ্গম অভ্যাসে পরিণত হয়।১০

উড়ো খৈ তিন নম্বর লেখা হয়েছে বাঙালি খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। বেশ মজাদার লেখা। পশ্চিমবঙ্গের ভঙ্গুর অর্থনীতির প্যাঁচে পড়ে ভোজনরসিক বাঙালির কি হাল হয়েছে তার কিছুটা বর্ণনা করেছেন। এই জাতির রসনা বিলাস নিয়ে অনেক লেখাই আছে। ‘মহাভোজ রাজভোজ’ নামে একটা বই পড়েছিলাম। লেখক বোধকরি প্রতাপ রায়। শংকরের লেখা আমার কেন জানি পানসে মনে হয়। তাঁর ও একটা বই আছে। ‘বাঙালির খাওয়াদাওয়া’। মজলিশী লেখকদের আমার ভাল লাগে। সমর সেনের এই লেখায় কিছুটা হামদি বে’র আমেজ পাওয়া যায়। হামদি বে লিখতেন কলকাতার ‘আজকাল’ পত্রিকায়। সেই সময় সম্পাদক ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। লেখাগুলোর সংকলন ‘বে অফ বেঙ্গল’ আমার পড়া সেরা কয়টা বইয়ের মধ্যে একটা। যেকোন বিষয়ের ওপর দারুণ কলাম খাড়া করে দিতে পারতেন হামদি বে।

সমর সেনের যৌবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জলো মনে হত। কাজী নজরুল ইসলাম তখন ছিলেন বিপ্লবের নায়ক। কল্লোলের লেখকদের কাজ কারবার চিত্তচাঞ্চল্যের জন্য যথেষ্ট ছিল। তাঁদের নিয়ে মুখরোচক গল্পের দিশা ও দিয়েছেন অল্পে। …

একজন ফুলশয্যায় রাত্রে পকেট থেকে দশ টাকার নোট বের করে নববধূকে দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ও, তোমাকে তো দিতে হবে না’। দশ টাকা তখন অনেক টাকা, এংলো-ইণ্ডিয়ান বেপাড়ার রেট।১১

সেই সময়ের সাহিত্যের আড্ডায় তাঁর নিয়মিত হাজিরা ছিল। সুধীন দত্তের বাড়িতে ‘পরিচয়’-এর আড্ডা। বুদ্ধদেববাবুর ‘কবিতা’ আড্ডা। বিষ্ণুবাবুর বাড়িতে আড্ডা। আড্ডায় থাকতেন অনেকে। সুরেন গোস্বামী, নীরেন রায়, হীরেন স্যানাল, হীরেন মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, অপূর্ব চন্দ, শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষ, গিরিজা ভট্টাচার্য, আবু সায়ীদ আইয়ুব, সুশোভন সরকার, হারীতকৃষ্ণ দেব, ধূর্জটিপ্রসাদ। বিষ্ণু দে কম কথা বলতেন, টিপ্পনী কাটতেন কেবল। জিহ্বা খুব প্রখর ছিল। …

বিষ্ণুবাবুর পাশের বাড়িতে থাকতাম বলে দু-একটা ঘটনা ঘটতো। আমার দ্বিতীয় কবিতার বই ওঁকে দিলাম। কিছু দূরে বসা ওঁর স্ত্রী দেখতে চাওয়াতে বিষ্ণুবাবু বইটা পায়ের দুটো আঙুলের মধ্যে গুঁজে ওঁকে এগিয়ে দিলেন। ওঁর স্ত্রী বিস্মিত হয়ে প্রতিবাদ করাতে বিষ্ণুবাবু বললেন, পা দুটো নানাভাবে ব্যবহার করতে পারি বলেই আমরা বাঁদর হয়ে থাকিনি। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, পা দিয়ে কবিতা লেখার চেষ্টা করলে কেমন হতো? একবার অবশ্য বিষ্ণুবাবু অল্প বিচলিত হয়েছিলেন। বিয়ে করে প্রথমে ওঁর বাড়িতে গেলে আমার স্ত্রীকে বলেছিলেন, কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করার পেছনে আমার উদ্দেশ্যটা কী? আমার স্ত্রী বলে উঠলেন ‘ ও, আপনি সেই বিষ্ণুবাবু যিনি ‘ঝড়জলে ছাতা মাথায় দিয়ে অন্যদের নিন্দা করতে বেরিয়ে পড়তেন!’ বিষ্ণুবাবু আমার দিকে তাকালেন, আমি অন্যদিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম।

বিষ্ণুবাবুকে কখনো কোট প্যাণ্ট, বুশ শার্ট পরতে দেখিনি। অনেকবার নিমন্ত্রিত হয়েও কখনো বিদেশ যাননি। সবই ভালো, সি.পি.আই. প্রেমটা বাদে।১২

১৯৪৪-এর জুন মাসে মিত্রশক্তিরা পশ্চিম ইউরোপে দ্বিতীয় ফ্রণ্ট খোলাতে বিবেক হালকা হয়ে গেল, সরকারি চাকরি নিয়ে রেডিও’র সংবাদ বিভাগে ঢুকলাম। সংবাদের চাপে, দেশের দাঙ্গাহাঙ্গামায় আস্তে আস্তে কবিতা লেখা বন্ধ হয়ে এলো- ছক মেলানো কঠিন হয়ে পড়ছিল।১৩

সমর সেন ১৯৪৬ সালের পর আর কোন কবিতা লিখেননি। তার ও তিরিশ বছর পর লেখা কলামে কবিতা লেখার অসুখ আবার ধরবে কিনা আশংকা করেছেন।

সম্প্রতি পুরনো কবিতার কিছু কিছু পংক্তি মনে পড়ে বলে দুশ্চিন্তায় আছি। এ-বয়সে কবিতার ব্যামো আবার ধরবে না তো? একটা পংক্তি- সুধীন দত্তের- ‘অতিকায় কৃকলাস অস্থিসার রুদ্র পরিপাকে।’ অতিকায় ও অস্থিসার কথা দুটো আমাদের দেশ সম্বন্ধে খাটে, কিন্তু রুদ্র পরিপাক? কীসের পরিপাক- হুজুগ ছাড়া? তার চেয়ে অনেক সহজবোধ্য- ‘ফাটা ডিমে তা দিয়ে কী ফল পাবে?’ সুধীন দত্ত তখনকার দিনে নিজের শ্রেণীর প্রাচুর্যে ভুলে গিয়েছিলেন যে ফাটা ডিম দিয়ে অন্তত ‘মামলেট’ করা যায়, যেটা ক্ষুদ্র পরিপাকের পক্ষে মন্দ নয়। এখন ফাটা ডিমের দাম বেশ চড়া। ‘পরিচয়’-এর শুরুতে শহরে তিন পয়সায় জোড়া ডিম পাওয়া যেতো, আড়াই টাকায় মণ চাল।১৪

ফিল্ড মার্শাল শ্যাম হোরামশিজি প্রেমজি "শ্যাম বাহাদুর" জামসেদজি ম্যানেকশ ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর প্রধান ছিলেন। উড়ো খৈ-এর একটি অংশে সমর সেন ম্যানেকশকে নিয়ে অল্প লিখেছেন।

১৯৭১ সাল বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন লোকের মনে থাকবে অনেকদিন। ফিল্ড মার্শাল ম্যানেকশ সেদিন বম্বের রোটারি ক্লাবে বলেছেন (টাইমস্ অব ইণ্ডিয়া, বম্বে, ১৯ নভেম্বর, ১৯৭৭) যে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ (ডিসেম্বর ১৯৭১) শুরু হবার মাস কয়েক আগে (অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের বিক্ষোভ ও দমন শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে) কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা তাঁকে তলব করে বলে যে ইয়াহিয়া খাঁর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘একশন’ নিতে হবে। ম্যানেকশ বলেন, একশনের অর্থ হ’ল যুদ্ধ। ‘Go to war then’, মন্ত্রীসভার মন্তব্য। ম্যানেকশ রাজী হননি, কেননা তখন যুদ্ধ লাগলে ভারতের পরাজয় নিশ্চিত, সৈন্য সমাবেশের জন্য অন্তত মাসখানেক লাগবে, তারপর বর্ষা শুরু হলে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করার প্রশ্ন ওঠে না। প্রস্তুতির জন্য বেশ কিছু সময় ও সর্ব প্রকারের সাহায্য চান ম্যানেকশ । তখনো ইন্দিরা গান্ধী এদেশের সম্রাজ্ঞী হননি, এই যা রক্ষে। ম্যানেকশর স্মৃতিশক্তি প্রখর। কিন্তু তাঁর কথার মানে এই দাঁড়ায় যে অগণন শরণার্থীর ভিড়ে রুদ্ধশ্বাস ভারতকে রক্ষা করার জন্য আমরা যুদ্ধে নামিনি।১৫

মস্কোর জীবন নিয়ে পরিশিষ্টে একটা অধ্যায় আছে। সেখানে বিদেশি সাহিত্য প্রকাশালয়ের বাংলা বিভাগে নটা থেকে ছটা চাকুরি করতেন। প্রবন্ধে রুশিয় শিক্ষাব্যবস্থার কথা উল্লেখ আছে। সমর সেন খেয়াল করেছেন একটা দেশের উৎকর্ষ সব দিক থেকে একসাথে ঘটে না। প্রগতির একটা দিকে বেশি গেলে এগিয়ে অন্য দিকগুলো ঠিক করে ততটা এগোয় না। সমর সেনের সময়কার রাশিয়ায় চিকিৎসা বা ওষুধ দেয়া হত বিনামূল্যে। আবাসনের কিছুটা ঘাটতি ছিল। সোভিয়েত জনগণের পৃথিবীর সব দেশের মানুষের প্রতি সমান সহানুভূতি। এমনকি জার্মান লোকজনকে তারা ঘৃণার চোখে দেখত না। এই বিরল গুণটা তারা আয়ত্ত করেছে ছোটবেলা থেকে।

কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দুটি কবিতা সংকলন ‘ক্রন্দসী’ এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’-এর সমর সেনের আলোচনা বইটিতে আছে। সুধীন বাবুর কবিতার শিরদাঁড়া মজবুত বলে রায় দিয়েছেন তিনি। ‘ক্রন্দসী’ নিয়ে লেখায় তিনি সুধীন বাবুর মুন্সীয়ানার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। ‘উত্তর ফাল্গুনী’ নিয়ে লেখা সমালোচনায় কিছুটা ভিন্ন মেজাজ দেখা যায়। …

সুধীন্দ্রনাথের বিশ্বাস সম্প্রতি অবসেশনে পরিণত, এবং বিশ্বাস যখন আবেগে পরিণত হয় তখন তার কাব্যশক্তি কমে আসে, শেষ পর্যন্ত লেখক একটি বিষন্ন গোলক ধাঁধায় প্রবেশ করেন, যেখানে মহৎ সত্যের সাক্ষাৎ মেলে না, যেখানে দেখি শুধু নিঃস্ব রোমাণ্টিক কাল আপনাকে পরিপাক করতে ব্যস্ত।১৬

‘বাবু বৃত্তান্ত’ বহির আরো একটা ভাল সংযোজন অতি আধুনিক বাংলা কবিতা নিয়ে সমর সেন আর সরোজকুমার দত্তের মধ্যকার বিতর্ক। ‘In Defence of the Decadents’ নামের ইংরাজি প্রবন্ধ সমর সেন ছাপান ১৯৩৮ সালে। এর প্রতিক্রিয়ায় সরোজকুমার দত্ত ‘অতি আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামে লেখা ছাপান। ১৯৪১ সালে। এর উত্তর করেন সমর সেন। পরে আবার প্রত্যুত্তর করেন সরোজ দত্ত। উপভোগ্য তর্ক। সরোজ দত্ত কবি সমর সেনের কবিতার ব্যবচ্ছেদ ও করতে চেয়েছেন।…

শ্রীযুত সেনের কবিতা সাধারণের বোধগম্য নহে- কেবলমাত্র ‘chosen few’-এর উপভোগ্য। আমি যথেচ্ছ দুটি স্থান উদ্ধার করিতেছিঃ

আকাশচরের শব্দ আকাশ ভরায়।
নীবিবন্ধে কূটগ্রন্থি,
শিবিরে আর নিবিড় মায়া নেই
তুষার পাহাড়ের শান্তি যদিচ শিশিরে ঝরে।

কিম্বা,

পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া
অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মতো,
ততদিন গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে
বণিকের মানদণ্ডের পিঙ্গল প্রহার।

এ-কবিতা ‘Intellectual clique’ –এর জন্য লেখা, আমার আপনার জন্য নহে। পাঠক সম্প্রদায়ের প্রতি এই সানুনাসিক অবহেলা, আপনার কাব্যকে সর্বসাধারণের উপভোগ হইতে বাঁচাইয়া দুর্বোধ্য করিবার এই গলদঘর্ম প্রয়াস, ইহা আর যাহাই হোক, বিপ্লবী মনোভাবের পরিচায়ক নহে।১৭

সমর সেন একজন পাঠক হিসেবে অনেক বছর পরে এই বিতর্ক পুনরায় পড়ে নিজের মতামত তুলে ধরেন। ১৯৭৭ সালে। সরোজ দত্ত ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে কলকাতা শহর থেকে নিখোঁজ হন।…

বহুদিন পরে লেখাটি পড়ে মনে হল সরোজ দত্ত ঠিক লিখেছিলেন, তিরিশের দশকে অনেক লেখক বোধহয় বিপ্লবীর অভিনয় করে বাহবার চেষ্টায় থাকতেন, তাঁদের আসল চেহারা সরোজ দত্ত চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।

কিন্তু পরের দু-তিনটি পৃষ্ঠায় আক্রান্ত প্রবন্ধকারের জবাব পড়ে মনে হল ব্যাপারটা অত সহজ নয়। প্রবন্ধকার বলেছেন যে নিজেকে তিনি কখনো ‘বিপ্লবী’ বলেননি। তার কবিতায় যে টাইপের জীবন এবং আত্মপরিক্রমার কথা আছে, সে টাইপ বিপ্লবী নয়, মুমূর্ষু শ্রেণীর প্রতীক। অবক্ষয় এদের আকর্ষণ করে, তার কারণ বোধ হয় এই যে উদীয়মান কোন শ্রেণীর প্রাণশক্তি এদের নেই, বরং পাতিবুর্জোয়ার গভীরে এদের শিকড় ইত্যাদি। অবক্ষয় বিষয়ে সচেতনতা এক ধরণের শক্তি, কিন্তু এমন একটা সময় আসছে যখন সেই শক্তিটুকু দিয়ে চলবে না, তখন মন স্থির করতে হবে। যে কবি তাঁর ব্যক্তিসত্তা অটুট রাখতে পেরেছেন গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দিলে তাঁর উপকার নিশ্চয় হবে। আর …He who is bent on living in a little cell, all will be dying with a little patience. প্রবন্ধকারের জবাবটা বালখিল্যসুলভ নয়, যদিও কোথাও একটা ফাঁকি রয়ে গিয়েছে। সরোজবাবুর প্রত্যুত্তরটা অনেকটা উকিলসুলভ। যেমন, কবিপ্রবন্ধকার যে পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সেই পত্রিকায় তাঁকে এবং অন্যদের মাঝে মাঝে বিপ্লবী বলা হয়েছে; প্রবন্ধকারের কবিতায় বিপ্লবী সুলভ উক্তি আছে অতএব বিপ্লবী শব্দটা আরোপ করা অযৌক্তিক হয়নি ইত্যাদি; সেই সময়কার মনোভাব বিষয়ে সরোজ দত্ত যা লিখেছিলেন তা উপভোগ্য- ‘এখনও তাঁহারা আলগোছে গণস্পর্শ বাঁচাইয়া, ‘dozen or so’ হাত ধরাধরি করিয়া কিছুকাল আত্মপরিক্রমায় অতিবাহিত করিবেন; তারপর গণ আন্দোলন আরম্ভ হইলে … তাহারা রাতারাতি স্বগতোক্তি পরিত্যাগ করিয়া গণ-কবি হইয়া বসিবেন।’ তবু নির্বোধ প্রবঞ্চক কথাগুলো অস্বস্তিকর ঠেকল, কেননা প্রবন্ধটি আমার লেখা ১৯৩৮ সালে; এম এ পাশ করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বৃত্তি পেয়ে তখন জীবনটা মন্দ কাটছিল না।১৮

সমর সেনের পুরানো বিতর্কের প্রতি এই ফিরে দেখা বেশ লক্ষণীয়। ‘বাবু বৃত্তান্ত’ পাঠ জরুরি সমর সেনের প্রাঞ্জল গদ্যের স্বাদ পাবার জন্যে। এত প্রিসাইজলি লেখা বাংলা, সাথে সাথে গভীর অন্তর্দৃষ্টি-সমর সেনের গদ্য না পড়লে বোঝা যাবে না। তাঁর লেখা থেকে এত উদ্ধৃতি তুলে দিলাম যাতে পাঠক কিছুটা হলেও সেই আন্দাজ পান। আর কবি সমর সেন। তিনি নমস্য।

বহি

বাবু বৃত্তান্ত – সমর সেন (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৮)

সূত্র

১। বাবু বৃত্তান্ত – সমর সেন (দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৮) [পৃষ্ঠা ৭৩]
২। [পৃষ্ঠা ৭৩] ৩। [পৃষ্ঠা ৭৩-৭৪] ৪। [পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭ ]
৫। [পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮] ৬। [পৃষ্ঠা ৯২-৯৩] ৭। [পৃষ্ঠা ১০১]
৮। [পৃষ্ঠা ১০৪] ৯। [পৃষ্ঠা ১০২] ১০। [পৃষ্ঠা ১০৪-৫] ১১। [পৃষ্ঠা ১১২] ১২। [পৃষ্ঠা ১১৩-১১৪] ১৩। [পৃষ্ঠা ১০৪-৫] ১৪। [পৃষ্ঠা ১১৮] ১৫। [পৃষ্ঠা ১১৩-১১৪] ১৬। [পৃষ্ঠা ১৩৩] ১৭। [পৃষ্ঠা ১৫০-১৫১] ১৮। [পৃষ্ঠা ১১৯-১২০]

--------
বহিরঙ্গ ||| ৩ |||


মন্তব্য

ফরিদুর এর ছবি

কবি সমর সেনের সঙ্গে পরিচয় ছিল। আপনার লেখা পড়ে তীক্ষ্ণধী গদ্যকার সমর সেনের পরিচয় পেলাম। বইটা শীঘ্রই সংগ্রহ করে পড়ে ফেলতে হবে। ছফাগিরির সাথে সাথে আপনার বহিরঙ্গ ও একাডেমিক ধাঁচের। লিখতে থাকুন, বস্‌।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ধন্যবাদ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১.
'ট্র্যাম থেকে থানায়’, ‘প্রস্তুতি পর্ব’, ‘নির্বাচন মার্চ, ১৯৭৭’, ‘জরুরী অবস্থায় বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা’, ‘শত্রুমিত্র’, ‘ইন্দিরা চরিত’- এই প্রবন্ধগুলো নিয়ে আলোচনা করলে এই কিস্তি দৈর্ঘ্যে অনেক বেড়ে যাবে।তাই সেদিকে গেলাম না।

সেদিকে যেতে কে না করেছে? লেখা যদি তাতে আরো দুই পর্ব বাড়ে তাতেই বা ক্ষতি কি? যে বিষয়টার আলোচনা দানা বাঁধছিল তাকে সিনেমার দিকে ঠেলে দেয়াটা কি ঠিক হল?

২.
সরোজ দত্ত ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে কলকাতা শহর থেকে নিখোঁজ হন।

সরোজ বাবু নিখোঁজ হননি। কংগ্রেস সরকারের পুলিশ তাঁকে "এনকাউন্টার" বা "ক্রসফায়ার" নামক পদ্ধতিতে খুন করেছে। সাক্ষী স্বয়ং উত্তম কুমার, যদিও জীবদ্দশায় তিনি তা সর্বসমক্ষে স্বীকার করে যেতে পারেন নি।

৩.
ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গগুলোকে আলাদা আলাদা শিরোনাম/উপশিরোনামে বা অন্ততঃ আলাদা নম্বরক্রমে ভাগ করে দিলে পাঠকে সুবিধা হয়। উদ্ধৃতি কোথাও ইটালিক আবার কোথাও সোজা হওয়ায় পাঠকের বিভ্রান্তি ঘটার সুযোগ থেকে গেল।

৪.
ক্যাটেগরীতে আছে "চিন্তাভাবনা" আর লেখার মধ্যে লেখকের চিন্তাভাবনা এসেছে সবচেয়ে কম। এরচেয়ে প্রত্যেকটা প্রসঙ্গ ধরে ধরে সেব্যাপারে লেখকের চিন্তাভাবনা আসাটা জরুরী ছিল। তাতে পাঠকের পক্ষেও আলোচনার সুবিধা হত। এখন হল কী? গোটা লেখা পড়তে পড়তে আগের প্রসঙ্গগুলো পাঠকের আর মনে থাকেনা - সমর সেনের কারিশ্‌মার মুগ্ধতা তাকে গ্রাস করে।

৫.
চলচিত্রের আলোচনা প্রসঙ্গে বলি, কী হলে কী হত তা ভাবা অর্থহীন। যা হয়েছে তা নিয়ে আমাদের আলোচনা কি নিরপেক্ষ? এখানেও কি মুগ্ধতা আমাদের বিচার বুদ্ধিকে গ্রাস করে না?

৬.
কবি সমর সেনকে নিয়ে একটা বাক্য লিখে শেষ করে দেয়াটা কি ঠিক হল? না হয় এই আলোচনা "বাবু বৃত্তান্ত" নিয়েই হল, সামনে তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা হবে অমন ইঙ্গিত থাকলে পাঠক স্বস্তি পেত।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

১.
এই কিস্তিতে শেষ করব ভেবেছিলাম। তাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ আলোচনা করতে পারি নি।

২.
তথ্যটা কোথাও পড়েছিলাম। নিশ্চিত ছিলাম না।

৩.
ইটালিকসে লেখা সব কথা 'বাবু বৃত্তান্ত' থেকে নেয়া।

৪.
সহমত। পরের পর্বের লেখার সময় মাথায় রাখব।

৫.
কিছুটা। তবে প্রবন্ধটা পড়লে কথাগুলো পরিষ্কার হত।

৬.
কবি সমর সেনকে চেনানোর জন্য অনেক কাব্যরসিক সচলে আছেন। উনারা লিখতে পারেন।

আলমগীর এর ছবি

শুভাষীশ দা
আপনার এ লেখায়, ছফাগিরি সব লেখায়, এমনকি ছায়াছবি নিয়ে লেখাগুলোতেও প্রচুর ম্যাটেরিয়াল। আপনি প্রচুর খাটেন কিন্তু বিষয়বস্তুকে যে ভাবে উপস্থাপন করেন তাতে কোন খেই থাকে না। আমার মতে অনেকটা র‌্যাম্বলিং/এলোপাথারি হয়ে যায়। যেমন:

প্রথম কোটে বুদ্ধিজীবি শব্দের সাথে জীবিকার সম্পর্ক আনলেন। এটা কে বললো, কী বললো তা না বলেই পরের কোটে আনলেন মানসিক দ্বন্দ্ব। বুদ্ধিজীবিদের মানসিক দ্বন্দ্ব থাকে সে কথাটাও তো আগে বলতে হবে নাকি? সেটারও কোন ব্যবস্থা না করে বুদ্ধিজীবিদের স্থানীয় ইস্যু বাদ দিয়ে বহির্বিশ্ব দৌড়িয়ে আনলেন।

এগুলো যে সমর সেনের কথা তা পরের প্যারা না পড়লে স্পষ্ট হয় না। সব কথা যদি সমর সেনের কথা তবে আন্তেনিওকে খামচালেন কেন?

প্রসঙ্গের অবতারণা, একটু ব্যাখ্যা না শুরু হতেই নতুন বিষয় নিয়ে আসেন। সেটাও কোন সূত্র ছাড়াই। কেউ কেউ কষ্ট করে পড়ে। আর, আমার মতো কেউ দু'প্যারা পড়ে আর ধৈর্য রাখতে পারে না।

বেশী কড়া সমালোচনা করে ফেল্লাম মনে হচ্ছে চোখ টিপি

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আলমগীর ভাই,

সমালোচনায় উত্তম জাঝা!

বহিরঙ্গ সিরিজের বইগুলোর প্রতিটা লাইন কোট করার মত। ফলে কি কোট করব সেটা নিয়ে গিয়ানজাম স্পষ্ট।

একটা কথা বলি। লেখাগুলো দ্বিতীয়বার পড়লে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।

যা ইটালিকসে আছে সব 'বাবু বৃত্তান্ত' থেকে নেয়া।

গ্রামসিকে নিয়ে খামচানোর কারণ আছে। গ্রামসি ও জীবিকা নিয়ে কথা পেড়েছেন। এডোয়ার্ড সায়ীদকে ও খামচানোর হাউস ছিল। পরে ভাবলাম থাক। চোখ টিপি

সূত্র আছে বস্‌। তবে সংক্ষেপে। কোন জায়গায় পূর্বের প্রসঙ্গ আর না আসা মানে সেখানে আমার কথাবার্তা শেষ।

আলমগীর এর ছবি

জাঝা দিয়ে কী করব!
আপনি ধরে নিয়েন না সবাই এসব পড়েছে। আমি ছফার লেখার খুব ভক্ত ছিলাম, তবু যে খুব বেশী পড়েছি তা না। বহিরঙ্গের মূল বহি যদি পড়া থাকে, তবে লেখকের নিজের বক্তব্য ছাড়া, শুধু শুধু উদ্ধৃতি পড়ব কেন?

একটু গুছিয়ে লিখলে পাঠকের ফায়দা হয়- এই আর কী।

সিরাত এর ছবি

আদ্ধেক পড়েই চার দিলাম। হাসি

একটু বাজে মন্তব্য হয়ে গেল যদিও, কিন্তু আপনার লেখা বড় বেশি কম্প্রিহেনসিভ হওয়ায় আর বেশি কিছু বলার ধৈর্য্য থাকে না।

সাবাশ!

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আদ্ধেক ও কি স্কিম কইরা পড়ছেন? দেঁতো হাসি

আবেদ এর ছবি

বাবুবৃত্তান্ত পড়েছি। আপনার আলোচনা ভাল্লাগছে। যারা বইটা পড়েন নাই, তাদের জন্য লেখাটা বোঝা একটু কঠিন মনে হতে পারে। অবশ্য একাডেমিক আলোচনা একবার পড়ে বোঝা কষ্টের। লিখতে থাকেন।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আবেদ ভাই,

আপনাকে কি আমি চিনি?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এক লেখায় অনেকগুলো বিষয় চলে এলো না?
খেই রাখা মুশকিল

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লীলেনদা,

একটু খেই ধরিয়ে দিই।

প্রবন্ধগুলো হলো ( রচনাকাল ১৯৭২-১৯৮০)-
১। চন্দ্রবিন্দু বাদে
২। বন্দে মাতরম্
৩। ট্র্যাম থেকে থানায়
৪। প্রস্তুতি-পর্ব
৫। নির্বাচন মার্চ, ১৯৭৭
৬। জরুরী অবস্থায় বুদ্ধিজীবিদের ভূমিকা
৭। শত্রুমিত্র
৮। দেখা ছবি
৯। ইন্দিরা চরিত

এর মধ্যে ১, ২, ৮ নাম্বার প্রবন্ধ নিয়ে কিছুটা কথা বলা হয়েছে। উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে - সেখানের বক্তব্য নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে বলেই।

উড়ো খৈ আছে সাতটি। প্রতিটা থেকে কিছু প্রধান কথাবার্তা উদ্ধৃতি আকারে এসেছে। বিষয় ম্যালা। সমর সেনের প্রবন্ধকার জীবনের ঘটনা কম নয়। উনি কি কি বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন তার কিছুটা ধারণা দিয়েছি।

পরিশিষ্টে আছে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের দুটি কবিতা বইয়ের উপর আলোচনা। আর সরোজ দত্ত-সমর সেন বিতর্ক।

বহিরঙ্গ সিরিজে একটা বই নিয়ে এক পর্বে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। ‘বাবু বৃত্তান্ত’ নিয়ে লিখতে গিয়ে দুই পর্বে হয়ে গেল। আমার নিজের আলোচনা বেশি এলে এই পর্ব রেল-লাইনের মত লম্বা হয়ে যেত( অলরেডি অনেক লম্বা হয়ে গেছে)। আমার অনেক ব্যাখ্যা তাই ছেঁটে ফেলেছি।

বিষয় বৈচিত্র্যে বইটা খুব উজ্জ্বল বলে নানান কথা এসে গেছে। খেই রাখা আসলেই মুশকিল। আমি ভেবেছিলাম অন্য কথা। সবাই এক টানে কবি সমর সেনের এমন প্রাঞ্জল গদ্য পড়ে যাবে। আমি উছিলা মাত্র।

অফটপিকঃ আপনার চল্লিশায় যামু না।বুইঝেন।

আসাদ [অতিথি] এর ছবি

১) লেখাটা বুদ্ধিজীবিদের জীবিকা এবং মানসিক দ্বন্দ্ব এসব নিয়ে শুরু হল, তারপর বঙ্কিম-আনন্দমঠ ওখানে এসে মন হয় অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল, এরপর আর পড়তে-বুঝতে পারিনি। শুরুর বিষয়ে সমর-সেন পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেই ভাল হত।

২) বইয়ের কোটেশনের চাইতে লেখকের বিশ্লেষণ আরো বেশি চাই।

৩) বুদ্ধিই যাদের একমাত্র সম্বল, তাদের জীবিকা আসলে কি হবে এইটা নিয়া দ্বন্দ্বে আছি।
রাজানুকূল্য, কিম্বা ভিক্ষার ঝুলি, অথবা বুদ্ধিকেই পণ্য বানিয়ে বেচা, এগুলা ছাড়া তো আর কোন পথ দেখলাম না? এব্যাপারে লেখক বা সমর সেনের বিশ্লেষণ কি?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।