কর্তন

শুভাশীষ দাশ এর ছবি
লিখেছেন শুভাশীষ দাশ (তারিখ: সোম, ০৫/০৭/২০১০ - ১:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চাকরি নিয়ে চলে আসার পর থেকে মাথার চুল বেঢপ লম্বা হতে থাকে। চুল লম্বা হয়ে কানের ওপর এসে পড়লে চুলকানি বাড়ে। এক সন্ধ্যায় বাসা থেকে বেরিয়ে একটা সেলুন খুঁজতে থাকি। কেসিদে রোডে চকোরি সেলুন নাম দেখে ঢুকি।এসির কোনো বালাই নেই। ছয়টা চেয়ার। সবগুলোতে কাস্টমার। বগল কাটা, চুল কাটা-মাত্র শুরু, চুল কাটা- মাঝামাঝি, পুরো মুখ ফোম শেভিং-ক্রিমে ঢাকা, মুখে ফাইভ-স্টার শেভিংক্রিম ঘষা শুরু, চুল কাটা-প্রায় শেষ পর্যায়। ছয়টি চেয়ারই ছয়জনের দখলে। বাইরে একটা টুলমতো। সেখানে দুইজনের গভীর মনোযোগ আজাদি আর পূর্বকোণের পাতায়। আমি সেখানে একটু জায়গা নিয়ে জীর্ণ একটা তারকালোক ওল্টাই। শাকিব খানের বেশ বড় ইন্টারভিউ চোখে পড়ে। পড়তে গিয়ে আর পড়ি না। পাতা উলটে দেখতে থাকি। সামনে বসে ক্যাশিয়ার ভদ্রলোক। পান চিবুতে চিবুতে একটা চিলমচিতে পিক ফেলেন একটু পর পর। তাঁর পেছনে অনেক পুরানো একটা সিনেমার পোস্টার। সিনেমার নাম চকোরি। গল্পে উপন্যাসে নামকরণের সার্থকতার সাথে সাথে সেলুনে পর্যন্ত নামকরণের সার্থকতা দেখে সামান্য হাসি। সালমান শাহের একটা পোস্টার ঝোলানো। ঢাকায় মৃত্যু খুব তাড়াতাড়ি মুছে গেলেও বন্দরনগরী কিছুদিন জিইয়ে রাখে। সালমান শাহের পাশে ফাইভস্টার সেভিং ক্রিমের একটা ক্যালেন্ডার। গত বছরের।

ক্যাচক্যাচক্যাচ ধ্বনি প্রতিধ্বনি সারে। একজনের শেষ হওয়ায় আমার ডাক আসে। শার্টের দুটো বোতাম খুলে কলার গুটানো, একটা হালকা ভেজা তোয়ালে চাপানো, তার ওপর অয়েল-ক্লথ জাতীয় কিছু। যান্ত্রিকভাবে এগুলো হয়ে যায়। খাঁটি চাঁটগাঁইয়া হওয়া সত্ত্বেও অভ্যাসবশে শুদ্ধ ভাষা চালাই। দুপাশে খুব ছোট হবে। উপরে মাঝামাঝি সাইজ। পেছনে একদম মিশিয়ে দেবেন। ঠিক আছে, বদ্দা, অসুবিধা নাই। মাথার চুলে স্প্রে মেরে চিরুনি চালানো শুরু হয়। সেলুনে এলে নিজেকে দেখা ছাড়া কোনো কাজ না থাকায় কাজটা নিখুঁতভাবে করি। খুব পরিচিত আমি তখন অচিন হই। মনের মধ্যের নিজস্ব কথাবার্তা অস্পষ্ট অবোধ্য হতে থাকে।

ক্যাচক্যাচ। ক্যাচক্যাচক্যাচ। পাশের জন বগল কাটার পর জামা গায়ে দেন। আয়না দিয়ে দেখি পেছনে অন্যদের চেয়ারগুলোর মানুষ পালটে গেছে। একটা খালি। চকোরি শব্দমালা আয়নায় চেহারা বদলে নেয়। চিলমচি এবার বামহাতে নেন ইমেজের ক্যাশিয়ার। আমার ঘাড় সোজা করে দেয় চিরুনি-কাঁচি হাতের ছোকরা। আমি ঘাড় সোজা রেখে চোখ দিয়ে যা দেখার দেখে নিতে চেষ্টা করি। রাস্তা দিয়ে চলছে মানুষ, কুকুর, রামছাগল। সাথে আলো-আঁধারি প্রাগৈতিহাসিক কিছু প্রাণী। চকোরি সেলুনের বাইরে অন্ধকার নেমে আসে দ্রুত। ঘাড় সোজা রেখে চোখ চালিয়ে খুঁজতে থাকি। বাইরের পৃথিবীর একটু কোনো আলো। অথবা ডানা ঝাপ্টানোর আওয়াজ সহ কোনো পাখি।

ক্যাসেট প্লেয়ার চালিয়ে দেন ক্যাশিয়ার। লো ভলিউমে। শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব আর শেফালি ঘোষের ‘রেঙ্গুন শহর যাইয়ুম আঁই, তঁর লাই আইন্ন্যুম কি’ গান আসলে ভলিউম একটু বাড়ে। বাকিরা সবাই কথা থামিয়ে গানে মনোযোগী হয়ে পড়ে। এমনকি ক্যাচক্যাচ করা কাঁচিগুলো পর্যন্ত সাবধানে আওয়াজ সারে। রেঙ্গুন শহরের সুন্দরীদের নিয়ে ভাবতে গেলে অনেক কিছু মাথায় আসে। বিষন্ন একটি বিকেলের কথা মনে পড়ে। পরক্ষণে এসব ভাবনা থেকে সরে আসি।

ক্যাচক্যাচক্যাচ ধ্বনি প্রতিধ্বনি করে আবার মর্ত্যে ফিরে। দীর্ঘ দীর্ঘতর এক যাত্রা সময় পেরিয়ে এগোয়। কাঁচি দিয়ে চিরুনির ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসা রোয়া রোয়া কিছু চুলকে ঘ্যাচাং করা হলে রক্তহীনভাবে তারা খসে পড়ে। চিরুনি আরো কিছু চুল আবারো সনাক্ত করে। ক্যাচক্যাচ শব্দ তৈরি করে আবারো ঘ্যাচাং। পুণরায় রক্তহীন। ক্রমাগত এসবে চুল তার দৈর্ঘ্য খর্ব করে। কানের পাশের পরিখায় লুকানো চুলগুলোতে মেশিন চালানো হলে অজস্র আণুবীক্ষণিক চুল উড়ে উড়ে হাওয়ায় লুকোয় আর বিশ্বের সমস্ত বিপ্লব লিউকিমিয়া আক্রান্ত হয়।

দূরে কোথাও রেডিও চলে। আমি আলতো আবছা শুনতে পাই। নন্দনকাননের রাস্তায় ফানুস ওড়ানো হলে সেটা মেঘ পেরিয়ে অতিক্রম করেছে একটা সুদীর্ঘ ছায়াপথ। সিনেমা প্যালেসের অব্যবহৃত স্ক্রিণে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মাতম বেড়ে গেছে অত্যধিক হারে। নিউমার্কেটের ছাদে কতিপয় রেসিস্ট কাক রঙ পালটে শ্বেতবর্ণ ধারণ করেছে গতকাল। আইসফ্যাক্টরি রোডে আজ সকাল থেকে বিক্রি হচ্ছে সের দরে গলিত লাভা। লাভলেইনে এক টাকায় একটা মিষ্টি পান কিনলে ছোট্ট এক বোতল সায়ানাইড ফ্রি। ডিসি হিলের চূড়া থেকে ঝাঁপ দিয়ে ওড়া শুরু করেছে পাগলা রশিদ। হাজারি গলিতে নিয়ন সাইনের নিচে আত্মহত্যার জন্য দাঁড়িয়ে রোখসানা -একটা টিভি চ্যানেল সরাসরি সেই দৃশ্য সম্প্রচার করতে …


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চিটাগাং এর ফেলে আসা জীবনের কথা মনে পড়ে গেল।
শুভ কামনা।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অতিথি লেখক এর ছবি

শুভাশীষ দা আজ লেখাটা মনে হয় খুব কম সময় নিয়ে লিখেছেন। আপনি এক জায়গায় চিরুনি লিখতে গিয়ে চুরুনি লিখেছেন, আরো কিছু টাইপো আছে, খেয়াল করলে আপনার চোখে পড়বে আমার চেয়ে বেশী। আমি বানান ভুলের জাহাজ, আমার এইসব বলা শোভা পায়না, চোখে পড়লো তাই একটু বললাম।

গল্প অনেক সুন্দর হয়েছে। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। মজাও পেলাম বেশ। খারাপ লাগলো যে দোষে আমাকে তিরষ্কার করতেন মন খুলে সেই ভুল আপনি কি করে করলেন।
সনাক্তকারী না সাক্তকরন?
লিউকেমিয়া না লিউকোমিয়া?

জানার জন্য প্রশ্ন?

ধন্যবাদ।

কামরুজ্জামান স্বাধীন

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

লিউকেমিয়া না লিউকোমিয়া?

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

লিউকিমিয়া।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

কামরুজ্জামান স্বাধীন সাহেব,

হ্যাঁ। একটু তাড়াতাড়ি করেই আপানো হয়েছে। কিছু টাইপো ঠিক্কর্লাম।

আপনাকে ধন্যবাদ।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

বাউলিয়ানা এর ছবি

চুল কাটতে গেলে সেলুনের রেডিওতে বাজতে থাকা বাংলাদেশ বেতারের অনুরোধের আসর খুবই ভাল পাইতাম দেঁতো হাসি

শুক্রবারে একটা নির্দিষ্ট টাইমে যাইতাম বলে এই আইটেম ছিল কমন।

গল্প ভাল লাগছে।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

হ।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

মুস্তাফিজ এর ছবি

গল্প ভাল লাগছে।

...........................
Every Picture Tells a Story

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ধন্যবাদ, মুস্তাফিজ ভাই।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গল্পের ভাষা নির্মিত হচ্ছে, গল্পের ঘটনার পরিপার্শ্বও নির্মিত হচ্ছে, কিন্তু গল্পটা তৈরি হতে পারছে কি? এটা যদি এক রকমের হোম ওয়ার্ক হয় তাহলে ঠিক আছে। অপূর্ণাঙ্গ শরীর নিয়ে জন্মানো গল্পশিশুরা গল্পপিতার কাছে কিন্তু একদিন পূর্ণাঙ্গ শরীর নিয়ে জন্ম দাবি করবে।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আমি নিজেই একটা প্রাচীর দাঁড় করাতে চাই গল্প না বলার। চলচ্চিত্র নির্মাতা সাই মিং লিয়াং এই প্রচেষ্টার উস্কানিদাতা। এই ফরম্যাট থেকে সরে আসার চেষ্টা করছি, পারছি কই!

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

কনফুসিয়াস এর ছবি

আমার কাছেও একটা সিনেমার খুব দারুণ একটা দৃশ্যের মত লাগলো লেখাটা। গল্প নেই, তবে বর্ণনাটা খুব ভাল লাগলো।

-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। হাসি

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আমার কাছে অবশ্য গল্প নাই বলে মনে হলো না। দৃশ্যকাব্যটাই গল্প।



অজ্ঞাতবাস

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

এক অর্থে ঠিক বলছেন, বস্‌।

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার কাছে মনে হল একটা বিশাল ক্যানভাসে ছবি আঁকা শুরু হল মাত্র; অন্য ভাবে বললে একটা চলচিত্রের শুরুর দৃশ্যকল্প। বেশ ভালই লাগল আমার কাছে।

অনন্ত

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

বিশাল ক্যানভাসে কিছু করার ধৈর্য্য আমার নেই। মন খারাপ

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

এনকিদু এর ছবি

রেঙ্গুন যাইতে মঞ্চাইতেছে


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আরো অনেক গানের মত এই গানটাকে পরবর্তীকালে খাৎনা করানো হয়েছে। সেই ভার্শানে 'রেঙ্গুন' কে 'ঢাকা' বানানো হয়েছে। যেমন আরেকটা গানে 'বখশীর হাটের পানের খিলি' কে 'সদরঘাটের পানের খিলি' বানানো হয়েছে।

এনকিদু, রেঙ্গুনের রঙ্গ আর সেখানে বাঙালীদের সেসময়কার ভূমিকা আরো বিস্তারিত জানতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'শ্রীকান্ত' দ্বিতীয় খণ্ড পড়ুন।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

শ্রীকান্ত দ্বিতীয় খণ্ড পড়ি নাই। মন খারাপ

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

'শ্রীকান্ত' মোট চার খণ্ডে সমাপ্ত। এই উপন্যাস না পড়া প্রায় অপরাধ। একটু অবাকই লাগে যে প্রায় শ'খানেক বছর আগে (১৯১৭, ১৯১৮, ১৯২৭ ও ১৯৩৩) বাংলায় শ্রীকান্তের মত উপন্যাস লেখা হয়েছে।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সংসপ্তক এর ছবি

দারুন। পাওলো কোয়েলিওর মত সুন্দর লেখা।
.........
আমাদের দূর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

.........
আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

তোমার এই ধরণের লেখা আর আসে না ক্যানো?

-----------------------------------------------------------
অভ্র আমার ওংকার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।