শত বছর আগে পাবনার বন্যপ্রাণী

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: রবি, ২৭/০৬/২০২১ - ৭:২৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৮৭৭ সালে স্ট্যাটিসটিক্যাল একাউন্ট অফ বেঙ্গলে লেখা হয়েছিল - পাবনা জেলার বড় প্রাণীদের মধ্যে মহিষ এবং হরিণ বিরল তবে বাঘ, চিতাবাঘ এবং বুনো শুয়োর সবখানে প্রচুর পরিমাণে আছে। পাবনা অঞ্চলের বুনো শুয়োরেরা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং আকারে বড় ছিল যে কারণে এখানে বসবাসকারী এবং ঘুরতে আসা ইউরোপিয়ানদের মাঝে শুয়োর শিকার অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল।

কিন্তু বর্তমানে এই অঞ্চল নিয়ে আর সেই কথাটি বলা যায়না। বুনো মহিষ হরিণ এবং বাঘেরা কৃষিকাজ বৃদ্ধির সাথে সাথে উধাও হয়ে গিয়েছে, বলা হয়ে থাকে যে গত শতকের শেষের দিকে একটি মানুষখেকো বাঘ কয়েকজন মানুষকে মেরে পাবনা শহরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল এবং তাকে শিকার করা হয়। তবে চিতাবাঘ এবং বুনো শুয়োরেরা এখনো অসংখ্য আছে। যদিও চিতা বাঘের সংখ্যা অনেক কমে গেছে তবুও চাটমোহর, দুলাই এবং উল্লাপাড়ার জঙ্গলে তাদের ভালোই দেখা যায়। তাদের শিকার হতো শুধুমাত্র গৃহপালিত পশুরাই হয় না কারণ প্রতি বছর একাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হিসেবে তাদের উল্লেখ করা হয়।

কিছু এলাকায় বুনো শুয়োর যথেচ্ছ ঘুরে বেড়ায় এবং কৃষকদের কাছে এর একটা অভিশাপ ফসল ধ্বংসের কারণে। যদিও নদীর চরে এদের বেশি দেখা যায় তবে মূল ভূখণ্ডে এরা যেখানে ধানের ক্ষেত এবং আখের ক্ষেত পায় সেখানে চলে আসে। পাবনার উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিমের জঙ্গলে কয়েকটা নেকড়ে দেখার রিপোর্ট আছে। এছাড়া শিয়াল, দুই ধরনের বেজি ,বনবিড়াল, একাধিক ধরনের খাটাশ , সজারু, খেকশেয়াল,খরগোশ এবং দুই ধরনের ভোঁদড় দেখা যায়।

ভারতবর্ষের দুইটি বিশাল নদী দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় অবশ্যই এই অঞ্চলে অনেক ছোট ছোট নদী, খাল, জলাভূমিতে ভরা বলে অজস্র জলজ পাখিকে এই ভূখণ্ড আকৃষ্ট করে। শীতকালে এখানে দাগি-রাজহাঁস, মেটে-রাজহাঁস এবং নাকতা-হাঁস কিন্তু শিকার করা বেশ কঠিন। পদ্মা এবং যমুনার চরে ল্যাঞ্জাহাঁস, খুন্তেহাঁস, পিয়ং-হাঁস, ভুতিহাঁস, নীলমাথা-হাঁস, দেশি-মেটেহাঁস এবং জোড়ায় জোড়ায় চখাচখি বেশ দেখা যায়। ছোট হাঁসদের মধ্যে পাতি-তিলিহাঁস, সরালি ভালো দেখা যায় তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ধলা-বালিহাঁস। চ্যাগা শিকারের আদর্শ জায়গা এখানে চার ধরনের চ্যাগা পাওয়া যায়।

অন্যান্য জলজ পাখির মধ্যে বক,কুট, ডুবুরি,লালপা,মাছরাঙ্গা, ছোট-পানকৌড়ি অন্যতম। অন্যান্য পাখি যেগুলো ভূমিতে চরে বেড়ায় তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। জিরিয়া এবং হরিয়াল দের প্রচুর দেখা যায় এবং নাটাবটের ও সাধারণ মেটে-তিতির মাঝে মাঝে শিকার করা হয়। কালা-তিতির কে মাঝে মাঝে দেখা যায় তবে বাদা-তিতির বা কিয়া ( Swamp Patridge/ Kyah) খুবই বিরল।

এখানকার নদী এবং বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায় এবং বর্ষায় বিশাল সংখক ইলিশ ধরা হয়। এই ইলিশ সমগ্র উত্তরবঙ্গ সহ কলকাতায় পাঠানো হয়। সত্যি বলতে ইলিশের মৌসুমে কলকাতার বাজারের জন্য প্রধান চালানটা এখান থেকে যায় এবং সেইসাথে ঢাকা এবং চিটাগাং এর উদ্দেশ্যে শত শত বাক্সভর্তি ইলিশ নিয়ে স্টিমারেরা যাত্রা শুরু করে।

অন্যান্য মূল্যবান মাছের মধ্যে রুই, মৃগেল, বোয়াল, মাগুর ইত্যাদি অন্যতম মাঝে মাঝে পদ্মায় পাওয়া rরুই এবং বোয়ালের ওজন তিরিশ সেরের বেশি হয়ে থাকে এবং দুই মণের বাঘাইড় ধরা পড়ে।

প্রতিবছরই কুমিরের একাধিক অসতর্ক স্নানরতকে ধরে নিয়ে যায় এবং বর্ষা মৌসুমে তারা ছোট ছোট নদীতে আশ্রয় নেয়।

- এল এস এস ওমালী ( L. S. S. O'Malley)

( ১৯২৩ সালে প্রকাশিত বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার থেকে)


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

খুঁটিয়ে দেখা, গুছিয়ে লেখা। অনুবাদ ভাল লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তারেক অণু এর ছবি

ধন্যবাদ দাদা

হিমু এর ছবি

লেখার শেষে একটা নির্ঘণ্টে যদি পাখিগুলোর বাংলা নামের বিপরীতে দ্বিপদী নাম সারণি আকারে জুড়ে দিতেন, ভালো হতো।

তারেক অণু এর ছবি

ওকে ভাই, চেষ্টা থাকবে।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

সে সময়কার পাবনা জেলার দুপাশে দুটি পৃথিবীবিখ্যাত নদী পদ্মা-যমুনা, এ ছাড়াও করতোয়া, হুরাসাগর, আত্রাই, বড়াল, গুমানি সহ আরও অজস্র নদী, এ ছাড়াও সুবিশাল চলন বিল। তাই মাছ যে বেশুমার পাওয়া যেত সে আর বলতে। সিরাজগঞ্জ-ঈশ্বরদি রেলপথের মোহনপুর, দিলপাশার, শরৎনগর, বড়ালব্রীজ রেল ষ্টেশনগুলো বসানোই হয়েছিল কলিকাতায় মাছ রপ্তানির জন্য। আমাদের ছোটবেলা অবধি একটি ট্রেন ছিল, নাম ম্যাইছ্যা টেরেন (মেছো ট্রেন)।

আমাদের ছোটবেলায় বর্ষাকালে আমরা যখন সারাদিন নদিতেই কাটাতে চাইতাম, তখন আমাদের দাদী নানী স্থানীয় মুরুব্বীরা আমাদের কুমীরের ভয় দেখাতো। ঘট কুমীর এবং বাইস্যা কুমীর নামক দু ধরনের ভয়ানক কুমীরের সাথা সাথে দেও নামক এক অজানা অশরীরী কিছুর কথা বলে আমাদের নদিবাস সংক্ষিপ্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হত।

গ্রামে গ্রামে দুটি পাখি ছিল বেশুমার, বলতে গেলে গ্রামগুলোর ট্রেডমার্ক পাখি, এক- ঘঘু, দুই- কানাকুকা। ঘুঘুপাখি এখন দেখা যায় না, তবে কালেভদ্রে ঘুঘুপাখির ডকা শোনা যায়। কিন্তু কানাকুকা আর একটিও নেই। আরও একটি প্রাণী ছিল পাবনার গ্রামের ট্রেডমাক, তাদের দেখা মিলতো অজস্র, তা হল দুরা বা ছোট কাছিম। অজস্র জলাশয়ের পাড় ধরে অগণিত সংখ্যায় ডাঙ্গায় উঠে তারা আরামে রোদ পোহাতো। আশ্চর্যের ব্যাপার, মাত্র পঞ্চাশ বছরেই একটি প্রাকৃতিক আবহ চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হয়ে গেল।

তারেক অণু এর ছবি

আহারে ঘট-কুমির মানে ঘড়িয়াল , কোন দিন দেখলাম না দেশের নিসর্গে!
কাছিম শেষ প্রায়!

আপনার মন্তব্য সুন্দর ফুটে উঠেছে সেই হারানো সময়ের ছবি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।