অতীতের সাথে পত্রালাপ (সাত) – স্বাধীনতা

তীরন্দাজ এর ছবি
লিখেছেন তীরন্দাজ (তারিখ: শুক্র, ২৮/১২/২০১২ - ১০:৪৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রিয় বন্ধু রতিকান্ত, যে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পথ পাড়ি দিয়ে দেশটি স্বাধীন হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এর নজির আর নেই। এটি আমার নয়, আমার শিক্ষকের মতিন মওলার কথা। ষাটের উপরে বয়েস তার। বুদ্ধিদীপ্ত, শানিত চেহারাটি কঠিন জীবনযাত্রা ও নির্দয় সময়ের কশাঘাতে ম্রিয়মাণ হলেও চোখদুটো উজ্জ্বল। মতিন মওলা এখানকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। হঠাৎই কোনো কারণ না দেখিয়ে ছাটাই করা হয়ে তাকে। এখন আশে পাশের ছাত্র পড়িয়ে দিন চালান। তবে শিক্ষক হিসেবে যতোই ভালো হোন না কোনো, কেন স্কুলের সাথে সরাসরি জড়িত না থাকলে এখানকার সমাজে সে শিক্ষকের মূল্যমান একেবারেই কম। সুতরাং খুব কষ্টেই দিন চলে মতিন মওলার।

এমনি এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মুক্ত যে দেশ, সেদেশের মানুষ আজ কোন হতাশার কারাগারে বন্দিত্ব, তাদেরই সামাজিক চেতনায় কেন এই বিবর্ণতার কালিমা, কেন গণ বিরোধী অপশক্তির সামনে তাদের মাথা এতোটা নত। কোন প্রভাবে এদেশের মানুষ নিজেদের আত্মিক গুণাবলী বিলিয়ে মানসিক দেউলিয়া হতে চলেছে দিনকে দিন। তাহলে এই যুদ্ধ আর রক্ত থেকে কী শিক্ষা নিলো সবাই, জানতে চাই তার কাছে।

মতিন মওলা বলেন, একটি কথা তোমাকে বলি সোহেল। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ চরিত্রগত ভাবে নির্বিরোধী ও শান্ত। প্রতিদিনের ডালভাত আর মাথার উপর রোদবৃষ্টি প্রতিরোধের আচ্ছাদন, এর বাইরে তাদের আর বেশি কিছু চাওয়া নেই। কিন্তু দলমত নির্বিশেষে আমাদের শাসক গেষ্ঠি, যে অসৎ স্বার্থপরতা ও উন্নাসিকতা নিয়ে দেশ চালায়, তাতে কোনো কোনো সময় এর প্রতিবাদে, কোনো কোনো সময় এর কষাঘাতে সাধারণ মানুষের ভেতরে অসুস্থ উন্মাদনা ভর করে। আমাদের বাজারের হিনু পাগলা যেমন এই উন্মাদনার ফসল, সন্ত্রাসী কালামের বেলাতেও একই কথা বলা যায়। গোঁড়ায় শক্তিশালী না হলে কোনো গাছই ঠিকভাবে ডালপালা মেলে দাঁড়াতে পারে না, আমাদের দেশটির অবস্থাও সেরকমই। যারা শাসক, তারা যদি শুধুমাত্রই শোষক হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ আর কতোটা আলাদা হতে পারে।

আগের আমলের রাজাদের সময় কি একই পরিস্থিতি ছিল না? রাজারাও তো শোষণই করতো প্রজাদের, বলি আমি।

সেটা ঠিক। রাজারা ঠিকই শোষণ করে যেত। সাধারণ মানুষও এর বাইরে কিছু ভাবতে পারে নি। রাজা ও তার অধীনস্থদের নিয়ে গড়া সামন্তবাদী পরিবারই ছিল রাজ্যশাষনের মূল শক্তি। সাধারণ প্রজারাও বাইরে কিছু ভাবতে শেখেনি। রাজাদের শোষণের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকুল আবহ গড়ে উঠতে পারেনি সেকারণেই। রাজারা, তার সামন্তরা শোষণ করবে, এটাই স্বাভাবিক। রাজার শোষণ যদি কিছুটা কম হয়, সেটি শুধুমাত্রই উপরি পাওনা। গণতন্ত্র নিয়ে প্রথমে প্রাচীন গ্রীসে ও পরে প্রাচীন রোমেও চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছিল। তারপর সময়ের স্রোতে ধীরে ধীরে ইউরোপের মানুষ শিক্ষিত হয়েছে, রাজশোষণে অতিষ্ঠ প্রতিবাদী হতে শিখেছে। প্রতিবাদের পথ ধরে সতেরশো শতাব্দীর শেষে এলো ফরাসী বিপ্লব। তারপরই আধুনিক রূপ নিয়ে গণতন্ত্রের পদধ্বনি শোনা গেলো সেখানে। শুরু হল একে ভিত্তি করে সরকার গঠনের প্রক্রিয়া। একসময় সেটি এশিয়াতেও গণতান্ত্রিক চিন্তার বাতাস বইতে শুরু করল। কিন্তু একটি ভুল আমরা করেছি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভালো বোঝার জন্যে সাধারণ মানুষকে যতোটা শিক্ষিত করে তোলা দরকার, তার সামান্যও করে উঠতে পারিনি আমরা। আর শাসকগোষ্ঠীও সে অশিক্ষার সুযোগ ইচ্ছেমত নিয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি একসময় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাও শিকড় গেড়েছিল পৃথিবীর বুকে। একই রাষ্ট্রের রাষ্ট্র-ভুক্ত সম্পদে সব মানুষের সমান অধিকার। কিন্তু মানুষের ত্যাগের চাইতে ভোগের লালসা এত বেশী তীব্র যে, সমাজতন্ত্রের হোতারাই এর মূলমন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে এর রসে নিজেদের লালসা পূরণ করার জন্যে পিষে ধরে সমাজকে। আর সমাজতান্ত্রিক সমাজের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী পুঁজিবাদী শক্তি পৃথিবী থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে সমাজতন্ত্রকে।

একটানা অনেক কথা বলে থামলেন মতিন মওলা। টেবিলের উপরের রাখা গ্লাস থেকে পানির গ্লাসটি চুমুক দিয়ে খালি করলেন। খুব ক্লান্ত দেখায় তাকে। এই অধঃপাতিত দেশটির সবরকম ব্যর্থতার গ্লানি তার কাঁধে ভারী এক বোঝা হয়ে চেপে আছে সারাক্ষণই। আমার খুব কষ্ট হয় লোকটিকে দেখে। তাই কোন প্রশ্ন না করে চুপচাপ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটি চড়ুই পাখি খোলা জানলা দিয়ে ঢুকে আবার ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেল। বাইরে বিকেলের পড়ন্ত আলো জানালা বেয়ে কৌণিক হয়ে পড়েছে মতিন মওলার চোখে। চেয়ারটি একটু সরিয়ে বসে আবার কথা শুরু করলেন তিনি।

এদেশেও একটি শিক্ষিত সমাজ আছে। এদেরকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়। বুদ্ধিজীবী শব্দটি আক্ষরিক অর্থেই এদের জন্যে এত বেশী প্রযোজ্য যে, বার বার বলেও শেষ করা যাবে না। এরা এদের বুদ্ধিকে শুধুমাত্র জীবিকা হিসেবেই দেখে। এর বাইরে সামান্যও নয়। এদের কর্মকাণ্ডের ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি তোমাকে। একটি অনুবাদ বইতে জার্মান লেখক হাইনরিখ ব্যোলের একটি গল্প পড়েছিলাম। গল্পটির অনুবাদিত নাম নাম হাসিকর। হাসিকর ভাঁড় নয়। ভাঁড়ের কাজ, নিজের ভাঁড়ামি দেখিয়ে লোকদের হাসানো। হাসিকরেরও লোক হাসায়। তবে নিজের ভাঁড়ামিতে নয়, এরা পরিকল্পনা করে নিজে হেসে অন্যদের হাসায়। সে হাসির মাঝে শুধুই প্রতারণা। ধরো, কোথাও কোনো একটি হলে একটি নাটক হচ্ছে। দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করছে সে নাটকটির সাফল্যের ভাগ্য। হাসিকরের কাজ হল, পয়সার বিনিময়ে দর্শকদের সারিতে গিয়ে বসা। কোনো এক দৃশ্যে হো হো করে হেসে ওঠে হাসিকর। সে হাসি সংক্রামিত হয় দর্শকদের মাঝেও। কয়েকবার এই একই প্রক্রিয়া চলার পর অতি খারাপ নাটকও উৎরে যায় ভালোভাবেই। আমাদের দেশের বেলাতেও এই একই প্রক্রিয়া চলে আসছে বছরের পর বছর। আমাদের ক্ষমতাসীনরা নাটক করে যাচ্ছে আর বুদ্ধিজীবীরা একই ভাবে হাসিকরের প্রতারণায় উৎরে দেয় সেই নাটক। আর আমরা দর্শক হেসে কুটিপাটি। তবে সবচাইতে দুঃখের বিষয় হল, এই জঘন্য নাটকের সফল মঞ্চায়নের বিষে আমাদের এই নজিরবিহীন মুক্তিযুদ্ধের যে অনুভব, সেটি ম্লান হতে হতে এখন অনেকটাই বিলীন। বাঙ্গালীর ভাত-কাপড়ের অভাব আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ, তথা স্বাধীনতার অনুভবও যদি না থাকে, তাহলে আর কী রইল!

মতিন মওলার কথায় কী এক বিষণ্ণতা ভরে উঠে ঘরটির প্রতিটি কোণে। জানলায় খেলা করছিল যে চড়ুই পাখি, একটি দাঁড় কাক উড়ে সে জায়গাটি দখল করায় উড়ে পালিয়ে যায় সেটি। মতিন মওলাও নিজে মুক্তিযোদ্ধাও হয়েও তেমনি এক পলাতক। আগরতলা এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশ নামডাক ছিল তার। মওলা বলতে বলতে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো তার দলের যোদ্ধারা। তারপর দেশ স্বাধীন হবার পর কী থেকে কী হল। রাজাকার আবুল হোসেন ভোল পাল্টে হল এলাকার জাতী-পন্থি দলের সাংসদ। তার ছেলে আরও বেশি ভোল পাল্টে এখানকার প্রগতিশীল সরকারের সাংসদ। এখানকার ইশকুলে শিক্ষকতা করতেন মতিন মওলা। এসব অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে সে চাকুরী হারিয়েছেন। মানুষটি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, এ কথা নিয়ে ভাবে না কেউ আর। পত্রিকাতে মাঝে মাঝে কেউ কোনো মুক্তিযোদ্ধা লেখাজোঁকা করলেও সেটি স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস সংখ্যার কাটতি বাড়ানোর জন্যেই করা হয়। সাংবাদিকের কাছ থেকেও পালিয়ে বেড়ান মতিন মওলা। এখানে দবির থাকলে বলতো, মুক্তিযুদ্ধের পুরস্কার হিসেবে বেশ কয়েকবারই খৎনা হয়েছে মওলার। যতোই বয়েস হোকনা কোন, আরও কয়েকবার হবে। আমাদের টেবিলে একটি পত্রিকা খোলা পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে মতিন মওলা বলেন,

ইদানীং যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেবার কথা উঠেছে। আমিও তা মনেপ্রাণে চাই। কিন্তু কারা দেবে এই সাজা। এই তথাকথিত প্রগতিশীল সরকার? এই, সরকার, যে রাজাকার আবুল হোসেনের ছেলেকে সংসদে পাঠায়, তার অনৈতিক কর্মকান্ডকে উৎসাহিত করে। এই সরকারই অন্য সরকারকে উৎখাত করার জন্যে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে হাত মিলিয়েছিল। এদের সাথে হাত মেলানো কি নিজের ধর্ষিতা মা কে আরও ধর্ষণের মাঝে ঠেলে দেয়া নয়? আমিও বিচার চাই, সে কথা আগেই বলেছি। তবে চাই, সে বিচার যেন সৎ মানুষ, সৎ সরকারের উদ্যোগে হয়। তাহলেই এই বিচার হবে সুদূরপ্রসারী ও এদেশের জনগণের সামনে এক সুকর্মের উদাহরণ হয়ে ভবিষ্যতের প্রেরণা জোগাবে। সেটি যদি না হয়, তাহলে বিচারের পর আবার আড়ালে আবডালে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সমর্থক দল। সরকারের অযোগ্য ও অসৎ কর্মকাণ্ডের কারণেই কিছুটা হলেও জনগণের সমর্থন পায় এরা। সে সমর্থনকে পুঁজি করে আবার দ্বিগুণ শক্তিতে শুরু করবে রাজনৈতিক পদচারণা। আর আমরা, সে নাটকের দর্শক হয়ে একবার কেঁদে, একবার হেসে হাততালি দিতে দিতে হল থেকে বেরিয়ে বলবো, আহা কী নাটক দেখলাম! তারপরও চাই, এ বিচার হোক। আমাদের ভালো থেকে ভালো বেছে নেবার সুযোগ কখনোই আসেনি, তাই হাজারো মন্দের থেকেই অপেক্ষাকৃত কম মন্দে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

ততক্ষণে বিদায় নিয়েছে বাইরের রোদ। ঘরের ভেতরেও ভর করেছে অন্ধকার। আমরা কোনো কথা না বলে আবছা অন্ধকারেই বসে থাকি সামনা সামনি। আমাদের কথোপকথনে বিষণ্ণতার যে মানচিত্র আঁকা হয়েছে ঘরের ভেতরে, সেটি তখনই ভাঙে, যখন দরজা খুলে দবির ঘরে ঢোকে। বাইরের দোকার থেকে গরম মচমচে সিঙ্গারা নিয়ে এসেছে সে। দবিরের অনুরোধে তার একটি খেয়ে বিদায় নেন মতিন মওলা।

আজ এখানেই শেষ করছি রতিকান্ত। বুঝতে পারছ নিশ্চয়ই যে, আমি অনেকটাই জড়িয়ে পড়েছি এই সময়ের মানুষ ও দেশের সাথে। এই জড়িয়ে পড়ার পেছনে আনন্দ ও কষ্টবোধ, দুটোই রয়েছে। আমার মনে হয়, এতে যে এখানকার মানুষের সাথে আমার সম্পর্ক, পৃথিবীর প্রতি আমার দৃষ্টিপাতকে আরও গভীর করবে। সত্যকে গভীরভাবে চিনি, সেটি আমার চাওয়া, তোমারও। কিন্তু এই সম্পর্ক আত্মিকভাবে আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে, জানা নেই ও সেখানেই ভয় আমার।

তুমি ভালো থেকো।

ইতি
তোমার বন্ধু রামকুমার

আগের পর্বগুলোর লিংক:

অতীতের সাথে পত্রালাপ (এক) - অবতরণ
অতীতের সাথে পত্রালাপ (দুই) – দবির মিয়া
অতীতের সাথে পত্রালাপ (তিন) – পথ আর ঘর
অতীতের সাথে পত্রালাপ (চার) – গাণিতিক সময়
অতীতের সাথে পত্রালাপ (পাঁচ) – দূরদর্শন
অতীতের সাথে পত্রালাপ (ছয়) – খৎনা


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।