দেশবিদেশের উপকথা(৩)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ০৫/০৫/২০০৯ - ১:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

স্ক্যান্ডিনেভিয়ার উপকথা

দেবতারা থাকতো স্বর্গে মানে আস্গার্ডে, মানুষেরা মর্ত্যে মানে মিডগার্ডে আর দত্যি দানো অসুরেরা আর সব বাকীরা নয়টি লোকের বাকী সাতটিতে। ভারী সুন্দর এক রংধনুর সেতু ছিলো স্বর্গ থেকে পাতাল অবধি। আগে ঝগড়াঝাঁটি ছিলো না কিনা, তাই ভাবভালোবাসা আর যাতায়াত ছিলো দেবতাদৈত্যে। কিন্তু পরে ঝগড়াঝাঁটি হয়ে আলাদা হয়ে গেলো। সেতুর উপরে পাহারা বসলো। বিরাট শিঙা নিয়ে দেবতা হীমদল পাহারায় রইলো, দৈত্যদের আক্রমণের উদ্যোগ দেখলেই সাবধান করে দেবে শিঙা বাজিয়ে। কিন্তু তাও দেবতাদের মনে ভারী ভয় এই বুঝি দৈত্যেরা এলো রে, স্বর্গ দখল করলো রে!

তাই তারা আস্গার্ড ঘিরে বিরাট প্রাচীর গড়ার টেন্ডার ডাকলো। তখন এক কারিগর এসে কইলো সে ফার্স্টক্লাস পাঁচিল তৈয়ার করে দিতে পারে কিন্তু দাম হিসাবে সূর্য চাই, চন্দ্র চাই আর স্বর্গের দেবী ফ্রেয়াকে চাই।

যখন আদিদেবতা ওডেন আর তার ছেলেপুলেস্থানীয়রা-থর, বালডার, টিউ হিমদল, ফ্রে সবাই পাঁচিলের কারিগরের দাম চাওয়ার বহর দেখে ক্ষেপে গিয়ে ওকে চলে যেতে বলছে, তখন ওদের সবাইকে থামিয়ে পরামর্শ করতে আড়ালে ডেকে নিলো চালাকির দেবতা লোকী।

সে কইলো," ওকে দিয়ে চালাকি করিয়ে কাজটা করিয়ে নেওয়া যাক না, দামের ব্যাপার পরে দেখা যাবে।" লোকী লোকটা নিজে হচ্ছে অত্যন্ত ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার, দেবতা দত্যি সবের সঙ্গেই তার ওঠাবসা, ট্রোলরা তার অনুগামী কর্মী, নিজে সে নানারকম ছদ্মবেশ ধরতে পারে। যখন তখন মিডগার্ডে মানে মর্ত্যে আর অন্যান্য লোকে এমনকি পাতালে টাতালেও ঘুরতে যায় লোকী। কিকরে এসব সব সত্বেও সে সগ্গে দিব্যি থাকতে পায়, খোদায় মালুম।

তো, লোকীর পরামর্শে কারিগরকে কওয়া হলো একলা ওর ঘোড়ার সাহায্যে যদি শীতকালের দীর্ঘ রাত্রির মধ্যে পাঁচিল বানিয়ে ফেলে, তাইলে ওর দাম দেওয়া হবে, নইলে কিছুই পাবে না। সেই মেনে দানব তো ওর ঘোড়া নিয়ে কাজে লেগে পড়ে, বানিয়েও ফেলে পাঁচিল, কিন্তু একটুখানি যখন বাকী তখন লোকী ঘোটকী সেজে দৈত্যের ঘোড়াটাকে ফুসলে নিয়ে পালায় বনে। তো সেই ঘোড়াকে খুঁজে আনতে দৈত্য ছুটে আসে, তা করতে গিয়ে রাত শেষ হয়ে ভোর হয়ে যায়। দৈত্য রেগে গিয়ে বলে "এভাবে চিট করলে খেলবো না", বলে সে দাম চাইতে যায়। কিন্তু থর তাঁর হাতুড়ী দিয়ে দৈত্যকে মেরে ফেলেন।

কিন্তু মারলে কি হবে? এই অন্যায়ের জন্য খুব গন্ডগোল হয়, সবার মনখারাপ, সবাই সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর-বলে লোকীর নামে দোষ দেয়, এদিকে সেতো তখন কোথায় ঘুরতে চলে গেছে! তাকে কোথায় পাওয়া যাবে? কয় মাস পরে লোকী এসে ওডিনকে এক আট-পা ওয়ালা ঘোড়া দেয়, সেই ঘোড়া নাকি ঐ দৈত্যের ঘোড়া আর লোকীর ঘোটকী অবস্থার সন্তান। দৈত্যের ঘোড়াটার পরে কি হয়েছিলো খোদায় মালুম। তো সেই আট-পা ঘোড়া বিদ্যুত্গতি, ওডিন তার পিঠে চড়ে দুনিয়া ঘোরে।

দিন যায়, দেবতা বালডার একদিন স্বপ্নে দেখে সে মারা গেছে, তাকে লালকার্পেটে অভ্যর্থনা করছে মৃত্যুলোকের অধিবাসীরা। তারা এত খুশী! কিন্তু বালডার খুশী হয় না, ঘুম থেকে উঠে সে মনমরা। ছেলেকে মনমরা দেখে বাবা ওডিন ব্যস্ত হয়, মা ফ্রিগ্গা ব্যস্ত হয়। ছেলেকে অনেক তুতিয়ে পাতিয়ে জিগিয়ে টিগিয়ে কারণ জানে দুজনে। ওডিন আট-পা ঘোড়ার পিঠে চড়ে বিদ্যুত্বেগে পাতালে যায় অবস্থা দেখতে আর কোনো উপায় আছে কিনা বালডারকে বাঁচানোর, তাই জানতে।

তো, সেখানে গিয়ে সে দেখে সাজো সাজো অবস্থা, সবাই বালডারের জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। ঝাড়ামোছা ফুল দিয়ে সাজানো ধূপ চন্দন আল্পনা মালা গাঁথা চলছে, এসব দেখে সে ঢোঁক গেলে, এর মধ্যে কিকরে সে কইবে যে বালডারকে আসতে দিতে তাদের কারু ইচ্ছে নেই? (ওডিন নিজে কঠোর সাধনায় মৃত্যুরহস্য মোচন করেছিল, তাই হয়তো সে দিব্যি যেতে পারে সেই লোকে। আবার ফেরত্ ও আসতে পারে অবলীলায়)

শেষ পর্যন্ত জানা গেলো দিনক্ষণ, কবে বালডারের মৃত্যু হবে আর কিভাবে হবে। ওডিন ফিরে এলো, সবাইকে সব বললো। ফ্রিগ্গা নয়টি লোকের সব বস্তুকে অনুরোধ করলো কেউ যেন বালডারের ক্ষতি না করে। কিন্তু সে ছোটো একটি ওষধি পরগাছাকে অনুরোধ করতে ভুলে যায়। লৌহকক্ষের সেই ছিদ্রপথেই লোকীর দুর্বুদ্ধি বালডারকে মৃত্যুলোকে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে।


জমকালো পার্টি হচ্ছিলো বালডারকে নিয়ে, প্রচুর ভালো ভালো খাওয়াদাওয়া হলো, তারপরে শিঙায় করে উচ্চমানের মীডপান, তারপরে ফান শুরু, সবাই ওর দিকে ঢিল পাথর গাছের ডাল বর্শা ছুঁড়ে মারে, সব ফিরে আসে। ক্ষতি না করার প্রতিশ্রুতিতে বদ্ধ তারা। এসব দেখে মজা পেয়ে সবাই হো হো করে হাসে।

এদিকে লোকীকে পাতাললোকের ওরা ধরে পড়েছিলো হয়তো আগেই, কিছু একটা উপায় করো গুরু, আশা দিয়ে শেষে বালডার আসবে না? এত সাজানো গোছানো এত আশা নিয়ে বসে থাকা-সব বৃথা হবে?

দেবতাদের মধ্যে একজন ছিলো অন্ধ, সে সম্পর্কে বালডারের কেমন বড়োভাই হয়। তো, সবাই যখন আনন্দ করছে পার্টিতে সে একপাশে চুপ করে ছিলো, সে তো দেখতে পায় না কিনা, তাই অনেক আনন্দ থেকেই বঞ্চিত। লোকী তার পাশে এসে ভাব জমালো আর বলে দিতে থাকলো কি হচ্ছে। কথায় কথায় একসময়ে সেই অন্ধ ভায়ের হাতে তুলে দিলো সেই প্রতিশ্রুতি না দেওয়া পরগাছাটি থেকে তৈরী এক লাঠি। অন্ধ দেবতা যেই না সেটি ছুঁড়েছে বালডারের বুকে লাগলো আর সে সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে পড়ে প্রাণত্যাগ করলো। লোকী তখন ত্রিসীমানায় নেই।

সকলের হাহাকারে খুব অবাক হয়ে গিয়ে অন্ধ দেবতা জানতে চায় কি হলো কি হলো কি হলো? ব্যাপারটা কি হলো জানতে পেরে সে ভেঙে পড়ে, বলে কে তাকে লাঠিটি দিয়েছিলো। সবাই লোকীর খোঁজ করে, কিন্তু লোকী তখন কোথা? হয়তো গিয়ে পাতালে বসে আছে, বালডারকে হাত ধরে নৌকো থেকে নামাবে বলে।

অনেক শোকতাপের পরে বালডারের দেহ ধুয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে অস্ত্র শস্ত্র অলংকারে সাজিয়ে নৌকায় তুলে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হলো আগুন দিয়ে।

3
এর পরে আছে আবার আপেল বাগানের দেবীকে হারানো ও ফিরে পাবার কাহিনি। দেবী ইদুন ছিলেন দেবতাদের চিরযৌবন রক্ষার দায়িত্বে। তাঁর বাগানের আপেল রোজ সকালে একটি করে খেতেন সব দেবতা। তাকে একদিন হরণ করে নিয়ে গেলো দৈত্য থেয়াস। খোঁজ খোঁজ খোঁজ--কোথা গেলো ইদুন, কোথা গেলো ইদুন, দেবতারা যে সব বুড়ো হয়ে যাবেন ইদুনের আপেল না পেলে-জানা গেলো ইদুন থেয়াসের পাথরের পুরীতে বন্দিনী। জানা গেলো এও লোকীর প্ল্যানে ঘটেছে, লোকী নাকি কবে থেয়াসকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো দেবী ইদুনকে এনে দেবে। মানে যেখানে যা হয় আরকি ... যা কিছু হারায় গিন্নী বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর!

সবাই মার মার করে গিয়ে লোকীর উপরে পড়লো, এবারে লোকী পালাতে পারেনি। সবাই মারতে চায়, কেউ ঠান্ডা হয় না, থর হাতুড়ী তুলে এই মারে কি সেই মারে। কিন্তু ঠান্ডামাথা দেবতারা কোনোরকমে অবস্থা সামাল দেয়, লোকীকে মারলে ইদুন তো ফিরবে না, এখন ইদুনকে ফেরানোর জন্য যা করা দরকার তাই করা হোক।

লোকী রাজী হলো উদ্ধার করে আনতে, মন্ত্রবলে মস্ত এক চিল হয়ে গিয়ে সে সোজা দৈত্যপুরীতে গিয়ে জানালায় বসলো। সেই ঘরে ইদুন বসে বসে ভাবছিলো কি হবে তার! জানালায় চিল দেখে সে আশ্বস্ত হলো, মন্ত্র পড়ে ইদুনকে ছোট্টো বাদাম বানিয়ে চিলরুপী লোকী পায়ের নখের মধ্যে নিয়ে উড়ে চললো সগ্গের দিকে, এদিকে থেয়াস খবর পেয়ে ইগল সেজে তাড়া করেছে। এই ধরে কি সেই ধরে।

(চা ব্রেক হাসি )


মন্তব্য

এনকিদু এর ছবি

নর্স মিথ নিয়ে সচলে এর আগে কোন লেখা পড়া হয়নি, আমার দেখা আপনার লেখাটাই প্রথম । অভিনন্দন জানাই ।

নর্স মিথের দুটি জিনিস আমার খুব ভাল লাগে । এক হল, যে কোন যুদ্ধে যে পক্ষেরই হোক, বীরত্বের সাথে লড়তে পারলে ভ্যালহালায় স্থান পাওয়ার ব্যাপারটা । আর দুই হল র‌্যাগনারকের যুদ্ধে হারতেই হবে, এটা জেনেও লড়ে যাওয়া ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

খেকশিয়াল এর ছবি

আহ্‌ কতদিন পরে নর্স দেব দেবীর গল্প পড়লাম, আর ছাড়ুন! আপনাকে ধন্যবাদ!

------------------------------
'..দ্রিমু য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

মূলত পাঠক এর ছবি

চা বাগান থেকে চা পাতা তুলে এনে ফুটিয়ে চা বানিয়ে খেলেও এতোক্ষণ লাগে না। নিজে ফাঁকি দিয়ে চায়ের নামে দোষ? বেচারার অবস্থা লোকির চেয়েও খারাপ!

কারুবাসনা এর ছবি

৫ পাতা রেখে গেলাম।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

সিরাত এর ছবি

সুউউউপার!! নর্স মাইথোলোজি গল্পের জন্য খুবই উত্তম ক্ষেত্র!

বালডারের নেমসেক গেমটা খেলছেন তো - বালডার'স গেট? যদিও এটা ডানজনস এ্যান্ড ড্রাগনসের লাইনের।

তো লোকি নরকে যাচ্ছে কবে?

মেকওয়ারিওর ৪ গেমটায় একটা ব্যাটলমেকের নাম ছিল লোকি। আরেকটা ছিল থর। আরেকটা ছিল ফাফনির। কি যে একটা গেম!! খেলে দেখেন পারলে!

ভুতুম [অতিথি] এর ছবি

এইসব লিখতাছেন, ভালোও লাগতাছে। কিন্তু গাউচ্ছা মাইয়া -৩ কৈ???

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

অতি জটিল! আপনারা (আপনি আর খেকশিয়াল) সচলায়তনের চেহারা আমূল বদলে ফেলেছেন! সবাই এখন বুদ হয়ে রুপকথা পড়া শুরু করেছি দেঁতো হাসি
___________________________
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ

কীর্তিনাশা এর ছবি

চা'টা একটু তাড়াতাড়ি শেষ করেন গো দিদি !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বহুদনি পরে রূপকথাটি আবার পড়লাম
চমৎকার

০২

দেবতাদের মধ্যে একজন ছিলো অন্ধ, সে সম্পর্কে বালডারের কেমন বড়োভাই হয়।

যতটুকু জানি সে বলডারের সৎভাই। নাম হডার

০৩

কোথায় এক জায়গায় পড়েছিলাম এই কাহিনীর হডার থেকে Wednesday এবং ফ্রিগা থেকে Friday আসার একটা কাহিনী আছে

সে বিষয়ে কিছু বলবেন?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।