অণুগল্প-১২। প্রতিশোধ।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: শনি, ২৫/০৭/২০০৯ - ৩:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সময় রাত একটা। স্থান দামুকদিয়া বাজারে তালুকদারের সাইকেলের দোকান।

মোজাম্মেল আর ইউসুফ সময় মতোই এসেছে। বরাবরের মতো নাসির আজকেও লেট। কিন্তু আজকের অপারেশনটাতো ঠিক বরাবরের মতো না। আজকে অন্ততঃ নাসির সময়মতো আসতে পারতো।

দুজনের হাতেই দুটো চটের বস্তা। তার মধ্যে আছে অনেকক্ষণ ধরে ধার দেয়া চকচকে রামদা। বিনা ঝামেলায় কাজ শেষ করতে হবে আজকে। এইরকম কাজ আজকেই প্রথম তাদের জন্যে। মনের মধ্যে তাই একটা চাপা দুশ্চিন্তা গুরগুর করছে।

মোজাম্মেল একটা সিগারেট ধরায়। ইউসুফ চাপা স্বরে ধমকে ওঠে,‘এখন সিগারেট ধরালি কেন? সিগারেটের আগুন বহুদুর থেকে দেখা যায় তা জানিস?’
মোজাম্মেল থতমত খেয়ে সিগারেট নিভিয়ে ফেলে। ‘শালার নাসিরের সময়জ্ঞানটা এখনো ঠিক হোল না।’

নাসির অবশ্য বেশী দেরী করেনা আজকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এসে পড়ে। তার হাতেও একটা চটের ব্যাগে পোরা রামদা রয়েছে।

‘সবাই রেডী?’
‘আমরা তো সেই সন্ধ্যেবেলা থেকেই রেডী। দেরীতো তুইই করলি।’
‘যাক- বাদ দে। চল- এখন রওনা দেই।’

তাদের গন্তব্য আধা মাইল দূরে কামাল মাস্টারের বাড়ী। আজকে কামাল মাস্টারকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়া হবে। শালার মাস্টারের বড় বাড় বেড়েছে আজকাল।

কামাল মাস্টার এখানকার হাইস্কুলের হেডমাস্টার। এলাকায় তার দাপট প্রচন্ড, আসলে দাপটটা ঠিক মাস্টারের না, দাপটটা তার বিরাশি সিক্কার কিলের। ছেলেপেলেরা দুষ্টুমী করলে কামাল মাস্টার দুমদুম কিল বসিয়ে দেন তাদের পিঠে। সেই কিলের ভরবেগ ভয়াবহ। কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো বলে একটা কথা আছে। কামাল মাস্টারের কিলও সেই মাত্রার। এই কারণেই বোধহয় আড়ালে ছেলেপিলেরা তাকে কামাল মাস্টারের বদলে ‘কাঁঠাল মাস্টার’ বলে ডাকে।

মূল ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল তিন দিন আগে। তিনমূর্তি গ্রামের বড় বটগাছের নীচে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। ওই সময়ে সামনের রাস্তা দিয়ে স্কুলে যাচ্ছিল রীনা। রীনাকে আবার ইউসুফের পছন্দ। সে তাই রীনাকে দেখে গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠেছিল,‘ও ছেমড়ি তোর কপাল ভালো, পাগলা বাবার নজর পইড়াছে।’
ব্যাস-এইটুকুই। এ রকম ঘটনা আকচার হচ্ছে। কিন্তু রীনা যে কামাল মাস্টারের কাছে গিয়ে নালিশ দেবে তা কে জানতো?
পরদিন বাংলা ক্লাশে কামাল মাস্টার এসে হাজির। তিনটেকে ধরে পুরো ক্লাশের সামনে আধা ঘন্টা ধরে কিলিয়েছে।
‘এই বয়সে পাগলা বাবা হইতে চাও? আসো- তোমাদেরকে পাগলা বাবা হওয়ার শখ মিটায়ে দিতাছি।’
সে কি কিল রে বাবা! পুরো হাড়গোড় মনে হয় গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে গেল।

সেইদিন সন্ধ্যেবেলা তিনজনে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে কামাল মাস্টারের বড় বাড় বেড়েছে। এর শেষ হওয়া দরকার। এবং অতি সত্বর। গায়ের ব্যথা মিলানোর আগেই।

হাঁটতে হাঁটতে নাসির জিজ্ঞেস করলো,‘রামদা গুলো ধার দেয়া হয়েছে তো?’
‘হুঁ।’
‘এক এক কোপে নামাতে হবে বুঝেছিস। একদম দেরী যেন না হয়। শালা মাস্টার কিছু টের পাবার আগেই যেন সবকিছু ফিনিশ হয়ে যায়।’
‘হুঁ।’

কামাল মাস্টারের পয়সা আছে। বেশ অনেকখানি জায়গার উপরে করা তার বাড়ীটা পাকা, উপরে টিনের চাল। চারপাশে অনেক গাছ-গাছালি।

অন্ধকারের মধ্যে তিনটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ায় বাড়ীর পিছনের উঠোনে। তিনজনেই একই সাথে চটের ব্যাগ থেকে রামদাগুলো বের করে। স্বল্প আলোতেও রামদা গুলো চকচক করে ওঠে। ইউসুফ আঙুল দিয়ে আলতো করে দা এর ধার পরীক্ষা করে।

‘কাঁঠাল মাস্টার-আজ আর তোমার রক্ষা নাই। তুমি বুঝো নাই যে তুমি কাদের সাথে টেক্কা মারতে গেছো?’
মোজাম্মেল ফিস ফিস করে বলে,‘একটা জিনিস মনে রাখবি কিন্তু। কাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই কিন্তু দা গুলো ভাল করে বস্তায় মুছে নিবি। দেরী করে মুছলে দা থেকে দাগ তুলতে সময় লাগে।’
ইউসুফ বলে,‘আমার মনে আছে। ভুল হবে না।’

শেষবারের মতো নাসির সবার দিকে তাকায়। ‘কি-সবাই রেডী তো?’
‘হুঁ-সবাই রেডী।’
‘ভয় লাগছে?’
‘অল্প-অল্প।’
‘কোন ভয় নাই। দশ মিনিটের মধ্যেই সব শেষ করবো আজকে।’

নাসিরের নির্দেশে উদ্যত দা হাতে তিনজনা একই সাথে রান্নাঘরের পাশে দাঁড়ানো কাঁঠাল গাছটির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবারে গাছটিতে অনেক কাঁঠাল ধরেছে। পরদিন সকালে গাছের অবস্থা দেখে মাস্টারের চেহারা কেমন হবে তাই ভেবে ইউসুফ একটু হাসে।

কাঁঠাল মাস্টারের অতিরিক্ত কাঁঠালপ্রীতির কথা এ তল্লাটে সবারই জানা।


মন্তব্য

সাইফ তাহসিন এর ছবি

জাহিদ ভাই, এবারেরটা কিন্তু পুরাই দম ফাটানো হাসির হয়েছে,

শালা মাস্টার কিছু টের পাবার আগেই যেন সবকিছু ফিনিশ হয়ে যায়।

এ লাইনটা কিন্তু সাসপেন্স কিছু কমিয়ে দিয়েছে। তবে ব্যাপক মজা পেয়েছি। আপনার অনুগল্প জিন্দাবাদ। চলুক আজীবন হাসি

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার মন্তব্যটি সঠিক। এখন আমারও মনে হচ্ছে যে ঐ লাইনটি অন্যরকম ভাবে লেখা উচিৎ ছিল। তাড়াহুড়োর লেখা বলেই বোধকরি এটি হয়েছে। লেখা ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

অনুগল্পের এই টাইপটা কি বহুব্যবহারে একটু প্রেডিক্টেবল হয়ে যাচ্ছে? আমি যেমন শুরু থেকেই বুঝতে পারছিলাম দা দিয়ে গলা কাটার কোন সম্ভাবনা নেই ...

অণুগল্পের ক্ষেত্রে সবাই শেষে একটা টুইস্ট রাখতে চায়, এই গল্পটায় মনে হয় এই টুইস্টটা না থাকাটাই সবচে বড় টুইস্ট হত ...
................................................................................................
খাদে নামতে আজ ভয় করে, নেই যে কেউ আর হাতটাকে ধরা ...

স্বপ্নহারা এর ছবি

সহমত...ধরেই নিয়েছিলাম কাঠাঁল কাটবে!

হতাশাবাদীর হতাশাব্যঞ্জক হতশ্বাস!

-------------------------------------------------------------
জীবন অর্থহীন, শোন হে অর্বাচীন...

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

এই গল্পটায় মনে হয় এই টুইস্টটা না থাকাটাই সবচে বড় টুইস্ট হত ...

সহমত, কাঁঠাল নয়- দু'তিনটা ছাগল মারতে সমস্যা ছিলো না...দেঁতো হাসি

তবে জাহিদ ভাইয়ের অণুগল্প সিরিজ আগ্রহ নিয়েই পড়ছি...। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

হুমম-আপনি তো চিন্তায় ফেললেন দেখি।
এই লেখাটি তৈরী করার সময়ে খুব চিন্তা করে লিখতে চেষ্টা করেছি যাতে করে পাঠকেরা একবারেও বুঝতে না পারে যে রামদা এর কোপ কাঁঠাল গাছে গিয়ে পড়ছে। আপনি যা বলেছেন তার সাথে আমিও আংশিকভাবে একমত। লেখার ফরম্যাট টা বদলানো দরকার তাহলে। দেখি ট্যুইস্ট ছাড়া কিছু লেখা যায় কিনা।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মামুন হক এর ছবি

জাহিদ ভাই, গল্পটা আমার কাছে ভালো লেগেছে।
অণুগল্পের আরো কী কী শাখা প্রশাখা আছে যদি জানাতেন তাহলে ওগুলো নিয়েও কিছু লেখা লেখির চেষ্টা করতাম হাসি

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনাকে লেখা শেখাবো আমি? এত বড় হাসির কথা আমি জীবনে আগে শুনি নাই।
আপনার লেখা অতিশয় উপাদেয়।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মূলত পাঠক এর ছবি

প্রেডিক্টেবল হলেও আমি সদাশিব পাঠক বোধ হয়, আমি একটু চিন্তায় ছিলাম, ছোটো ছোটো স্কুলের ছেলে, এরা শেষে খুন করবে মাস্টারকে? যাক ঐ কাঁঠালের নামে মাস্টারের নাম রেখে ব্যাপারটা আরো গুলিয়ে দেওয়ায় মজা পেলাম। মোদ্দা কথা, খাসা লাগলো। হাসি

জাহিদ হোসেন এর ছবি

যাক-মূল পাঠক যখন খুশী, তখন আমার আর কোন চিন্তা নেই।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

তুলিরেখা এর ছবি

একেই বলে মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া! হাসি
কিন্তু কাঁঠাল পাড়তে রামদা লাগলো?

-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

জাহিদ হোসেন এর ছবি

কাঁঠালগুলো যে রামকাঁঠাল ছিল সেই কারণে দা এর বদলে রামদা র আমদানী ঘটেছে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

হো হো হো

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

ঠিক আছে। কাঁঠাল পাড়তে রামদা লাগলেও সই হাসি

মৃত্তিকা এর ছবি

চমৎকার হয়েছে গল্প, সাস্‌পেনসে ছিলাম......শেষ প্যারায় হেসে ফেললাম!

বইখাতা এর ছবি

মজার গল্প।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

আমার কাছে তো দারুণ লাগল গল্পটা। শুরুতে ঠিক ধরতে পারিনি শেষে কী ঘটবে। সিরিজ চলুক।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

থ্যাংক ইউ। মাঝে মাঝে লিখতে ইচ্ছে করে, তাই সময় সুযোগ পেলে লিখি আরকি। সিরিজ হবে কিনা জানিনা।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

দারুণ

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আমি কিন্তু চূড়ান্ত সাসপেন্সেই ছিলাম। দারুণ গল্প। দারুণ। জোশ।
--------------------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়...

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

জাহিদ হোসেন এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাদের দুজনকে।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

খুব বেশি মাথা খাটায়ে পড়ার মতো অবকাশ নাই... খালি পড়ি... ভাবি না।
আর অনুগল্প পড়ার খুব সহজ একটা কায়দা আবিষ্কার করে ফেলছি। সময়াভাব থাকলে... আগে শেষ লাইনটা পড়ে ফেলি... হো হো হো
তাই সাসপেন্স নিয়া আমার কিছু বলার নাই।

কিন্তু এইখানে একটা কথা মনে আইলো- আমি একসময় লিও ক্লাব করতাম। লিও ক্লাব অব ঢাকা গুলশান। সেই ক্লাবে একজন ছিলো রামপ্রসাদ... তারে আমরা সবসময় রামদা বলে ডাকতাম... হো হো হো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনি অণুগল্পও পুরোটা পড়তে চান না! আপনি তো ভাই চরম পিপু-ফিসু দেখা যায়।
দেখি চেষ্টা করবো আপনার জন্যে এক-দুই লাইনের কোন গল্প বানানো যায় কিনা।
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

শাহেনশাহ সিমন [অতিথি] এর ছবি

চলুক

হরেকৃষ্ন এর ছবি

প্রিয় জাহিদ সাহেব,

আপনি প্রতিশোধ গল্পটি লেখেছেন বেশ ভালই, কিন্তু আমরা পাঠকদের আশাহত করে কিসের প্রতিশোধ নিচ্ছেন বুঝতে পারছি না। আমরা তো ভাই আপনার কোন ক্ষতি করি নাই, সব সময় আপনার লেখার প্রসংশাই করে গেলাম।

প্রথম দিকে মনটা খারাপ ও অস্থির হয়ে গিয়েছিল এই কচি ছেলেগুলোকে সত্যিই আপনি খুনী বানিয়ে ছাড়েন কিনা, পরে দেখলাম নাহ আপনি ততটা খারাপ লোক নন। তার জন্য আপনি প্রসংসা পাওয়ার যোগ্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।