টেরি ফক্স, নির্ঝরের জন্মদিন ও একটি ক্যান্সার হাসপাতালের গল্প

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি
লিখেছেন জোহরা ফেরদৌসী (তারিখ: রবি, ২৭/০৫/২০১২ - ৩:২০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“Dreams are made possible, if you try”…Terry Fox

১.

ছোট্ট নির্ঝর প্রথম কখন শুনেছিল ক্যান্সারের কথা? সেই যেবার CBC আয়োজন করেছিল The Greatest Canadian । তখন নির্ঝরের বয়স দু’বছর কয়েক মাস । CBCর সেই আয়োজনের প্রথম পর্বে দর্শকদের সরাসরি ভোটে প্রথম দশজনকে নির্বাচন করা হয়েছিল । জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের ভিত্তিতে তাঁদের নির্বাচন করা হয়েছিল । প্রথম দশজনের মধ্যে ছিলেন বিজ্ঞানী (আলেজান্ডার গ্রাহাম বেল, স্যার ফ্রেডেরিক বেন্টিং), রাজনীতিবিদ (কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী স্যার জন এ ম্যাকডোনাল্ড, পিয়ের ট্রুডূ, লেস্টার বি পিয়ার্সন), পরিবেশবাদী (ডেভিড সুজুকি), হকি ব্যক্তিত্ব (ওয়েইন গ্রেটস্কি, ডন চেরী) । সর্বোপরি ছিলেন কানাডার সামাজিকখাতে স্বাস্থ্যসেবার আইকনিক উদ্যোক্তা টমি ডগলাস, নির্ঝরের মা যাঁর ভীষন অনুরক্ত । প্রথম পর্বে নির্বাচিত এই দশজনের প্রত্যেককে নিয়ে একটি করে ডকুমেন্টারী করা হয়েছিল যেখানে কানাডার জাতীয় উন্নয়ন ও মানব সভ্যতায় তাঁদের অবদানের কথা তুলে ধরা হয় । সেই সময়ে প্রথমবারের মত নির্ঝররা শুনতে পেল প্রয়াত তরুন টেরি ফক্সের কথা । টেরি ফক্সের পর্বের আগে পর্যন্ত্য নির্ঝরের মা নিশ্চিত ছিল টমি ডগলাসকেই ভোট দেবে । কিন্তু টেরির পর্বটি দেখার পর নির্ঝরের আবেগাক্রান্ত মা ছোট্ট নির্ঝরকে উদ্বেলিত গলায় অনেক কিছু বলে গেল । নির্ঝর তার খুব অল্পই বুঝল, অনেকটাই বুঝল না । তবে মা আর ছেলে মনিটরের সামনে বসে টেরিকেই তাঁদের ভোটটা দিল ।

২.

মাত্র আঠার বছর বয়সে টেরিকে ক্যান্সারের হিমশীতল ডায়াগনোসিস শুনতে হয়েছিল । অস্টিওজেনিক সারকোমার (হাড়ের ক্যান্সার) কাছে ডান পা হারাতে হ’ল তাকে । ১৯৭৭ সালে এছাড়া আর কোন চিকিৎসা ছিল না । ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার আর দশটা সাদামাটা ওই বয়সী তরুনদের মতই ভীষন এথলেটিক ছিল টেরি । দুরপাল্লার রানার আর বাস্কেটবল খেলোয়াড় টেরির কেমন লেগেছিল সার্জারীর পরের প্রথম সকালে হাসপাতালের বিছানায়...হাঁটুর ছয় ইঞ্চি ওপর পর্যন্ত্য এমপিউট করা ব্যান্ডেজ ছুঁতে...? আজ আর তা জানার উপায় নেই । ক্যান্সার টেরির অঙ্গহানীর করতে পারলেও, ওর ভেতরের শক্তিকে দমাতে পারেনি । হাসপাতালে থাকাকালে ক্যান্সারে আক্রান্ত অন্য রোগি, বিশেষতঃ শিশুদেরকে দেখে টেরি খুব তাড়িত হয় । মরনব্যাধী ক্যান্সারের হাত থেকে মানুষের মুক্তির একটাই উপায়, উন্নত চিকিৎসা ব্যাবস্থা । তার জন্য চাই গবেষণা, ব্যয়বহুল সেই গবেষণার জন্য চাই প্রচুর টাকা । কিন্তু অসংখ্য ক্যান্সার রোগির বেঁচে থাকার আশাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে গবেষণা আর উন্নত চিকিৎসার কোন বিকল্প নেই ।

টেরি সেই টাকা সংগ্রহেই ব্রতী হয় । প্রথমে টেরির মা টেরিকে অনুমতি দিতে চাননি । কিন্তু মায়ের কাছেই যার সত্যনিষ্ঠার দীক্ষা, তাকে মা কী করে ঠেকাবে? তাই শেষ পর্যন্ত্য মাকে সায় দিতে হয় । সহযাত্রী হয় বন্ধু ডগ আর একটি ভ্যান । প্রস্তুতি পর্বের আঠার মাস ধরে পাঁচ হাজার কিলোমিটার দৌড়ের পরে কানাডার পূর্বপ্রান্তের নিউ ফাউন্ডল্যান্ড থেকে টেরি যাত্রা শুরু করে ১৯৮০ সনের ১২ই এপ্রিল । প্রতিদিন ম্যারাথনের সমান দূরত্ব (২৬ মাইল) দৌড়ে কানাডার পুর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পাড়ি...লক্ষ্য একটাই...প্রতিটি কানাডিয়ানের কাছ থেকে একটি করে ডলার সংগ্রহ করা । তখনকার কানাডার জনসংখ্যা ২২ মিলিয়ন । টেরির সেই স্বপ্নের ম্যারাথনের নাম “ম্যারাথন অফ হোপ” ।

একশ তেতাল্লিশ দিনে পাঁচ হাজার তিনশ তিয়াত্তর কিলোমিটার দৌড়ের পর দূর্বিনীত এই তরুনকে থামতে হ’ল । ততদিনে ক্যান্সার ছড়িয়ে গেছে শরীরের অনেক জায়গায়...১৯৮১র ২৮শে জুন মাত্র বাইশ বছরের টেরি এই পৃথিবী থেকে চলে যায় অন্যলোকে...

৩.

টেরি যাত্রা শুরু করেছিল আটলান্টিকের তীর থেকে । বোতলে ভরে নিয়েছিল সমুদ্রের নোনা জল । ইচ্ছে ছিল প্রশান্ত মহাসাগরে সেই পানি ফেলে দিয়ে যাত্রার ইতি টানবে । যাত্রা পথে ক্যান্সারের গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহ করবে । ক্যান্সার টেরিকে তার অভিযাত্রা শেষ করতে দেয়নি...কিন্তু টেরির ম্যারাথন অফ হোপ এখন পর্যন্ত্য পৃথিবীর নানা প্রান্তে ক্যান্সার রোগিদের জন্য স্বপ্নের প্রতীক হয়ে আছে । আজ পর্যন্ত্য টেরির ম্যারাথন ৬০০ মিলিয়ন ডলার ক্যান্সার গবেষণার উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করেছে । আজকের কোন টেরিকে আর অস্টিওজেনিক সারকোমার কাছে পা হারাতে হয় না...টেরির ম্যারাথন ক্যান্সার গবেষণা, উন্নত চিকিৎসার অনুপ্রেরনা হয়ে আছে । কে জানে কত অসংখ্য ক্যান্সার রোগির দীর্ঘায়িত জীবনের পেছনে আছে এই দূর্বিনীত তরুন?

৪.

২০০৪ এর সেই The Greatest Canadian শোতে দর্শকের ভোটে শীর্ষস্থানের টমি ডগলাসের পরেই টেরি ফক্স জায়গা করে নেয় । সেই থেকে টেরি নির্ঝর আর ওর মায়ের “হিরো” হয়ে গেল । ওদের ঘরের দেয়ালে টেরির পোস্টার লাগানো হ’ল ।

জীবন কী বিচিত্র! ঠিক তিন বছরের মাথায় নির্ঝরের মাকে শুনতে হ’ল ক্যান্সারের হিমশীতল ডায়াগনোসিস । টমি ডগলাস আর টেরি ফক্স দু’জনেই কী ভীষনভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে গেল নির্ঝরের আর ওর মায়ের জীবনে!

৫.

কানাডায় থাকার কারনে নির্ঝরের মা পেল সরকারীখাতের চিকিৎসা । ক্যান্সার চিকিৎসার দীর্ঘ যাত্রায় নির্ঝরের মা কোন একটা মুহুর্তের জন্যেও ভূলেনি ফেলে আসা ছোট্ট দেশটির কথা, যে অভাগা দেশের ক্যান্সার রোগিদের তার মত এমন ভাল ভাগ্য হয় না । কেমন করেইবা ভূলবে...১৯৭৮ এ ক্যান্সারের কাছে উনত্রিশ বছরের বড় বোনকে হারিয়েছে না সে?

৬.

১৯৭৮ থেকে এই এতগুলো বছরে ক্যান্সার রোগি কতগুন বেড়েছে বাংলাদেশে? কতজনকে পাড়ি জমাতে হয় বিদেশে চিকিৎসার জন্য? কতজনকে ভিটেমাটি বিক্রি করতে হয়? কতজনকে পত্রিকায় সাহায্য চেয়ে বিজ্ঞাপণ দিতে হয়? কতজন এর কিছুই করতে পারে না? এর কোন পরিসংখ্যানই নেই নির্ঝরের মায়ের কাছে । টেরির মত কিছু করার সামর্থ্যও তার নেই । আছে শুধু দূর্বিনীত একটা স্বপ্ন । বাংলাদেশের মাটিতে একটা অন্ততঃ ক্যান্সার হাসপাতাল একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে ।

৭.

সেই থেকে নির্ঝরের মা আন্তর্জাল হাতড়িয়ে আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপাতালের প্রকল্পের খোঁজ পায় । ২০০৫ সালে শুরু হওয়া এই হাসপাতালটি এখনো শেষ হয়নি । সরকার ও জনগণের আর্থিক অনূদানে ধীরগতিতে এগোচ্ছে হাসপাতালটির কাজ । নির্ঝরের মা তার ক্ষুদ্র সামর্থ্য থেকে আর কীইবা করতে পারে? তাই নির্ঝরের জন্মদিনে উপহারের বদলে হাসপাতালটির জন্য অনূদান সংগ্রহ করে । এবারের জন্মদিনে নির্ঝরের বন্ধুরা সবাই বিভিন্ন রকম মিউজিক্যাল ইন্সট্রুম্যান্ট বাজিয়েছে আর মোট ৭৩০ কানাডিয়ান ডলার অনুদান দিয়েছে হাসপাতালটিতে ।

নির্ঝরের মা আশায় বুক বেঁধে আছে একদিন হাসপাতালটির কাজ শেষ হবে । কিছু মানুষ অন্ততঃ চিকিৎসা পাবে...হয়তোবা নির্ঝরের মত কোন শিশু...ওর মায়ের মত কোন মা...টেরির মত কোন এথলেট...

...........................................................................

রেফারেন্সঃ

The Greatest Canadian

টেরি ফক্স

আহছানিয়া মিশন ক্যান্সার ও জেনারেল হাসপাতাল

...........................................................................

ছবি: 
02/12/2010 - 2:04পূর্বাহ্ন
02/12/2010 - 2:04পূর্বাহ্ন
02/12/2010 - 2:04পূর্বাহ্ন
02/12/2010 - 2:04পূর্বাহ্ন
02/12/2010 - 2:04পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

ধুসর জলছবি এর ছবি

নির্ঝরের মায়ের সপ্ন পুরন হোক। টেরি ফক্সের কথা জেনে অদ্ভুত ভাল লাগল।
চলুক চলুক

ক্রেসিডা এর ছবি

খুব সুন্দর লাগলো আপনার উপস্থাপন।

ভালো থাকবেন।

__________________________
বুক পকেটে খুচরো পয়সার মতো কিছু গোলাপের পাঁপড়ি;

মরুদ্যান এর ছবি

নির্ঝরের মায়ের স্বপ্ন পূরণ হোক।

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

স্বপ্ন পূরণ হোক।
চলুক

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

পদ্মজা এর ছবি

আমরা স্কুলে পড়তাম তখন ঢাকায় টেরি ফক্স রান হোত। এখন হয় কি না, জানি না।

তারেক অণু এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ এমন লেখার জন্য। আমার জীবনের নায়কদের একজন উনি।

তাসনীম এর ছবি

নির্ঝরের মায়ের স্বপ্ন পূরণ হোক।

টেরি ফক্স রান হতে দেখেছি বাংলাদেশ।

নির্ঝরের মায়ের মতো আমার মা'ও কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, ২০০৫ সালে। আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতালেই চিকিৎসা হয়েছে - আম্মার ডাক্তার ওই হাসপাতালে জড়িত ছিলেন। ক্যান্সার চিকিৎসা একটি অতন্ত্য ব্যয়বহুল চিকিৎসা। পুরো পরিবারের জন্যই এটা এক দুঃসহ অভিজ্ঞতা।

আহসানিয়া মিশন হাসপাতালটার কথা আমি অবশ্য আমি আগে থেকেই জানতাম - ওটার জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করেছিলাম। সফল হোক ওদের এই হাসপাতাল প্রজেক্ট।

লেখাটি ছড়িয়ে পড়ুক।

শুভকামনা।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

রায়হান আবীর এর ছবি

চলুক

বাহিরি এর ছবি

ভাল লেগেছে। স্বপ্ন পূরণ হোক।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

নির্ঝরের মায়ের স্বপ্ন আলোর মুখ দেখুক।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আশরাফুল কবীর এর ছবি

অনেক দারুন! উত্তম জাঝা!

বন্দনা এর ছবি

এমন কিছু মানুষ আছে বলেই অধরা স্বপ্নগুলা এই ধরাধামে আমাদের নাগালে এসে ধরা দেই।এই মানুষগুলার জন্য শুভকামনা থাকলো।

সাফি এর ছবি

নির্ঝরের মায়ের স্বপ্ন পূরণ হোক।

ঢাকায় ক্যানাডিয়ান হাই কমিশনের উদ্যোগে আয়োজিত টেরি ফ্ক্স রানে দৌড়ানোর অভিজ্ঞতা হয়েছিল ঃ)

তিথীডোর এর ছবি

চলুক

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়লাম লেখাটা , অসাধারণ এককথায় |
//সারাজীবন

অতিথি লেখক এর ছবি

”মানুষ আসলে তার স্বপ্নের চেয়েও বড়” । টেরির কথা জানতাম না । খুব ভাল লাগলো ।
নির্জরের মায়ের স্বপ্ন পূরণ হোক-এই শুভকামনা । (পান্থজন)

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

নির্ঝরের মায়ের স্বপ্ন পূরণ হোক!
মন ছুয়ে গেল লেখাটা।
ভালো থাকবেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।