আমার বন্ধু-----(দ্বিতীয় পর্ব)

অনিকেত এর ছবি
লিখেছেন অনিকেত (তারিখ: বুধ, ০৮/১০/২০০৮ - ৫:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[এখানে যা যা উল্লেখ করা হচ্ছে, সবই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। স্মৃতি প্রতারক। কাজেই তথ্য বিচ্যুতি বা অন্য কোন স্খলনের জন্য আগেই ক্ষমাপ্রার্থী। স্মৃতিচারনে আমি কারো ব্যক্তিগত নাম উল্লেখ করা পছন্দ করি না। কারন এতে করে কোন একজন সম্পর্কে শুধু একটি লোকের মতামত জানা যায়---যেটা অনেক ক্ষেত্রেই পক্ষপাত দুষ্ট। যেসব ক্ষেত্রে আমি একেবারেই এড়াতে পারব না---সেসব ক্ষেত্রে হয়ত নাম উল্লেখ থাকতে পারে।]

-----------------------------------------------------------------------
(প্রথম পর্বের পর)

আমার তৃতীয় ও সম্ভবত 'শেষ' রদ্দা থেকে বাচালো---মানস। হৈ হৈ করে বলল, আরে মিয়া আইসা পড়ছ তাইলে!! তারপর দৈত্যের দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ ফরিদ, এরে কি ভয় দেখাইতেছ নাকি? ফরিদ নামের সে দৈত্য ফিচিক করে হেসে বলল, আরে মিয়া তুমি আরেকটু দেরী করলে এইটা প্যান্ট খারাপ কইরা দিত।
আমি অবাক হয়ে শুনলাম, ফরিদ প্রায় বোধগম্য ভাষায়ই কথা বলছে। তাহলে একটু আগে কি শুনেছিলাম? ফরিদ এক টানে আমার বিশাল বোঁচকা কাধে তুলে নিয়ে শিষ দিতে দিতে এগুলো। পেছনে পেছনে আমি আর মানস। মানস ও আমার সাথে পড়ে, একই ডিপার্টমেন্টে। আমি তার সাথেই থাকব বলে স্থির হয়েছে।দশ ফুট বাই বারো ফুট এর ঘরে আমি ও মানস ছাড়া আরেকটি প্রানী রয়েছে। সেইটিও একই বিভাগের।আমার নেমসেক!

ঘরে ঢুকতেই একটা ভেজা কলাপাতার মতন গন্ধ এসে লাগল। আর্দ্র, কোমল একটা গন্ধ। ঘরে তিনটা খাটিয়া/চৌকি পাতা---অনেকটা ইংরাজী "U" অক্ষরের মত করে। U- এর দুই হাতে দুই চৌকি----মানস আর তারেকের। আমার চৌকি অবশিষ্ট বাহুতে।

প্রথমেই যেটা নজরে পড়ল---সেটা হল সবগুলো চৌকি দেখা যাচ্ছে বেশ উঁচু। চৌকির স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে এমনতর প্রবৃদ্ধি ঠিক কি কারনে হয়েছে জানা গেল একটু পরেই। চৌকির চার পায়াই দেখা গেল
গড়ে তিনটা ইটের উপর বসানো।মানসকে জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল---এখানে খুব সাপের উৎপাত। রাতের বেলা যেন দুম করে মাটিতে পা না পড়ে সে জন্য চৌকি গুলোকে উঁচু করা হয়েছে।

আমি কোঁৎ করে ঢোক গিলে বললাম, ইয়ে কি বললে তুমি? সাপ?? এখানে??

--আরে হ্যা সাপ! আমরা তো ডেইলি তিন-চারটা করে সাপ মারি বিকেলে। ইনফ্যাক্ট, আমাদের সাইড কিন্তু লিডিং---সাপের বডি কাউন্টে!!

--দাঁড়াও,দাঁড়াও। আমাদের সাইড? বডি কাউন্ট? প্রায় তোতলাতে তোতলাতে আমার প্রশ্ন।

-- আরে মিয়া হোষ্টেলের তো দুই সাইড (প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য)। উত্তর সাইডে আমরা--সায়েন্সের পোলাপান---আর দক্ষিন সাইডে ইকোনোমিক্স।

--- আর বডি কাউন্ট?

---- ওহ, আমাদের এখানে কম্পিটিশান চলছে। কোন সাইড কত বেশি সাপ মারতে পারে। এখন পর্যন্ত আমাদের সাইড এগিয়ে আছে। আমরা এখন পর্যন্ত -----টি সাপ মেরেছি (সঠিক সংখ্যাটি মনে নেই,তবে দশের বেশি, বিশের কম)।

আমার হঠাৎ কেন জানি খুব দুর্বল লাগতে শুরু করে।

অল্প কিছুক্ষন পরেই আমাকে এক তেপান্তরের মাঠে অনেক গুলো সাপের মাঝে রেখে সুয্যিমামা সেদিনের মত বিদায় নিলেন। ঘরে ঘরে টিমটিমে বাতি জ্বলছে। এক রুম থেকে আরেক রুম দরমার বেড়া জাতীয় কিছু দিয়ে পৃথক করা। আশে পাশের রুমে নানান জন নানা কিছু নিয়ে আলাপ করছে। অধিকাংশ আলাপের বিষয়বস্তু PG 13 থেকে শুরু করে R rated! কিছুক্ষন পর পর হো হো করে হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে।
ভেসে আসছে নানান বাক্যবন্ধ যে গুলো আমি এর আগে কখনো কোথাও শুনিনি। সেগুলো শুনে আমি আমোদিত হবার বদলে আরো ভীত হয়ে পড়লাম।

এ কোন জায়গায় এসে পড়লাম রে বাবা! এরা এই রকম করে কথা বলছে কেন?

এরই মাঝে হঠাৎ করে বিরাট হৈ চৈ শোনা গেল বাইরে। সাপের ভয়ে আমি খাটের উপর পা তুলে বসে আছি। আগুন না লাগলে বা বাথরুম না চাপলে আমি এখান থেকে আর নামছি না।

মানস ছুটে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। তারেক বেরিয়ে গেল জানালা দিয়ে! আক্ষরিক অর্থেই জানালা দিয়ে। তারেকের বিছানার পাশেই জানালা। জানালার পাল্লা খুলে দিলে কেবল ধু ধু অন্ধকার। তারেক তার টেবিলে বসে ছিল। সেখান থেকে তিন লাফে জানালার ফূটো দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমার চোয়াল ঝুলে খাটে নেমে পড়ল। এ কি রে বাবা, এতো সাক্ষাৎ--হনুমান!!!

বাইরে হৈ চৈ ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। কেন জানি একটা মিছিল মিছিল ভাব এসে গেছে হৈ-হল্লার আওয়াজে। আমি খাটের উপর একা বসে উসখুস করছি, যাবো কি যাবো না।
এমন সময় মানস এসে বলল, জলদি আস মিয়া। মাহফুজরে ধইরা পানিতে ফালানো হইতাসে।

মাহফুজ কে বা কেনই তাকে পানিতে ফেলা হচ্ছে --এসব প্রশ্ন অবান্তর। আমি সাহস করে খাট থেকে নেমে মানসের পেছনে ছুট লাগালাম। দেখা গেল অনতিদূরে একটা জংলা ডোবার মতন কিছু আছে। সে দিকে দশ বারো জনের একটা দল মিছিল করে যাচ্ছে।
মিছিলে দুই তিনটা মশাল জ্বলছে। সেই আলোয় দেখা গেল ছেলেপিলের কাঁধে এক ভারী "অনিচ্ছুক" প্রানী ছট-ফট করছে। মনে হল এইটাই "মাহফুজ"। সমস্বরে শ্লোগান দিতে দিতে (শ্লোগানের ভাষা অ-মুদ্রনযোগ্য বিধায় উল্লেখ করা হলো না) মিছিল ডোবার কাছে থামল। মিছিলের সব আওয়াজ ছাপিয়ে সেই ছটফটে প্রানীর চিৎকার শোনা গেল----'শুয়ারের বাচ্চারা, আমারে যদি আইজকা আবার পানিতে ফেলছস---তাইলে--"
মাহফুজের হুমকিটা ঠিক শোনা গেল না লোক জনের হৈ হৈ এর কারনে।"দে দোল দোল" করে মাহফুজ কে দেখলাম সেই ডোবায় ছুড়ে ফেলা হল। ছুড়ে ফেলে দিয়েই সবাই 'কিছুই যেন হয়নি" এ রকম ভাব করে যার যার রুমের দিকে রওনা দিল। আমার চেহারাতে বোধ করি আতংক-বিস্ময় একেবারে মাখামাখি হয়েছিল।

--"ডরাইয়েন না স্যার, মাহফুজ স্যার রে দুই দিন বাদে বাদেই এরা পানিত চুবায়।" ফিরে দেখি ছোট্ট একটা ছেলে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে হাসি মুখে। দেখা গেল তার কথা সত্যি। মাহফুজ নামের সে প্রানী দেখলাম আছড়ে পিছড়ে ডোবা থেকে উঠে এল। সারা গায়ে কাঁদা লেপ্টানো।বৃষ্টির মত পানি ঝরছে গা থেকে। গজগজ করতে করতে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাহফুজ থমকে দাঁড়াল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি, নতুন নাকি?

আমি মাথা নাড়লাম।

-ওয়েলকাম, ওয়েলকাম।

বলেই শিস দিতে দিতে রুমের দিকে রওনা দিল।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

এ কোন জায়গায় এসে পড়লাম আমি---!!!

(চলবে)


মন্তব্য

ধুসর গোধূলি এর ছবি
অনিকেত এর ছবি

দেঁতো হাসি

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

ভালো লাগলো অনিকেতদা, কেমন যেনো আমিও আমার অতীতে চলে গেলাম।

স্মৃতি সততই দুঃখের, তা সে সুখের হোক আর দুঃখেরই হোক, ইধার সে ভী কাটেগা উধার সে ভী। চলো ইয়েভী সহি।

ভালো থেকো।

------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

অনিকেত এর ছবি

তুমিও ভালো থেকো বস

রেনেট এর ছবি

হো হো হো
আপনার লেখার ভংগি খুবই মজার। চালিয়ে যান বস (শেষ করলে খবরাছে!)
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

অনিকেত এর ছবি

হা হা হা--- দোয়া রাইখো বস

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক...

কল্পনা আক্তার

.............................................................................................
সব মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা

মাহবুব লীলেন এর ছবি

চোখের সামনে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি হয়ে ওঠার গল্প

চলুক

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আচ্ছা অর্থনীতির নাসিম সাঈদী (নাম যদি ভুল না করে থাকি) কি আপনাদের ব্যাচ?



তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আলমগীর এর ছবি

উনারা একই ব্যাচের। কী করছে নাসিম ভাই?

আলমগীর এর ছবি

শুভ ভাই, সাহস করে নাম নিছেন বলে দেখছেন কত ভাল হইছে লেখা হাসি

রণদীপম বসু এর ছবি

হা হা হা ! মজা পাচ্ছি খুব ! চালাতে থাকুন। সহজে থামাবেন না।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমি হইলে ফিরতি বাসেই ফেরত আসতাম... সাপের নাম শুনলেই আমি দৌড়...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অনিকেত এর ছবি

উপায় ছিল না নজরুল ভাই। উপায় থাকলে, আপনার আগে আমি বাস ধরতাম।

ভাঙ্গা মানুষ [অতিথি] এর ছবি

"মাহফুজ"-এর চুবানি-রহস্যের তো কিনারা করলেন না!!!

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

চরম হচ্ছে বস! হো হো হো
আপনি কি জাফর ইকবালরে পাইসিলেন? তাইলে উনার সম্পর্কেও কিছু লিখেন।
আপনার তো অনেক সাহস! সাপ-টাপ থাকলে, ওই অবস্থায় মনে হয় না আমি থাকার সাহস করতাম!
পরের পর্ব তাড়াতাড়ি!

অনিকেত এর ছবি

জাফর স্যার কে পেয়েছিলাম---কিন্তু অনেক পরে।
আর সাপের ভয়?? আমারে কি তোমার খুব সাহসী মনে হয় রে ভাই?

উপায় ছিল না বস, তাই সাপ-টাপ নিয়েই থাকতে হয়েছে।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

হে হে। চলুক
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

আহা আমি গাঁ গঞ্জের লোক, সাপের এত নিন্দা সয় না। সাপেরা এমনিতে কিছু বলে না, কিন্তু ওদের ঘরবাড়ী খানাপিনা দখল হয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাবে তখন বেচারারা?
ওদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিলো। কাছাকাছি কোনো অভয়ারণ্যে।

রানা মেহের এর ছবি

দারুন জমেছে
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অনিকেত এর ছবি

থ্যাঙ্কু

নজমুল আলবাব এর ছবি
তুলিরেখা [অতিথি] এর ছবি

শিয়ালেরা মিটিং‌ করতো? ও বাব্বা! খুব উঁচুদরের তো!
অবশ্য, করবে নাই বা কেন?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।