দরিদ্র মানুষের সেবায়ঃ এডরিক এস. বেকর

অরফিয়াস এর ছবি
লিখেছেন অরফিয়াস (তারিখ: শনি, ৩১/১২/২০১১ - ১২:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মানবতার সেবায় নিরবে-নিভৃতে কাজ করে যাওয়া মানুষের সংখ্যা খুব বেশি হয়তো নয়, সময়ের স্রোতে হারিয়ে যাওয়া আদর্শের- এই বর্তমানে তবুও কিছু মানুষ আছে, যারা নিজেদের জীবন অপরের জন্য বিলিয়ে দেয়| অনেক মানুষের ভিড়ে তাদের কথা হয়তো আমাদের সামনে আসেনা| এরকমই একজন মানুষ চিকিৎসক এডরিক এস. বেকর, দুস্থ মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে ৩২ বছর এর বেশি সময় ধরে নিরলস কাজ করে চলেছেন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ১১০ কি.মি দূরের টাঙ্গাইল জেলার কায়লাকুড়ি গ্রামে|

১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ড এর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এডরিক এস. বেকর, চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা সম্পন্ন করেন ১৯৬৫ সালে অতেগো মেডিকেল কলেজ, ডুনেদিন থেকে, তারপরেই তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আর্ত-মানবতার চিকিৎসাসেবা প্রদানের সাথে জড়িত হন| তিনি কাজ করেছেন ভিয়েতনাম সহ আরও কয়েকটি দরিদ্র দেশে| ভিয়েতনামে কাজ করার সময়ই জানতে পারেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা| তখন থেকেই ইচ্ছা ছিলো যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে কাজ করার| ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন যুদ্ধ-বিধ্বস্থ ভিয়েতনামে, তারপরে তিনি চলে আসেন ইংল্যান্ড এ, চিকিৎসাশাস্ত্রে আরো পড়াশোনা করার জন্য| তারপর ১৯৭৯ সালে তিনি আসেন বাংলাদেশে| প্রথমে তিনি কিছু চিকিৎসাকেন্দ্রে কাজ করেন, কিন্তু দুস্থ মানুষের সেবায় সরাসরি জড়িত হবার উদ্দেশ্যে তিনি পরে থানারবাইদ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে যোগদান করেন| কিন্তু কোনো ভাবেই সন্তুষ্ঠ হতে পারছিলেননা, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, গ্রাম্য-দরিদ্র মানুষকে স্বাস্থ্য-সেবা দিতে হলে, সর্বপ্রথম তাদেরকে স্বাস্থ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছনতা, চিকিৎসাসেবা এসব বিষয়ে ধারণা দিতে হবে| দুস্থ মানুষকে সেবা করার এই তাগিদ থেকেই তিনি পরে কায়লাকুড়ি গ্রামে প্রায় ৩ একর জায়গা নিয়ে তৈরী করেন তার স্বপ্নের স্বাস্থ্য-সেবাকেন্দ্র|

দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে তিনি নিরলস পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছেন তার সেবাকেন্দ্রটি| নামমাত্র মূল্যে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫০ মানুষের জন্য সেবা প্রদান করছেন| নতুন রোগীদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ফি মাত্র ১০ টাকা এবং পুরনোদের জন্য মাত্র ৫ টাকা| রেজিস্ট্রেশনের পর সবাইকে ধারণা দেওয়া হয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে| সেবাকেন্দ্রে ৪০ জন পর্যন্ত রোগীকে ভর্তি করারও ব্যাবস্থা রয়েছে, এরজন্য এককালীন রোগীপ্রতি ১০০ টাকা এবং তার সাথের আত্মীয় এর থাকার জন্য ২০০ টাকা নেওয়া হয়| যদি কোনো দুস্থ রোগী এই পরিমান টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে তাহলে তাদের জন্য চিকিৎসা করা হয় বিনামূল্যে| রোগীদের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার প্রদানের লক্ষ্যে তিনি তৈরী করেছেন সবজি বাগান, দুধ এর জন্য পালন করা হয় গাভী| খাবার খরচ হতে আনুষঙ্গিক সব খরচ বহন করে তার সেবাকেন্দ্র| বর্তমানে প্রায় ১০ টি গ্রামের মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করে চলেছে তার সেবাকেন্দ্রটি| ১৯৮৩ সালে স্থাপন করা এই সেবাকেন্দ্রটি দুস্থ মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণে কাজ করে চলেছে অবিরত| সাধারণ মানুষের কাছে "ডাক্তার ভাই" হিসেবে পরিচিত এডরিক এস. বেকর বাংলা বলতে পারেন আর দশজন সাধারণ বাংলাদেশীদের মতই| জীবনের ৩২টি বছর তিনি পার করে দিয়েছেন নিজের জন্মভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এই দেশে, দুস্থ মানুষের জন্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে|

তার চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে ডায়বেটিক রোগীদের জন্য আছে আলাদা একটি পরিচর্যাকেন্দ্র| এর আওতায় ৪টি উপজেলার প্রায় ১১০০ মানুষ চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন| মা ও শিশুর জন্যও আছে আলাদা ব্যাবস্থা| মা ও শিশু সেবার আওতায় চিকিৎসা পাচ্ছে প্রায় ১৭টি গ্রামের মানুষ| তার সহায়তায় আছে গ্রামের প্রায় ১০০ জন তরুণ-তরুণী, যাদের সবাই স্বল্পশিক্ষিত, এডরিক বেকর যাদের তৈরী করেছেন নিজের হাতে, নিজে শিখিয়েছেন চিকিৎসাসেবার খুঁটিনাটি|

সেবাকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য সব অর্থ সাহায্যই আসে এডরিক বেকর এর পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন থেকে| তিনি প্রতি বছর একবার নিজ দেশ নিউজিল্যান্ড যান, সেখানে গিয়ে ঘুরে ঘুরে তিনি তার সেবাকেন্দ্রের জন্য অর্থ-সাহায্য জোগাড় করেন| সম্পূর্ণভাবে বেসরকারী অর্থ-সাহায্যে পরিচালিত তার এই সেবাকেন্দ্রটি নিরলস ভাবে বিনাস্বার্থে কাজ করে চলেছে গ্রামের দুস্থ মানুষদের জন্য, যেকোনো সরকারী সেবাকেন্দ্র থেকে ভালোভাবে| নিজের দেশের সম্ভ্রান্ত আরাম-আয়েশের জীবন ছেড়ে, বহু দূরের বাংলাদেশে কাজ করে চলেছেন এই মানুষটি| তার থাকার ঘরটি মাটির তৈরী, মাটিতেই ঘুমানোর ব্যাবস্থা| নূন্যতম সুযোগে তিনি নিজের জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন শুধুমাত্র আর্ত-মানবতার সেবার মহান উদ্দেশ্যে| বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে ফেলা ৭০ বছর বয়স্ক চিকিৎসক এডরিক এস. বেকর এর জীবনের আকাংখা খুব বেশি কিছু নয়, তিনি শুধু চান দুস্থ মানুষের সেবার জন্য তার গড়ে তোলা এই সেবাকেন্দ্রটি যেনো তার মৃত্যুর পরে যোগ্য লোকের হাতে পরিচালিত হয়| যেনো মানুষের সেবার মহান উদ্দেশ্যেই চালিত হয় তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি, যেনো তার মতই কেও এগিয়ে আসে এই ব্রত নিয়ে| সাধারণ পোশাক গায়ে অতি সাধারণ একটি সাইকেলে করে ঘুরে বেরোনো এই মানুষটির চোখে যে অসাধারণ স্বপ্নটি আছে, তার ভার বহন করার ক্ষমতা কতজনের আছে জানিনা|

দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজের জীবন উত্সর্গ করা, চিকিৎসক এডরিক এস. বেকর এর এই স্বপ্নকে সফল করতে হয়তো এগিয়ে আসবে অন্য আর একজন তারই মতো, আর এভাবেই বেঁচে থাকবে মানবতার গল্প, ত্যাগের গল্প, সর্বোপরি মানুষের প্রতি মানুষের নির্মোহ ভালোবাসার গল্প| আর কিছু না পারি, অন্তত এইটুকু আশা করতে তো দোষ নেই|

ছবি: 
02/12/2009 - 12:22am

মন্তব্য

উচ্ছলা এর ছবি

চমৎকার লাগলো উনার সম্পর্কে জেনে। দু' একটা লিঙ্ক শেয়ার করতে পারেন যাতে আরও কিছু জানা যায় উনাকে নিয়ে?...তাঁকে নিয়ে আমার ম্যাগাজিনে লিখতে পারলে দারুন হতো। তাঁর সেবাকেন্দ্রের জন্য হয়ত কিছু ডোনার, স্পন্সারের সংখ্যা বাড়ত।

অরফিয়াস এর ছবি

লিঙ্ক ১

লিঙ্ক ২

লিঙ্ক ৩

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

উচ্ছলা এর ছবি
তাপস শর্মা এর ছবি

জাস্ট হ্যাটস অফ...............। দুনিয়াকে বদলানোর রাস্তা তো অনেক দীর্ঘ। এদের মত কিছু মানুষের হাত ধরেই বোধ হয় উত্তরণ আসে। আর সত্যিই কখনো কখনো মনে হয় এই পৃথিবীর সবটা এখনও নষ্টদের হাতে চলে যায় নি । এরা আছে বলেই হয়তো পৃথিবী এখনও শ্বাস নিতে পারে।

আলাদা ভাবে এই মানুষটির কথা তুলে আনার জন্য লেখককে অনেক অভিনন্দন ।

অরফিয়াস এর ছবি

ধন্যবাদ, তাপস দা| না, পৃথিবীটা এখনো নষ্টদের হাতে চলে যায়নি, কখনো যেতে পারেনা...

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

রাসেল এর ছবি

স্যালুট এডরিক এস. বেকর

অরফিয়াস এর ছবি

ধন্যবাদ| তবে ভালো হয় যদি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন এই মহৎ উদ্যোগের কথা...

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

অরফিয়াস এর ছবি

ধন্যবাদ| তবে ভালো হয় যদি সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারেন এই মহৎ উদ্যোগের কথা...

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

আয়নামতি এর ছবি

অচেনা আপনজনটির জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা, কৃতজ্ঞতা! লেখককে ধন্যবাদ।

অরফিয়াস এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকেও সময় করে পড়ার জন্য, সবাই জানুক এই মহৎ উদ্যোগের কথা ...

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

শ্যামল এর ছবি

স্যালুট।

অরফিয়াস এর ছবি

ধন্যবাদ ..

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ভ্যালেরি টেলর বা এডরিক এস. বেকর এর মতো মানুষদের মনোজগত সম্পর্কে বুঝতে অক্ষম আমি। যেদিন প্রথম ভ্যালেরি টেলরের কর্মযজ্ঞ সম্পর্কে জেনেছি সেদিন মনে হয়েছিল এই মহিলার জীবনের উদ্দেশ্য কি। নেহায়েত মানবতার জন্য কাজ করার মতো মানুষ এই পৃথিবীতে বেঁচে আছে ভাবতেও অবাক হই বারবার। আজও এই ভদ্রলোকের সম্পর্কে পড়ে একই প্রশ্ন জাগলো।

এই মানুষগুলো পৃথিবীর সবগুলো ধর্মের চেয়ে মহত্তর কর্মে লিপ্ত আছে। তবু ধর্ম দাবী করে তারাই শ্রেষ্ঠ। আমি বলি, সকল ধর্মেরই নতজানু হওয়া উচিত এই মানুষগুলোর মানবধর্মের কাছে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অরফিয়াস এর ছবি

তথাকথিত ধর্মব্যাবস্থা মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করে, মানুষ পরিবর্তন-ভীতু, তাই চলে আসা সমাজ ব্যাবস্থাকে পাল্টে দিয়ে এগিয়ে যেতে ভয় পায়, স্রোতের বিরুদ্ধে দাড়াতে পা কাঁপে.. কিন্তু কিছু মানুষ নিরবে-নিভৃতে বিপ্লবের সূচনা করে যাচ্ছেন, মানবিকতার যে দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করে যাচ্ছেন তা আমাদের প্রচলিত সমাজকে একদিন ঠিকই বদলে দিবে বলে আশা রাখি..

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

আহারে! এতো অসাধারণ একজন মানুষ! আমি দেশে গেলে অবশ্যই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। আপনার পরিচিত হলে তাঁকে আমার শ্রদ্ধা জানাবেন।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

অরফিয়াস এর ছবি

ধন্যবাদ, উনি আমাদের অনেক কাছের মানুষের থেকেও হয়তো বেশি পরিচিত ...

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

তারেক অণু এর ছবি

শ্রদ্ধা, আর অক্ষমতা জাগে তাদের মত একজন বড় মনের মানুষে পরিণত না হবার জন্য।

অরফিয়াস এর ছবি

ধন্যবাদ, তাদের আলোকে আমরাও হয়ে উঠবো এক একজন খাঁটি মানুষ ...

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।