মনোজ্ঞ সঙ্গীত সন্ধ্যা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ১৩/১১/২০১০ - ৯:২২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আয়োজনটি শহরের উত্তর প্রান্তের ক্লাবঘরটিতে। সারবেঁধে ড্রাইভওয়ে দিয়ে ঢুকছে ক্লাব সদস্যদের গাড়ি। বিশাল পার্কিং-এ গোটা ষাটেক গাড়ী আঁটে, তারপরও জায়গা হয় না। সামনের আর পাশের রাস্তায় পার্ক করা আরো শ'খানেক। ঝকমকে শাড়ীর চমক আর সুগন্ধী সৌরভ ছড়িয়ে লাস্যময়ী সদস্য-সদস্যারা আরো মোহময় করে তুলছেন সান্ধ্য আয়োজনটি। গাড়ী থেকে নেমে কুশলাদি সেরে ভীড় ঠেলে পথ করে নিচ্ছেন। দরজার ফাঁক গলে প্রায়ই পোর্চে হানা দিচ্ছে হলঘরের বাজনার আওয়াজ।

হলঘরে দ্রিম দ্রিম শব্দে বেজে চলেছে ড্রাম। সঙ্গে লিড গিটার,বেইজ গিটার আর কিবোর্ড। উন্মাতাল মূর্ছনার সাথে গায়িকার সুলোলিত কন্ঠের রেশ ছুঁয়ে যাচ্ছে উপস্থিত শ'তিনেক দর্শকের কান। বেশ কিছু মনও যে আলোড়িত হচ্ছে তাও বোঝা যায় তালে তালে মাথা নাড়া দেখে। অনেকেই নিজেরদের মধ্যে আলাপচারিতায় মগ্ন। সংসারের খুটিনাটি কিংবা পরিচিতজনের খোঁজখবর। মন্তব্যের চটপটির সাথে নতুন গুজবের মুড়মুড়ে ফুচকা।

"হাজার দর্শক, মন মাতাইয়া ..." ধ্বনিত হয় ভরা হলরুমের শেষ অবধি। হাজার না হোক, তিনশই সই। গায়িকার পূর্ণ পোষাকের ডিজাইনে সংক্ষিপ্ততার আবেদন। ছন্দের সাথে কোমরের দোলায় অজানা সুখের নিমন্ত্রনের আভাস। হলরুমটার অ্যাকোয়াস্টিকস ভাল। শব্দ পুরো টেনে না নিলেও, প্রতিধ্বনি নেই। গান ভাল লাগলে শোনবার পক্ষে আরাম। ছ'টা ঢাউস মাপের স্পীকার আর ত্রুটিহীন শব্দ প্রাণবন্ত করে তোলে সুশোভিত হলরুম।

যারা গান দেখতে চান তাদের জন্যও সুব্যবস্থা আছে। কোনায় কোনায় আর প্রতিটি থামের ঝুলান এলসিডি ডিসপ্লে। তিনটে ক্যামেরা ধারণ করে চলেছে গায়িকার প্রতিটি ক্ষণ, বাদ্যযন্ত্রীদের বাজানো। মাঝে মাঝেই দর্শকদের দিকে ঘুরে যাচ্ছে ক্যামেরা। যুগলবন্দিদের উপর কয়েক মুহুর্ত স্থায়ী। কারো লাজুক হেসে ত্রস্ত হাত ছেড়ে দেয়া, আবার প্রতিষ্ঠিত যুগলদের আরো ঘনিষ্টতা প্রমানের চেষ্টা। আলাপচারিতায় মগ্নদের আলাপের মোড় ঘুরে যায় ... অমুকের ছেলে না এটা ... ভাবীর গয়নাটা দেখেন ... উনিই আছেন ভাল, জীবনটাকে এনজয় করছেন ... ইত্যাদি।

মঞ্চের সামনে একটু জায়গা রেখে বসার ব্যবস্থা। ঐ একটু জায়গার ঠাঁই নিয়েই যুদ্ধ নবীন কিশোর-কিশোরীদের মাঝে। ছোট ছোট দলে জড়ো হয়ে তালে তালে নাচ। হিন্দী ছবির সর্বশেষ নাচের মুদ্রা রপ্ত সবারই। একজন একটা শুরু করলে অন্যরাও মুহুর্তমাঝে ধরে নেয়। দুয়েকজন আবার ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে আসা প্রমানের জন্য হিপহপের ভঙ্গিমা করে। বাকিদের কেউ কেউ নকল করার চেষ্টা করে। অন্যেরা নিজেরটাই চালিয়ে যায়, সকরুন চোখে। ক্যামেরার লেন্স এড়ায় না কিছুই।

একপাশে নেচে চলেন রূমি আংকেলও। সত্তুরোর্ধ রূমি আংকেল দেখতে অনেকটাই প্রফেসর শংকুর মত। মধ্যম উচ্চতা, গোলগাল সুখি সুখি মুখ, স্ফীত পেট। খালি আর্ধেক মাথা চুল আর মুখজোড়া শুভ্রশশ্রু, এই যা বেশকম। নাচের ভঙ্গিমাটা ছোটবেলার একটা খেলনার কথা মনে করায়। একটা ভালুক মাথার উপরে হাত তুলে আর নামায়, হাতের কাঠিগুলি কোমরে ঝোলান ড্রামের লেগে শব্দ হয়। রূমি আংকেলের কাঠিও নাই, ড্রামও নাই। তবু তিনি ঘুরে ঘুরে বাজিয়ে চলেন এক অদৃশ্য ড্রাম। গায়িকা গানের মাঝে মাঝে হঠাৎ থেমে মাইক্রোফোন বাড়িয়ে ধরেন নাচুনেদের দিকে। তাল ভুল না করেই পরের লাইন গেয়ে যায় নাচুনেরা। রূমি আংকেলের অঙ্গভঙ্গি বলে তিনিও তাদের থেকে পিছিয়ে নেই, যদিও পাশের মেয়েটির তির্যক দৃষ্টি ইঙ্গিতদেয় গানের কথা না মেলার। গাইতে গাইতেই হঠাৎ থেমে যায় বাজনা, নাচুনেরদল থেমে থাকে বাজনা শুরুর উদ্দেশ্য। রূমি আংকেলও থেমে থাকেন সেই ছোটবেলার খেলনা ভালুকের মত; সবকটা এলসিডি জুড়ে।

হলের পেছনদিকে খাবারের আয়োজন খোলা আকাশের নিচে। ছোট ছোট স্টলের সামনে লাইন। মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্লেট হাতে গল্পে মশগুল অনেকেই। মাথা ঝুঁকিয়ে অন্য পরিচিতজনদের সালাম কিংবা গল্পের সঙ্গিকে ফেলে রেখেই আরো গুরুত্তপূর্ণ কারো সাথে একান্ত আলাপের চেষ্টা। ব্যস্ত বারটেন্ডার গ্লাস আর অ্যাকাউন্টের হিসাব মেলাতে মেলাতে ঘর্মাক্ত। নিয়মবাঁধা মানুষেরা বাড়ীর পথে রওয়ানা দেয়।

রাত বাড়ে, গানের লয় বাড়ে, বাড়ে নাচের উদ্দামতা। নাচুনের সংখাও হয় দেখার মত। একটার পর একটা জমানো গানের অনুরোধ জমা হয় গায়িকার হাতে। উৎসাহী ড্রামার ঝরে পড়া ঘামের বিন্দুগুলো পিটিয়ে বেড়ায়। গিটারের কাজ নাচন ধরায় রক্তে। দৃঢ় হয় নতুন যুগলের হাতের বাঁধন। কিশোরীরা মায়ের চকিত চাহনিতে নজর রাখে। ধোঁয়া ধোঁয়া আবেশে লেজার আলোর ঝলকানিতে জীবনটাও স্বপ্নাবিষ্ট মনে হয়।

গাড়ীচালকদের অপেক্ষার ঘরে ইন্টারকমে নির্দেশ ভেসে আসে। বলা কথা কিংবা দেখতে থাকা টিভি প্রোগ্রাম অসম্পূর্ণ রেখেই ত্রস্তভঙ্গিতে গাড়ী আনতে ছোটে ডাক পড়া গাড়ীচালক। আর কিছুক্ষণ পরেই বিশ্রাম। অন্তত সকালের ডিউটির আগ পর্যন্ত।

অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এলিটদের ক্লাবে যাবেন, আইটেম গায়িকার গান শুনবেন আবার তা নিয়ে শ্লেষ করবেন - ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো না?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

সে আর বলতে! জীবনটাকে সরলরেখায় বাঁধতে পারার ক্ষমতা আমার জন্য কোন সহজ কথা নয়। হয়ত আপনাদের থেকে সাহস পাব।

তবে 'আইটেম' গায়িকা বলতে বাধছে। পরিবেশনের ভঙ্গিমায় আপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু সুরসাধনার শিল্পী সে অবশ্যই।

অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

শেষটা একটু ভাবালো!

অতিথি লেখক এর ছবি

অনুভূতি প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ।

অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

১. এই সব সঙ্গীত সন্ধ্যার চেহারা গোলাপ কলির মতো। রাত যতো বাড়ে ফুল ততোই খুলতে থাকে। সুবাস ছড়ায় চারপাশ থেকে। শব্দ গান ড্রাম গীটার অট্টহাসি ফিসফিসানী সব এক স্কেলে ও একই সুরে বাজতে থাকে।

২. মন্তব্যের চটপটির সাথে নতুন গুজবের মুড়মুড়ে ফুচকা।

জব্বর হইছে।

৩. গাড়ী চালকরা প্রথম প্রথম কিছু দিন ঐরকম থাকে, তারপর নিজেরাই স্বত‍‌স্ফুর্তভাবে ব্যস্ত থাকার উপাদান খুঁজে বের করে নেয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

উপমাটা সুন্দর। খালি একটা রাতেরই ফুল।

অমিত্রাক্ষর
অমিত্রাক্ষর@জিমেইল ডট কম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।