গ্রীক পুরাণের মহানায়কেরা - পর্ব ০৩

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৭/০৩/২০১৩ - ৭:৩৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

গ্রীক পুরাণ পড়তে গিয়ে একটা ব্যাপারে শান্তি পেয়েছি এই জেনে যে, শুধু আমরা বাংলাদেশীরাই ইতিহাসের ব্যাপারে গিট্টু লাগাতে ওস্তাদ নই। এই ব্যাপারে আরো বহু ওস্তাদ আছেন। সেই গ্রীক আমলেরই এমন এক ওস্তাদোকা ওস্তাদ হলেন ওভিড। ওভিড গ্রীক পুরাণ রচয়িতাদের মধ্যে সেরাদের কাতারেই পরেন কিন্তু তার কিছু কাহিনী অন্যদের কাহিনীর বিপরীত দাবী জানায়। এই ওভিড একাই মজার এক কাহিনী বর্ণনা করলেন যেখানে পার্সিয়াস সেরিফাসে ফেরার পথে সবার আগে থামেন হেসপেরিডেসে। এই সেই জায়গা যেখানে আদি টাইটান এটলাস তার কাঁধের ওপর সারা আকাশটার ওজন বহন করে যুগ যুগান্তর ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনিই এই হেসপেরিডেসের রাজা। এমন এক মান্যবরের সামনে এসে কি আর পরিচয় না দিয়ে থাকা যায়। কাজেই পার্সিয়াস বিনীত ভাবে নিজের পরিচয় দেন। আর সেখানেই লাগলো প্যাঁচ। পার্সিয়াস বলে উঠেন যে তিনি জিউসের সন্তান ও এই জায়গায় একটু বিশ্রাম নিতে চান। আর যায় কোথায়, পার্সিয়াসকে গালি দিয়ে, বকে, অপমান-অসম্মানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এটলাস। কি? অবাক হলেন? আসল কাহিনীর সূত্রপাত আর আগে। সেই আদিতে আরেক টাইটান থেমিস এটলাসকে বলেছিলেন একসময় জিউসের এক পুত্র আসবে হেসপেরিডেসে যে কিনা সোনালি আপেল চুরি করে নিয়ে যাবে (মহাবীর হেরাক্লিস)। কাজেই পার্সিয়াস জিউসের সন্তান শুনে সে সোনালী আপেলের পাহারাদার এটলাসের একটু আধটু রাগ উঠাটা স্বাভাবিক বৈকি।

এটলাস জোরপূর্বক পার্সিয়াসকে হেসপেরিডেস থেকে বের করে দিতে চাইলেন। পার্সিয়াস দেখেন এতো দেখি আরেক ঝামেলা। কিন্তু পার্সিয়াস না পারেন কিছু কইতে, না পারেন সইতে। কিছু কইতে গেলেই তো এটলাস পার্সিয়াসকে মোটামুটি আলু ভর্তা বানিয়ে দেবে। কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই পার্সিয়াসের মাথায় বুদ্ধির ঝিলিক দেখা দিলো। বেকুব এটলাসকে ধোঁকা দিয়ে তার ঝোলায় কি আছে দেখাতে চাইলেন পার্সিয়াস। এটলাসও কৌতূহলী হয়ে উঠলেন। নিজের চোখটা বন্ধ রেখে ঝোলা থেকে মেডুসার মাথাখানা বের করে পার্সিয়াস বাড়িয়ে ধরলেন এটলাসের দিকে। মেডুসা মারা গেলে কি হবে, তার মুখের জাদু তখনো একেবারে টাটকাই আছে। কাজেই বিশাল-দেহী এটলাস নিমিষে পরিণত হলেন গগনচুম্বী এটলাস পাহাড়ে। এই হলো কাহিনী কিন্তু সে ক্ষেত্রে যা আমরা সবাই জানি সেই কাহিনীর কি হবে? হেরাক্লিস - জিউসের আরেক সন্তান ও গ্রীক পুরাণের শ্রেষ্ঠ মহাবীরের (সম্ভবত) সেই বিখ্যাত কাহিনীর কি হবে? অন্যান্য কাহিনীকাররা তো লিখেছেন যে হেরাক্লিস সোনালী আপেল আনার সময় এই এটলাসকে ধোঁকা দিয়ে কাজ উদ্ধার করেছিলেন। তাহলে? এটলাস যদি আগেই পাহাড় হয়ে গিয়ে থাকে তবে পরের ঘটনাটা ঘটে কি করে? এ যে ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মরিয়া গেলো অবস্থা।

যাই হোক, পার্সিয়াস তো উড়ে উড়ে ফিরছেন সেরিফাসের দিকে। তিনি যখন ইথিওপিয়ার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছেন তখন হঠাৎ তার চোখ ঝলসে গেলো এক অপরূপ জ্যোতিতে। পার্সিয়াস চমকে গিয়ে নীচে তাকালেন। ওই যে নীচে। কি ওটা? মার্বেল পাথরের তৈরি কোনো মূর্তি নাকি? হুম, তাই তো মনে হয়। একটি অপরূপ নারী মূর্তি। পার্সিয়াস ভালো করে দেখার জন্যে একটু নীচে নেমে আসলেন এবং অবাক বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কোনো মূর্তি নয়। এ যে জলজ্যান্ত এক অপরূপ মনোহর রমণী। তার সারা শরীর থেকে ঈশ্বরপ্রদত্ত রূপ যেনো সূর্যের জ্যোতি হয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। কিন্তু এ কি? এমন রূপসী কেনো অঝোর-ধারায় কাঁদছে? পার্সিয়াস স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

প্রথম প্রথম তো কোনো কথাই বললো না সেই রূপসী। রূপের একটা দাম তো আছে নাকি? কিন্তু কিছুকাল পরে পার্সিয়াসের বিনয়ী ও সুন্দর আচরণে আস্বস্ত হয়ে সে তার দুঃখভরা কাহিনী বলা শুরু করলো। রূপসীর নাম এন্ড্রোমিডা। লেভান্টিন সাগরের উপকূলবর্তী ইথিওপিয়া মতান্তরে জপ্পার শাসক সিফিয়াস ও রাণী ক্যাসিওপিয়ার সুযোগ্যা কন্যা। কিন্তু রাণী ক্যাসিওপিয়ার মুখের লাগাম বলতে গেলে ছিলোই না। একদিন কথায় কথায় ক্যাসিওপিয়া বড়াই করে বলে বসলেন যে সমুদ্র-দেবতা পসাইডনের দরবারে যে সকল নেরেইডেরা অর্থাৎ সমুদ্র-দেবীরা থাকেন তাদের চাইতেও এন্ড্রোমিডা অধিক সুন্দরী। আর যায় কোথায়। দেবতা গেলেন চটে। প্রথমেই প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সারা রাজ্য বন্যায় ভাসিয়ে দিলেন। তাতেও কি আর রাগ কমে? এবার নিজের একান্ত অনুগত এক সমুদ্র দৈত্যকে পাঠিয়ে দিলেন সারা ইথিওপিয়া লণ্ডভণ্ড করে আসতে। অবস্থা বেগতিক দেখে সিফিয়াস চটজলদি একজন ওরাকলের বা জ্যোতিষীর সাহায্য নিলেন। ওরাকল বললো কোনো উপায় নেই। এন্ড্রোমিডাকে বলি দিতেই হবে। তাতে যদি পসাইডনের রাগ একটু কমে। কাজেই সিফিয়াস বাধ্য হয়ে নিজ কন্যাকে এই পাথরের সাথে শিকল দিয়ে বেধে রেখেছেন পসাইডনের নিকট উপঢৌকন হিসেবে।

কাহিনী শুনে পার্সিয়াস তো গলে জল। তার মত বীর থাকতে কিনা এন্ড্রোমিডাকে বলি হয়ে যেতে হবে। এ কি মামদোবাজি পেয়েছো? কাভি নেহি। তার উপর এখন যখন এন্ড্রোমিডা নিজেও পার্সিয়াসকে বললো যে পার্সিয়াস যদি তাকে উদ্ধার করতে পারে তবে সে সানন্দে পার্সিয়াসের স্ত্রী বা দাসী হয়ে আজীবন থাকতে রাজী আছে। এহেন সুযোগ হারায় কোন বেক্কলে? তবে পার্সিয়াস বেক্কল তো নন মোটেই, বরং মোটের উপর একটু বেশিই বুদ্ধিমান। কাজেই পার্সিয়াস আগেই সিফিয়াসের সাথে কথা পাকা করে নিলেন যে যদি তিনি এন্ড্রোমিডাকে উদ্ধার করতে পারেন তবে এন্ড্রোমিডা তাকে বিয়ে করতে বাধ্য থাকবে। সেই সাথে এই পুরো রাজত্বও তার হবে। সিফিয়াস তো যেনো হাতে চাঁদ পেলেন। তার মেয়েও প্রাণে বেঁচে যাবে, তার দেশও মুক্ত হবে পসাইডনের রুদ্ররোষ হতে। আর কি লাগে? তিনি সানন্দে রাজী হয়ে গেলেন।

কাজেই দৈত্য সমুদ্র থেকে মাথা তুলার অপেক্ষা, পার্সিয়াস বীরের মত ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ভয়ানক এক যুদ্ধ হলো, পার্সিয়াসের তলোয়ারের আঘাতে দৈত্যর রক্তে সমুদ্র লাল হয়ে গেলো। অবশেষে বহু কষ্ট করে পার্সিয়াস সমুদ্র-দৈত্য বধ করেন। এরপর এন্ড্রোমিডাকে শিকল মুক্ত করে সোজা রাজপ্রাসাদে। এবার পার্সিয়াস সিফিয়াসকে বলেন তার দেয়া কথা পূরণ করতে। সিফিয়াস অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। তা ছাড়া পার্সিয়াসের মত মহাবীরকে জামাই হিসেবে পেতে কে না চাইবে? কাজেই তিনি চটজলদি বিয়ের আয়োজন করলেন। কিন্তু এত ডামাডোলের মধ্যে সিফিয়াস একটা কথা ভুলে গিয়েছিলেন। আর সেটা এই যে এন্ড্রোমিডার বিয়ে আগে থেকেই ঠিক করা ছিলো। সিফিয়াসের ভাই ফিনিয়াস (মতান্তরে এগেনোর)-এর সাথে। এন্ড্রোমিডার উদ্ধারে একটা আঙ্গুল না নাড়ালেও এখন সময় বুঝে ফিনিয়াস মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেন। তাহলে উপায়?

উপায় আবার কি? বীরের কাজই দাবী আদায় করে নেয়া। কাজেই বিয়ের অনুষ্ঠানের মাঝখানে যখন ফিনিয়াস বিশাল সেনা-বহর নিয়ে হাঙ্গামা করতে উপস্থিত হয়ে গেলেন তখন পার্সিয়াস বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে যুদ্ধ শুরু করলেন। কারণ এন্ড্রোমিডাকে পার্সিয়াস আসলেই ভালোবেসে ফেলেছিলেন। এই বিশাল সেনাবাহিনীর সামনে যে কারোরই অসহায় বোধ করার কথা। কিন্তু এ যে পার্সিয়াস। তিনি নিজে লড়াই তো করলেনই সেই সাথে তার ঝোলা থেকে মেডুসার মাথা খানি বের করে সব্বাইকে দেখিয়ে তাদের পাথরের মূর্তি বানিয়ে বিয়ের মণ্ডপে চটজলদি ফেরত এলেন। কাজেই বাদ্য বাজনা বেজে উঠলো, দেশ জুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো, উৎসব চললো সাত দিন ধরে। এন্ড্রোমিডার সাথে পার্সিয়াসের বিয়ে হয়ে গেলো। এবং পরবর্তীতে গ্রীক পুরাণের অধিকাংশ ঈশ্বর-দেব-দেবী-বীর-রাজার উদাহরণকে পায়ে ঠেলে পার্সিয়াস আজীবন এন্ড্রোমিডার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার অপূর্ব নিদর্শন গড়েন।

বিয়ের পরও আরো দীর্ঘ একটি বছর পার্সিয়াস সিফিয়াসের আতিথ্য বরন করে ইথিওপিয়াতে থেকে যান। এই সময়ে এন্ড্রোমিডার কোল জুড়ে এলো তাদের প্রথম সন্তান। পেরেস। এক বছর পরে যখন পার্সিয়াস সেরিফাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন তখন পেরেসকে তার নানা-নানীর কাছে রেখে যান। কারণ এন্ড্রোমিডা ছাড়া সিফিয়াস ও ক্যাসিওপিয়ার আর কোনো সন্তান ছিলো না। কাজেই সিফিয়াস মারা গেলে রাজ্য চালানোর জন্যে উত্তরাধিকারী হিসেবে কেউ না কেউ তো থাকা লাগবে। পার্সিয়াসের পক্ষে তো আর এতো দূর থেকে এসে এসে রাজ্য চালনা করা সম্ভব নয়। যাই হোক, এই পেরেস পরবর্তীতে ইথিওপিয়ার রাজা হন ও পার্সিয়া নামক সুবিশাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

(পর্ব ০৩ সমাপ্ত ও চলবে...)

আগের পর্বগুলোতে একটিবার ঢুঁ মেরে আসতে হলেঃ গ্রীক পুরাণের মহানায়কেরা - পর্ব ০১
এবং
গ্রীক পুরাণের মহানায়কেরা - পর্ব ০২

লিখনেঃ সামি

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

সৌরভ চে এর ছবি

অনেক কিছু জানলাম। ভালো হইছে

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভালো লাগলো ভাই।
সৌম্য

কৌস্তুভ এর ছবি

বড্ড প্যাঁচ রে ভাই, মাথা ঘুচ্ছে

তুলিরেখা এর ছবি

এই পার্সিয়াস (আমি আগে জানতাম পার্সিয়ুস) চরিত্রটা খুবই চমৎকার! ঝটাংপটাং করে ঠিক ঠিক কাজগুলো করে যায় ঠিক ঠিক সময়ে। এইখানে একবার পার্সিয়ুসের একটা সংক্ষিপ্ত গল্প দিয়েছিলাম হাসি
লেখা চমৎকার! হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নাসিফ  এর ছবি

এক বসায় তিনটা পর্ব পড়ে ফেললাম। পরের পর্বগুলার আশায় থাকলাম।

ব্যঙের ছাতা এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। হাসি
লেখায় লেখা -গুড়- হয়েছে

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার সবগুলো লেখা পড়লাম। বেশ ভাল লেগেছে। আপনার গল্প বলার স্টাইল সুন্দর। লিখে যান। অনেক শুভ কামনা রইল।
শ্রাবনী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।