আমাদের গল্প (২য় পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৭/০৪/২০১৪ - ২:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধাচরণ করে একটি গোষ্ঠী দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে । সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনকে ব্যাহত করার যাবতীয় চেষ্টা করছে । যা জাতির জন্য অমঙ্গল বয়ে আনবে বলে আমার আশঙ্কা হয় । যুদ্ধাপরাধীদের উপযুক্ত বিচার ও স্বাধীনতা বিরোধীদের এ ষড়যন্ত্র থেকে জাতিকে রক্ষা করার প্রয়াস অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার পথকে সুগম করবে । উপর্যুক্ত প্রসঙ্গে আলোচনার উদ্দেশ্যেই এ লেখনী । তবে মূল আলোচনায় যাওয়ার আগে একটু অতীতে ঘুরে আসব ।

১৯৭১ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম যখন চূড়ান্তরূপ লাভ করে তখন একশ্রেণির রাজনীতিবিদ ধর্মকে সামনে নিয়ে এসে অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার চেষ্টা করে । সরলভাবে দেখলে দ্বি-জাতি তত্ত্বের পরিবর্তিত রূপ অনুযায়ী ’৪৭ এর দেশ ভাগ ধর্ম ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক চেতনার একটি ফল । ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে মুসলিম সমাজ ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ প্রদর্শন না করায় সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে হিন্দু সমাজের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে । সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের মনঃজগতে বড় রকম প্রভাব ফেলে । যা জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে । ধূর্ত ইংরেজ শাসকগণ দু’টি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যকার বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে ‘Divide and rule’ পলিসি গ্রহণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে ঔপনিবেশিক শাসন দীর্ঘতর করতে সচেষ্ট হয় । সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারণ হিসাবে অনেকগুলো বিষয় নজর কাড়ে তবে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে সামনে চলে আসে অর্থনৈতিক দিকটি । যা ভারত স্বাধীনতার প্রশ্নেও দু’টি ভিন্ন ধর্মালম্বী গোষ্ঠীর মাঝে অনৈক্য তৈরী করে । একইভাবে সমগ্র বাঙলা নিয়ে পৃথক একটি বাঙলা রাষ্ট্র না গড়ে তোলার পেছনেও অর্থ সংক্রান্ত স্বার্থটি মূখ্য হয়ে ওঠে । বিস্মৃত হলে চলবে না, তৎকালীন ভারতের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ‘কংগ্রেস’ ও ‘মুসলিম লীগ’ এর অর্থের উৎস ছিল সমৃদ্ধশালী ‘অবাঙালি ও হিন্দু বণিক সম্প্রদায়’ । কোন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে স্বজাতির প্রতি বিশেষ দূর্বলতা থাকা সঙ্গত কারণেই স্বাভাবিক । কিন্তু আলোচনার ভিত্তিতে কল্যাণকর পথের সন্ধান করাটা সম্ভবপর ছিল যা মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ অজ্ঞাত কারণে তুচ্ছজ্ঞান করেছেন বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় । এর সাথে মাউন্টব্যাটেন সাহেবের স্বাধীন খণ্ডিত ভারতবর্ষের উভয় অংশের গভর্নর জেনারেল থাকার তীব্র অভিলাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি পুনর্গঠনে মনোযোগী ইংরেজদের মধ্যকার আশ্চর্য তাড়া ছিল যা ভারত ভাগকে সাম্প্রদায়িক বিরোধের ক্ষেত্রে পরিণত করে । এদিকে পূর্ব-পাকিস্তান হতে কলকাতা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলের অর্থনৈতিক উৎসের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে বাঙালির স্বার্থ রক্ষিত না হওয়ার কারণ হিসাবে উভয়পক্ষের সচেতন প্রয়াসের অভাব ছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায় । ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভাগের প্রশ্নে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ব্যর্থতা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে । পাকিস্তান গঠনের পক্ষে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ প্রদেশ সমূহে শান্তি আনয়ন, মুসলমানদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপিত হয় । কিন্তু ’৪৭ পরবর্তী সময়ের সাম্প্রদায়িক বিভেদের চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে তৎকালীন মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ দ্রুতই ভুল বুঝতে পারে, তবে এ সমস্যার সমাধান কোন সহজসাধ্য কাজ ছিল না । ভারতীয় উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা আরও আগে, তবে উনিশ শত চল্লিশের দশকে তা প্রকট আকার ধারণ করে । এমন একটি সময়ে(১৯৪১) জন্মলাভ করে আবুল আলা মওদুদি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মওদুদিবাদ তথা ‘অস্ত্রভিত্তিক ইসলামী রাজনীতি’ । যা ব্রিটিশ - যা ব্রিটিশ ভারতে একটি বিশেষ সময়ে আগত ওয়াহাবি ইসলামের আদর্শের বিকৃত ও চরমাভাবাপন্ন রূপ । অথচ আরব সমর নায়ক মোহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু জয়ের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তির বাণী নিয়ে ইসলামের আগমণ । পরবর্তীতে সুফিবাদের মাধ্যমে ধর্মপ্রচারকেরা সমগ্র ভারতে তার বিস্তার ঘটান । কিন্তু বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ মওদুদিবাদের প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত । যা মূল ইসলামী চেতনার বহির্ভূত একটি ধারণাকে বহন করে । ‘বাংলাদেশ জামায়েতে ইসলামী’ দলটি ধর্মকে বিপণন করে ক্ষমতায় যেতে সদা সচেষ্ট । এধরণের ভ্রান্ত রাজনৈতিক মতবাদ ভিত্তিক রাজনীতির প্রচার যে একমাত্র ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করছে তা নয় বরং উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’, দক্ষিণ এশিয়ার ‘জামায়াতে ইসলামী’, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘জামা-আল ইসলাম’ এবং মধ্য এশিয়ার ‘ইসলামিক মুভমেন্ট’ প্রভৃতি দলের কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে । ’৭১ সালে ধর্মকে ঢাল করে যে সকল ব্যক্তিবর্গ ও দল স্বাধীন বাংলা দেশ (বাংলাদেশ) গঠনের বিরোধিতা করেছিল এবং অখণ্ড পাকিস্তান রাখার স্বপ্নকে ধারণ করে মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছিল তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পেছনে ক্ষমতারোহন ও সম্পদ অর্জনের লক্ষ্য ছিল তালিকার প্রথমে যা সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত উপর্যুক্ত নেটওয়ার্কের লক্ষ্যের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ও এক কেন্দ্রিক । এখানে স্বল্প পরিসরে এ প্রসঙ্গের গভীরে প্রবেশ করা যুক্তিসংগত হবে না । বরং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার উপর আলোকপাত করা যাক ।

সাম্প্রদায়িকতা মূলত একধরণের মনোভাব । স্বধর্মে বিশ্বাসী সংগঠিত জনগোষ্ঠী যখন ভিন্ন ধর্মালম্বী গোষ্ঠীর সাথে বিরূপ আচরণ করে, হিংসা করে এবং ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন জন্ম হয় সাম্প্রদায়িকতার । উপর্যুক্ত সংজ্ঞা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ধর্মে বিশ্বাসী জনগণ হিংসামূলক আচরণ করে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে , অথচ বিশ্বের তাবৎ ধর্মের মূল সত্যের কেন্দ্রমুখী । সেখানে হিংসা, ঈর্ষা, ক্ষতিসাধনের প্রবৃত্তির কোন স্থান নেই । তাহলে প্রশ্ন হল ধর্মের ভিত্তিতে যে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম তার ভিত্তি কোথায় ? ধর্ম সংক্রান্ত বিভেদের ভিত্তি হল ধর্ম সংক্রান্ত আচরণ ও ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি । পৃথিবীর সকল ধর্মের অনুসারীদের জন্য রয়েছে ভিন্নভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আচরণ ও তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অর্থব্যবস্থা । ধর্ম সংক্রান্ত যে সমালোচনা লক্ষ্য করি তা মূলত ধর্মের কেন্দ্র নিয়ে নয়, বিশ্বাসের কেন্দ্র নিয়ে নয় বরং এই আচার নিয়ে । ধর্ম বিশ্বাসের মূলে আঘাত করা যায় না যেহেতু তা অদৃশ্য কিন্তু আচার দৃশ্যত হওয়ায় তা আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় । তবে কি আচার অপ্রয়োজনীয় ? এ প্রশ্নে আমার উত্তর হলঃ না , কারণ এই আচার ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ । বিপুল সংখ্যক মানুষকে একত্রিত করার মাধ্যম এই আচার, ধর্মীয় চেতনাকে লালন ও ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি । অথচ যাবতীয় বিরোধ, হানাহানি, সমস্যার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াচ্ছে ধর্মের এই সাংস্কৃতিক দিক, সম্পর্কি । মানব সমাজে সাংস্কৃতিকভাবে একত্রিকরণের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে অর্থনৈতিক চেতনা । মানুষ জন্মগতভাবেই সম্পদ অর্জনের চেতনা লাভ করে । ইহজীবনের বিবেচনায় অর্থ-সম্পদের গুরুত্ব অপরিমেয়, সামাজিক মান বিবেচনার অন্যতম নিয়ামক । এই অর্থ সংক্রান্ত অংশই আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টিতে উৎসাহ দেয় । ধর্মীয় পরিচয়কে স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম করে তোলে নির্বোধ মানুষ । বস্তুত সকল ধর্মমতের কেন্দ্র এক, কেবল পথ ভিন্ন । এই ভিন্ন পথ সম্পর্কে জ্ঞানের দূর্বলতা ধর্মের মূল লক্ষ্য থেকে মানুষকে বিচ্যুত করে আচার সর্বস্ব করে তোলে এবং সংঘাত সৃষ্টিতে প্রেরণা দেয় । তাই বরং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রশ্নে সত্যমুখী হই, মূল বক্তব্যে মনোযোগ দেই । সংঘাত বিবেচনার সম্ভাবনার জন্যই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে ধর্ম গ্রন্থে বারবার সতর্ক করা হয়েছে । যেহেতু ধর্ম স্রষ্টার সাথে তার সৃষ্টির নিবিড় যোগাযোগের মাধ্যম এবং প্রত্যেকের জন্যই তা একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি সেহেতু এ ব্যাপারে ভালো-মন্দ সূচক কোন বাক্য ব্যয় নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার সামিল, বরং নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণই শ্রেয়তর । প্রসঙ্গত, পৃথিবীতে ধর্ম বিশ্বাসে আস্থাহীন একটি গোষ্ঠী রয়েছে যারা মূলত বিবেকের আদালতে নির্ভরশীল । তাদের বিশ্বাসের প্রসঙ্গে কোন যুক্তি উপস্থাপনে আমি বিশেষ আগ্রহবোধ করিনা । এ তাদের একান্ত ব্যক্তিগত পছন্দ ও সিদ্ধান্তের বিষয় । মানবতাবাদের বিশ্বাসী মানুষ সমাজের জন্য কার্যত ক্ষতিকর নয় । তবে ধর্মীয় দুষ্কৃতিকারীদের পাশাপাশি স্বাধীন চেতনাধারী এই শ্রেণির একটি অংশও খুব দুঃখজনক আচরণ করছে । এরা মূলত ধর্মের আচারকে আক্রমণ করে দৃষ্টি আকর্ষণ ও নতুন ধারণা সামনে আনার আড়ালে শক্ত সামাজিক অবস্থান সৃষ্টিতে ব্যস্ত । তাদের আচরণ প্রকৃতপক্ষে লজ্জাজনক । ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষ নিজের যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে নানা ধর্মালম্বী মানুষের মনে আঘাত দিতে পারেন না বলেই আমার বিশ্বাস । বিশ্বাস ও আদর্শকেন্দ্রিক প্রশ্নে আমাদের যেকোন মন্তব্য সচেতন প্রয়াসের ফল হওয়া তাই বাঞ্চনীয় । সাম্প্রদায়িক চেতনা যেন সংঘাতের কারণ না হয় সেজন্য মানবতাবোধের লালন জরুরি । সকলের কল্যাণের জন্য তাই একান্ত বিশ্বাসকে ক্ষুদ্র স্বার্থসংশ্লিষ্ট করা থেকে বিরত থেকে মানবিক হয়ে শান্তির লক্ষ্যে ধাবিত হই ।

বাংলাদেশের সংবিধানে যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়েছে । সেখানে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক মর্যাদাদানের বিপক্ষে রাষ্ট্রের অবস্থান নির্দিষ্ট হয়েছে । কিন্তু সামাজিক অবস্থানের দিকটি স্পষ্ট করা হয়নি । সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঘটনায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জনগণকে প্রেরণা দিতে পারে না । অবশ্য সরকারের ক্ষেত্রে অবস্থা ভিন্ন হয়ে দাঁড়ায় । সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতারোহন করে । ক্ষমতায় যাওয়ার অর্থ জনসেবা যেমন সত্য তেমনিভাবে সম্পদ অর্জন করার মনোবৃত্তি কোন অলীক ধারণা নয় বরং নিষ্ঠুর বাস্তব । সুতরাং খুব স্বাভাবিক বিবেচনায় রাজনৈতিক দলসমূহ তাদের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে । বাংলাদেশে যেহেতু একটি বিশেষ ধর্মালম্বী গোষ্ঠী মোট ভোটারের বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্ব করে সেহেতু একটি দল যখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি আঘাতের প্রতিরোধের চেষ্টা করে তখন অন্যদলটি প্রতিপক্ষের অবস্থানকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারে সচেষ্টা হয়। ফলে সার্বিক রাষ্ট্রকাঠামোতে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় । ফলাফল স্বরূপ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় । এ অবস্থায় দুর্বৃত্তদের অন্যায় প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ হওয়া জরুরী । মানুষ হিসাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব । সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর এধরণের আক্রমণ সার্বিকভাবে আমাদের সকলের উপর বিরূপ প্রভাব বয়ে নিয়ে আসবে । কেবলমাত্র রাজনৈতিক দল বা সরকারের উপর আশা করে থাকলে জাতিগত সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় । বস্তুত রাজনীতির হিসাব-নিকাশ অত্যন্ত জটিল । বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থ-সাহায্যের উৎসের দিকে মনোযোগী হলে জোটে অংশীদার দলগুলোর কার্যপদ্ধতি কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা যায়। কোন ধরণের নীতি গ্রহণ করবে তা বোঝা যায় । এ প্রশ্নে দ্বিমত পোষণের কোন সুযোগ নেই, জামায়াতে ইসলামের রাজনীতি মূল ইসলাম বিচ্যুত । ধর্মের নামে মানুষ হত্যা কোন যুক্তিতেই বৈধতা পেতে পারে না । এই রাজনীতিকে সমর্থন দেওয়া যায়না । জননিরাপত্তা সম্পর্কিত এ প্রশ্নে বিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুব গুরুত্বপূর্ণ । আর বর্তমান সময়কে বিবেচনায় রেখে সরকারের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য সুস্থ্য আবাস হিসাবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে মানবতার সত্য উপলব্ধি করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মাঝে ইতিবাচক মনোভাবের বিকাশ সাধন ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করা অত্যন্ত জরুরী ।

আমাদের মত দেশে প্রকৃত অর্থে শিক্ষিতের হার অত্যন্ত কম হওয়ার দরুন রাজনৈতিক দলগুলো কপটাচারীর ন্যায় অবস্থান গ্রহণ করে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মাঝে সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে অপপ্রচার চালায় । ১৯৬৫ সাথে যুদ্ধকালীন সময়ে নিরাপত্তার খোঁজে ভারতে চলে যাওয়া হিন্দু সম্প্রদায়ের ফেলে যাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্য-জমিজমা-সম্পদ ‘শত্রু সম্পত্তি’ আইন ঘোষণা করে লুন্ঠন করে একদল উগ্র মুসলিম । সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ম ব্যবসায়ী একদল উন্মত্তের কর্মকাণ্ডের ফলে খুব দুঃখজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে । সমাজের নিম্নবিত্ত ও শিক্ষা হতে বঞ্চিত শ্রেণিকে সংঘাতের প্রতি আহ্বান করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের উদ্দেশ্যে নিরীহ জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ করা হয়েছে । মূলত যে রাজনৈতিক দলের স্বার্থে বর্বরোচিত এ আক্রমণ সম্পন্ন হয়েছে তারা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বাঁধা প্রদান করতে একই পথ অবলম্বন করেছিল । তখনো ধর্মের বিপণনে তারা কার্পণ্য করেনি । তখন তাদের যে লক্ষ্য ছিল, আজকের দিনেও তা বদলে যায়নি । মূলত ধর্মের সাংস্কৃতিক রূপায়নে বাহ্যত লাভজনক দিক অর্থাৎ সম্পদ ও ক্ষমতার চেতনায় তারা মোহগ্রস্ত । এজন্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আঘাত হানা, মানুষের সহজাত সাম্প্রদায়িক দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে দেশে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, দেশের ৮০ শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের সমর্থন লাভের মাধ্যমে উগ্রমতবাদে বিশ্বাসী ধর্ম বণিকদের বিচার থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার চেষ্টার করা, নানাভাবে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে অশিক্ষিত ও নিম্নমধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে ধর্ম ব্যবসায়ীদের মন্দ রাজনীতির অংশ করা ও লাশের রাজনীতির মাধ্যমে বহিঃবিশ্বের সমর্থন লাভ করার চেষ্টায় তারা সদা সচেষ্ট । যুদ্ধাপরাধিদের বিচার থেকে বাঁচানোর পেছনে মূল উদ্দেশ্য এই ক্ষমতার স্বার্থ । ধর্ম বিপণনকারীদের রাজনৈতিক আন্দোলন মানুষের কল্যাণের জন্য নয় এটা সারা বিশ্বে উগ্রবাদী এ সম্প্রদায়ের নানা কর্মকাণ্ডে বহুল প্রমাণিত । যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে ক্ষমতায় যাওয়ায় মত সামর্থ্য তাদের নেই তাই নগ্ন চিন্তাধারার অধিকারী এ গোষ্ঠীকে লেজুড়ে বৃত্তিতে আগ্রহী হতে বাধ্য করেছে । অন্ধ জনগণের দূর্বলতা বিবেচনায় রেখে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সমূহের ভোট বাজার বিবেচনায় নানা সময়ে বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে সময়ে খেলনা থেকে খেলোয়াড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে । যা অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নে সংগ্রাম করা সাধারণ মানুষের জন্য কষ্টদায়ক অনুভূতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে । বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল সমূহের তুলনায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সাংগঠনিক অনেক বেশি শক্ত ও বিস্তৃত । ধর্মের মূল ঐশী বাণী সম্পর্কে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ যেখানে সচেতন নয়, সেখানে অশিক্ষিত বিপুল জনগোষ্ঠীকে হাতিয়ার করে বিশৃংখলা সৃষ্টি, সম্পদ লুন্ঠন, আইন-শৃংখলা বাহিনীর উপর বর্বর আক্রমণ, আলেম সম্প্রদায়কে হত্যার ষড়যন্ত্র, অন্য ধর্মালম্বী সম্প্রদায়ের উপাসনালয়ে আক্রমণ-ভাংচুর, ধর্ম পালনে বাধা সৃষ্টি, জাতীয় পতাকার অবমাননা ও শহিদ মিনার ভাংচুরের মত ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থেকে মানবতা বিরোধীদের বিচার বন্ধ করতে চেষ্টা করছে । অপরদিকে বিশৃংখলা দমনে সরকারও কঠোর হতে বাধ্য হচ্ছে । প্রাণ হারাচ্ছে সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষ । দুষ্কৃতিকারী কিংবা সরকার কোন পক্ষই এধরণের হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠবে তা কাম্য নয় । এধরণের পরিস্থিতি মোকাবেলায় উন্নত শিক্ষার সুযোগ প্রদান, ভ্রান্ত বিশ্বাসীদের আলোর পথে আনার জন্য চেষ্টা করা, অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল ও গ্রামে বসবাসকারী নারী-পুরুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরী । এই উগ্রবাদীদের শেকড় সময়ের সাথে সাথে অনেক গভীরে পৌঁছে গেছে, স্বমূলে উৎপাটনের পাশাপাশি কোন সত্য পথ বাতলে না দিলে আমাদের পরিণতি সুখকর হবে না । ভুলে গেলে চলবেনা, আমাদের দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিণতি আজকের বাংলাদেশ, একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব । ১৯৭১ এ লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের গৌরবের লাল-সবুজ পতাকা । তাই ৭১ এর ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে কোন আপোস কাম্য হতে পারে না । বরং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে যাত্রা শুরুর অন্যতম বাধাকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপসৃত করতে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হই । ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সত্যের এ লড়ায়ে সমর্থন করা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব । প্রকৃত অর্থে ও নিরপেক্ষভাবে আদালতের মাধ্যমে যদি সমগ্র বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় তবে জাতির একান্ত চাওয়া ও আদালতের রায়ের মধ্যে পার্থক্য থাকার কথা নয় । জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সকলের ইতিবাচক সহযোগিতা আজ অত্যন্ত জরুরি । ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের পথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক সূচনাসম । কেননা কেবলমাত্র সত্যনিষ্ঠ সমাজেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব । জয় হোক বাঙালির, ধর্ম-বর্ণ পরিচয় নির্বিশেষে শান্তিতে বসবাস করুক শান্তিপ্রিয় বাঙালী ।

কায়সুল খান অনাবিল
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেলঃ


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।