আমার ওড়াউড়ি এবং বৃষ্টি বিলাস!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৫/০৬/২০১৫ - ৬:৫৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি কিন্তু উড়তে পারি! না, না, হাসির কথা নয়—সত্যিই আমি উড়তে পারি। তবে স্বপ্নে এই আর কী খাইছে স্বপ্নে আমি যখন উড়ি, সেটা কিন্তু মোটেই সুপারম্যান স্টাইলের ঝড়ের গতিতে ওড়া নয় বরং অনেকটা সমুদ্রের মধ্যে জেলিফিশ যেভাবে সাঁতার কাটে আমি সেভাবেই হাওয়া কেটে উপরে উঠি। নিজের ভরশূন্যতা উপভোগ করতে বেশ লাগে। নিজেকে অনেক হালকা মনে হয়। আর উপর থেকে সবকিছু দেখার মজাই আলাদা। যারা নিয়মিত বিমানে চড়েন, তারাও ওই মজা পাবেন না কারণ হয় তারা অনেক উপর দিয়ে যান বলে খুঁটিনাটি সবকিছু নিখুঁতভাবে দেখা যায় না, নয়তো মেঘ এসে ঢেকে দিয়ে যায় সবকিছু। আমি অবশ্য অত উপরে উঠি না। মোটামুটি বিশ-বাইশ তলা আমার সর্বোচ্চ উড্ডয়ন। মাঝে কয়েকবার অবশ্য অনেক উঁচুতে উঠেছি, প্রায় মেঘের কাছে- কিন্তু কেমন জানি শীত শীত লাগে আর একা মনে হয়। অত উপরে মাটির পৃথিবীর সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। তার চেয়ে বরং কম উচ্চতায় অনেক কিছু দেখাও যায় আবার তারাতারি ভ্রমণও সেরে ফেলা যায়। মাটিতে পা দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে যখন উপরে উঠতে থাকি আস্তে আস্তে তখন সবকিছু কী সুন্দর ছোট হয়ে আসে ধীরে ধীরে, অনেক বড় কিছুও আর অত বড় মনে হয় না উপর থেকে। আবার যখন নামতে থাকি, তখন উপরের ঠাণ্ডা বাতাস থেকে আস্তে আস্তে মাটির যত কাছে এগুতে থাকি মাটির উত্তাপ আর মানুষের কোলাহল সেই সাথে বাড়তে থাকে। উপরে কখনও কখনও সাঁই করে কানের পাশ দিয়ে উড়ে যায় কোন পাখি। কখনওই ইচ্ছা হয়নি তাড়া করে একটাকে ধরে ফেলতে।

বাস্তবে মাটির উপরে উঠলে বা গতির কারণে সবার আগে যে অনুভূতিটা হয় সেটা হল ভারসাম্যের পরিবর্তন। ভারসাম্যের পরিবর্তন ব্যাপারটা এত সূক্ষ্মভাবে আমাদের শরীর অনুভব করতে পারে, যে দিব্বি এমন ধিরিঙ্গি শরীর নিয়েও আমরা মানুষরা দুই পায়ে হেটে চলে বেড়াতে পারি। এমনকি স্বপ্নেও অনেক উপর থেকে পড়তে গিয়ে কে না হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেছে! স্বপ্নের মাঝেও মস্তিস্ক মনে করে আমরা সত্যিই মনে হয় পড়ে যাচ্ছি, ভারসাম্য ঠিক করা দরকার। তখন ধড়ফড় করে জেগে উঠি আমরা। আমরা মনে করি কান বোধহয় শুধু শোনার কাজেই ব্যবহৃত হয়, কিন্তু এই ভারসাম্যের অনুভূতিগুলোও কিন্তু অন্তঃকর্নের কারসাজি। বহুদিন আগে, সেই ক্লাস সিক্সে কুষ্টিয়ায় একবার বানিজ্যমেলায় গিয়ে জীবনে প্রথমবারের মত নাগরদোলায় উঠেছিলাম। উপর থেকে নীচে পড়ার সেই মোটামুটি ভয়ঙ্কর (অন্তত তখন তাই লেগেছিল) অভিজ্ঞতা আমার মাথায় গেঁথে গেল। পেটে যে অসম্ভব সুড়সুড়ি পেয়েছিলাম সেই থেকে পণ করেছিলাম এইসব জিনিসে আর উঠছি না! এমনিতেই কেন জানি আমার অনুভূতি একটু বেশীই মনে হয় (ধর্মানুভূতি নয় অবশ্য)। সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে নীচে নামলেও পেটে সুড়সুড়ি লাগে। তাই ঐ নাগরদোলায় কেমন লেগেছিল তা বলাই বাহুল্য।
এরপর বহুদিন কেটে গেছে। ঢাকায় যেখানে থাকি তার দুই পা দূরেই গড়ে উঠেছে যমুনা ফিউচার পার্ক। তার সামনে তারা বানিয়েছে রোলার কোস্টার, স্কাই ড্রপ সহ আরও কিছু রাইড। মাঝে মাঝে যমুনায় যাওয়া পড়লে রাইডগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি, মাঝে মাঝে আবার কেউ সেগুলোতে চড়লে তাদের তারস্বরে চিৎকারও বেশ উপভোগ করি। কিন্তু ভুলেও কোনটায় গিয়ে চড়তে পা বাড়াইনি। তবে একটা লোভ লাগত। আমি বৃষ্টি বিলাসী। শেষ যে বছর বাড়িতে ছিলাম, অর্থাৎ ২০১১ সালের পুরো বর্ষাকাল আমি মোটামুটি ছাদেই কাটিয়েছি বৃষ্টিতে ভিজে, একটা হাঁচিও হয়নি। ফিউচার পার্কের ঐ রাইডগুলোর একটাতে (টাওয়ার চ্যালেঞ্জার) যখন মানুষ অনেক উপরে উঠে চড়কির মত ঘোরে, তখন আমার মনে হত আচ্ছা, বৃষ্টির ভিতর ঐ ভাবে শূন্যে ঘুরতে কেমন লাগবে? আমি নিজেও স্বপ্নে ওড়ার সময় কখনও বৃষ্টি পাইনি। বৃষ্টির মধ্যে মাটির বন্ধনমুক্ত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় লোভীর মত তাকিয়ে থাকতাম ঐ রাইডটার দিকে। কিন্তু, ঐ যে সুড়সুড়ির ভয়! তাছাড়া বৃষ্টির মধ্যে নাকি ওরা রাইড চালায়ও না।

****

গতকাল আমার বন্ধু বিষাণ আসল বসুন্ধরায়। ও ভারতে পড়াশুনা করছে, তাই আমাদের সাক্ষাৎ বছরে দুই-তিনবার মাত্র হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা চাইলাম যতটা সম্ভব মজা করে সাক্ষাৎটা উশুল করে নিতে। আমার ভার্সিটিতে ওকে ঘুরিয়ে, দুইজনে গেলাম ফিউচার পার্কে। আমার ক্লাস ছিল আবার সাড়ে পাঁচটায়, তার আগেই ঘোরাঘুরি করে ফেরার ইচ্ছা। এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে আমরা পৌছালাম বাইরের অ্যামিউজমেন্ট পার্কে। বিষাণ রাইডগুলো দেখেই বলল, উঠবে! সে নাকি কয়েকদিন আগেই স্বপ্নে দেখেছে এমন একটা জায়গায় আমার সাথে রাইডে চড়েছে! এখন বাস্তবায়নের এমন সুযোগ পেয়ে কি আর ছাড়া যায়! আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, ওর সাথে আমাকেও যদি উঠতে হয় তবেই গেছি আর কী! নাগরদোলাতেই যদি ওই হয় তাহলে এখানে কী হবে সেটা আর না ভাবি! কিন্তু আমাদের কিছু করারও নেই হাতে। যমুনার মত মোটামুটি নিম্নমানের একটা শপিং কমপ্লেক্সে আমাদের আসলেই কিছু করার নেই। তাছাড়া নতুন অভিজ্ঞতাতে আমার কখনই আগ্রহের ঘাটতি ছিল না। তাই বিষাণের ক্রমাগত সাহসে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম টিকেট কাউন্টারের দিকে। জনমানবশূন্য। আমরা ছাড়া আর কেউ নেই ধারে কাছে। টিকেট কাউন্টারের খোপে বিরস মুখে বসে আছে একজন। আমাদের দেখে প্রথমেই জানিয়ে দিল রোলার কোস্টার বন্ধ! যেন আমরা রোলার কোস্টারে ওঠার জন্য মুখিয়ে আছি, হুহ! আমরা টাওয়ার চ্যালেঞ্জের টিকেট কাটলাম দুটো। টিকেট কাটার পরেই ব্যাটা জানিয়ে দিল, শুধু আমাদের দু’জনার জন্য রাইড চালু করা সম্ভব নয়, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে অন্য আরও কয়েকজনের জন্য! টিকেটের উপর পরিষ্কার ইংরেজীতে লেখা আছে, “ফেরতযোগ্য নয়”। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আজ যদি আর কেউ না আসে তাহলে কী হবে? মুখ আরও কাল করে সে জবাব দিল, “না আসলে নাই! তাইলে দুইজন নিয়াই চালামু” কিন্তু আমাদের কিছুক্ষণ অন্তত অপেক্ষা করতেই হবে। আমাদের দুজনের কাঁধেই ব্যাকপ্যাক, জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কোথায় রাখা যেতে পারে? প্রবল বৈরাগ্য দেখিয়ে উত্তর এল, “নিয়াই উইঠ্যা পইড়েন!” হাল ছেড়ে দিয়ে আমরা গিয়ে ঢুকলাম ফোনের শোরুমগুলোতে। সময় তো কাটাতে হবে। নিত্যনতুন চকচকে-ঝকঝকে-লিকলিকে ফোনগুলো দেখে আমাদের জিভ লকলক করলেও আপাতত টিপেটুপে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কাটল কিছুক্ষণ। আমার ক্লাসের সময়ও এগিয়ে আসছে। শেষে আড়ঙের শোরুমে ব্যাগ জমা দিয়ে আবার গিয়ে হাজির হলাম রাইড চত্বরে।
কিছু মানুষজন দেখা গেল কাছাকাছি, কিন্তু মূল রাইড কমপ্লেক্সে মাত্র দুইজন ছাড়া কেউ নেই। ঢুকে পড়লাম। বাকি দুইজন আমাদেরই বয়সী। তারাও মাত্র দুইজন বলে কিছুতে উঠতে পারছে না! তারা আবার টিকেট কেটেছে তিনটা রাইডের! যাইহোক প্রথম রাইড তারা আমাদের সাথেই চড়তে চাইল। পুরো রাইড কমপ্লেক্সে আমরা মাত্র চারজন! এতগুলো রাইড সব খাঁ খাঁ করছে। অবশ্য রোজার মধ্যে কেই বা ইফতারির ঘন্টা দুয়েক আগে এইসবে চড়তে আসবে। ওদিকে আকাশ কাল করে মেঘ চলে এসেছে। বাতাস ভেজা ভেজা। যেকোন মুহুর্তে আবার বৃষ্টি নামতে পারে। আমরা ঝটপট উঠে পড়লাম দোলনায়। আমি আর বিষাণ পাশাপাশি (একা হলে ভয়ে চড়তামই না!)। বাকি দুইজনের একজনের অবস্থা আমার চেয়েও করুণ। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ফাঁসিকাষ্ঠে চড়তে যাচ্ছে। অন্যজন বেশ ডাকাবুকো, সে আগেও বেশ কয়েকবার এখানে সবগুলো রাইডে চড়েছে, কাজেই অভিজ্ঞতা বেশী। সে ক্রমাগত সাহস দিয়ে গেল। আমিও একটু ভরসা পেলাম আর কী! আস্তে আস্তে ঘুরতে শুরু করল চড়কা, আর আমরাও উপরে উঠতে থাকলাম। যখন গতি বাড়তে বাড়তে মাঝামাঝি পর্যন্ত উঠল, তখন নামল ঝিরঝিরে বৃষ্টি। আমার পেটে সুড়সুড়ি লাগছে ঠিকই, কিন্তু আমি একদম মোহিত হয়ে গেলাম। তীব্র গতিতে বাতাস কেটে আমি এগিয়ে যাচ্ছি, মুখে লাগছে ভেজা বাতাসের ঝাপটা। দূরে বসুন্ধরার বাড়িগুলো ছাড়িয়ে বিশাল আকাশ আরও বিশাল করে ধরা পড়ল চোখে। ওদিকে একদিকে হালকা মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্য। আমার পাশে কেউ আছে কি নেই ভুলে গেলাম। স্বপ্নে আমি পালকের মত হালকা হয়ে উড়ি, এখানে উড়ছি পুরো ওজন নিয়ে। পৃথিবী আমাকে টেনে নীচে নামাতে চাইছে আর ঘুর্নন গতি চাইছে আমাকে ছিটকে বৃত্তের বাইরে ফেলতে। আমি শুধু উড়ছি আর উড়ছি! হ্যারি পটার তাহলে এভাবেই উড়ে বেড়ায়? এভাবেই তাহলে বৃষ্টির ছাঁটের ভেতর গোল্ডেন স্নিচ খুঁজে বেড়ায়? আমার কাছে গোল্ডেন স্নিচ হল উঁকি দেওয়া সোনালি সূর্য, আর জাদুর ঝাড়ু হল সামনের নিরাপত্তা বেষ্টনী। প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছে কেন্দ্রবিমুখী বলের কারণে আমি বোধহয় এই ছিটকে গেলাম। তখন হয়ত উড়তে উড়তে স্নিচের মত সূর্যটাকে ধরে ফেলব! আমরা আবার নামতে থাকলাম, গতিও কমে আসতে থাকল ধীরে ধীরে। একসময় আবার মাটিতে রাখলাম পা।

ভেবেছিলাম মাটিতে দাঁড়িয়ে মনে হয় টাল খাব। এতক্ষণ বনবন করে ঘোরার পরে মাথা নিশ্চয়ই ঘুরবে। ওমা, কিছুই হল না। বরং নেশা চেপে গেল। বিষাণও জানাল ও আরও কিছুতে উঠবে। আমিও বুঝে গেছি, এতদিনের পুষে রাখা ভয়টা অমূলক। কোন রাইডই আর এখন আমাকে সুড়সুড়ির ভয় দেখাতে পারবে না। আবার গেলাম টিকেট কিনতে। টিকেট কিনে ফিরতে ফিরতে বৃষ্টি ভাল মতই নেমে গেল। এর মাঝে কোন রাইডই তারা চালাবে না। ভালকথা, অপেক্ষা করব। আমাদের সাথের দুজনের মধ্যের সেই ভীতু ছেলেটার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে মনে হচ্ছে। তার চোখে মুখে আতঙ্ক। মনে হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ঘুরে এসেছে সে। বৃষ্টি থেমে আসল। আমরা গিয়ে দাড়ালাম পাইরেট’স শিপ নামের রাইডটিতে। নৌকার মত একটা কাঠামোকে সরল দোলকের মত প্রায় ৮০ ডিগ্রী কোণে দোলানো হয়। ফ্রি ফলের (free fall) এর কিছুটা অনুভূতি পাওয়া যায়। তো সে নৌকা প্রায় ডুবে গেছে বৃষ্টির জলে! উপরেও প্রায় একহাত জল। সিটগুলোও জলে জলে জলাকার! উপায় না দেখে খালিই চালিয়ে দেওয়া হল আমাদের সামনে। আর দুলতে দুলতে জলও পড়তে লাগল দুলকি চালে। অবশেষে চোখের সামনের ঐ দুলুনিতে আমি যখন প্রায় হিপনোটাইজ হয়ে গেছি, তখন সেটা থামল আর একজন এসে কয়েকটা সিট একটু মুছে টুছে দিল। চেপে বসলাম জলদস্যুর নৌকায়। এবার আমরা দু’জন আর ওরা মুখোমুখি। শুরু হল দুলুনি। ভীতু ছেলেটা মুখ-চোখ শক্ত করে ঠেসে বসে আছে। এবার টের পেলাম সুড়সুড়ি কাকে বলে! উলটো হয়ে উপর থেকে নীচে পড়ার সময় পুরো শরীরজুড়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। কিন্তু তার মাঝেও অবাক হয়ে একটা জিনিস খেয়াল করলাম। উলটো হয়ে উপর থেকে নীচের দিকে গেলে যেমন পেটে সুড়সুড়ির অনুভূতি হয়, চিৎ হয়ে উপর থেকে নীচের দিকে গেলে তেমনটা হয় না। অথচ আমার জানামতে দুইভাবে পড়লেই অমনটা হওয়ার কথা। ব্যপারটা একটু ঘেঁটে দেখতে হবে!
আমাদের দুজনেরই পকেটের অবস্থা করুণ ততক্ষনে। আরও কিছু সামান্য বাকি আছে। দুইজনই মুচকি হেসে বলে উঠলাম, “লাস্ট ওয়ান!” অবশেষে মানিব্যাগ ঝেড়েপুছে আমরা শেষ রাইডটার কাছে এসে দাড়ালাম। এটার আবার গালভরা একটা নাম আছে, “ফ্লাইং ডিস্কো!” অনেকটা পাইরেট’স শিপের মত তবে আরও এক্সট্রিম এবং দুলুনির সাথে ঘোরানোও হয় র‍্যান্ডম মোশনে। তো ভীতু ছেলেটা এককথায় না করে দিল। সে আর মরে গেলেও উঠবে না। টিকেট চুলোয় যাক, তাকে আরও টাকা দিলেও সে উঠবে না! কী আর করা, আমরা তিনজন। অপারেটর জানিয়ে দিল, তিনজন হলে তিনজনকে তিনদিকে বসতে হবে ভারসাম্যের জন্য। অর্থাৎ এবার আর বিষাণ আমার পাশে বসতে পারছে না, আমাকে একলাই বসতে হবে একদিকে। একটু ভয় নিয়েই বসলাম। কারণ এটা নাকি পাইরেট’স শিপের মত অতটা নিরীহ না। অপারেটর এসে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে দিল। আমার আর নড়ার উপায় থাকল না বেশী। এরপর পায়ের নীচ থেকে লোহার পাটাতনও সরে গিয়ে গোল গর্ত মত দেখা গেল। পায়ের নীচে যখন মাটি থাকল না তখন নিজেকে খুব অসহায় লাগতে লাগল। শুরু হল দুলুনি আর ঘুর্নন একসাথে। এই যন্ত্রদানব যেন আমাকে নিয়ে শূন্যে ইচ্ছেমত লোফালুফি করছে। রাইডের পাশের রাস্তায় লোক জমে গেছে আমাদের দেখতে। প্রতিমুহুর্তে মনে হচ্ছে আমি তুমুল বেগে আছড়ে পড়ব গর্তের ভিতরে, কিংবা ছিটকে যাব শূন্যে। মনে হচ্ছে হ্যারি পটারের ও্যহ্‌ম্পিং উইলো গাছ আমাকে নিয়ে খেলা করছে। এর এক ফাঁকে চেয়ে দেখি সেই ভীতু ছেলেটা আমাদের দিকে দাঁত বের করে হাসছে আর মোবাইলে ভিডিও করছে! আমিও হাসলাম, ও জানে না যে কী মিস করল! একসময় চেঁচিয়ে উঠলাম, “Yahoo! I’m flying……..I’m enjoying it!” কেন যে মুখ থেকে বাংলা বের হল না, তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার! অবশ্য আমার নিজেরও একটা ব্যাখ্যা আছে। একসময় যন্ত্রের দাপাদাপি বন্ধ হল। হালকা দুলুনিতে আমার চোখভোরে ঘুম নেমে এল। পুরোপুরি থামতে, তাড়াতাড়ি নেমেই আমরা দৌড় লাগালাম, কারণ ঘড়িতে প্রায় সাড়ে পাঁচ বাজে। আড়ং থেকে ব্যাগ ফেরত নিয়ে বিষাণের কাছ থেকে কোনমতে বিদায় নিয়েই দৌড় লাগালাম ক্লাসের দিকে। যারা এতক্ষণে আমাকে নার্ড (Nerd) বলে ভেবে বসেছেন, তাদেরকে বলে রাখি- এটা ছিল ল্যাব ক্ল্যাস যার অ্যাটেন্ডেন্সেই ৫০%! তা না হলে আমার বয়েই গেছিল এত ওড়াউড়ি শেষে এত তড়িঘড়ি করে ক্লাসে দৌড়াতে!

****

সেদিন রাতে আমার ঘুম খুব ভাল হয়েছিল। আর যেমনটি আশা করেছিলাম, স্বপ্নেও আমি অনেকদিন পর উড়তে পারলাম। কিন্তু একদম আগের মতই ধীর-স্থিরভাবে, নতুন অভিজ্ঞতার কোন প্রভাবই তাতে পড়ল না। তবে খুশীতে লাফিয়ে উঠলাম যখন একসময় আকাশভেঙ্গে বৃষ্টি নামল। আমার এতদিনের ওড়াউড়িতে কখনও বৃষ্টি পাইনি স্বপ্নে। এবার পেলাম। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা নিচে নেমে আসছে আর আমি হালকা হয়ে উপরে উঠছি আলতো ভঙ্গিতে। সেই ওঠা-নামার বৈপরীত্যের মাঝখানে আমি স্থির হয়ে ভেসে ভিজে যেতে লাগলাম।

কোনটা ভাল লাগল আমার? বাস্তবের ঐ উত্তাল গতির ওড়াউড়ি? যেখানে বৃষ্টির ঝাপটা এসে আমার মুখ ভিজিয়ে দেয়, যেখানে শো শো করে বাতাস কেটে এগিয়ে যেতে থাকি আমি সেটা? নাকি স্বপ্নের ঐ ছান্দিক কিন্তু ধীর-স্থির গতিহীন ওড়াউড়ি? যেখানে আমি বৃষ্টির প্রতিটি কণাকে যেন আলাদাভাবে উপভোগ করতে পারি, বাতাসকে যেন প্রাণ দিয়ে ছুঁয়ে দেখে ভেতরে টেনে নিতে পারি, সেটা? উত্তর খুঁজেই বোধহয় কাটবে জীবন।

বিঃদ্রঃ ছবিটা আমাদের তোলা নয়। আমরা স্কুলের দুই বন্ধু দেখা করে মনে হয় সেই স্কুলের দিনগুলিতেই ফিরে গিয়েছিলাম যখন আমাদের সাথে থাকত না কোন সেলফোন কিংবা ইলেকট্রনিক গ্যাজেট। তাই দু’জনের কারওরই ছবি তোলার কথা মনে হয়নি!

- সীমান্ত রায়


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো অভিজ্ঞতা। স্বপ্নে আমিও উড়ি, সেই ছোটবেলা থেকে এখনও ওড়াউড়ির স্বপ্নটা নিয়মিত দেখে যাই হাসি

দেবদ্যুতি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আহ, প্রথমবার ঢাকা এসে যখন প্রথম লিফটে চড়ার সুযোগ পাই, তখন পদার্থবিদ্যা বইয়ে পড়া (কিন্তু বুঝতে না পারা) সম্ভাব্য অভিজ্ঞতা গুলো যাচাই করে দেখেছিলুম। সেই স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমারও ঢাকাতেই প্রথম লিফটে ওঠা। সম্ভবত ক্লাস ফাইভে। তখন তো আর মধ্যাকর্ষনের ব্যাপার-স্যাপার জানি না। শুধু মনে আছে লিফট উপরে ওঠার সময় নিজের ওজন বেড়ে যাওয়ায় কেমন অভিভূত হয়ে গেছিলাম হাসি
- সীমান্ত রায়

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।