খাদ্যসংস্কৃতি তেমন নিরিহ কোন বিষয় নয়- ২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৬/০৫/২০১৬ - ২:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দ্বিতীয় পর্বে আসুন, এবার দেখা যাক নিরিহ মশুর ডাল কতটা ধার্মীক এবং প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে। যদিও পুরোটাই ধর্মের জাড়ক রসে জাড়িত, কতটা অতিরঞ্জন আর কতটা সত্যি আছে এই গল্পে তা আমরা জানি না।

বাঙালী ডাল খেতো না একসময় এটা নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন বাঙালীর ইতিহাস: আদি পর্বতে। আবার তিনি একটা ‘সম্ভবত’ যোগ করে বলতে চেয়েছেন, ডাল আর্যদের দান। আর্যদের দান হোক আর যাইহোক না কেন, প্রাচীন বাংলায় ডালের চাষ এবং ডাল খাবারের উল্লেখযোগ্য কোন খবর পাওয়া যায় না। বরং মুসলিম শাসক আর তাদের সৈন্যদের মাধ্যমে ডাল, বিশেষ করে মশুরের ডাল বাংলায় প্রচলিত হয়েছিলো বলে যে মত আছে সেটি বেশ জনপ্রিয়।

আমরা যেটা বলতে চাইছি− হিন্দু বিধবা রমণীরা মশুর ডাল ভক্ষণ করেন না। এটা শাস্ত্র অসিদ্ধ লোকাচার। এই উত্তর আধুনিক যুগের বিধবাদের সাথে বিষয়টাকে মেলালে চলবে না কিন্তু। কেন হিন্দু বিধবা রমণীগন মশুর ডাল খেতেন না? এই রহস্যের সরল অনুবাদ করা হয় এভাবে− এতে প্রটিন আছে। আর প্রটিনে বিধবা নারীদের শরীর গরম হয়ে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। তাতে বুদ্ধিবিভ্রমজনিত কারণে তাদের জাত এবং ধর্মনাশ হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে! বিষয়টা কি আদতে তাই? না। গল্পটা ঘাপটি মেরে বসে আছে রাজীব লোচন রায়ের ঘরে এবং ঘাড়ে। অবশ্য আরো একটা মত রয়েছে হিন্দু বিধবাদের মশুরের ডাল না খাবার। তবে সেটার বিস্তারিত আলোচনা আমরা করবো না। কারণ ইতিহাসের ধারা বুঝলে আমরা তার হদিস এমনিতেই পেয়ে যাবো।

রাজীব লোচন রায়− এই নামটা বললে অধিকাংশ মানুষই তাকে চিনবেন না। কিন্তু যদি বলি− কালাপাহাড়! নিমাই ভট্টাচার্যের মেমসাহেব উপন্যাসের কালাপাহাড়! বাংলাসাহিত্য পড়েছেন আর কালাপাহাড়ের নাম জানেন না, এমন তো হবার কথা নয়, তাই না? কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাজীব লোচন রায় কী করে কালাপাহাড় হলেন? সে অনেক কথা, অনেক গল্প। গোড়া হিঁদুরা বলবেন, জোর করে এনার খৎনা দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টি আদতে সত্যি নয় একেবারেই। রাজীব লোচন রায় কে? ইনি ব্রাহ্মণ ছিলেন, তবে কেউ বলেন উত্তর বঙ্গের আর কেউ বলেন পাণ্ডুয়ার (পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান হুগলি জেলায়)। ‘রায়’ হচ্ছে মুসলমান শাসকদের দেওয়া উপাধি। যারা প্রচুর অস্থাবর সম্পত্তির অধিকারী, তাদের এই উপাধী দেওয়া হতো। যাদের স্থাবর সম্পত্তি প্রচুর তাদের উপাধী দেওয়া হতো ‘চৌধুরী’। আর ‘রায়চৌধুরী’ তাদেরই বলা হতো যাদের স্থাবর এবং অস্থাবর দুটোই প্রচুর থাকতো।

বিশেষ কিছু জানা না গেলেও রাজিব লোচন রায় ভালো যুদ্ধ শিখেছিলেন− এটুকু জানা যায়। ফলে, নজরে পরে যান গৌড়ের শাসক সুলাইমান কারনানীর। বাংলা ও বিহারের শাসনকর্তা সুলাইমান কারনানী (কেউ আবার বলেন কারারানী/কররানী)। সুলাইমান কারনানী নামটা সিন্ধী হলেও, ইনি ছিলেন জাতে আফগান। কাররাণীরা মাত্র বারো বছর (১৫৬৪-১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত) বাংলা শাসন করে। তাজ খান কাররাণী তার জীবনের শুরুতে আরেক আফগান শের শাহ্‌ সূরীর অধীনস্থ কর্মচারী ছিলেন। প্রভুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে সূরীদেরই শাসক মুহাম্মদ আদিল শাহ্‌ সূরীকে আক্রমণ করে উত্তর প্রদেশের অংশ দখল করেন তাজ খান। পরবর্তীতে মুহাম্মদ আদিল শাহ্‌ আর সম্রাট হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্যের সম্মিলিত আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে পূর্ব দিকে সরে যান। পরে বাংলার দুর্বল শাসক তৃতীয় গিয়াস উদ্দীন শাহকে কৌশলে হত্যা করে বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। তাজ খান কাররাণী বাংলায় এসেছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কুর্‌রম থেকে। বাংলা আক্রমণের সময় ইমাদ, সুলাইমান ও ইলিয়াস নামে তার তিন ভাইও সাথে ছিলেন। সাম্রাজ্য স্থাপনের পর তিনি সেটি ভোগ করার জন্য দুই বছরেরও কম সময় পান। ১৫৬৬ খ্রীস্টাব্দে তাজ খান কাররাণী মারা যাবার পর তার ছোট ভাই সুলাইমান খান কাররাণী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। সুলাইমান কাররানীদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় (প্রায় সাত বছর) বাংলা শাসন করেছিলেন। তিনি বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে পদ্মার তীরের ট্যাঁড়া বা তান্দায় (পশ্চিমবঙ্গে) স্থানান্তর করে শরীয়া আইন প্রচলন করেছিলেন। ট্যাঁড়া বা তান্দা প্রায় দশ বছর বাংলার রাজধানী থাকলেও এর নাম আজ প্রায় কেউ জানে না। শহরটি পরিত্যক্ত হবার পর এক সময় পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। (ট্যাঁড়ার খাজা নামে একটা তিলের খাজা এখনও পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের মালদাতে)

এই সুলাইমানের সেনাপতি ছিলেন রাজিব লোচন রায় ওরফে কালাপাহাড়− যিনি আমৃত্যু মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। কেউ কেউ লোদী সম্রাট সুলতান বাহ্‌লুল লোদীর ভাগ্নে মিয়াঁ মুহাম্মাদ ফারমুলীকে তার হিন্দু মন্দির ধ্বংসের প্রবণতার জন্য কালাপাহাড় নামে আখ্যায়িত করেন। কিন্তু এখানে আলোচ্য কালাপাহাড় মিয়াঁ মুহাম্মাদ ফারমুলীর প্রায় একশত বছর পরের মানুষ। রাজীব লোচন রায়ের কর্মজীবন শুরু কিভাবে হয়েছিল সেকথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। তবে গৌড়ের সেনানীতে যোগ দিয়ে সৈন্য পরিচালনা ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা দেখানোর গল্প পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত যোগ্যতায় তিনি সুলাইমানের শাসনামলে গৌড়ের ফৌজদারের পদ লাভ করেন। এভাবে তিনি সুলাইমানের কাছাকাছি আসার সুযোগ পান এবং তার কন্যার প্রেমে পড়েন। রাজীব লোচন রায় সুলাইমানের কন্যার পাণিপ্রার্থী হলে সুলাইমান তাকে ধর্মান্তরিত হবার শর্ত দেন। কারো কারো মতে, রাজীব লোচন রায়ের যুদ্ধ দক্ষতা দেখে সুলাইমান নিজেই তার নিকট নিজের কন্যার বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। উচ্চাভিলাষী রাজীব লোচন রায় সুলাইমানের প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং ধর্মান্তরিত হয়ে সুলাইমানের কন্যাকে বিবাহ করেন। এর ফলে তিনি নিজ সমাজে ‘জাতিচ্যূত’ হন। শাহজাদীও বলেন, একজন নারীর জন্য ধর্ম পরিবর্তন করার কোনো কারণ ছিল না। নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিছুদিন পর তিনি বাংলার ধর্মগুরুদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চাইলে তারা কোন বিধান দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে রাজীব পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্তের সংকল্প করেন। কিন্তু পুরীর ধর্মগুরুরা তাকে ও তার স্ত্রীকে মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা দেন এবং তার কোন প্রায়শ্চিত্ত হবে না বলে জানিয়ে দেন। এতে রাজীব লোচন রায় মর্মাহত হন এবং প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়েন। সুলাইমান এই রকম সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। ওডিশার (ঊড়িষ্যা) রাজা মুকুন্দ দেবের সাথে যুদ্ধে সুলাইমান বুদ্ধি করে রাজীব লোচন রায়কে তার অন্যতম একজন সেনাপতি বানিয়ে দেন। এতে তিনি ঊড়িষ্যার ধর্মগুরু ও ধর্মস্থানগুলোর উপর নিজের অপমানের প্রতিশোধ নেবার সুযোগ পান। ১৫৬৭ খ্রীষ্টাব্দে সুলাইমান কাররাণীর পুত্র বায়েজিদ খান কাররাণী ও সেনাপতি সিকান্দার উজবেকের যৌথ আক্রমণে মুকুন্দ দেবের পতন হলে কালাপাহাড় ঊড়িষ্যা ও তার নিকবর্তী অঞ্চলের হিন্দু মন্দিরগুলোতে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। ১৫৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কালাপাহাড় পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান, প্রতিমা ভাঙচুর করেন এবং মন্দিরের সম্পদ লুণ্ঠন করেন। জানা যায়, তিনি জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার কাঠের প্রতিমা উপড়ে নিয়ে হুগলীর তীরে আগুনে পুড়িয়ে দেন। কালাপাহাড় ঊড়িষ্যার বালেশ্বরের গোপীনাথ মন্দির, ভুবনেশ্বরের কাছে কোনার্ক মন্দির, মেদিনীপুর, ময়ূরভূঞ্জ, কটক ও পুরীর আরো কিছু মন্দিরে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালান। তার মন্দির আক্রমণের প্রক্রিয়াটি একটু অভিনব ছিল। তিনি গরুর চামড়ার বিশাল আকৃতির ঢোল আর পিতলের বড় বড় ঘন্টা মন্দিরের ভেতরে ক্রমাগত বাজিয়ে তীব্র অনুরণন তৈরি করার ব্যবস্থা করতেন। সেই অনুরণনের তীব্রতায় প্রতিমার হাতগুলো খসে পড়ত। এতে উপস্থিত লোকজন হতভম্ব হয়ে পড়লে প্রতিমা উপড়ে ফেলা হত। (এই লোকটা ভীষণ ভালো পদার্থবিজ্ঞান জানতেন মনে হচ্ছে!!) কালাপাহাড় মন্দির সমূলে ধ্বংস করার চেয়ে প্রতিমা ধ্বংস ও লুটপাটে বেশি আগ্রহী ছিলেন। মন্দির আক্রমণের শেষ পর্যায়ে তিনি সম্বলপুরের ‘মা সম্বলেশ্বরী’র মন্দিরে আক্রমণ করতে সম্বলপুরের উপকণ্ঠে মহানদীর তীরে দুর্গাপালীতে উপস্থিত হন। সম্বলেশ্বরী মন্দিরের পূজারীরা মন্দির রক্ষার্থে এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ নেন। একজন নারীকে গোয়ালিনীর ছদ্মবেশে কালাপাহাড়ের ছাউনিতে পাঠানো হয়। এই নারী সৈন্যদের মধ্যে বিষ মিশ্রিত দুধ, দই, ছানা বিক্রি করে। পরদিন সকালে খাদ্যের বিষক্রিয়ায় কালাপাহাড়ের বেশির ভাগ সৈন্য আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তিনি অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে পালিয়ে যান।

তার মন্দির ধ্বংসের ঘটনা ঊড়িষ্যা ও মেদেনীপুরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ১৫৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কাররাণীরা কোচবিহার আক্রমণ করলে সেখানে তিনি কামাখ্যা মন্দিরসহ আরো কিছু মন্দির ধ্বংস করেন। কালাপাহাড় কাররাণীদের শেষ শাসক দাউদ খান কাররাণীর আমল পর্যন্ত কাররাণীদের সেনাপতি ছিলেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলোতে অংশগ্রহণ করেন। ১৫৭৬ খ্রীষ্টাব্দে কাররাণীদের পতনের পর কালাপাহাড় সম্ভবত আফগান নেতা মাসুম কাবুলীর দলে যোগ দেন এবং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন। সম্ভবত ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সেনাপতি খান- ই-আজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মাসুম কাবুলী পরাস্ত হলে সেই যুদ্ধে কালাপাহাড়ও নিহত হন।

এবার আসল কথা। এই কালাপাহাড়ের প্রিয় খাদ্য ছিল মুশুর ডাল। এই ডাল, তুর্ক সেনারাও খেতো। কালাপাহাড় এই ডাল খেতেন বলে পরে ব্রাহ্মণরা এই ডালের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী করে খাওয়া নিষিদ্ধ করে দিয়ে একধরনের প্রতিশোধ নেন। সাধারণ মানুষ বিষয়টা না মানলেও মানসিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল বিধবা নারীরা কিছু বলতে পারেনি। তারা শাস্ত্রের বিধান মনে করে মশুরডাল খাওয়া বন্ধ করে দেয়। এর সঙ্গে প্রোটিনের বা শরীর গরম হয়ে যাবার কোনো সম্পর্ক নেই । কারণ, কম বেশী প্রোটিন সব ডালেই আছে।
আরও একটা মত আছে হিন্দু বিধবাদের মশুর ডাল না খাবার। সেটা হচ্ছে, মশুর ডাল ভারতে এসেছিল মুসলিম শাসকদের হাত ধরে। প্রচলন করে নবাবের সিপাইরা। মুসলিমদের দ্বারা প্রচলন বলেই হিন্দু বিধবা ও পুরোহিতরা সাধারণত মশুরির ডাল খান না।

দুটো ঘটনাই মোটামুটি ধর্মের মোড়কে আচ্ছাদিত। প্রথম গল্পটি ভীষণভাবে প্রতিশোধের কাহিনী। ধর্ম ত্যাগী একজন ক্ষমতাবান রাজপুরুষ নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে নিজের সাবেক ধর্ম আর ধর্মগুরুদের উপর ভীষণ অত্যাচার চালায়। তারই ফলশ্রুতিতে ধর্মগুরুর দল একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশোধ গ্রহণ করে কালাপাহাড়ের প্রিয় মশুরের ডাল নিষিদ্ধ করে। এই ব্রাহ্মণরা হয়তো ভাবতেও পারেনি প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে যে নিদান তারা দিয়েছিলেন সেটা একসময় শাস্ত্র অসিদ্ধ লোকাচারে পরিণত হবে− ঠিক সতীদাহ প্রথার মতো।

একইভাবে দ্বিতীয় গল্পটিও কিন্তু এক অর্থে প্রতিশোধরেই গল্প। মুসলমান শাসক আর সৈন্যদের দ্বারা যে খাবারের প্রচলন ঘটে বাংলায় তাকে নিষিদ্ধ করা হয় স্থানীয় ধর্মগুরুদের নিদানে। কারণ মুসলমান শাসকদের বর্বরতার যে তথ্য আমরা জানি তাতে স্থানীয় ধর্মগুরুদের এর বাইরে হয়তো আর করার কিছুই ছিলো না। কারণ তারা জানতো, যুদ্ধ করে পারা না গেলেও ধর্মের দোহাই দিলে মুসলমানদের অনেককিছু থেকে স্থানীয় ধর্মকে রক্ষা করা যাবে।

কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। এত খাবার থাকতে মসুরের ডাল কেন? একটুখানি সূত্র পাওয়া যায় নীহাররঞ্জনের বইয়ে। তিনি জানাচ্ছেন, সাধারণ বাঙালী ডাল না খেলেও উচ্চবর্ণের বাঙালীদের মধ্যে ডাল খাবারের রীতি সীমিত পরিমানে হলেও প্রচলিত ছিলো। এই সূত্র ধরেই আমরা একটা ধারণা করে নিতে পারি যে হয়তো এ দেখে ব্রাহ্মণরা ভেবেছিলেন, যেহেতু উচ্চবর্ণে ডালের প্রচলন হয়েছে আর এটাই খায় রাজিব লোচন রায়− এটা খুব দ্রুত সাধারণ্যে ছড়িয়ে পরবে। সেকারণেই হয়তো মশুর ডালের উপরই খড়গটা নেমে এসেছিলো। কারণ নতুন জিনিস দ্রুত ছড়িয়ে পরে আর সেটা যদি খাবার হয় তো কথাই নেই। দ্বিতীয় গল্পটার ক্ষেত্রেও একই ধরনের হাইপো থিসিসিস দাঁড় করানো যায়। এখানেও ভিন্ন ধর্মীয় শাসককর্তৃক স্থানীয় ধর্মের অবমাননা আর তা থেকে উদ্ভূত ক্ষোভ নানা ধরনের কূটকৌশলের জন্ম দিয়েছিলো।

তো, এই ছিলো আমাদের আজকের অধিবেশন। এতদিন পরেও ইতিহাস আমাদের পিছু ছাড়েনি। বিভিন্ন মোড়কে ভিন্ন ভাবনায় এখনো ইতিহাস আমাদের ভয় দেখায়। কখনো কখনো পুনরাবৃত্তিও হয়ে যায়। সেকারণেই খাদ্যসংস্কৃতির মতো নিরিহ, নরমসরম আর গোলগাল গোছের একটি বিষয়ও কিন্তু ভীষণভাবে ধর্মমনা। কাজেই আমার ভয় প্রতিনিয়তই বাড়ছে বই কমছে না। রাজনীতিটা কিন্তু আরো জটিল যদি আপনি হিন্দু বা সনাতন ধর্মের বিস্তৃত জটাজালের দিকে তাকান, বিশেষ করে বর্ণাশ্রম প্রথার দিকে। এখানে জল চল, জল অচলসহ নানান কিম্ভূত বিষয় আছে। এই সবকিছুই কিন্তু খাদ্যসংস্কৃতিরই অংশ। আমি সনাতন ধর্মের কথা বলছি, কারণ জন্মসূত্রে আমি এই ধর্মটিতে আছি (মানা না মানার দায়ভার আমার)। দেখে দেখে বড় হয়েছি নানান কিছু। কাজেই অন্য ধর্ম কিংবা সম্প্রদায়ের বিষয়গুলো আমি জানি না।

কোথায় যে যাব!?

অনার্য তাপস
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সূত্র: রামকৃষ্ণভট্টাচার্য সান্যাল এবং তাঁর চাপড় ঘন্ট। ফেসবুকে তার আরো কিছু লেখা থেকে সংস্কৃত সাহিত্যের সূত্রগুলো নেওয়া।
রামকৃষ্ণভট্টাচার্য সান্যাল এর সাথে একটি যৌথ প্রকল্পের জন্য বেশ কিছু লেখা তৈরি করা হয়েছিলো। এটি তারই একটি অপ্রকাশিত অংশ।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


মন্তব্য

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

লেখা ভালো লাগলো, মসুর ডালের ঘটনা জানা ছিল না.

এ পর্বে প্যারাগুলোর মাঝে স্পেস দেয়ায় পড়তে আরাম হলো.

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

সোহেল ইমাম এর ছবি

চমৎকার। কে জানতো মশুরের ডালের ছোট্ট দানার মধ্যে এতখানি ইতিহাস লুকিয়ে আছে। লেখাটা দারুন হয়েছে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

অনার্য তাপস

হাসিব এর ছবি

বুঝলাম। কিন্তু রেফারেন্স থাকা উচিত ইতিহাস নিয়ে লেখাগুলোর।

শেহাব এর ছবি

বেশ ভাল লাগল।

 ‍অনার্য তাপস এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তাপস

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক আগে সচলে প্রকাশিত এই পোস্টটার কিছু কিছু বাক্যের সাথে এই লেখাটার কিছু বাক্যের আশ্চর্য অভিন্নতা আছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আপনার নির্দেশিত পোস্টটির তারিখ দেখা যাচ্ছে ২০১১ সাল। আমি সচলায়তনে লিখতে শুরু করি ২০১৫ সালের একেবারে শেষের দিকে। দুটি ঘটনা একই ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়ে। প্রেক্ষাপটও মোটামুটি একই। সে কারণে বাক্যগঠন একই রকম হতে পারে।
ধন্যবাদ।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ডাল থেকে তো দেখি ডাইলের ইতিহাস বরং নিরীহ

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক নিরিহ। তবে ডাইলের ইতিহাসে একসময় আমার ৭০টাকার একটা হৃদয়বিদারক গল্প আছে বইলা ওটা আমার কাছে পেইনফুল। তারপরেও মশুরের চাইতে নিরিহ কিন্তু বিষয়টা।

দেবদ্যুতি এর ছবি

মশুর ডাল আমার বহুত পছন্দের। তবে শুধু হিন্দু বিধবা বা ব্রাহ্মণ নয়, মশুর ডাল নিষিদ্ধ যে কোনো হিন্দুর নিরামিষ খাবারে, কারণটা যতদূর জানি তাতে এ ডালের আমিষের পরিমাণই এ জন্য দায়ী। কেবল অনুকূল ঠাকুরের অনুসারীদের নিরামিষ-আমিষের ধারণা একটু আলাদা বলে তারা মসুর ডাকলে নিরামিষ মনে করে।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

অতিথি লেখক এর ছবি

সব ধরনের ডালেই আমিষ, প্রটিন ইত্যাদি আছে। পরিমানে কম আর বেশি। নিষিদ্ধটা করাই হয়েছে ওই কারণে। তারপর তাতে নানা ঘটনা আর ব্যাখ্যার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।
------------------------------
তাপস

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।