দার্জিলিং এর গপ্পো # ১০ম পর্ব # কালিম্পং! কালিম্পং!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০৩/১২/২০১৬ - ৪:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রেমে পড়েছি। ভুল বলছি না, সত্যিই প্রেমে পড়েছি। কৈশোরে টাইটানিক সিনেমা দেখে কেট উইন্সলেটের প্রেমে পড়েছিলাম। দুষ্টু ছেলেরা বলে এইগুলো প্রেম না, ক্রাশ। ফেসবুকের এই যুগে কোনটা প্রেম আর কোনটা ক্রাশ সেটার মাঝে পার্থক্য আমার বুঝে আসে না। সম্ভবত কিছুটা আদিম যুগেই রয়ে গেছি। যা বলছিলাম, প্রেমে পড়েছি। কোন রমণীর নয়, পাইন গাছের। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন বিদেশী সিনেমায় কিংবা নতুন বছরের উপহার পাওয়া ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠায় পাইন গাছের ছবি দেখেছি। বড় হয়ে ইউটিউবে পাইন গাছের ভিডিও দর্শন করেছি। অবশেষে দার্জিলিং ঘুরতে এসে সামনাসামনি পাইনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রেমেই পড়ে গেলাম। ৩ দিন ধরে যেইভাবে পাইন গাছের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থেকেছি আমার ধারণা নতুন প্রেমিক তাঁর প্রেমিকার দিকেও এইভাবে তাকিয়ে থাকে না। বিয়ের পর বউ নিয়ে দার্জিলিং ঘুরতে আসলে ভুলেও পাইনের দিকে এইভাবে তাকানো যাবে না। দেশে ফিরে তাহলে নির্ঘাত না খেয়ে মরতে হবে।

পুষ্কর বেশ জোরেশোরেই গাড়ি চালাচ্ছে। আমাদের আজকের গন্তব্য কালিম্পং। সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে রাতে ফিরব দার্জিলিং। যাত্রাপথের দৃশ্যাবলী অসাধারণ। সত্যি বলতে কি কালিম্পং কি কি দেখার আছে সেই বিষয়ে আমাদের ধারণা নগণ্য। মূলত দার্জিলিং থেকে কালিম্পং এর যাত্রাপথের সৌন্দর্য দর্শনের নিমিত্তেই আমাদের আজকের ভ্রমণ। এবং সেই ভ্রমণের আনন্দ কড়ায় গণ্ডায় উসুল করেছি।

দার্জিলিং এর আবহাওয়ার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। এই হয়ত ঝকঝকে রোদ, আবার পরক্ষণেই মেঘ এসে চারপাশ অন্ধকার করে দেয়। শীতের প্রারম্ভ বিধায় কুয়াশার আধিপত্যও দিন দিন বাড়ছে। আমরা যখন হিমালয় মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট থেকে রওনা দিয়েছি তখন প্রকৃতি সূর্যস্নানে হাসছে। শহর থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সেই হাসিমুখ উধাও। শূন্যস্থানে ভর করেছে কুয়াশাস্নাত বিষণ্ণতা। সাপ্তাহিক ছুটির দিন (রোববার) ছিল বলে রাস্তায় জনমানুষ এবং যানবাহন উভয়ই কম। দ্রুতগতিতে পাহাড়ি বাঁকগুলো পাড়ি দেওয়ার সময় শরীর কিছুটা হলেও শিরশির করছিল। একপাশে গভীর খাদ। কোনভাবে যদি গাড়ির ব্রেক নষ্ট হয় তাহলে হাড়গোড় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এভাবেই কিঞ্চিৎ ভয় এবং ততোধিক উত্তেজনার দোলাচলে পাইন আর ধুপি গাছের অরণ্য চিড়ে আমাদের চৌচক্রযান ছুটে চলছিল কালিম্পং এর পানে। কুয়াশার অবগুণ্ঠন ঠেলে হঠাত করে ছোট ছোট কিছু লোকালয়ের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও সেগুলোতে প্রাণের স্পন্দন খুব একটা চোখে পড়ে নি। ছুটির দিন বলেই হয়তবা।

প্রথমবারের মত যাত্রাবিরতি দিলাম দার্জিলিং থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে লামাহাটা নামক এক ছোট্ট গ্রামে। গ্রাম না বলে রিসোর্ট বলাই ভাল। সমতল থেকে ৫৭০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠা গ্রামটিকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজানো হয়েছে পর্যটকদের জন্য। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কালিম্পং যাওয়ার পথে এই স্থানে যাত্রাবিরতি করেন। এখানকার সৌন্দর্যে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশ দেন যেন এইখানে ইকো ট্যুরিজম প্রকল্প চালু করা হয়। সেই পরিকল্পনারই সফল বাস্তবায়ন আজকের লামাহাটা। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে যে অনেক কিছুই সম্ভব লামাহাটাই তার উত্তম উদাহরণ। আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিগণ যদি এইরকম এক-আধটু সদিচ্ছা একটু দেখাতেন তাহলেই দেশটা পাল্টে যেত।

লামাহাটায় পাইন এবং ধুপি অরণ্যের ভিতর দিয়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ পায়ে চলা পথ আছে। আছে অর্কিডের বাগান। আছে বৌদ্ধ মন্দির। রাত কাটানোর জন্য আছে তাবু এবং গ্রামবাসীদের বাড়ি। কিন্তু আমাদের হাতে ছিল না সময়। তাই ১০ মিনিটের একটা টি-ব্রেকের সুযোগে বাইরে থেকে যতটুকু দেখে নেওয়া যায় সেটুকুই লাভ। এই রিসোর্টে একটা রাত কাটানোর ইচ্ছে মনের গহীনে তোলা থাকল। ধুপি গাছগুলোর মাঝ দিয়ে একসারিতে বিভিন্ন রঙের অনেকগুলো পতাকা টানানো আছে। পুষ্করের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম এগুলো প্রার্থনা পতাকা। পতাকাগুলোতে বিভিন্ন ধর্মীয় বাক্য এবং চিহ্ন আঁকা। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই পতাকাগুলোর মাঝ দিয়ে প্রবাহিত বাতাস প্রকৃতি এবং মানুষের মনকে পরিশুদ্ধ করে। ব্যাখ্যাটা সত্যিই চমৎকার।

লামাহাটা পার হওয়ার পর থেকেই গাড়ি ক্রমাগত নিচের দিকে নামছিল। পুষ্করকে জিগ্যেস করতেই সে রহস্যমাখা হাসি উপহার দিয়ে জানাল অপেক্ষা করুন। রহস্য উন্মোচিত হতে খুব বেশি সময় লাগে নি অবশ্য। রাস্তার পাশে হঠাত করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাদের নামতে বলল। সামনে দেখি ছোট্ট একটা গেট যার উপরে লেখা Lovers Meet View Point. “তিস্তা নদী দেখে নিন” জানানো মাত্র বুঝলাম কেন পুষ্কর কেন রহস্য করছিল। এই নদী নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের রাজনীতি, মমতা ব্যানার্জির তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা এবং সেই নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের অসন্তোষ সবকিছুর ব্যাপারেই পুষ্করের ভাল ধারণা আছে। কথা না বাড়িয়ে ২০ রুপির টিকেট কেটে সবাই ভিউ পয়েন্টে প্রবেশ করলাম। বসার জন্য কিছু সিমেন্টের বেঞ্চ আছে যেগুলো কি না যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধুকছে। এখান থেকে তিস্তাকে চমৎকার দেখায়। কুয়াশার চাদরে চারপাশ আচ্ছন্ন থাকায় নিচের দৃশ্যাবলী খুব একটা স্পষ্ট নয়। নদীর দুধারে গাড়ি চলার রাস্তা দেখা যাচ্ছে। এক পাশের রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছি। নদী পার হয়ে অপর পাশের রাস্তায় কিছুক্ষণ পর উঠব।

হিমালয় পর্বতমালায় জন্ম নিয়ে ৩০৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একপাশে সিক্কিম, অন্যপাশে পশ্চিমবঙ্গকে আলাদা করে কালিম্পং এবং জলপাইগুড়ি জেলার বুক চিড়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যমুনায় মিশেছে। এই নদীর পানি যতটা ঘোলা তার থেকেও ঘোলা এই নদী নিয়ে রাজনীতি। বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জির রাজনীতি। আশা করছি কোন একদিন সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। রাজনীতিবিদগণ নিজেদের ইগো বিসর্জন দিয়ে জনতার জন্যই রাজনীতি করবেন।

ভিউ পয়েন্টে বেশিক্ষন থাকি নি। আবারও রওনা দেওয়ার অল্প সময়ের মাঝেই আমরা তিস্তা নদীর উপর বানানো সেতুটি পার হলাম। সেতু অতিক্রমের আগে সারিবদ্ধভাবে অপেক্ষমাণ গাড়ির লম্বা লাইন অতিক্রম করতে হয়েছে। তিস্তা নদীতে র্যামফটিং হয় জানতাম না। র্যােফটিং এর শখ অনেকদিনের। হাতের কাছে র্যাতফটিং এর এত চমৎকার সুযোগ ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু ওই যে বললাম, সময়ের বড়ই অভাব।

তিস্তা পার হওয়ার পর গাড়ি আবারও উপরে উঠা শুরু করল। এবার আর কোথাও থামাথামি নেই, একটানে কালিম্পং। কালিম্পং-এ প্রবেশের পথে একটা স্বাগত তোড়ন চোখে পড়ল। খেয়াল করেছি Gorkha Territorial Administration এর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটা জেলায় প্রবেশের আগে একইরকম স্বাগত তোড়ন দেখা যায়। দার্জিলিং জেলায় প্রবেশের সময়ও এমনটি দেখেছিলাম। পাশেই আরকেটা রাস্তা চলে গেছে লাভা, লোলিগাও, রিশপ হয়ে সিক্কিমের রাজধানী গ্যাংটক পর্যন্ত। বাংলাদেশীদের সিক্কিম যাওয়ার অনুমতি থাকলে এই সুযোগে অবশ্যই ঘুরে আসতাম।

কালিম্পং যখন পৌঁছেছি তখন মধ্যদুপুর, যদিও আকাশ দেখে সেটা বোঝায় উপায় নেই। সমতল থেকে ৪১০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত শহরটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নবীনতম জেলা শহর। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কালিম্পংকে জেলা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে এটি ছিল দার্জিলিং জেলার একটি থানা শহর। কালিম্পং এর উচ্চতা দার্জিলিং এবং গ্যাংটক থেকে নিচুতে হওয়ায় বছরের বেশিরভাগ সময়েই এখানকার আবহাওয়া আরামপ্রদ থাকে। যারা দার্জিলিং এর চরম ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারেন না কিন্তু হিমালয়ের বরফ মাখানো পর্বতশীর্ষে রোদের প্রতিফলন দেখতে চান তাঁদের জন্য চমৎকার জায়গা কালিম্পং।

দার্জিলিং থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এক সময় ভুটানের অংশ থাকা কালিম্পংকে ব্রিটিশরা দখল করে নেয় ১৮৬৫ সালে। তিব্বতের সাথে ভারতবর্ষের বাণিজ্যের অন্যতম এক অবস্থানগত গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল কালিম্পং। ১৯৬০ সালে চীন তিব্বত দখল করে নেওয়ার পর এই বাণিজ্যপথটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে সিকিমের নথুলা পাস হয়ে আবারও বাণিজ্য চালু হয়েছে অবশ্যযদিও সেটার মাত্রা খুব একটা বেশি নয়। ব্রিটিশরা কালিম্পং দখল করে নেওয়ার পর জায়গাটির প্রভূত উন্নতি ঘটায়। এখানে অনেক নামীদামী বিদ্যালয় আছে। আর আছে অনেকগুলো নার্সারি। এসব নার্সারিতে উৎপন্ন ফুল ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় যায়। এমনই এক নার্সারি ছিল আমাদের পরবর্তী গন্তব্য।

Pine View Nursery নামক এই নার্সারিটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন MS Pradhan ১৯৭১ সালে। তিনি পরলোকগত হয়েছেন ২০১২ সালে কিন্তু নার্সারিটি স্ব-মহিমায় টিকে আছে। এইখানে আছে বিচিত্র ধরণের ক্যাকটাসের এক বিপুল এবং দুর্লভ সংগ্রহ। ক্যাকটাস ছাড়াও বিভিন্ন জাতের ফুলের গাছও আছে তবে মূল আকর্ষণ ক্যাকটাস। ক্যাকটাস যে এত বর্ণের এবং ডিজাইনের হতে পারে তা এখানে না আসলে বুঝতে পারতাম না। উঁচু পাহাড়ের উপর অবস্থিত হওয়ায় এখান থেকে পুরো কালিম্পং শহরটিকে চমৎকার দেখায়। নার্সারির মালিক যে বেশ রুচিশীল ছিলেন সেটি পুরো নার্সারি এবং নার্সারি কমপ্লেক্সের ভিতরে অবস্থিত বাড়িগুলো দেখলে বোঝা যায়। এমন একটা জায়গায় এমন সুন্দর একটা বাড়ি থাকলে মন্দ হত না।






কালিম্পং-এ আমাদের পরবর্তী এবং শেষ গন্তব্য দেলো রিসোর্ট। এটি কালিম্পং এর সবচাইতে উঁচু জায়গা। পাইন ভিউ নার্সারির একদম বিপরীত দিকে এই রিসোর্ট। মানে আবার কালিম্পং শহর অতিক্রম করে বিপরীত দিকে যেতে হবে। কালিম্পং এর মূল শহরটা একদম ছোট। শহরের কেন্দ্রে মার্কেট স্কয়ার নামে একটা জায়গা আছে। এটিই শহরের সবথেকে ব্যস্ত অংশ। এইখানে আসলেই লোকজনের হৈ হল্লা, যানবাহনের ভিড় আর ট্রাফিক পুলিশের ব্যস্ততা চোখে পড়ে। শহরের বাকি অংশ একদম শুনশান। টুরিস্টের ভিড় দার্জিলিং এর তুলনায় অনেক কম। যারা কালিম্পঙে ঘুরতে আসেন তাঁদের বেশিরভাগই লাভা, রিশপ কিংবা লোলিগাওতে রাত কাটান।

দেলো রিসোর্টের অবস্থান কালিম্পং শহরের ৬ কিলোমিটার উত্তরে দেলো পাহাড়ে। এই পাহাড়ে অবস্থিত পানির রিজার্ভার থেকেই পুরো কালিম্পং শহরে পানির সরবরাহ হয়। একদম পাহাড় চূড়ায় রিসোর্টটি বানানো হয়েছে পর্যটকদের কথা চিন্তা করেই। ২০ রুপির টিকেট কিনে আপনি পুরো রিসোর্টটি ঘুরে দেখতে পারবেন। চাইলে এখানে রাতও কাটানো যায় কিন্তু সে জন্য অনেকগুলো টাকা খরচ করতে হবে। দেলো রিসোর্টে আমাদের জন্য অনেক বড় একটা চমক অপেক্ষা করছিল। সেটা হচ্ছে প্যারাগ্লাইডিং।

সারা জীবন ভিডিওতেই দেখেছি প্যারাগ্লাইডিং এর দৃশ্য। দার্জিলিং কিংবা কালিম্পং-এ যে প্যারাগ্লাইডিং এর ব্যবস্থা আছে জানতামই না। জানতাম কাছেপিঠে নেপালের পোখরাতেই প্যারগ্লাইডিং করা যায়। হাতের কাছের এমন সুবর্ণ সুযোগ কি আর হারানো যায়? সমস্যা একটাই, টাকা। একদম হিসেব করে যতগুলো টাকা এনেছি সেগুলো শেষ হওয়ার পথে। ১৫ মিনিটের একদফা প্যারাগ্লাইডিং এর খরচ ২৮০০ রুপি (এমনিতে খরচ ৩৫০০ রুপি কিন্তু দীপাবলির সময় ছিল বলে ৭০০ টাকা ছাড়)। সমাধান দিল সাইমুম। সে প্রচুর টাকা নিয়ে এসেছে। আমরা আপাতত ধার নিব, পরবর্তীতে দেশে ফিরে শোধ করে দিব। যদিও শেষ পর্যন্ত সাইমুমের কাছ থেকে আর ধার করার প্রয়োজন পড়ে নি। বুদ্ধি করে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ডলার এনডোর্স করিয়েছিলাম। এই কার্ডের মাধ্যমেই দার্জিলিং ফিরে State Bank of India-র এটিএম বুথ থেকে কড়কড়ে রুপি বের করে দেশে ফেরার বন্দোবস্ত করতে হয়েছিল। এমনিতে ক্রেডিট কার্ড বস্তুটা আমার খুব অপছন্দের। তবে দার্জিলিং ভ্রমণে খুব কাজে দিয়েছিল।

আমি আর অনিন্দ্য তৈরি ছিলাম প্যারাগ্লাইডিং এর জন্য। সাইমুম যাবে না আমাদের সাথে। কারণ একটাই, ভয়। একটা কাগজে সই করতে হয় যেখানে লেখা থাকে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটেই যায় তাহলে আয়োজক সংস্থা কোনোভাবেই দায়ী নয়। এইটা পড়েই বেচারার অবস্থা কাহিল। অনিন্দ্য অবশ্য এই ক্ষেত্রে বেশ দার্শনিক। “ভাই, বাবা মা কেউই তো বাইচা নাই। নিজে মরলেই কি আর বাঁচলেই কি। আমি আকাশে উড়বই”, বলে সে উড়াল দিল। ওর কথা শুনে আমিও দার্শনিক হয়ে গেলাম। “বাবা-মা সবাই আছেন, কিন্তু শখও তো আছে। শখই যদি পূরণ করতে না পারলাম তাহলে বাইচা থাইকা কি লাভ”, ভেবে আমিও ফর্মে সই করলাম।

প্যারাগ্লাইডিং যেখান থেকে করে সেই জায়গা থেকে পাহাড়ের ঢাল শুরু হয়েছে। এখান থেকে উড়াল দিলে পাহাড়ে কিংবা পাইন গাছে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। দেলোতে প্যারাগ্লাইডিং এর সময় মারা গেছে এমন কোন রেকর্ড নেই। তবে আবহাওয়া খারাপ হয়ে এলোমেলো বাতাস বইলে অনেক সময় প্যারাসুট পাইন গাছে আটকে যায়। আজকের আবহাওয়া খুব একটা সুবিধের নয়। রোদের অস্তিত্ব তো নেইই, তার উপর ভালই বাতাস বইছে। আমার সাথে একজনকে দেওয়া হয়েছে যে কি না প্যারাসুট নিয়ন্ত্রণ করবে। ২০ বছর বয়সী রাহুল এর বাড়ি নেপাল। সেখানেই প্যারাগ্লাইডিং এর হাতেখড়ি। একটানা সাড়ে ৪ ঘণ্টা উড়বার রেকর্ড আছে বলল। মনে মনে ভাবছিলাম দুর্ঘটনা তো আর রেকর্ড দেখে আসে না। ভুলই করলাম না তো?

অল্প সময়ের মাঝেই দেখি আমার শরীরে একগাদা বস্তু লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক প্যারাসুটেই আমি আর রাহুল উড়াল দিব। আরকেটা ব্যাকআপ প্যারাসুট রাহুলের পিঠের ব্যাকপ্যাকে বাঁধা আছে। যদি কোন কারণে প্রথম প্যারাসুট ছিদ্র হয়ে যায় তাহলে সেটা খুলে দিবে। জীবনে প্রথমবারের মত আকাশে উড়তে যাচ্ছি, ভিতরটা উত্তেজনায় কাঁপছিল। রাহুল কানের কাছে মুখ এনে বলল, “উড়বার জন্য আপনি তৈরি তো?” মাথা ঝুঁকিয়ে সায় দিতেই আমাকে নিয়ে দিল এক দৌড় এবং সেকেন্ডের মাঝে নিজেকে হাওয়ায় ভাসা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম।

এখন পর্যন্ত আমার জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা এই প্যারাগ্লাইডিং। বাতাস যদিও আমাদেরকে সরিয়ে দিতে চাইছিল নির্দিষ্ট পথ থেকে কিন্তু রাহুল খুব ভালোভাবেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছিল। আকাশে উড়বার এই অনুভূতি সত্যিই ভুলবার নয়। নিচে পুরো কালিম্পং শহর। দূরে মেঘের গালিচায় ঢাকা পাহাড় আর ঘন অরণ্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল তাঁদের সৌন্দর্য আবিষ্কারের। নিজেও মাঝে মাঝেই মেঘ আর কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ছিলাম। আমাকে ভয় দেখানোর জন্যই কি না রাহুল জানান না দিয়েই এক্রোব্যাটিক ভঙ্গিতে ডানে বামে ডাইভ দিচ্ছিল। ভয়ের বদলে বেশ মজাই পাচ্ছিলাম। আকাশে উড়ার সাথে সাথেই ভয় কেটে গেছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য সুধা পান করছিলাম। এত উপর থেকে প্রকৃতি দেখার সুযোগ তো আগে কখনও পাই নি।

অনেক নিচে সর্পিলাকার রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা পথচারি, ছুটে চলা জীপগাড়ি কিংবা খেলার মাঠে ফুটবলে মত্ত কিশোরদের কলতান কানে আসছিল। শহর ছেড়ে আমরা এইবার উড়ে চললাম পাইনের ঘন অরণ্যের উপর দিয়ে। কালিম্পং এ তুষারপাত হয় না। হলে হয়ত গাছের ডালে কিংবা পাতার ফাঁকে তুষারের দেখা পেতাম। রাহুলের ভাষ্যমতে সবথেকে সুন্দর দৃশ্য দেখা যাবে নেপালের পোখরাতে প্যারাগ্লাইডিং করতে পারলে। এভারেস্ট সহ হিমালয় পর্বতমালার তুষারশৃঙ্গ দেখতে দেখতে উড়া যায়। এই ইচ্ছেটাও তোলা থাকল।

কথা ছিল ১৫ মিনিট ধরে উড়ব। কিন্তু বিধি বাম। বাতাসের বেগ বেড়ে যাওয়ায় প্যারাসুট সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছিল। ঝুঁকি না নিয়ে তাই নিচে নামার প্রস্তুতি নিল রাহুল। অবতরণ করব কালিম্পং এর সবথেকে বড় খেলার মাঠে। সেখান থেকে গাড়িতে করে আবার দেলো রিসোর্টে নিয়ে যাবে। উড়বার পুরো সময়টি নিজে নিজেই ভিডিও করেছি। টাকা শোধ করে ভিডিওর সিডি নিয়ে তারপর ফিরব। পুষ্কর অপেক্ষায় আছে।

মাঠে অবতরণ করতে গিয়ে দেখি বিশাল রাজনৈতিক জনসভা চলছে। বিষয় ওই একটাই, গোর্খাল্যান্ড। পাহাড়ে নেপালীরা প্রধান জনগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করলেও তরাই সমতলে ভারত ভাগের ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে আগত বিশাল সংখ্যক বাঙালি উদ্বাস্তুরা বসবাস শুরু করতে শুরু করে। নেপালীদের দাবীগুলির প্রত্যুত্তরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিস্পৃহ মনোভাবে বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে দার্জিলিংয়ের স্বায়ত্তশাসন ও নেপালী ভাষার স্বীকৃতির দাবী ওঠে।

১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে সিক্কিম নামক একটি নতুন রাজ্যের উদ্ভব হলে এবং ভারত সরকার দ্বারা নেপালী ভাষাকে ভারতীয় সংবিধান অনুসারে প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের নিস্পৃহতা লক্ষ্য করে এই অঞ্চলে গোর্খাল্যান্ড নামক একটি নতুন রাজ্য তৈরীর জন্য বিংশ শতাব্দীর আশির দশক জুড়ে ব্যাপক ও হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদ নামক একটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদলের সৃষ্টি করা হয়, যাদের ওপর এই জেলার প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়া হয়। ২০০৮-০৯ সাল নাগাদ ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার পৃথক রাজ্যের দাবী মেনে নিতে অস্বীকৃত হলে পুনরায় ধর্মঘট আন্দোলন শুরু হয়। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ভারত সরকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার মধ্যে একটি চুক্তির ফলে গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামক একটি নতুন স্বায়ত্তশাসিত পার্বত্য পরিষদ গঠন করে এই জেলার প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ২০১৩ সালে দক্ষিণ ভারতে তেলঙ্গানা নামক নতুন অঙ্গরাজ্য সৃষ্টি হলে এই আন্দোলন আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠে যা এখনও চলছে। মমতা ব্যানার্জি যতই নিমারজি হোন না কেন দার্জিলিং এর স্থানীয় বাসিন্দারা যে সত্যিই গোর্খাল্যান্ড চান সেটা বোঝা যায়। গোর্খাল্যান্ড এর দাবী বাস্তবায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গ তার পুরো পাহাড়ি অঞ্চল হারাবে, আয়তনেও একদম ছোট হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গবাসির জন্য ব্যাপারটা মেনেই নেওয়া সত্যিই কঠিন।

খুব ভালোভাবেই অবতরণ করলাম মাঠের এক পাশে। অনিন্দ্য নুডলস খাচ্ছিল। হেসে বলে, “ভাই, কেমন লাগলো?“ উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুলব এমন সময় উপরে তাকিয়েই অবাক হতে হল। আরেকজন অভিযাত্রী প্যারাসুট দিয়ে নিচে নামছেন এবং তিনি আমাদের সহযাত্রী সাইমুম। ব্যাপার হচ্ছে আমি আর অনিন্দ্য উড়ছি দেখে আর নিজেকে সে সামলাতে পারে নি। ভয়কে করেছে জয়। জোরে জোরে তাঁর পিঠ চাপড়ে দিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠলাম। এবার ফেরার পালা।

পুষ্কর খুব ভাল গাড়ি চালায়। যখন ফিরছি তখন বিশ্ব চরাচরে অন্ধকার নেমেছে। আরও প্রায় দুই ঘণ্টার রাস্তা দার্জিলিং। ড্রাইভারের পাশের আসনে বসে রেডিওতে ভেসে আসা হিন্দি গান শুনছি। একটু পর দেখি গানের ভাষা বদলে গেছে। পুষ্কর নিজেই জানাল, এগুলো নেপালি সঙ্গীত। কি মনে হতে যেন পুষ্করকে জিজ্ঞাসা করলাম, “পুষ্কর, গোর্খাল্যান্ড চান?” সে শুধু হাসে, কিছু বলে না। আমরা বাইরের মানুষ বলেই হয়তবা।

আমি চোখ বন্ধ করে অঞ্জন দত্তের সেই গানটা মনে মনে গাইতে থাকলাম,

বেড়াতে যদি তুমি যাও কোনদিন
আমার কালিম্পং
মনে রেখ শংকর হোটেলের ভাড়া
ট্যুরিস্ট লজের চেয়ে কম
রাত্তির নেমে এলে আসবে
তোমার ঘরে চুল্লিটা জ্বালিয়ে দিতে
আর কেউ নয় সে যে আমার ফেলে আসা
নীলচে পাহাড়ের মেয়ে,
বলোনা তাকে আমি দারোয়ান
শুধু বলো করছি ভালোই রোজগার
ঐ বস্তির ড্রাইভার চীগমীর সাথে
যেন বেঁধে না ফেলে সংসার
আর কিছু টাকা আমি জমাতে পারলে যাব যাব ফিরে
পাহাড়ী রাস্তার ধারের বস্তির আমার নিজের ঘরে ।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

১ম পর্ব # পশ্চিমবঙ্গে স্বাগতম
২য় পর্ব # রোড টু দার্জিলিং
৩য় পর্ব # শুভ সকাল, দার্জিলিং
৪র্থ পর্ব # মন্দির প্যাগোডার শহর
৫ম পর্ব # চা-বাগান এবং রক গার্ডেনের সৌন্দর্য
৬ষ্ঠ পর্ব # ক্যাবল কারে ভ্রমণ
৭ম পর্ব # ঘুম নগরীর ঘুম
৮ম পর্ব # আমি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখি নি
৯ম পর্ব # হিমালয় স্পর্শের স্বপ্ন


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমিও কিঞ্চিত উড়ে আসলাম আপনার সাথে

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি উড়তে দারুণ লাগে। পাখিদের আনন্দটা কিছুটা অনুভব করতে পারছি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

বড়বাঘা এর ছবি

টু ডু তালিকায় রাখলাম। চমৎকার লিখেছেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ। হাসি

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি

কালিম্পঙ এর কথা বহুবার পড়েছি সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজে, সেই শহরে আবারো ঘুরে এলাম

অতিথি লেখক এর ছবি

সমরেশ মজুমদারের গর্ভধারিণী বইতে সম্ভবত কালিম্পং এর নাম প্রথম পড়েছিলাম। এছাড়া ডূয়ার্সের চা-বাগানের সাথে পরিচয় সাতকাহন এর সুবাদে। এই জন্যই জায়গাগুলোতে যাওয়ার প্রচ্ছন্ন একটা ইচ্ছে মনের ভিতর কাজ করেছিল। ভাল লেগেছে ঘুরে।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সোহেল ইমাম এর ছবি

প্যারাসুট পাইন গাছে আঁটকে গেলে কি হয়? ঠিক কতক্ষণ ঝুলে থাকতে হয়? নেমে আসার পদ্ধতিটাইবা কি?

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

যারা প্যারাগ্লাইডিং এর বন্দোবস্ত করেন তাঁদের নিজস্ব লোক থাকে এইরকম ক্রিটিক্যাল সমস্যা সমাধানের জন্য। কতক্ষণ ঝুলে থাকবেন সেটা নির্ভর করে কোন জায়গায় ঝুলেছেন সেটার উপর। রাস্তার পাশে ঝুলে থাকলে সময় লাগবে কম। অরণ্যের গভীরে আটকে গেলে উদ্ধারকর্মীদের পৌঁছাতে সময় লাগবে বেশি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনি যার সাথে উড়ছেন তিনিই কিছু একটা বন্দোবস্ত করবেন। নেমে আসার পদ্ধতি জানা নাই যেহেতু আটকে যাই নি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

দারুণ লাগলো। আপনার ক্যামেরাটা ভালো হলে ছবিগুলো আর-ও চমৎকার আসতো। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

একটা ডিএসএলআর এর অভাব প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি। মন খারাপ

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।