বেনাপোল/হরিদাসপুর: সীমান্তের তিক্ততা

নীড় সন্ধানী এর ছবি
লিখেছেন নীড় সন্ধানী (তারিখ: বুধ, ২৮/১০/২০১৫ - ৮:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সড়কপথে প্রথমবারের মতো সীমান্ত অতিক্রম করার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা রোমাঞ্চ কাজ করছিল। যেহেতু দেশটা ভারত এবং সীমান্ত পেরিয়ে আরেকটি বাংলাদেশ, সুতরাং প্রত্যাশিত রোমাঞ্চের পরিমানটা একটু বেশীই ছিল। সীমান্তের ওপারে সেই বাংলা যার সাথে আমার পরিচয় কেবল বইপত্রে। যেই বাংলায় আমার প্রিয় লেখকেরা বাস করেছেন, করছেন এখনো। কখনো না গিয়েও সেই বাংলার সাথে পরিচয়টা এতটাই ঘনিষ্ঠ যে না দেখা দেশটিকেও বহুবার দেখা হয়ে গেছে মনের চোখে। আকাশপথে যতবার বিদেশ ভ্রমণ করেছি কখনোই দেশের সীমানা পেরিয়ে নতুন দেশে পা রাখার রোমাঞ্চের সুযোগ ছিল না। জানা ছিল সড়কপথে যাত্রাও খুব বেশী সুখকর হবে না। কিন্তু সেই দীর্ঘ সড়ক ভ্রমণটি আশাতীত ভালো লাগলেও সীমান্তের তিক্ত অভিজ্ঞতাটুকু সেই আনন্দের অনেকটাই জখম করে ফেলেছিল। জানি না এরকম বাজে অভিজ্ঞতা অন্যদেরও পোহাতে হয় নাকি আমারই দুর্ভাগ্য ছিল। অনেকটা তিতিবিরক্ত হয়েই সেই অভিজ্ঞতাটা লিখে ফেললাম। ভারতীয় বন্ধুরা এদেশে প্রবেশের সময় এরকম সমস্যায় পড়েন কিনা তা জানতে পারলে ভালো হতো। শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারছেন, পোস্টটি ভ্রমণবিষয়ক হলেও এই পর্বটি তেতো অভিজ্ঞতার অংশ নিয়ে লেখা, সুতরাং ভাষাও খানিক সেরকম হবে।

বাসটি যখন বাংলাদেশ সীমান্তের শেষ সড়কটি অতিক্রম করছিল তখন পুবাকাশে সূর্যটা উঠি উঠি। পথ কতটা বাকী দেখার জন্য জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়েই আটকে গেলো চোখ। ভোরের মৃদু আলোয় আশ্বিনের নবীন কুয়াশা কচি সবুজ ধানক্ষেতের উপর তুষার শুভ্র রং ছড়িয়ে স্থির ভেসে আছে দূর দিগন্ত ব্যাপী। এত মসৃণ সৌন্দর্য আমার চেনাজানা গ্রামের কোথাও দেখিনি এর আগে। বাংলার মুখ আমি যতখানি দেখিয়াছি যশোহরের সেই ভোরের সৌন্দর্য অতুলনীয়। শুধু প্রকৃতি নয়, মানুষের ঘরবাড়ি, দোকানপাট সবকিছুতে একটা শৃংখলা, সুনিপুণ রুচির ছাপ এখানে। আমার চেনাজানা বাংলাদেশের সাথে মেলাতে পারি না। প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি ফুলের বাগান। বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি- এটাই জীবনানন্দের সেই বাংলা। রবিঠাকুর বলে গেছেন শতবর্ষ আগে- দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া...। এই বাংলাতেই কত না দেখা অজানা সৌন্দর্য রয়ে গেছে।

অতঃপর যাত্রা সমাপন। বেনাপোল বর্ডার। এপারের দালাল ফন্দিবাজের চিপা এড়িয়ে কাস্টম ইমিগ্রেশান করিয়ে সীমান্ত পার হয়ে যখন জিরো পয়েন্টে তখন পৌনে নটা। রোদের তীব্রতা বাড়ছে। জিরো পয়েন্ট জায়গাটা একটা খোলা ময়দান। দুপাশে দুই দেশের সীমান্ত প্রহরী। মধ্যিখানে হাশরের ময়দানে অপেক্ষমাণ বিচারাধীন বান্দাগণ। ভারতগামী হাজারখানেক মানুষ জিলিপির প্যাচের মতো অসীম দীর্ঘ বাঁকাচোরা ঘূর্ণিপাকের লাইনে দণ্ডায়মান। সীমাহীন সেই প্যাচের একটা লেজে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। লাইনের আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একই লাইন একই জায়গা দিয়ে পাঁচ ছয়বার ঘুরে গেছে। মাথার উপরে ঠা ঠা রোদ। যারা ভাগ্যবান তারা কিছুটা গাছের ছায়া পেয়েছে।

পাঁচ-দশ-পনেরো মিনিট গিয়ে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলো। তখনো লাইনে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি মনে হয়, যতটা এগোচ্ছি তাতে অগ্রগতি বোঝা যায় না। লাইন নড়ে কি নড়ে না। রোদের তাপে চাঁদি পুড়ে যাচ্ছে। সামনে কিসের ঝামেলা, কেন এত দেরী, কেউ জানে না। দূর থেকে দেখলাম ভারতীয় সীমান্তে ঢুকার যে পথ সেখানে অনেক সময় নিয়ে একেকজনকে ঢুকতে দিচ্ছে। ওটা ইমিগ্রেশানও না, কাস্টমও না। শুধু ঢুকার প্রবেশ পথ। সেই পথ পেরিয়ে কাস্টম আর ইমিগ্রেশানের অফিস। ওই গেটে ঢুকতে কেন এত সময় লাগবে বুঝতে পারছি না। যেন জেলখানার দাগী আসামীদের সাবধানে ঢোকানো হচ্ছে। কড়া ধমক চলছে খানিক পর পর। গরম বিরক্তি রাগ সবকিছুর মাত্রা চড়তে থাকে বেলা বাড়ার সাথে। সেই পৌনে নটায় লাইনে দাঁড়িয়েছি, এখন বাজে সাড়ে এগারোটা। লাইন শেষ হয় না তবু। ঘেমে কয়েকবার গোসল হয়ে গেছে। চরম বিশৃংখল অবস্থা। এর মধ্যে আবার সুযোগ পেয়ে কিছু দালাল লাইনের জায়গা বেচাকেনা করছে, লাইন(কার)চুপি চলছে হরদম। যারা পরিবার নিয়ে, বয়স্ক মানুষ নিয়ে, নারী ও শিশুদের নিয়ে যাচ্ছে তাদের দুর্ভোগ বর্ণনাতীত। চরম জঘন্য এক পরিস্থিতি। এরকম অবস্থাতেই মানুষের মাথায় খুন চেপে যায়।

ইচ্ছে করছিল পিছিয়ে গিয়ে ফিরতি পথ ধরি। নিখাদ বেড়াতে যাবার জন্য এতখানি ধকল সহ্য করার কোন মানে হয় না। এতগুলো মানুষকে বৈধ ভিসা পাসপোর্ট কাগজ নিয়েও ঢুকতে ঝামেলা করছে ভারতীয় পক্ষ। যদিও ওই গেট দিয়ে ঢোকার পরেই ইমিগ্রেশান, কাস্টম, সিকিউরিটি চেক হবে। তারপর ভারতে প্রবেশ। জিরো পয়েন্টে দাড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি জীবনে আর কখনো ভারতে যাবো না, গেলেও এই অসভ্য প্রবেশ পথে আর না। যে দেশ ইমিগ্রেশানে ঢোকার আগেই এত বিশ্রী বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে ওই দেশে ঢোকার ইচ্ছে উবে যায়। জানি না ভারতীয়রা এরকম অসভ্যতা শুধু বাংলাদেশীদের সাথে করে নাকি বাকী সবদেশের সাথে করে। অথবা বেনাপোল(পেত্রাপোল) সীমান্তের চরিত্রই অমন।

অনেক ভোগান্তি পরিশ্রমের পর সাড়ে বারোটার দিকে সেই মহা কাংখিত গেট পার হয়ে ভারতীয় কাস্টমসে ঢুকার সুযোগ পেলাম। ধন্য করে দিল ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী, তাদের স্বর্গতুল্য দেশে প্রবেশ করতে দিয়ে। এরপর কাস্টমসে ঢোকার পথে শুরু কুলী বাহিনীর প্রতিপত্তি। কুলী বাহিনীর এই প্রতিপত্তি বাংলাদেশ অংশেও দেখেছিলাম। তবে এই অংশে পার্থক্য হলো কুলিহীন যাত্রীদের সাথে কাস্টম অফিসারের হৈ হুংকার এবং আর কুলিসহ যাত্রীদের সাথে কাস্টম অফিসারের এক্সট্রা খাতির, তারা লাইনে ওভারটেক করার অনুমতিপ্রাপ্ত। কুলিরা কাস্টম করিয়ে দেয়। কুলি-কাস্টমসের যৌথ বাণিজ্য সহজে বোধগম্য।

লোকজনের লাইনের ভিড় দেখে এক কাস্টম অফিসার পৈশাচিক উল্লাস, 'বাংলাদেশ থেকে তো সব লোক ভেগে চলে এলো!' অফিসার হারামজাদাকে একটা চটকানা দেবার ইচ্ছেটা দমন করলাম নিরুপায় হয়ে। আগেও নানান দেশের ইমিগ্রেশান কাস্টমসের বেড়া ডিঙিয়েছি, কিন্তু পেত্রাপোল বর্ডারের সেই কাস্টমস অফিসারের মতো অশ্লীল অভব্য আচরণ আর কোথাও দেখিনি।

অবশেষে বেলা দুটোর সময় ইমিগ্রেশান কাস্টম পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ। যে পশ্চিমবঙ্গের জন্য আমার পূর্ব জন্মের এক নস্টালজিয়া কাজ করতো সবসময়, যেখানে প্রথম প্রবেশের আনন্দ রোমাঞ্চ এতদিন ধরে জমিয়ে রেখেছিলাম, ভারতীয় কতৃপক্ষের নির্দয় আতিথ্য সেটা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। একটা নতুন দেশে প্রবেশের কোন অনুভুতিই হলো না।

দুটো সভ্য দেশের কাস্টমস আনুষ্ঠানিকতা করাতে এতটা সময়/শ্রম/বিরক্তি যুক্ত হবার কারণ হচ্ছে দেশ দুটি যথেষ্ট সভ্য হতে পারেনি এখনো। তাই খুব বিরক্তির সাথে দুটো দেশকে উদ্দেশ্য করেই বলছি- 'বিশ্ব দরবারে তোমাদের রাষ্ট্রনায়করা যতই সভ্যতা বা উন্নয়ন নিয়ে বাকোয়াজি করুক, তোমরা এখনো যথেষ্ট বর্বর। তোমরা তোমাদের অর্ধশতক পুরোনো সামান্য দুটো সীমান্ত পোস্টকে ন্যূনতম সভ্যতার আলো দিতে পারোনি।'

স্বদেশপ্রীতি মনে হলেও একটা কথা বলতে হয় যে ভারতের কাস্টমস/ইমিগ্রেশান অংশের তুলনায় বাংলাদেশ কাস্টমস ইমিগ্রেশান অংশ অনেকটা আলোকিত, সভ্য, আধুনিক। মানুষ এবং দালানকোঠা উভয় ক্ষেত্রেই। দালানকোঠার বিচারেও ভারতীয় কাস্টমস এলাকা আক্ষরিক অর্থেই গরুর খোঁয়াড়ের চেহারায়। স্থানে স্থানে বাঁশের কঞ্চির বেড়া দেখে গরু ছাগলের হাটের কথাই মনে করায় এবং ভেতরের অফিসারের পশুসুলভ আচরণ তার যথার্থতা প্রমাণ করে দেয়।

[পরবর্তী পর্ব: নস্টালজিয়ার কোলকাতা, প্রথম মুগ্ধতা]


মন্তব্য

মুস্তাফিজ এর ছবি

স্থল বন্দর হিসাবে বেনাপোলের অবস্থা সবচাইতে খারাপ। তুলনামূলক ভাবে বুড়িমাড়ি অনেক ভালো, সবমিলিয়ে ঘন্টাখানিকের মত লাগে। তবে সেখানেও হ্যাপা আছে, দুপাশেই নগদ নারায়ণ সেবা করতে হয়, এই নগদ নারায়ণের ব্যাপারটা আবার নির্ধারিত, বাস ওয়ালারাই আপনাকে বলে দিবে কোথায় কত দিতে হবে, পরিমাণ খুব একটা বেশি না।

...........................
Every Picture Tells a Story

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বাসওয়ালারা বাংলাদেশ অংশের কাস্টম ইমিগ্রেশানে কিছুটা সেবা দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের গেট পেরোনোর পর নোম্যান্স ল্যাণ্ডে আপনি হাশরের ময়দানের প্রাণী, ওখানে কেউ কারো নয়। সারভাইভাল অব ফিটেস্ট থিওরিতে ওটা পাড়ি দিতে হয়।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মুস্তাফিজ এর ছবি

বুড়িমাড়ি বন্দরের নোম্যানস ল্যান্ডে অপেক্ষা করতে হয়না। ওদের সময় যেহেতু আমাদের চাইতে আধঘন্টা পিছিয়ে তাই ওরা যখন বর্ডার খুলে সে সময় পতাকা নেড়ে ইশারা দেয় আর এদিক থেকে লোকজন সেদিকে এগোয়। ঢোকার সময় লাইনে ঢুকতে হয় আর র‍্যান্ডমলী কাউকে সন্দেহ হলে বডি চেক করে ঢোকায়।

...........................
Every Picture Tells a Story

অতিথি লেখক এর ছবি

ক’দিন আগে কলকাতা ঘুরে এলো আমার কিছু স্বজন, বেনাপোল সীমান্ত দিয়েই। তো আগের ভোগান্তি বিবেচনায় তারা মুস্তাফিজ ভায়ের বলা নগদ নারায়ণ দিয়ে ঘণ্টাখানেক বা তার কিছু বেশি সময়ে সব ঝামেলা চুকিয়ে ফেলতে পেরেছিল, ফেরার দিনও একই উপায়...

দেবদ্যুতি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ফেরার সময় ঝামেলা হয়নি। ঘন্টা দেড়েকে পার হয়ে এসেছি এপাশে। যাবার সময়ই যত ঝামেলা হলো। আমি জানি না ঠিক সেইদিনই অত ঝামেলা হলো, নাকি হরদম সেরকম হয় জানি না। কাস্টম ইমিগ্রেশানে লাইন থাকলেও অত বিশ্রী লাগেনি। কিন্তু বাংলাদেশ অংশ পেরিয়ে ভারতীয় গেটে ঢুকতেই চরম হয়রানি করলো। গেটে ঢোকাটাকে এত কঠিন রাখার মানেটা বুঝতে পারিনি। সবাই বৈধ কাগজ নিয়ে ঢুকছে। গেটে ঢুকতে এত ঝামেলা করলে এত কাগজপত্র ভিসা পাসপোর্টের দরকার কি ছিল। আমাদেরকে মানুষই মনে করছিল না এমন বাজে আচরন ছিল তাদের।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

জানি না আপনি কবে গিয়েছিলেন, কিসে(মানে কোন বাসে) গিয়েছিলেন। ধরে নিচ্ছি আপনি সম্প্রতি গিয়েছিলনে, এবং ভাঙা বাসে গিয়েছিলেন। ভারত ভ্রমনের এই পর্বটা কখনই সুখকর ছিল না, তবে ক্ষেত্র বিশেষে ভোগান্তি কমেছে, কোন কোন ক্ষেত্রে আগের তুলনায় অনেকটাই কমেছে।

অনেক আগে, মানে আশির দশকে নিতান্ত অল্প বয়সেই প্রথম গিয়েছি ভারতে। পিছন ফিরে দেখলে সে অভজ্ঞতা এক বিভীষিকা ছাড়া আর কিছু নয়। শুধুমাত্র বয়সের চাপল্য এবং ভারতে প্রবেশের পর তার বহুমখী ক্ষেত্র এবং অপরূপ সৌন্দর্যময় ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর আকর্ষণেই শুধুমাত্র চেকপোস্টের দুর্বিষহ দুর্বিপাক সহ্য করা সম্ভব হত। চেকপোস্টে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে বিএসএফ এর যে অতিশয় কদর্য ও নির্দয় আচরণ, এটা শুধু বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যই প্রযোজ্য, ভারতীয় যাত্রীগণ এ বিড়ম্বনা থেকে অনেকটাই মুক্ত। কেন তারা এরকম আচরণ করে, অনেক ভেবেও তার সঠিক উত্তর আমি পাই নি, তবে একটা অনুমান আছে। ভারতীয় কাস্টমসের আচরণ দেখে আকবর আলি খানের "পরার্থপরতার অর্থনীতি" বইটিতে বর্ণিত "শুয়ারের বাচ্চা" দের কথা মনে পড়ে- যারা টাকাও নেয়, কিন্তু যন্ত্রণাও দেয়। তাদের এরকম জঘন্য আচরনের কারন পরিস্কার, এর মাধ্যমে তারা যাত্রিদের একটা চাপের মধ্যে রাখতে চায়- অর্থাৎ, যদি ভাল চাও তো চুপচাপ কিছু মাল কড়ি দিয়ে কেটে পড়। বিএসএফ এর ব্যাপারটাও বোধ হয় এরকমই কিছু একটা, মানুষজন বৈধভাবে ভ্রমন না করে একটা বন্দোবস্থের মাধ্যমে তা করলে একটা আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থা হয়। প্রতিদিন প্রচুর মানুষ দালালদের মাধ্যমে সেভাবেও ভ্রমণ করে থাকে। স্থলপথে ভ্রমনের ক্ষেত্রে আগে এ দুটি নিগ্রহের সাথে বাড়তি আরও একটা উপদ্রব ছিল(জানি না এখনও আছে কি না), পথে পথে গাড়ী দাঁড় করিয়ে কোন একটা পুজার নাম করে চাঁদা আদায় করা হত। দিতে অস্বীকার করলে অত্যন্ত জঘন্য আচরণ করা হত, কোন কোন ক্ষেত্রে টাকা পয়সা ছিনিয়েই নেয়া হত। তবে একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, এই নিগ্রহের সাথে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার কোন সম্পর্ক নেই, বাংলাদেশের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এই রকম নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। বিমান ভ্রমনে কলকাতা এয়ারপোর্টেও কমবেশি ঝামেলা করা হত।

এখন যতদূর দেখেছি, এয়ার এবং ট্রেনে(মৈত্রী এক্সপ্রেস) উল্লেখযোগ্য কোন হয়রানি নেই। সরাসরি বাসের ক্ষেত্রেও ঝামেলা প্রায় নেই বললেই চলে, এ ক্ষেত্রে কাস্টম/ইমিগ্রেশনের ঝামেলা বাসের লোকজনই সামাল দেয়। শোনা কথা- কাস্টম/ইমিগ্রেশনের সাথে তাদের মাসকাবারি বন্দোবস্ত থাকে।

স্বদেশপ্রীতি মনে হলেও আরও একটা কথা না বললেই নয়- দেশে ফিরে আসার সময় বাস যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে, চোখের তখন বড়ই আরাম হয়। ও দেশের মাঠ-ঘাট, বাড়িঘরের তুলনায় এ দেশের যেন পটে আঁকা ছবি, তখন মনে হয় এই আমার দেশ, কত সুন্দর।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আমি ভালো বাসে করেই গিয়েছি। সোহাগ পরিবহনের এসি বাস। সরাসরি কোলকাতার টিকেট করে গেছি। ইমিগ্রেশান কাস্টম ওরা করে দেবার কথা থাকলেও সেখানে বাড়তি টাকা নিয়েছে ওদের লোকেরা। তবে বাসযাত্রা মোটেই খারাপ লাগেনি। এপারে এবং ওইপারে দুদিকেই আরামদায়ক ছিল যাত্রা। ঝামেলা যা হয়েছে সব বর্ডারে। বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে নোম্যান্স ল্যান্ডে অমানবিকভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা শতশত মানুষকে একটা খোঁয়াড়ে আটকে রাখার কোন কারণ দেখিনি। পুরো নোম্যান্স ল্যাণ্ডটাই ছিল একটা খোঁয়াড়ের মতো। তিনঘন্টা রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে যখন বিএসএফ এর গেট পার হচ্ছি তখন দেখলাম সেখানে কোন চেক করার ব্যাপার নেই, কিন্তু কেন খামাকা দাড় করিয়ে রেখেছিল জানি না। নোম্যান্সল্যাণ্ডের খোলা মাঠে রোদের মধ্যে এতগুলো মানুষকে যেভাবে আটকে রেখেছিল তাতে মনে হচ্ছিল এই লোকগুলো অপরাধী, তাদেরকে এক জেলখানা থেকে আরেকটা জেলখানায় ঢোকানো হচ্ছে। বিএসএফএর হম্বিতম্বিও সেইরকম ছিল। কিন্তু যে মানুষগুলো ওই পথে ভারতে যায় তার বিশাল একটা অংশ চিকিৎসার জন্য যায়, বিশেষ করে তাদের কথা ভেবে শিউরে উঠেছি। প্রতিটা যাত্রীকে সীমান্ত পার হতে ৬টা লাইনে দাড়াতে হবে। বাংলাদেশ অংশে তিনটি, ভারতীয় অংশে তিনটি। বাংলাদেশ অংশের লাইন তিনটি পার হতে সময় লেগেছে আধাঘন্টার মতো। আর ভারতীয় অংশে প্রথম লাইনেই দাড়িয়েছিলাম তিন ঘন্টার বেশী। কাস্টম ইমিগ্রেশানের দুই লাইনে ঘন্টা দেড়েক।

যাত্রার আগে ভিসা প্রক্রিয়া নিয়ে বিরক্ত ছিলাম, কিন্তু ওই যন্ত্রণার তুলনায় ভিসা যন্ত্রণাকে নিতান্ত শিশু বলতে হবে। সরাসরি বাস বলতে কিছু দেখিনি ওদিকে। সরাসরি বাস চলার মতো কোন অবস্থাও তো দেখিনি। সোহাগ গ্রীনলাইন সৌদিয়া সবাই তো দুই পারে বাসের ব্যবস্থা রেখেছে। নাকি অন্য কোন পথ আছে, ঠিক জানি না।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

শাব্দিক এর ছবি

এইরকম বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা অনেকের কাছেই শুনেছি। অনেকেই উপদেশ দিয়েছে ভারতে কোনভাবে যেন বাইরোডে না যাই। তাই প্রতিবারই কষ্টেশিষ্টে হলেও আকাশপথে গিয়েছি।

---------------------------------------------------------
ভাঙে কতক হারায় কতক যা আছে মোর দামী
এমনি করে একে একে সর্বস্বান্ত আমি।

গালীব পাশা কবি এর ছবি

আমি ব্লগে ভারত ভ্রমন নিয়ে কয়েক পর্ব লিখে ছিলাম তাই বেশী কিছু না লিখে বলতে চাই,জগন্য।আমি অবস্থা দেখে টাকা দিয়ে সব সেরেছি।

মন মাঝি এর ছবি

বেনাপোল বর্ডার পেরুনোর ক্ষেত্রে সবার এত এত খারাপ অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেখে অবাকই হলাম। আমার অভিজ্ঞতাটা কিন্তু একদম উলটো। একবারই গিয়েছিলাম। ২০০৫ সালে। বিআরটিসি বাসে।
১মত বিআরটিসি বাসে আমাকে বর্ডার পেরিয়ে অন্য বাসে উঠতে হয়নি - সামান্য একটু পথ পায়ে হেটে পেরিয়ে আবার ঐ একই বাসেই উঠেছি ওপারে। ওপারে শুধু বাসের সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা লোক দুইজন বদলে গিয়েছিল - বাংলাদেশ অংশে ছিল বাংলাদেশি, ভারতীয় অংশে ভারতীয়। কাস্টমস-ইমিগ্রেশনের জন্য কোনো পাশেই খুব একটা অসুবিধা হয়নি। বাংলাদেশ অংশে শুধু তাড়াতাড়ি করার জন্য দালালকে ২০ টাকা স্পীডমানি দিতে হয়েছিল, ভারতীয় অংশে কিছুই দিতে হয়নি। ভারতীয় অংশে যদ্দুর মনে পড়ে একটা ঘর বা ছাউনিওলা জায়গাতেই দাঁড়াতে হয়েছিল এবং সেটা খুব সাঙ্ঘাতিক একটা বেশি সময় না। ওদের পুরো ব্যাপারটাই ছিল সম্পূর্ণ প্রোফেশনাল। আজাইরা কথাবার্তা না বলে লাইনে দাঁড় করিয়ে ঝটপট-ঝটপট চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছিলেন। কোনো সমস্যা হয়নি আমার। কেই কোনো টাকা চায়নি, কোনো ইঙ্গিতও করেনি। আমি বাংলাদেশিদেরই সমস্যা করতে দেখি বেশি - অতিরিক্ত ঠেলাঠেলি, লাইনে না দাঁড়িয়ে অযথা ভীড় আর হাউকাউ করা, fussy আচরণ করা আমাদের অনেকের (এটা উপমহাদেশ জুড়েই আছে, তবে আমাদের মধ্যে একটু বেশি) চিরন্তন অভ্যাস যেন। এখান থেকে বর্ডার পেরিয়ে আসা সেই একই বাসে করে সরাসরি সল্ট লেকের বাস স্টেশনে। মাঝখানে কোথায় যেন খাওয়ার জন্য একটুখানি থেমেছিলাম - সেইখানে প্রথম টের পেলাম আরেক দেশে ঢুকেছি, নয়তো বর্ডারে কোনোই সমস্যা হয়নি। পরে দিল্লীতে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে ভিসা অফিসে দৌঁড়ুতে হয়েছিল এক্সটেনশনের জন্য, সেই অভিজ্ঞতাও খুবই ভাল ছিল - এত ভাল ব্যবহার অন্য কোনো দেশে তো নয়ই এমনকি নিজ দেশেও বোধহয় পেতাম না বোধহয় কোনো উচ্চ আমলার রেফারেন্স ছাড়া! হো হো হো

****************************************

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনি বোধহয় মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানদের একজন। সেই কারণে বিনা ঝামেলায় পেরেছেন। আপনি যে আমলে গেছেন সে আমলে একই বাস সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওই পাড়ে যেতো অথবা বিআরটিসির জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল। আমি যখন যাই তখন সীমান্তের এপার ওপার আলাদা বাস। সেদিন হয়তো যাত্রীর সংখ্যাও বেশী ছিল। সব মিলিয়ে ছেড়াবেড়া অবস্থা।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।