ছাইরং মানুষের মুখ। ২৩ কিংবা ২৭। অর্ণব

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: শনি, ২৭/০৬/২০০৯ - ৪:৪৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঘুমের মধ্যে অয়ন এসে একটা ঝাঁকি দেয়- ওঠেন। বাইরে যেতে হবে রেডি হন
এই স্বর অন্যরকম স্বর। এক লাফে উঠে ওর দিকে তাকাই- কেন?
- অর্ণব মারা গেছে...

অনেকক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই টের পেলাম আমার ভেতর থেকে অন্য কেউ যেন কথা বলে উঠছে অয়নের সাথে- কুন থুওলেল বাত্তা বলে...

পিচ্চি পোলাপান নেয়ার নিয়ম নেই নাটকের দলে তবু এক পিচ্চি পাবনা থেকে এসএসসি পাশ করে ঢাকায় এসে ঠেঁসে ধরল বকুল ভাইকে- ভাই আমি নাতক কলব...

কথা বলে একেবারেই আদুলবাদুল আর আচরণটাও তাই। বকুল ভাই যতই তাকে বোঝান কমপক্ষে ভার্সিটিতে ভর্তি না হলে তাকে নেয়া যাবে না ততই সে বাচ্চাদের মতো আব্দার করতে থাকে- আমি নাতক কলব...

নিরুপায় হয়ে বকুল ভাই তাকে শর্ত দেন- ঠিকাছে তুমি যদি তোমার বাবা মায়ের লিখিত অনুমতিপত্র নিয়ে আসতে পারো তাহলে দেখা যাবে...

তারপর তিনি তাকে ভুলে যান। কিন্তু হঠাৎ একদিন তার অফিসে গিয়ে হাজির হয় সেই ছেলে। লিখিত অনুমতি পত্র না। জীবন্ত বাবা মাকে পাবনা থেকে ধরে নিয়ে এসছে সুপারিশের জন্য। ছেলেটা অর্ণব। তানভীন জে এহসানের মতো ভারী একটা পোশাকি নামের আড়ালে আগাগোড়া আদুল। কথা বলে জড়িয়ে জড়িয়ে। আর তার থেকে বেশি জড়িয়ে ফেলতে পারে যে কোনো মানুষকে। খুব দ্রুত আমরা ভুলে যাই আমাদের থেকে অত ছোট সে। ঈদ- বৈশাখ- নববর্ষে প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা একেকটা কার্ড হাতে বানিয়ে ভোর বেলা এসে হাজির- তিতু ভাই এতা আপনার। লেলেন ভাইর জন্য এতা। অয়ন দার এতা...

আমাদের প্রত্যেকের নামেরই তার নিজস্ব একটা উচ্চারণ ছিল। আর তার স্টাইল ফলো করে আমরাও তার নামটা অর্ণব থেকে বানিয়ে ফেলি অর্বন

- ভাই আমিতো একতিং কলাল জন্য দল করি না। আমি জানি আমাল সমস্যা আছে। কথা জলিয়ে যায়। আমি দল কলি নাতক আমাল ভালো লাগে বলে। আল আমাল কোনো বলো ভাই নাই। তাই আপনাদেলকে আমাল ভালো লাগে...

একেবারে পরিষ্কার সমীকরণ অর্ণবের। সে থাকে। দলের সঙ্গে থাকে। থাকে আমাদের সঙ্গে একেবারে মিশে আর ঢাকায় থাকে মামার বাসায়

গ্রুপে যায় মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে এসে হাজির হয় কলাবাগানের আড্ডায়। বছর দেড়েকের মাথায় একদিন মিষ্টি নিয়ে হাজির- ভাই আমি চাকলি পেয়েছি। আলটিভিতে। এসিস্টেন্ত প্লডিউসার
- মেট্রিক পাশ পোলা তোরে চাকরি কে দিলো?
- এখন মেত্রিক পাশ বলে থালা জীবন তো আর মেত্রিক পাশ থাকব না। আমি স্তুদেন্ত...
- কিন্তু তুই চাকরি পেলি কেমনে?
- ইন্তালভিউ দিয়ে
- কী ইন্টারভিউ দিলি তুই?
- কী আবাল? যা যা জিজ্ঞেস কলল; বললাম
- কিন্তু তারা মেট্রিক পাশ নিলো?
- আমাকে বলছিল- তুমিতো অনেক ছোতো। তোমাকে কীভাবে নেই? আমি বলেথি আমার তো বলো হবার জায়গা বাকি আছে। কিন্তু বলো হবার পলে আপনাদের এই পদতো খালি থাকবে না। তাই ছোতো থাকতেই অ্যাপ্লাই কললাম...

দাপটের সঙ্গে চাকরি করা শুরু করল অর্ণব। মাঝে মাঝেই এসে হাজির হয় কলাবাগান- তিতু ভাই মাথাল খুলি কোন জায়গায় কিনতে পাওয়া যায় বলতে পালেন?
- মাথার খুলি?
- জ্বি। মানুষেল মাথাল খুলি
- মাথার খুলি দিয়ে তুই কী করবি? তুকতাক শুরু করেছিস নাকি?
- না। শোপিস বানাতাম

অথবা কোনোদিন জ্যান্ত সাপ কেনার জন্য খুঁজতে খুঁজতে ধামরাই বাজার পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এসে হাজির হয় আড্ডায়- লেলেন ভাই। সাপেল অত দাম আমি জানতাম না। পকেতে তাকা থাকলে আজ দুইতা সাপ কিনতে পাত্তাম
- সাপ দিয়ে কী করবি?
- পালতাম... সাপ খুব থুন্দল...

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্ণব বড়ো হয়। প্রমোশন আর গ্রাজুয়েশন একসাথেই হয়ে যায় তার। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন আগুন লাগে এনটিভি-আরটিভি বিল্ডিংয়ে। দুটো চ্যানেলেই আমাদের অসংখ্য গ্রুপ মেম্বার আর বন্ধুবান্ধব। কিন্তু সবগুলো ফোনই একটা আরেকটাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে- অর্ণব কোথায়?

অর্ণবের খোঁজ পাওয়া যায় না। পোড়া দালানের কাভারেজের ধোঁয়ায় হঠাৎ টিভি স্ক্রিনে আমাদের কেউ চিনে ফেলে- অর্ণব। ওই যে দালানের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে অর্ণব। ফায়ার ফাইটাররাও অর্ণবে দেখে আর টিভি পর্দার সামনে বসা আমাদের চোখের সামনে লেডার বেয়ে মাটিতে নেমে আসে অক্ষত অর্ণব। পরের দিন আমরা তাকে ঘিরে ধরি- কেমনে কী হলো বলতো?

- আল বলেন না ভাই। কিচ্চু দেখি না। খালি ধোঁয়া আল ধোঁয়া। আমি মনে মনে বলি এইভাবে আগুনে পুলে মলে যাওয়া তো থিক না। তাল চেয়ে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে মললেও অনেক শান্তি। আমি আন্দাজ কলে জানালাল দিকে দৌল দিয়ে দেখি জানালা ভাঙা। সেটা দিয়ে কার্নিশে নেমে প্লথমে ভাবলাম লাফ দেই। পলে চিন্তা কললাম এইখানে আগুন আসতে দেলি আছে। দেখি আলেকটু। কালন লাফ দিলে আমালে তো ভাই আল খুঁজে পাওয়া যাবে না। পলে দেখি একটা মই আমাল দিকে আসে। মনে মনে বললাম- নাহ। লাফ না দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজই কলেছি...

কিছুদিন পরে অর্ণব একদিন কলাবাগানে এসে সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া শুরু করে- ভাই আপনাদেল কাছ থেকে বিদায় নিতে আসলাম
- কেন আত্মহত্যা করবি? গুড
- না ভাই। ইন্দিয়া দাবো
- মরার জন্য ইন্ডিয়া যাবার দরকার কী? কত শত লোক প্রতিদিনই তো দেশের ভেতরেই মরে। তোর সমস্যা কী?
- না ভাই। মলব না। আমি একটা কোর্স কলতে যাব?
- কিসের কোর্স?
- কিসের কোর্স জানি না। তবে মিদিয়া সম্পর্কে তো আমি কিথুই জানি না। ইন্দিয়া গিয়ে দেখি কোনো একতা কোর্স কলা যায় কি না
- কোনো যোগাযোগ না করেই যাচ্ছিস? তোকে এই বুদ্ধি কে দিয়েছে?
- কেউ দেয়নি ভাই। এমনিই ভাল্লাগথে না কিথু। গিয়ে দেখি। না হলে তো চলে আসবো...
- চাকরি?
- এক মাসের ছুতি নিয়েছি...

প্রায় দেড় বছর অর্ণবের কোনো খবর নেই। হঠাৎ একদিন ইংল্যান্ডের নম্বর থেকে ফোন- লেলেন ভাই আমি চলে আসসি
- কই আসছিস?
- ধাকায়
- ঢাকায় তো ইংল্যান্ডের নম্বর কেন?
- অনেক কাহিনী আথে ভাই। এখনও কলাবাগান যান?
- যাই মানে? প্রতিদিনই যাই। কলাবাগান আয়...

রাতের বেলা মোটাসোটা একটা মানুষ ক্রাচে ভর করে এসে দাঁড়ায় কলাবাগান- অর্ণব এটা কী?
- আল বলেন না ভাই। ফ্লাইওভার থেকে পলে পা ভেঙে গেছে আমাল...
- কোথায়?
- লন্দন
- লন্ডন? হারামজাদা তুই বাসে উঠে গেলি ইন্ডিয়া। তোর ঠ্যাং লন্ডনের ফ্লাইওভারে যায় কেমনে?
- ভাই সেতা অনেক কাহিনী। আমি একতু বসি ভাই

প্রচণ্ড বেমানানভাবে ক্রাচ একপাশে রেখে বসে অর্ণব। ভারী। ক্লান্ত। ইন্ডিয়া থেকে কীভাবে যেন চলে যায় লন্ডন। ভর্তি হয় মিডিয়ার একটা কোর্সে। তারপর ফ্লাইওভার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যায় নিচে। বাম পা টুকরা হয়ে যায়। হাসপাতালে থাকে চারমাস। পায়ের সঙ্গে ওরা লাগিয়ে দেয় একটা স্টিলের পাত...

কিন্তু পরের দিনই সবাই তাকে সমানে গালাগাল করতে থাকে। ইউকে থেকে নিয়ে আসা তার মোবাইল নম্বরটা সে নিয়ে গিয়েছিল বিটিটিবির কাছে। নম্বরটা ঠিক রেখে তারা সেটাকে বিটিটিবির লিস্টে ঢোকাবে কি না। তারা না করে দিয়েছে। তারপর একে একে ঘুরেছে অন্যসবগুলো ফোন কোম্পানিতে। কেউ রাজি হয়নি। কিন্তু সে তার নম্বর ছাড়বে না। পরে র‌্যাংগস টেল না ঢাকা ফোন কারা যেন রাজি হয় তার নম্বরটাকে নিজেদের নম্বর করে নিতে। +৪৪ কোডসহ অর্ণব টিকিয়ে রাখে তার ইউকের ফোন নম্বর বাংলাদেশে। কিন্তু তাকে যেই ফোন করে সবার ফোনে বিল ওঠে ওভারসিজ কলের। অর্ণবের একটাই কথা- ভাই আমি আপনাদেল ক্ষতি কলতে চাইনি। কিন্তু ওলা আমাকে বলেনি যে এটাতে ফোন কললে লন্দনের বিল উথবে...

ততদিনে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক যুগ। আরটিভির মালিক কে গবেষকরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। প্রধান থেকে শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত বেশিরভাগই নতুন। বদলে গেছে সবার আইডি কার্ডও। এর মধ্যেই একদিন দেড় বছর আগে একমাসের ছুটি নেয়া অর্ণব পুরোনো আইডি কার্ড নিয়ে গিয়ে হাজির হয় অফিসে- আমি এখানে চাকলি কলি...

এ জিজ্ঞেস করে ওরে। ও জিজ্ঞেস করে তারে। কেউ চেনে না। কাগজপত্র সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আগেই। কার ফাইল কোথায় কার ছুটি কোথায় কেউ জানে না। এর মধ্যে একজন তাকে চিনতে পারে- হ্যাঁ ও আমাদের স্টাফ

ব্যাস। অর্ণব আবার শুরু করে দেয় আরটিভিতে....

২০০৯ এর বইমেলার চার কি পাঁচ নম্বর দিন অর্ণবের ফোন- ভাই আপনি কি আমাল একটা কাজ কলে দিতে পালবেন?
- কী কাজ?
- অফিস থেকে আমালে দায়িত্ব দিয়েছে বইমেলা কাভাল কলাল জন্য। লাইভ পোগ্লাম। আপনি কি আমার পোগ্লামটা উপস্থাপনা কলবেন?
- মনে হয় না সম্ভব হবে। লাইভ প্রোগ্রামতো শুরু হয় বিকেল থেকে কিন্তু আমার যেতে যেতে প্রতিদিনই অনেক দেরি হয়
- ওইটা আমি দেখব। আপনাল চিন্তা কত্তে হবে না
- তাইলে দেখা যেতে পারে

অর্ণব ফোন রেখে দিয়ে আবার ফোন করে- আপনাল নাম তাইলে অফিসে প্লস্তাব কলি। আপনাকে হয়তো শুরুল আগে একদিন অফিসে আসতে হবে
- আচ্ছা ঠিকাছে
- আচ্ছা ভাই আপনার নামেল সাথে তো আপনাল দুয়েকটা বইয়ের নাম বলতে হবে। ...আচ্ছা এই উকুন বাছা দিন... এল চেয়ে ভালো কোনো বইয়ের নাম পান নাই ভাই? এই বইয়েল নাম কাউকে বলা যায়?
- ওই ব্যাটা এর পরে আমার বই বেরিয়েছে আরো একহালি। আর উকুন বাছা দিনে তোর সমস্যা কী?
- না কিন্তু এইতা কোনো না নাম হলো?

কতক্ষণ পরে আবার অর্ণবের ফোন- ভাই বসের কাছে আপনার নাম বলাল সাথে সাথে উনি আমালে জিজ্ঞেস কলেন- মাহবুব লেলেন মানে ওই কবন্ধ উকুন? ...দেখেন ভাই আমি আপনাল অন্য বইয়েল নাম লিখে নিলেও তিনি আপনাল কবন্ধ জিলাফ আল উকুন বাছা মিলিয়ে এক নাম বানিয়ে আমালেই বলে- কবন্ধ উকুন? ... চিন্তা কলেন তো এইতা কেমন নাম?
- তাতে তোর সমস্যা কী? বই আমার বলেছে আরেকজন। তোর চুলকায় কেন?
- চুলকায় না ভাই। কিন্তু এইতা কেমন নাম বলেন তো?
- তো কী করতে হবে? তোদের জন্য আমার বইয়ের নাম বদলাতে হবে?
- না সেতা না। বস আমালে জিজ্ঞেস কলল আপনাল মুখে এখন ফুল দাড়ি না হাফ দাড়ি?
- মানে?
- মানে আপনিতো ভাই কয়েকদিন পলে পলে দাড়ি কেটে ফেলেন। তালপল কয়েকদিন আপনাল মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি থাকে। উনি বলেছেন ফুল দাড়ি থাকলে অসুবিধা নাই। কিন্তু খোঁচা খোঁচা দাড়ি থাকলে আপনি সেইভ কলবেন কি না জিজ্ঞেস কলতে বলেছেন। খোঁচা দাড়ি স্ক্রিনে ভালো লাগে না
- আমার এখন খোঁচা খোঁচা দাড়ি এবং সেভ করব না আপাতত
- তাইলে তো ভাই হলো না
- নো প্রোব্লেম
- এইতা একতা সমস্যা ভাই আপনাদেল নিয়ে। উকুন বাছা- কবন্ধ- তালপল ফুল দাড়ি হাফ দাড়ি। কোনো কিছুল ঠিক নাই কী কলেন না কলেন
- তুই কি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস?
- না না ভাই জ্ঞান দেই না। কিন্তু আমাল কাজটা হচেছ না দেখে খালাপ লাগছে
- খারাপ লাগলে তুই তোর অফিসের সঙ্গে গিয়ে বুঝে খা...

তারপর দেখা হয়েছে মাত্র দুয়েকবার। ক্রাচ ছেড়ে কোথায় কোথায় যেন একা একাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে অর্ণব। বাইরে বের হয় কম। ক্যান্সারে আক্রান্ত মা মারা যান। অর্ণব কাউকে বলে না। কিন্তু জেনে যায় সবাই। একদিন অর্ণবের ফোন- ভাই আমাল মনটা খুব খালাপ। আমি কলাবাগান আসতে চাই
- আয় না। আসিস না কেন?
- যাই না ভাই। গেলেই থবাই আমাল মায়েল কথা জিজ্ঞেস কলবে এইজন্য। আমি ভাই কথাতা মনে কলতে চাই না। আমাল সঙ্গে ভাই এখন আল কেউ ফাজলামি কলে না। সবাই খুব সিলিয়াস হয়ে কথা বলে। আমাল ভাল্লাগে না...
- আয় তোকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করবে না...

অর্ণব আসে। মরার পরে নরকে গেলে তাকে শাস্তি দেয়াটা আল্লার জন্য কতটুকু সুবিধা তার বর্ণনা দেয়। তাকে শাস্তি দেবার জন্য আল্লার আলাদা আগুন জ্বালতে হবে না। শুধু একটা কারেন্টের তার পায়ের স্টিলটায় কানেকশন দিলেই হয়ে যাবে। অটো পুড়তে থাকবে সব...

সামনের সাত জুলাই অর্ণবের যাবার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ায়। একটা ফিল্ম ফেস্টিভালে। কিন্তু তার আগেই আজ সকালে সে গেলো আশুলিয়ার রাস্তায় মোটর সাইকেল চালিয়ে হাত ফ্রি করে নিতে। মোটর সাইকেলটা কিছুদিন আগেই কিনেছে। এক পায়ে স্টিলের ঠেকনাসহ বাস রিকশায় চড়তে তার অসুবিধা হয়। মোটর সাইকেলটাই ভালো বিকল্প বাহন। চালানো শিখছিল কিছুদিন থেকে। শুক্রবার বন্ধের দিন ফাঁকা রাস্তায় সে আজ সকালে একটু দূরে চলে যায়। বেড়িবাঁধ দিয়ে আশুলিয়ার রাস্তায়...

এক পথচারী আবিষ্কার করে রাস্তার একপাশে কাত হয়ে পড়ে থাকা মোটর সাইকেল। সাইকেলের ভিউ মিররে আটকানো হেলমেট আর অন্যপাশে ইলেট্রিকের খুঁটির সাথে মাথা থেঁতলে যাওয়া অর্ণব...

মোবাইলের রিসিভ লিস্ট ধরে ডায়াল করে সেই লোক ঠিকানা পায় আরটিভির। পিকাপ ভ্যানে তুলে যখন অর্ণবকে নিয়ে আসে তখন আরটিভি এনটিভির অনেকের সাথেই নেমে আসে এনটিভিতে কাজ করা আমাদের গ্রুপের আরেকটা ছেলে ইভান। ইভান লাশটা দেখে। তারপর লাশটা আরটিভির কার লাশ জানার জন্য একটা নম্বরে ফোন করে ইভান। সেই নম্বরটা অর্ণবের...

অর্ণব এতটাই বদলে গেছে যে একই গ্র“পের ইভানও তাকে চিনতে না পেরে তাকেই ফোন করে জানতে চায় লাশটা কার...

দুপুরে আমরা যখন গিয়ে পৌঁছাই তখন লাশ চলে গেছে ঢাকা মেডিকেলে পোস্ট মর্টেম আর সার্টিফিকেটের জন্য। লাশ নিয়ে আরটিভিতে গাড়ি এসে পৌঁছায় রাত সাড়ে দশটায়। কফিনের মুখ খোলা হয়। দেখার জন্য লাইন ধরে দাঁড়ায় সবাই। আমিও ঢুকে যাই লাইনের ভেতর। মোবাইলের ক্যামেরা অন করে রাখি। তারপর কাছাকাছি গিয়ে অজান্তেই অন করা ক্যামেরাসহ মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলি...

আমাকে একবার আমার নাটকের গ্রুপ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। রাস্তায় দেখা হবার পরে অর্ণব গ্রুপের খবর জিজ্ঞেস করায় বলেছিলাম- আমাকে গ্রুপ থেকে বের করে দিয়েছে। আমি তো এখন আর গ্রুপে নেই। গ্রুপের খবর জানি না

অর্ণবের মুখে জীবনের একমাত্র গালিটা শুনেছিলাম সেদিন- কুন থুওলেল বাত্তা বলে আপনি গ্লুপে নাই...

অর্ণবের লাশটা দেখেই আমারও চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল- কুন থুওলেল বাত্তা বলে এতা অর্বনের লাশ...

২০০৯.০৬.২৬ শুক্রবার


দুবছর বয়সে সেই প্রথম মৃতদেহ দেখেছিলাম জন্মের আধঘণ্টা পরে মারা যাওয়া পিঠেপিঠি ছোটভাই হিরণের। ভাই আসবে বলে পুরোটা দিন আমাকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে রাখা ভাইয়ের লাশ যখন বারান্দায় রাখা হয় আমি তার হাত ধরে টানছিলাম কথা বলার জন্য। তারপর ছ বছর বয়সে কফিনের ভেতর উঁকি দিয়ে নানাকে দেখেই মনে হয়েছিল তিনি আমার জন্য তার হাতঘড়ির মতো বড়ো একটা ঘড়ি আনার কথা ছিল। কিন্তু না এনে শুয়ে শুয়ে হাসছেন খালি। আর এগারো বছর বয়সে স্কুল টিলার ঠিক নিচেই আমাদের ক্লাসের পরেশকে পিষে দেয়া বাসটাকে যখন লোকজন ভেঙে চুরে দিয়ে চলে গেছে তখন গাছের একটা ডাল ভেঙে অনেকক্ষণ ধরে পিটাচ্ছিলাম গাড়ির সেই চাকাটিকে। যেটা চলে গিয়েছিল পরেশের উপর দিয়ে। এবং সম্ভবত তখনই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম মৃত্যু কিছু একটা নিয়ে যায়...

তারপর সেই সংখ্যা কত হলো? ২২ নাকি ২৬? একটা লিস্ট করতে বসেছিলাম। ভেবেছিলাম ছাইয়ের মতো ঝাপসা সেই নামগুলোকে গেঁথে রাখব কোথাও। কিন্তু কল্পনাতেও ভাবিনি সেই সিরিজটার প্রথম পর্বটাই হবে অর্ণবকে নিয়ে। যার সিরিয়াল হতে পারে ২৩। হতে পারে ২৭। কিংবা হতে পারে ৪০ কিংবা তারও বেশি...


মন্তব্য

সুমন সুপান্থ এর ছবি

আমার আবার ফালতু অভ্যাস, এতো বয়স বাড়লো, তবু এই চোখ ভিজে ওঠা গেলো না !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

সাইফ তাহসিন এর ছবি

লীলেনদা, খুবই হৃদয় বিদারক মন খারাপ , ভাষা হারিয়ে ফেললাম

=================================
বাংলাদেশই আমার ভূ-স্বর্গ, জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী

ধুসর গোধূলি এর ছবি
নাহার মনিকা এর ছবি

কোন বিচিত্র কারণে জানিনা- মৃত মানুষের মুখ দেখার অভিজ্ঞতা আমার খুব কম।
এই রকম ঘটনা, লীলেন যেভাবে লেখে, ঝাঁকি দিয়ে গেলো...

মামুন হক এর ছবি

সান্ত্বনা দেবার ভাষা জানা নাই লীলেন ভাই, দেশে থাকলে আপনাকে কোন পার্কে বা নদীর ধারে বা অন্য কোথাও নিয়ে যেতাম। প্রকৃতির কাছাকাছি গেলে মানুষের কষ্ট লাঘব হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সবাই চেয়েছিল আপনার "লুলাবর্ষ" কেটে যাক। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে এভাবে কেউই চায়নি।

আমি অর্ণবকে চিনি না। হঠাৎ করে আরটিভিতে খবর দেখতে গিয়ে তাদের ২৮ বৎসর বয়সী সহকর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যুর বর্ণনায় শিউড়ে উঠি। এই টিভি চ্যানেলটা আমি দেখি না, দেখা হয় না। তবু মাইকেল জ্যাকসনের খবর খুঁজে খুঁজে দেখতে গিয়ে এই খবরটা কীভাবে যেন দেখা হয়ে গেল। আপনার লেখার শুরুর দিকে "তানভীন জে এহসান" নামটা দেখে বুঝে ফেলি কার কথা বলতে যাচ্ছেন। এতো অল্প বয়সে! এমন ....... কায়দায়! আমি কালকেও সহ্য করতে পারিনি, আজো পারছিনা।

আপনাকে সান্ত্বনা দেবার বোকা চেষ্টা করব না। কারণ তার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু এ'টুকু বলি অর্ণব যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

লীলেন ভাই। কী আর বলবো।
আমার জীবনে পড়া সেরা লেখার একটা।
চোখ যে কেন এমন ভিজে ওঠে!
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

রণদীপম বসু এর ছবি

সময় থেমে গেলে আর কোন মন্তব্য চলে না ! অসাধারণ শোকপত্র......

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

তানভীর এর ছবি

খবরটা বিডিনিউজে দেখেছিলাম। পঁচিশ বছরের যে কোন মানুষের মৃত্যুই মর্মান্তিক। আর তার পেছনের গল্প যদি এমন হয়, কী বা বলা যেতে পারে!!

অনিন্দিতা চৌধুরী এর ছবি

অফিসে এসেই আপনার লেখাটা চোখে পড়ল।
এর আগে আমি ঘটনাটা জানতাম না। পরে অবশ্য বিডি নিউজে পড়েছি।
প্রতিদিন আমরা কত শত নাম না জানা মানুষের মৃত্যুর কথা শুনি।
সব খবর আজকাল কেন জানি স্পর্শ ও করে না। হয়ত এদের জীবনের গল্প জানি না বলে।

আজ আপনার লেখাটা কেমন যেন অবশ করে দিল।
অর্ণব বেঁচে থাকুক সবার মাঝে।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

......................................

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

নিবিড় এর ছবি

আপনার একটা লেখা সচলে দেখতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু এই ভাবে তা হবে আশা করি নি।


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

..................................

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

রেনেট এর ছবি

.................................

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

জিজ্ঞাসু এর ছবি

......

___________________
সহজ কথা যায়না বলা সহজে

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

মন খারাপ

মন খারাপ

মন খারাপ

মন খারাপ

মন খারাপ

দেশের খোঁজখবর রাখা হয় না তেমন। টিভিও দেখা এখন খুব বিরল ঘটনা! তার মধ্যে খবর তো আরো না!
এই লেখাটা না পড়তে না পড়তেও যে কোনোমতে সময় করে পড়তে চলে এলাম লীলেন ভাই আপনার লেখা ব'লেই বেশি। কিন্তু, জানা থেকে বেঁচে যেতে যেতেও শেষমেশ এ আমি কী জানলাম! মন খারাপ
প্রথমটায় নিজেকে তুলনামূলক সুবিধার জায়গায় মনে হচ্ছিল যে আমি থাকাকালে অর্ণব ছিল না নিশ্চয়ই। কিন্তু আস্তে আস্তে বর্ণনায় যেভাবে আমার সেই দূর ছয়মাসের ঘষাকাচটাকে পরিষ্কার ক'রে তুললেন আপনি, না এই পোস্ট আমার না পড়াই ভালো ছিল! মন খারাপ
হ্যাঁ, আমিও এখন চিনেছি আবার অর্ণব নামের অতীত সেই ছেলেটাকে, এমন চিরঅতীত হয়ে যাবার পরে! হায় রে মানুষের জীবন! হায়রে ... মন খারাপ
কেন এমন সুপারক্যাথার্টিক গল্প হ'তে হবে মানুষেরই জীবন নিয়ে পৌনঃপুনিক! মন খারাপ

___________
স্বাক্ষর?!
মাঝেসাঝে বুঝতে পাই- আমি
নিরক্ষর!

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

দময়ন্তী এর ছবি

..................................

--------------------------------------------------------------------- ----
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

দ্রোহী এর ছবি

পড়লাম...............
বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না!

মুস্তাফিজ এর ছবি

ইদানীং ব্যস্ত। সচলেও আসা হয় কম। আজ ঢুকেই পড়লাম এটা। বলার কিছু নেই।
অর্নব যেখানেই আছে ভালো থাকুক।

...........................
Every Picture Tells a Story

যুধিষ্ঠির এর ছবি

লেখায় মন্তব্য দেয়ার কোন উপায় রাখেননি আপনি। অর্ণব শান্তিতে ঘুমাক।

লুৎফর রহমান রিটন এর ছবি

খুবই মন খারাপ করানো হৃদয়ছোঁয়া লেখা।
লীলেন তুমি লিখেছো অসাধারণ! আহারে ছেলেটা.........

হাবু বেশ বড়সড়,গাবুটা তো পিচ্চি
হেরে গিয়ে হাবু বলে--উৎসাহ দিচ্ছি!

তানবীরা এর ছবি

...................................
---------------------------------------------------------
রাত্রে যদি সূর্যশোকে ঝরে অশ্রুধারা
সূর্য নাহি ফেরে শুধু ব্যর্থ হয় তারা

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

রানা মেহের এর ছবি

খুব খারাপ লাগছে লীলেন ভাই
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

Gopal  krishna Dash এর ছবি

Mrittu bishoye
Jibonanander por
apni

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অনুগ্রহ করে বাংলায় লিখেন ব্রো।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।