এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে... হে আল্লা...

মন মাঝি এর ছবি
লিখেছেন মন মাঝি [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০৬/০৬/২০১১ - ৭:২৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মনটা খুব খারাপ। নির্ঘুম, বিষন্ন, ভারাক্রান্ত। কিছু বলার নেই, সবই তো জানা কথা – এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে... হে আল্লা...

জীবনের শুরু হয়েছিল যে গানের পাখির কণ্ঠে, স্মৃতির ধূসর পাতা খুঁড়ে প্রথম যে প্রিয় গানের কথা মনে পড়ে, যার গান বন্ধুদের সাথে নিয়ে নিজের বেসুরো কণ্ঠেও গাইতে গাইতে শৈশবের প্রথম পর্ব পার করেছি - সেই প্রিয় সদাচঞ্চল গানের পাখির প্রাণপাখিটা আজ (৫ই জুন, ২০১১) কোন অনন্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে জানি না - কিন্তু মাটির দেহটা আজ এত সুন্দর দুনিয়ার খাঁচা ছেঁড়ে সেই মাটির বুকেই আবার চিরমুক্তি লাভ করেছে। প্রিয় গানের পাখির অচিন পাখি হয়ে যাওয়ার এ এক মনভাঙ্গা দৃশ্য।

অর্থাভাবে পূর্ণ চিকিৎসা হয়নি। ভয়ঙ্কর ক্যান্সারের বীজ মুখগহবর থেকে ফুসুফস, লিভার, হাড় – অনেক জায়গাতেই পৌঁছে গেছিল। হার্ট এটাক হয়েছিল। ফুসফুস বহুলাংশে অকার্যকর। পানি জমেছিল। শেষবারের মত স্কয়্যারের আইসিইউতে ভর্তির পর টিভিতে ডাক্তার যা বললেন, তাতে সরাসরি চরম কথাটা বলে না দিলেও – বুঝতে আর কিছুই বাকি থাকেনি। এইবার বোধহয় আর হাসপাতাল থেকে ফেরা হবে না। নিরব, নির্বাক, স্তম্ভিতচিত্তে বুঝে নিতে হয়েছে। গভীর বিষাদে মৌন প্রার্থনায় অবনত হয়েছে হৃদয়।

কিন্তু সব প্রার্থনার উর্ধে উঠে গুরু আজম খান -- এই ভীষন প্রিয়, সহজ-সরল-খাঁটি, মায়াবী মানুষটা চলেই গেলেন শেষ পর্যন্ত আমাদের ছেড়ে।

এখন শুধু মনে পড়ে যাচ্ছে আর বারবার শুনতে ইচ্ছা করছে মায়ামেদুর ছায়াচ্ছন্ন শৈশব স্মৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ তার সেই প্রথম দিকের গানগুলি। মনে পড়ে প্রিয় গানগুলি নিয়ে শিশুমনের প্রথম স্মৃতি -- বড় ভাইয়ার কণ্ঠে ‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে, ক’জনাই বা...’ (এটা কি তাঁর ছিল, নাকি ফিরোজ সাঁইর?) শুনে কি মজাই না পেতাম কেন যেন। মনে পড়ে ক্লাস-থ্রীতে ম্যাডামের আদেশে পুরো ক্লাসের সামনে বন্ধু নাইমুলের খালি গলায় ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা’ প্রথম শুনে কি বিমোহিত আর ঈর্ষান্বিত হয়েছিলাম। মনে পড়ে ‘আলাল ও দুলালের’ একজন ডাইনে গেলে অন্যজনের বামে যাওয়া, তাদেরকে তাদের বাআআআবার সারাদিন খুঁজে খুঁজে মরা (আহ , এই কলি ভাঁজতে ভাঁজতে আমি নিজেও কতদিন ঝিম ধরা দুপুরে বাড়ি থেকে সটকেছি, আর মনে মনে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আব্বু বা আম্মুর হয়রান হওয়ার কথা ভেবে মজা পেয়েছি!), বা প্যাডেল মেরে ‘চাঙ্খারপুলে’ পৌঁছানোর কথা। এই চাঙ্খারপুলটা চিনতাম না তখন – বড়ই রহস্যময় জায়গা ছিল আমার জন্য। যেন বাবা-মার শাসনের আওতার বাইরে শিশুদের জন্য বিমল ফুর্তি আর স্বাধীনতার একটা সাক্ষাৎ স্বর্গ – যে স্বর্গে স্রেফ প্যাডেল মেরে পৌঁছানো যায় – প্যাডেল মেরে মেরে উড়ে চলা যায় দিগ্বিদিক স্বাধীনতায়। আহ্‌ কি মুক্তি ! তাঁর গানগুলির অর্থ ঠিকমত বুঝতাম না তখন – টুকরো টুকরো করে ভেঙে নিয়ে ঐ টুকরোগুলির কিছু কিছু নিজের কল্পনা মাখিয়ে নিজের মত করে বুঝে নিতাম। গুরুর অর্থের সাথে কোন মিল থাকুক বা নাই থাকুক। ঐতেই কি আনন্দ ! এখনো সেসবের কিছু অনুরণন স্মৃতি কোষের গহীনে আটকে আছে সঙ্গোপনে। এটা মোছার নয়।

নতুন করে সব মনে পড়ে যায় গানের পাখিকে নিউজ হতে দেখে। কিন্তু এটাতো কোন কাঙ্খিত নিউজ নয়। তার এই খাটিয়াতে শায়িত, চিরনিস্তব্ধ রূপ দেখে গভীর শোকের সাথে সাথে কৃতজ্ঞতায় দ্রবীভূত হয় হৃদয়। আমার শৈশবকে তার সুরে সুরে সমৃদ্ধ করার জন্য।

আর কি বলব জানি না। কিছু বলতে বা লিখতেও ইচ্ছে করছে না আর। কিছু বলার নেই। শুধু এটুকুই -

আসুন আমরা সবাই এদেশের, স্বাধীন বাংলার, প্রথম যুগের তারুন্যের প্রতিভূ এক চিরতরুন গানের পাখি – গুরু আজম খানকে স্মরণ করি কিছুক্ষণের জন্য হলেও। সকলে একযোগে বিনত হই মৌন প্রার্থনায়। তাঁর গান শুনি আজ।

আজম খান ও তাঁর গান অক্ষয় হোক আমাদের স্মৃতিতে ও হৃদয়ে।

এত সুন্দর দুনিয়ায়...

আলাল ও দুলাল...

ওরে সালেকা, ওরে মালেকা...



মন্তব্য

আশালতা এর ছবি

আমার শৈশব কৈশোরের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশই এই মানুষটার অবিনাশী গান, তাঁকে নিয়ে আসলে নতুন করে কিছু বলার নেই । অথবা উলটো করে বলা যায়, এত কিছু বলার থাকে যে তা ভাষায় আসেনা । সব বলা না বলার উপরে ওনার জন্যে ভালবাসা জমে থাকুক সবার মনে ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমাদের আড্ডায় যখনই গান গাওয়া হতো তখন গুরুর গান ছিলো 'মাস্ট'। বস্তুত আমাদের আগের ও পরের প্রজন্মের আড্ডার জন্যও কথাটা সত্যি। কনসার্টগুলোতে ব্যান্ড যেই হোক গুরুর গান গাইতেই হবে। আমাদের সেই আড্ডায় অশ্বিনীকুমারের কণ্ঠে "হে আল্লা, হে আল্লা রে ..." আর তার গিটারের তীব্র স্ট্রোক কখনোই ভোলার নয়, আর গুরু মনে থাকবেন আরো তীব্র ভাবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

শ্রদ্ধা

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

তাসনীম এর ছবি

আমাদের প্রজন্মের শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের ছায়াছবির ব্যাকগ্রাউন্ড সঙ্গীতের রচয়িতা আজম খান। স্বাধীনতার পরের সেই অস্থির সময়ে নিয়ম ভাঙা গান নিয়ে আসা আজম খানকে বিদায়। আপনি বেঁচে থাকবেন আমাদের গল্পগুলোতে...বিদায় গুরু।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

MSR এর ছবি

আজিমপুরে শুরু.......আজিমপুরে শেষ।।

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

শ্রদ্ধা

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

..................

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।