রাজকুমার, রাজবংশী, ঠগুয়া আর রামু'র কথা

মুস্তাফিজ এর ছবি
লিখেছেন মুস্তাফিজ (তারিখ: বুধ, ২৩/১২/২০০৯ - ১:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ময়মনসিংহ পলিটেকনিকে আমাদের দিনগুলি ছিল আনন্দের। মূল শহরের বাইরে এ জায়গাটা একসময় হিন্দু মালিকাধীন ছিলো, এগুলো বিক্রি করে বহু আগেই ওরা দেশ ত্যাগ করে। জ্ঞান হবার পর পুরো এলাকায় অনেক পুকুর দেখেছিলাম, আস্তে আস্তে সেসব ভরাট করে স্টাফ কোয়ার্টার, ইন্সটিটিউট বিল্ডিং, হোষ্টেল এসব বানানো হয়। মোটামুটি ‘৭২ এর ভেতরই পূর্ণ রূপ নেয় পলিটেকনিক।
পুরো এলাকার পেছন দিক ১০/১২ ফুট উঁচু দেয়াল আর সামনে ৮ফুট দেয়ালে ঘেরা, মাঝখানে আবার আরেকটা ৮ ফুটের দেয়াল তুলে আবাসিক এলাকা আলাদা করা ছিলো। আবাসিক এলাকার পেছনে ছিলো বিশাল লিচু বাগান, বেশ বড় আর মিষ্টি লিচু ধরতো তাতে, বাগানের ভেতর পুরাতন বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। লিচু বাগানের ভেতরে একপাশে একটা পুকুর ছিলো, সবগুলো ভরাট হলেও এ পুকুরটা টিকে গিয়েছিলো। ‘৭১ এর উত্তাল দিনগুলোতে প্রায়ই স্কুল বন্ধ থাকতো, পালিয়ে থাকার কারনে আবাসিক এলাকায় সমবয়সীদের সংখ্যাও আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। এপ্রিলের শুরুতে পুরাতন হোষ্টেলে পাকিস্তানী সেনারা আস্তানা গাড়লে আমাদের মাঠে যাওয়াও এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। যদিও মাঝখানে দেয়াল ছিলো তারপরও বারান্দায় দাঁড়ালে পাকিস্থানীদের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যেতো।
যেদিন এখানে মিলিটারী আসে তার পরদিনই আবাসিক এলাকা একপ্রকার ফাঁকা হয়ে যায়। পুরো এলাকায় শুধু আমরা আর পলিটেকনিকের দারোয়ান রাজকুমার আর তার পরিবার। এই রাজকুমার ছিলো রাজস্থানী, এখানে কখন কিভাবে এসেছে আমার জানা নেই। তার মেয়ের জামাই রাজবংশীও দারোয়ান ছিলো, থাকতো একই সাথে। রাজকুমারের দুই ছেলে ঠগুয়া আর রামু মোটামুটি আমাদের বয়সী, ঠগুয়া সম্ভবত কয়েক বৎসরের বড়। রাজবংশীর গানের গলা চমৎকার, ভাষা না বুঝলেও গান ভালো লাগতো। ওদের পূজা পার্বণ সামনে এলেই উন্মুখ হয়ে থাকতাম বংশীর গান শুনতে। ঠগুয়া আর রামু ছিলো আমাদের খেলার সাথী, জাত পাতের বালাই ছিলোনা, ৭৩ এর দিকে এসে এসবের পরিবর্তন শুরু হয়, নুতন কর্মচারী আসে, অনেক ছেলেমেয়ে, মোটামুটি একপ্রকার অচ্ছুৎ হয়ে পড়ে ওরা, আসলে বিভাজন শুরু হয়েছিলো উচ্চ বর্ণের হিন্দু কর্মচারীদের দ্বারাই। রাজকুমারের অনেকগুলো দুধেল গাভী ছিলো, যুদ্ধের সময় ওর গাভী গুলো লুটেরারা অনেক চেষ্টা করেও নিতে পারেনি। আব্বা কঠোর হাতে সেসব রক্ষা করেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আম্মাকে একটা গাভী দিতে চাইলেও আম্মা নেননি, অবশ্য পরে রাজকুমার থেকেই আম্মা ১১০ টাকায় একটা গাভী আর ১৫ টাকায় একটা ছাগল কিনে নেন।
সেই সময় যখন আমাদের এই দুই পরিবার ছাড়া সবাই বাসা ছাড়া এবং সামনেই মিলিটারী ক্যাম্প তখন একদিন সন্ধ্যায় আব্বা রাজকুমারকে ডেকে এনে ওর পরিকল্পনা জিজ্ঞেস করলেন, রাজকুমার খুব সহজ ভাবে সেখানেই থেকে যাবে বলাতে পরদিন আমরা সেখান থেকে ত্রিশালের দিকে ধানীখোলা নামে এক জায়গার স্কুলে আশ্রয় নিই। সেই স্কুলে পলিটেকনিকের আরো শিক্ষকদের পাশাপাশি মেডিক্যালের প্রিন্সিপাল সহ অনেক ডাক্তারও আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এই ধানীখোলাতেই আমরা আম্মার শাড়ী কেটে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা বানাই। যদিও স্কুলের মাঠে বিশাল একটা পাকিস্থানী পতাকা উড়তো বিমান আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য। একজায়গা থেকে অন্যত্র যাবার সময় আমাদের পতাকার স্থান হতো টিয়া পাখির খাঁচার ভেতর।
পুরাতন কর্মচারী বলে পলিটেকনিকের প্রিন্সিপাল কলেজ ছেড়ে যাবার সময় আব্বার কাছে পলিটেকনিকের সব চাবি রেখে গিয়েছিলেন। সব প্রধান ফটকে ৪/৫টা করে তালা লাগানো থাকলেও ধানীখোলা থেকে আব্বা প্রায়ই এসে এসে দেখে যেতেন। তেমন অবস্থায় একদিন ফিরে যেয়ে বললেন পলিটেকনিকের আবাসিক এলাকায় লুটপাট শুরু হয়েছে, এর প্রথম শিকার ছিলেন হিন্দু কর্মচারীরা। আম্মা তখন সন্তান সম্ভবা, আর আমাদের স্কুলও খুলেছে বলে শুনেছি। অনেককিছু বিবেচনা করে আব্বা ফিরে আসা মনস্থির করলেন। আমরাও খুশী মনে চলে এলাম।
ফিরে আসার পর মাঠে যেয়ে খেলাধুলা করার উপর আমাদের নিষেধাজ্ঞা ছিলো, মাঠের পূব দিকে আমাদের বাসা আর পশ্চিমে একটা দেয়াল পরেই আর্মি ক্যাম্প, দুপুরের দিকে আব্বা পলিটেকনিকের সেই থেকে যাওয়া পুকুরে নিয়ে যেতেন সাঁতার শিখতে, বড় দুই ভাই,আমি আর আমার ছোটটা এসময়ই সাঁতার শিখি। এরই মাঝে একদিন আছরের আজ্বানের সময় অবাক হয়ে দেখলাম ঠগুয়া আর রামু টুপি মাথায় মসজিদে যাচ্ছে। দৌঁড়ে এসে বাসায় এ খবর জানাতে সন্ধ্যায় আব্বা রাজকুমারকে ডেকে এনে পুরো বৃত্বান্ত শুনলেন।
আমরা সবাই পলিটেকনিক ছাড়ার পর শুধুমাত্র ওরা যখন সেখানে সেসময় সেখানকার মসজিদের ইমাম মিলিটারীর হাত থেকে ওদের বাঁচাতে মুসলমান হিসাবে পরিচয় করিয়ে কার্ড বানিয়ে দেয়। ঠগুয়ার নাম হয় আবদুর রহমান আর রামু হয়ে যায় আবদুল খালেক, রাজকুমার আর বংশীরও নুতন নাম হয়, ওরা কলেমা শিখে, সুরা শিখে, মসজিদে যায়, টুপি মাথায় গেটে ডিউটি করে, মিলিটারীরা মাঝে মাঝে ডেকে নিয়ে যায় মালপত্র উঠানো নামানোর জন্য।
সব কিছুই ঠিকঠাক মত চললেও একদিন ছন্দ পতন ঘটে। রাজকুমার দু’দিন যাবৎ উধাও, সকালে বাজারে যাবার কথা বলে আর ফিরে আসেনি। আম্মা তখন হসপিটালে, পলিটেকনিকের দেয়াল টপকে প্রতিদিনই আমাদের কেউ না কেউ দু’বেলা খাবার পৌঁছে দিতাম সেখানে। এমন একদিন আব্বা হসপিটালে যাবার সময় ইমার্জেন্সীতে রক্তাক্ত আর অজ্ঞান অবস্থায় রাজকুমারকে দেখতে পান। কয়েকদিন পর একটু সুস্থ হলে হসপিটাল থেকে পলিটেকনিকে আর না ফিরে পরিবার সহ পালিয়ে যায়। পরে শুনেছি বাজারে যাবার সময় মেডিক্যালের গেটে রাজাকারদের প্ররোচনায় পাকিস্তানীরা ওর লুংগী খুলে মুসলমানিত্ব পরীক্ষা করতে যেয়েই বিপত্তি বাধে। সাথে সাথে বন্দুকের বাট দিয়ে পিটুনী, কিল ঘুষি আর লাথি, গুলি করার আগ্‌ মূহুর্তে পলিটেকনিকে থাকা মিলিটারীদের থেকে নেয়া রাজকুমারের আইডি কার্ড দেখিয়ে মসজিদের সেই ঈমাম একপ্রকার জোর করেই তাকে উদ্ধ্বার করে হসপিটালে নিয়ে আসেন। প্রাণে বাঁচলেও এর পর যতদিন বেঁচে ছিলো রাজকুমার কে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছি।
দেশ স্বাধীন হবার পর ওরা আবার পুরোনো নামে ফিরে যায়।

মুসলমানিত্ব পরীক্ষামুসলমানিত্ব পরীক্ষা


মন্তব্য

খেকশিয়াল এর ছবি

লিখতে থাকুন মুস্তাফিজ ভাই, পড়ে যাচ্ছি

------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

-----------------------------------------------
'..দ্রিমুই য্রখ্রন ত্রখ্রন স্রবট্রাত্রেই দ্রিমু!'

দুর্দান্ত এর ছবি

কোরানের কোথাও মুসলমানির কথা লেখা নেই। আছে কিছু হাদিসে (সবগুলো সংকলনে নেই) যেগুলোর ভিত্তি তওরাত (১৭-১১)। আর এটাই কি না হয়ে গেল মুসলমানের প্রধান পরিচয়।

মুস্তাফিজ এর ছবি

এখানে কিন্তু প্রধান পরিচয় হিসাবে মুসলমানির কথা বলা হয়নি। মুসলমানির কথা কোরানে লেখা না থাকলেও এটা একটা ভালো সুরক্ষা।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেককেই নিজের মুসলমানিত্ব প্রমাণের জন্য এই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। আমি এই পরিস্থিতির কথাই শুনাতে চেয়েছি। যেহেতু হিন্দুদের এ অভ্যাস নেই তাই এটা ছিলো একটা সহজ পন্থা। এ সময় অনেকে কলেমা শুনাতে যেয়ে বিভিন্ন দোয়া, আজ্বান কিংবা সুর করে পড়া মিলাদের শ্লোক (বিশেষ করে সাদী’র কবিতা ‘বালাগাল উলা বে কামালিহী’) শুনিয়েও পার পেয়েছে শুনেছি। কারন শ্রোতা পাকিস্থানী সৈনিকদের অনেকে সেসবও জানতো না।

...........................
Every Picture Tells a Story

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

চলুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

হিমু এর ছবি

মুস্তাফিজ ভাই, এইটা একটা পূর্ণাঙ্গ বই হয়ে যাবে পয়লা বৈশাখ নাগাদ। প্রকাশায়তনের কাজ একা মুর্শেদকে করতে হচ্ছে, পয়লা বৈশাখে আমরা শুরু করতে পারবো বলে আশা করছি।

চলুক নিয়মিত। জয় বাংলা!



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

হিমু এর ছবি

কেন যেন ইদানীং শুধু রাজাকারদের নাম জানতে ইচ্ছা করে।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

শেখ নজরুল এর ছবি

হাজাম-রাজাকার।
শেখ নজরুল

শেখ নজরুল

তানভীর এর ছবি

চলুক।

অমিত এর ছবি

এইটা বই আকারে পেতে চাই

সুমন চৌধুরী এর ছবি

প্রতিটা পর্ব গিলে চলেছি। এটা একটা ইবুক হতেই হবে।



অজ্ঞাতবাস

আলমগীর এর ছবি

সব পর্ব পড়ে যাচ্ছি।
আরেকটু বড় করে লিখেন না মুস্তাফিজ ভাই।

মুস্তাফিজ এর ছবি

ভাই, আমার বয়স তখন অল্প, যতটুকু মনে আছে সেটুকুই লিখছি।

...........................
Every Picture Tells a Story

মামুন হক এর ছবি

মুস্তাফিজ ভাই, অনেক অনেক ধন্যবাদ এই সিরিজটার জন্য। পরের পর্বের অপেক্ষায় আছি।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ঠিক এইভাবে ড্রাফটগুলো দাঁড়িয়ে গেলে পরে ঘষামাজা করে একটা চমৎকার বই করে ফেলা যাবে

আকতার আহমেদ এর ছবি

নির্মোহ স্মৃতিচারণ অনেক বেশী জরুরী, বিশেষত ঐতিহাসিক ঘটনায়। আপনার বর্ণনায় এই পরিমিতিবোধ স্পষ্ট, মুস্তাফিজ ভাই। লেখা অব্যাহত থাকুক। চলুক

রানা মেহের এর ছবি

এই কথাগুলো জানা খুব জরুরী
ধন্যবাদ মুস্তাফিজ ভাই
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

শুভাশীষ দাশ এর ছবি

ক্রমাগত লিখতে থাকেন।

হিমু এর ছবি

একটা ভিডিও দিয়ে যাই। শালাদের অবস্থা কী হইসিলো দেখেন। ডরপোকগুলি।



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

তুলিরেখা এর ছবি

বই আকারে পাবার আকাঙ্ক্ষা আমারও। এটা একটা অসাধারণ কাজ হচ্ছে।
-----------------------------------------------
কোন্‌ দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।