১০১টা ছবির গল্প - ১৩, বাজারের গলি

মুস্তাফিজ এর ছবি
লিখেছেন মুস্তাফিজ (তারিখ: শুক্র, ২৮/০৭/২০১৭ - ১২:১৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নিচে যে ছবিটি আমরা দেখবো, তার একটা গল্প আছে। শত বছরের পুরোনো সেই গল্প এতদিনে গল্প থেকে ইতিহাস হয়ে গেছে। আমি আজকে সেই গল্পটিই আপনাদের শুনাবো।

গল্প শুনতে শুনতে সেই শত বছর আগের শহরে যদিও ফিরে যাওয়া যাবে না, তারপরও আমাদের এই শহরের গড়ে ওঠার একটা চিত্র নিশ্চয়ই পাঠকেরা দেখতে পাবেন। ছ’বছর আগে এ শহরে পা দেয়ার পর থেকেই এর পুরোনো অংশের গলি-ঘুপচিতে ঘোরাঘুরিতে আমার আগ্রহের কখনই কমতি ছিলো না। আমি ঘুরি, ছবি তুলি, তারচে’ও বেশি দেখি। প্রথমদিকে আগ্রহ ছিলো গলিতে আঁকা বিভিন্ন চিত্রকর্ম বা গ্রাফিতি নিয়ে। কী চমৎকার সেসব কাজ! স্থানীয় মাদকসেবিদের আঁকা বেশিরভাগ গ্রাফিতি’র বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সেরা আঁকিয়ে-রা এখানকার গলিতে গলিতে ছবি এঁকে গিয়েছেন। কোনো কোনো গ্রাফিতি’র স্থায়িত্ব একদিন, আবার কোনোটা টিকে আছে বছরের পর বছর। ঘুরে ঘুরে গ্রাফিতি’র ছবি তুলেছি, মিলিয়ে যেতে দেখেছি, মুছে ফেলতে দেখেছি, আবার একই জায়গায় নতুন ক’রে আঁকা গ্রাফিতিও দেখেছি। আমাদের আজকের গল্পটা কিন্তু এই গ্রাফিতি নিয়ে নয়, সেই গল্প তোলা থাকলো ভবিষ্যতের জন্য।

এই শহর, যার নামের সাথে ১৮৮৬ সাল থেকে জড়িয়ে আছে ক্যাপ্টেন জর্জ ভ্যাংকুউভার-এর নাম, সেই শহরের গ’ড়ে ওঠার সময়গুলোতে এর নাম ছিলো গ্যাসটাউন, এ শহরের প্রথম বিদেশি জন ডেটন - যিনি গ্যাসিজ্যাক নামেই পরিচিত - তার নামেই। ভ্যাংকুউভারের পুরোনো অংশ তাই আজও গ্যাসটাউন নামেই পরিচিত। ১৮৮৬ সালে এক দাবানলে পুরো গ্যাসটাউন পুড়ে যাবার পর নতুন ক’রে শহরটা যখন গ’ড়ে উঠছে, সেসময় এলাকার বাসিন্দারা প্রথম সিটি কাউন্সিলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, এখনকার পাওয়েল আর কলম্বিয়া স্ট্রিটের কোনায় তাঁবু খাটিয়ে এর যাত্রা শুরু হয়, সেই বিল্ডিংয়ের বর্তমান মালিক গায়ক ব্রায়ান অ্যাডামস। আমাদের আজকের গল্প সেই বিল্ডিং নিয়েও নয়।

ভ্যাংকুউভারের সিটি হল পরবর্তী কয়েক বছরে বেশ কয়েকবার জায়গা বদল ক‘রে মেইন স্ট্রিট আর ইস্ট হেস্টিংস-এর কোনায় বেশ কয়েক দশক স্থায়ী হয়। কালের গর্ভে সেই দালান ‘ওল্ড মার্কেট হাউজ বিল্ডিং’ এখন ইতিহাস। সেই দালানের নিচে ছিলো বাজার আর উপরে সিটি কাউন্সিলের অফিস। সে সময়ের বসতি স্থাপনকারীদের নানা কাজেই সিটি কাউন্সিল অফিসে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতে হ’তো, ঘোড়ায় টানা গাড়িতে কিংবা হেঁটে। তাই তাদের কেনাকাটার একটা প্রধান জায়গা ছিলো এই মার্কেট হাউজ বিল্ডিং। চাহিদা বাড়তে থাকলে এই দালানের পাশেই গড়ে উঠেছিলো আরেকটা বাজার। নাম বিল্ডিংয়ের সাথে মিল রেখে হ’লো ‘বাজার গলি’ (Market Alley)। লন্ড্রি, মুদির দোকান, লাইব্রেরি, কামার-সূতার, বেকারি, কাপড়, দর্জিবাড়ি থেকে শুরু ক‘রে পতিতা আর হোটেল ব্যবসা- সবই ছিলো এই গলিকে ঘিরে। আরো ছিলো একটা অপিয়াম ফ্যাক্টরি। ১৯০৭ সালে অ্যান্টি-এশিয়ান রায়টে এই এলাকার দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার বেশিরভাগেরই মালিকানা ছিলো চিনা-দের। পাশের চায়না টাউনের আরো দু‘টো গলি- সাংহাই আর ক্যান্টন প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় জাপান টাউন-ও। এ রায়টের পরপর ম্যাকেঞ্জি কিং - যিনি তখন ছিলেন ডেপুটি লেবার মিনিস্টার, যাকে আমরা পরে ক্যানাডা’র প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দেখেছি - তার নেতৃত্বে একটি দল ক্ষতিপূরণের জন্য তদন্তে আসে। তদন্তের ফল যা-ই হোক, ম্যাকেঞ্জি ঘুরে যাবার পরই ১৯০৮ সালে এদেশে অপিয়াম নিষিদ্ধের ঘোষণা আসে এবং এদিকের সব অপিয়াম ফ্যাক্টরি ধ্বংস করা হয়। এ ঘটনার পর পুলিশ আর গোয়েন্দাদের অপিয়াম-বিরোধি তৎপরতা সত্ত্বেও এর সেবন থেমে থাকেনি। মাঝেমাঝে দুয়েকজন গ্রেফতার হ’লেও এর মূল ঘাঁটি বের করতে গোয়েন্দাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। কয়েক মাস পর এক গোয়েন্দা পকেট-ছুরি হাতে নিয়ে ‘বাজার গলি’তে হাঁটার সময় হঠাৎ পাশের দেয়ালে সাঁটানো পত্রিকায় ছুরি আটকে গেলে উনি পত্রিকার পিছনে একটা দরজা আবিষ্কার করেন, যা উনাকে নিয়ে যায় সেই গোপন অপিয়াম কারখানায়, এবং যেটি ছিলো তখন ভ্যাংকুউভারের শেষ চালু থাকা অপিয়াম কারখানা, ঠিকানা ‘Thirty Four Market Alley’।

ভ্যাংকুউভার শহর যখন পশ্চিমে-দক্ষিণে বাড়ছে, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে আমাদের সেই বাজারের গলিও আস্তে আস্তে ম’রে যেতে থাকে। ব্যবসাগুলো স’রে যেতে থাকে, শুধুমাত্র কমদামি কিছু খাবারের দোকান আর বার কোনোভাবে ব্যবসা টিকিয়ে রাখে। ১৯৯০ সালে শেষ দোকান ‘গ্রিন ডোর রেস্টুর‌্যান্ট’ বন্ধ হয়ে যাবার পর ঠিক একশ’ বছর আয়ু নিয়ে এ-গলিটিও ম’রে যায়। এখন কোথাও এর স্থান নেই, নতুন কোনো নকশায় বা ম্যাপে নেই, কোনো ঠিকানাতেও নেই। এ এক নিষিদ্ধ গলি। দু’পাশের বাড়িগুলো তার মুখ উল্টোদিকের রাস্তায় ঘুরিয়ে নিয়েছে। এখন এখানে ময়লা ফেলার ডাস্টবিন, গ্রাফিতি আর্টিস্টদের চারণভূমি, মাদকসেবি আর মাদকবিক্রেতাদের আড্ডা। দিনের বেলাতেও অন্ধকার এ গলিতে সাধারণত কেউ আর হাঁটে না। পুরোনো কোনোকিছুই টিকে না থাকলেও অতিউৎসাহি-দের জন্য ‘বাজার গলি’র দু’টো জিনিস এখনও টিকে আছে। এক: এর ইতিহাস। দুই: ‘Thirty Four Market Alley’ বাড়িটির ঠিকানা লেখা দরজা, আমাদের আজকের গল্পের ছবি।

3In-very-basement-of-their-lives
অপিয়াম ডেন রেইড, পেপার কাটিং Headline for the very 1st drug bust in Canada. May Doyle and Nell Robertson of Victoria were found in a Market Alley drug den, but only the Chinese operator was prosecuted. The “trapdoor” was actually just a regular door covered by newspapers. Daily Province, 30 September 1908.

2Mkt-Alley-1910
Directory listing for Market Alley in 1910. Note there are no longer any white women listed because the red light district was moved on. Opium had been outlawed in 1908, but opium merchants like Yip Sang were given until the beginning of 1909 to sell their remaining stock abroad, though the directory listing hadn’t been updated to reflect this.

1Mkt-Alley-Goads-1912
Market Alley from Goad’s fire insurance map, 1912. The alley takes its name from the Market Building, labelled here as City Hall. City of Vancouver Archives, taken from the City’s Van Map online database.

Green-Door-Al-Harvey
The Green Door restaurant in Market Alley, 1977. Photo by Al Harvey

বাজার গলির বর্তমান অবস্থা
50
51
52
21
610A5866

অপিয়াম ফ্যাক্টরীর ঠিকানা লেখা দরোজা যা এখনও টিকে আছে
610A5865
64


মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

১৮৮৬ সালে এক দাবানলে পুরো গ্যাসটাউন পুড়ে যাবার পর নতুন ক’রে শহরটা যখন গ’ড়ে উঠছে, সেসময় এলাকার বাসিন্দারা প্রথম সিটি কাউন্সিলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে,

এখানে বসতি স্থাপন করা ইউরোপিয়ানরা যেখান থেকে এসেছে সেখানে ১৩-১৪ শতক থেকে সিটি কাউন্সিল ধরণের প্রতিষ্ঠান আছে। এই জিনিস ওরা কানাডা গিয়ে প্রথমেই বানালো না কেন? আরেকটা ইন্টারেস্টিং জিনিস জানলাম পুরনো অংশগুলো পরিত্যক্ত হওয়া। ইউরোপে শহরের পুরনো অংশগুলো পরিত্যক্ত বা জৌলুশহীন হয়নি।

মুস্তাফিজ এর ছবি

কানাডাতো বিশাল জায়গা। অন্যান্য বসতিতে ছিলো। কিন্তু গ্যাসটাউনে সেসময় হাতেগোণা কয়েকটা বাড়ি ছিলো মাত্র। প্রথমে এটা ছিলো একটা টাউনশীপ। মাত্র ছয় একরের বসতি। ভ্যাঙ্কুউভার সিটি হবার পরই সিটি হল হয়। প্রথম সিটি হলের ছবি দেখেন
vancouver-city-hall-tent

...........................
Every Picture Tells a Story

তাসনীম এর ছবি

পুরনো শহরের গল্প পড়তে ভালো লাগে। ওয়েলকাম ব্যাক। আমি নিজেও জড়তাতে আক্রান্ত হয়েছি যদি হাসি

১০১ টা ছবির গল্পের আরও ৮৮ টা বাকি আছে দেঁতো হাসি

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

মুস্তাফিজ এর ছবি

বেঁচে থাকলে হয়ে যাবে চোখ টিপি

...........................
Every Picture Tells a Story

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

পুরনো শহরের গল্প পড়তে বেশ লাগে।
নগরায়নের ধারাবাহিক ছবি তুলে রাখতে পারলে দারুণ হয়। যেমন ঢাকা এখন বাড়ছে পূর্বাঞ্চলে। সেখানকার চিত্র ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। এই বদলে যাওয়াটা ছবিতে তুলে রাখা গেলে দারুণ হতো।

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মুস্তাফিজ এর ছবি

ছবিতো সবাই মানে কেউ না কেউ তুলেই। দরকার হলো একটা সমন্বিত আর্কাইভ।

...........................
Every Picture Tells a Story

সোহেল ইমাম এর ছবি

আমাদের পুরনো শহর রাজশাহীটাও পাল্টে যাচ্ছে। আগে অনেক অনেক পুরনো ধাঁচের বিল্ডিং ছিলো এখন সেসব ভেঙ্গে নতুন দালান হচ্ছে। বড় বড় রাস্তা হচ্ছে। আগের চেহারাটা আর খুঁজে পাওয়া যায়না। ঘুরতে ঘুরতে এসবের ছবি তুলে একটা ফেসবুকে পেজ করে জমাতে থাকি। কয়েক বছর হয়ে গেছে। এখন দেখি পুরনো চেহারাটার অনেক ছবিই থেকে গেছে। এরকমটা যে কেউিআগ্রহী হয়ে কিন্তু করতে পারে। ছবি তোলাটাতো কোন সমস্যাই না।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মুস্তাফিজ এর ছবি

সেটাই

...........................
Every Picture Tells a Story

নজমুল আলবাব এর ছবি

বহুল প্রতিক্ষিত একটা সিরিজের সাথে বুড়াভাইর ফিরে আসা! আহা, মধু!

মুস্তাফিজ এর ছবি

সাময়ীক হো হো হো

...........................
Every Picture Tells a Story

নজমুল আলবাব এর ছবি

উহ, কইলেই ওইলো

সোহেল ইমাম এর ছবি

গ্রাফিতি নিয়ে আপনার গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম। সময় করে ক’টা ছবি দিয়ে লিখে ফেলেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

মুস্তাফিজ এর ছবি

হয়ে যাবে

...........................
Every Picture Tells a Story

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

বাহ। নতুন তোলা ছবি নাকি? এই এলাকায় গেলেই আপনার আর ফাহিমের সাথে ঘোরা আর ছবি তোলাতুলির সময়গুলার কথা মনে হয়।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

মুস্তাফিজ এর ছবি

নুতন। দুই সপ্তা ধরে হাঁটতেছি

...........................
Every Picture Tells a Story

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বহুকাল পর মুস্তাফিজ ভাই!
বছরে যদি এরকম ১টা করে ছাড়েন, আপনার সবগুলো ছবির গল্পের জন্য ২১০৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এবার থেকে মাসে একটা করে ছাড়েন হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

মুস্তাফিজ এর ছবি

হে হে হে

...........................
Every Picture Tells a Story

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আহা। ঘুমন্ত লেখকরা সচলে ফিরিতেছেন পুরানা তেজ নিয়া...

০২
লেখাটা বহুত ঘোরলাগা

মুস্তাফিজ এর ছবি

'ঘুম থেকে উঠে সচলে আসিয়াছেন' হবে। চোখ টিপি

...........................
Every Picture Tells a Story

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

ঘুম ভাঙা মানুষের গল্পে শুভেচ্ছা স্বাগতম!

মুস্তাফিজ এর ছবি

ধন্যবাদ আবদুল্লাহ

...........................
Every Picture Tells a Story

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।