দাদার মুখে শোনা গল্প ০৩ : সাক্ষী বৃষ্টির ফোঁটা

কীর্তিনাশা এর ছবি
লিখেছেন কীর্তিনাশা (তারিখ: শনি, ১৭/০১/২০০৯ - ১০:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক গাঁয়ে দুই কৃষক থাকতো - সিরাজ আর মিরাজ। এক খন্ড জমি নিয়ে দু’জনের মধ্যে চরম শত্রুতা । একদিন সিরাজকে নিজের এলাকায় পেয়ে লোকজন নিয়ে তাকে প্রচন্ড মারধর করে মিরাজ। সেই দিনই সিরাজ মনে মনে সংকল্প করে মিরাজকে সে খুন করবে।

তখন বর্ষাকাল। এক সন্ধ্যায় আকাশে মেঘ জমেছে প্রচুর। বৃষ্টি নামবে যে কোন সময়। এমনি অবস্থায় মিরাজ ফিরছিল বাজার থেকে একা একা জঙ্গলের পথ ধরে। সিরাজ সেই পথের ধারেই অপেক্ষা করছিল। মিরাজ আসতেই সে তার উপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে কাবু করে ফেলে। তারপর তার হাত পা বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় জঙ্গলের ভেতরে এক পরিত্যক্ত মন্দিরের উঠোনে।

মিরাজ তখন বাঁচার জন্য কাঁকুতি-মিনতি করছে। বার বার বলছে তাকে ছেড়ে দেবার জন্য। কিন্তু সিরাজের মন তাতে একটুও গলে না। প্রচন্ড ক্রোধে সে অন্ধ হয়ে গেছে। মিরাজ যখন দেখলো সিরাজ তাকে কিছুতেই ছাড়বে না তখন সে বলল - আমারে মাইরা তুই বাঁচতে পারবি না। তোরও একদিন শাস্তি হবে। এ কথা শুনে সিরাজ হা হা করে হাসে, বলে - ক্যামনে শাস্তি হবে? আমি তোরে মাইরা গুম কইরা ফালামু। কেউ এই ঘটনার সাক্ষী থাকবে না। তাইলে আমার শাস্তি ক্যামনে হবে?

আকাশ থেকে তখন বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। সন্ধ্যার আলো তখনো নিভে যায় নি পুরোপুরি। সেই আলোতে মন্দিরের উঠোনে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো পড়ে ছিটকে উঠছিল। সেদিকে তাকিয়ে মিরাজ বলে - ঐ বৃষ্টির ফোঁটাই আমার সাক্ষী। ও’ই একদিন আমার খুনের সাক্ষী দিবে। শুনে সিরাজ আবারো হেসে ওঠে হো হো হো করে।

একটু পরে সিরাজের হাতের ধারালো অস্ত্র ঝলসে ওঠে। মিরাজের রক্ত ধুয়ে যায় অঝোর বৃষ্টিতে। তারপর সিরাজ উঠোনের পাশের বহুদিনের অব্যবহৃত কুপের ভেতর ফেলে দেয় মিরাজের লাশ। আর কুপের মুখ ঢেকে দেয় এক খন্ড বড় পাথরের স্ল্যাব দিয়ে, যা কিনা ওটা ঢাকার কাজেই ব্যাবহার হতো আগে।

এর পর অনেক দিন চলে গেছে। মিরাজের কথা গাঁয়ের লোকজন ভুলে গেছে। যদিও সবাই সিরাজকে এ ব্যাপারে সন্দেহ করেছে, কিন্তু প্রমানের অভাবে কিছুই করতে পারেনি তারা। সিরাজ এখন বৃদ্ধ। মাঠে কাজ করতে যেতে পারে না। তার ছেলে সব কিছু দেখাশুনা করে। সিরাজের দিন কেটে যায় অলস ভাবে ঘরের দাওয়ায় বসে বসে।

একদিন গোধুলি লগ্নে বৃষ্টি নামলো। তখনো সিরাজ বসে ছিল ঘরের দাওয়ায়। উঠোনে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে ছিটকে উঠছিল। তা দেখে হঠাৎ সে হেসে উঠলো। তার ছেলের বউ একটু দূরে বসে বসে চাল ঝাড়ছিল। সে জিজ্ঞেস করলো - বাবা হাসেন ক্যান? তখন সিরাজ হেসে বলে - একজন মরার সময় এই বৃষ্টির ফোঁটারে সাক্ষী রাখছিল। তারপর আবেগের বশে সে তার ছেলেবউকে সব ঘটনা খুলে বলল।

পরের দিন নদীর ঘাটে পানি আনতে গিয়ে সে ঘটনা বউ তার সইকে বলল। সই আবার রাতে খেতে বসে ঘটনা তার স্বামীকে বলল। এভাবে এ’কান ও’কান করতে করতে ঘটনা পৌঁছালো মিরাজের ছেলেদের কানে। তারা সোজা থানায় গিয়ে মামলা ঠুকে দিল সিরাজের নামে।

দু’দিন পরে পুলিশ এসে সিরাজকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। জেরার মুখে সে ঘটনার সত্যতা স্বিকার করলো। এরপর মামলা কোর্টে উঠলো এবং সবশেষে সিরাজের ফাঁসি হলো।

এভাবেই সামান্য বৃষ্টির ফোঁটার কাছে সিরাজকে নতি স্বিকার করতে হলো। যে বৃষ্টির ফোঁটাকে মিরাজ সাক্ষী মেনেছিল তার মৃত্যুর আগে।

------------------------------------------------------
ছোট বেলায় খুব ভালো সময় কেটেছে আমার গ্রামে। প্রতি বার্ষিক পরীক্ষা শেষে গ্রামে যেতাম। সেখানে আমার অনেক আকর্ষনের একটা ছিল দাদার কাছে গল্প শোনা। গল্পের অফুরন্ত ভান্ডার ছিল তাঁর কাছে। সেসব গল্প থেকেই একটা তুলে দিচ্ছি এখানে। আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে। জানিনা এসব গল্পের উৎস কি (কে লিখেছেন বা কোথাকার কাহিনী)। যদি কেউ বলতে পাড়েন তবে উপকৃত হবো আমিও।


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

সেটাই। কৃতকর্মের শাস্তি পেতে হয়ই। সত্য চাপা থাকে না কখনোই। সিরিজটা খুব ভাল হচ্ছে। চালায়া যান।

কীর্তিনাশা এর ছবি

সহমত আপনার সাথে।

অসংখ্য ধন্যবাদ হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

এনকিদু এর ছবি

বেশ ভাল লাগল ।
আপনার দাদুর মত একটা দাদু পেলে ভাল হত । আমার নিজের দাদু মারা গিয়েছিলেন আমার শৈশবেই ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ এনকিদু!

আসলেই আমি খুব ভাগ্যবান ওরকম একজন দাদু পেয়েছিলাম।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অনেকদিন পর দাদার কথা মনে পড়লো।
আমার দাদা ছিলো একখান জিনিস ! দেঁতো হাসি
এই গল্পটা আমার কাছে নতুন।
ভালো লাগলো।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

কীর্তিনাশা এর ছবি

আমার দাদাও একখানা জিনিস আছিলো দেঁতো হাসি
পাঁচখানা করছিল বিবাহ (সেই কাহিনী বলবো আরেকদিন)

গল্প ভালো লেগেছে শুনে আমারো ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ। হাসি
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

রণদীপম বসু এর ছবি

হুঁ, চলুক...

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

কীর্তিনাশা এর ছবি

আইচ্ছা চলবো ......... হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নিবিড় এর ছবি

হুম...... আমিও বলি চলুক ।
*********************************************************
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

কীর্তিনাশা এর ছবি

হুম .... আমিও বলি চলবে ........ হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

একজন [অতিথি] এর ছবি

চমৎকার গল্প

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

অভ্রনীল এর ছবি

আপনার গল্পগুলি সবসময়ই ভালো লাগে... এইবারেরটাও ব্যতিক্রম না... এই সিরিজের গল্পদুটা আগে পড়া ছিলনা... খুঁজে খুঁজে পড়ে ফেললাম... সিরিজটা ধরে রাখেন... আমার নানা দাদার বলা গল্পগুলা এখন আর মনে পড়েনা...

_______________

এক ছাগলের দুই কান,
তুই আমার জানের জান।

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

দারুন উৎসাহিত হলাম।

ব্যাপার না, মনে করার চেষ্টা করুন, মনে পড়ে যাবে।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

কীর্তিনাশা এইবার নীতিবাক্য ধরলেন?

কীর্তিনাশা এর ছবি

হ গুরু ! সাধু, দরবেশ হওনের চেষ্টায় আছি দেঁতো হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মুস্তাফিজ এর ছবি

চমৎকার, ভাল লাগল ।

...........................
Every Picture Tells a Story

কীর্তিনাশা এর ছবি

ধন্যবাদ, মুস্তাফিজ ভাই ! হাসি
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ, একদিন সবাইকেই নিজের কর্মের ফল ভোগ করতে হবে।
ক্লু পাওয়া যাবেই।

/ছোট মানুষ

কীর্তিনাশা এর ছবি

তাই তো মনে হয় ! হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

দূর্দান্ত লাগল। চলুক।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

কীর্তিনাশা এর ছবি

থ্যাঙ্কু ! হাসি

ছিলেন কই এদ্দিন?

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

আরে, এই কাহিনী তো ছোটবেলায় আমিও শুনেছি। শুধু শিরোনামটা ছিলো "বুদবুদ তুমি সাক্ষী থাইকো"। বুদবুদ বলতে বৃষ্টির ফোঁটা পানিতে পড়লে ক্ষণিকের জন্য যে বুদবুদ সৃষ্টি হয় সেটা।

কীর্তিনাশা এর ছবি

গল্পটা সম্ভবত একটা সময়ে বেশ প্রচলিত ছিল গ্রামে গঞ্জে। হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

এই গল্পটা আমিও শুনেছিলাম বালকবেলায়, গ্রামবাসকালে। তবে যে কার মুখে শুনেছিলাম তা আজ আর মনে নেই।

কীর্তিনাশা এর ছবি

মনে না পড়লে নাই! গল্প শুনছেন এইটাই বড় কথা হাসি

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

সাইফুল আকবর খান এর ছবি

আমিও এই গল্প শুনছিলাম ছোটবেলায়। কীর্তিনাশার কাছে! চোখ টিপি

মজাদার হইছে। হাসি

০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০-০
"আমার চতুর্পাশে সবকিছু যায় আসে-
আমি শুধু তুষারিত গতিহীন ধারা!"

___________
সবকিছু নিয়ে এখন সত্যিই বেশ ত্রিধা'য় আছি

কীর্তিনাশা এর ছবি

হা হা হো হো হো

ধন্যবাদ !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।