আমি যখন পণ্ডিতমশাই…(২)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৩/০৯/২০১১ - ৮:২০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি যখন পণ্ডিতমশাই…(১)

আমার টিউশনি জীবনের শুরুর দিকে একটা ক্লাস সিক্সের ছেলেকে গুলশান-২ এ গিয়ে পড়াতাম। সেইরকম অভিজাত এক পরিবার! দারোয়ান, কেয়ারটেকার সহ আরো কয়েকজনের কাছে জবাবদিহিতা এবং কয়েক জায়গায় সাক্ষরদান ছাড়াও গার্জিয়ান ফোনে কনফার্ম করার পরেই কেবলমাত্র বাসায় প্রবেশের অনুমতি মিলতো। যাই হোক, সবই সয়ে নিয়েছিলাম কারণ মাস শেষের প্রাপ্তিটা বেশ খুশি করার মতোই ছিলো। আর তাছাড়া আমার টিউশনির বাজারটাতেও তখন বেশ মন্দা যাচ্ছিল। তো, টিউশনির শুরুতে বলা হয়েছিলো যে, সপ্তাহে চারদিন(সাধারণত তিনদিনের বেশি পড়ানো হয় না। কিন্তু ঐ যে বললাম, বাজারে মন্দা চলছিলো।) সন্ধ্যা ৭টা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত পড়াতে হবে। কিন্তু সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যজনক ভাবেই হোক, টিউশনির প্রথমদিন থেকেই আমার মহাব্যস্ত স্টুডেন্টের শিডিউল পাওয়াটা ‘লাম্বার ওয়ান ছাখিব কান’ এর শিডিউল পাওয়ার চেয়েও কঠিন কাজ হয়ে দেখা দিলো।

বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বুয়েটের সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় ওই দুইদিন নিয়মিতই যেতাম। আর বাকি দুইদিন ল্যাব, কুইজ ইত্যাদি বিবেচনায় শিফট হত। তো, শুক্রবারদিন আমার স্টুডেন্টের রুটিন ছিলো এরকম-ভোরে উঠে শারীরিক শিক্ষকের কাছে ব্যায়াম, তারপর নাস্তা; নাস্তার পর হুজুরের কাছে কোরআন-শিক্ষা, এরপর আমার কাছে অংক করা; তারপর আমার মতোই আরেকজন পার্টটাইম পণ্ডিতমশায়ের(ইনি ঢাকা ভার্সিটির ছিলেন) কাছে অন্যান্য বিষয়গুলো পড়া। এভাবেই দুপুর গড়িয়ে যেতো। তারপর বিকেল তিনটায় আবার স্পেশাল(!) কোচিং। সন্ধার পরে আবার বসতে হতো সারাদিনে নানান টিচারের কাছ থেকে প্রাপ্ত হোমওয়ার্কের সদগতি সাধনে!

ইংলিশ ভার্সন স্কুলের ছাত্র হলেও মূলতঃ ক্যাডেট ভর্তি পরীক্ষাকে সামনে রেখেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিলো। এর আগের বছরও ক্যান্ডিডেট ছিলো, কিন্তু চান্স পায় নি(মানে ক্লাস সিক্সে এটা ওর দ্বিতীয় বছর)। তাই এবার ভীষষণ সিরিয়াস! একদিন বিকেলবেলা আমাকে হটাৎ ফোন করে বললো, “ভাইয়া, আজ পড়বো না। আজ আমার আমার বার্থডে।” আমি বললাম, “বেশ।” মনে মনে বললাম, জন্মদিন ব্যাপারটা কেন বছরে একবার আসে? কেন প্রতি মাসে একবার করে আসে না? পরদিন ওকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এটা ছিলো ওর ১৪তম জন্মবার্ষিকী। মানে ১৪ পেরিয়ে ১৫ তে পদার্পণ।(মনে রাখবেন ও কিন্তু তখনো ক্লাস সিক্সে পড়ে! মনে আছে আমার ১৪তম জন্মবার্ষিকীর কয়েকদিন পরেই দশমশ্রেণীর ১ম সাময়িক পরীক্ষা দিয়েছিলাম।)

যাই হোক, এতোগুলো টিচারের এতরকম চাপে পড়ে ওর অসহায় অবস্থা দেখে আমার বেশ মায়াই লাগতো। তাই আমি আর ওর সেই চাপকে না বাড়িয়ে, যথাসম্ভব ইজি-ওয়ে তে হ্যান্ডেল করতে চেষ্টা করতাম। আর এটা নিয়ে আমাকে ওর মায়ের কাছ থেকে নানান অভিযোগও শুনতে হতো। আমি নাকি ওকে ভালো করে চাপ দিচ্ছি না, বেশি করে হোমওয়ার্ক দিচ্ছি না, ফাঁকিবাজির জন্য বকা দিচ্ছি না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবু এতকিছুর পরেও আজ ওর কথা বলতে পারছি এই জন্যেই যে, ও আমাকে হতাশ করে নি। অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে স্থান করে নিয়েছে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ।

তবুও, ও কি কোনোদিন এই গঁতবাধা শৈশবের জন্য নিজেকে বঞ্চিত ভেবে আক্ষেপ করবে না???

এদিকে, একটা কঠিন এবং নিরস টিউশনির গল্প দিয়েই এই লেখা শেষ করলে আমার কিন্তু আক্ষেপ হবে, আর পাঠকও বঞ্চিত হবে। তাই আমার পার্টটাইম পণ্ডিতমশাই হওয়ার আগের একটি ঘটনা বলেই এই লেখার ইতি টানতে চাই…

গণিত উৎসবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে আহবান জানিয়েছিলেন, তিন ‘ম’ কে না বলার জন্য। আর এই তিন ‘ম’ হচ্ছে মিথ্যা, মাদক ও মুখস্থ। আর এজন্য আমিও আমার ছাত্র-ছাত্রীদের সবসময় মুখস্থ না করে বুঝে পড়ার জন্য বলি। ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে স্কুলে থাকতে(বাড়িতে থাকতে) জ্যাঠাতো-কাকাতো ভাইবোনগুলোকে পড়ানোর দায়িত্বটা সবসময় আমার কাঁধেই বর্তাতো। তো, আমার সদ্য ক্লাস সেভেনে উঠা কাকাতো বোনকে ধর্মশিক্ষা পড়াচ্ছিলাম। তো ওকে “ঈশ্বরের স্বরূপ বর্ণনা কর।” শীর্ষক প্রশ্নের জন্য পাঠ্যবই থেকে একটা প্যারা ভালো করে পড়তে এবং তারপর নিজের মতো করে গুছিয়ে লিখতে বললাম। কিছুক্ষণ পর ও আমাকে যেটা লিখে এনে দেখালো তার শুরুটা এরকম, “ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। তিনিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। ঈশ্বর অনেক। কিন্তু তাঁর শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন…….........”

তো, আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে, ঈশ্বর অনেক পাইলি কই?!”

সাথে সাথে ওর জবাব, “বারে, তুমি যে বললে নিজের মতো লিখতে। এক লিখলে তো বলতে সব বই দেখে লিখছি...............”

--বাংলামায়ের ছেলে


মন্তব্য

কল্যাণF এর ছবি

চলুক

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

ধন্যবাদ।

তারেক অণু এর ছবি

দেঁতো হাসি হাঁ ঈশ্বর গড়াগড়ি দিয়া হাসি

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

হো হো হো হাঁ ভগবান গড়াগড়ি দিয়া হাসি খাইছে

কর্ণজয় এর ছবি

ঈশ্বর মুচকী হাসলেন...

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

আমি কিন্তু অট্টহাসিই হেসেছিলুম...হো হো হো

আশফাক আহমেদ এর ছবি

আরেকটু আশা নিয়ে বসেছিলাম। সিরিজ চলুক চলুক

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

তৃতীয় পর্বে ভিন্নস্বাদের কিছুই দিতে চাচ্ছি।

আশা করি আপনার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবো।

সাথেই আছেন তো?

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বাহ, আপনার লেখনী তো খুব সাবলীল! আপনার কাছে পাঠকের প্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেল, সেটি কি বুঝেছেন?

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

জ্বী আজ্ঞে, কিঞ্চিত টের পাচ্ছি বোধ হয়।

আশা করি...প্রত্যাশার এই পারদকে সবসময়ই উর্ধ্বমুখীই রাখতে পারবো...

আপনাকে আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

উচ্ছলা এর ছবি

আপনি অনেক মজা করে লিখতে পারেন হাসি

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

তাই!
মজা লেগেছে শুনে ভালো লাগলো।

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
সাথে থাকা হোক। ভালো থাকা হোক।

জ.ই মানিক এর ছবি

ভবিষ্যত্‍ প্রস্তুতি যুদ্ধে অকালে হারায় শৈশব আজকাল।

আহ্ ঈশ্বর! হাসি

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

কচিদেহ নুয়ে পড়ে
জ্ঞানবোঝা ভারে।
ছোট কাধেঁ এতো চাপ
সইতে না পারে।।

ওরা জানে না দুরন্ত শৈশবের মানে কি...

আহ্ ঈশ্বর! মন খারাপ

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

হায় ঈশ্বর! মজা পেলাম পড়ে হাসি

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

মজা দিতে পারলুম জেনে আমারো বেশ ভালো লাগছে...
আশা করি আগামী পর্বে আরো অনেক মজা দিতে পারবো।

ধন্যবাদ। সাথে থাকা হোক। ভালো থাকা হোক।

বন্দনা কবীর এর ছবি

আজকালকার বাচ্চাগুলোর জন্য খুব মায়া হয়। পড়া কোচিং আর এক্ট্রা কারিকুরাম সর্বোপরি বাবা-মায়ের উচ্চ চাহিদার ভিড়ে বেচারা শৈশবটাকেই হারিয়ে ফেলে। আহা !

সুন্দর আর সাবলিল লেখা। চলুক...

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

সহমত।

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।

সাথেই থাকুন। আগামী পর্বের লেখা শেষ করলাম এই মাত্র।

এবার একটু ভিন্নস্বাদ দিতে চাই...

বন্দনা এর ছবি

আজকালকার বাচ্চাকাচ্চাগুলার জন্য কষ্ট হয় খুব, আমাদের সময় আমাদের অনেক স্পেস ছিলো, এত বাধাধরা লাইফ ছিলোনা। লিখা ভালো হচ্ছে। হাসি

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

হুমম...ঠিক তাই। আমি যখন আমার শৈশবের কথা চিন্তা করি আর ওদের কে দেখি তখন অজান্তেই আফসোস ঝরে পড়ে, "হায়! ওরা কতই আনলাকি!!"

ভালো হচ্ছে?
শুনে ভালো লাগলো।
অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
ধন্যবাদ। ভালো থাকা হোক।

দিহান এর ছবি

আমাদে বাবা-মা রা কবে বড় হবে? ১৪ তে ক্লাস সিক্স? গ্রাজুয়েশন শেষ করতে করতেই তো জীবন শেষ!

ইদানীং পৃথিবী অনুভব করে, একটা সূর্যে চলছেনা আর
এতো পাপ, অন্ধকার
ডজনখানেক সূর্য দরকার।

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

নটরডেমে একসময় ভর্তির যোগ্যতা হিসেবে বয়স বেশি হওয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া হতো।(এখনও তাই হয় কিনা নিশ্চিত নই।) আমার বয়স অন্যদের তুলনায় এতই কম ছিলো যে, অনেকসময় দেখা যেত একাডেমিক্যালি আমার জুনিয়ররাও বয়সে আমার চেয়ে দুই-তিন বছরের বড়।

ভাবুনএকবার ব্যাপারটা কিরকম বিব্রতকর ছিলো...

সুমন তুরহান এর ছবি

আপনি কিন্তু বেশ মজা করে লিখতে পারেন। নিয়মিত লেখা চাই। হাসি

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

বাংলামায়ের ছেলে এর ছবি

ধন্যবাদ।

ক্লাস, সেশনাল, C.T. আর টিউশনির ফাঁকে যেটুকু সময় পাই............তার মধ্য থেকেই ব্লগ পড়া আর লেখার সময় বের করতে হয়.........তবু চেষ্টা করবো নিয়মিত থাকার...

ভালো থাকা হোক।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।