কথাকলি। ১০। ভাঙারি পার্টি

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: সোম, ২৪/১০/২০১১ - ১২:৩২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রতীক্ষা নাটকে হড়বড় করে সাকুল্যে দুইটা ডায়লগ দিয়ে জীবনে একবার মাত্র মঞ্চে ঢোকার অভিজ্ঞতা নিয়ে ব্যারিকেড চারিদিক নাটকে বেশ বড়ো একটা চরিত্র পেয়ে গেলাম। ‘ব্যারিকেড চারদিক’ হাবিবুল ইসলাম হাবিবের লেখা পথনাটক। নির্দেশনা দিচ্ছেন আক্তার ভাই। জেলবন্দী তিন বামপন্থী ছাত্রনেতার একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র; তার প্রেমিকা-টেমিকা আছে ক্যাম্পাসে; সেই চরিত্রটা মারুফের। তার সাথে দুইজন পাতি নেতা; একজন দেয়ালে চিকা মারার সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ায় তার ক্ষ্যাপাটে বাবা থানায় গিয়ে পুলিশরে উল্টা ঝাড়ি দেয়- কাগজপত্রের যা দাম তাতে পোলাপান দেয়ালে লিখব না তো তোর বাপের কপালে লিখব হালার পো?... এই চরিত্রটা তুহিন ভাইয়ের। আর আরেক পাতি নেতা যার ঘরে খাবার নাই; সেই চরিত্রটা আমার...

বেশ বড়ো চরিত্র। নাকমুখ খিঁচে আমি ডায়লগ মুখস্থ করি। মারুফ ডায়লগের সাথে কী কী যেন ক্যারিকেচার করে। তুহিন ভাইও দুয়েকটা ঘুরুন্টি টুরুন্টি দেয় মঞ্চে। কিন্তু ডায়লগের বাইরে ক্যারিকেচার করতে আমার কেমন যেন লাগে; তাই আমি শক্ত হয়ে থাকি। আক্তার ভাই কয়েকবার কয়েকটা ক্যারিকেচার দেখিয়েও কিছু করতে না পেরে আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি ওভাবেই করতে থাকি...

নাটক হবে স্বাধীনতা দিবসে উন্মুক্ত মঞ্চে। প্রথম মঞ্চায়ন চারাদিঘির পাড়। আমাদের কস্টিউম জেলের পোশাক। খোলা জায়গায় মানিব্যাগ রাখার কোনো জায়গা নেই; আবার যারে তারে দেয়াও যায় না হাতানোর ভয়ে। শেষমেশ বদরুল ভাইকেই সবচে বিশ্বস্ত মনে হলো। তিনি অভিনয় করছেন না। তার কাছেই মানিব্যাগটা দিলাম। কিন্তু নাটক শেষ করে দেখি বদরুল ভাই নেই। আমার বাড়ি শহর থেকে আঠারো কিলোমিটার দূরে শুক্রবারিবাজার। সিলেট শহর থেকে ওদিককার শেষ বাসটা ছেড়ে যায় সন্ধ্যা সাতটায়। রিহার্সেল শেষ করে প্রায় দিনই আমাকে বন্দরবাজার এসে সিলেট থেকে জাফলং যাওয়া ট্রাকের পেছনে উঠে বাড়ি ফিরতে হয়। মাঝে মাঝে একটা দুইটা বেবিটেক্সি পেলেও সাত টাকার ভাড়া বিশ-ত্রিশ টাকা চায়। যত দেরি হয় বাড়িফেরা তত ঝামেলা হয়। মাঝে মাঝে সোজা হাঁটতে হয় আঠারো কিলো পথ। কিন্তু বদরুল ভাই কোথায়?

রাত প্রায় নয়টা। শেরো ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই একটা ত্যাড়া হাসি দিলেন- তোমার কি ধারণা বদরুল তোমার মানিব্যাগ পাহারা দেবার জন্য বসে আছে? দেখো গিয়ে নাটক শুরু হবার সাথে সাথেই সে অমুকের বাসায় চলে গেছে....

বদরুল ভাই একজন বান্ধবী-সুহৃদ মানুষ। দুনিয়া ঘোরে একদিকে আর তার বান্ধবীকে নিয়ে তিনি ঘোরেন অন্যদিকে। বান্ধবীর ছোট বোন একবার তাকে বলেছিল ভিসিপি দেখানোর কথা। তিনি পাড়ার ভিসিপি দোকানে গিয়ে সোজা আদেশ দিয়েছিলেন ওই বাসায় একটা ভিসিপি পাঠিয়ে দিতে আর যত লাগে তত ক্যাসেট দিতে। পরে শুনেছিলাম ভিসিপি আর ক্যাসেটের যা ভাড়া তিনি দিয়েছিলেন তাতে নতুন দুইটা ভিসিপি সেট কিনতে পাওয়া যায়...

আমাকে বেক্কলের মতো বসে থাকতে দেখে শেরো ভাই পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট হাতে ধরিয়ে দিলেন- ওর অপেক্ষা করে লাভ নেই। বাড়ি যাও...

মানিব্যাগের মধ্যে সাতশো সত্তুর টাকা। তখন আমার শহরে যাওয়া আসার দৈনিক বাজেট সর্বোচ্চ দশ টাকা। সকালে বাসে তিন টাকা হাফ ভাড়া দিয়ে কলেজে নামি। বিকেলবেলা কলেজের বাসে করে চলে যাই রিকাবিবাজার। সেখান থেকে রিহার্সেলে। আবার শেষ করে সোজা হেঁটে বন্দরবাজার এসে বাস-ট্রাক খুঁজি। বাস পেলে ভাড়া নেয় ছয় টাকা আর টেম্পু হলে সাত টাকা। ট্রাকে চড়লে মাঝে মাঝে টাকা নেয় না। যেদিন বাজেট থেকে টাকা বেঁচে যায় পরেরদিন তা যোগ হয় খাবারের বাজেটে; আর না হলে সারাদিনের খাবার কিংবা বিড়ি পুরোটাই চলে এরে-তারে ভাঙিয়ে। কোনোদিন কাউরে ভাঙাতে না পারলে সরাসরি খাদ্য ও বিড়ি সন্ন্যাস...

কিন্তু পরের বহুদিন বদরুল ভাইর কোনো সন্ধান নেই। প্রায় একমাস পরে একদিন হৈ হৈ করে আমার দিকে তেড়ে এলো- এই তোর মানিব্যাগটা আমার কাছে। ধর... ওখান থেকে কিছু খুচরা টাকা আমি খরচ করে ফেলেছি...

মানিব্যাগ খুলে দেখি সামনের পকেটে রাখা খুচরা টাকাগুলো আছে কিন্তু ভেতরের পকেটের সাতশো টাকা হাওয়া। আমি হা করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার সত্তুর দিনের বাজেট তার কাছে খুচরা টাকা?....

কইলজাটা জ্বলে গেলেও মুখে বললাম- সমস্যা নেই। কারণ শুধু বান্ধবী নয়; আমাদের জন্যও বদরুল ভাই অনেক উদার। পেটচুক্তি খাওয়াতো মামুলি বিষয়; গ্র“পের রিহার্সেল রুমে ফ্যান লাগানো কিংবা স্টিলের আলমারি কেনার জন্য এক সদস্যবিশিষ্ট ক্রয় কমিটির প্রধানও সব সময় বদরুল ভাই। তার দায়িত্ব থাকতো সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে গ্র“পের জিনিসপত্র কেনা। তিনি প্রথম দিন একটা লিস্টি করে এর তার কাছে যেতেন- তোমার চাঁদা অত টাকা...
- বদরুল ভাই। অমুক দিন দেই?

সেই অমুক দিন আর আসে না। অবশেষে সকলের সামনেই লিস্টিটা ছিঁড়ে ফেলতেন বদরুল ভাই। এবং তার পরের দিনই দেখা যেত রিহার্সেল রুমে ফ্যান ঘুরছে কিংবা একটা চকচকে স্টিলের আলমারি ঘরের কোনায়। কিংবা ধরেন আমরা নাটক করতে ঢাকা যাব। ঠিক করা বাসটাতে আমরা সবাই যখন উঠে বসেছি তখন হঠাৎ দেখা গেলো প্রান্তিক চত্বরে আরেকটা বাস এসে ঢুকছে- আরেকটা বাস কেন?

ওটা কিছু না। বদরুল ভাইর বাড়ি বিশ্বনাথ। সকাল বেলা সেখান থেকে গ্র“পে আসার কোনো গাড়ি পায়নি তাই একা পুরা একটা বাস রিজার্ভ করে নিয়ে চলে এসছে। কিন্তু এসে দেখে ব্রিফকেসের ভেতর টাকা পয়সা রেখে চাবিটাও ভেতরে ঢুকিয়ে তালা মেরে দিয়েছে। বাসের ড্রাইভার তাকে চেনে বলে পরে টাকা নেবার শর্তে তাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। কিন্তু ঢাকা যাওয়া পর্যন্ত বদরুল ভাইর হাত খরচ চলবে কেমনে? বদরুল ভাইতো আবার পান খায়...

বদরুল ভাই এসে কানে কানে বলল- তোর কাছে টাকা আছে?
- কেন?
- তুই আমার রাস্তার খরচ দিস। ঢাকা গিয়ে ব্রিফকেসের তালা খুলে তোর টাকা দিয়ে দেবো
- সুদ দিতে হবে কিন্তু
- আচ্ছা নিস

রাস্তায় গাড়ি থামে। আমরা নাস্তা করি। বিল তিন-চারগুণ করে লিখে রাখি বদরুল ভাইর নামে। এক টাকা দিয়ে বদরুল ভাইকে একটা পান কিনে দেই; বিল ধরি বিশ টাকা... অর্ধেক রাস্তায় আমার পাওনা পঁচশো টাকা ছাড়িয়ে গেলে বদরুল ভাই টাকা ধার করা শুরু করে দুলুদার কাছ থেকে। দুলুদার উৎসাহ অফুরন্ত। সে জোর করে বদরুল ভাইকে পান খাওয়ায়; চানাচুর খাওয়ায়; আর ঢাকায় হোটেলে পৌঁছেই এক মিস্ত্রি এনে বদরুল ভাইর ব্রিফকেস খুলে মোট দেড় হাজার টাকা বিল নিয়ে যায় কিন্তু আমার পাওনা চাইতে গেলে ঝাড়িঝুড়ি মেরে আমাকে ধরিয়ে দেয় মাত্র বিশ টাকার একটা নোট...

আমি ভাবছিলাম এই চান্সে আমার সাতশো টাকা তুলে নেবো। কিন্তু দুলুদার মতো কচ্ছপ মাঝখানে পড়ে যাওয়ায় এখন আর কোনোভাবেই তা সম্ভব না। তখন আমি সুফি চর্চা করতাম; বিশ্বাস করতাম একধ্যানে কাউরে অভিশাপ দিলে তা ফলবেই ফলবে। আমি সোজা বাথরুমে ঢুকে ধ্যানে বসি- হালা বদরুল। আমার টাকা মেরে খাওয়ার পাপে অমুক মেয়ে তোর তালুতে পেশাব করে আরেক বেটারে বিয়া করবে দেখিস...

২০১১.১০.২৩ রোববার

কথাকলি। ০৯। শ্যামপিরিতি
কথাকলি। ০৮। রাবারের চাপা
কথাকলি।০৭। বিট এন্ড হিট
কথাকলি।০৬। আমি একটা দল
কথাকলি।০৫। অচেনা সেতার
কথাকলি।০৪। কী যেন ডাকে
কথাকলি।০৩। বাঙালের বাংলা শিক্ষা
কথাকলি।০২। এ্যানার্জি পয়েন্ট
কথাকলি।০১। প্রেমিক পাগল আর কবি


মন্তব্য

বন্দনা কবীর এর ছবি

আমি সোজা বাথরুমে ঢুকে ধ্যানে বদি- হালা বদরুল। আমার টাকা মেরে খাওয়ার পাপে অমুক মেয়ে তোর তালুতে পেশাব করে আরেক বেটারে বিয়া করবে দেখিস

গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার বাথরুমীয় অভিশাপ কিন্তু বিফল হতো না

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

কথাকলি কখনো না ফুরাক। এইটা এক হাজারটা জীবনের গল্প...

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ফুরাবে না। কথাকলির গল্প বলে কুলাতে পারি কি না সেটা ভাবছি

০২

আর কথাকলির গল্পটা একই সাথে আমারও একটু একটু করে হাঁটতে শেখার গল্প

 তাপস শর্মা  এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি গড়াগড়ি দিয়া হাসি
খাইছে। লীলেন ভাই। ঐ মহামান্য বদরুল ভাই থেইকা কি রেহাই পাইছেন ?

মাহবুব লীলেন এর ছবি

টাকা দেয়নি। কিন্তু খেয়ে উসুল করে নিয়েছি

তারেক অণু এর ছবি
মাহবুব লীলেন এর ছবি

নীলকান্ত এর ছবি

হো হো হো মজা পাইছি।


অলস সময়

যুমার এর ছবি

গড়াগড়ি দিয়া হাসি

জোবায়ের এর ছবি

উত্তম জাঝা!

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

হালা বদরুল .......................

হো হো হো

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

তানিম এহসান এর ছবি

দারুন মজা পেলাম হাসি .... আপনার ’অ-দন্ডী’র মত চোয়াল শক্ত হয়ে যায় এমন লেখার অপেক্ষায় থাকি! ভালো থাকবেন লীলেন ভাই, জয়তু!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ঘাড় শক্ত হওয়া রোগের নাম জানি ঘোড়ারোগ। কিন্তু চোয়াল-শক্ত রোগের নাম কী?

তানিম এহসান এর ছবি

চোয়াল শক্ত হলে ‘নীরোগ’ হয় লীলেন ভাই হাসি ধন্যবাদ।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

গুরু গুরু গুরু গুরু মনে হল আমি সাগরে নামছি। প্রতি মুহুর্তে বিষ্ময়, আনন্দ আর আরো কিছুর আকাঙ্ক্ষা। প্রথমে পড়লাম কথাকলি-১০। তারপর বাকিগুলো এক লহমায় পড়ে ফেললাম। দারুন। আপনি কোথায় ছিলেন এতদিন? এতোদিন কেন আমি পড়িনি? মন খারাপ দুঃখ লাগছে এত দেরিতে পড়ার জন্য। আগামি পর্ব এর জন্য হাত পেতে দাড়িঁইয়ে থাকলাম।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ওরে বাপরে। তবে সাগরে সাঁতরানো সহজ হলেও কিন্তু মাঝে মাঝে মুখে লোনাপানি ঢুকে যেতে পারে ভাইজান...

আর আমি আর কোথায় থাকব?
চিপায়চুপায় আছি। মাঝে মাঝে সাহস করে উঁকি দেই আর কি

বন্দনা এর ছবি

লীলেনদা বাথরুমীয় অভিশাপটা সম্পর্কে যদি একটু ডিটেইল বলতেন, একবার চেষ্টা করে দেখতাম এপ্লাই করন যাই কিনা।

কল্যাণF এর ছবি

খিক খিক খিক খিক খিক খিক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।