বাংলাদশ কি ধনীদের দেশে পরিণত হচ্ছে !

রণদীপম বসু এর ছবি
লিখেছেন রণদীপম বসু (তারিখ: শুক্র, ১১/০৭/২০০৮ - ৩:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চলতে চলতে হঠাৎ করেই সামনেরটিকে ধাক্কা মেরে বসলো আমাদের রিক্সাটা। যাত্রীর গুঞ্জন ছাপিয়ে সামনের চালক খেঁকিয়ে ওঠলো- অই হালার পো, আন্ধা নি ? চউক্ষে দেহছ না ?
রীতিমতো মারমুখি ব্যাপার। অথচ প্রতি উত্তর শুনে আমাদের চালকটিকে বেশ রসিকই মনে হলো- আবে হালায় ডাকাইত নি ! তুই এহনো চউক্ষে আন্ধাইর দেহস নাই ! হালায় জমিদারের নাতি হইছ তো রিক্সা ঠাপাইতে আইছস কেন্ বে ?
দূর হালার পো হালা। বলেই আগের চালক সামনে চলতে শুরু করলো। হয়তো আরো কিছুটা বাগড়াবাগড়ি চলতো। কিন্তু রাস্তার জ্যাম মুক্ত হওয়ায় যে যার পথে ছুটলো আবার।

ঢাকার রিক্সায় চড়েছেন অথচ রিক্সায় রিক্সায় ঠেলাগুঁতো বা চালকদের মধ্যে ঝক্কিফ্যাসাদ দেখেন নি এমন কেউ কি আছেন ? আমার জন্যে তো তা নিত্য নৈমিত্তিক অভিজ্ঞতাই। কিন্তু আজকের বিষয়টাকে কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম বা আনকোড়াই মনে হলো। কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে চালককে জিজ্ঞেস করলাম, বাড়ি কই আপনার ?
জী, আছিলো তো বরিশাল।
বরিশালের লোকেরা মনে হয় রসিক হয় খুব, তাই না ?
রস দেখলেন কই স্যার ! আমাগো জান বাইরয়, আর আপনে দেখতে আছেন রস ?
কেন, আপনাদের কথা চালাচালি শুনে আমার তো তাই মনে হলো !
ঘর্মাক্ত সচল শরীর দুমড়ে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পেলাম যেনো। হঠাৎ তাঁর কথার মধ্যে কটাক্ষের ছোঁয়া পাচ্ছি। হ, গরীবের কি আর ভাত খাওনের জোগার রাখছেন আপনেরা ? কথা দিয়াই তো আমাগোরে পেট ভরতে অয়।
হুম, ঠিকই বলেছেন। গরীবের বাঁচার আর কোন রাস্তাই নাই।
ফজরে ঘুম তনে উইঠ্যা দোকানে যাইয়া হুনি চাইলের দাম আবার বাড়ছে। কাইল আপনেগো উপদেষ্টা সাবে কী জানি কইছে রাইত, সকাইল্যা বেলাই সয়াবিনের দাম বাইড়া গেছে পনরো টেকা। আরে হালার দোকানে তেলই নাই। রাইতের বেলাই ফিনিশ ! সব মাগীর পুতেরাই এক রকম। গরীব হালার পুত হালায় একটায়ও বাঁচবো না আর। সব হালারা মরবো।...
কথা তো না, যেনো মাংস পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে ! আগের রাতে আমাদের অর্থ উপদেষ্টা মহোদয় সংবাদকর্মীদের কাছে ‘এটা শায়েস্তা খাঁ’র আমল না, দ্রব্যমূল্য কমার কোন সম্ভাবনা নেই ; এখানে সরকারেরও কিচ্ছু করার নেই’ বলে যে ঐতিহাসিক বাণী ছেড়েছেন, এর কয়েক ঘণ্টা পরই অস্থির বাজার পরিস্থিতি আর খেটে খাওয়া দিনজীবী মানুষগুলোর বেঁচে থাকার নাভিশ্বাস অবস্থার অতি ক্ষুদ্র এক টুকরো প্রতিফলন ভাসছে এই রিক্সাচালকের উক্তিতে।
আগে রিস্কার মালিককে আধা বেলায় দিতে হইতো পঞ্চাশ টেকা। এখন দিতে অয় নব্বই টেকা। বস্তির ভাড়া বাড়াইছে পাসশো টেকা। আপনেরা তো স্যার ভাড়া দুই টেকা বেশি চাইলেই সোজা হাঁটা শুরু কইরা দেন !
আমি বললাম, দেখেন ভাই, আপনার জন্য যেমন সব বাড়ছে, আমার জন্যেও তো বাড়ছে সব। ছোটখাট চাকরি করি। সব কিছুর দামই সরকার ক’দিন পর পর বাড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের বেতন তো একটাকাও বাড়ায় নাই ! আমি কার কাছে বলবো এসব ? আমার জন্যে তো রিক্সা চড়াটাই এখন বিলাসিতা !
তয় আমরা যামু কই ? দেইখেন গরীব হালার পুত হালারা একটাও বাচবো না ! মইরা সাফ হইয়া যাইবো সব।

কথোপকথনের সংবেদনশীলতায় পারতপক্ষে খুব একটা যেতে চাই না আমি। মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক যন্ত্রণাকে ঘাটানো বিপজ্জনকও। কষ্টের আগ্নেয়গিরিতে খোঁচা খেলে মানুষের আবেগ অস্থির হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রেই কোন বাধা মানে না আর। কিন্তু দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক পরিস্থিতিতে সব কিছুই যেভাবে উদ্ভটতায় আক্রান্ত হচ্ছে, তাতে করে সবাই নিজ নিজ ভবিষ্যৎ নিয়ে যে অনিশ্চয়তা আর অস্থিরতায় ভুগছে, সব কিছুই একাকার হয়ে কেমন একটা গুবলেট অবস্থায় দাঁড়াচ্ছে যেনো। তাই আমাদের কথোপকথনের পরিবেশটাকে সিরিয়াসনেস থেকে ঘুরিয়ে হালকা করার জন্য হঠাৎ করেই কৌতুকের আশ্রয় নিলাম। আমাকে বহনকারী রিক্সার চালকের শেষ উক্তির রেশ ধরেই বললাম- আপনি ঠিক বলছেন তো, গরীব সব মরে সাফ হয়ে যাবে ?
হ, গরীবের গুয়ায় যেই বাঁশ ঢুকাইবার লাগছেন, এক হালায়ও কি বাঁচবো আর ? সব শেষ।
তাহলে তো আমাদের এই দেশের জন্য বিশাল সুখবর এটা !
কোন প্রত্যোত্তর না পেলেও আমার এমন কথায় তাঁর জেগে ওঠা কৌতুহল টের পেলাম ঠিকই। আমি বলে চললাম, আপনার কোন আত্মীয় বা পরিচিত কেউ বিদেশে থাকে ?
আত্মীয় নাই। তয় পরিচিত আছে অনেকেই।
দেশের বাইরে বিদেশে বাংলাদেশের পরিচয় কী রকম, আপনি জানেন ?
মাথা নেড়ে তার অজ্ঞানতা প্রকাশ করলো।
বিদেশে বাংলাদেশের পরিচয় হচ্ছে ফকির মিসকিনের দেশ, এইটা তো শুনেছেন ?
হ।
এই সুযোগে আপনার কথা অনুযায়ী যদি দেশের সব গরীব মইরা যায়, তাইলে বাঁইচা থাকবে কারা, বলেন তো ?
বড়লোকেরা !
হ্যাঁ, তখন কেবল ধনীরাই থাকবে বাংলাদেশে ! কোন গরীব নাই ! বিশ্বে আর একটা দেশও কি পাবেন যেখানে কোন গরীব নাই ? তাহলে তখন বাংলাদেশের পরিচয় কি আর ফকির মিসকিনের হবে ? এটা তখন ধনীর দেশ হয়ে যাবে !
হ, ঠিকই কইছেন।
তাহলে সরকার কেন এই সুযোগ হাতছাড়া করবে ? কোন সরকার যা পারে নাই, এই সরকার তা করে দেখিয়ে দেবে ! বাংলাদেশ ধনীদের দেশ ! অতএব যত তারাতারি মইরা যাইতে পারেন ততই দেশের জন্য মঙ্গল। যারা এইটা বুইঝাও এখনো মরতেছে না, তাগরে মারনের একটা বুদ্ধি বের করতে হবে না !
তার সম্মতিসূচক মাথা নাড়ানো দেখেই বুঝলাম কথাটা বোধ হয় বেচারার মনে ধরেছে।

বাসার সামনে এসে ভাড়া দু’টাকা বাড়তি দিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললাম, আমার কথায় কিছু মনে করবেন না ভাই। আপনার কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু আমাদের কষ্ট কেউ বুঝে না।
ভাড়া গুনে হঠাৎ বাড়তি টাকা দুটো ফেরৎ বাড়িয়ে বললো, নেন স্যার। এই টাকা নিমু না আমি।
কেন ?
আপনিও আমাগোর মতোই।
আমি ফেল ফেল করে চেয়ে রইলাম। দেশটা যদি সত্যি সত্যি ধনীদের হয়ে যায়, এই সহানুভূতিটুকু কি থাকবে তখন ?
(১১/০৭/২০০৮)


মন্তব্য

রণদীপম বসু এর ছবি

অজান্তের ভুলে বাংলাদেশ শব্দটি বাংলাদশ হয়ে গেছে। অনিচ্ছাকৃত ভুলটির জন্য দুঃখিত। পড়ার সময় নিজগুণে সবাই শুদ্ধভাবেই পড়বেন আশা করছি।
ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

আলমগীর এর ছবি

আপনি আমি সবাই গরীব হলে ধনীটা কে?

মুশফিকা মুমু এর ছবি

মন খারাপ
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

রেনেট এর ছবি

বাংলাদেশের এই অবস্থা একদিনে হয়নি। সমাধান ও একদিনে হবে না।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা সবকিছু নগদে পেতে চাই। পরিকল্পনার অভাব আজ আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছে...আমরা অগ্রসর হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু পিছনের দিকে।
-----------------------------------------------------
We cannot change the cards we are dealt, just how we play the hand.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

মনজুরাউল এর ছবি

মনজুরাউল
দেশটাও ধনীদের হয়ে যাচেছ না, আপনি-আমিও গরিব হয়ে যাচ্ছি না ।সহানুভূতিও নেই হয়ে যাচ্ছে না । শেণী বৈষম্যের এই সমাজে শেণী শোষণ থাকছেই । অতএব সহানুভূতি দেখানোর যায়গার অভাব হবে না ।
.....................................................................................
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি..........

.......................................................................................
আমাদের মাতৃগর্ভগুলি এই নষ্ট দেশে
চারদিকের নিষেধ আর কাঁটাতারের ভিতর
তবু প্রতিদিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতার জানা
হাজার শিশুর জন্ম দেয় যারা মানুষ......

দুর্দান্ত এর ছবি

সরকারের উচিত এক ব্যাক্তির একাধিক রিক্সা, সি এন জির মালিকানাকে অবৈধ করা ও বড় শহরের সব ধরনের বাস/টেম্পোকে শুধু পাবলিক লিমিটেডের মাধমে পরিচালনা করতে দেয়া; সবচেয়ে ভাল হয় যদি দু'তিন বছরের মধ্যে মানুষে টানা সব পরিবহন ও অবৈধ করে দেয়া যায়।

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

দুইবার পড়লাম লেখাটি।
কি যে বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা।
মাঝে মাঝে মনেহয় সরকারের সব গুলাকে ধইরা রিক্সাঅলা বানায় দেই। বুঝুক ঠ্যালা।

--------------------------------------------------------

সবজান্তা এর ছবি

সুপ্রিয় রণদীপম বসু, আপনার লেখার জন্য জাঝা।

কিছু কিছু লেখা একদম চাবুকের মত গায়ে এসে পড়ে, আপনার এই আপাত নিরীহ লেখার মধ্যে সেই ধারটা ছিলো।

আমি এখনো বেশ তরুণ, বাপের হোটেলে খাই। তাই ঠিক টের পাই না, কিভাবে সংসার চলে। তবে হয়ত আর বছরখানেকের মধ্যেই এসব নিয়ে আমাকেও ভাবতে হবে, হয়ত একই সুরে গাইতে হবে আমাকেও।

সরকার নিয়ে কিছু বলার নাই, এর চেয়ে বাসার সামনের সোয়ারেজ লাইনে যেই মল ভেসে যায়, তাকে নিয়ে কথা বলাটাও আরামদায়ক।


অলমিতি বিস্তারেণ

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

হুমম...

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দেশের কথা বলতে পারবো না... আমি যে গরীব থেকে ক্রমশ গরীব হচ্ছি তা বেশ ভালো করেই জানি।
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বাংলাদেশ তো ধনীদের দেশই
এই দেশ আপনি গরিব পাইলেন কই?

মুশফিকা মুমু এর ছবি

০১ লীলেন ভাই আপনার এই cool ছবি দেখে বুঝতে পারছিনা আপনি ধনী না গরিব

০২ আপনি ধনী না গরিব?
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এই লেখাটায় ভালো এবং খারাপ দুটোই একসঙ্গে পাওয়া গেলো। খুব চমৎকার একটা লেখা। কিন্তু পড়ে অক্ষমতার হতাশায় মন খারাপ না করে উপায় নেই।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অভ্রনীল এর ছবি

এই দেশে রাস্তায় হর হামেশা বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ়, লেক্সাস দেখা যায়। আরো হাইফাই গাড়ি পোরসে কিংবা ভল্ভো দেখতে চান? সোজা গুলশান চলে যান। বোনাস হিসেবে সেলিকা, সুপ্রা বা মাযদা মিয়াটা'র স্পোর্টস কার পাবেন। এই দেশ আবার গরিব নাকি!

তবে মাঝে মাঝে কিছু গরীব দেখা যায়, যাদেরকে গ্রামের মহাজনরা গ্রাম থেকে তারিয়ে দেয়। তারা শহরে এলে শহরের মহাজনরা তাদের 'উচ্ছেদ' করে। এদের জন্যই কি বাংলাদেশকে গরীবের দেশ বলা হয়??

_________________________________
| আমার বাংলা ব্লগ | আমার ইংলিশ ব্লগ |
_________________________________

পলাশ দত্ত এর ছবি

অভিনন্দন।

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

দিগন্ত এর ছবি

আমি বাংলাদেশকে চিনেছি গত দশবছরে ধীরে ধীরে। ঢাকা-কেন্দ্রিকতা আর এই ধনী-গরিব ক্লাস বিভাজন বাংলাদেশের খুব বড় সমস্যা। এর মূলে আছে ঔপনিবেশিক আমলের জমিদারী কালচার যা এখনও মানুষের মধ্যে প্রভাব রেখে চলেছে। এখনও অন্তত শ'খানেক বছর লাগবে উপমহাদেশের এই সমস্যার সমাধান হতে। কিছু হলেও আমি কেরালাতেই এর কিছু ব্যতিক্রম দেখেছি তাই মনে করি সর্বশিক্ষাই এর একমাত্র মুক্তিপথ। অবশ্য ইতিহাসও কেরালাকে সহায়তা (কেরলের ১৮৯১ সালের প্রথম সর্বশিক্ষা অভিযান - যখন বাংলায় লোকে লিখতে পারলে জাত জিজ্ঞাসা করত) করেছে বলেই তারা আলাদা হয়ে উঠতে পেরেছে।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।