কবি'র অনুবাদে কবি’র রচনা

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: মঙ্গল, ২৫/০১/২০১১ - ১২:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

কহলিল জিব‌রান আরবী ও ইংরেজী ভাষার লেখক হলেও বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে একটি সুপরিচিত নাম। তাঁর রচনা, বিশেষ করে তাঁর কাব্যগ্রন্থ “The Prophet” বাংলা ভাষায় বহুজনে বহুবার অনুবাদ বা রূপান্তর করেছেন - কি বাংলাদেশে, কি ভারতে। জিব‌রানের পরিচয় তিনি কবি, গদ্যকার, চিত্রকর। তবে জিব‌রান মূলতঃ কবি; তাঁর গদ্যের ভাষা কাব্যিক, তাঁর চিত্রকর্মও কাব্যিক। তিনি রঁদ্যা’র মতো শিল্পীর কাছে শিল্পকর্মের তালিম নিলেও তাঁর শিল্পকর্ম তাঁর কবিতাকে ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। বোদ্ধা দর্শকের চোখে তাঁর শিল্প কর্ম উইলিয়াম ব্লেইক দ্বারা বড্ড প্রভাবিত। কিন্তু তাঁর কবিতাও কি তাই? সম্ভবতঃ না। আটত্রিশ বছর বয়সে বাহা’ই ধর্মের প্রবক্তা বাহা’উল্লাহের পুত্র আবদুল বাহা’র সাহচর্যে আসলেও কাব্যে গসপেলের মতো ভাষার ব্যবহার বা ধর্মের ঘন ছায়ার উপস্থিতি আরো আগে থেকে ছিল। ১৯১২’র “Broken Wings”-এ ভাষা ও আঙ্গিকে যে ধারার সূচনা দেখা যায়, তা পূর্ণ বিকাশ লাভ করে ১৯২৩-এ “দ্য প্রফেট”-এ এসে। তবে ঈশ্বর বা তাঁর বিধানের বাঁধন জিবরানের মানবিক দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেনি। তাই মানবিক বোধ আর মানুষের স্বাতন্ত্র্য ফুটে ওঠে পরবর্তীতে রচিত “Sand and Foam” বা “Jesus, The Son of a Man”-এ।

জিব‌রানের কাব্যকে হয়তো আধুনিক বলা যাবেনা তবে তার আবেদন চিরায়ত। “Sand and Foam”-এ তিনি দ্বিপদী বা একপদী কবিতার যে কাঠামো চর্চা করেছেন, অথবা অন্য আরো গ্রন্থে ছোট ছোট অনুচ্ছেদে গদ্য রচনার যে কাঠামো চর্চা করেছেন সেগুলোও বেশ আগ্রহোদ্দীপক।

এই রচনার উদ্দেশ্য জিব‌রানকে পরিচিত করা বা তাঁর রচনার ব্যাপারে পাঠককে উদ্ধুদ্ধ করা নয়। এই রচনার উদ্দেশ্য ভিন্ন, এখন সেই কথা বলব।

বাংলা কবিতায় কবি আসাদ আলমের নাম পরিচিত নয়। পরিচিত না হবার কারণ তাঁর একমাত্র প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “কষ্টে কষ্টে কষ্টিপাথর” প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে আঠারো বছর আগে ১৯৯৩ সালে, এবং তা কখনো পুনর্মুদ্রিত হয়নি। সেই বই প্রকাশের কয়েক বছর আগে পরে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় অনিয়মিতভাবে কিছু কবিতা বা আরো পরে দৈনিক প্রথম আলোতে অনিয়মিতভাবে কয়েকটি গদ্য প্রকাশিত হয়েছিল। এর বাইরে পাঠকের পাতে তিনি আর কিছু তুলে দেননি। মাঝে দীর্ঘ বিরতির পর বছর দুই আগে সচলায়তনে “ফকির লালন” নামে নিবন্ধন করে কবিতা পোস্ট করা শুরু করেন। এখানেও তিনি ঠিক নিয়মিত নন্‌। তবু সচলায়তনের কবিতাপ্রিয় পাঠকের কাছে “ফকির লালন” আজ আর কোনো অজানা কবি নন্‌। সেই “ফকির লালন” এই ২০১১-এর বই মেলায় আবার হাজির হচ্ছেন স্বনামে - কহলিল জিব‌রানের বিভিন্ন রচনা থেকে আগ্রহোদ্দীপক নানা অংশের অনুবাদের সংকলন নিয়ে। বইয়ের নাম “কহলিল জিবরানের রত্মভান্ডার থেকে”। প্রকাশক শুদ্ধস্বর, প্রচ্ছদ করেছেন সুনৃত শুদ্র, ৬৪ পৃষ্টার এই বইয়ের দাম রাখা হয়েছে ১০০ টাকা। সবকিছু ঠিক থাকলে এই বইটি বইমেলার শুরু থেকে শুদ্ধস্বরের স্টলে পাওয়া যাবার কথা।

অনুবাদকের ভাষায়, “কহলিল জিবরানের কাব্যিক ভাষা এবং মরমি সুরের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তা অনুবাদ করা যথেষ্টই কঠিন কাজ বলে মনে হয়েছে। মূলের প্রতি অনুগত থেকে আমি আমার সাধ্যমত সে সুর ধারণের চেষ্টা করেছি”। আসাদ আলম এই চেষ্টাটি যে বেশ আন্তরিকতার সাথে করেছেন সেটি বোঝা যায় অনুবাদকর্মটি পড়লে। উদাহরণ দেই,

“সেদিন সন্ধ্যায় অবিশ্বাসী ব্যক্তিটি গেলেন মন্দিরে, দেবতার সামনে নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে তার দীর্ঘ অবিশ্বাসের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

ঠিক একই সময়ে, বিশ্বাসী পন্ডিত তার সমস্ত পবিত্র পুঁথি পুড়িয়ে ফেললেন, কেননা সেদিন থেকে তিনি ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন।“

অথবা

“একজন ক্ষুধার্ত বর্বর মানুষ গাছ থেকে ফল পেড়ে খায়, আর একজন ক্ষুধার্ত সভ্য মানুষ তা অন্যের কাছ থেকে কিনে খায়, যে কিনা তা প্রকারন্তরে কিনে আনে আর একজনের কাছ থেকে - যে ফলটা গাছ থেকে পেড়েছে।“

উদাহরণের সংখ্যা বাড়ানো যায়, তবে তার প্রয়োজন নেই। প্রকৃত পাঠক যেমন বিপণি থেকে সঠিক বইটি বেছে নিতে জানেন; তেমন একটি বইয়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর চোখে আলাদা হয়ে ধরা পড়ে। আসাদ আলমের এই অনুবাদকর্মটি রচনাগুণে ও স্বীয় বৈশিষ্ট্যে প্রকৃত পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।

ছবি: 
16/06/2008 - 4:29pm

মন্তব্য

সুরঞ্জনা এর ছবি

কবিকে অভিনন্দন।
যে দুটো অনুবাদ এখানে দেয়া, দুটোই ভাল লেগেছে। বাকি কবিতাগুলোও পড়ে দেখার ইচ্ছা রইলো।

পান্ডবদার কল্যাণে বইয়ের সাথে প্রথম পরিচয়টা ভালো হলো। হাসি

............................................................................................
এক পথে যারা চলিবে তাহারা
সকলেরে নিক্‌ চিনে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সুরঞ্জনা, অনুবাদকর্মটি কবিতার আকারে নয় মুক্তগদ্য আকারে। ছোট ছোট অনুচ্ছেদে আলাদা আলাদা শিরোনামে দেয়া। বইটার কিছু অংশ কবি নিজেই তাঁর সর্বশেষ পোস্টে দিয়েছিলেন। আপনার চোখে পড়েছে হয়তো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ফাহিম হাসান এর ছবি

কবিকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।

দেবতার সামনে নতজানু হয়ে ঈশ্বরের কাছে

একটু খটকা লাগছে যে!

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এখানে দেবতা বলতে অনুবাদক সম্ভবতঃ প্রতিমার কথা বুঝিয়েছেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

দ্রোহী এর ছবি

অভিনন্দন কবি।

স্পর্শ এর ছবি

জিব্রানকে শুধু কবিই নয় কেমন যেন আধ্যাত্মিক দর্শনের গুরু মনে হয়। বইটার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করছি। ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য। সন্দেশের পোস্টেও ভুক্তি দিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

কবিকে অভিনন্দন।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি

তার আধ্যাত্মিক দর্শন কী রকম?

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

এ প্রশ্নটি আমারও মাথায় এলো। কবি ফরিদুদ্দিন আত্তার এর 'দর্শন' বোধকরি 'সুফিবাদ' কিন্তু কবি কাহলিল জিবরানের 'দর্শন' কি তা জানতে প্রায়শঃই ইচ্ছে করে। যতদূর জানি, তিনি ইংরেজিতে কিছু দার্শনিক প্রবন্ধ লিখেছেন, দার্শনিক হিসেবে পরিচিতিও পেয়েছেন হয়তো। কিন্তু 'দি প্রফেট', 'স্যান্ড এন্ড ফোম', 'দি গার্ডেন অব প্রফেট', 'কিংডম অব দ্য ইমাজিনেশন', 'জেসাস, দি সান অব ম্যান' কে কোন প্রতিষ্ঠিত কিম্বা নব্য দার্শনিক চিন্তাধারা প্রভাবিত করেছে তা নির্ণয় করতে গিয়ে নিজের জ্ঞানের ঊনতাকেই পুনরাবিষ্কার করি।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

আশরাফ মাহমুদ এর ছবি
সুহান রিজওয়ান এর ছবি

কবি ফকির লালনের করা জিবরানের অণুঅনুবাদ সম্বলিত লেখাটি দারুণ লেগেছিলো।

বইমেলায় তাই এই বইয়ের অপেক্ষায় রইলাম।

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

যাক, কবি আমাদের কথা শুনলেন হাসি

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

এই লেখাটি ভালো লেগেছিল। দারুণ কিছু অনুবাদ মলাটে বেঁধে দেয়ায় কবিকে ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

আনন্দী কল্যাণ এর ছবি

আনন্দ-সংবাদ। কিন্তু, কবির মৌলিক কবিতার বই আসলে আরও খুশি হতাম।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কবিকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি আরো এক বছর অপেক্ষা করতে বলেছেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

কবিকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। ধন্যবাদ পাণ্ডব-দা কেও। জিবরান একজন বহু-অনুদিত কবি। তাঁর বই বহু-বিক্রিত ও বহু-পঠিত বটে। তাই 'কবির রত্নভান্ডার' থেকে বাছাই করা ঠিক কোন অংশগুলো কেমন ভিন্নস্বাদে এই বইটিতে নবরূপ পেল তার একটি উপক্রমণিকা পাণ্ডব-দার এই ব্লগটিতে জুড়ে দিলে বইটির প্রতি পাঠকের আগ্রহ আরো বেড়ে যেতো বলে মনে করি।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বস্‌, কবি বইটিতে কোন সূচীপত্র দেননি, কোন অংশ কোন গ্রন্থ থেকে তাও বলেননি। তাই সবাইকে বলি বইটা সংগ্রহ করে পড়ে দেখুন।

অটঃ এই বইমেলায় আপনার কবিতার বই বের হলোনা এই আফসোশটা থেকে গেলো। আশা করি ২০১২তে আমাদের আফসোশটা দূর করবেন, অথবা তার আগেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

পাণ্ডব দা,
আপনার ব্লগ পড়েই বইটি সংগ্রহের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেছি!
আমার 'কবিতার বই' প্রকাশের প্রসঙ্গে বলি, তেমন যোগ্য হয়ে ওঠা সম্ভার যে আমার নেই। আমার যে রচনাগুলি স্খলিত পদে চলতে আরম্ভ করেছে মাত্র, যারা ঠিক কবিতার সীমার মধ্যে এসে পৌঁছয় নি, সেগুলিকে ছাপার বইয়ে প্রশ্রয় দিয়ে নিজেকে কুন্ঠিত করতে চাই না। ডিমের মধ্যে যে শাবক আছে সে যেমন পাখি হয়ে ওঠে নি, এটাতে কেউ দোষ দেবে না, কিন্তু পাখি বললে দোষ দিতেই হবে। তারচে যেমন করে দিন যাচ্ছে যাক না! যখন খুশি লিখছি, ছাপবার যোগ্য হলে সচলায়তন তা ছাপছে, কেউ কেউ আগ্রহ নিয়ে পড়ছেন, মন্তব্য পাচ্ছি, এই তো বেশ, 'আমার তো কোন স্বাদ নেই ফসলের তরে'!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বস্‌, আপনি যদি ঢাকায় বাস করে থাকেন তাহলে দয়া করে একবার টোকা দিয়ে দেখুন - এই বান্দা হাজির হয়ে যাবে। আপনার সৃষ্টির ভাণ্ডারটা আমাকে শুধু একটু ঘাঁটতে দেবেন, আমি ঠিক জিনিষগুলো ঠিকই খুঁজে বের করতে পারবো। সচলে প্রকাশিত আপনার সব কবিতাই আমার পড়া আছে। সুতরাং আমি জানি বই বের করার মতো কবিতা আমি ঠিকই বের করতে পারবো। এই অধমের কবিতা লেখার যোগ্যতা নেই সেটা সত্য, তবে আমি কবিতা চিনি, কিছুটা বুঝতেও পারি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আহ্, দারুণ খবর, অপেক্ষায় রইলাম

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।