কোথায় পাবো তারে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: মঙ্গল, ২৯/১০/২০১৩ - ৬:১৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নাকি মায়ের ডাকে সাড়া দিতে বর্ষার প্রমত্ত দামোদর সাঁতরে পাড়ি দিয়েছিলেন। আমরা তাঁর নামাঙ্কিত সেতুর ওপর দিয়ে ঘুমন্ত হুগলী নদী পাড়ি দেই গুরপ্রীত সিং-এর মোটরযানে করে। পেছনে পড়ে থাকে কল্লোলিনী মহানগরী, যার সন্তানদের অধিকাংশ আজ এখনো ঘরের বাইরে বের হননি। দুর্গতিনাশিনীর আনুষ্ঠানিক বিসর্জন হয়ে যাবার কথা আরো একদিন আগে। তাতে মণ্ডপ ফাঁকা হয়ে যাবার কথা — আমাদের অভিজ্ঞতায় অন্তত তাই বলে। কিন্তু এখানে মায়ের ভক্ত-সন্তানেরা তাঁকে তাঁর কন্যার আগমনের আগে ছাড়তে চান না। তাই কোথাও কোথাও তিনি বিসর্জিত,আর কোথাও কোথাও তিনি সগৌরবে বিরাজমান। যেখানে বিসর্জন হয়ে গেছে সেখানে সবার মাঝে স্বস্তি-তৃপ্তি-অবসাদের আয়েশ। আর যেখানে বিসর্জন হয়নি সেখানে গত সারারাতের আনন্দ-উল্লাসের ক্লান্তি। আজকের সকালটা কোরবানীর ঈদের সকালও বটে। তবে সেটা বোঝা যায় নির্ধারিত কিছু জায়গায়,যেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য আছে। রাস্তায় ঈদের পোশাকে সজ্জিত মানুষ, রাস্তার পাশে পতাকাশোভিত,কাগজের ফুলশোভিত ঈদগাহ বা মসজিদ দেখা যায় মহানগরীর বাইরেও। কোরবানী সবখানেই হয় — তবে রাস্তাঘাটে নয়, কসাইখানায়। তাই সেখানে এই ঈদ মানে রক্ত-গোবরে নোংরা রাস্তা-ফুটপাথ, নাড়ি-ভুঁড়িতে উপচানো ড্রেন-ডাস্টবিন, দুর্গন্ধে ভারী আকাশ-বাতাস নয়। এতে ধর্মীয় বিধান পালিত হলো,কিন্তু পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হলো না। বিষয়টা ভাববার বটে।

সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবী-টুপি পরা কিশোর সাদমান মুদি দোকানে ঢুকতে দোকানদার মনোহর ভোরা একগাল হেসে বললেন,
- কিরে বেটা সাদমান,আজ ঈদের দিন,মেঠাই খাওয়াবি না?
- মেঠাই খাওয়াবো কেন,আজ তো গোশ্‌ত খাবার দিন।
- তুই তো জানিস আমি গোশ্‌ত খাই না। তাহলে বললি কেন?
- যেই ঈদের যা রেওয়াজ,তাই বললাম। আচ্ছা যাও তোমাকে বিকেলে মেঠাই খাওয়াবো।
সাদমান মনোহরকে মেঠাই খাওয়ালো কিনা সেটা আর জানা হবে না। কারণ,আমাদেরকে বেরিয়ে পড়তে হবে এখনি। যেতে হবে মহানগরী ছেড়ে অনেক দূরে।

মহানগরী থেকে বেরিয়ে পড়াটা সহজ হলেও এখানে পৌঁছানোটা সহজ ছিলোনা। এবারের ছুটিতে ইচ্ছে ছিল হিমালয়কন্যাকে দেখার। ভ্রমণসহায়তাকারীর দ্বারস্থও হয়েছিলাম। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল অনেক। মনমতো যাবার উপায় হয় তো সুবিধামতো ফেরার উপায় হয় না। থাকার ঠাঁই যা মেলে সেটাও সুবিধার হয়না। তার ওপর ভ্রমণসহায়তাকারী যে মূল্যটা হাঁকলেন সেটা স্বাভাবিক মানের প্রায় দ্বিগুণ। অতএব হিমালয়কন্যার আশা ছাড়তে হয়। তারপর চেষ্টা করি বজ্রড্রাগনপুত্রের কাছে যাবার। সেখানেও বিধি বাম। ভ্রমণসহায়তাকারী এক গাল হেসে বলেন, ওখানে যাবার-ফেরার উপায়, ঠাঁই সব অনেক আগেই পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ছে। আপনি বরং পশ্চিমে কোথাও যান। পশ্চিমে যাবার জন্য আমি সব সময় এক পায়ে খাড়া। কিন্তু সেখানে যাবার ছাড়পত্র পাওয়া এতো সহজ নয়। সেটা নাকি হস্তিনাপুর থেকে দণ্ডকারণ্য যাবার ছাড়পত্র পাবার চেয়েও কঠিন। আমি কপাল ঠুকে আবেদন করে ফেলি। নিকটজনরা বলেন, আবেদন করেছো বটে কিন্তু দূতের আহ্বান পেতে পেতে তোমার ছুটি ফুরিয়ে যাবে। কিন্তু কী করে যেন শেষ মুহূর্তে তাঁর ডাক পেয়ে যাই, বিজয়ার দিন সন্ধ্যায় ছাড়পত্রও মিলে যায়। এবার ভ্রমণপরিচয়পত্রে মুদ্রা বিনিময়কারীর ছাপ মারার পালা। সারা শহর ছুটিতে চলে গেছে। আমি ছুটি নয়াবাজারের কোরবানীর হাট পেরিয়ে তাঁতীবাজারের সরু গলিতে। সেখানে বিশাল বিশাল ট্রাক প্রস্তুত আছে বিসর্জনযাত্রার জন্য। এয়োতিরা ঠাকুরকে শেষ ভোগ দিচ্ছেন, লোকজনের মুখ-শরীর আবীরের রঙে রাঙানো। অদূরে আগ্নেয়াস্ত্রসজ্জিত নিরাপত্তাকর্মীরা শান্তিরক্ষা করছেন। আমি ওসব পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাই। মুদ্রা বিনিময়কারীর অফিস খোলা থাকায় ছাপ মিলে যায়।

বিমানে তিলোত্তমা থেকে কল্লোলিনীর কাছে পৌঁছুতে বিশেষ সময় লাগে না। বিমানবন্দরে দুটো জরুরী কাজ আছে। এক, অগ্রবর্তী দলকে জানাতে হবে যে, আমি এসে গেছি। দুই, মুদ্রা বিনিময় করতে হবে। প্রথমটার জন্য ফোনের সিমকার্ড খুঁজি, কিন্তু সহজে মেলে না। যদিও বা তার খোঁজ মিললো, কিন্তু জানা গেলো সাত দিনের আগে সেটা কার্যকর অবস্থায় আসবে না। আমার অতো সময় কোথায়! দ্বারস্থ হই ফোনবুথের। ফোনবুথকর্মী শুরুতে জিজ্ঞেস করেন আমার কাছে খুচরো ছ’টাকা হবে কিনা। খুচরোর পরোয়া না করে আমি ফোন করি। ফোন সারতে সারতে মিনিট দুই সময় লাগে। ফোনবুথকর্মী জানান আমাকে ছয় দুগুণে বারো টাকা শোধ করতে হবে। কিন্তু ঠিক বারো টাকা যে আমার কাছে নেই! কুড়ি টাকার নোট দিলে ফোনবুথকর্মী মুখ করুণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে এটা ওটা হাতড়ে বলেন আমাকে তিনি কিছুই ফেরত দিতে পারবেন না। তার অতি অভিনয়ে বিরক্ত হই। আমার বিরক্তি ক্রোধে পরিণত হয় যখন মুদ্রা বিনিময়কারী মুদ্রা বদলে দেবার সময় শতকরা প্রায় নয় ভাগ কম দেন। একটা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাষ্ট্রীয় বা তফসিলী ব্যাংকের মাধ্যমে মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবস্থা নেই দেখে ক্ষুদ্ধ হই। কিন্তু একটা কথা ভেবে সেটা গিলে ফেলি। আমাদের বিমানবন্দরের ব্যবস্থা কি এরচেয়ে ভালো?

বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে শহরে ঢুকতে প্রথমে যে হোর্ডিংটা চোখে পড়ে, সেটা দেখে একটু হোঁচট খাই। হজ্বযাত্রীদের নিরাপদ ভ্রমণ কামনা করছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। সেটা তিনি করতেই পারেন। তবে সেখানে তাঁর ছবিটা মোনাজাতের ভঙ্গীতে, মাথায় কপালঢাকা ঘোমটা — যেমনটা মুসলিম নারীরা নামাজ পড়ার সময় করে থাকেন। বুঝলাম ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার আর সংখ্যালঘু কার্ড খেলার চেহারাটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের উড়নদূরত্বের এ’পাশে-ও’পাশে একই প্রকার। সারা শহরজুড়েই ছোট-বড় বিলবোর্ড। সেগুলোতে মাননীয়া সবাইকে একসাথে ‘শারদীয়া, ঈদ-উজ-জোহা, দীপাবলী আর ছট্‌ পূজা’র শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। উদ্যোগটা প্রথমে ভালো লেগেছিল, পরে একটু কেমন কেমন লাগলো। কেন? মহানগরী আর তার বাইরে যেখানে যেখানে গেছি — সর্বত্র দেখেছি বিলবোর্ড-পোস্টার-ফেস্টুনে শুধু তিনিই আছেন। কোথাও কোথাও তাঁর ছবির নিচে একদল কৃপাপ্রার্থীর ছবিও আছে, তবে মাথার ওপরে অন্য কারো ছবি নেই। ঘড়ির হিসেবে ত্রিশ মিনিট পূর্বের সাথে মিল আর অমিলটা এখানে। আমি আমার অনেক আগের করা এই অঞ্চল ভ্রমণের কথা স্মরণ করার চেষ্টা করি। তখন পোস্টার-ফেস্টুন-দেয়াল লিখনে কাস্তে, হাতুড়ি, পাঞ্জা, পদ্ম, ঘাসফুল, সিংহ, কোদাল সবকিছুই কম-বেশি দেখা গেছে। এখন পশ্চিম ফ্রন্টে ঘাসফুল ছাড়া বাকিরা দৃশ্যত অদৃশ্য।

বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে হাইওয়েতে ঢুকলে পথের দু’পাশে কোথাও কোথাও দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। সেখানে কোথাও কোথাও কাশবন — একেবারে ফুলে ফুলে সাদা। মাঠে গরু-ছাগলের দল মোটামুটি ছাড়া অবস্থাতেই চড়ে বেড়ায়। এক আধটা জায়গায় পাকা ধান বা সবজি চোখে পড়ে। তবে বেশিরভাগ মাঠই ফাঁকা। হেমন্তের শুরুতে এমন দৃশ্য অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া সুযোগ থাকলে জমিকে বিরামও দিতে হয়। গরু-ছাগলকে হাইওয়ের দুই লেনের মাঝখানের নিচু ঘাসজমিতেও চড়তে দেখা যায়। ব্যাপারটা বিপদজনক। মাঝখানটাকে ঊঁচু করে সেখানে ফুলের গাছ বা বড় বৃক্ষ লাগানো যেতে পারে। হাইওয়ের যেখানে যেখানে দু’পাশে রেলিং-এর বাধা আছে, সেখানে হাইওয়ের সমান্তরালে গ্রামের পথও আছে। সে’পথ সরু, তবে কার্পেটিং করা। দু’পাশে যেসব গ্রাম চোখে পড়ে সেখানে অভিজ্ঞতায় বিরল কিছু চোখে না পড়লেও পূর্বের গ্রামগুলোর চেয়ে একটু পরিপাটি মনে হয়।

অবকাঠামোগত উন্নয়ণ একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সব পর্যায়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিকভাবে বিকশিত হতে দেয়া। পশ্চিমের উন্নতিটা আহামরি কিছু না হলেও এই দুই ক্ষেত্রে তাদের যতটুকু উন্নতি হয়েছে পূর্বে সেটা হয়নি বা হতে পারেনি। গোড়ার এই পার্থক্যটুকু এখন আর উপেক্ষা করার মতো পর্যায়ে নেই। ’৫৮-’৭১ যোগ ’৭৫-’৯০ যোগ ’০৭-’০৮ একুনে ত্রিশ বছর। ছেষট্টি বছরের মধ্যে ত্রিশ বছর লেফট-রাইট করলে অবকাঠামোগত উন্নয়নের নামে লুটপাটের মহোৎসব চলে আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ফসিলও টিকে থাকে না।

আমাদের চালক কাম গাইড গুরপ্রীত সিং পাঞ্জাবী শিখ, কিন্তু জন্মেছেন এই মহানগরের ভবানীপুরে, বড় হয়েছেনও এখানে। কেশ, কাঙ্ঘা, কারা, কৃপাণ ধারণ করেন না, কাচ্ছেড়া পরেন কিনা জিজ্ঞেস করিনি। নিরামিষাশী, ধূমপান করেন না, তবে সন্ধ্যার পর একটু উচ্চমার্গে থাকেন। পথ চলতে চলতে তার সাথে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা হয়, দেশের অবস্থা নিয়ে কথা হয় — আমার মাতৃভাষা, তার মাতৃভাষার কিছু শব্দবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ভাষা আর একটা আন্তর্জাতিক ভাষার মিশেল দিয়ে। আমার দৌড় আমার মাতৃভাষা আর ঐ আন্তর্জাতিক ভাষাটা পর্যন্ত। বাকিগুলো কিছু কিছু বুঝি, কিন্তু বলতে পারি না। তাতে কথপোকথন চালাতে কোন অসুবিধা হয় না। গুরপ্রীত এক কন্যা আর এক পুত্রের গর্বিত জনক। পুত্র খালসা স্কুলের ইংলিশ মিডিয়ামে একাদশ শ্রেণীর ছাত্র, ভালো হকি খেলে, রাজ্য দলেও স্থান পেয়েছে। গুরপ্রীত তার ব্যাপারে খুব আশাবাদী। শুনে আমাদেরও খুব ভালো লাগে, বলি,
- আপনার দেশ তো হকিতে দুনিয়ার প্রথম সারির দেশ, নিয়মিত বিশ্বকাপে খেলে। ছেলে যদি একবার ন্যাশনাল টিমে সুযোগ পেয়ে যায় তাহলে তো কথাই নেই!
গুরপ্রীতের মুখ হাসিতে ভরে ওঠে। কন্যার কথা জিজ্ঞেস করি। এবার তার মুখে আঁধার ঘনায়। কন্যা ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে পড়ে মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙেছিল। সেই সমস্যা এখনো তাকে ভোগায়। প্রায়ই সে অসুস্থ থাকে। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়া কন্যাকে ভবিষ্যতে গুরপ্রীত কী বানাতে চান সেই প্রশ্নে একটু আমতা আমতা করে জানান, কন্যা যা পড়তে চায় তার কোন কিছুতেই তার আপত্তি নেই। এমনকি কন্যা তার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে চাইলেও তার আপত্তি নেই, শুধু পাত্র আর তার পরিবার মানুষ হিসেবে কেমন সেটা তিনি দেখবেন। এই প্রসঙ্গে একটা অস্বস্তিকর বিষয় আলোচনায় চলে আসে। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা কথায় বুঝতে পারি, এখানে ‘দহেজ্‌’ এখনও একটা বড় ব্যাপার।

ভারী হয়ে যাওয়া বাতাস হালকা করতে আমাদের প্রিয় প্রসঙ্গ — রাজনীতি নিয়ে কথা বলি। গুরপ্রীত জানান, মাননীয়ার প্রতি তার আস্থা আছে, তবে তাঁর সহযোগীদের ওপর নয়। মাননীয়ার পরিবারের লোকজনের কাণ্ডকারখানা নিয়ে প্রচলিত গল্পও তার কাছে শুনতে পাই। তার সত্যাসত্য জানি না, তবে সেগুলোর কোনটাই ভালো নয়। আমি রসিকতা করে বলি,
- আগামী বছর আপনাদের দেশ তো গুজরাতী প্রধান পেতে যাচ্ছে।
- হ্যাঁ, দেশটা একেবারে বেচে দেবে।
দেশবেচার ধারণা এ’খানেও সগৌরবে বিরাজমান দেখে অবাক হই। আমি এক গাল হেসে বলি,
- এতো বড় আর এতো মানুষের দেশ কিনবে কে?
- আরে দেশ বেচা কি আর ওভাবে হয়? বিদেশিরা আসবে, সস্তায় কাজ করিয়ে নেবে। আমাদের লেবার, ইলেকট্রিসিটি, কয়লা, জমি খরচ করে জিনিস বানিয়ে আমাদের কাছেই বেশি দামে বেচবে, অন্য দেশে বেচবে, তাদের দেশে নিয়ে যাবে। আমাদের ধন, আমাদের মাল লুটে লাভ নিয়ে ভেগে যাবে। মাখ্‌খন খাওয়া হলে শেষ হলে এখানে শুধু আঁটিটা পড়ে থাকবে।
গুরপ্রীতের বোধের গভীরতা দেখে অবাক হই। পরে ভেবে দেখলাম, কুড়ি বছরের বেশি সময় হয় ওখানে দরোজা খুলে দেয়া হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষার বিস্তার হলে, তাতে যা কিছু হচ্ছে তা দেখে সাধারণের কারো কারো মনে অমনটা বোধ হতেই পারে। তাদের দেশের নীতির সমালোচনা করার অধিকার আমার সীমিত। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ আর পণ্ডিতজীর দিন শেষ হবার পর নরসিংহ আর মনমোহনরা যে দ্বার খুলে দিয়েছেন তাতে বেনোজল ঢোকার পথ রুদ্ধ করার উপায় আছে কি!

দেখতে দেখতে সিঙ্গুর এসে যায়। গুরপ্রীত সিং দূরে কিছু অসম্পূর্ণ অবকাঠামো দেখিয়ে টাটা’র চলে যাবার গল্প বলেন। তার ভাষ্য, সেই জমি তো নষ্ট হলোই, মাঝখান থেকে টাটাকে তাড়িয়ে দিয়ে কী লাভ হলো? এই প্রশ্নের যথার্থতা আর তার উত্তর আমার জানার দরকার নেই। আমি বরং সিঙ্গুরের একটা খালকে দেখি। এমন খালকে কোন কোন দেশে নদী বলে চালিয়ে দেয়। দু’পাশ থেকে বৃক্ষ পানিতে ঝুঁকে আছে, লতা-গুল্মরা তার দুই পাড়কে ঢেকে ফেলেছে। ছোট কানি বক, বড় ধবল গোবক, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, ডাহুকের সাথে বেশ বড়সড়, একা একটা পাখিকে দেখলাম। আকার আকৃতি সারসের মতো। তবে রঙ সাদা-লালের কম্বিনেশন নয়, কালো-ধুসরের কম্বিনেশন। গাড়ি থামিয়ে দেখার উপায় ছিলো না, তাই চিনতে পারলাম না। ব্ল্যাক স্টর্ক হতে পারে। কিন্তু কার্তিকের শুরুতেই কি সে চলে আসবে? তাও আবার একা! এমন একটা খালের পাড়ে বসে পাখি দেখে আর তাদের গান শুনে সারাটা দিন কাটিয়ে দেয়া যায়।

আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। জাতীয় মহাসড়ক ২ ধরে যাবার সময় শক্তিগড়ে একবার থামি গলা ভিজিয়ে নেবার জন্য। গলা ভেজাবার জন্য এখানে কচি ডাব আর মন ভরাবার জন্য বহুল আলোচিত ল্যাংচা আছে। ল্যাংচা হচ্ছে দুই মাথা সরু কালো রঙের একটা মিষ্টি, ভেতরটা সাদা। অনেকটা কালোজামের সাথে তুলনীয়। ল্যাংচাগুলোর দোকানে মহানায়ক আর তাঁর উত্তরসূরীর ছবি আর নাম সাঁটানো। তাঁরা কখনো এখানে হয়তো থেমে ল্যাংচা খেয়েছিলেন। ল্যাংচা খাওয়া হলো। সাথে রসগোল্লা, সীতাভোগ, সরভাজা, মালপোয়া, পাটিসাপ্টা, সিঙ্গারা, রাবড়িও খাওয়া হলো। খাবারের মান হাইওয়ের পাশের যে কোন দোকানের মতোই অখাদ্য। আমি তরমুজের সাইজের একটা বিশাল ডাবের জল পান করলাম। ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে কিছুটা সরও খাওয়া হলো। এরপর আবারও পথ চলা।

মহাবীরের পন্থাকে শাস্ত্র নাস্তিকপন্থা হিসেবে চিহ্নিত করে। আড়াই হাজার বছর আগে, তিনি তাঁর পথপরিক্রমায় আস্তিকগ্রামে কিছুদিন ছিলেন। স্থানের নামের সাথে অস্তি-নাস্তি’র কোন সম্পর্ক নেই, সে স্থানের বয়স তখনই দেড় হাজার বছরের মতো। মহাবীরের একটা উপাধি হচ্ছে ‘বর্ধমান স্বামী’। সেই থেকে আস্তিকগ্রামের সম্মানিত নাম হলো ‘বর্ধমান’। মুঘলদের চতুর্থ সম্রাট যে একটা অপদার্থ ছিল সেটা সবাই জানেন। তার একটা প্রিয় বিষয় ছিল স্থানের পুনঃনামকরণ। সে জায়গাটার নাম দিলো বাধ-ই-দিওয়ান। লোকে তার থোড়াই পরওয়া করলো। বর্ধমান নামই টিকে গেল। ক্ষত্রিয় সংগ্রাম রাই পাঞ্জাব থেকে এসে বর্ধমান রাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সে নিজে এবং তার বংশধরেরা বড়ই রাজভক্ত ছিল। যথাক্রমে মুঘল ও ব্রিটিশ দুই প্রভুর নিমকহালালী করে গেছে আজীবন, এমনকি ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও। স্বাধীন দেশে এদের কোন দরকার ছিল না। তাই ১৯৫৬ সালে পণ্ডিতজী এই আগাছা উচ্ছেদ করেন।

রাস্তার পাশে বর্ধমানের বাজার দেখি। সেখানকার কৃষিপণ্য লক্ষ করি। মনে হলো হাইব্রীডের আগ্রাসণ এখানে এখনও বেশি নয়। লাউ, কুমড়ো, টমেটো, আলু, পেঁয়াজ সবগুলোর চেহারায় হাইব্রীডের বাড়তি লাবণ্য নেই। কারো কারো চেহারা তো রীতিমতো দীন। একই ব্যাপার লক্ষ করেছি বীরভূমেও। তবে সেখানকার বাজার বর্ধমানের বাজারের মতো সমৃদ্ধ নয়, অনেক দরিদ্র। বর্ধমানের বাজার পেরিয়ে পথ চলে যায় ইস্পাতনগরীর দিকে। আমরা সেদিকে যাবো না। আমাদেরকে উত্তর দিকে মোড় নিতে হবে। মোড়ের নাম দার্জিলিঙ মোড় হলো কেন জানি না। দার্জিলিঙ তো এখান থেকে কয়েকশ’ কিলোমিটার দূরে! মোড়ে একটা ধাবা ছিল। খুব ইচ্ছে ছিল গল্প-সিনেমার মতো ধাবায় নেমে রুটি-কষা মাংস খাই। কিন্তু ভ্রমণসঙ্গীরা বাদ সাধলেন।

গুসকারায় আসার পর গুরপ্রীত সিং কেন যেন রামনগর-ভেদিয়ার সোজা রাস্তা রেখে আউসগ্রাম-ছরা-ইলম বাজারের ঘুর পথ বেছে নেয়। আমরা একটু একটু করে বীরভূমে ঢুকে পড়তে থাকি। দু’পাশে কোথাও শালবন, কোথাও জলাজমি, কোথাও গ্রাম। কোথাও অদূরে ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙামাটির পথ’। মূল পথের অবস্থা এখানে একটু বেশি খারাপ। এই অঞ্চলে পথের পাশে বেশ ঘন ঘন আইএমএফএল বা তার দেশি ভাইয়ের বিপণী। চাহিদা যেখানে বেশি স্বাভাবিক নিয়মে সেখানে যোগানটাও বেশি হবে। এখানে আদিবাসী আর পশ্চাতপদদের সংখ্যা একসাথে মিলিয়ে শতকরা ত্রিশ ভাগ বলে চাহিদাটা বেশি কিনা জানি না। পিছিয়েপড়াদেরকে নিয়ত মত্ত রেখে গণঅভ্যূত্থান ঠেকানোর অতি প্রাচীন নীতিটার অনেক দিন ধরে চর্চার ফলে সদামত্ততা এখন তাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে কিনা তাও জানি না। তবে ব্যাপারটা শুভ কিছু নয়।

আমরা আমাদের গন্তব্য আশ্রমের কাছে পৌঁছে যাই। আশ্রম যতই কাছিয়ে আসে, বুকে দোলা লাগে। সেথায় রাত্রিবাসের জন্য কোন ঠাঁই যে ঠিক করা হয়নি সেটা নিয়ে ভাবনা হয় না। আশ্রমে যখন ঢুকি তখন বেলা পড়ে এসেছে। তবু রাত্রিবাসের ঠাঁইয়ের বা মর্ধ্যাহ্ন ভোজের কথা কিছু না ভেবে আমরা আশ্রম প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়ি। আশ্রমের পরিপার্শ্বে মিশে যেতে আমাদের সময় লাগে না।

আশ্রমে ঢোকার বিপদ হচ্ছে, সেখানে ঢুকলে সময়জ্ঞান থাকে না। কিন্তু আমরা যে তখনো অনিকেত, তাই সময়জ্ঞান হারিয়ে চলার উপায় নেই। পছন্দের ঠাঁই ছিলো প্রান্তিকের কাছাকাছি, যেখানে কাছেই একটা বাঁধ আছে। কিন্তু পুনর্নির্মাণ চলায় তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ আছে। আমরা ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে থাকি এ’বাড়ি-ও’বাড়ি। শেষে ঠাঁই মিললো জামবুনি’র চারুপল্লীতে। ঠাঁইয়ে থিতু হতে না হতে চারদিকে আঁধার গাঢ় হয়ে ঘনিয়ে আসে। চারপাশ অদ্ভূত, নিরব, নিস্তব্ধ। একটু শীত শীত লাগে। রাতের পৃথিবীকে দেখার জন্য আমরা বেরিয়ে পড়তে চাই, কিন্তু পথের হদিস জানি না। হদিস জানতে ঠাঁইয়ের কর্মীদের সাহায্য নেবার চেষ্টা করি।

ঠাঁইয়ের কর্মী সঞ্জীব মাঝি, হারাণ ঘোষ, রিপন মুর্মু আর যোগেশ দে’কে দেখি তাদের সাথে কথা বলি। তাদের মুখের ভাষায় একটু ভিন্ন টানের পার্থক্য ছাড়া তাদের দেহাবয়বে নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগত কোন পার্থক্য আমি করতে পারি না। এটা কি আমার ব্যর্থতা নাকি আসলেই কোন পার্থক্য নেই তা জানি না। তারকেশ্বরের বাঙালী হারাণ আর রাজনগরের সাঁওতাল সঞ্জীবের মধ্যে আসলেই কি কোন পার্থক্য আছে? এবং তাদের দু’জনের সাথে আমারও কি কোন পার্থক্য আছে? মুর্খের দল তাহলে কী নিয়ে বড়াই করে!

অনেক রাতে যখন ঠাঁইয়ের বিছানায় ফিরি তখন সারা দিনের ক্লান্তির চেপে ধরার চেয়ে প্রশান্তির আবেশ আমাদেরকে জড়িয়ে ধরে। আমরা আমাদের পূর্বাপর ভুলে যাই। যাপিত জীবনের কোন অযোগ্যতা, অপ্রাপ্তি, ক্ষতি বা বিনাশের কথা মনে থাকে না। রাতজাগা পাখির ডাক শুনতে শুনতে আমরা ঘুমে তলিয়ে পড়ি।

রাস্তাজুড়ে তারা ঘুমিয়ে আছে। কোথাও একা, কোথাও দলবেঁধে। এটা রাতের দৃশ্য। দিনের বেলাতেও তারা রাস্তাজুড়ে থাকে। কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো শুয়ে জাবরকাটারত। কারো কাছে এরা সাক্ষাত ভগবতী, কারো কাছে বৈতরণী পার হবার উপায়। তাই কেউ কিছু বলে না। কিন্তু জায়গাটা তো রাস্তা! সেখান দিয়ে পথচারী যাবে, সাইকেল যাবে, রিক্‌শা যাবে, ছোট-বড় গাড়ি যাবে। যানারোহীর চিৎকার-চেঁচামেচি, গাড়ির হর্ন কোন কিছুর পরোয়াই তারা করে না। বাধ্য হয়ে পদব্রজে চলা বা যানারোহী মানুষকে রাস্তা থেকে একটু নেমে বা ঘুরে পথ চলতে হয়। আমি বুঝলাম এই আশ্রমের সাথে “অ্যাই গরু সরে দাঁড়া” কথাটা কী করে জুড়ে গেছে।

শুধু যে গাভীকুল এখানে এমন আচরণ করে তা নয়। তাদের দেখাদেখি অজকুলও একই আচরণ করে। সারমেয়কুল দিনমান রাস্তাজুড়ে শুয়ে থাকে, অথবা এমন উদাস ভঙ্গীতে কোথায় যেন তাকিয়ে থাকে যে তাদের কানে গাড়ির হর্ন পশে না। তন্দ্রাচ্ছন্ন কুকুর তার পা মাড়িয়ে যাওয়া লোকের দিকে একবার বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার চোখ মুদে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে এ’সব প্রাণীদের পালনকারী কেউ আছে বলে মনে না হলেও দুর্ঘটনা ঘটলে তারা কোন অদৃশ্য থেকে যেন হাজির হয়। ঠাঁই থেকে সকালে বের হতে দেখি এক মোটরসাইকেল আরোহী এক পাঁঠাকে চাপা দিয়েছে। আর যাবে কোথা! কোত্থেকে পাঁঠার মালিক উদয় হয়ে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে ফেললো। লোক জড়ো হতে দেরি নেই। বাংলার স্থানীয় উপভাষার সাথে স্থানীয় আদিবাসীদের ভাষায় ব্যাপক ঝগড়া চললো, মাঝে মাঝে রাষ্ট্রভাষায় ধমকও শোনা যেতে লাগলো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘটনাটার শেষ পর্যন্ত হয়তো দেখা যেতো, কিন্তু হাতে অতো সময় ছিলো না। আমাকে যেতে হবে ডাকঘর পর্যন্ত। সেখানে পুরনো বইয়ের একটা দোকান আছে। এতো সকালে সেটা খোলা পাওয়া যাবে কিনা, অথবা আশ্রমে ছুটি থাকলে দোকানকর্মীরাও ছুটিতে চলে যান কিনা জানিনা। আমার সঙ্গিনী যাবেন ডাকঘর থেকে বাঁয়ে কালভার্ট পার হয়ে সোনাঝুরিপল্লীর দিকে। বইয়ের দোকান খোলা পাওয়া গেলো না। তাই আমাকেও সঙ্গিনীর সাথে যেতে হলো।

একদা গুরুদেব যবদ্বীপ থেকে বিশেষ এক ধরনের বাটিকশিল্পী আনিয়েছিলেন যারা শুধু চামড়ার ওপর বাটিকের কাজ করেন। তারা স্থানীয় শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছিলেন সেই কৌশল। পরে আশ্রমের সীমানা ছাড়িয়ে এই শিল্প এই অঞ্চলের একটা অন্যতম প্রধান হস্তশিল্পে পরিণত হয়েছে। সোনাঝুরিপল্লীর যেখানটাতে আমরা গেলাম সেখানে এই হস্তশিল্পের প্রদর্শনী ছিল। কেন্দ্রটা শুধু নামেই ধরিত্রীর নাম ধারণ করেনি, দর্শনেও তার স্নিগ্ধ মায়া আছে। মন্দিরের মতো সেখানে জুতা খুলে ঢুকতে হয়। দেখি শুধু চামড়া নয় আরো অনেক রকম হস্তশিল্পের প্রদর্শনীই সেখানে আছে। আমার সঙ্গিনী পাগলের মতো সবকিছু হাতড়াতে থাকেন। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শিল্পীদের মুন্‌শীয়ানা বোঝার চেষ্টা করি। তার কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না।

রিকশাচালক সরোজ তুড়ি বেশ শৌখিন মানুষ। ফুলহাতা শার্ট আর ট্রাউজারের সাথে বেশ মানানসই একটা ওড়না গলায় ঝোলানো। প্রথমে ভেবেছিলাম গামছা নাকি! পরে দেখি, না, সেটা ওড়নাই বটে। সকাল থেকে আমাদের ঠাঁইয়ের গেটে দাঁড়িয়েছিলেন। এখানকার রিক্‌শাগুলো আমাদের রিক্‌শার তুলনায় নিচু, হুডটাও একটু অন্যরকম। আর রিক্‌শাগুলো মোটেও আমাদের রিক্‌শাগুলোর মতো রঙিন নয়। আমরা ঠাঁই থেকে বের হতে সরোজ জিজ্ঞেস করলেন কোথাও যাবো কিনা। যাবো না শুনে আবার জিজ্ঞেস করলেন আমরা কী কী দেখেছি। আমাদের অদেখা জায়গাগুলোতে নিয়ে যেতে চাইলেন। সাথে এটাও জানালেন আশ্রমের সব কিছুর বিস্তারিত তার জানা আছে। অনায়াসে আমরা তাকে গাইড হিসেবে নিতে পারি। আমাদের সে উপায় নেই। আমাদের সাথে গুরপ্রীত সিং আছেন তার মোটরযান নিয়ে। সরোজ তুড়িকে তিনি এক কথায় বিদায় করে দিলেন। আমরা আবার আশ্রম প্রাঙ্গনের দিকে রওয়ানা হলাম।

আশ্রমটা বন্ধ থাকলে সেটা হয়তো কিছুটা নিষ্প্রাণ থাকে, তবে আশ্রমপ্রাঙ্গন ভালো করে দেখার এটা একটা মোক্ষম সময়। শিল্পের এক অবতার পরামাণিকপুত্র হয়ে জন্মেও কী ভুবনমোহন সব সৃষ্টি করে গেছেন সেটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা যায়। দিল্লী-নেপাল-বুদাপেস্তে গিয়ে তাঁর সৃষ্টি দেখার সুযোগ কখনো হবে কিনা জানি না। তাই সেই অজানা ভবিষ্যতের আশায় থাকার চেয়ে এই আশ্রমে থাকা ছয়টা মাস্টারপিস বরং ঘুরে ফিরে দেখে নেই, বুঝে নিতে চাই।

‘কলের বাঁশি’ আর ‘সাঁওতাল পরিবার’-এর মাথার উপর চালা তুলে চাক্ষিক-রূপকারের রূপময় কাজ দুটোর সাড়েসর্বনাশ করা হয়েছে। যিনি বলেছিলেন,
“ছেলেবেলা থেকে আমার একটা ইচ্ছা ছিল — যেখান দিয়ে যাব রাস্তার ধারে-ধারে মূর্তি রচনা করে চলব। সূর্যের আলো, চাঁদের আলো, বর্ষণাতুর আকাশের তলায় বড় মূর্তি দেখতে ভালো লাগে।“
তাঁর কাজকে ঘেরাটোপ পরিয়ে কেমন করুণ করে তোলা হয়েছে। ‘সুজাতা’র চারপাশে বাঁশ বাঁধা আছে দেখলাম। বুঝলাম তাকেও ঘেরাটোপে বন্দী করা হবে। সুজাতা যার অভিমুখীনী, সেই ‘বুদ্ধ’ এখনো মুক্ত। কিন্তু তার শরীর দেখলে মনে হয় না তার যত্ম নিয়ে কেউ ভাবে। ‘গান্ধী’র অবস্থা বুদ্ধের চেয়ে একটু ভালো। শুধুমাত্র ‘আলোকবর্তিকা’র অবস্থা অনেকটা ঠিক আছে। এটা বোধকরি একেবারে সামনে বলে একটু বেশি যত্ম পেয়েছে। ওপেন এয়ার স্কাল্পচার রক্ষণাবেক্ষনের নানা রকম পদ্ধতি আছে। সেগুলো নিয়ে এখানে কতটা চর্চা হয় সেটা ভাববার বিষয়। বুদ্ধ বা গান্ধী ক্ষয়ে যাচ্ছেন — এই ধূঁয়া তুলে অচিরেই তাদেরকেও হয়তো ঘেরাটোপে বন্দী করা হবে। ঘেরাটোপ পরানো হলেও কোন ভাস্কর্যের পাদদেশে বা ধারেকাছে তার কোন নামফলক বা পরিচিতি নেই। এটা এখানকার রীতি হতে পারে। তবে তাতে আশ্রম সম্পর্কে কম-জানা বা না-জানা দর্শনার্থীদের নির্ভর করতে হয় অশিক্ষিত গাইডদের ওপর, যারা গুরুদেবের ‘দুই বিঘা জমি’র সাথে মহর্ষির ভুবনডাঙার জোতের মাপ মিলিয়ে এক আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসে।

বিজনেস স্কুল আর তার জাতকদের যতই গালমন্দ করা হোক না কেন, যেখানে নিত্য দেশি-বিদেশি হাজারো পর্যটকের আনাগোনা সেখানে দক্ষ ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত বিরাট একটা প্রতিষ্ঠান চালাতেও আন্তর্জাতিকমানের দক্ষ ব্যবস্থাপক লাগে। আশ্রমের দৃষ্টিকোন থেকে ব্যবস্থাপক নিয়োগ হয়তো নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণের মতো ব্যাপার। কিন্তু এই বটিকা আজ হোক কাল হোক বোধকরি গিলতে হবে। আরো নিয়োগ লাগবে পরিকল্পক, উদ্যানতত্ত্ববিদ, প্রাণিতত্ত্ববিদ, কীটতত্ত্ববিদ, পক্ষীতত্ত্ববিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, স্থপতি, প্রত্মতাত্ত্বিক, প্রকৌশলী। এঁদের অনেকেই হয়তো আছেন, তবে আশ্রম ঘুরে দেখলে তাঁদের অনেকের অভাবই বোধ হয়। বিশেষত পরিকল্পকের অনুপস্থিতি পীড়া দেয়। প্রাঙ্গনজুড়ে মহৎ সব কীর্তির পাশাপাশি আনাড়ি হাতে করা কাজের পরিমাণ নেহাত কম নয়। এই ‘টাটকা-পঁচা তত্ত্ব’ কর্পোরেট দুনিয়ার কোথাও কোথাও লোকে গিললেও এখানে গেলার উপায় নেই। স্রেফ বমি হয়ে যাবে। তবু তার মাঝে এক ঊঁচু চতুষ্কোণ বেসের ওপর বেলনাকার এক কলামের ওপর বসানো হেঁটমুণ্ডঊর্ধ্বপদ একটি ভাস্কর্য মুগ্ধ-বিস্ময়ে দেখি। বেস আর কলামে হিউম্যান ফিগারের ভ্যারিয়েশনের সূক্ষ্মকাজ। ভাস্কর্যের আর তার নির্মাতার নাম জানতে পেলাম না — একটু আফসোস্‌ থেকে গেলো।

বীরভূমের মাটিতে আয়রন অক্সাইডের পরিমাণ বেশি, তাই তার রঙ লাল। জলবায়ু বাংলার অন্য অনেক এলাকার তুলনায় চরম ভাবাপন্ন। তাই কার্তিক মাসেও আশ্রমে ক্যাসিয়া, জারুল, নাগলিঙ্গম, ছাতিম সব একসাথে ফুটে আছে। আমলকী বা নাগলিঙ্গম গাছজুড়ে ফলও ফলে আছে। সব গাছ যে শতবর্ষের পুরনো তা তো নয়। অনেক গাছই পরে লাগানো হয়েছে। একটু লক্ষ করলে বৃক্ষরোপণে অসাবধানতাটা চোখে পড়ে। বৃক্ষকূলের বেনোজলেরা কী করে যেন ঢুকে পড়েছে। একটা জায়গায় দেখলাম বেশ আয়োজন করে কানফুটা গাছ লাগানো হয়েছে। এই গাছটাকে ঠিক বাংলার গাছ বলা যায় না। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতে বরং সুলভ। একমাত্র এই গাছটাতে বৈজ্ঞানিক নামের প্ল্যাকার্ড লাগানো আছে। তাও সেখানে Flemingia strobilifera নামটার শেষের a–টা লেখা হয়নি। বাংলা নাম দেয়া হয়েছে ‘বিনুনী’। ‘কানফুটা’ নামটা কী দোষ করলো সেটা বুঝলাম না। এবং এই গাছটাকে কেন এতো গুরুত্ব দেয়া হলো সেটাও বুঝলাম না। বৃক্ষবিথী বলতে যা বোঝায় তা এখানে নেই। এই ব্যাপারটা ভালো লেগেছে। কেউ কেউ আছে যারা সবকিছুকে কেটে-ছেঁটে কলেছাঁটা চালের মতো বানাতে ভালোবাসে। আশ্রম যে এখনো অমন কলেছাঁটা চাল হয়নি তাতে স্বস্তি পাই। আবার যাবার আগ্রহ পাই।

এখানে ভয়ের ব্যাপারটা হচ্ছে ভূমিদস্যুদের আগ্রাসণ। অক্টোপাসের মত তাদের শুঁড় নানা শুড়িপথে আশ্রমকে চেপে ধরছে। অবসরপ্রাপ্তদের আবাসভূমি হয়ে গেছে আশপাশের অনেক জায়গাই। তাদের সাজানো-ঘোছানো এক ইউনিটের বাড়ি, তার সামনে-পেছনে বাগান, ভেতরে পোষা রাজহাঁস-কুকুর-বেড়াল দেখে অনেকেই সেখানে শেষ দিনগুলো থাকতে আগ্রহী হতে পারেন। রাস্তাঘাটে জমির দালালদের নোটিশও চোখে পড়ে। কোপাই-খোয়াইও দূষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি। স্থানে-অস্থানে গড়ে উঠেছে ট্যুরিস্ট লজ, মুদি দোকান।

আশ্রমে ঢোকার মুখে গাড়ি থামিয়ে গাইডদের প্রচ্ছন্ন হুমকি, সাইকেল ভ্যানে সস্তার পণ্য সাজিয়ে চলা হকারদের হাঁকডাক দর্শনার্থীদের বিব্রত করে। সাইকেলের পেছনে আইসবক্সে দই আর রাবড়ি নিয়ে দইওয়ালারা যখন অমলের দইওয়ালার মতো হাঁক দেয়,
‘দই, দই, ভালো দই, রাবড়ি!
বাবু দই খাবেন? ভালো ঘরেপাতা দই আছে! রাবড়ি?’

তখন অমলের কথা ভেবে মন কিছুটা উদাস হয় বটে। কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো তাদের পিছু লেগে থাকা, নিবিষ্টমনে কোন স্থাপনা বা শিল্পকর্ম দেখার সময় তাদের ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান কিছুটা বিরক্ত করে বইকি। ভূমিদস্যুদের আগ্রাসণসহ বাণিজ্যের আগ্রাসণ এই বেলাতে নিয়ন্ত্রণ না করলে পরে অনেক দেরি হয়ে যাবে।

মূল প্রাঙ্গনের যে ফটক দিয়ে ‘ব্রাহ্ম মন্দির’ বা ‘গ্লাস হাউস’-এ যাওয়া যায় সেটা দিয়ে বাইরে বের হতে গেলে একটা ছোট নোটিশ চোখে পড়ে। সেখানে যা বলা আছে তার সারাংশ হচ্ছে, ঐ প্রাঙ্গনে কেবল নিরাকার এক ঈশ্বরের উপাসনা করা যাবে, মদ্যপান ও অপবিত্র আমোদ (!) নিষিদ্ধ। নোটিশটা ঢোকার মুখে থাকা উচিত ছিল। নোটিশটা দেখে আমার পাপী মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে এই প্রাঙ্গনে নাস্তিকের স্থান কোথায়?

সে প্রশ্নের উত্তর কোথায় পাওয়া যাবে জানি না। আপাতত যার খোঁজে এসেছিলাম তাকেই খোঁজ করে যাই। সামনে পথ পড়ে আছে বিস্তর।

হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশ্য
আমি বেড়াই ঘুরে দেশে দেশে।

কুল-মান সব গেলো রে
তবু না পেলাম তারে,
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে
তাই তো মোরে দেয়না দেখা সে রে।

ও তার বসত কোথা না জেনে
কয় গগন ভেবে মরে
যদি সেই মানুষের হদিশ জানিস
কৃপা করে আমার সুহৃদ হয়ে
আমার জ্ঞাতি হয়ে বলে দে রে
কোথায় পাবো তারে।


মন্তব্য

সুবোধ অবোধ এর ছবি

বাহ্‌!!
যেন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন সাথে করে।
হাততালি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

মুগ্ধ বিস্ময়ে রুদ্ধবাক হয়ে আপাততঃ তারা দাগিয়ে গেলাম। পরে আবার পড়ে কিছু বলবো। আপনার তীর্থস্থানকে এত অ্যাবস্ট্রাক্ট ভাবে উপস্থাপন করেছেন যে অনুধাবন করতে দাঁত ভেঙ্গে যাবার যোগার! দেঁতো হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

একটু ভুল বুঝেছেন মনে হয়। গোটা লেখার একমাত্র প্রসঙ্গ বহির্ভূত অনুচ্ছেদটা ছিল 'তীর্থ' নিয়ে। আশ্রমের সাথে তীর্থের কোন সম্পর্ক নেই, এবং আশ্রম আমার তীর্থ নয়। তাই ঐ অনুচ্ছেদটা বাদ দিলাম। আবার পড়লে আপনার প্রতিক্রিয়া জানাবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তারেক অণু এর ছবি

হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশ্য
আমি বেড়াই ঘুরে দেশে দেশে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দিবো তার তুলনা কি!
যার প্রেমে জগৎ সুখী
হেরে যে জুড়ায় আখি
সামান্যে কি দেখতে পাবি তারে।

তারে যে দেখেছে সে মজেছে
ছাই দিয়ে সংসারে
মরি হায়।

ওরে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষে মন চুরি করে
আমি কোথায় পাবো তারে?


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

মনে হচ্ছে যেন বৌয়ের কাছে বান্ধবীর গল্প করছেন 'অন্যের বৌ' পরিচয় দিয়ে
অত বেশি নামধাম লুকাচেছন কেন? গল্পটা কিন্তু বেশ মারখাচ্ছে তীর্থ তুর্থ এইসব শব্দের কারণে

০২

ঝেড়ে কাশেন। আমরা অণুপাণ্ডব কেউ না। আমরা না বাস্তবে না গুগলে; কোথা্ও কোনেদিন বেড়াতে যাই নাই
আমরা অন্যের মুখ থেকে শুনি আর চোখ থেকে দেখি

এনালিস্ট এর ছবি

সহমত লীলেনদা, পান্ডবদা অন্তত একবার বললেই পারতেন যে উনি ইয়ে'তে যাচ্ছেন গুরুদেব দর্শনে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এখানে তো গুরুদেব আর তার আশ্রম একটা অংশমাত্র। আর বাকি গল্প তো সব অন্যদের নিয়ে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

গোটা লেখাতে একটা প্রসঙ্গ বহির্ভূত অনুচ্ছেদ ছিল - সেটা তীর্থ নিয়ে। বুঝতে পারছি এটার জন্য আপনি এবং অন্যরা (যেমন উপরে আব্দুল্লাহ্‌ ভাই) ভুল বুঝেছেন। আশ্রমের সাথে তীর্থের কোন সম্পর্ক নেই, এবং আশ্রম আমার তীর্থ নয়। তাই ঐ অনুচ্ছেদটা বাদ দিলাম।

জায়গার নামধাম কিছু লুকাইনি তো। নাম দিয়েছি, ইতিহাস দিয়েছি, কোন পথ ধরে কোথায় যেতে হয় সেটাও বলেছি। এটা ভ্রমণকাহিনী নয়। সেটা হলে সাথে ছবি জুড়ে দেবার কথা ভাবতাম। এটা ভ্রমণজনিত উপলব্ধি। অথবা এটাকে গল্পও ভাবতে পারেন। তাই সেখানে ট্রাভেল গাইড টাইপ বর্ণনা দেবার প্রয়োজন বোধ করিনি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

সরাসরি নাম না দিয়ে পরিচয় প্রকাশ করায় আপনার দক্ষতা প্রশ্নাতীত। তবে লীলেনদার সাথে সহমত প্রকাশ করছি - তুতো সম্পর্ক একটু বেশী হয়ে গেছে।

লেখার শুরুতে একটু ধন্দে পড়ে গেছিলাম আপনি এপারের না ওপারের তা ভেবে!! কিন্তু দারুণ লেগেছে ভাষার কারিকুরি দিয়ে নির্জলা সত্যের প্রকাশে।

লেখা তো সেই রকম হচ্ছে- পরের পর্ব পাবো কবে?

____________________________

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কোথাও কোথাও পপুলার নেম, কোথাও কোথাও বিকল্প নাম ব্যবহার করেছি বটে তবে বেশিরভাগ জায়গায় আসল নামই ব্যবহার করেছি। বিদ্যাসাগর সেতু থেকে বীরভূম পর্যন্ত সব নামই তো আসল নাম।

আমি বাঙালী, আমি গঙ্গা-পদ্মার দুই পাড়ের মানুষ।

পরের গল্প লেখার ইচ্ছে আছে। কখনো লিখতে পারলে আপনারা পড়তে পাবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগলো, বর্ণনা ছবির মত তবে আরেকটু খোলসা করে বললে ভাল হত।
ইসরাত

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঐযে আগে বললাম - এটা ভ্রমণজনিত উপলব্ধি। অথবা এটাকে গল্পও ভাবতে পারেন। তাই সেখানে ট্রাভেল গাইড টাইপ বর্ণনা দেবার প্রয়োজন বোধ করিনি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ব্যাঙের ছাতা এর ছবি

১) গত তিন দিন ধরে মুগ্ধতা নিয়ে পড়ে চলেছি নারায়ণ সান্যাল এর ‘রূপমঞ্জরী’। বইটির প্রথম খন্ডে পেলাম ‘ল্যাংচা’ নামক মিষ্টান্নের নামকরণের ঘটনা। আপনার এই লেখা পড়তে যেয়ে আবার মনে হতেই হেসে ফেললাম।

২) খুব ভালো লেগেছে আপনার এই লেখা। আপনার বিবরণে যেন মনের চোখে সব দেখে আসলাম, অনুভব করে আসলাম। ধন্যবাদ।

‘‘হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশ্যে
আমি বেড়াই ঘুরে দেশে দেশে” শেষের এই উল্লেখ যেন অন্যরকম এক দ্যোতনা দিল।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পড়া ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

না শুধুমাত্র আশ্রম নয়, আমি সামগ্রীকভাবে শান্তিনিকেতনকেই তীর্থস্থান বলে মনে করেছি। ছোটবেলায় একবার নানার বাড়ীতে বেড়াতে গিয়ে জানলাম কাছেই কোথাও চৈত্র সংক্রান্তির মেলা হচ্ছে। আমার চেয়ে বছর কয়েকের বড় কিন্তু বন্ধুস্থানীয় মামাকে খুব করে ধরলাম মেলায় নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে মোটেই গা করলেন না, ফলে খুব মনমড়া হয়ে পড়ে রইলাম। বিকালে মামা বললেন চলো এক কুটুম বাড়ী থেকে ঘুরে আসি, বিষন্নচিত্তে একরাশ অনিচ্ছা নিয়ে তার সাথে হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা জনাকীর্ণ এক বিচিত্র স্থানে উপস্থিত হলাম এবং বিস্ময়াভিভূত হয়ে বুঝতে পারলাম এই সেই চৈত্র সংক্রান্তির মেলা।
লেখার শুরুতে আপনি যখন গুরপ্রীত সিংয়ের সারথ্যে বিদ্যাসাগর সেতু পার হয়ে পশ্চিমের পানে চলেছেন, তখন তো আর জানি না আপনার গন্তব্য কোথায়। বরং মানীয়ার ভোটের রাজনীতি, গুরপ্রীতের পুত্রকন্যা বিষয়ক সুখ দুঃখের কথা, সাদমান-মনোহর ভোরার পথচলতি আলাপচারীতা, ফুলে ফুলে সাদা বরন কাশফুলের দৃশ্য, লতাগুল্মে ঢাকা খালের ধারে কানি বক, ধবল গোবক, মাছরাঙ্গা পানকৌরির সমাবেশ, পথের ধারে ল্যাংচা সহযোগে ডাব সেবনে এতই আচ্ছন্ন হয়ে ছিলাম যে বর্ধমানের আগমনেও ব্যাপার কিছু আঁচ করতে পারি নাই। শেষে যখন বুঝতে পারলাম, মুগ্ধচিত্তে নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা অনুভব করলাম। সামগ্রীকভাবে লেখাটির বিষয়ে মনোভাব আগেই ব্যক্ত করেছি।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

হ্যাঁ, এভাবে ভাবার অধিকার আপনার আছে। আশ্রম অনায়াসে কারো তীর্থ হতে পারে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

বুড়া এর ছবি

নাম-না-জানা ভাস্কর হলেন কে এস রাধাকৃষ্ণন ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ। মূল লেখাটাতে আমার আফসোসটুকু থাক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কড়িকাঠুরে এর ছবি

যেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, হাত নেড়ে নেড়ে দেখালেন সব কিছু।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনি যদি সত্যি সত্যি দেখে থাকেন তাহলে আমার চেষ্টা সার্থক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

সকালে ব্যস্ততার মধ্যে ৫ তারা দিয়ে থেমে যেতে হয়েছিল। এখন আবার ফিরে আসার সুযোগ মিলল।
প্রিয় 'আ' (এই লেখাতে আপনি পাঠক-কে নিয়ে যেরকম ধরা-অধরার খেলা খেলেছেন, তাতে আমিও একটু খেলা করলাম), আপনার লেখা পড়তে পড়তে নানা অনুভূতির দোলায় দুলতে দুলতে যেভাবে আপনার ভ্রমণের সাথে একাত্ম হয়ে যাচ্ছিলাম তা এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা।
"আমরা আমাদের পূর্বাপর ভুলে যাই। যাপিত জীবনের কোন অযোগ্যতা, অপ্রাপ্তি, ক্ষতি বা বিনাশের কথা মনে থাকে না। রাতজাগা পাখির ডাক শুনতে শুনতে আমরা ঘুমে তলিয়ে পড়ি।"
কি করে লেখা যায়, লেখা হয় এমন - আহা!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় অগ্রজ, আপনার চোখকে ফাঁকি দেয়া যে কঠিন সেটা জানি। আর আমি যা বলেছি তার কোন কিছুই তো আপনার অভিজ্ঞতার বাইরে হবার কথা না। তাই আপনার বিনয়বচনকে পুরষ্কার হিসেবেই গ্রহন করলাম। ভালো থাকবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

মন্তব্যটা এতটা ভালো লাগলো যে আঙ্গুল না উচাইয়া পারলাম না - চলুক

____________________________

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

আমি বড় হয়ে এরকম লিখতে চাই গুরু গুরু গুরু গুরু

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আর বড় হবার দরকার নেই, তুমি এখনই এরচেয়ে ভালো লেখো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সত্যপীর এর ছবি

দারুণ।

বাধ-ই-দিওয়ান কথাটার মানে দাঁড়ায় কি?

..................................................................
#Banshibir.

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

@সত্যপিীর, উইকি অনুযায়ী অর্থটা হচ্ছে- ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টার।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

ভাসুরের নামটা মুখেই আনলেন না শেষমেষ। পারলেন কেমনে? গুরু গুরু

তবে একটা ঝড়ে বক মারলাম। কেন যেন যাত্রার শুরুতে আমি ধরে নিয়েছিলাম আপনার গন্তব্য কোথায়। এটা কি এবারের যাত্রা ছিল? নাকি আগের? ছাড়পত্র এত দ্রুত পেলেন সেটাই তো অবাক হলাম। যাওয়া আসা মিলে কদিন লাগলো?।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাঙালীর বিশেষণের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা আছে। এজন্য দেখবেন বড় বড় মানুষদের নামের আগে-পড়ে আমরা এতোসব কিছু জুড়ে দেই যে শেষে তাদের আসল নামটাই ঢাকা পড়ে যায়। তাই অমন মাপের মানুষদের ক্ষেত্রে নাম উচ্চারণ না করে শেষ করাটা কঠিন কিছু নয়।

এটা বোধকরি ঝড়ে বক মরা নয়। আপনি বুদ্ধিমান মানুষ তাই নূন্যতম ক্লু থেকেই ধারণা করে ফেলতে পেরেছেন। যাত্রাটা এবারেরই ছিল। এইতো সপ্তাহ তিনেক হলো। কোন তদবির ছাড়া এতো তাড়াতাড়ি ছাড়পত্র কী করে পেলাম সেটা আমিই ভেবে পাই না। কোন আশা করা ছাড়াই আবেদন করেছিলাম। সব মিলিয়ে লাগলো সপ্তাহখানেক।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।