স্বর্গের নিচে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: সোম, ২৯/০৬/২০১৫ - ৪:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[সচলায়তনে লেখালেখির শুরুর দিকে ‘পাণ্ডবের চীন দর্শন’ নামে কয়েক পর্বের একটা সিরিজ লিখেছিলাম। সেই সিরিজটা গণচীন ভ্রমণ বিষয়ক হলেও সেখানে কোন ছবি ছিল না। ভ্রমণের গল্পও বিশেষ কিছু ছিল না। কিছু পাঠক কয়েক বার ‘ছবি দেন’ বা ‘ছবি নাই ক্যান’ জাতীয় কথা বলে বিরক্ত হয়ে চুপ করে গিয়েছিলেন। সিরিজটা ছবি আর গল্পবিহীন কেন সেই কথা বলতে বলতে এক সময় আমিও চুপ করে যাওয়াটা শ্রেয় মনে করলাম। এরপর থেকে পারতপক্ষে আর কোন ভ্রমণ বিষয়ক লেখা দেবার অপচেষ্টা করিনি। এই লেখাটা ঐ চীন দর্শন সিরিজটার মতো ছবি আর গল্পবিহীন। আসলে বেশ কিছু দিন ধরে গুইলিনের কথা খুব মনে পড়ে মনটা ভার হয়ে আছে। এখানে মনের বোঝা নামালাম মাত্র। ব্যক্তিস্বার্থে করা এই অপকর্মের জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।]

প্রাচীন চীনা প্রবাদ হচ্ছে, স্বর্গের নিচে যা শোভা আছে তার মধ্যে গুইলিনই সবার সেরা (গুইলিন শানশুই জিয়া তিয়ানশিয়া)। আমি জীবনে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি খুব কম। যে সব জায়গায় গেছি তার মধ্যে উল্লেখ করার মতো স্থানের সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। বছর দুই আগে পেটের দায়ে চীন ভ্রমণের সময় যে জায়গাগুলোতে যেতে হয়েছিল তার মধ্যে গুইলিনও ছিল। এভাবে হঠাৎ করেই গুইলিন ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে যাই। ভূস্বর্গে তো আর হুট করে পৌঁছে যাওয়া যায় না! তার জন্য অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয়। তাই পথের শুরু থেকে শুরু করি।

আমাকে প্রথমে যেতে হবে জিয়াঙলান পাহাড়ের কোলের জিয়াঙশানে। জিয়াঙ মানে নদী আর শান মানে পাহাড়। সুতরাং নামেই জিয়াঙশান বুঝিয়ে দিচ্ছে তার চেহারা কেমন। জিয়াঙশানের বুক চিরে গেছে চিয়ানতাঙ নদী আর দক্ষিণ জুড়ে আছে জিয়াঙলান পাহাড়। আগের দিন দুপুরে দেশ ছেড়েছি, তারপর হয় আকাশে নয়তো কোন এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে। হাঙচৌয়ের শিয়াওশান এয়ারপোর্ট থেকে যখন বের হচ্ছি তখন বাড়ি ছাড়ার পরে চব্বিশ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে খাওয়ার ঠিক নেই, ঘুমানোর সুযোগ নেই, একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা। শিয়াওশান থেকে একশ’ চল্লিশ কিলোমিটার বেগে ছোটার মাঝে চিয়ানতাঙ আর চু নদীকে বুড়ি ছুঁয়ে প্রায় তিনশ’ কিলোমিটার দূরের জিয়াঙশান যাচ্ছি, মাঝে চুচৌতে একটা যাত্রা বিরতি আছে। ক্লান্তিতে দুচোখ ভেঙে ঘুম নামতে চাইলেও পথের দুধারের শোভা আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। একই রকমের অবস্থা হয়েছিল এর দুই দিন পরে জিয়াঙশান থেকে তাইচৌ যাবার পথেও।

পথের পাশে চু নদী ঝিলিক দিয়ে যায় বা পাশে দৌড়ে যায়। গণচীনের পূর্বের উপকূলীয় এলাকায় কিছুটা পথ গেলেই একটা ছোট শহর বা একটা বড় শহরের পরিধি চোখে পড়বে। কিন্তু একটু পশ্চিমেই ব্যাপারটা আর অমন নেই। মাইলের পরে মাইল গেলেও দুপাশে মাঠ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। পথঘাট জনবিরল। দেখে মনে হয় না প্রায় দেড় বিলিয়ন লোকের দেশ এটা। জিয়াঙলান পর্বতমালার রেখা কখনো স্পষ্ট, কখনো অস্পষ্ট হলেও দিগন্তবিস্তৃত ভূমি মোটামুটি সমতল। ক্ষেতে মূলত গম আর তুলা – দুটোই ফসল তোলার পর্যায়ে। কোথাও কোথাও সবজিও আছে – সেগুলো শুরুর পর্যায়ে। পথের ধারে কয়েক ভ্যারাইটির রক্তকরবী আর ল্যান্টানার ঝাড় ছাড়া অন্য কোন ফুল চোখে পড়ে না। কোথাও কলাগাছের ঝাড় আছে, তবে কলা দেখতে পাইনি। পূবের শহরগুলোর হাইওয়ে-এক্সপ্রেসওয়েগুলোতে মাঝে মাঝেই বড় বড় ভাস্কর্য দেখা গেলেও এখানে অমনটা নেই।

চু নদীর পানি উপচে নিচু যে জমিগুলো সাময়িকভাবে জলাভূমিতে পরিণত হয় সেখানে জলচর পাখির সংখ্যা দেখে মনে হয় জলের নিচে ভালো পরিমাণে খাবার আছে। কালো টুপি, ধুসর নীল ডানা আর ধুসর গায়ের নিশিবক; কালো টুপি আর রঙধনুরঙের জামাপরা মাছরাঙা; খয়েরী মাথা-গলা-বুক, কালো পিঠ আর সাদা পেট-লেজের চীনা কানিবক; কালো-খয়েরী-সাদার বিচিত্র জামাপরা শরালি এদের কথা মনে আছে। আরো যারা ছিল তাদেরকে ঠিক চিনি না। মাঝে বিরতির সময়ে যখন গাড়ি থেকে নেমেছিলাম তখন রাস্তার পাশে কয়েকজনকে গাছের ডালে বসে থাকতে দেখেছিলাম। তাদের নাম জানতাম না, তবে তাদের গায়ের নীল আর খয়েরী রঙের শার্টটা ভোলার মতো নয়। পরে খুঁজে বের করলাম – শিলাদামা, আগে দেখিনি। তখন মনে হলো যাদেরকে হলুদ ঠোঁটের কাক মনে করেছিলাম তারাও সম্ভবত শিলাদামার আরেক প্রজাতি। স্বীকার করে নিচ্ছি, এই পাখিগুলোর বাংলা নাম আমার জানা ছিল না। তারেক অণুর লেখা থেকে ইংলিশ নামের সাথে মিলিয়ে বাংলা নামগুলো নিয়েছি। আমি এখনো Heron-Crane-Stork-King stork-Coot গণগুলোর বাংলা নাম জানি না।

চুচৌ পৌঁছানোর পর একটু লম্বা যাত্রা বিরতি দিতে হয়, কারণ জিয়াঙশানে যে আমার মেজবান (হায়! তার নামও জিয়াঙ!) সে এখানে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি গাড়ি থেকে নেমে একটা খোলা স্কয়ারমতো জায়গা, যেখানে প্লাস্টিকের চেয়ার-টেবিল বিছিয়ে আর পলিথিনের প্যারাসোল টাঙিয়ে অস্থায়ী সব খাবারের দোকান খোলা হয়েছে, সেখানে বসি। ময়লা টি-শার্ট আর ততোধিক ময়লা ট্রাউজার্সপরা একজন এসে তার নিজ ভাষায় জিজ্ঞেস করে – কী খাবো। আমি ইশারায় পানির বোতল দেখাই। বোতল দিয়ে যাবার সময় জানায় মূল্য তিন ইউয়্যান। আমি সাথে সাথে মূল্য চুকিয়ে দেই। এই দোকানে পানি ভিন্ন অন্য কোন কিছু খাবার ইচ্ছে আমার নেই – নোংরা, অস্বাস্থ্যকর, নাড়িভুঁড়ি উলটে অন্নপ্রাশনের ভাত বের করে আনার মতো গন্ধসমৃদ্ধ। একজনকে দেখলাম বড় কোন চতুষ্পদের লম্বা অন্ত্রের খণ্ডাংশের ভেতর পানি ঢেলে পরিষ্কার করছে। একটু পর সেগুলো চপিং উডে রেখে ধাঁই ধাঁই করে কুঁচি কুঁচি করে ফেললো। তারপর সেগুলো চুলোয় বসানো খাড়া পাত্র, যাতে টগবগ করে পানি ফুটছে, তাতে ঢেলে দিলো। বাতাস ম’ ম’ করে উঠলো চতুষ্পদের অন্ত্রের সুবাসে। চোখ আর নাকের পক্ষে এমন সুখকর পরিবেশে টেকা কঠিন। তার ওপর যখন দেখলাম চপিং উডে বিশালাকৃতির যকৃত-প্লীহা-ফুসফুস ফালি ফালি করে কাটা হচ্ছে, আর সেগুলো ভাজার জন্য রাঁধুনী তাওয়া গরম করছে তখন প্রাণ বাঁচাতে ওখান থেকে উঠে আসাটা শ্রেয় মনে করলাম। জিয়াঙ যখন পৌঁছালো তখন আমার মনে হলো এক যুগ সময় পার হয়ে গেছে।

জিয়াঙ সবে ত্রিশ পার করা যুবক। চেহারা বিশেষত্বহীন, তার বয়সী অন্য উদ্যোক্তাদের মতো উজ্জ্বলও নয়। উঠতি মধ্যবিত্তদের মতো দামী জামা-কাপড়-জুতা-ঘড়ি-সানগ্লাস এবং ততোধিক দামী গাড়ি। জিয়াঙকে ধনী বললাম না এই জন্য যে গণচীনে এখন ধনীর সংজ্ঞা পালটে গেছে। ধনী হবার এখনকার নিম্নসীমাতে জিয়াঙের মতো উদ্যোক্তা কখনো উঠতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। তাছাড়া যাদের ট্যাঁকের জোর ক্ষমতার জোর কম তারাই কর রেয়াত, আর্থিক প্রণোদনা, সস্তা শ্রমিক-ইউটিলিটি ইত্যাদির লোভে পড়ে জিয়াঙশানের মতো ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে কারখানা খোলে। জিয়াঙের সাথে কথা বলে জানা গেলো এই বয়সেই সে তিন সন্তানের জনক। এক সন্তান নীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উঠতি পয়সাওয়ালারা ইদানীং ফুটানি দেখাতে তিন-চারটা সন্তান নেয়। বোঝা গেলো জিয়াঙ সেই দলের।

লিঙ্কনের এসইউভি’র আরামদায়ক সিটে শরীর ছেড়ে দিতে জিয়াঙ জিজ্ঞেস করে খেয়ে নেবো কিনা, আমি রাজী হই না। গাড়ি দক্ষিণ-পশ্চিমে ছুটতে থাকে। জ্বালানী তেল ধাতু মার্কিন মুদ্রার দরদাম ওঠানামা নিয়ে আমরা টুকটাক আলাপ করি। সূর্য সেদিনের মতো বিদায় নেবার আয়োজন করতে থাকে। পাহাড়ী এলাকায় সন্ধ্যা ঝুপ করে নামলেও সমতলে সে একটু রয়েসয়ে আসে। এখানে অমনটাই হলো। আলো যত কমতে থাকলো আমরা ততোই জনবিরল, নীরব এলাকার গভীরে ঢুকতে থাকলাম। জিয়াঙশান শহরটা হঠাৎ করে শুরু হলো। এখানে থাকার জায়গা নিয়ে বিশেষ বাছাবাছি করার উপায় নেই। খাবার দোকানের বেলাও একই কথা প্রযোজ্য। ঠিক হলো যেখানে থাকবো তার দোতলার রেস্তোরাঁতেই খাবো। হোটেল রুমে বাক্সপ্যাঁটরা রেখে নিচে নামতে দেখি জিয়াঙের স্ত্রী এসে হাজির। নাম বললো সিন্ডি। নিঃসন্দেহে সিন্ডি নামটা ইংলিশ শেখার সময় তার শিক্ষকের দেয়া। তার মূল নামটা আর জিজ্ঞেস করলাম না। সিন্ডির ইংলিশ জিয়াঙের চেয়ে ভালো। জানা গেলো কারখানার লেখালিখি আর যোগাযোগের কাজটা সিন্ডিই করে। রেস্তোরাঁতে খাবারের বৈচিত্র্য অপ্রতুল। আমি মাছ, সবজি, ভাতের অর্ডার দিলাম। হঠাৎ দেখি এক জায়গায় কুমড়ো ফুল রাখা। জিজ্ঞেস করলাম, খাওয়া যাবে নাকি? জানা গেলো কুমড়ো ফুল কুঁচি করে ডিমের সাথে মিশিয়ে অমলেট বানিয়ে দেয়া হয়, তো সেই অমলেটও অর্ডার করলাম। কুমড়ো ফুলের অমলেট দিয়ে গেলো যে মেয়েটা সে নিতান্তই পাড়াগাঁ থেকে আসা। আমার মতো চেহারার বিদেশী সে যেমন আগে দেখেনি তেমন কাউকে ছুরি কাঁটাচামচ দিয়ে অমলেট খেতেও দেখেনি। সে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো আমি কী করে খাই। আমি কাঁটাচামচে এক টুকরো অমলেট তুলে মুখে দিতে সে বিস্ময়সূচক শব্দ করলো। আবার চপস্টিক দিয়ে আমি যখন সেদ্ধ বাদাম তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি তখন সে হেসে ফেলছে। যে শহরটার নাম আসলে ‘ঘোস্ট টাউন’ হওয়া উচিত ছিল সেখানে রাতে আর বের হবার কথা ভাবি না। তাছাড়া এতো ক্লান্ত ছিলাম যে হোটেল রুমে ফিরে এসেই ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে জিয়াঙের কারখানায় গিয়ে আমি হতাশ। এটা একটা ওয়ার্কশপের একটু বড় ভার্সান মাত্র। ঠেলেঠুলে একে হয়তো অ্যাসেমব্লিং ফ্যাক্টরি বলা যেতে পারে, কিন্তু ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি নয়। আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম এই ফ্যাক্টরির পার্টস কোথা থেকে আসে! কারণ, জিয়াঙশান এলাকায় সেগুলো তৈরি হবার কথা না। জিয়াঙকে জিজ্ঞেস করতে সে সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার দূরের অন্য একটা প্রদেশের একটা জায়গার নাম বল্‌ল। অতদূর থেকে পার্টস এনে এখানে সংযোজন কী করে পোষায় এমন প্রশ্ন করতে থলের বেড়াল বের হয়ে আসলো। জানা গেলো এমন মফস্বলে হ্রাসকৃত হারে কর, রপ্তানীর ওপর আর্থিক প্রণোদনা, সস্তা শ্রমিক, সস্তা ইউটিলিটি বিলের সুবিধা তো এমনিতেই পাওয়া যায়, ইদানীং এর সাথে সুবিধাজনক শর্তে রাষ্ট্রীয় বা ব্যাংক ঋণও পাওয়া যাচ্ছে। ফলাফল হচ্ছে এই যে, এমন সব এলাকার জমির মালিকরা জমি দেখিয়ে শিল্প স্থাপনের কথা বলে ঋণ নিচ্ছে। ঋণগ্রহীতা সবাইকেই কারখানা বানাতে হয়, তবে সেই কারখানা কতোটা প্রডাকশন দেবে সেটা ভাবার বিষয়। ঋণগ্রহীতাদের একটা অংশ শুরুতেই দামী গাড়ি, বড় শহরে ফ্ল্যাটবাড়ি, বিলাসী জীবনযাপনে ঋণের একটা অংশ খরচ করে বসে। এইরকম ‘গণি মিঞা’ টাইপ ঘটনার ফলাফল আঁচ করার জন্য অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। এই ভ্রমণের দুই বছরের মধ্যে জিয়াঙের কারখানার পরিণতির ব্যাপারে আমার আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

জিয়াঙশানের দুটো দিনে আমি সময় পেলেই অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ খুলে বসেছি। হিংলাজের প্রকৃতির সাথে জিয়াঙশানের প্রকৃতির কোন মিল না থাকলেও কাজেকর্মে যে বেহাল দশায় পড়েছিলাম তাতে মনে মনে হিংলাজের প্রকৃতিকে অনুভব করছিলাম। অমন পরিস্থিতিতে পাত্রবন্দী শাওশিঙের রোহিতাগ্নি কোন অপ্রাপ্তিকে তিরোহিত করতে পারে না। অবধূত হবার সামর্থ্য যাদের নেই তাদের জন্য অবধূতের রচনাই সান্ত্বনা। সিন্ডি আমাকে বাস স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। আমি টিকিট কেটে বাসের অপেক্ষায় বসে থাকি। কয়েকজন ভিক্ষুক ভিক্ষা চেয়ে বিরক্ত করতে থাকে। ভিক্ষুকদের মধ্যে অতি বৃদ্ধ, অপ্রাপ্তবয়ষ্ক, পঙ্গু, অস্বাভাবিক শারিরীক গঠনের সব প্রকারেরই দেখা মিলল। বাসে বসে প্রথমে নিশ্চিত হয়ে নেই ঠিক বাসে উঠেছি কিনা। বাসের সুপারভাইজারকে নিজের গন্তব্যের কথা বলতে সে হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকানোর সাথে একগাদা কথা বলে যায়, আমি কিছু না বুঝেই সায় দিয়ে যাই। সহযাত্রীদের দিকে এক নজর বুলিয়ে টেলিভিশনে চলমান অ্যাকশন মুভিতে মন দেই। মুভিটাকে দক্ষিণ ভারতীয় মুভির চীনা ভার্সান বলে মনে হয়। অমন পেশিবহুল নায়ক, লুতুপুতু নায়িকা, বীভৎসদর্শন ভিলেন, উদ্ভট অ্যাকশান, প্রচুর ভায়োলেন্স, অপ্রয়োজনীয় ভীরু যৌনতা। সাথে গানও আছে প্রেমের, বিরহের, বিদায় বা মৃত্যুকালীন সময়ের, নাইটক্লাবে মদ খেয়ে মাতাল হবার সময়কার। এমন মুভি বোঝার জন্য ভাষা না জানাটা কোন বাধা হয় না, সাবটাইটেলেও চোখ রাখতে হয় না। মুভি শেষ হয়ে স্ট্যান্ডআপ কমেডি শো শুরু হলে আমি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই।

জিয়াঙশান থেকে তাইচৌ যাবার পথের ধারে ডঙইয়াঙ আর লিঙ নদী বার বার বাঁক খেয়ে গেছে বা ছোট খাঁড়ি ঢুকে পড়েছে। কোথাও কোথাও অক্সবো। পাশের ছোট বড় কারখানাগুলোর কোন কোনটা থেকে নদীর পানিতে বিষ মিশছে। সেখানে জলের রঙ লজ্জাকর। এসব নিয়ে আজকাল কথা ওঠে, কথা হয়, প্রতিবাদও নাকি হয়। এসব প্রতিবাদ নিয়ে তিয়ানজিন, দা চিন তাই আর হেয়্যুয়ানে প্রতিবাদকারীদের ওপর পুলিশের অভিযানের খবরও শুনেছি। নদীর তীর নিচু,পানি অগভীর,তীরভর্তি নুড়িপাথর। রাস্তার পাশ থেকে নদী পর্যন্ত বা কোথাও পাহাড়ের কোল পর্যন্ত ফসলের ক্ষেত। সেখানে ধানই বেশি,তবে গম,কচু,পদ্ম আর অন্য সবজির ক্ষেতও আছে। কোন কোন ক্ষেতে আমাদের দেশী গরুর মতো শীর্ণদেহী গরু চরে বেড়াচ্ছে, তার পিঠে ফিঙের মতো পাখি। ক্ষেত,নদী আর পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে হেরন আর স্টর্কের মতো ওয়েডারের দল। কানি বকের সাইজেরটার পিঠের রঙ আমাদেরটার মতো ধুসর নয়,ধবধবে সাদা। কিংস্টর্কের গলাটা কেমন যেন দুইটা হাঁটুর মতো ভাঁজখাওয়া। হোৎকা হেরনটার গায়ের যেখান থেকে গলাটা শুরু হয়েছে সেখানে আবার কমলা রঙের একটা ছোট ঘাগড়া রয়েছে। আকারে রিঙের মতো হলে মেখলা বলতাম,কিন্তু এটা গলার দিকের কড়া রঙ থেকে গায়ের দিকে হালকা হয়ে গেছে তাই ঘাগড়া বললাম। ছোট বড় সব ওয়েডারের সাথে গরুদের বেশ ভাব আছে দেখলাম। দুয়েকটা গেরস্থ বাড়ি থেকে মুরগীর দলকে বের হতে দেখলাম। এই মুরগীগুলো স্বাস্থ্যবান হলেও ফুজিয়ানের মুরগীগুলোর মতো বুকফোলানো নয়। চড়ুইগুলো আমাদেরগুলোর মতো,জিয়াঙসুর চড়ুইয়ের মতো হোৎকা নয়। কাক, চিল বা কোন স্ক্যাভেঞ্জার চোখে পড়লো না।

তাইচৌ যখন পৌঁছাই তখন সূর্য পাটে গেছে। ততক্ষণে জিয়াঙশানের অস্বস্তি মন থেকে মুছে গেছে। এই অঞ্চলের বেশিরভাগ শহর আমার পরিচিত। এখানে বহুবার এসেছি, আর তার অনেক কথা আগে বলেছি। তাই এখানে আর তাইচৌয়ের কথা বললাম না। তাছাড়া শুরু করেছিলাম তো গুইলিনের কথা বলার জন্য। গুইলিন যাবার জন্য তাইচৌ থেকে নিঙবো গিয়েছিলাম। কারণ, তাইচৌ থেকে গুইলিন যাবার কোন ফ্লাইট নেই। এখন অবশ্য নিঙবো থেকেও গুইলিন যাবার ফ্লাইটও নেই। যাত্রীর অভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। খুব ভোরে নিঙবো থেকে গুইলিনের উদ্দেশ্যে যখন ফ্লাইট ছাড়ে তখন নিচের দিকে তাকিয়ে স্বস্তি অনুভব করি। পুরোটা পথ আকাশযান বেশ কম উচ্চতা দিয়ে উড়ে গেলো। তাতে কালচে পাহাড়ের সারির আস্তে আস্তে সবুজ হয়ে যাওয়া, প্রশস্ত নদীর সরু হতে হতে পাহাড়ী নদী হয়ে যাওয়া, ফুলেভরা উপত্যকা, গ্রস্থ উপত্যকা, ছোট হ্রদ, নদীর দ্বীপ সবই দেখা গেলো। সময়টা গ্রীষ্মকাল তাই ছুটি কাটাতে যাওয়া পর্যটকরাই দলে ভারি। বড় বড় টিমও আছে। একটা টিম পরিবারের ছোট বড় নানা সাইজের সদস্যে পূর্ণ। তারা যে কোন ঘটনায় হর্ষধ্বনি দিয়ে যাচ্ছে – তা সে প্লেন টেকঅফ করুক, বাম্প করুক, মেঘের ভেতরে ঢুকুক বা তীব্র রোদে পড়ুক! সেই দলের বছর দেড়েক বয়সের এক ক্ষুদে সদস্য আমার সামনের সিটে বসা। পেছনে ফিরে এই অদৃশ্যপূর্ব চেহারার জীবটিকে দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছে। তারপর একসময় চিড়িয়াখানার বানরকে কলা বা বাদাম দেবার মতো করে আমাকে ক্যান্ডি সাধতে লাগলো।

গুইলিনের লিয়াঙজিয়াঙ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটিকে দেখলে আমাদের চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের কথা মনে পড়বে, কেবল আকারে আরো বড়। বিমানবন্দরের ফরমালিটি সেরে বাইরে বের হতে দেখি কেউ আমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। আমি একটু অবাক হয়ে ট্যাক্সির খোঁজ করার জন্য বাইরে পা বাড়াতে এক হান যুবতী আমার দিকে এগিয়ে সহাস্যে বললো,
- পাণ্ডব! আমি তাঙ রৌমেঈ!
- তুমি আমাকে চিনলে কী করে?
- তোমার ছবি তো আগেই দেখেছি। তাছাড়া এই ফ্লাইটে তুমি ভিন্ন আর তো কোন বিদেশী নেই।
- তা ঠিক! তোমাকে ছবিতে যা দেখেছিলাম বাস্তবে তুমি তার চেয়ে আরো অনেক সুন্দরী।
- ওসব কথা রাখো। যে গরম পড়েছে তাতে তোমাকে তো জিনস্‌-টী শার্ট পরে আসতে বলেছিলাম। তার বদলে তুমি এই ধরাচূড়া পরে এসেছ কেন?
- প্রথম কথা হচ্ছে, আমি প্রমোদভ্রমণে আসিনি তাই অমন পোশাক পরা যাবে না। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে আমার টী শার্ট থাকলেও জিনস্‌ নেই।
আমরা খোলা কার পার্কের দিকে এগিয়ে যাই। সেখানে তাঙের দুজন সহকর্মী গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের সাথে পরিচিত হলাম। দেখা গেলো তারা যে গাড়ি নিয়ে এসেছেন সেটা খুবই সাধারণ একটা গাড়ি। বুঝলাম অতিথিকে দামী গাড়িতে চড়িয়ে ফুটানি দেখানোর পূর্ব দিকের কালচারটা এখনো গুইলিনে এসে পৌঁছায়নি। আমি আসন্ন ফুটানির ধরন কেমন হতে পারে সেটা ভাবতে ভাবতে রাস্তার পাশের দৃশ্যে মন দিলাম। এখন স্বর্গের নিচে ভূস্বর্গে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, সুতরাং চোখকান খোলা রাখতে হবে।

তাঙকে জিজ্ঞেস করলাম, এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল কতদূর? উত্তর দিল, এই চল্লিশ মিনিট লাগবে। গুইলিনে যে কয়দিন ছিলাম সে কয়দিন এই চল্লিশ মিনিটের চক্কর থেকে বের হতে পারিনি। যাকেই জিজ্ঞেস করি, অমুক জায়গায় যেতে কতক্ষণ লাগবে? উত্তর, চল্লিশ মিনিট। কাউকে জিজ্ঞেস করলাম, আমার হোটেলে আসতে তোমার কতক্ষণ লাগবে? উত্তর, চল্লিশ মিনিট। অনেকটা সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় ‘মা খু চিহ্‌ল্‌ ও পঞ্জাম্‌ হস্তম’-এর মতো! এয়ারপোর্টের রাস্তা পার হতে যে জিনিসটা প্রথমে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সেটা পাহাড়। এতদিন আমার অভিজ্ঞতায় ছোট ঝোপওয়ালা লালমাটির পাহাড়, লতানো ঝোপওয়ালা কালো পাথরের পাহাড় আর উদ্ভিদবিরল বরফেঢাকা পাহাড় ছিল। এবার তারসাথে মার্বেল আর চুনাপাথরের সাথে লালমাটির মিশেল দেয়া, উঁচু উঁচু বৃক্ষে ঢাকা পাহাড় যুক্ত হলো। এমন ঘন বৃক্ষে ঢাকা হলেও বৃক্ষগুলোর প্রথম চার/পাঁচ মিটারে কোন ডালপাতা না থাকায় মূল পাহাড় চোখের আড়াল হয় না। অথচ উপরের ক্যানোপির জন্য গোটা পাহাড়টাকে সামিয়ানা খাটানো বলে মনে হয়।

এমন দৃশ্যের ভেতর হঠাৎ অদূরে পাহাড়সমান উঁচু দুটো সাদাটেরঙা বিশাল ডমরু দেখা যায়। তা থেকে সাদা রঙের মেঘের মতো ধোঁয়া বের হচ্ছে। ওই ডমরু দেখে আমার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এই ভূস্বর্গে নিউক্লয়ার রিঅ্যাকটর বসানোর দুর্বুদ্ধি কার! কী উৎপাদিত হয় এখানে – বিদ্যুৎ নাকি মারণাস্ত্র, চিকিৎসা সহায়কদ্রব্য নাকি কৃষি সহায়কদ্রব্য? যা কিছু উৎপাদিত হোক চুল্লীটা তো আছে! একটা দুর্ঘটনা হলে তখন কী হবে! ভেবে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। একটু যেতে দেখি মাথার ওপর দিয়ে একাধিক ট্রেন লাইন যাচ্ছে। কোনটা ব্যবহারোপযোগী, আর কোনটা নির্মাণাধীন। তাঙ জানালো বছরখানেকের মধ্যে হাইস্পীড ট্রেন দিয়ে দেশের বড় বড় শহরগুলোর সাথে গুইলিনের যোগাযোগ তৈরি হয়ে যাবে। সত্যি তাই, আজ গুইলিন থেকে ট্রেনে করে আড়াই ঘন্টায় কুয়াঙচৌ, সাড়ে নয় ঘন্টায় সাঙহাই আর সাড়ে দশ ঘন্টায় পেইচিঙ পৌঁছানো যায়।

এয়ারপোর্ট এক্সপ্রেসওয়ে শেষ হতে যে শহুরে রাস্তায় পড়ি সেটা নিতান্তই সাদামাটা। আসলে গোটা গুইলিনই একটা সাদামাটা শহর। পূর্ব উপকূলীয় এলাকায় কম গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর চাকচিক্য-জৌলুসও এরচেয়ে বেশি চোখ ধাঁধানো। পূর্ব আর দক্ষিণ-পূর্ব ছাড়া গণচীনের আর সব অঞ্চল সব বিষয়ে এখনো অনেক পেছনে পড়ে আছে। আমার যে হোটেলে থাকার কথা সেখানে যেতে বেশি সময় লাগার কথা না কিন্তু কী কারণে যেন ড্রাইভার এমনসব রাস্তায় চলা শুরু করলেন যেটা দেখেই বোঝা যায় এটা ঠিক পথ নয়। বিদেশী অতিথিকে পথের গোলকধাঁধায় ফেলার একটি প্রাচীন ঐতিহ্য কিছু চীনার মধ্যে আছে। তারা ঢাকার গুলিস্তান থেকে টঙ্গী নিতে বললে প্রথমে গাবতলীর দিকে রওনা দেবে তারপর মানিকগঞ্জ, পাটুরিয়া দিয়ে একবার পদ্মা পার করিয়ে বৃহত্তর ফরিদপুর, তারপর আবার পদ্মা পার করিয়ে বৃহত্তর পাবনা, তারপর যমুনা পাড়ি দিয়ে টাঙ্গাইল, গাজীপুর ঘুরিয়ে টঙ্গীতে পৌঁছাবে। এক যুগ আগে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের একটা শহরে নেবার জন্য এক চীনা ভদ্রলোক আমাকে দুইশ’ দুইশ’ করে চারশ’ কিলোমিটার বাসে আর শ’তিনেক কিলোমিটার বিমানে চড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অমন আরো অভিজ্ঞতা থাকায় আমি বুঝলাম আমাকে অমন ঘাস খাওয়ানোর চেষ্টা চলছে। বিরক্ত হয়ে তাঙকে বললাম,
- মূল পথ ছেড়ে এই অলিগলির পথ ধরেছ কেন? গাড়ি তো দেখতে পাচ্ছি শহর ছেড়ে উপকণ্ঠের দিকে চলে যাচ্ছে!
- আসলে এই সময়টাতে মূল রাস্তার ট্রাফিক খুব খারাপ থাকে তো তাই একটু ঘুর পথে যেতে হচ্ছে।
বুঝলাম ব্যাখ্যাটা সবৈর্ব মিথ্যা। প্রথমত, সময়টা অফিস অথবা স্কুলের শুরু বা শেষ হওয়ার সময় নয়। তাছাড়া গুইলিন জনবহুল ব্যস্ত শহর নয়। পরে দেখেছি, গুইলিনে যে কয়দিন ছিলাম তাতে কোন দিন কোন সময়ে ট্রাফিক জ্যামে পড়তে হয়নি।

ঘুরতে ঘুরতে শহরের যে জায়গাটাতে আমরা এসে পড়েছি সেখানটার রাস্তা-বাড়িঘর-কালভার্ট সব কিছুকে খুব চেনা চেনা লাগে। মনে হয় বাংলাদেশের কোন জেলা শহরে চলে এসেছি। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে, ভ্যাপসা গরম। একটা জায়গায় কাদায় গাড়ির চাকা আটকে গেলো। ইটের চিমনীওয়ালা একটা পরিত্যক্ত কারখানার পাশে লাল কাদামাটি ভরা একটা মাঠ। তাতে বড় বড় কয়েকটা গাছ। সেই গাছের নিচে অয়েলক্লথ বা চট বিছিয়ে বাজার বসেছে। মূলত সবজি, ফল, হাঁসমুরগী, মাছমাংস বিক্রি হচ্ছে। লাউ-চালকুমড়ো, বেগুন-টমেটো, শশা-চিচিঙ্গা, কলা-কাঁঠালের পাহাড় দেখে কে বলবে এটা বাংলাদেশের কোন হাট না! থকথকে কাদাতে ডালায় সাজিয়ে রাখা মাছ কিনছে রাবারের গামবুটপরা ক্রেতার দল, একটা কাঠের গুঁড়িতে মাংস রেখে ধাঁই ধাঁই করে চাপাতি চালাচ্ছে তরুণ মাংসবিক্রেতা তার পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করছে কয়েকটা নেড়ি কুকুর। বুড়োরা বসে গল্প করছে, কৃষকরা জটলা করে সিগারেট টানছে, অন্ধ ভিখিরী গান গেয়ে ভিক্ষা চাইছে, ছোট বাচ্চা কাঠিতে গাঁথা কাবাব খাচ্ছে। আইসক্রীমওয়ালা জালার মতো আইসক্রীমের গাড়ি নিয়ে হাঁক দিচ্ছে, একটা ঠেলাগাড়িতে বোঝাই করে সবজি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব দেখে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। বহুকাল আগে উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের কথা মনে পড়ে যায়।

লী জিয়াঙ বা লী নদী গোটা গুইলিন শহরটাকে শাখাপ্রশাখা দিয়ে স্থানে স্থানে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। নান্‌ এরহুয়ান লু’র (সাউথ রিং রোড) সমান্তরালে লী নদীর একটা শাখা আছে। আবার নান্‌ এরহুয়ান লু যেখানে চৌশান নান্‌ লু (সাউথ চৌশান রোড)-কে আড়াআড়ি কেটে গেছে সেখানে লী নদীর শাখা থেকে একটা প্রশাখা চৌশান নান্‌ লু’র সমান্তরালে বের হয়ে ইংলিশ বর্ণ ‘T’-এর মতো সৃষ্টি করেছে। এই ‘T’-এর মাথায় নদীর কূল থেকে একটু দূরে বাঁধ দিয়ে একটা জায়গা তৈরি করা হয়েছে যেটা জোয়ারের সময় প্লাবিত হয়ে কোমর ছাড়িয়ে যায়। ভাটার সময়ে পানি নেমে পায়ের পাতায় নেমে আসে। এই কৃত্রিম জলাটার তিন দিক জুড়ে গাছ, ফুলের বাগান, বসার জায়গা, হাঁটার জায়গা সব বানিয়ে একটা পার্কমতো করা হয়েছে। জোয়ারের সময় এই জলার ধারে ঘন্টার পর ঘন্টা অনায়াসে বসে থাকা যায়। জলার ধারের রাস্তার ঠিক অপর পাশের হোটেলে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। হোটেলের তিনতলার রেস্তোরাঁতে বসলে জলাটার পুরো দৃশ্য দেখা যায়। এই রেস্তোরাঁতে লী নদীর মাছের স্বাদ নেবার ব্যবস্থা আছে। রাতে খাবারের অর্ডার দেবার সময় তাঙ কী কী যেন বুঝিয়ে বলল, ব্যাস পুঁটিমাছের ঝাল ঝোল চলে আসলো। বাংলার বাইরে মাছের এমন সুস্বাদু ঝোল আমার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল। একটা কার্পের মাথা আসে লাল ঝোলে ডোবানো। ঝোলের উপরে লাল-হলুদ-সবুজ মরিচের কুঁচির একটা পরত। এই হুনানী রান্নাটি আগে অনেকবার খেয়েছি। পিৎসা ভিন্ন অন্য কোন খাবারে আমি কখনো একাধিক প্রকারের মাংসের ব্যবহার বোধহয় দেখিনি। এই দফা একটা স্যুপ দেখলাম যেখানে হংস আর বরাহ পাশাপাশি বিরাজমান। তার রঙ-গন্ধ কোনটাই রুচিকর নয়। একটা লম্বা, খুব সুস্বাদু মাছ খেলাম। নাম বল্‌লো ছুরি মাছ, তাও নাকি নদীর ছুরি মাছ। পানিফলকে দেখলাম বাদামের মতো শুকিয়ে শুকনো খোলায় ভেজে অথবা সেদ্ধ করে অথবা রান্না করে খাওয়া হয়। এই দফাতে তিনটার স্বাদই নিয়েছি – বিশেষ ভালো লাগেনি। আমি খাদক শ্রেণীর মানুষ নই, তাই খেতে বসলে বেশিক্ষণ চালাতে পারি না। গলা পর্যন্ত আইঢাই খাওয়ার চেয়ে বাইরে বের হয়ে রাতের গুইলিন দেখাটা বরং বেশি ভালোবাসবো।

গুইলিনে নাইট লাইফ মানে নাইট মার্কেটে ফঙ্গবেনে জিনিসের দোকানে দোকানে ঘোরা আর ডিসকোতে হতাশ লোকজনের জোর করে আনন্দ করা দেখা। অল্প কিছু রাস্তা ছাড়া গুইলিনের বাকি এলাকা রাতে ঘোরাঘুরি করার জন্য খুব একটা নিরাপদ মনে হয়নি। তাঙ আমাকে ফু ওয়াঙ লু’র নাইট মার্কেটে নিয়ে যায়। যে কোন শহরের ফুটপাথে বিক্রি করে এমন সব জিনিসের পসরা দেখলাম, সাথে বিপুল সংখ্যক অস্থায়ী খাবার দোকান। নলের বাঁশি বেচতে দেখলাম। এই এলাকার নল বন বিখ্যাত। আমার কেনার কিছু ছিল না। তাছাড়া মার্কেট এলাকা বেশ গরম। তাই আমরা লী নদীর তীর ধরে নান্‌ এরহুয়ান লু দিয়ে বিন জিয়াঙ লু দিকে হেঁটে যাই। কাজের কথার বাইরে অন্য সব বিষয়ে গল্প করি। তাঙ স্থানীয় মানুষ। পড়াশোনা করতে এক পর্যায়ে সাঙহাইয়েও কিছু দিন ছিল। কিন্তু বড় শহরে কাজের প্রচুর সুযোগ থাকার কথা থাকলেও ঠিক মন মতো কাজ পাওয়া এতো সহজ নয়। সব সঞ্চয় ফুরিয়ে গেলে ব্যর্থ তাঙ শেষে গুইলিনে ফিরে আসে। ইংলিশ জানায় এখানে কাজ পেয়ে যায়। কিন্তু তাঙ জানে এখানে কাজের সুযোগ খুব কম। চাইলেও চাকুরি পালটানো যাবে না। তাছাড়া এমন এলাকার কোম্পানিগুলো স্থবির ধরনের হয়। নিজেদের বিশেষ উন্নতি করার চেষ্টাও এরা করে না। বস্তুত গণচীনের অধিকাংশ এলাকায় এমন স্থবির শহর আছে যার জীবনের সাথে পেইচিঙ-সাঙহাই-কুয়াঙচৌ-তিয়ানজিনের জীবনের তুলনা হয় না। স্বাভাবিকভাবেই তাঙের মতো ঝকঝকে গতিশীল তরুণী ভবিষ্যতের কথা ভেবে হতাশায় মুষড়ে পড়ে। লী নদীকে ডানে রেখে বিন জিয়াঙ লু ধরে তারাভরা আকাশের নিচে ঐ নিদাঘ রাতে তাঙের গল্প শুনতে শুনতে হেঁটে যাওয়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা শান হু বা শান হ্রদে চলে আসি। চার হ্রদ আর দুই নদীর শহর গুইলিনের বাকি তিনটা হ্রদ হচ্ছে রঙ, গুই আর মুলঙ। লী ছাড়া অন্য নদীটা হচ্ছে তাওহুয়া। শান হু আর রঙ হু সরু চ্যানেল দিয়ে যুক্ত। এগুলোর মাঝে আবার ছোট দ্বীপ আছে। শান হু’র দ্বীপে রিয়্যু শুয়াঙতা নামে একটা পার্কে নয় তলা উঁচু সান টাওয়ার (রি তা) আর সাত তলা উঁচু মুন টাওয়ার (ইয়্যু তা) দুটো প্যাগোডাসদৃশ টাওয়ার আছে। রি তা-কে হলুদ আলো আর ইয়্যু তা-কে নীল আলোয় সাজানো হয়েছে। দেখতে অপার্থিব লাগে। এই যাত্রার বেশ কয়েক বছর আগে কিছু দিন দক্ষিণ-পূর্বের ছোট শহর নিঙদিতে ছিলাম। প্রতিদিন ভোরে নিঙদি থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে কাজে যেতে হতো, আবার সন্ধ্যার পর ফিরতে হতো। যাওয়া আসার পথে পাহাড়ের ওপরে এমন উঁচু উঁচু টাওয়ারের মতো প্যাগোডা দেখতে পেতাম। সেগুলোও রাতের বেলা এক একটা আলোকস্তম্ভ হয়ে যেতো। নিঙদিরগুলোর সাথে এই দুটোর পার্থক্য হচ্ছে ওগুলো ছিল পাহাড় চূড়ায় আর এগুলো মোটামুটি হ্রদের জল ফুঁড়ে উঠেছে। দিনের বেলা হলে কাছে গিয়ে দেখা যেতো তাছাড়া হাতে অতো সময়ও ছিল না। আমি হোটেলে ফিরে যাই।

লুচিয়াঙ নদীর তীরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চ্যাঙদের কারখানাতে যখন পৌঁছাই তখন মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি চলছে। আমি কারখানার প্রাঙ্গন আর তার বাইরের গাছ দেখি, ঝোপ দেখি, আগাছা দেখি। ঘাসগুলো দেখি মরু ঘাসের মতো সরু কাঁটার মতো হয়ে গেছে। এটা হয়তো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা আর আর্দ্রতার ঘাটতির জন্য হয়েছে। এতো রঙের ঝুমকো জবা আগে দেখিনি। নানা রকমের প্রুনের ঝাঁকালো অনুচ্চ মাথা রাস্তার পাশ আর পাহাড়ের পাদদেশ ঘিরে রাখে সাথে লেবু আর Osmanthus-এর ঝাড়। বাংলাদেশে Osmanthus গণের কোন সদস্য স্বাভাবিকভাবে হয় না। কেউ বিদেশ থেকে এনে লাগালে ভিন্ন কথা। এজন্য এর বাংলা নাম নেই। হিমালয়ের চারপাশে এর পাদদেশ এলাকায় Osmanthus-এর কয়েক ডজন প্রজাতি পাওয়া যায়। সাদা থেকে হলুদ হতে হতে কমলা রঙ হওয়া পর্যন্ত চার/পাঁচটা রঙের যে osmanthus গুইলিনকে রঙিন আর সুরভিত করে রাখে সেটা sweet osmanthus। আগে এক সময় বলেছিলাম চীনারা খাবারের ব্যাপারে উদার। তো তাদের সেই উদারতা থেকে sweet osmanthus-ও বাদ পড়েনি। চা, চাটনি বা সস্‌ বানিয়ে খাওয়া তো আছেই এমনকি পিঠাতেও দিয়ে খায়। তবে যা শুনে অবাক হয়েছি তা হচ্ছে sweet osmanthus থেকে ওয়াইনও তৈরি হয়। আইস ওয়াইনের মতো হালকা আর মিষ্টি, তবে চাখার সুযোগ পাইনি।

চ্যাঙ বছর ত্রিশেকের যুবক, স্থানীয় নয়। সে এসেছে তিয়ানজিন থেকে। একথা শুনে আমি ভুরু কোঁচকাই। কারণ, তিয়ানজিন হচ্ছে গণচীনের সবচে’ উন্নত পাঁচটা মহানগরের একটা। সেখানে থাকা, কাজ, চলাচল, নাগরিক সুবিধা যে পর্যায়ের তার সাথে গুইলিনের মতো ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরের কোন তুলনাই হয় না। আমি চ্যাঙকে প্রশ্ন করি। উত্তরে একটু বিব্রত চ্যাঙ বলে গণচীনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়াটা খুব সহজ নয়, সেখানে গাওকোয়া নামের একটা এন্ট্রেন্স পরীক্ষাতে ভালো ফলাফল করার ব্যাপার আছে। আবার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খরচ খুব কম নয় যদিও তাদের অনেকের মান নিয়ে সন্দেহ আছে। (হায়! চ্যাঙ কাকে এই গল্প শোনায়!) পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুনাম বেশি, তাই সেখানে ভর্তির প্রতিযোগিতাটাও প্রবল। এজন্য সেখানকার অনেকে উত্তর, পশ্চিম বা মধ্যাঞ্চলের অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করে। চ্যাঙের গল্পটাও তাই, গুইলিন কারিগরী বিশ্ববিদ্যালয়ে জলপানি পেয়ে তিয়ানজন ছেড়ে গুইলিনে এসে পড়া, পড়া শেষে এখানেই চাকুরী খোঁজা, চাকুরী পাওয়া, স্থানীয় কন্যার পাণিগ্রহন। এভাবে তিয়ানজিনের চ্যাঙ গুইলিনের চ্যাঙ হয়ে যায়। কিন্তু চ্যাঙ কি এখানে ভালো আছে? তার অ্যাপিয়ারেন্সে, তার কথায় বোঝা যায় যে তার আয় যথেষ্ট নয়। মাসখানেক হয় সে নতুন বাবা হয়েছে। শুধুমাত্র পুত্রের প্রসঙ্গ উঠলে তার মুখ আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। মোবাইল ফোনে পুত্রের ছবি দেখায়। বলে, পুত্র খুবই বুদ্ধিমান আর স্মার্ট! মাসখানেক বয়সী পুত্রের পিতার অমন ধারণা হতেই পারে। পুত্রকে নিয়ে করা গল্প শেষ হলে চ্যাঙের মনে পরে রাতের খাবারের জন্য বাসায় বাজার করে নিয়ে যেতে হবে। আমি আগ্রহ নিয়ে তার সাথে বাজারে যাই। চ্যাঙ এটাসেটা অনেক দরাদরি করার পর শেষে আধখানা চালকুমড়ো আর আধ কেজি শুকরের অন্ত্র কেনে। সদ্যপ্রসূতির পুষ্টির জন্য কেনা বাজারের এই চেহারা দেখে চ্যাঙের অবস্থা বুঝতে আর কষ্ট হয় না। বাহ্যিক সৌন্দর্যে গুইলিন ভূস্বর্গ হলেও চ্যাঙের কাছে তা দণ্ডকারণ্য ছাড়া কিছু নয়।

গুগলে কেউ গুইলিনের ছবি খুঁজতে নিলে দুটো ছবি অবধারিতভাবে আসবে – একটা শিয়াঙ বিশান (হাতি শুঁড় পাহাড়)-এর আর আরেকটা পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে নানা রঙের ফসলের ক্ষেতের। লী নদী ধরে আগালে মহাযানী বৌদ্ধদের সাথে সম্পর্কিত বোধিসত্ত্বা সমন্তভদ্র ওরফে পুশিয়ান-এর মন্দির মাথায় নিয়ে হাতির মাথার মতো দেখতে শিয়াঙ বিশান আমার হোটেল থেকে অল্প দূরে। আর নদী পথে শহর থেকে বের হলে পাহাড়ের ধাপে ধাপে আর উপত্যকায় ধান, গম, চা, বেলী ফুল, সরষে, তিল তিসির মতো নানা রকমের ফসলের নানা রঙের ক্ষেত যে দৃশ্য তৈরি করেছে সেটা মানুষের কল্পনায় আসে না। লী নদী ধরে ইয়াঙশৌ পর্যন্ত গেলে পাহাড় আর মাঠের এমন আরো বহু দৃশ্য, বহু প্রাকৃতিক নিদর্শন চোখে পড়বে। নদীর পাড় খাড়া আর উঁচু বলে নদীর পানিতে তাদের প্রতিফলন পড়ে পুরো দৃশ্যটাকে ক্যালেন্ডারের পাতা বানিয়ে ফেলে। শহরের উপকণ্ঠে খুব কাছেই একটা দর্শনীয় স্থান হচ্ছে লু দি ইয়ান (নলের বাঁশীর গুহা)। জলার পাশে পাহাড়ে চুনাপাথরে ক্ষয় হয়ে গুহা তৈরি হয়েছে। ভেতরে স্ট্যালাকটাইট আর স্ট্যালাগমাইটের কারিকুরি সাথে আছে তাঙ রাজবংশের আমলের প্রস্তরলেখ। পর্যটকের ভীড় কম থাকলে গুহার বাইরে নলখাগড়ার বন, আঁকাবাঁকা পায়েচলা পথ, ছোট পুকুর, সেতু, কাঠ আর পাথরে বানানো বসার জায়গা, বাগান এগুলো দেখে দিন পার করে দেয়া যায়। তবে গুহার ভেতরে হরেক রঙের আলো, বিশেষত লেজার লাইট, দিয়ে যে চোখ ধাঁধানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে সেটা এই স্থানের পরিকল্পকদের চিন্তার দীনতার পরিচায়ক।

গুইলিনে যে কেবল পর্যটকেরা আসে তা নয়। এখানে আমার মতো পেটের দায়ে আসা লোকই বেশি, যারা এক-আধবেলা ঘোরে বাকি সময়টা কাজের ধান্ধায় থাকে। আমার মতো মানুষদের গুইলিনে আসার কারণটা মূলত এর মাটির নিচে লেখা আছে। নানা রকম আকরিকে এই এলাকা সমৃদ্ধ। তাছাড়া যারা নিজেদের ফ্যাক্টরির বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি কিনতে চান তারাও এখানে আসেন। যে যুগে দুনিয়াজুড়ে বাম সরকাররা ভারিশিল্প দিয়ে শিল্পবিপ্লব করে দেশের চেহারা বদলে দেবার কথা ভাবতো সে আমলে গুইলিনে অমন বড় বড় শিল্প কারখানা বসেছিল। আজ সেগুলোর অনেকগুলোই হয় অচল নয়তো কী করে যেন ব্যক্তি মালিকানায় চলে গেছে। হুয়াঙদের কোম্পানিটা অমন একটা সাবেক সরকারি কোম্পানি। খোদ শহরের বুকে নানা জায়গায় তার জমিজমা, স্থাপনা, কারখানা আছে। সেগুলোর কিছু ঘুরিয়ে এক দুপুরে হুয়াঙ আমাকে নিয়ে আসে আমাদের ইপিজেডে’র মতো একটা শিল্পাঞ্চলে, যা শহর থেকে সেই চল্লিশ মিনিটের দূরত্বে। সেখানে হুয়াঙদের কারখানার একটা ইউনিটে দেখি অদ্ভূত আকৃতির, বিশাল, খাড়া, ভারি ভারি সব পাত্র। এমন জিনিস আমার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল। জিজ্ঞেস করলাম,
- কী এগুলো?
- কৃত্রিম হীরা উৎপাদনের প্ল্যান্টের অংশ।
- কোন মানের হীরা?
- প্রধানত জেম কোয়ালিটি; তবে কাটিং টুলের উপযোগী হীরা বানানোর প্ল্যান্টও আমরা বানাই।
- আজকাল চলে বেশি কোনটা?
- কাটিং টুলেরটা সবসময়ই চলে, তবে জেম কোয়ালিটিরটা আজকাল বেশি চলছে।
- কারা নেয়?
- স্থানীয় ফ্যাক্টরিগুলো তো আছেই, এর বাইরে আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইউক্রেন আর বেলারুশের ফ্যাক্টরিগুলোও আছে। দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, আয়ারল্যান্ডে ক্রেতা খোঁজার চেষ্টা করছি।

মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে, পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে, রেডিওটিভিতে বিজ্ঞাপন শুনিয়ে দেখিয়ে, শহরজুড়ে বিলবোর্ড টাঙিয়ে ৪০ ডলার থেকে শুরু করে হীরার গয়না বেচা কী করে সম্ভব এবং সেসব হীরার গয়নার কেন সাধারণ স্বর্ণালঙ্কারের মতো পুনঃবিক্রয়যোগ্যতা নেই সেটা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়।

হুয়াঙ অতিচালাক ধরণের যুবক। তার পোশাক আশাক কথাবার্তায় আমেরিকান হবার প্রবল চেষ্টা আছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে ওঠে তার অবিশ্বস্ততা। আমি হুয়াঙের বকবকানিতে কান না দিয়ে মিটিং টেবিলে রাখা প্লেটভর্তি ফলের দিকে মনোযোগ দেই। গণচীনের ছোট শহর আর গ্রামগুলোতে দেখেছি বাসায় বা কাজের জায়গায় কোন অতিথি আসলে নানা রকমের ফল আর চা দিয়ে আপ্যায়ন করতে। গুইলিনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যখনি কারো অফিসে বা বাসায় গেছি প্লেট ভরে ভরে নানা রকম ফল নিয়ে এসেছে। লেমন লাইম অরেঞ্জ পমেলো গ্রেপফ্রুট ম্যান্ডারিন ট্যাঞ্জেরিন কিনু শ্যাডক এইসব লেবুজাতীয় ফলগুলোকে আমি সোজা দুই ভাগে ভাগ করি – এক, যেগুলোর কোয়া আলাদা করা যায়; দুই, যেগুলোর কোয়া আলাদা করা যায় না। গুইলিনের লেবুজাতীয় ফলের কোয়া আলাদা করা যায় না, আকারে বেশ বড়, বেশ রসালো, অপেক্ষাকৃত মিষ্টি। জিঞ্জু নামে টকস্বাদের একটা ফল খেয়েছিলাম, আগে কখনো দেখিনি। এখানে ভালো আনারস হয়, ভালো আঙুরও হয়। লু হান গু বা বুদ্ধের ফল নামে একটা ফল নাকি গুইলিনে হয় যার মতো মিষ্টি ফল পৃথিবীতে হয় না। আমি বুদ্ধের অনুসারী না, তাই তাঁর ফলটা দেখার সুযোগ হয়নি। লি পু ইউ নামের এক রকম কচুর মুখি খাওয়ানোর জন্য অনেকে সেধেছিল। পর্ক দিয়ে লি পু ইউ’র নাকি একটা সুস্বাদু ডিশ বানানো হয়, কিন্তু কচুর মুখি আমার গলার জন্য না। চুফা নামের আরেক টিউবার বা বালব আছে যেটা নানা কায়দায় প্রসেস করে খাওয়া হয়। খেতে একটু বাদাম বাদাম স্বাদ লেগেছে, আমার ভালো লাগেনি।

সানহুয়া জিউ (সানহুয়া ওয়াইন), লাজিয়াও (চিলি সস্‌) আর জিয়াঙ দোফু (ফার্মেন্টেড বীন কার্ড) — এই তিনটা জিনিসকে গুইলিনের তিন রত্ম বলা হয়। সানহুয়া ওয়াইনের যতটা নামডাক শোনা গেছে, চাখতে ততোটাই সাধারণ লেগেছে। চিলি সসের স্বাদ গন্ধ সিরকার স্বাদ গন্ধে চাপা পড়ে গেছে। আর আমি বীন কার্ড রসিক নই। ফলে গুইলিনের রত্মদেরকে আমার পক্ষে যথাযোগ্য মূল্যায়ন করা সম্ভব না। অর্থাভাবে চুয়াঙের বিখ্যাত রেশমের ওপরে সূচীকর্ম বা ইয়াঙশৌয়ের রেশমের হাতপাখা কিনতে পারিনি। তবে এমব্রয়ডারি করা রেশমের বলগুলোতে সূক্ষ্মহাতের কারুকাজ দেখলে বিস্মিত-মুগ্ধ হতে হয়।

আমাকে মূলত কাজের মধ্যে থাকতে হয়েছে বলে গুইলিনের সৌন্দর্যের এক শতাংশও দেখতে পেরেছি বলে মনে হয় না। তবু যা দেখেছি তার তুলনা হয় না। গুইলিন এখন বড় বড় শহরগুলোর সাথে হাইস্পীড ট্রেন নেটওয়ার্ক দিয়ে যুক্ত হওয়ায় অন্যান্য প্রদেশ থেকে অনেক পর্যটক বেড়াতে আসার কথা। কিন্তু গুইলিনের চাকচিক্য কম আর অবকাঠামোগত সুবিধা কম বলে বাইরের পর্যটকরা হতাশ হতে পারেন। এখানে একটা ট্যাক্সি পেতে রাস্তায় ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মুদ্রা বিনিময়ের সুযোগ, বৈদেশিক ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহারের সুযোগ খুব কম। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ব্যাংক, ট্রেন স্টেশন, ট্যাক্সি, সুপার মার্কেটে ইংলিশ জানা লোকের সংখ্যা খুবই কম। অল্পকিছু কেএফসির ফাস্টফুডের দোকান ছাড়া অন্যান্য দেশীয় খাবারের দোকান চোখে পড়েনি। ইন্টারন্যাশনাল চেইনের হোটেলের সংখ্যা খুবই কম।

গুইলিনের টার্গেট এখনো চীনা পর্যটকেরা। অবশ্য ওদের লোকাল মার্কেটটা অসম্ভব বড়। কিন্তু সেই যুক্তিতে বিদেশের বাজারটাকে অবহেলা করার কোন মানে নেই। গুইলিন নিজে থেকে উদ্যোগ না নিলে তার পক্ষে ব্যাংকক, কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, বালি তো বহু দূরের ব্যাপার ভূমিকম্পপূর্ব কাঠমান্ডুর পর্যায়ে যেতেও তার বহু বছর লেগে যাবে। একটু কুণ্ঠার সাথে বলতে হচ্ছে যে কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভ্রমণকেন্দ্রকে চীনারা খুব দ্রুত সাপের খেলা বা বৈশাখী মেলা বানিয়ে ফেলে। যেমন, এখানে লু দি ইয়ানের কথা বলেছি বা আরো আগে জিনশান পার্কের মতো জায়গার কথা বলেছি। পর্যটন শিল্পকে মাথায় রেখে গুইলিনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হলেও সেটা যে সাপের খেলা বা বৈশাখী মেলা হয়ে যাবে না সেই নিশ্চয়তা নেই।

বাংলাদেশী বা ভারতীয় পর্যটকদের মধ্যে যাদের পক্ষে সম্ভব তারা গুইলিনকে পরবর্তী গন্তব্যে রাখতে পারেন। চীনের বড় বড় শহরগুলোর তুলনায় গুইলিন অনেক সস্তাগণ্ডার জায়গা। হোটেলে থাকা হোক, রেস্টুরেন্টে খাওয়া হোক, ছোট ছোট প্যাকেজ ট্যুরগুলো হোক আর সুপার মার্কেটে কেনাকাটাই হোক সবই তুলনামূলক সস্তা। গরমে যাওয়াটা এড়াতে পারলে ভালো হয়। তাপমাত্রা ঢাকা বা কলকাতার মতো অতো বেশি না হলেও খুব কম না, বাতাসে আর্দ্রতা কম বলে অস্বস্তিকর লাগে না তবে একটা গুমোট ভাব আছে। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর গুইলিন বেড়ানোর জন্য সবচে’ ভালো। যে কোন স্থান নাগরিক সৌন্দর্যে সেজে ওঠার আগে তার বুনো সৌন্দর্য দেখার সুযোগ সব সময় মেলে না। দুই যুগ আগে আমি কুয়াকাটা, বান্দরবানের মতো জায়গাগুলোর যে বুনো সৌন্দর্য দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম আজ হাজার মাথা খুঁড়লেও সেগুলো দেখতে পাওয়া যাবে না। এখন ঢাকা থেকে কুয়াঙচৌ সরাসরি যাবার ফ্লাইট আছে। আর কুয়াঙচৌ থেকে আড়াই ঘন্টার ট্রেনে বা সোয়া এক ঘন্টার বিমানে করে গুইলিন পৌঁছে যাওয়া যায়। তবে ঢাকা বা কলকাতা থেকে কুনমিঙ হয়ে বিমানে করে গুইলিন যাওয়াটা বেশি সাশ্রয়ী ও যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া এই রুটটা নিলে ফিরতি পথে কুনমিঙে দুয়েক দিন থেকে স্টোন ফরেস্ট (শিলিন) আর দিয়ান হ্রদ (দিয়ান চি) দেখে নেয়া সম্ভব হয়।

গুইলিন উপক্রান্তীয় অরণ্যাঞ্চলে পড়লেও উচ্চতা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত সব মিলিয়ে এখানে শীত অরণ্য, মরু তৃণ, চিরহরিৎ আর পত্রপতনশীল বৃক্ষের অরণ্যের সদস্যদের চোখে পড়ে। যেদিন শেষ বিকেলে চলে আসছিলাম তখন পাহাড়জুড়ে ইউক্যালিপটাস আর নানা জাতের পাম গাছের সারির উপর দিয়ে অস্তায়মান সূর্যের আলোর দিকে তাকাতে মনে হলো গুইলিনের কী কী আমার মনে থাকবে? অনেক ভেবে দেখলাম লী নদী, তার দুই পাশের পাহাড়, আর গোটা গুইলিনের পাহাড়ের গা জুড়ে লম্বা লম্বা বৃক্ষের অরণ্য ছাড়া আর কিছু মনে থাকবেনা। আমি নদীমাতৃক দেশের মানুষ। বাংলাদেশে নদীর যে বৈচিত্র্য দেখেছি তাতে খুব সহসা আমার কোন নদী দেখে মুগ্ধ হবার কথা না। কিন্তু লী নদীর স্বচ্ছতা, তার বুকে দুই পাড়ের প্রতিফলন, তার শান্ত রূপ সব মিলিয়ে একে পৃথিবীর কোন নদী বলে মনে হয় না — বিশেষত ধাপে ধাপে সাজানো ফসলের ক্ষেতগুলো দেখলে।

গুইলিনের বৃক্ষরাজী শোভিত পাহাড়ের সৌন্দর্যের আড়ালে পাহাড় কেটে, গাছ কেটে মাটি খুঁড়ে আকরিক তোলার ভয়ঙ্কর ব্যাপার আছে। সেই আকরিক গুঁড়ো করতে গিয়ে আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা সাদা-লাল-বাদামী-হলুদ ধুলার আস্তরণে ঢেকে যাবার মতো প্রলঙ্করী ব্যাপারও আছে। স্বাভাবিক প্রশ্ন, গুইলিনের কোন মানুষকে কি আমার মনে থাকবে না? তাঙ-চ্যাঙ-হুয়াঙ বা অন্য কাউকে? যে কোন পর্যটনকেন্দ্রে প্রতিদিন বাইরের পর্যটকরা এসে স্থানীয়দের সাথে যে বিচিত্র আচরণ করে তাতে সারা বছর ধরে তাদের স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ে। পরিণামে স্বল্প ব্যতিক্রমছাড়া তাদের সবার মধ্যে একটা নিস্পৃহ বাণিজ্যিক আচরণ গড়ে ওঠে। সে আচরণে প্রাণের ছোঁয়া থাকে না। লিঙচুয়ান যাবার পথে গঙকুয়াঙ পোস্টফিসের সামনে একটা তরুণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। তার পরণের সাদা টীশার্টের বুকে নীল রঙের বড় বড় অক্ষরে ইংলিশে লেখা ছিল ‘SICK’। তরুণীটি হয়তো জানেনই না এই ইংলিশ শব্দটির মানে কী! কিন্তু গুইলিনের সাধারণ মানুষদের নির্লিপ্ত অভিব্যক্তি, দোকানদারদের রূঢ় বিরক্তি, ভ্রমণসহায়তাকারীদের উপরচালাকি, হোটেল-রেস্টুরেন্টকর্মীদের অপেশাদার আচরণ, পরিচিতদের কথায় আশাহীন টোন শুনে আমার কেবল ঐ ইংলিশ শব্দটি মনে পড়েছে। এজন্য তাদের কেউ আর মনে দাগ কাটতে পারেনি।

লিয়াঙজিয়াঙ বিমানবন্দরের মাটি ছেড়ে বিমান যখন আকাশে উড়ছে আমি তখন জানালা দিয়ে নিচে তাকানোর চেষ্টা করলাম। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসায় কিছু আর বোঝা যাচ্ছিল না। আমি জানালা থেকে মুখ ফেরাতে ফেরাতে মনে মনে বলি, বিদায় তিয়ানশিয়া! ভালো থেকো অপার্থিব সৌন্দর্য আর বিষন্ন মানুষের দেশ! আমি নিশ্চিত জানি তোমার কাছে আর কখনো ফেরা হবে না।


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

যে বর্ণনা দিলেন ছবির তো দরকার ই পড়লোনা!! চলুক চলুক

কি কাজে গিয়েছিলেন? মনে হল ফ্যাক্টরি ইন্সপেকশন জাতীয় কিছু?

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

উঞ্ছবৃত্তি করে বাঁচি। কি দরকার সেসব কথা টেনে পাঠকদের বিরক্ত করার!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

তা, স্বর্গের নিচ থেকে ঘুরে এলেন, উপরর দিকে একটু উঁকিঝুঁকি দিয়েছিলেন কি? দেখেছেন, স্বর্গের হুরদের! কী আছে স্বর্গে! লালন ফকিরতো বলেছেন,
"আছে হিন্দু-মোছলমান দুই ভাগে, ফকিরি করবি ক্ষ্যাপা কোন রাগে,
বেহেস্তের আশার মমিনগণ, হিন্দুরা দেয় স্বর্গেতে মন,
বেহেস্ত-স্বর্গ ফাটক সমান, কার বা তা ভাল লাগে!"

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমি তো স্বর্গের মানুষ না, স্বর্গের নিচের মানুষও না। যা দেখেছি তাতেই অপার বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়েছি। এর বেশি কিছু ভাবার ক্ষমতা আমার নেই।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

গুইলিনের সৌন্দর্য ছাপিয়ে সেখানের মানুষদের মর্মবেদনার ছবিটিই তো পরিশেষে প্রকট হয়ে দেখা দিল।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সব ভূস্বর্গের অধিবাসীদের অবস্থা তাই। আমরা যারা বাইরে থেকে সেখানে ফূর্তি লুটতে যাই তাদের অ্যান্টেনায় এই সত্যটা খুব কম সময়ই ধরা পড়ে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

গৌতম বুদ্ধের অনুসারী না হলে লু হান গু দেখার সুযোগ মেলে না?

যাহোক, লেখা পড়ে ছবির অভাব বোধ করিনি। যাওয়ার সাধ তীব্র হলো, জানি না কখনো সুযোগ হবে কি না

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লু হান গু একটু রেয়ার ধরনের ফল। এর প্রধান ক্রেতা চীনা কবিরাজেরা। একটু খাটাখাটুনি করলে হয়তো শুকনা লু হান গু দেখতে পেতাম, কিন্তু অতো তেল ছিল না। বুদ্ধের নামে ফলের নাম শুনেও তেল খরচ করিনি।

আমরা যারা বাইরের লোক তারা গণচীনে গেলে মহাপ্রাচীর, পেইচিঙ, সাঙহাই, কুয়াঙচৌ ছাড়া অন্য কিছু দেখার কথা ভাবি না। বড় জোর কুনমিঙ বা হাইনান দ্বীপ। যাদের অ্যাডভেঞ্চারে আগ্রহ আছে তারা বড়জোর তিব্বত (শিঝ্যাঙ) যাবার কথা ভাবেন। উরুমচী, কাশী (কাশগড়), গুইলিন, হোহট, চিচিহার, মোহে'র মতো অপার্থিব সৌন্দর্যের জায়গায় যাবার কষ্টটুকু করার কথা কেউ ভাবেন না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইটা রাইখ্যা গেলাম...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কীসের ইটা রাখলেন? এখানে তো কোন লাইন নাই!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সময় নিয়ে পরে পড়ব, তাই। হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ঈয়াসীন এর ছবি

অক্ষরেই ছবি ফুটে উঠছে। চমৎকার। মুজতবা আলীর ভ্রমন কাহিনী গুলোও আমরা ছবি ছাড়াই পড়েছি। তাতে কোনো কিছুই অপূর্ণ থাকেনি। চলুক

------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মনে করে দেখুন, জীবনে যা ভ্রমণকাহিনী পড়েছেন তার প্রায় সবই ছবি ছাড়া। কিন্তু ব্লগের ব্যাপারটা ভিন্ন। এখানে বেশি দৈর্ঘ্যের লেখা পড়তে যেমন পাঠকের অনাগ্রহ আছে তেমন ছবি ছাড়া ভ্রমণকাহিনী পড়তেও পাঠকের অনাগ্রহ আছে। এই লেখার দৈর্ঘ্য বেশি। তাতে প্রচুর পাঠক পুরোটা না পড়েই ভেগে যাবার কথা। আর শুরুর ডিসক্লেইমারটা ব্লগটাতে না ঢুকেই পড়া যায়। সেখানে ছবি নাই শুনে বাকিরা এই ব্লগেই আর ঢুকবে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

এই পোস্ট ফটোবিহীন, তাই চলিত অর্থে ছবিবিহীন ঠিক-ই, তবে লেখার পরতে পরতে নানান ছবি ফুটে রয়েছে - মানুষের ছবি, প্রকৃতির ছবিও।

কিন্তু গল্পবিহীন কি করে বলি? "থকথকে কাদাতে ডালায় সাজিয়ে রাখা মাছ কিনছে রাবারের গামবুটপরা ক্রেতার দল" বা "৪০ ডলার থেকে শুরু করে হীরার গয়না বেচা কী করে সম্ভব" কি, "চ্যাঙ এটাসেটা অনেক দরাদরি করার পর শেষে আধখানা চালকুমড়ো" - গল্পের পর গল্প।

এটা ঠিক যে, "স্বর্গের নিচে যা শোভা আছে তার মধ্যে গুইলিনই সবার সেরা" এই চীনা প্রবাদটির মর্মার্থ বোঝানোর মত প্রকৃতির সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা অংশ গোটা লেখার পরিসরের অনুপাতে কম পাওয়া গেছে। কিন্তু সেটার ধরতাই লেখক নামকরণেই দিয়ে রেখেছেন - স্বর্গের নীচে। তাই স্বর্গদৃশ্য কম আসবে এটাই প্রত্যাশিত। লেখক একটা কৈফিয়তও দিয়েছেন "আমাকে মূলত কাজের মধ্যে থাকতে হয়েছে বলে গুইলিনের সৌন্দর্যের এক শতাংশও দেখতে পেরেছি বলে মনে হয় না।" আমার প্রশ্ন হচ্ছে লেখকের ঝুলিতে কি সে স্বর্গের কোন ফটো নেই? গুগল কি ফ্লিকার ঘুরে যে ছবি পাওয়া যায় লেখকের তোলা ফটোগ্রাফ তার থেকে আলাদা কোন মাত্রা দেখাত কি না এই কৌতূহলটা থেকে গেল।

এবারে শেষ কথায় আসি। এই শেষ কথাটায় কোন প্রতিক্রিয়া জানানোর একেবারে দরকার নেই। এত গুছিয়ে, এত বিভিন্ন দিককে ধারণ করে যে চমৎকার পরিবেশন এ পোস্ট রেখেছে তা পরম তৃপ্তিদায়ক। পাঠ্য বইয়ে রাখলে ছাত্রছাত্রীরা উপকার পেত - কি দেখতে হয়, কেমন করে দেখতে হয়, কি লিখতে হয়, কেমন করে লিখতে হয়।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

দীর্ঘ বিশ্লেষণী মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ প্রিয় অগ্রজ। আপনার মন্তব্যের তৃতীয় অনুচ্ছেদের শেষে যা বলেছেন সেটা নিয়ে বলছি।

জীবনে প্রথমবার গণচীন ভ্রমণের সময় ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ ছিল না। সেই ক্যামেরা, নেগেটিভ, ছবি কিছুই আজ আর নেই। এরপর আর কোন ভ্রমণে, দেশে বা দেশের বাইরে, আমি আর ক্যামেরা বহন করিনি, করার ইচ্ছেও নেই। আর এখনতো আমার ক্যামেরাও নেই। মোবাইল ফোন আমার কাছে শুধু যোগাযোগের যন্ত্র মাত্র। কোন দৃশ্য দেখে মোবাইলে সেটা ধারণ করার অপচেষ্টা করিনা। গুইলিনের সৌন্দর্য এমন যে সেটা ক্যামেরায় ধারণ করা কঠিন। সেখানকার একটা দৃশ্যকে মোটামুটি ধারণ করতে উঁচু মানের একজন ফটোগ্রাফারেরও অনেকটা লম্বা সময় লাগবে। সেখানে আমি কোন ছার!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

বুঝলাম। প্রাক-ডিজিটাল পর্বের ছবি নিয়ে এই বেদনাটা আমাদের অনেকেরই। কি আর করা যাবে!

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ছবি নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই (এবং ছিলও না)। জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছি (এবং কাটাচ্ছি) ক্যামেরা ছাড়া। নিজে ছবি তুলতে পারি না (এবং শেখার ইচ্ছে নেই)। কেউ আমার ছবিও সচরাচর তোলেনি (এবং তোলেনা)।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! আমার ছোটবেলায় আমার প্রতি সুপ্রযুক্ত একখান মধুর সম্ভাষণ এইখানে নামায় দিই - গেছো, একেবারে গোল্লায় গেছো। (সারাদিন ধরে অনেক ভেবেও এখন আর মনে পড়ছে না যে কথাটা আমায় কে বলেছিল! কিন্তু বলেছিল কেউ।)

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ওডিন এর ছবি

কি চমতকার একটা লেখা। একটা নিখুঁত ভ্রমণকাহিনী মনে হয় এইরকমই হয়। এত নিখুঁত বর্ণনার পরে আবার ছবি লাগে নাকি! হাসি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এটা যে নিখুঁত ভ্রমণকাহিনী নয় সেটা তুমি জানো। কারণ, ভ্রমণকাহিনীর অনেক শর্তই এই লেখা পূরণ করে না। এই লেখাগুলো আসলে ভ্রমণজাত উপলদ্ধি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ওডিন এর ছবি

ভ্রমণকাহিনীর শর্ত কি সেইটা ঠিক জানি না, তবে আমার কাছে এই ভ্রমণজাত উপলদ্ধির ব্যপারটাই দারুণ লাগলো।

অনেক অনেক দিন আগে আপনি আমার একটা লেখায় অনেকটা এইরকম একটা মন্তব্য করেছিলেন- অমুক জায়গায় কেমনে গেলাম কই খাইলাম কই শুইলাম কি কিনলাম কেমনে কিনলাম- এইরকম ভ্রমণকাহিনী বাংলা ভাষায় অনেক আছে, নেই শুধু ভ্রমণের সময় সে উপলব্ধিগুলোর কথা, সেই মানুষগুলোর কথা।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ভ্রমণকাহিনীতে যাওয়া থেকে ফিরে আসা চক্র পূর্ণ করা, ক্রনোলজিক্যাল অর্ডার ঠিক রেখে ঘটনার বর্ণনা দেয়া, পরিবহন-রাত্রিবাস-অন্নসংস্থান ইত্যাদির বর্ণনার সাথে ব্যয়ের ধারণা দেবার ব্যাপারগুলো থাকে। আমার এই লেখায় সেগুলো কিছু নেই।

সাধারণ ভ্রমণকাহিনী প্রযুক্তিগত, ব্যবস্থাপনাগত ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাথে সাথে এক সময় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। ভ্রমণজাত উপলদ্ধি খুব সহসা পালটায় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্যাম এর ছবি

চলুক

তাহসিন রেজা এর ছবি

খুব বেশি ছবি যুক্ত ভ্রমণ কাহিনী ভালো লাগে না। এই লেখাটি পড়ে ছবির বিন্দুমাত্র অভাব বোধ করলাম না। হাসি
এতো অসাধারণ লেখেন, অপেক্ষা করি আপনার লেখার জন্য।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------
“We sit in the mud, my friend, and reach for the stars.”

অলীক জানালা _________

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমার লেখার জন্য অপেক্ষা করলে না খেয়ে মরতে হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

বাহ্! চমৎকার লিখেছেন। যখন পড়ছিলাম জিয়াঙশান, গুইলিনের সৌন্দর্য যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠছিলো। পড়ে ভালো লাগলো।
সাদা মেঘদল

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

পোস্ট পড়া ও মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনি ছবি দেন নাই তো কি হয়েছে, যে বিশদ বর্ননা দিয়েছেন তার সাথে গুগল করা ছবি মিলিয়ে যে স্বর্গের দেখা পেলাম তাতে অদূরভবিষ্যতে ঢাকা-কুনমিং-গুইলিন রুটের টিকেট কাটার সুযোগ খুঁজতেও পারি। বছর দশেক আগে ভিয়েতনামের বাখ ডং নামের একটা জায়গায় গিয়েছিলাম তার ভূ প্রকৃতির সাথে গুইলিনের বেশ মিল পেলাম। তবে খাবার দাবারের বর্ণনা শুনে একটু চিন্তিত হলাম। সত্যি বলতে কি নাকচ্যাপটা জাতির খানাপিনার সাথে আমি যতটা পরিচিত সেটাই দুশ্চিন্তার কারণ। হাসি

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

Bạch Đằng তো Hạ Long Bay'র কাছে তাই না? উত্তর ভিয়েতনামের ভূপ্রকৃতির সাথে ঠিক গুইলিনের না, তবে কুয়াঙশি প্রদেশের দক্ষিণ ভাগের ব্যাপক মিল আছে।

মঙ্গোলয়েডরা অসংখ্য জাতিতে বিভক্ত, আর তাদের প্রত্যেকের খাবার, রান্না করার কৌশল সবই ভিন্ন। একটু সহৃদয়তার সাথে বিবেচনা করলে পার্থক্যগুলো যেমন বুঝতে পারবেন তেমন তার মজাটাও বুঝতে পারবেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীড় সন্ধানী এর ছবি

সরি Bích Động হবে জায়গাটা। Hạ Long Bay থেকে শ দেড়েক মাইল দক্ষিণ-পুবে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম ব্যক্তিস্বার্থে করা আপনার অপকর্মে। দেশের বাইরে ঘুরতে যাবার সুযোগ এখনও হয়নি। দেশের ভেতর বন্ধুদের সাথে হইচই করে যে কয়েক জায়গায় ঘুরতে গেছি, প্রতিবারই ক্লিকবাজীর যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ বোধ করেছি। মাঝে মাঝে মনে হত বন্ধুরা যদি ফটোশপে দক্ষ হত তাহলে আর কষ্ট করে ভ্রমণে বের হত না, সুন্দর সব ব্যাকগ্রাউন্ডের সামনে নিজেদের ছবি বসিয়ে ফেসবুকে শেয়ার দিত। অল্প কয়েকজন সমমনা বন্ধুদের সাথে হটাৎ করে বের হওয়া ভ্রমণগুলি তুলনামূলকভাবে বেশী আনন্দদায়ক ছিল। অচেনা কোন টং দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দেবার পর বেরিয়ে আসতে কেমন যেন মায়া লাগত – কখনো আর ফিরে আসা হবে না বলে।

আমি তোমাদের কেউ নই -> আতোকেন

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

অর্থ-সময়-শ্রম ব্যয় করে কোথাও বেড়াতে গিয়ে যদি সেটা দুচোখ ভরে না দেখেন, বুক ভরে তার ঘ্রান না নেন, কান পেতে তার গান না শোনেন, সারা গায়ে যদি তার পরশ না নেন, প্রাণ ভরে যদি তা উপভোগ না করেন তাহলে গেলেনই বা কেন! ফটোগ্রাফি যাদের পেশা তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বলার কিছু নেই। এটা যাদের শখ তাদের লক্ষ্য রাখা উচিত শখ যেন মূল কর্মকে ছাপিয়ে না যায়। আর যারা দেখনদারি তাদের ব্যাপারে কিছু না বলাই ভালো।

কোথাও তো আর ফেরা হয়, ফেরা যায়ও না তাই মায়াটা লাগে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

লম্বা লেখা, সময় নিয়ে পড়লাম। গুইলিনের প্রকৃতির বর্ণনা কম মনে হলো। সেইজন্য জায়গাটা ঠিক কতটা 'ভূস্বর্গ' তা ঠিক করতে পারলাম না। মানুষের বর্ণনা ভালো লেগেছে। মানুষ আর জায়গার নামগুলো খুব অপরিচিত বলে মিলিয়ে নিতে হোঁচট খেয়েছি। তবে এই সমস্যা লেখার নয়, পাঠকের।
আপনার লেখার জন্যেেই লেখাটা বেশি ভালো লেগেছে।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রকৃতির বর্ণনা আরো কিছু লিখেছিলাম, যেমন শিয়াঙ বিশান এলাকার। তারপর মনে হলো এভাবে লিখলে পাঠক ছবি না দেবার জন্য আরো বিরক্ত হবেন। তাই ওসব বাদ দিয়ে দিয়েছি।

জায়গাগুলোর ইংলিশ বা বাংলায় অনুদিত নাম দিতে পারতাম। যেমন, শিয়াঙ বিশান না বলে এলিফেন্ট ট্রাঙ্ক হিল বলতে পারতাম। তাহলে হয়তো পাঠক আরাম বোধ করতেন। কিন্তু এই অহেতুক অনুবাদ করতে আমার ভালো লাগে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। ব্লগে বড় লেখা যারা পড়েন না এবং ছবি ছাড়া ভ্রমণকাহিনী যারা ভালু পান না তাদের জন্য কিঞ্চিত ক..... নাহ, দু:খ অনুভব করলাম।

গণচীনের ভু-প্রকৃতি নিয়ে আমার বিশাল আগ্রহ আছে। বর্তমান বাস্তবতায় সেখানে যাওয়া অসম্ভব, কাজেই গুগলই একমাত্র ভরসা। গুগল করে গুইলিনের ছবি দেখে আপনাকে ঈর্ষা করলাম, আর নিজের জন্য রইলো আক্ষেপ।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

তুমি যেখানে আছো সেখানকার ভূপ্রকৃতির বৈচিত্র্যও কম নয়। একটু খোঁজখবর নিলে তোমার ধারেকাছে অখ্যাত অথচ সত্যিকারের ভূস্বর্গ ঠিকই খুঁজে পাবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

বর্ণনায় মুগ্ধ

অতিথি লেখক এর ছবি

বর্ণনায় মুগ্ধ হলাম লেখক। শুভেচ্ছা রইলো
jaraahzabin

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ধন্যবাদ!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

স্যাম এর ছবি

অসাধারণ! ছবির অভাব বোধ করিনি একটুও।

আচ্ছা এখন যারা স্কুলে পড়ে তারা আরেকটু বড় হলে ছবি/গ্রাফিক্স/ইত্যাদি ছাড়া যে লেখা হতে পারে তা কি ভাবতে পারবে? এখনতো গল্পের বইতেও ছবি থাকে অনেক।

অটঃ লোকেন বোসের জার্নাল এর অপেক্ষায়...

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

তারা আরেকটু বড় হলে ই-বুক ধরনের জিনিস পড়বে যেখানে টেক্সট, গ্রাফিক্স, অডিও, ভিডিও সবই থাকবে। একসময় সেখান থেকে গন্ধ, তাপ, স্পর্শ, স্বাদ এগুলোও পাওয়া যাবে। তো তাদের বেশিরভাগ জনের ধারণায় আসবেনা কথাচিত্র জিনিসটা কী।

অটঃ লোকেন বোসের জার্নাল তো সিরিজ না। আর অমন জার্নাল লিখতে অনীহা, অনিচ্ছা হয়। তারচেয়ে বেশি হয় - ভয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাবিব এর ছবি

ড্রাইভার দের কেউ কেউ ঘুরপাক খাওয়ানো ছাড়াও মিটার টেম্পারিং করে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

মিটার টেম্পারিং খুব কম জায়গায় হয়। বলা ভালো নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় হয়। তবে হুদাই চক্কর মারানোর ব্যাপারটা প্রায় সব জায়গায় আছে। আর আজকাল বেশিরভাগ জায়গায় ট্যাক্সি মিটারে যেতে চায় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাবিব এর ছবি

ফলের chinese উচ্চারণ guo গু -অ, তাই লু হান গু না হয়ে সঠিক উচ্চারণ হবে লু হান গু -অ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রায় ঠিক! উচ্চারণটা 'গুঅউ'-এর মতো হবে (অন্তত আমার কানে যা শুনেছি)। লেখার সময় ইচ্ছে করে এই জটিলতা পরিহার করেছি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাবিব এর ছবি

চিনা ভাষায় ফল মানেই শেষে যোগ হবে গুয়া, তাই আমার মনে হয় উচ্চারনটা হবে লু হান গুয়া

আপনার লেখার হাত অসাধারণ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

লু হান গুঅউ হবে মনে হয়। আর ফল মানেই সর্বত্র গুঅউ নয়। কোথাও কোথাও গুঅউশি, কোথাও কোথাও গুঅউজি -ও হয়।

আপনার কাছে আমার লেখা ভালো লেগেছে তাতেই আমি ধন্য।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রানা মেহের এর ছবি

লেখা অনেক ভালো লাগলো পাণ্ডব দা।
ভ্রমন কাহিনী আমি সাধারণত এড়িয়ে যাই সেখানে মানুষের কথা থাকেনা, নিজের উপলদ্ধির কথা থাকেনা বলে।তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভ্রমনের কাহিনী গুগলের কাহিনী হয়ে যায়।

এই লেখাটা এই দোষমুক্ত থাকার কারণেই ভালো লাগলো।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনার শ্রেণীর পাঠকের প্রতিক্রিয়াটা ক্লিয়ার হল। ধন্যবাদ। আবার কখনো এমন লেখা লিখতে গেলে এটা মাথায় রাখবো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

কী দারুণ একটা লেখা! জ্যামে বসে মোবাইলে পড়ে ফেললাম। আর বাড়ি ফিরে মন্তব্য। লেখায় যা পাওয়া যায় ছবিতে তা পাওয়া যায় না। আর ছবিতে যেটা থাকে সেটা লেখাও আসাও অসম্ভব। তবে ভাগ্যের কথা ছবি দেখতে হলে এখন আর ব্যক্তির ওপর নির্ভর করা লাগে না। আবার একটা জায়গার নিরপেক্ষ বর্ণনা জানতে, সেখানে কী কী আছে জানতেও গুগ্লের সরণাপন্ন হওয়া যায়। কিন্তু ব্যক্তির দৃষ্টি সেখানে অনুপস্থিত থেকেই যায়। আপনার এই লেখাটায় সেই দৃষ্টিটার উপস্থিতিই আনন্দদায়ক।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

তুমি একটা অসাধারণ মন্তব্য করেছ! এই পরিবর্তিত দুনিয়ায় গুগলের স্ট্রিটভিউ দিয়ে একটা জায়গার রাস্তাঘাটদোকানপাটবাড়িঘর মায় রাস্তার লোকজন পর্যন্ত দেখা যায়। বিস্তারিত ইতিহাস বা বিবরণ জানার জন্য উইকি, এনকার্টা এমন হাজারো জিনিস আছে। সুতরাং এসব নিয়ে আর বিশেষ মাথা ঘামানোর দরকার নেই। বাঘা বাঘা ফটোগ্রাফাররা সারা দুনিয়ার সকল দ্রষ্টব্যের ছবি ফ্লিকারের মতো সাইটগুলোতে তুলে দিয়ে রেখেছেন। সুতরাং ছবি নিয়েও ভাবনা নেই। এই বিবেচনায় ভ্রমণকাহিনীগুলো কলেবরে ছোট হয়ে আসতে বাধ্য। সেখানে ব্যক্তির নিজের গল্প আর নিজের উপলদ্ধির বাইরে খুব বেশি কিছু আসার দরকার নেই। আবার যদি ভ্রমণকাহিনী লেখার অপচেষ্টা করি তাহলে এই ব্যাপারটাতে আরো সচেতন হব।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

আপনার এই লেখাটা পড়ে বুঝলাম আমার মরুযাত্রা সিরিজটা কি অসম্ভব রকম স্থুল, অশিক্ষিত আর নিয়াণ্ডার্থাল-মার্কা ছিল। ভ্রমণ-কাহিনি লিখতে হয় তো এরকমই লেখা উচিৎ! গুরু গুরু

****************************************

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

কোলাকুলি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এই ব্যাপারে আমার প্রবল দ্বিমত আছে। আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, আপনার মরুযাত্রা সিরিজ পড়ে আমি এবং আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আপনার কাছে ই-বুক দাবী করেছিলাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

সে আপনার মহানুভবতা। কিন্তু আমিতো জানি এই পরিণত পর্যবেক্ষণশক্তি, অনুভবের গভীরতা ও তা প্রকাশের শক্তি, সাটেলিটি, ভাষার উপর দখল - এগুলি সোজা বিষয় না। এইসব আমি কোথায় পাবো? তাই খালি ইর্ষাই করতে পারি! হাসি

****************************************

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমি আপনাকে মহানুভবতা দেখাবো কী করে!ঙ্কারণ, আমি তো মহানুভব ব্যক্তি নই। মরুযাত্রার ব্যাপারে শুধু আমিই তো একমাত্র না, আরো পাঠকেরা এমন মন্তব্য করেছেন।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

দুই দিনে ভাগ করে পড়লাম। আমি বেড়াতে পারি না বলে ভ্রমণকাহিনী পড়ে আমার একটু আফসোস হয়। আমি জানি চীন দর্শন হবে না আমার। মানে লজিক্যালি হবার কথা না। দেশের মধ্যেই খুব একটা ঘোরা হয়নি। আশা আছে বাচ্চার আরেকটু বড় হলে ছুটিছাটাগুলো আর রান্নাঘরে কাটাবো না। সেসব কবে হবে জানি না। কিন্তু আপনার বর্ণনা আমি কিন্তু মাথায় রাখতে চেষ্টা করবো। ছবি ছাড়াও অনিন্দ্য সুন্দরভাবে প্রকৃতি ও মানুষের বর্ণনা দেয়া খুব কম মানুষই পারে বোধহয়। ভাল থাকুন পাণ্ডবদা। আবার ঘুরতে যান, সেই শুভকামনা রইল।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কষ্ট করে লেখাটা পড়া আর বিস্তারিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। চীন যেতে হবে এমন কোন কথা নেই। দেখার চোখ থাকলে পাশের মহল্লা/গ্রামেও অনেক কিছু দেখতে পাওয়া যায়। বাচ্চাদের সাথে নিয়েই ঘুরুন, ধারেকাছে ঘুরুন। বাচ্চাদের এটাসেটা চেনাতে চেনাতে বা এটাসেটার গল্প করতে করতে দেখবেন এক একটা চমৎকার ভ্রমণ হয়ে গেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

তারেক অণু এর ছবি

দুই দিন আগে পথে থাকার সময়ই খুব তারিয়ে তারিয়ে পড়ছি, বেশ উমদা ! নানা জায়গার খুঁটিনাটি এবং স্থানীয়দের জীবনে কিছু না-জানা গল্প সবসময়ই জানই আপনার লেখা থেকে, এবারও জেনে চীনের ঐ অঞ্চলে যাবার ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

পাখির বাংলা নাম ব্যবহারের জন্য ধন্যবাদ দাদা, যেগুলোর নাম দেন নি সেগুলোর নাম চলে এসেছে নতুন বইতে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

চীন তো আসলে অনেকগুলো দেশের সমন্বয়ে একটা দেশ। হয়তো উপমহাদেশ। সেখানে প্রকৃতির বিচিত্রতার প্রায় সব আছে। তো চীনের যেখানেই যাও সেখানেই দেখার মতো বিস্তর কিছু পাবে।

পাখির বাংলা নাম নিয়ে আমার সামান্য বক্তব্য আছে। সেটা যথাস্থানে জানাবো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।