বাস কথন -০১

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি
লিখেছেন ষষ্ঠ পাণ্ডব (তারিখ: বিষ্যুদ, ২১/১২/২০১৭ - ১১:৫৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা কত? নানা রকম সূত্র নানা রকম তথ্য দেয়, কিন্তু সেই তথ্যের ভিত্তি কী সেটা জানা যায় না; অথবা তথ্যের ভিত্তির কথা বললেও দেখা যায় সেই ভিত্তি নড়বড়ে। সেসব ভিত্তিহীন বা দুর্বল ভিত্তির তথ্য অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা ৮৫ লাখ থেকে ১ কোটি ৪৪ লাখের মধ্যে উঠানামা করে। এই ব্যাপারে ঢাকাবাসী কাউকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে তিনি সংখ্যাটা দেড় থেকে দুই কোটির দিকে ঠেলবেন। তাদের এই ঊর্ধ্বমুখী ঠেলা দেবার কারণ দুটো — প্রথমত, ঢাকা মহানগরীর জন্য আলাদা কোন জনজরীপ হবার কথা তারা শোনেননি অথবা অমন জরীপ হয়ে থাকলেও তার ফলাফল তারা জানতে পারেননি। তাই থিকথিক করা জনচাপে তাদের মাথায় কোটির নিচে কোন সংখ্যা গ্রহনযোগ্য বলে মনে হয় না। দ্বিতীয়ত, শরীরের সব রক্ত মুখে আনার মতো করে দেশের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে ঢাকায় এনে জড়ো করায় প্রতিদিন কয়েক নিযুত মানুষকে ঢাকায় আসতে হয়। তাদের বড় অংশ দিন ফুরোলে আপন কুলায় ফিরে যান বটে তবে দিনভর তাদের সবার চাপ এই মহানগরীকে সইতে হয়। তাই ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যাকে দুই কোটি মনে হওয়াটা ভুল কিছু নয়।

এই দুই কোটি লোকের চলাচলের জন্য সাইকেল, ঘোড়ার গাড়ী, রিকশা, অটোরিক্‌শা-টম্‌টম্‌, টেম্পো-হলার-ম্যাক্সি-লেগুনা, মিনিবাস-বড় বাস-আর্টিকুলেটেড বাস-দোতলা বাস, হরেক রকমের ট্যাক্সি-মাইক্রোবাস, ট্রেন, নৌকা, লঞ্চ আর ব্যক্তিগত গাড়ী আছে। এখানে গণপরিবহন মানে আসলে বাস, বাকিগুলো এহ বাহ্য। এতো লোকের এতো বড় শহরে শুধু বাস দিয়ে গণপরিবহন চালাতে গেলে যে পরিমাণ রাস্তা আর যে অযুতসংখ্যক বাস লাগবে তার এক-আধলাও ঢাকাতে নেই। সেটা হওয়া সম্ভবও নয়। এখানে গণপরিবহন হিসেবে রেল (সার্ফেস, এলিভেটেড, আন্ডারগ্রাউন্ড, মনো, স্কাই)-এর চিন্তা ভাবনা একেবারে অধুনা। কাছের মহানগর কলকাতায় গণপরিবহন হিসেবে রেলকে বিবেচনা করা হয়েছে পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই। সেখানে ১৯৮৪ সাল থেকে পাতাল রেল চলছে। অথচ ঢাকা মেট্রোপলিসের আয়তন কলকাতা মেট্রোপলিসের আয়তনের চেয়ে ৬৬% বড় আর জনসংখ্যা ৩.২ গুণ!

নগর যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যারা নূন্যতম খবর রাখেন তারা জানেন ওভারপাস, আন্ডারপাস, ওভারব্রীজ, ফ্লাইওভার ইত্যাদি ব্যবস্থা গণপরিবহন সমস্যার সমাধান হতে পারে না। একজন ফাস্ট বোলারের জায়গায় দশটা ফাস্ট স্প্রিন্টার নামালে ক্রিকেট খেলা জেতা যাবে না, যদিও উভয় পক্ষই জোরে দৌড়ান। সুতরাং ঢাকার গণপরিবহন সমস্যার সমাধানের জন্য মাথার উপর দিয়ে চলতে পারে এমন রেল ব্যবস্থা ছাড়া উপায় নেই। সমস্যা সমাধানের জন্য যারা ঢাকা মহানগরের ভেতরে রেপিড বাস ট্রানজিটের কথা বলেন তারা সম্ভবত ঢাকার রাস্তাগুলোর আকার-আয়তন-প্রকৃতিকে, এবং ঢাকার রাস্তায় চলার বিদ্যমান সংস্কৃতিকে তাদের বিবেচনায় নেন্‌ না।

কোন এক রাঙা ভোরে ঢাকা মহানগরে লোকের মাথার উপর দিয়ে রেল চলবে, এবং সেই রেল আমাদের যেখানে যাওয়া দরকার তার ধারে কাছে নামিয়ে দিয়ে যাবে অমন সুখস্বপ্ন যে অনির্দিষ্টকাল পরে বাস্তবায়িত হবে তার আগে পর্যন্ত আমাদেরকে মূলত বাসে চড়েই যাতায়ত করতে হবে। আমাদের প্রতিদিনের ঘর থেকে বের হবার পরের গল্প তাই এক প্রকার ‘বাস কথন’।

১.

এই মহানগরের বাসগুলোর কোনটাতে কতগুলো আসন আছে, সেগুলোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা কতো, মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা, ভূমি থেকে বাসের উচ্চতা, বাসের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা কতো তার কোন কিছু কোন বিধি মেনে চলে না। আপনি কখনোই না গুণে বলতে পারবেন না যে, এই মিনিবাসে ২৭টি আসন বা এই বড় বাসটিতে ৫৬টি আসন আছে। এইসব তথ্য গাড়িটির যিনি মালিক বা যারা গাড়িটির কর্মী তাদের খুব কমজন হলফ করে বলতে পারবেন। ফলে এই বাসগুলোর কোনটাতে উঠতে প্যান্ট ফেঁসে যাবার দশা হয়, আবার কোনটাতে পাঁচ বছরের শিশুও উঠতে পারে। কোনটার ভেতরে সাড়ে পাঁচফুটি মানুষ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, আবার কোনটাতে মাশরাফি বিন মুর্তজা’র সোজা হয়ে দাঁড়াতে বিশেষ কষ্ট হবে না। তবে একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকা যায় যে এই বাসের আসনগুলোতে আরাম করে, হাঁটু কুঁজো না করে, পাশের যাত্রীকে চেপে ভর্তা বানানো অনিচ্ছুক চেষ্টা না করে বসা যায় না। একবার খবরের কাগজে দেখেছি এইসব বিষয়ে মাপজোকগুলো কী হবে সেসব নিয়ে নাকি আইন আছে। সেই আইন কেতাবে রয়ে গেছে। বাস যারা বানান তারা তাদের ইচ্ছেমতো আকার-আয়তন-ডিজাইনের বাস বানিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতু যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এই বিষয়ে কেউ প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ জানাননি, তাই বোধকরি তারা কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি।

২.

যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মাঝে মাঝে বাস ভাড়া বৃদ্ধি সংক্রান্ত ঘোষণা আসে। তখন সেটা নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়, হালকা-পাতলা আন্দোলনও হয় — সবশেষে বাসের ভাড়া কার্যত আরেক দফা বাড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে দশ ডলার/ব্যারেল হলেও বা দেশের অকটেনের মূল্য ত্রিশ টাকা/লিটার হলেও বাস ভাড়া ক্রমাগত কেবল বাড়বেই।

সরকারের তরফ থেকে নানা জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন দেখলে আমার সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গানটা মনে পড়ে —

“ব্রিগেডে মিটিং হবে, ময়দান তোলপাড়
ব্রিগেডে মিটিং শেষ, ছড়ানো চায়ের ভাড়।”

বাস ভাড়া নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কিলোমিটার প্রতি বাসের ভাড়া যা কিছুই নির্ধারণ করুন না কেন ঢাকার বাসগুলো তাদের নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করে থাকে। একই রুটে, একই দূরত্বের জন্য বিভিন্ন কোম্পানীর বাসের ভাড়া বিভিন্ন রকমের হয়। সেই ভাড়াও আবার সরকার নির্ধারিত ভাড়ার হিসেবের সাথে মেলে না। একটা উদাহরণ দেই। আরামবাগের নটর ডেম কলেজের সামনে থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত যাবার ভাড়া কিছু বাসে কয়েক মাস ১২ টাকা করে রাখা হলো। এটা নিয়ে প্রতিদিন বাসে কুরুক্ষেত্র চলতে থাকলো। কী কারণে যেন মাঝে দিন দশেক সব বাসে সিটিং/গেটলক সার্ভিস বন্ধ করায় ঐ বাসগুলোই ৮ টাকা করে ভাড়া নিতে থাকলো। ৮ টাকার মধুচন্দ্রিমা শেষ হতে না হতে ভাড়া একটু উঠে ১০ টাকায় স্থির হলো। উল্লেখ্য যে, এর মধ্যে বাস ভাড়া নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বাস ভাড়ার কোন পরিবর্তন করেনি। সবার নাকের ডগার সামনে দিয়ে এই বাসগুলো প্রতিটি যাত্রীর কাছ থেকে প্রথমে ৫০% ও পরে ২৫% বাড়তি ভাড়া আদায় করে যাচ্ছে। এটা নিয়ে সম্ভবত এখনো কেউ যথাযথ কর্তৃপক্ষকে প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ জানায়নি, এই জন্য তারা কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন বলে চোখে পড়েনি। প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ না থাকলে তারা কীভাবে বুঝবেন যে এই ব্যাপারে কিছু করতে হবে!

৩.

এই মহানগরের অনেক জায়গায় দেখা যায় নগর কর্তৃপক্ষ রাস্তার পাশে বাস স্টপের প্রতীকসম্বলিত পোস্ট লাগিয়েছে, অথবা ‘এইখানে বাস থামিবে’ লেখা বোর্ড টাঙিয়েছে। বিভ্রান্তিকর ব্যাপার হচ্ছে এই যে, প্রায়ই দেখা যায় ঐ পোস্ট/বোর্ডের সামনে একজন ট্রাফিক পুলিশ ডাণ্ডা হাতে দাঁড়িয়ে কোন বাসকেই সেখানে থামতে দিচ্ছেন না। বোঝা যাচ্ছে, নগরকর্তারা যে স্থানকে বাস থামার উপযুক্ত মনে করছেন ট্রাফিককর্তারা সে স্থানে বাস থামলে সমস্যা হবে মনে করছেন। উলুখাগড়া যাত্রীরা ট্রাফিক পুলিশের ডাণ্ডার বলয়সীমার বাইরে (সামনে বা পেছনে) দৌড়ে চলমান বাসে উঠার ঝুঁকি নিচ্ছেন।

৪.

বাসে উঠতে গেলে অধিকাংশ সময়ে শুনতে হয় — ‘লেডিস্‌ সিট নাই’! মানে বাসে নারী যাত্রীকে উঠতে দেয়া হবে না। বাসে বসার সব আসন পূর্ণ হয়ে গেলে অবধারিতভাবে কন্ডাকটর, হেলপাররা এই কথা বলে থাকেন। আগে এই কথা শুনলে নারীরা পিছিয়ে যেতেন, এখন তাঁদের অনেকেই বলেন, ‘দাঁড়ায়া যামু’। তারপরেও ভীড় বাসে নারীদের ওঠার মতো অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি। নারীদেরকে দেখলেই তাদেরকে স্পর্শ করার, নিপীড়ন করার প্রবল ইচ্ছেজাগা ইতরের সংখ্যা এখনো অনেক।

৫.

ঢাকার বাসগুলোতে দরোজা দিয়ে উঠতে শুরুর ৬টি বা ৯টি আসন ‘নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত’ এমনটা লেখা থাকে। তবুও অনেক লোক আছে যারা সারা বাসের আসন ফাঁকা থাকলেও ঐ সংরক্ষিত আসনগুলোতেই বসবে। এই ব্যাপারে বাসের ড্রাইভার, কন্ডাকটর, হেলপার বা অন্য যাত্রীরা কিছু বললে ঐ লোকগুলো অশ্লীল তর্ক শুরু করে। এমন সংরক্ষণ কেন করা হলো তার যৌক্তিকতার প্রশ্ন তুলে তারা নারীবাদ আর দেশে প্রায় তিন দশক ধরে চলা নারী নেতৃত্বকে অশ্লীল কটাক্ষ করে দু’দশ কথাও শুনিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে ভাবি, দেশে আদমশুমারী হয় কিন্তু শুয়োরশুমারী হয়না কেন!

৬.

(ক)

বাসে উঠলে কিছু মানুষ পাঁচ টাকা ভাড়া দেবার জন্যও পাঁচশ বা হাজার টাকার নোট বাগিয়ে ধরেন। আদতেই সাথে ভাঙতি টাকা নেই এমন মানুষ বাধ্য হয়ে এ’কাজটি করেন বটে তবে এখানে এক শ্রেণীর মানুষ আছেন যারা এই সুবাদে নোটটা ভাঙিয়ে নিতে চান; এবং এখানে আরেক শ্রেণীর মানুষ আছেন যারা কামনা করেন নোটের আকার দেখে সাথে ভাঙতি না থাকা কন্ডাকটর আপাতত পিছিয়ে যাবেন। পরে কন্ডাকটর ভুলে যাবার সুবাদে তিনি ভাড়া না দিয়েই নেমে যাবেন।

(খ)

বাসে যখন কন্ডাকটর ভাড়া চাইতে আসেন তখন অবধারিতভাবে কিছু মানুষ বলবেন, “পরে আসেন/আস/আয়”। এই কথাটা তারা কেন বলেন তা আমার বোধগম্য নয়। ভাড়া যখন দিতেই হবে তখন চাওয়া মাত্র ভাড়া দিতে অসুবিধা কী? তাদের কারো কারো উদ্দেশ্যটা তখনই স্পষ্ট হয় যখন গন্তব্য আসলে তারা ভাড়া না দিয়ে নির্বিকার মুখে নেমে পড়েন।

(গ)

মতিঝিল থেকে উঠা যাত্রী পাঁচ টাকা ভাড়া দিলে কন্ডাকটর জিজ্ঞেস করেন, “কই যাইবেন”? যাত্রী উত্তর দেন, “পল্টন”। বাস পল্টন পার হয়ে, প্রেস ক্লাব – মৎস্য ভবন – শাহ্‌বাগ – বাংলা মোটর - কাওরান বাজার পার হয়ে ফার্মগেটে চলে আসে তবুও পাঁচ টাকা ভাড়া দেয়া যাত্রীর পল্টনযাত্রা শেষ হয় না। বাস মণিপুরীপাড়া অথবা বিজয় সরণি সিগন্যালে আসতে তিনি টুক্‌ করে নেমে পড়েন। এভাবে পাঁচ টাকা দিয়ে তিনি দশ টাকারও বেশি পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেন।

৭.

ঢাকার বাসে কন্ডাকটর যেভাবে ভাড়া কাটছেন তাকে সেভাবে ভাড়া কাটতে দিন, এবং আপনার কাছে তিনি যখন ভাড়া চাইবেন ঠিক তখনই ভাড়া দিন, যদি না আপনার কাছে ভাড়া চাইবার আগেই আপনার গন্তব্য চলে আসে। আপনি যদি তাকে ডেকে ভাড়া দেন তাহলে তার ভেতরকার ভাড়া কাটার নিজস্ব ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়ে। তখন তিনি বার বার আপনার কাছে ভাড়া চাইতে আসবেন।

(সামাজিক জীবনে কোন আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধব সাহায্য চাইলে আমি সাধারণত যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করি। কিন্তু এই জীবনে যত বার কাউকে আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে গেছি দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া তার প্রতিবার দেখেছি সাহায্যপ্রাপ্ত জন বলেছেন, “এই ব্যাটা পাণ্ডব আগ বাড়িয়ে ভ্যাজাল না করলে আমার এই দশা হয় না”! তো দশাটা কী? তিনি যে বিপদে পড়েছিলেন সেটা। যেহেতু আমি আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম তাই এইখানে তার বিপদে পড়ার দোষটা নিঃসন্দেহে আমার। আমি বাস যাত্রা থেকে শিক্ষা নেইনি।)

৮.

বাসের কর্মীদের অঘোষিত পদমর্যাদা হচ্ছে ড্রাইভার > কন্ডাকটর > হেলপার। অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া বাসযাত্রীদের সবাই বাসের চালককে ‘ড্রাইভার সাহেব’ বা ‘ওস্তাদ’ বলে সম্বোধন করেন। ব্যতিক্রমীরা ‘অই ড্রাইভার’ বলে থাকেন। কন্ডাকটরকে ‘আপনি’ সম্বোধনকরা যাত্রীরা সংখ্যালঘু, ‘তুমি’ আর ‘তুই’ সম্বোধন করা যাত্রীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই আছে। বাসের সহকারী অর্থাৎ হেলপারকে ‘আপনি’ সম্বোধনকরা যাত্রীরা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি, ‘তুমি’ সম্বোধনকারী যাত্রীর সংখ্যা কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের তারাদের মতো — তাদেরকে কখনো দেখা যায়, কখনো দেখা যায় না।

যাদের কাছ থেকে আমাদের সেবা নিতে হয় তাদেরকে যথাযথ সম্মান দিতে আমরা প্রায়ই কার্পণ্য দেখাই। আমরা এটা ভাবতে চাই না যে, যাকে অপমান করছি আমি তার তুলনায় কোন বিচারে শ্রেষ্ঠ নই।

(ঠিকঠাক মতো লিখতে পারলে বাস কথনে গল্পের সংখ্যা ‘আলিফ লায়লা’কে হার মানাবে। আমার অতো এলেম নেই। আমি যেটুকু পারি লেখার চেষ্টা করবো।)


মন্তব্য

তিথীডোর এর ছবি

যেখানে কামলা দিই, তার প্রধানতম সুবিধা যাতায়াতসেবা। সেটা চালু হবার আগের একমাস জীবন মোটামুটি দূষিত মনে হতো।

বাসের আকার-আয়তনের সঙ্গে গতির দিকটাও আলোচ্য। ব্রেক, সিগন্যাল এবং স্পিডব্রেকার উপেক্ষা করে যেভাবে বেপরোয়া উড়ে চলে, রীতিমতো আতঙ্কিত হই।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

বাসের গতি-জাড্যতা, দ্রুতি-বেগ, ত্বরণ-মন্দন, ট্রাফিক আইন-সিগন্যাল-সিম্বল, রাস্তার খোমা-ছুরত ইত্যাদি নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার এরাদা রাখি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রেজওয়ান এর ছবি

বাস ভাড়া/মেট্রো ভাড়ার ক্ষেত্রে ডিজিটাল কার্ড পদ্ধতি সবচেয়ে কার্যকরী। দিল্লী মেট্রো প্রথমে টোকেন দিয়ে শুরু করলেও এখন কার্ডে শিফট করছে। আর বাসের ক্ষেত্রেতো - বাস ড্রাইভার নিতে পারে - সামনের গেট শুধু খোলা থাকে - ভাড়া দিয়ে ঢুকবেন - কার্ড রিডার থাকবে বা ড্রাইভার (আমাদের দেশের ক্ষেত্রে হয়ত হেল্পার) ক্যাশ নেবে। কুয়ালালামপুরের পাবলিক বাসে ভাড়া ১-৩ রিঙ্গিত (দূরত্ব ভেদে)। নির্দিষ্ট পরিমাণে ভাড়া নিয়ে আসতে হয় - কারণ টাকাটি বাক্সে জমা হওয়ার পরে টিকেট ইস্যু হয়। ভাংতি না নিয়ে আসলে নেমে যেতে হয়। মাঝে মধ্যে বাসে চেকিং হয় (কেউ ক্যাশে অল্প ভাড়া দিয়ে দুরে যেতে চাইলে) এবং অনেক পরিমাণে ফাইন হয় ভাড়া ঠিক না থাকলে বা বাসে গণ্ডগোল করলেও। আর বাসে কার্ডের ক্ষেত্রে আরও জব্বর নিয়ম - প্রথমে বাসের গন্ত্যব্যের শেষ মাথা পর্যন্ত টাকা কেটে ফেলে। এরপর যখন আপনি মাঝের কোন গন্তব্যে নামবেন - নামার আগে আবার কার্ড সোয়াইপ করলে বাকি টাকা ফেরত পাবেন - ভুলে গেলে আপনারই লস। সিস্টেম চালু করলে ভাড়া না দেবার প্রবণতার এইসব বদঅভ্যাস লাইনে চলে আসবে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আইন করে বা প্রযুক্তিগত কায়দা দিয়ে বদভ্যাস হ্রাস করা যায় বটে, নির্মূল করা যায় না। বাসে উঠলে যতটুকু গেলাম তার জন্য ঘোষিত ভাড়াটা দিতে হবে এই মানসিকতাটা যাত্রীদের সবার মধ্যে গড়ে উঠলে, আর যাত্রীকে যতটুকু নিয়ে গেলাম ঠিক ততোটুকুর জন্য ঘোষিত ভাড়া দাবী করার মানসিকতা সব বাস কোম্পানী আর তার কর্মীদের মধ্যে গড়ে উঠলে এই সমস্যাটার সহজ সমাধান হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে খবরের কাগজে দেখি দেশের কোথাও কোথাও কোন বিক্রেতা বা কর্মীবিহীন 'অনেস্টি শপ' চলছে। সুতরাং একদিন কন্ডাকটর-হেলপারবিহীন বাস সার্ভিসও অসম্ভব কিছু হবে না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

বাংলাদেশের বাসগুলিতে যা হওয়ার সম্ভাবনা আছেঃ

১। কার্ডরিডার চালুর মাসখানেক পরেই অনির্দিষ্টকালের জন্য নষ্ট হয়ে যাবে; এবং/অথবা

২। কার্ডরিডারকে এমনভাবে সেট করা হবে, যাতে সেটা যাত্রীর কার্ডের পুরো টাকা একবারে কেটে ফেলবে, এবং সেটা আর ফেরত দেবে না (যাত্রী নামার আগে কার্ড সোয়াইপ করুক বা না করুক)।

Emran

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

Emran, কার্ড এবং সোয়াইপ মেশিনওয়ালা বাস যে ঢাকায় ছিলোনা তা নয়। সেগুলো ছিল এবং কিছুদিন পর আপনি যা যা বলেছেন ঠিক তাই তাই ঘটেছে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাসিব এর ছবি

যেকোন পরিকল্পনায় জনসংখ্যা আর জায়গার অভাব সবকিছু গুবলেট করে দেয়। এর উপর থাকে সততার অভাব। কয়েকটা পয়েন্ট বলি।

১। বাসে ওঠার সময় টিকেট কেটে বা কার্ড সোয়াইপ করে ওঠা। এতে ঢাকায় যে সমস্যা হবে সেটা হলো মানুষ শাহবাগ টু ফার্মগেট টিকেট কেটে উত্তরায় নামবে। এটা ঠেকাতে যেরকম বাসে চেকার ওঠার কথা বললেন সেভাবে চেকার উঠবে। কেউ এরকম অতিরিক্ত ভ্রমণ করছে দেখলে ফাইন করবে। এটা কার্যকরী করতে কিছু সমস্যা আছে। ইওরোপে চেকার উঠে ফাইন করলে টাকাটা জায়গায় দাড়িয়ে দিতে হয়। অথবা বিল ধরিয়ে দেয়া হয়। সেই বিল বাসায় গিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে ট্রান্সফার করে পাঁঠাতে হয়। লোকাল বাসে টিকেট ছাড়া উঠলে জার্মানিতে এই ফাইন এখন ভাড়ার প্রায় ২৫ গুন। এখন ঢাকায় এইরকম সিস্টেম করলে অর্থাৎ ১০ টাকার ভাড়া ফাকি দেবার জন্য ২৫০ টাকা ফাইন করলে দেখা যাবে যাত্রীর কাছে সেটা নেই। বাসায় গিয়ে দেবেন এইটা আপনি বাংলাদেশে নিশ্চিত করতে পারবেন না। যাত্রী বাসায় গিয়ে টাকা না দিলে আপনি কিছু করতে পারবেন না। কারণ তাকে খুঁজে পাবার কোন উপায় আইনি কাঠামোয় নেই বাংলাদেশে। জার্মানিতে ১ টাকা ডিফল্ট করলেও বাসায় চিঠি আসবে কারণ বাসার ঠিকানাটা সঠিকভাবে আমার আইডিতে লেখা আছে। আমি টাকা না দিলে কয়েকটা চিঠি পাঠিয়ে আমাকে ডিফল্টার লিস্টে ফেলে দেবে। এই লিস্টে নাম ওঠা মানে ফিনান্সিয়াল সুইসাইড। বাংলাদেশে আপনি যেহেতু ডিফ্লটারকে ধরতে পারবেন না বা ধরার মতো কাঠামো প্রস্তুত নেই সেহেতু এভাবে আপনি কিছু করতে পারবেন না। আইন করার সাথে এনফোর্স করার ক্যাপাসিটি গ্রো করতে হয়। বাংলাদেশে মাত্র আইডি কার্ড দেয়া শুরু হয়েছে। ইন্ডিয়াতে আধার শুরু করেছে। এসব কাজে লাগানোর মতো অবস্থায় যেতে আরো ২০ বছর।

২। জোনভিত্তিক বাস ভাড়া করা যেতে পারে। এক জোনে এক ভাড়া হবে। এক জোনের বাস অন্য জোনে যাবে না। রুটগুলো সার্কুলার হবে। একবার বাসে ওঠা মানে সে টিকেট কেটে উঠেছে। সে টিকেট অ্যানালগ বা ডিজেটাল যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন।

৩। নর্থ আমেরিকায়, লন্ডনের সাবওয়েতে দেখেছি এই সিস্টেম। কার্ড সোয়াইপ করার জায়গা থাকে ঢোকা আর বের হবার সময়ে। ঢোকার জায়গা আর বের হবার জায়গা হিসাব করে টাকা কেটে রাখবে মেশিন। বাসের জন্য এই সিস্টেম করার সমস্যা হল এজন্য বাস স্ট্যান্ড বানানো লাগবে বড় একটা জায়গা জুড়ে যেখানে সিকিউরড এন্ট্রান্স আর এক্সিট রাখা লাগবে। এতো জায়গা দেশে নাই।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আপনার পর্যবেক্ষণগুলো সঠিক। আপাতত আমরা যদি এক রুটের সব বাসের জন্য অভিন্ন টিকিট, টিকিট কাউন্টার এবং কিউ পেতাম তাহলে লাইন ধরে বাসে উঠতে পারতাম তাহলে বেঁচে যেতাম, অযথা জীবনের ঝুঁকি নিতে হতো না। উঠার এবং নামার সময়ে টিকিট চেক করলে অনেক কম জনবল দিয়েই কাজটা অনেকাংশে সফলভাবে করা সম্ভব।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

সোয়াইপ কার্ড শুরু করলে শাহবাগ টু ফার্মগেট টিকেট কেটে উত্তরায় নামার সুযোগ তো কমবে? উঠার সময় সোয়াইপ আবার নামার সময় সোয়াইপ।
ব্যপারটা কঠিন, এবং অনেক কিছুর সাথে সংশ্লিষ্ট (যমন বাস থামার জায়গাই না, সময় কম, কিউতে না দাঁড়িয়ে সবাই ঠেলা-ধাক্কা করে বাসে উঠতে হয়)।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

কার্ড সোয়াইপ করার ক্ষেত্রে কী ঘটেছিল সেটা উপরে এমরানকে দেয়া জবাবে বলেছি। তবে এইসব অদক্ষতা কাটানো গেলে কার্ড সোয়াইপ করা বা আঙুলের ছাপ দেয়াটা কার্যকর ব্যবস্থা হতে পারে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নৈষাদ এর ছবি

সুন্দর একটা সিরিজ হচ্ছে।
ডিমেনশিয়া হয়ে যাচ্ছে কিনা জানিনা। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও নব্বই দশকের শেষ দিকে ঢাকার জনপ্রিয় হয়ে উঠা সেই এসি-বাস গুলির নাম মনে করতে পারলাম না (টাটার মিনি-বাস ছিল সেগুলি)। শেষমেষ টিকতে পারলা না।
ঢাকা মেট্রোপলিসের আয়তন যে কলকাতা মেট্রোপলিসের আয়তনের চেয়ে ৬৬% বড় সেটা জানতাম না।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিমিয়াম, নিরাপদ। আর মনে নেই।

সত্যপীর এর ছবি

প্রিমিয়াম বাস, সাদা রঙের টাটা বাস। তার কয়দিন পরে নামে নিরাপদ বাস, লম্বা কোরিয়ান বাস।

..................................................................
#Banshibir.

অতিথি লেখক এর ছবি

১৯৯০-র দশকের শেষ এবং নতুন সহস্রাব্দের শুরুর দিকে ঢাকায় সবচেয়ে জনপ্রিয় বাস ছিল বিআরটিসি-র দোতলা ভলভো। আমি সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, এবং আমরা থাকতাম বনানীতে। কাকলি-শাহবাগ রুটে নিয়মিত যাতায়াত করতাম। কাকলিতে বিআরটিসি, প্রিমিয়াম, নিরাপদ - তিন বাসেরই কাউনটার ছিল। এমন দিনও দেখেছি যেদিন তিন কাউনটারেই বাস হাজির, কিন্তু এসি-যুক্ত প্রিমিয়াম/নিরাপদ বাদ দিয়ে লোকে এসি-বিহীন ভলভোতে উঠেছে।

উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বড় শহরগুলিতে দেখেছি গণপরিবহন (বাস, ট্রাম, রেল) একটা সংস্থাই নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি শখানেক প্রাইভেট বাস কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়ার বদলে বাংলাদেশ (এবং/অথবা ঢাকা নগর) সরকারের উচিৎ ছিল বিআরটিসি-কে উন্নত এবং শক্তিশালী করা। এত প্রাইভেট বাস চালু হয়ে সার্ভিসের মানও বাড়েনি, ভাড়াও কমেনি; উল্টো বরং ঢাকায় ট্রাফিক জ্যাম বেড়েছে!

Emran

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ভলভো বাসের ব্যাপারটি খুব ভালোভাবে তদন্ত হওয়া দরকার। ঐ আমলে এক একটি ভলভো বাস কয়েক কোটি টাকা খরচ করে কেনা হয়েছিল। এই বিপুল ব্যয়কে পাবলিকের নিকট গ্রহনযোগ্য করানোর জন্য পত্রপত্রিকায় নানা প্রকার হাইপও তৈরি করা হয়েছিল। অন্য বাসের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী হবার কথা থাকলেও কার্যত এই ভলভোগুলোর আয়ু অন্য রদ্দি বাসের মতো হয়েছিল। বাসগুলো আসলেই খারাপ মানের ছিল নাকি বাসগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ করা হতো - এইসব নিয়ে নানা প্রকার গল্প বাসেই শোনা যেতো। সত্যটা কী সেটা আর জানতে পারিনি।

শখানেক প্রাইভেট বাস কোম্পানিকে লাইসেন্স দেয়ার বদলে বাংলাদেশ (এবং/অথবা ঢাকা নগর) সরকারের উচিৎ ছিল বিআরটিসি-কে উন্নত এবং শক্তিশালী করা।

- বর্তমানে বিআরটিসি'র বাসগুলোর অবস্থা এবং সেবার মান কি আপনার এই আশাকে সমর্থন করে? কয়েকশ' প্রাইভেট কোম্পানীর বাস দিয়ে চলা এখনকার ব্যবস্থা ভালো নয় বটে, কিন্তু একটি কোম্পানীর হাতে সকল বাসযাত্রীর জিম্মি হওয়াটাও ভালো ব্যবস্থা নয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে দেখা যেতে পারে - বিআরটিসি-র দক্ষতা এবং সেবার মান বৃদ্ধির জন্য সরকার কি কি পদক্ষেপ নিয়েছে? বিআরটিসি-র অদক্ষতা এবং নিম্নমানের সেবার চূড়ান্ত বেনেফিশিয়ারী কারা হচ্ছে?

Emran

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শুধু বিআরটিসি নয় এই প্রকার রাষ্ট্রীয় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন, বিআইডব্লিউটিসি, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ বিমান, বাংলাদেশ পোস্টঅফিস, বিটিসিএল ইত্যাদিতে দক্ষতা ও সেবার মান বাড়ানোর জন্য গত সাতচল্লিশ বছরে সরকার কি কোন পদক্ষেপ নেয়নি? অবশ্যই নিয়েছে। তাতে জনগণ কি উপকৃত হয়েছে? কিছুটা তো অবশ্যই হয়েছে কিন্তু সেটা কি কাঙ্খিত পর্যায়ের? তা যে হয়নি সেটা বোঝা যায় বেসরকারী বাস কোম্পানী, লঞ্চ-কার্গো কোম্পানী, এয়ারলাইন্স, ক্যুরিয়ার সার্ভিস, মানি ট্রান্সফার, মোবাইল ফোন কোম্পানী ইত্যাদিগুলোর রম্‌রমাতে। রেল খাতে বাংলাদেশ রেলওয়ের মনোপলি, তবু তার লোকসান কী পরিমাণ সেটা দেখুন!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ঢাকা মেট্রো বাস কোম্পানী 'প্রিমিয়াম' বাস চালাতো মতিঝিল-উত্তরা, মতিঝিল-মোহাম্মদপুর, মতিঝিল-মিরপুর (১০-১১-১২) এবং মতিঝিল-নারায়ণগঞ্জ রুটে। এর মধ্যে মিরপুর রুটের সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায় সবার আগে - টিকতে দেয়া হয়নি। এরপর বন্ধ হয় মোহাম্মদপুর রুট - একই কাহিনী। উত্তরা আর নারায়ণগঞ্জ রুটে বেশ কয়েক বছর চলেছিল। 'নিরাপদ'-এর লম্বা বাস নামিয়েছিল একটা বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া যৌথ মূলধনী কোম্পানী, নাম মনে নেই।

ঢাকা মহানগরের ভেতরে এখন বিআরটিসি'র উত্তরা-মতিঝিল রুটের অল্প কিছু বাস ছাড়া আর কোন রুটে, কোন কোম্পানীর এসি বাস দেখা যায় না।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

প্রিমিয়াম/নিরাপদ বাসগুলি চালু হওয়ার পরে ঢাকার মানুষের মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে সুশৃঙ্খলভাবে বাসে উঠানামার একটা চর্চা গড়ে উঠেছিল। এটা হয়ত একটা ফ্যাক্টর (এসি আরেকটা ফ্যাক্টর হতে পারে) যে কারণে যেসব রুটে এই বাসগুলি চলত, প্রয়োজনে একটু বেশী দাম দিয়ে টিকেট কিনতে হলেও সেসব রুটের যাত্রিরা এই বাসগুলিতে চড়ার চেষ্টা করত।

Emran

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

এসি বাসের ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ সঠিক। এই বাসগুলোর জনপ্রিয়তার কারণও এইগুলো। তবে এই বাসগুলোর মেইনটেন্যান্স খরচ বেশি (ঢাকার রাস্তা বিবেচনায় খরচটা আরও বেশি) তাই ব্যবসাটা ব্রেক-ইভেনে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগতো। এর মধ্যে অন্য বাসগুলোর রাজনীতিতে পড়ে এরা আর লাভের ঘরে পৌঁছাতে পারেনি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

হাসিব এর ছবি

বাস, গণপরিবহন প্রসঙ্গ আমাদের ফিকশন সাহিত্যে তেমন আসে না। কলকাতার লেখকদের লেখায় এটা আসে। বাংলাদেশের কেউ কলকাতায় না গিয়ে কলকাতার অনেক রাস্তার নাম জানেন এই ফিকশনের কল্যাণে। ঢাকায় বাস করা লেখকেরা এটা নিয়ে তেমন লেখেননি। যদিও ঢাকায় বাস করা একজন নাগরিকের জীবনের একটা বড় অংশ রাস্তায় কোন না কোন পরিবহনের ভেতরে বসে বা দাঁড়িয়ে কাটে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

সাধারণ মানুষ প্রতিদিন যেসব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যান সেসবের প্রায় কিছুই আমাদের ফিকশনে তেমন আসে না। এই কারণে দেখবেন সেসব ফিকশন পড়লে স্থান বা কাল সম্পর্কে বিশেষ কোন ধারণা পাবেন না। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া বড় ঘটনাগুলোর কোন বর্ণনা বা ছাপ সেগুলোতে থাকে না। সেগুলোর ভাষা এবং সংস্কৃতিও কোন বিশেষ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ভাষা বা সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করে না।

একবার সদরঘাট থেকে গাবতলী বা আবদুল্লাহ্‌পুর পর্যন্ত লোকাল বাসে করে গেলে বাসের ভেতরে যাত্রীদের কথা-আচরণ, পথে ঘটে যাওয়া ঘটনা - এসব থেকে দুয়েকটা গল্প লেখা সম্ভব। তবে তার জন্য দেখার চোখ, বোঝার মানসিকতা, কল্পনার সক্ষমতা এবং লেখার যোগ্যতা থাকতে হবে। যাদের সেসব থাকে না তাদেরকে 'গরিবের পোলা, বড়লোকের মাইয়া', 'বাড়িতে বিয়া মানে না', 'বাপ-মায়ের খুনের প্রতিশোধ', 'মেলায় হারায়া যাওয়া' ইত্যাদি নিয়ে ফিকশন লিখে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

karim এর ছবি

১। বাংলাদেশের সাহিত্যে 'ডিস্ট্রিক্ট রোড' এর বড় উল্লেখ আছে। কিন্তু নগরসাহিত্যগল্পে বাস, রাস্তার নাম নাই। সুনীলের মেট্রোর মতো বাংলাদেশী নীরাও মধুমিতার সামনে দাঁড়ায় না। রেস্টুরেন্টের গল্প নাই, স্ট্রিটফুডের খবর নাই। হিমু ছাড়া সাহিত্যের অন্য কোনো চরিত্র বেশি হাঁটাহাঁটি এখনও করেননি।
২। প্রিমিয়াম বাসের মতিঝিল উত্তরা ২০টাকা ভাড়া এবং ডেটিং এর জন্য জনপ্রিয় ছিল।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

১। বাংলাদেশের (পূর্ববঙ্গের) নায়িকারা এই সেদিনও পাবলিক প্লেসে নায়কের সাথে দেখা করতো না। তাদের সকল অভিসারই ছিল গোপন ও লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাই এদেশের গল্পে দীর্ঘকাল ধরে স্থানের বর্ণনাগুলোতে রাস্তার বা গণপরিবহনের বিবরণ অনুপস্থিত ছিল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শহীদুল জহির কিন্তু সেসব অচলায়তন ভেঙেছেন। তাঁদের লেখায় রাস্তা-পাড়া-মহল্লার খুঁটিনাটি উঠে এসেছে, পথের ধারের দৃশ্যাবলী এবং পথচলতি চরিত্ররাও এসেছে।

২।

এবং ডেটিং এর জন্য জনপ্রিয় ছিল

- আহা! কী কথা মনে করিয়ে দিলেন। আমাদের এক বন্ধু সেই আমলে চাকুরিতে যেদিন প্রথম বেতন পেলেন সেদিন সবেতন অবস্থায় গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে একটা মতিঝিল-উত্তরা-মতিঝিল রাইড দিলেন। আবেগে টইটুম্বুর অবস্থায় কখন যে পকেট থেকে বেতনভরা খাম বাসে পড়ে গেছে সেটা আর টের পাননি। বাসায় ফিরে তার তো মাথায় হাত! গার্লফ্রেন্ডকে 'ফয়ট্স‌'-এ না খাইয়েই বন্ধুটির অবস্থা সমারসেট মমের গল্পের নায়কের মতো হয়ে গেলো!


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

মন মাঝি এর ছবি

বেচারা! দেঁতো হাসি

****************************************

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বাসের কর্মীদের যে আচরণটি খুব পীড়িত করে তা হল- ওঠার সময় কোন তাড়া নাই, কিন্তু নামার সময় বলে, চালু করেন।
বাসের প্যাসেঞ্জারদের যে আচরণটি খুব পীড়িত করে তা হল- "ব্যবহারে বংশের পরিচয়" প্রবচনটি কেউ সত্য বলে মনে করেন না।

হাসিব এর ছবি

ব্যবহারে বংশের পরিচয়

জিনিসটা আসলেই সত্য নাকি?

মন মাঝি এর ছবি

জেনারেলি, সবটুকু না হলেও অনেকখানিই তাই কি মনে হয় না? এখানে 'বংশ' ও 'ব্যবহার' বলতে যা বোঝানো হচ্ছে, তা মূলতঃ ফর্ম্যাটিভ পিরিয়ডে (শৈশব-কৈশোর-ইত্যাদি) যে পরিবেশের প্রভাবে* মানুষের কিছু সংস্কৃতি, সামাজিকতা ও মূল্যবোধগত "লার্ন্ড বিহেইভিয়ার" গড়ে উঠে - "সেই পরিবেশটাকেই" আসলে "বংশ" - আর ঐ "লার্ন্ড বিহেইভিয়ার"-এর আলোচ্য বর্তমানের প্রতিভাত রূপটাকে "ব্যবহার" বলা হচ্ছে। এই বংশের সাথে বলিয়াদি বংশ বা ছাগলিয়া বংশ বা এমন কোনো সুনির্দিষ্ট বা বায়োলজিকাল "বংশের" কোনো নেসেসারি, ইনেইট কিম্বা জেনেটিক সম্পর্ক নেই - সম্পর্কটা ঐ "লার্ন্ড বিহেইভিয়ার"-এর সাথে তার অনুমিত বা প্রকল্পিত জন্মদাতা "পরিবেশ"-টার।

বাস্তব দুনিয়ায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই বাগ্‌ধারাটা, আমার মতে, একটা ভদ্রসভ্য ছদ্মবেশী গালি আসলে। আমি যতদুর লক্ষ্য করেছি, কারও ব্যবহারের সমালোচনা বা বিদ্রুপ করার সময়ই এটা বেশি-বেশি উঠে আসে বা ব্যবহৃত হয়, প্রশংসা করার সময় না! অর্থাৎ, কারও ব্যবহার খুব খারাপ লাগলে তার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে একটা সাব্জেক্টিভ জাজমেন্ট পাস করে হেয় করার জন্য তথা শান্টিং দেয়ার জন্যই এটা বলা হয়, বাস্তবে তার ব্যাকগ্রাউন্ড যেমনই হোক না কেন। এই দৃষ্টিকোন থেকে একটা টার্ম মাথায় আসছে, আমরা একে হয়তো "রিভার্স বংশায়ন" বলতে পারি! দেঁতো হাসি

--------------------------------------
*সাধারনত পারিবারিক ধরে নেয়া হয়।

****************************************

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

জিনিসটা আসলেই সত্য নাকি?

জিনিসটা অনেক সময় বাসের গায়ে লেখা থাকে। এই অমিয় বানীর ব্যাকগ্রাউন্ড মেসেজ হল- দেখেন ভাই প্যাসেঞ্জারগন, আপনাদের মধ্যে যারা কন্ডাক্টর/হেল্পারদের সাথে মধুর ব্যবহার করেন, তাঁরা সেটা এই কারনে করেন যে, আপনারা অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত বংশের( যেমন সৈয়দ কিংবা ব্রাহ্মণ) সন্তান। আর যারা সেরকমটা করতে ব্যর্থ হয়, সেটা এই কারনে হয় যে তারা আসলে ফকিন্নির পোলা। চাল্লু

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

উঠা-নামা'র ক্ষেত্রে যাত্রীদের সাথে বাসের কর্মীদের এই পার্থক্যপূর্ণ আচরণ আমাদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও দেখতে পাবেন। তৃষ্ণা পেলে ভোট দেবার আগে 'ফুস্‌ পানি' আর ভোট দেয়া শেষ হলে 'নরমাল পানি'র গল্পতো পুরনো ব্যাপার।

বাসের কর্মীদের সাথে কিছু যাত্রীর অমানবিক, অশোভন, অসভ্য আচরণের মতো ব্যাপার অন্যত্রও দেখা যায়। হোটেল-রেস্টুরেন্টের কর্মী, রিক্শা‌-অটোরিক্‌শা চালক, পাড়ার বা বাজারের দোকানদার, মোট বওয়া শ্রমিক, গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নির্মাণ শ্রমিক, অন্যান্য শ্রমিক, নিরাপত্তা কর্মী, অফিসের পিওন .................................. এমন অনিঃশেষ তালিকা দেয়া যাবে যাদের সাথে বিপুল সংখ্যক মানুষ এমন জঘন্য ব্যবহার করে থাকেন। এটা নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ আছে, তবে সেটা এখানে আলোচ্য নয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

এক লহমা এর ছবি

ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল ঢাকা-ফরিদপুর-বিক্রমপুর-সিলেট যাবো - কোনদিন একবার ঠিক যাবো। আজ আর সেইসব স্বপ্ন অবশিষ্ট নেই। আপনাদের লেখা থেকেই সেইসব স্বপ্নের রাজ্য থেকে ঘুরে আসি। নানা সীমাবদ্ধতার কথা জানি এইসব মরমী লেখা থেকে - তবু এদের নিয়ে আমার রোমান্টিকতা কমে না।

মানুষের সাথে মানুষ যে সব অমানুষিক জঘণ্য আচরণ করে - তা একমাত্র মানুষের দ্বারাই সম্ভব মনে হয়।

পরের কিস্তির অপেক্ষায় থাকলাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

আমারও ইচ্ছে করে বিশাল বাংলার ছোট-বড় শহরের অলি-গলিতে হাঁটতে, গাঁয়ের মেঠো পথ দিয়ে যেতে, পথচলতি মানুষদের দেখতে, পাড়া-মহল্লার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড দেখতে, পথের ধারের খাবারের দোকান থেকে খেতে, কুড়িয়ে পাওয়া স্বজনদের সাথে কথা বলতে। আমার বিশাল বাংলা উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত, পূবে লুসাই পাহাড় থেকে পশ্চিমে মানভূম-সিংভূম-ধলভূমগড়ের সীমানা পেরিয়ে। আমি জানি আমার এই স্বপ্ন আর কখনো পূরণ হবে না। যেদিন সময় হবে সেদিন অর্থ থাকবে না, যেদিন অর্থের সংস্থান হবে সেদিন শরীর আর চলবে না। আমার বিশাল বাংলা যেমন অধরা স্বপ্ন, আমার বাংলা দেখাও তেমন অধরা।

পরের কিস্তি মোটামুটি লেখা আছে। আপনারা লেখা দিয়ে এই পোস্টটাকে নীড়পাতা থেকে সরিয়ে দিলেই পরের কিস্তি পোস্ট করবো।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।