বই পরিচিতি -‘পেঙ্গুইন’

তারেক অণু এর ছবি
লিখেছেন তারেক অণু (তারিখ: সোম, ২৫/০৩/২০১৯ - ১:০১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মানুষের সাথে পেঙ্গুইনের একমাত্র সম্পর্ক এই সেদিন অবধিও ছিল কেবলই খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক! জেলে, নাবিক ও অভিযাত্রীরা যখনই পেঙ্গুইনদের আবাসে গিয়েছেন তখনই তাদের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে জাহাজ ভর্তি করেছেন সমুদ্রযাত্রার রসদ হিসেবে, সেই সাথে বাক্স ভর্তি করে এনেছেন পেঙ্গুইনদের ডিমও! তখনো মানুষের কাছে পেঙ্গুইনদের আদরণীয় ‘ইমেজ’ তৈরি হয় নাই, যদিও পেঙ্গুইনেরা মানুষের কাছে প্রথম থেকেই ছিল এক বিস্ময়কর পাখি, যারা কিনা মানুষের মত সোজা হয়ে দাড়াতে পারে, যাদের পাখির মত পালক আছে, এবং যারা মাছের মতই সাতার কাটতে পারে।

পেঙ্গুইন মাত্রই বরফের দেশের পাখি যারা খুব ঠাণ্ডা ছাড়া টিকতে পারে না এমন একটা জনপ্রিয় ভুল ধারণা আছে আমাদের মাঝে, যদিও অধিকাংশ পেঙ্গুইনই ঠাণ্ডার দেশেরই বাসিন্দা, কিন্তু পৃথিবীতে বর্তমানে যে ১৭ প্রজাতির পেঙ্গুইন আছে তাদের আবাস প্রায় দক্ষিণ মেরু থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে পৃথিবীর শুষ্কতম স্থান আতাকামা মরুভূমি ছুঁয়ে ক্রান্তীয় গ্যালোপাগোস দ্বীপ অবধি বিস্তৃত। এই পেঙ্গুইনদের সাথে মানুষের সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে তথ্যবহুল, শতাধিক ইল্যুস্ট্রেশন সম্বলিত এক চমৎকার বই লিখেছেন অ্যান্টার্কটিকার ইতিহাসবিদ স্টেফান মার্টিন, যা প্রকাশ করেছে রিয়েকশন বুকস, যারই পাঠপ্রতিক্রিয়া এই লেখা।

আবিষ্কৃত পেঙ্গুইন ফসিল গবেষণা করে দেখা গেছে পেঙ্গুইনেরা একসময় উষ্ণ সাগরের পাখিই ছিল, পরবর্তীতে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের উদ্ভব ও ঠাণ্ডা আবহাওয়ার আগমনের কারণে তারা বিবর্তিত হয়ে এখানে বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়ে ওঠে। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে নিউজিল্যান্ডে ‘ওয়াইমানু’ নামের যে উড্ডয়নে অক্ষম কিন্তু সাতারে পটু পাখির ফসিল পাওয়া গেছে, তাকেই পেঙ্গুইনদের আদিপুরুষ হিসেবে ধরা হয়। ৪ কোটি বছর আগে নানা প্রজাতির পেঙ্গুইনের উদ্ভব ঘটে, তার মধ্যে পেরুতে আবিষ্কৃত ফসিল প্রমাণ করে যে তখন ৫ ফুট উচ্চতার ১৩৬ কেজির ওজনের দৈত্যাকৃতির পেঙ্গুইন রাজত্ব করতো ক্রান্তীয় উপকূলে।

প্রাক-কলম্বিয়ান যুগের ল্যাতিন আমেরিকান মৃৎশিল্পে পেঙ্গুইনদের কোন উপস্থিতিই নেই, অথচ অন্য পাখির ছড়াছড়ি সেখানে, তাই বলা যায় সেই অঞ্চলের আদিবাসী মানুষদের সাথে পেঙ্গুইনদের সেরকম পরিচয় ছিল না। আর ইউরোপিয়ানরা প্রথম যে পেঙ্গুইন চাক্ষুষ করেন তা আফ্রিকান পেঙ্গুইন, যার তৎকালীন নামকরণ করা হয়েছিল জ্যাকাস পেঙ্গুইন বা খচ্চর পেঙ্গুইন, পাখিগুলোর তীক্ষ চীৎকারের কারণে। ইউরোপীয় নাবিকেরা যখন নব নব ভুখন্ডের সন্ধানে পাল উড়িয়ে বেরিয়ে পড়লেন, তখনই দক্ষিণ সমুদ্রে একের পর এক আবিষ্কার হতে শুরু করলো অন্য অনেক পশু-পাখির সাথে পেঙ্গুনেরাও।

১৪৯৭ সালে ভাস্কো দা গামার অভিযানে নাবিকদের বিবরণে হাঁসের মত কিন্তু উড়তে অক্ষম পাখিদের বিবরণ মেলে, যাদের নাবিকেরা ইচ্ছে মত মেরে জাহাজে তুলেছিল খাদ্য হিসেবে। ম্যাগেলানের যাত্রাতেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এখন আমরা জানি সেগুলো ছিল নানা জাতের পেঙ্গুইন।

তিমি, সিল শিকারিদের জাহাজে নিয়মিত মাংসের জোগান দেবার জন্য পেঙ্গুইন হত্যার মোচ্ছব চলতেই থাকে সেই যুগে ( ১৭৭৮ সালে সাউথ জর্জিয়া দ্বীপে সিল শিকারিরা পৌঁছানোর পরবর্তী ৫০ বছরে শুধু লন্ডনের বাজারেই ১২ লক্ষ ফার সিল এবং ২০ হাজার টন এলিফেন্ট সিলের তেল এসেছিলো, এই থেকেও মানুষের হাতে মৃত পেঙ্গুইনের সংখ্যার একটা ধারণা পাওয়া যায়), এর মাঝেও প্রকৃতি নিয়ে উৎসাহী নাবিক ও অন্যান্যরা নিজ থেকে গবেষণা করে যান অদ্ভুত পেঙ্গুইন, তাদের শারীরিক গঠন ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

১৮৩৪ সালে চার্লস ডারউইন ফকল্যান্ড দ্বীপে পেঙ্গুইনদের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করে তাঁর বিখ্যাত নোটবইতে লিপিবদ্ধ করেন, যা আজ অবধি পেঙ্গুইনের সাগর যাত্রার আইকনিক বিবরণ হিসেবে অসংখ্য বার নানা জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে।

১৮৬৫ সালে লন্ডনে রিজেন্ট পার্কের জুলজিক্যাল গার্ডেনে প্রথমবারের মত জীবিত পেঙ্গুইন প্রদর্শিত হয়, এবং সেবার ইস্টার মানডে’তে ২৩,০৬৯ জন দর্শনার্থী সেই পেঙ্গুইন দেখার জন্য জমায়েত করে! ১৯১৪ সালে হারবাট পন্টিং এর নির্বাক তথ্যচিত্র ‘নব্বই ডিগ্রী দক্ষিণ’ এবং ফ্রাংক হার্লের ‘হোম অফ দ্য ব্লিজার্ড’ ছিল ভিডিওতে পেঙ্গুইনদের প্রথম উপস্থিতি। পরবর্তীতে কার্টুন অ্যানিমেশনের পেঙ্গুইনদের সরব আদরণীয় উপস্থিতি মানুষের চিত্ত জয় করে নেয়, এদের বিরুদ্ধে শিকারিদের নির্মম আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন অনেকেই। ১৯৩৫ সালে বিশ্বখ্যাত পেপারব্যাক বইয়ের প্রকাশন ‘পেঙ্গুইন বুকস’ তাদের লোগো হিসেবে এই বিশেষ পাখিটির ব্যবহার শুরু করে। ২০০৬ সালে বিখ্যাত তথ্যচিত্র ‘মার্চ অফ দ্য পেঙ্গুইনস’ সেরা তথ্যচিত্র হিসেবে অস্কার লাভ করে, এবং কোটি দর্শকচিত্ত মোহিত হন পেঙ্গুইনদের সংগ্রামময় কঠিন জীবন দেখে।

২০০ পাতার বইটিতে আছে ৯৫টি আলোকচিত্র ও স্কেচ,যাদের অনেকগুলোই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে এখন যেমন অ্যান্টার্কটিক অভিযাত্রী আর্নেস্ট শ্যাকলটনের তাঁর কেবিনে আঁকা পেঙ্গুইনের ছবি, কিংবা রবার্ট স্বক্টের অভিযানের জন্য সংগৃহীত পেঙ্গুইনের ডিম, অ্যাডমিরাল রিচার্ড বিয়ার্ডের অভিযানের কাহিনী। সেই সাথে ফিরে এসেছে উত্তরের পেঙ্গুইন বলে খ্যাত উড়তে অক্ষম সাঁতারু পাখি ‘জায়ান্ট অক’দের স্কেচ ও গল্প। সেই সাথে নানা দেশের ডাকটিকেট, টাকা, পোস্টারে পেঙ্গুইনদের নীরব কিন্তু প্রবল উপস্থিতি।

‘কোট পরা ভদ্রলোক’ খ্যাত পেঙ্গুইনদের আপনি যে ভালবাসেন তা আমরা জানি, কিন্তু তাদের জীবন নিয়ে লেখা এই বইটি পড়া থাকলে পেঙ্গুইনদের যে এক নতুন মুগ্ধতার আলোকে যে দেখবেন তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।

ছবি: 
07/07/2011 - 11:39অপরাহ্ন

মন্তব্য

অবনীল এর ছবি

ভালো লাগলো পাঠ প্রতিক্রিয়া। বইটা পড়ার ইচ্ছে রইলো। নিউ ইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্ক চিড়িয়াখানা আর পিটসবার্গের চিড়িয়াখানা। দুই জায়গাতেই এই চমকপ্রদ প্রাণিটির সাথে সাক্ষাৎ হবার সুযোগ হয় আমার। যে অনায়াসে এরা পানি থেকে ডাঙা আর ডাঙা থেকে পানিতে বিচরন করে তা বিস্ময়কর। তীর বেগে সাতার কাটতে কাটতে পানির ভেতর থেকে একলাফ দিয়ে মাটিতে খাড়া অবতরণ করে দন্ডবত অবস্থায়। চোখ ফেরানো যায়না এদের কান্ডকারখানা দেখতে থাকলে। আশা করি ভবিষ্যতে আবারো দেখা মিলবে এদের সাথে। লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।

___________________________________
অন্তর্জালিক ঠিকানা

তারেক অণু এর ছবি

কয় ধরনের পেঙ্গুইন আছে সেখানে? রিয়েকটনের বইগুলো আসলেই বেশ ভালো, অফট্রাকের তথ্যবহুল

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

এত দিন কোথায় ছিলেন প্রিয় তারেক অণু, প্রায় আড়াই বছর পর আবার সচলে আপনার লেখা দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠলো। স্বাগতমঃ

এই লেখাটা পড়ে অবাক হয়ে ভাবছি, আমরা নেহাতই ভাগ্যবান যে মানুষের খাদ্যে পরিনত হওয়া সত্বেও এই আশ্চর্য সুন্দর পাখিটা এখনও এই পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত অবলুপ্ত হয়ে যায় নি।

তারেক অণু এর ছবি

পথে পথেই ছিলাম ভাই, চেষ্টা করব এখন থেকে নিয়মিত লেখার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।