ধূপছায়া রঙের পর্দার আড়ালে এসে দাঁড়ায় সে। তাই ওকে স্পষ্ট করে দেখতে পাই নি কোনোদিন। শুধু ওর সজল চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে অস্তসূর্যের আলোয়। মুখের বাকীটা ভালো করে বোঝা যায় না। কেন জানি মনে হয় ওর অল্প-স্ফীত ঠোঁটে, এলোমেলো হাওয়াওড়া চুলে, করুণ হাতের ছন্দে অচেনা অভিমানের আভাস থাকে। কেজানে! বোঝা যায় না ভালো করে কিছুই। ও যে কে, তাও বুঝতে পারিনা।
আজকে বিকালে মেঘ সরে গিয়ে দেখা দিয়েছে রোদ। আকাশ কোমল নীল, রোদ্দুরে সোনারঙ। সূর্যপিয়াসী প্রাণগুলি আজ হারানো সুর খুঁজে খুঁজে বের করে তোড়া বাঁধে, বেসুরো শুকনোপাতা ফেলে দিয়ে। ভুলে যাওয়া শরতের মতন কাশফুলী মেঘেরা ভাসে আকাশে, ডানামেলা পাখির মতন উড়ে যায় সবুজ অরণ্যের দিকে, ওদের দিগন্তপ্রিয় ডানার নীচে তরল জলের ধারার মতন গলে পড়ে দূরত্বের কাঠিন্য।
আজকে মেঘলা ধূসর দিন, মনখারাপ করে দেওয়া ঘোলাটে সব। মাঝে মাঝে নামছে বৃষ্টি, বাদামী হলুদ শেষ পাতাগুলো ও ঝরে পড়ছে পর্ণমোচীদের শীতনগ্ন কঙ্কালশরীর থেকে। ওদের ভ্রূক্ষেপ নেই। ওরা জানে বসন্তে বসন্তে নবযৌবন আসে ওদের। আমাদের মনুষ্যজীবনের মতন কৃপণ নয় বৃক্ষজীবন।
টুকরো টুকরো দ্বীপেরা ছড়িয়ে আছে। অসেতুসম্ভব সব দ্বীপেরা। মাঝে বয়ে গেছে বিচ্ছেদের আর বিষাদের নোনাপানি। অবিশ্বাস আর বেদনার নীল সমুদ্র। একদিন এইরকমই এক দ্বীপে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। মাঝে মাঝে গতজন্মস্মৃতির মতন মনে পড়ে বহুদিন আগে আমরা একটা মহাদেশে থাকতাম।
কাকজ্যোৎস্নায় বালিহাঁস ওড়ে, সাগরতীর গর্ভিণী নৈ:শব্দ নিয়ে পড়ে থাকে চুপ। চুপ করে পড়ে পড়ে ভিজতে থাকে গহন রাতের অলীক আলোয়।
মিশরী ওড়নার মতন নেমে আসে শিরশিরে শিশিরকণা, বুঝি বা ঐ নীল চিত্রা তারার কাছ থেকে। ওরই জন্যে বুঝি সমুদ্রঝিনুকেরা ডানা মেলে রাখে? বুকের ভিতর শিরশিরে ব্যথাকে মুক্তা করে ফলাবে বলে?
পালকমেঘের অবিশ্রান্ত আনাগোনার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দেখা দেয় মুখের সারি, শান্ত ও রাগী, নিষ্ঠুর ও করুণ-হাজার হাজার মুখ। তরুণ ও বৃদ্ধ মুখ-সতেজ ও লোলচর্ম মুখ। পায়রার বুকের মত নরম মুখ, বাজপাখির নখের মত হিংস্র মুখ, শেয়ালের মত সেয়ানা মুখ, হায়নার মত ধূর্ত মুখ, শিমূল তুলোর মত উদাসী মুখ। চলমান মুখের সারি কখনো হাস্যদীপ্ত, কখনো অশ্রুঝলোমলো।
সময়ের অমোঘ পাহারা উপরে ও নিচে- মাঝে নক্ষত্ররাজি জেগে থাকে চুপচাপ, বিষন্ন নির্জন চাঁদে ফুটে থাকে এলোমেলো চুলের ভুলে যাওয়া মুখ।
নি:শব্দ শিশিরে শিশিরে মিছিমিছি কান্না ঝরে যায়। তন্দ্রাচ্ছন্ন তুন্দ্রার তুষারে সে আজো সাবধানী পায়ে হেঁটে যায়, নীলসবুজ ওড়না দুলে ওঠে আকাশে।
টুকুন, তোকে গল্প বলি আয়
সে ছিলো এক মেঘপরীদের দেশ,
রুমঝুমিয়ে বাজতো তাদের নূপুর
চিকমিকিয়ে উঠতো তাদের কেশ।
টুকুন তোকে বলেছিলাম আগে,
মাটির সে ঘর, নিকোনো উঠান-
আমকাঁঠালের ছায়ায় ছায়ায় পথ
হাওয়ায় দোলে ক্ষেতের সোনার ধান।
টুকুন, তোকে দেখাবো একবার
এবার যখন আমরা যাবো দেশে-
তখন সবাই গাঁয়ের বাড়ী যাবো
দেখিস, এবার যাবোই ঠিক শেষে।
"প্রতিবারেই তুমি বলো যাবে
কোনোবারেই হয় না যাওয়া জানি-
ঐখানে শব্দের কয়েক টুকরা সবুজ দ্বীপ জেগে ছিলো নৈঃশব্দ্যের আদিগন্ত নীল সমুদ্রের বুকে। শব্দে ও নৈঃশব্দ্যে ছিলো গোপণ বোঝাপড়া। তাদের খেলা দেখতে সূর্য উঠতো পুবে, আবার খেলা দেখতে দেখতেই বেলা ঢলে পড়তো।একদিন ঈশান কোণ থেকে ঘূর্ণীঝড় উঠে এসে ওদের সব হিসাব এলোমেলো করে দিলো-
এখানে সোনালী রূপালী শব্দেরা সাঁতরে বেড়ায়-
তণ্বী রূপালী মাছেদের সঙ্গে খেলা করে,
কালচে সবুজ নরম শৈবালের মধ্যে
লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষের অন্ধকার তখন ছড়িয়ে ছিলো আমাদের ঘিরে, তবু আমরা মিলে ছিলাম- অবিচ্ছিন্ন, অখন্ড, এক। আমরা ভেসে চলেছিলাম একসঙ্গে, অবিচ্ছিন্ন সমুদ্রের অন্তহীন ঢেউয়ের মতন। কোনো দিক জানা ছিলো না, সর্বদিকশূন্য নিবিড় সে সুধাসমুদ্রে জড়িয়ে মিশে ছিলাম আমরা।
তারপর আলো হলো-এক কণা আলো, দুই কণা আলো, তারপরে তীব্র আলোর বিস্ফোরণ- জ্বলে উঠলো সবদিক।