কাঠ মধু মাছের উৎস আর বাঘের আস্তানার বাইরে সুন্দরবনকে নিয়ে আমাদের ভাবনা কতদিনের? ৭২ সাল পর্যন্ত বাঘকে আমরা জানতাম উপদ্রব; শিকার করলে পুরস্কার মিলত। হরিণ ছিল মৃগয়ার উপকরণ। তার বাইরে সুন্দরবনের বাকিটা ছিল মৌয়াল বাউলি কিংবা বনবিভাগের কর্মীদের নৈমিত্তিক পানসে জীবন...
শরীরটা সামনে ঝুঁকিয়ে হাতলের শেষ মাথায় শক্ত করে বাম হাত আর একটু উপরের দিকে আলতো করে ডান হাত রেখে কুড়ালটা বাগিয়ে ধরে আব্দুল ওহাব। তার হাত আর শরীরের এই পজিশন সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কোপ মারার পজিশন। কোপ মারার আগে হাত আর মেরুদণ্ড একসাথে পেছনে গিয়ে একসাথে নেমে আসবে সামনে। অর্ধেক সেকেন্ড সময় লাগবে কুড়াল মাথার উপর তুলতে আর বাকি অর্ধেক সেকেন্ডে হ্যাপ করে নেমে আসবে সামনে। সোজা কুড়ালের ফালিটা গিয়ে ভ্যাৎ করে গে
- আর ইউ এন ইজিপশিয়ান?
সুন্দরবন টিকবে না বেশিদিন। মানুষের হাতে-মুখে বেড়ে চলা গজদন্ত ঠেকাতে না পারলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে সুন্দরবন। প্রায় এরকম একটা বক্তব্য শুনতে শুনতে সুন্দরবনে একদল দেশি বিদেশি পরিবেশবাদীর সফরসঙ্গী হয় ফটোগ্রাফার নয়ন। তার কাজ পুরো ভ্রমণের ছবি তোলা
সামনের পা দুটো পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে টানটান করে পুরো শরীরের ভার লাফ দেবার জন্য পেছনের পায়ে নিয়ে শণ ঝোপের মধ্যে খাপ ধরে বসেছিল বাঘটা। বছর দশেকের পূর্ণ পুরুষ বাঘ। আমাকে দেখে শরীরটা আরো গুটিয়ে লাফ দেবার জন্য সামনের পা দুটো তুলতে তুলতে হঠাৎ করে থেমে গেলো। মাত্র হাত দশেক দূরত্ব। আমি কী করব না করব বুঝে উঠার আগেই দেখলাম বাঘটা খাপ ছেড়ে শরীর নরম করে পেছনের পায়ের উপর বসে পড়ল। মুখটা একটু হায়ের মতো ফাঁক হয়ে এলো- ভাগিনা সালাম...
আমি এখনও ভাবছি দৌড় দেবো কি না। এমন সময় আবার শুনলাম- দাঁড়িয়ে রইলি কেন? আয় এদিকে আয়
পদবি নৌকা চালক। প্রশিক্ষণ বন্দুক চালনায়। নাম রতন সরকার
দুবলার চর। সুন্দরবনের অস্থায়ী পুরুষ বসতি; এক অস্থায়ী গ্রাম। ঘোরেপ্যাঁচে কোনো নারী যদি সেখানে পৌঁছে যায় তবে দিনে দিনে তাকে চর ছেড়ে আসতে হয়। এটাই নিয়ম। ভাসান নদীর বুকে সাগরের মুখে এই চরে পুরুষেরা বছরের শুকনা মৌসুমে পাঁচ মাসের গ্রাম বেঁধে থাকে। সেখানেই বসে রাসপূজার আসর আর মেলা। দূরান্ত থেকে শতশত নারী পুরুষ তীর্থযাত্রী সেখানে গেলেও মেলা শেষে সবাই ফিরে আসে। শুধু মজুর পুরুষেরাই সেখানে থেকে যায়। তারা সে
রাত দুপুরে ঘরের চালে
প্যাঁচায় দেলে ডাক
বেনবেলা কেন মাথার পরে
কা কা করে কাক।
শোনো তুমি মা বনবিবি
বলি গো তোমারে
অভাগিনি শরণ নেলে
তোমারই চরণে॥
(ওমা) তোমারই চরণে
খা-নকি মা-গি। প্যাঁচা আর কাউয়ার মুখে তুমি তোমার নিজের কম্মের কথা শোনো? নিজের কম্ম তুমি নিজে জানো না? তোমার নিজের কম্মের গর্ত থেকে বনবিবি এসে উঠাবে তোমারে?
সুন্দরবনের শীত ভোরে গলায়-পিঠে ক্যামেরা ঝুলিয়ে কাদা ভেঙে হাঁটছে ফটোগ্রাফার দলটি। কারো পায়ে বুট- কারো স্যান্ডেল। সবাই হাঁটছে জুতায়-পায়ে কাদাঠাণ্ডার উহুআহা অনুভূতি নিয়ে। দলের সামনে নির্লিপ্ত বনপ্রহরী রতন আর পেছনে তার তরুণ সহকর্মী মাজেদ। বেতনের বাইরে ভাতা আর বখশিশের আকর্ষণ ছাড়া এই বন তাদের কাছে পুরোটাই বিরক্তিকর। তারা হাঁটছে সুন্দরবনের যে কেনো গার্ডের মতো বারবার বনের বেশি গভীরে না যাবার সতর্কতা জানিয়ে
তুমি কি বুঝতে পারছো গতকাল এখানে এসেছিলাম আমরা, জায়গাটা চেনা চেনা লাগছে কি? হুম, আমি জানতাম তুমি বলবে একবার মনে হয় এসেছিলাম আবার মনে হয় না তো ঠিক এরকমই হবে সেই জায়গাটা। আসলে এরকমই হয়, প্রতি মুহূর্তে এখানে রূপ পাল্টায় সুন্দরবন। প্রকৃতির এই বিশাল সম্ভার কখনোই একেবারে পুরোপুরি মেলে দেয় না নিজেকে। তাছাড়া বনের পারিপার্শ্বিকতাও আমাদের দেখার চোখ আর মনকে প্রভাবিত করে। তাই চেনা জায়গাকেও আবার নতুন করে চিনতে হয়।