উৎস-পৃথিবী (শেষ পর্ব)

তুলিরেখা এর ছবি
লিখেছেন তুলিরেখা (তারিখ: মঙ্গল, ১০/১২/২০১৩ - ২:০৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

নীরার চোখের পাতা কেঁপে ওঠে, সত্যি তো কিভাবেই বা বলবে সে, এ কি অদ্ভুত পরিস্থিতি ! সময়ের ধাঁধা! নীরার ইতিহাস কি নীরার কাছে একদম শক্ত কঠিন দৃঢ়? সে যা জানে ইতিহাস বলে, তা কি ধোঁয়াচ্ছন্ন ও কাঁপা কাঁপা নয়?

কিভাবে সে বলবে সেইসব ঘটনা দুর্ঘটনার স্থান কাল ও পাত্র? নীরার মনে পড়ে ডক্টর কীর্তিকারের কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরির ক্লাস। উনি সেই সব ক্লাসে যত্ন করে বুঝিয়েছেন একই ঘটনাকে কত বিভিন্নভাবে ইন্টার্প্রিট করা যায়, ঘটনা বলেও আসলে নাকি কিছু নেই,যা পড়ে আছে তা আসলে কতগুলো সম্ভাবনার যোগফল।

মহাসময়ের জটিল স্রোত নীরাকে কাঁপিয়ে তোলে যেন সে জল হাত ডুবিয়ে বুঝতে পারছে না জল কী? যেন সে জীবনযাপন করতে করতে ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না জীবন কী? জলের ভিতরে মাছের মতো সাঁতার কাটতে কাটতেও কিছুতেই জলপান করতে পারছে না। আকন্ঠ তৃষ্ণায় গলা কাঠ হয়ে আসছে নীরার।

একি অদ্ভুত ধাঁধা! এমন হবে তা ভাবনাতেও ছিলো না নীরার। এ কী আশ্চর্য দুনিয়া! কেনই বা সে তাহলে এত কাঠখড় পুড়িয়ে এলো? কেনই বা দেখা করলো এই মানুষটির সঙ্গে যার মন নীরব নিশীথে ভাঙা দেউলে লুটিয়ে পড়ে কেবলই গাইছে " শূন্যহাতে ফিরি হে নাথ পথে পথে দ্বারে দ্বারে/ চিরভিখারী হৃদি মম নিশিদিন চাহে কারে....."

নীরার দূরমগ্ন চোখের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় রোহিতাশ্ব বলেন,"দেবী, আপনি ঠিক আছেন তো? কেমন অন্যমনস্ক লাগে আপনাকে! বলতে হবে না দেবী কিছু, ভবিষ্যৎ আমি জানতে চাই না, যা হবার তা হোক। আপনি এমনি এমনি অন্য কথা বলুন। "

নীরা হাসে, মাথা ঝাঁকিয়ে ভাবনা দূর করে দিয়ে বলে," আমি ঠিক আছি, কিন্তু আরো ভাবতে হবে, ব্যাপারটা যা ভেবেছিলাম তারচেয়ে বেশী জটিল। আজ আমি বিদায় নিই, পরে আসবো অন্যদিন। সেদিন হয়তো কোনো সমাধান পাবো। "

নীরা উঠে দাঁড়ায়, বলে, "আমাকে দেবী বলবেন না রোহিতাশ্ব, আমাকে নীরা বলুন। ঠিক আছে?"

রোহিতও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, মাথা কাত করে সম্মতি প্রকাশ করলেন। নীরার তখনও তৃষ্ণার্ত লাগছিলো, তবু জল চাইতে পারছিলো না। একবার কী একটা বলতে গিয়ে ও বললো না, আস্তে করে মাথা অল্প ঝুঁকিয়ে বললো,"আজ আসি রোহিতাশ্ব। পরে আবার দেখা হবে।আপনি ভালো থাকবেন।"

রোহিতাশ্ব নীরাকে এগিয়ে দিলেন উঠানপ্রান্তের দরজা অবধি, আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে দূরে মিলিয়ে গেলো নীরা বাঁকা পথটি বেয়ে মিহিন কুয়াশার আড়ালে।

*******

"অদীন, উঠে পড়ো, সকাল হয়ে গেছে। " হিন্দোলের শান্ত গলা, প্রতিদিনের মতন ডাকতে এসেছে, হাতে গরম জলে ভেজানো সাদা তোয়ালে। অদীনা প্রতিদিনের মতন থ্যাংকু দিয়ে তোয়ালে নেয়, উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। চারিদিক এত আলো দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে,"অনেক বেলা হয়ে গেছে? হিন্দোল?"

"আরে তাতে কী? আজ তো উইকেন্ড আর কাল রাতে অতক্ষণ জেগে রইলে যে!"

অদীনা বলে,"আজকে আমি ব্রেকফাস্ট বানাই হিন্দোল? দেরি যখন হয়েই গেছে, আরেকটু অপেক্ষা করো, আমার তৈরী হয়ে আসতে মিনিট পনেরো মতো লাগবে।"

"থাক না অদীন, ভালো হয়ে গেলে তুমি তো তখন করবেই। এই ক'দিন আমিই করি।"

"আজকে ভালোই লাগছে হিন্দোল, ডক্টর হপকিন্স তো আমায় এসব করতে বারণ করেন নি, বলো, করেছেন?"

"না, তা করেন নি, তবে স্ট্রেস নিতে বারণ করেছেন।"

"এতে স্ট্রেস হবে না হিন্দোল, লক্ষ্মীটি আজকে করতে দাও।"

"ঠিক আছে, করো। আমি ততক্ষণ খবরের কাগজ পড়ি।"

স্নান সেরে এসে গুনগুন করতে করতে চা-টোস্ট-এগপোচ তৈরী করছিলো অদীনা, বেশ ভালো লাগছে। গল্পটা অনেক এগিয়ে গেছে, এইবারে একদিন লেখা শুরু করতে হবে। ঐ যে ভবিষ্যতের মেয়েটি অতীতের মানুষটির কাছে যায়, ওরা কীভাবে রিলেটেড হতে পারে অদীনার সঙ্গে? নাহ, সেতো দর্শক মাত্র, বাইরের থেকে দেখছে শুধু। ঐ ছোট্টো ছোট্টো ফুলের মতন মেয়েদুটি, যাদের ঘুমিয়ে থাকতেই শুধু দেখেছে অদীনা, তাদের জন্য এমন লাগছে কেন হঠাৎ ওর? অচেনা ব্যথায় ভরে উঠছে বুক মুখ তলপেট? সত্যি কি ওরা ওর ছিলো সেই বহু বহু জন্ম আগে? যাদের ছেড়ে সে চলে যেতে চায় নি কখনো? তবু আঁধার মৃত্যু জোর করে নিয়ে গেলো অসময়ে?

ব্রেকফাস্ট টেবিলে সব শুনতে শুনতে চোখ এতখানি হয়ে উঠলো হিন্দোলের। অদীনা কল্পনাপ্রবণ হিন্দোল জানতো, কিন্তু এইরকম আশ্চর্য কল্পনা ওর?

বিকেলে ডক্টর হপকিন্স সব মন দিয়ে শুনে হাল্কা খুশী ভঙ্গীতে মাথা দোলাচ্ছিলেন। তারপরে হেসে বললেন, অদীনা, এই তো আপনি অনেক ইম্প্রুভ করেছেন। অদীনা, হিন্দোল, আপনারা বিয়ে করে ফেলুন, এইটাই তো ঠিক সময়! আপনারা দেরিই বা করছেন কেন? দেখুন, কিছু মনে করবেন না,ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলছি বলে, কিন্তু আমার কাজটাই এমন যে অন্যের প্রাইভেসিতে হাত পড়ে যায়। মানুষের মন ভারী রহস্যময় ব্যাপার,আমরা এর সারফেসটুকু ও পুরো বুঝিনা, অথচ সেইটুকুর ভিত্তিতেই কাজ করতে হয়। একেবারে হাতবাঁধা অবস্থা। আশা করি কিছু মনে করলেন না?"

তাড়াতাড়ি অদীনা আশ্বস্ত করে ওনাকে, "না না কিছু মনে করবো কেন? আমাদের কালচারে বয়োজ্যেষ্ঠরা এমনিতেই এইসব উপদেশ দিতে পারেন, মনে করা দূরের কথা, সৌভাগ্য হিসাবে নেওয়া হয়।"

প্রৌঢ় ভদ্রলোক হাসছিলেন, হয়তো অদীনাকে ভালো হয়ে যেতে দেখে তাঁর সত্যি ভালো লাগছিলো, কদিন আগেও কী ক্লিষ্ট, ভয়ার্ত, দুঃখী লাগতো অদীনাকে। এই গভীরমনের যুবতী মেয়েটিকে তিনি অবসাদ ও ওষুধের খপ্পরে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন এই মানসিক শান্তি তাঁর।

চেম্বার থেকে বেরিয়ে হিন্দোল গাড়ী চালালো স্টেট পার্কের দিকে, চলো অদীন, স্টেট পার্কের ঐ সুন্দর লেকটা তুমি ভালোবাসতে। চলো আজকে বোটিং করবো।

সন্ধ্যা গাঢ় হলে চাঁদের রুপোলি আলোয় ভরে যায় চরাচর। হিন্দোল অদীনার নৌকা আলতো হাওয়ায় ভাসছিলো, অদীনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিলো হিন্দোল, ওর চুলে আলতো বিলি দিতে দিতে অচেনা একটা সুর গুণগুণ করছিলো অদীনা, কোন্‌ গানের সুর তা কিছুতেই বোঝা যাচ্ছিলো না।

রাত বাড়লে ফিরে আসে দুজনে, রাতের খাবার হিন্দোল বানায়, খেয়ে দেয়ে যে যার ঘরে ঘুমোতে যায় গুড নাইট জানিয়ে। অদীনা ডাকে না বলে হিন্দোল আসে না ওর ঘরে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে আশ্চর্য সুখে অদীনা ভরে ওঠে, রোহিতাশ্বের সঙ্গে দেখা হবে!

*******

আজকে নীরা অনেক ধীর স্থির গোছানো, শান্তভাবে এসে কুশাসনে বসে প্রদীপ উসকে দিলো। উন্মুখ হয়ে ওর দিকে চেয়ে ছিলো রোহিতাশ্ব, আগুনের শিখার ঐপাশে নীরাকে কাঁপা কাঁপা অলীক উপস্থিতির মতন লাগে।

নীরা বলেছে তাই সে ভুর্জপত্রের বাঁধন খোলে সাবধানে, হংসপালকের কলম দোয়াতে ডুবিয়ে প্রস্তুত হয় লিখতে, অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে ওঠে রোহিতাশ্বের হাত, আঙুল। কেমন অদ্ভুত শীত ভাব সর্বাঙ্গ ছেয়ে ছড়িয়ে পড়ে।

এখুনি কি কোনো অলৌকিক আলো এসে পড়বে দুজনাকে ঘিরে? কোনো আশ্চর্য শব্দ ও সুর শোনা যাবে? কোনো অলৌকিক অনুভব? নীরার পারফিউমের হাল্কা মিষ্টি সৌরভ আচ্ছন্ন করে রোহিতাশ্বকে, জানালার বাইরে রাত্রির রহস্যময়তার দিকে কেন জানি একবার চোখ পড়ে রোহিতের, তারপরেই চোখ ফিরে আসে দীপশিখায়।

নীরার চোখের দিকে চেয়ে রোহিতাশ্ব স্থির নিস্তব্ধ হয়ে যায়, চোখের মণিতে অলৌকিক আলো। একবার নীল মনে হলো, পরক্ষণেই সবুজ, তারপরেই হাল্কা গোলাপী থেকে আকাশী, ফের নীল। মাথা ঝিমঝিম করে এলো রোহিতাশ্বের। সে দেখলো নীরা হাসছে, পাতলা তরমুজফালি ঠোঁট অল্প ফাঁক হয়ে মুক্তোরঙ দাঁতের সারি, আশ্চর্য যুথীগন্ধে ভরে গেছে ঘর, রোহিতাশ্ব দেখলো গ্রীষ্মবিকেলের আকাশ ভরে খুলে দেওয়া বিপুল কেশভারের মতন কৃষ্ণ মেঘমালা, চমকে চমকে উঠছে বিদ্যুৎ, একসার সাদা বক উড়ে গেলো মেঘের উপর দিয়ে। গোলাপী আকাশী বেগুনী অজস্র রঙ ছড়িয়ে পড়ছে, নোনতা মিষ্টি টক তেতো আবীরগুলাল, আজ কি দোল?

নীরা হাত বাড়াচ্ছে, ছুঁয়ে দিলো রোহিতাশ্বের কাঁধ, রোহিতের আকাশে মধ্যরাত্রিনীল ফুঁড়ে ঝলকে ঝলকে নামতে লাগলো নক্ষত্রের বর্ষণ। এলোমেলো বেণীর মতন কিসের ঢেউ ওর চারপাশ ঘিরে, ও ডুবে যাচ্ছে ও ভেসে উঠছে, ভয়ে ওর দমবন্ধ হয়ে আসে ওর, বুক কাঁপে দুরুদুরুদুরু করে, তারই সঙ্গে আনন্দের অলৌকিক শিহরণ। রোহিতাশ্ব দেখছে জ্বলন্ত তন্তুগুচ্ছ উড়তে উড়তে দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে, নানারঙের আবীর ঝলসে উঠছে, পোড়ানো লোহার গন্ধ বদলে যাচ্ছে বৃষ্টিগন্ধে। তারপরেই টুপটাপ শিশিরের মধ্যে এসে সে হয়ে যাচ্ছে জলকমল।

শরতের বৃষ্টিশেষ সন্ধ্যার আকাশ, পশ্চিমদিকটা সোনার মতন ছলছল করছে, সেদিকে ভরা নদীর জল সোনার মতন, আকাশে কমলা মেঘ, বিরাটা হাল্কা কমলা পালকের মতন ভেসে আছে, আলোর ছটা পড়েছে রোহিতাশ্ব আর সদানীরার উপরে, তখন তাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে, সেই কনেদেখা আলোয় কি কোনো যাদু ছিলো? হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারে না রোহিতাশ্ব, দুচোখে ঝাপসা বাদল, অথচ আকাশে বাদল তো ফুরিয়ে গেছে!

দমকা হাওয়ায় দক্ষিণ সমুদ্রের গন্ধ, রোহিতাশ্বের মুখচুল ছুঁয়ে উড়ে চলে যায় হাওয়া, রাত্রি ভরে জ্বলজ্বল করে ওঠে তারার দল, ছায়াপথের ওড়নায় স্পন্দন জাগে।

চোখের পাতা ফেলে সে দেখে নীরা একইভাবে চেয়ে আছে তার দিকে অল্প উদ্বিঘ্ন মুখ! হাতটি সরিয়ে নিয়েছে।নীরা বলে,"রোহিতাশ্ব, আপনার কি কোনো অসুবিধে হচ্ছে? আমি অনেকগুলো কথা বলে গেলাম, কিন্তু আপনি শুনতে পেলেন না!"

রোহিতাশ্ব কী বলবে, সে যে কত কী দেখছিলো, শুনছিলো, কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। সে এত জায়্গায় এত বিভিন্ন কালে একই সঙ্গে কী করে থাকবে, সেতো একটা মানুষ!

নীরা আবার স্পর্শ করে রোহিতাশ্বের হাত, অমনি সবুজ নীল ছটা ছড়িয়ে পড়ে চারধার ঘিরে, রোহিতের চেতনায় দ্রুতগামী অশ্বেরা আলোর তন্তুর মতন চতুর্দিকে ছুটে যাচ্ছে আর সে নিজে ছুটে যাচ্ছে আলোর চোখের কেন্দ্রের দিকে। মধ্যবিন্দু থেকে উৎসারিত অনন্ত আলোকমালা জলের ধারার মতন ওকে ঢেলে নিয়ে যাচ্ছে ওদিকে,অসহায় ও ভয়ার্ত রোহিত হাত বাড়িয়ে আটকে যেতে চাইছে কোথাও,অমনি একটি নিটোল সুন্দর সোনার চূড়িবালায় সাজানো হাত ওর হাত ধরে ফেললো, সদানীরা!!!

দু'খানা ঢেউ ঘুরে ঘুরে জলের মধ্যে নাচছে, গোলাপী কমলা সোনালী সবুজ হাজার হাজার রঙের আলো ঝলকে ঝলকে উঠছে, ঐ ঘূর্ণি আসলে রোহিতাশ্ব নিজেই।

সদানীরার হাত তো নয়, এতো এই আশ্চর্য ভবিষ্যতরুণীর হাত, নাকি স্বপ্নসম্ভবার হাত? রোহিতাশ্ব নিজের দুহাতে শক্ত করে ধরে নীরার দুহাত, তীব্র ঘূর্ণির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে দুজনে ঐ রহস্যবিন্দু ভেদ করে চলে যায়, এইবারে সবকিছু আলোয় আলো, এইবারে নির্ভয়তা, এইবারে অভয়, এইবারে বীতশোক তারা!

********

মাঝরাত পার হয়ে গেছে কখন, ঘড়ির কাঁটা টিক টিক টিক টিক করে চলেছে শেষরাত্রির দিকে। অদীনা জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে রাত্রির নিবিড় রহস্যে ডুবে আছে। অবিরল জলধারা ওর গাল চিবুক গলা ভাসিয়ে দিচ্ছে,কিন্তু খুব ভালো লাগছে ওর,খুব ভালো। বহুদিনের কঠিন জমাট হিমপাথর গলে গিয়ে নদী হয়ে যাচ্ছে। এতদিনে কি সূর্যোদয়ের বেলা এলো? এইবারে কি এই ঘোর আঁধারে আলো ফুটবে?

এত কোটি কোটি তারা, তবু অন্ধকার! তবু ভালোবাসার উপরে ও কিসের কঠিন আস্তরণ! তবু কেন এত ভয়? এত সন্দেহ? এইবারে কি ঘুচবে সব বালাই? এতদিনে কি পথ দেখতে পেয়েছে অদীনা? এই বিঁধে থাকা কষ্টের বর্শা একে একে একটু একটু করে ওকে কি দিয়েছে মৃত্যু পার হয়ে অমৃতে যাবার দিশা?

আজকে স্বপ্ন-রোহিতাশ্ব তাকে বলে দিয়েছে পথ, আজকে সে দেখতে পেয়েছে এই গোলোকধাঁধা থেকে বেরিয়ে যাবার রাস্তা। সে একই বৃত্তে ঘুরছিলো আর ঘুরছিলো বলে দেখতে পায় নি উপরে নীচে খোলা খোলা এত খোলা বিপুল আকাশ, এই গন্ডীটুকুর বাহির হতে পারলেই আর কোথাও বাধা নেই, কান্না নেই, বৃথাদুঃখ নেই। তখন কে বা এই সামান্য অদীনা, কেই বা হিন্দোল, এই টুকরো টুকরো জীবন, সুখতুলো অশ্রুপালক আর দুঃখপাথর শিশিরগাঁথা মণিহার হয়ে দুলছে ঐ বিরাট আলোর গলায়।

দরজা খুলে আলতো পায়ে উত্তরের ব্যালকনিতে আসে অদীনা, আকাশে সপ্তর্ষির দিকে তাকিয়ে অল্প মাথা নোয়ায় অদীনা, ধ্রুবতারার দিকে চেয়ে সে দেখতে পায় ওর কল্পনার নীলকন্ঠ পাখিটাকে, একটি একটি করে পালক যে প্রতিদিন ফেলে গেছে অদীনার শিয়রে, কিন্তু এতদিন ওর ঘুম ভাঙে নি। দুয়ারটুকু পার হয়ে ও এসে দাঁড়াতে পারেনি সাগরসঙ্গমে। আজ খুলে গেছে সব, আজ পাথরের দুর্গ পাপড়ির মতন খুলে গেছে ওর চারপাশ থেকে।

দুপুরে সে ফোন করে অধ্যাপক কীর্তিকারকে, বহুদূর মহাদেশ থেকে অধ্যাপকের গভীর সুন্দর কন্ঠস্বর ভেসে আসে, উনি একটু অবাক, অনেকটা খুশী। অদীনা সত্যি সত্যি একদিন ফিরতে চাইবে হয়তো উনি ভাবতেও পারেন নি। কিন্তু স্থিতধী বৈজ্ঞানিক তিনি, গলায় আবেগ ফুটতে দেন না, শুধু পরপর অঙ্কের জট খোলার মতন ধাপে ধাপে বলে দেন কিসের পর কী করতে হবে অদীনার।

কাজের থেকে ফিরে হিন্দোল সব শুনে অত্যন্ত অবাক। হালকা ছায়া পড়ে ওর মুখে, অদীনা বুঝতে পারে।

হিন্দোলকে জড়িয়ে ধরে ও বলে," হিন্দোল, তুমি যদি "না" বলো, তাহলে আমি যাবো না। তোমাকে দুঃখ দিতে কখানো পারবো না, যখন সবাই আমায় ত্যাগ করেছিলো, তখন তুমি একা আশ্রয় দিয়েছিলে, এত সতর্ক যত্নে আমায় বিপদ পার করে এনেছ, বিনিময়ে কিছু চাও নি, সেই তোমাকে কিছুতেই আমি দুঃখ দিতে পারবো না। হিন্দোল, তুমি একবার শুধু বলো তুমি কী চাও, আমি তাহলে কালকেই ওঁকে জানিয়ে দেবো।"

হিন্দোল অদীনার ডানহাতের কব্জি নিজের হাতে আলতো করে ধরে আস্তে আস্তে বলে,"পাগলি কোথাকার, এমন করে বলছো কেন? আশ্রয় আবার কী ? আমি আশ্রয় দেবার কে? প্লীজ এভাবে বোলো না, কেমন লাগে। আমি কখনোই তোমাকে "না" বলবো না, বলতে পারি না, আমি জানি তুমি অন্যরকম, তোমার জীবন অন্যরকম, আমার জীবন যেন তার পথে বাধা না হয়, তারজন্য প্রার্থনা করি আমি, বিশ্বাস করো।" হিন্দোল এমন নরম এমন আশ্চর্য মগ্ন সুরে কথা বলছে যে অদীনা আর থাকতে পারে না, দু'হাতে ওর মুখটা ধরে নামিয়ে আনে নিজের দু'খানা ঠোঁটের দিকে ...

এত বছর পরে এই প্রথম অদীনা হিন্দোল হাতধরাধরি করে পার হয়ে যায় নিষেধের ও বাধার গন্ডী, এতদিন পরে ছাড়া পারতো না অদীনা, যে বন্দী সে কী করে পূজা নিবেদন করতে পারে? একমাত্র যখন সে মুক্ত তখনি তো দিতে পারে পুষ্পাঞ্জলি! হিন্দোল আগে চাইলে সে কী করতো? মাঝপথে খেলা ভেঙে চলে যেতে হতো ওকে!

শুনতে শুনতে হেসে ফেললো হিন্দোল, বললো,"এই অদীন, তুমি আমাকে অমন মনে করতে? বিশ্বাস করো নি একেবারে, না? কী করবে বলো, আমার তোমার দোষ নয়, হাজার হাজার বছরের চিন্তা আর অভ্যাসের ব্যাপার কি রবার দিয়ে মুছে দেওয়া যায়?"

অদীনা লজ্জায় একটু কুঁকড়ে যায়, সত্যি পুরোপুরি বিশ্বাস তো সে করে নি করতে পারে নি হিন্দোলকে। কী করবে? সে কি তখন আজকের অদীনার মতন ছিলো?

হিন্দোলই সব ব্যবস্থা করে ফেললো, একমাস পরে অধ্যাপকের কাছে হিন্দোলই পৌঁছে দিয়ে গেলো অদীনাকে, দু'দিন অতিথিও রইলো সেখানে।

পাহাড়ের উপরে সাদা রঙের পাথরের বাড়ী, চারিপাশে সবুজ আর সবুজ, কত গাছ, কত পাখী! চন্দনগাছের সারি, গোলাপের সযত্নরচিত উদ্যান, নারকেল গাছগুলোর কান্ড বেয়ে গোলমরিচের লতা, নীলমণিলতায় ফুলের গুচ্ছ। চেনা পাখিরা খুনসুটি করছে, গান গাইছে। অদীনার মুখে অচেনা আলোর কারুকাজ, ময়ূরপঙ্খী ভাসানোর সুখ। হিন্দোল অতৃপ্তচোখে দেখছিলো।

উপরের গোল ঘরে অধ্যাপক কাজে মগ্ন থাকেন, ঐ জটিল গণিতের গোলকধাঁধা থেকেই টুকরো টুকরো সুতো এনে এনে অদীনা গাঁথবে ওর মেঘডম্বরু পালা। অণোরণীয়ান ও মহতোমহীয়ানের পালকের সূক্ষ্ম কারুকাজ তাতে। হাসিমুখ অধ্যাপকের নির্লিপ্ত অথচ জ্যোতিদীপ্ত চক্ষু দুটি, ইনিই কি অদীনার চেতনাজন্মের পিতা নন? ইনিই তো নবজীবন দান করেছিলেন একদিন ওকে! শান্তভাবে কাজে মগ্ন হয়ে যায় অদীনা, অধ্যাপক কখনো নীরবে কখনো সরবে আস্তে আস্তে অসীম ধৈর্যে ওর মনের প্রদীপে তৈলসঞ্চার করে যান।

হিন্দোল অপেক্ষায় থাকবে বলে গেছে, অদীনা জানে সে অপেক্ষায় থাকবে সত্যিই, দেশকালের বিপুল বাধা দূর হয়ে যাবে, যাবেই। দৃঢ় বিশ্বাসে চোখে নিঘুম আলো জ্বেলে ঐ সময়বিহীন স্বপ্নলোকের দিকে বইতে থাকে অদীনা। ঐ দিব্যধামবাসী মেঘ অমৃতজল বর্ষনে তৃষ্ণার্ত ধরিত্রীকে শান্ত করবে একদিন, করবেই। সপ্তর্ষির অনন্ত জিজ্ঞাসাচিহ্ন আকাশে জেগে থাকে অক্ষয় হয়ে, ধ্রুবতারার কাছে থেকে উড়ে আসে অলীক সে নীলপাখি....

অদীনা পূর্বাস্য হয়ে ভোরের ছাদে দাঁড়িয়ে মৃদুসুরে আবৃত্তি করে," অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্তা বিদ্যয়ামৃতমস্নুতে..."

সেই আকাঙ্খিত আলোর বর্ষণ ভরে যাক এই সুধাহীনা বসুধার হৃদয়, অদীনা ভিক্ষার অঞ্জলি পাতে একা একা।

(সমাপ্ত)

এখানে দ্বিতীয় পর্ব
এখানে প্রথম পর্ব


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ইটা রাইখ্যা গেলাম...

এইবার পুরাটা পড়ি হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তুলিরেখা এর ছবি

ধন্যবাদ সাক্ষী সত্যানন্দ। পড়া হইলে বইলেন কেমুন পাইলেন। হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মোল্লা ঝুলুক আগে... তাপ্পর রিলাক্সে পড়ুম্নী

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তুলিরেখা এর ছবি

বহুকাল সচলায়তনে আসা হয় নাই। আজ আইলাম। হাসি
লেখাটা রিল্যাক্সে পড়েছিলেন সত্যানন্দ? হাসি

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।