মুহম্মদ জুবায়ের এর একটি সাম্প্রতিক লেখা পড়ে।

জাহিদ হোসেন এর ছবি
লিখেছেন জাহিদ হোসেন (তারিখ: শুক্র, ২২/০৮/২০০৮ - ১১:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বছর খানেক আগের কথা।
আমার মেয়েটি কাঁপা হাতে একটি মোটাসোটা খাম খুলছে, আর আমরা সবাই উত্সুক চোখে তাকিয়ে আছি। দুই সেকেন্ড পর গগনবিদারী চিত্কার, "ই-য়ে--সসসস্‌!"
ক্যালটেক থেকে আসা চিঠি। সেখানে আমাদের কন্যাটির অ্যাডমিশন হয়েছে। বেশ ভাল একটা স্কলারশিপ সহ।
আমাদের দুজনের মুখের হাসির আড়ালে উঁকিঝুঁকি দেয় বেদনা আর শংকার কালো মেঘ। এইটুকু মেয়ে এতটা দূরে চলে যাবে? ও এক একা সেখানে থাকতে পারবেতো? আমরা তাকে ছেড়ে থাকতে পারবো তো?

কয়েক সপ্তাহ পর এক রোদেলা বিকেলে তাকে আমি নামিয়ে দিয়ে এলাম ক্যালটেকের ক্যাম্পাসে। সে সেখানে তিন দিন থাকবে। ফাইনাল সিদ্ধান্ত নেবার আগে যেন ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যালটেকের জীবন সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পায়, তার জন্যেই এই আয়োজন।
ক্যাম্পাসটি ভয়ানক সুন্দর, মনে হয় যেন একটা চমত্কার পার্কে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

একা একা বাড়ী ফিরে আসার সময় প্লেনের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম সারাটা পথ। এমনি ভাবেই বহুদিন আগে আমি একা একা এদেশে উড়ে এসেছিলেম সবকিছুকে পিছনে ফেলে। এখন পে-ব্যাক টাইম!

শেষ পর্যন্ত অবশ্য মেয়েটি ক্যালটেকে ভর্তি হয়নি। তার কাছে ভাল লাগেনি। বড় বেশী পুরুষ-প্রধান, বড় বেশী অংক, বড় বেশী ইঞ্জিনিয়ারিং। আর হয়তোবা মনে মনে বলেছে, বড় বেশী দূর। এখন আমাদের এখানকার ইউনিভার্সিটিতেই পড়ছে সে। বায়োলজি কিংবা মেডিসিন নিয়ে পড়ার ইচ্ছে তার এই মুহুর্তে, দু বছর পর কি মনে হবে কে জানে।

সে এখন ডর্মেই থাকে, উইকএন্ডে বাড়ী আসে। বড় বেভুল সে, তার জন্যে প্রতি নিয়ত আগের মতোই বকাঝকা খায়। সে হাসে। বলে,"আমি ক্যালটেকে চলে গেলে তোমরা কাকে বকা দিতে? ঘরের দেয়ালকে?"

বুকের মধ্যে ভয়টি নড়াচড়া করে জানান দেয়। একদিন চলে যাবে সে চিরকালের মতোন। এটাই নিয়ম, এটাই শাশ্বত। এখন বুঝি আমার বাবা-মা কতখানি কষ্টকে বুকে ধারণ করেছিলেন। আমি তাদেরকে এতটা কষ্ট দিয়ে ছিলাম? আহা-কেন আমি কিছুই বুঝতে পারিনি তখন? নিজেকে নিয়ে অতি আচ্ছন্ন ছিলাম বলে?

এবারে গিয়ার বদলাই।

মেয়েটির ক্লাস যখন শুরু হোল, তখন সে প্রতি সপ্তাহে এসে আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প শোনায়। বন্ধুদের কথা, টীচারদের কথা, মজা করার কথা। শুনে আমারও চোখ আচ্ছন্ন হয়ে আসে। মনে পড়ে নিজের ছাত্রজীবনের কথা। কাউকে শোনাতে ইচ্ছে করে গল্পগুলো।

ভাগ্যিস-এখন বাংলাব্লগের যুগ। ও পাড়াতে একটি সিরিজ লেখা শুরু করি। কিভাবে যেন পর্বের পর পর্ব লেখা হয়ে যায়। স্মৃতি থেকে কাছের মানুষেরা উঠে এসে কম্পিউটরের পর্দায় হাঁটাহাঁটি করে। তাদের কথা শুনতে অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আমিও নাচুনে বুড়ির মতো ঢোলের বাড়ি পেয়ে লিখে চলি ছাইপাঁশ। কাগজ-কালি তো আর কিনতে হচ্ছে না।

এখন বুঝি ঈশ্বর কাউকেই পুরোপুরি নিঃস্ব করেন না। মেয়েটির চলে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই বোধহয় আমার লেখালেখির শুরু। আর সেটি চালিয়ে রেখেছে ব্লগের কিছু না চেনা অতি ধৈর্য্যশীল মানুষেরা।

মুহম্মদ জুবায়েরকে তাই বলছি, জীবনের ধন কিছুই ফেলা যায়না।


মন্তব্য

অন্দ্রিলা এর ছবি

লেখাটা পড়ে হঠাৎ ভয়ঙ্কর অপরাধবোধে আক্রান্ত হলাম। মাবাবাকে বেশি সময় দেওয়ার চেষ্টা করবো।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

ভাই জাহিদ, আপনার লেখার শিরোনামে আমার নাম দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত। সংকোচবোধ তো আছেই। তবু আমার লেখাটি আপনাকে কিছু লিখতে উদ্বুদ্ধ করে থাকলে নিজেকে ধন্য মনে করি।

ধন্যবাদ আপনার অনুভবগুলি তুলে আনার জন্যে।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার লেখাটি পড়ে মনের কোণের চেপে রাখা কথাগুলো ভুসভুস করে বেরিয়ে এলো। সব বাবাদেরই বোধহয় এমনধারা অনুভূতি হয়।
আপনি না লিখলে এই টপিকের উপর আমি হয়তো লিখতাম না কিছুই।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

রায়হান আবীর এর ছবি

জাহিদ ভাই, অনেকদিন পর...

লেখাটা হৃদয় ছোঁয়া হয়েছে।

============================
তু লাল পাহাড়ীর দেশে যা!
রাঙ্গা মাটির দেশে যা!
ইতাক তুরে মানাইছে না গ!
ইক্কেবারে মানাইসে না গ!

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আপনার হৃদয় ছুঁতে পারার জন্যে আমার আনন্দের সীমা নেই। ভাল থাকুন।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

রণদীপম বসু এর ছবি

হৃদয়স্পর্শি লেখা। ধন্যবাদ।
বেশি বেশি লিখুন।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

পরিবর্তনশীল এর ছবি

অনেকদিন পর আমার প্রিয় লেখকের লেখা পড়লাম।

---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

জাহিদ হোসেন এর ছবি

প্রিয় মানুষের মন্তব্যে আমিও খুব খুশী হলাম।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

জিহাদ এর ছবি

অনেক দিন পর দেখা পাওয়া গেল আপনার হাসি

মাস্টারিতে কি ইদানিং খুব বেশি বিজি নাকি? ছাত্ররা পেছনে বসে আপনাকে নিয়ে ছড়া লিখছে কীনা সেটা ঠিকঠাক খেয়াল করছেন তো? দেঁতো হাসি

জাহিদ হোসেন এর ছবি

মাস্টারী সামারের জন্য বন্ধ আপাততঃ। শুরু হবে সামনের মাসে আবার। এখন ক'দিনের জন্য বেড়াতে এসেছি ক্যালিফোর্নিয়াতে।
লেখালেখিটা আজকাল একটু কমকম হচ্ছে। ওপাড়াতে একটা সিরিজ লিখছি, কিন্তু সেটাও খুব নিয়মিত হচ্ছেনা।
আমাকে মনে রাখার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

একেবারে জীবন্ত বর্ণনা
কিন্তু আপনার কোনো লেখা আমি আগে পড়েছি বলে মনে হয় না
(এমনিতেই আমি কানা মানুষ। তার উপরে করি কুত্ত দৌড়ের দিনমজুরি। চোখের উপর দিয়ে যাওয়া অনেক কিছুই চোখে পড়ে না)

০২

লিখেন স্যার
আমাদের যাদের স্মৃতি নেই তারা আপনার স্মৃতিতে কিছু ভাগ বসাই

জাহিদ হোসেন এর ছবি

আমি এমন কিছু নজরে পড়ার মত লিখিয়ে নই বলেই বোধকরি আপনি দেখেননি। তাতে সমস্যা নেই। এই লেখাটি যে আপনার দৃষ্টি কেড়েছে, তাতেই আমি তুষ্ট। আর স্মৃতি না থাকার কথাটা যুক্তিসংগত নয় মোটেও। আপনি কত মানুষের স্মৃতির উত্স তা কি জানেন?

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

অনিন্দিতা এর ছবি

আহা, বড় ভাল লাগল।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

ভালো লাগল খুব। আসলেই হৃদয়স্পর্শী লেখা। ভালো থাকুন।
_______________________________
বিষন্নতা ছোঁয় আমায় মাঝে মাঝেই, কখনো কি ছোঁয় না তোমায়?

উজানগাঁ এর ছবি

জুবায়ের ভাইয়ের জন্মদিন নিয়ে আরিফ জেবতিকের লেখার লিঙ্ক ধরে আমি এই লেখাটা পড়লাম। অনেক ভালোলাগলো। অনেক সাবলীল লেখা। আরো লিখছেন না কেনো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।