মন্তব্যের মন্তাজ-৩

অনিকেত এর ছবি
লিখেছেন অনিকেত (তারিখ: সোম, ১৭/০৩/২০০৮ - ২:০৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লেখাটার উৎপত্তি আজকের এক অতিথি লেখকের কলাম পড়ে।
নন্দিনী লিখেছেন তার 'মন খারাপের দিনগুলো' নিয়ে। সাধারনত 'মন খারাপ','বিষাদ' এই জাতীয় শব্দ গুলো আমার জন্যে আঁকশী শব্দ (Catch phrase) হিসেবে কাজ করে। কাজেই তাঁর লেখার শিরোনাম দেখেই চোখ বুলিয়ে নিলাম।

তাঁর লেখা ভাল না মন্দ, সেইটা নিয়ে কথা বলা অবান্তর। তিনি প্রবাসে বাঙ্গালীদের যে চিত্রটি তুলে ধরেছেন সেইটা একটি নিদারুন সত্য হিসেবে উঠে এসেছে। নন্দিনী তার সৎ ঋজু লেখনীতে তুলে এনেছেন আমাদের প্রবাসী জীবনের কথকতা।

নন্দিনীর মত আমি ও এক সিলেটি। সিলেট শহরের পথে প্রান্তরে আমার বেড়ে ওঠা। সাধারনত প্রত্যেকেরই যার যার নিজ জন্মস্থান নিয়ে এক রকমের দুর্বলতা থাকে। আমি ও ব্যতিক্রম ছিলাম না। সিলেটি হিসেবে গর্বিত হবার জন্য আমার কাছে বেশ ক'টি কারন ধরা পড়েছিল। এই সব 'কারন' গুলোর কিছু নিজের মস্তিষ্ক প্রসুত আর কিছু চারপাশ থেকে নেয়া--যেমন সকলেই নেয়। আমার গর্বের কিছু উদাহরন নীচে দিলাম। আমি নিশ্চিত সচলায়তনের বাকী সিলেটিরা এ গুলোর এক বা একাধিক কারনের সাথে পরিচিতঃ

------- সিলেটিরা দেশ চালাচ্ছে। আমরাই সারা দেশের বেশির ভাগ বৈদেশিক আয়ের অংশ সাপ্লাই দিচ্ছি। শুধু কি তাই? 'আমাদের' গ্যাস , 'আমাদের' কমলা, আমাদের চা-----বিশাল লিষ্টি। দেশের আর কোনো জেলা আছে এই রকম সমৃদ্ধ?

------ সিলেট হল শাহ জালাল, শাহ পরানের দেশ। সারা দেশের মানুষ(ছোট থাকতে এই 'সারা দেশ' ব্যাপারটা 'সারা পৃথিবী' হিসেবে ছিল) এই খানে আসে পুন্য অর্জনের লোভে। সিলেটের যে এত রমরমা, এর কারন এই দুই পুন্যাত্মার আশীর্বাদ।

------ আমরা 'জাতি' হিসেবে অন্যদের চেয়ে উন্নত। আমাদের মধ্যে এক ধরনের আভিজাত্য রয়েছে যা অন্য জেলার মানুষের নেই। যে কারনে আমরা অন্য জেলায় বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহী না। আমরা আমাদের 'সিলেটি' রক্তের শুদ্ধতা বজায় রাখতে বদ্ধ পরিকর।

----- আমরা অত্যন্ত 'উদার'। আমাদের মন বড়। আমাদের 'খোলা হাত'----অন্য জেলার লোকেরা কিপ্টে।

আর তালিকা দীর্ঘ করতে চাইছি না। বরিশাল যখন আমাদের আগে বিভাগ হয়ে গেল, আমরা তখন 'গনদাবী পরিষদ' ('গদা পরিষদ) গঠন করলাম। রাস্তা ছেয়ে গেল স্লোগানে স্লোগানে----'আমড়া'র চেয়ে কমলা ভাল/ আমড়া কেন বিভাগ হল?' আমি এই রকম হাজার উদাহরন দিতে পারব আমাদের সিলেটিদের আত্মভরীতার।

যে কোন মোহ ভঙ্গ আসলে কষ্টের। আমার সিলেটি গর্বের মোহ ভাংতেও প্রচুর মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।
এখন আমি কিছু কিছু ভিন্ন চিত্রাবলী তুলে ধরছি, যেগুলো
আমার মোহভঙ্গের প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিলঃ

------- ক্লাস এইট। বৃত্তি পরীক্ষা সমাগত। পরীক্ষা যাতে ভাল হয় তার জন্য মা আর আমি গেলাম শাহ জালালের মাজারে। মা ঢুকলেন মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত এক বিশেষ ঘরে, আমি একলা উঠলাম সিঁড়ি বেয়ে, শাহ জালালের কবর জিয়ারত করতে। কিছু ক্ষন পরে যখন আমি আর মা ফিরছি বাড়ি, আমার মন তখন পুন্যভাবে নয়, বিশাল এক প্রশ্নের ভারে ভারাক্রান্ত। মেয়েরা উপরে যেতে পায় না কেন? মেয়েরা কবর জিয়ারত করলে কি হয়? জানা গেল, শাহ জালাল এবং শাহ পরান এরা দুই জনই 'গরম' পীর'(শাহ পরান নাকি একটু বেশি গরম)। এরা কেউই নাকি মেয়েদের পছন্দ করতেন না।তারা চাইতেন মেয়েরা যেন তাদের 'পুন্যস্পর্শ' থেকে দূরে দূরে থাকে।
এই উদাহরন বছরের পর বছর ধরে আমাদের নিষ্পেষিত নারীদের গঞ্জনায় কেবল ইন্ধন দিয়ে এসেছে। খুব ছোট বেলা থেকেই আমরা জানতে পারছি, মেয়েরা 'অস্পৃশ্য','অছ্যুৎ'। মহৎ লোকেরা সর্বদা নারী সঙ্গ পরিহার করেছেন।

------ শাহ জালাল তাঁর আপন ভাগ্নে শাহ পরান কে বিতাড়িত করেছিলেন তাঁর নিজের আস্তানা থেকে। কারন হিসেবে যে কাহিনী প্রচলিত তা হল এই রকম--- শাহ জালালের কিছু প্রিয় কবুতর ছিল (জালালি কৈতর)। সেই গুলোর প্রতি ভাগ্নের অনেক দিনের লোভ। এক দিন সুযোগ বুঝে কবুতর ধরে খেয়ে ফেললেন (আশা করছি রেঁধে খেয়েছিলেন)। শাহ জালাল যখন তার কবুতর খুঁজছিলেন, তখন কিছুখন ভাগ্নে এই ব্যাপারে তার সম্পুর্ন অজ্ঞানতা জাহির করছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে, তিনি কবুতরের কিছু দেহাবশেষ থেকে শাহ জালালের সামনেই জীবন্ত কবুতর বানিয়ে দেন। এই জিনিস শাহ জালাল কে ক্ষুদ্ধ্ব করে। তিনি আদেশ দেন ভাগ্নে কে, অবিলম্বে তাঁর আস্তানা ছেড়ে যেতে। এই কাহিনী অন্য কারো হলে আমরা হয়ত বলতাম, মামাটা কি হিংসুটে। কিন্তু সিলেটে এইটা একটা আধ্যাত্মিক লীলা হিসেবে দেখা হয়।

------ আমার জানা মতে সিলেট হল একমাত্র জায়গা যেটা বারবার কবি শামসুর রাহমান কে আসতে বাঁধা দিয়েছে। আমার জানা মতে দু' দুবার তাকে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রত্যেক বার মৌলবাদীদের হাতে সে চেষ্টা ভন্ডুল হয়েছে।

----- মনিকা আলী তার 'ব্রিক লেন' উপন্যাসে আমাদের প্রবাসী সিলেটিদের কিছু একান্ত চিত্র তুলে ধরেছিলেন। সেটা তাকে বিশাল এক ক্ষোভের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়---তিনি নাকি সিলেটিদের অবজ্ঞা করেছেন! সর্বনাশ!! সিলেটিদের লন্ডনে থেকে, সিলেটিদের অপমান??!!! প্রবল আন্দোলনের তোড়ে বেচারীর বুকার প্রাইজের স্বপ্ন ভেসে গেল। আমরা সিলেটিরা বিজয় গর্বে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলাম।

আমাকে সিলেট-বিদ্বেষী অনেকেই হয়ত ভেবে নিয়েছেন এর মধ্যে। কিন্তু সেইটা ভুল হবে। আমি চাই শুধু সিলেট না, সারা দেশ ভালো হয়ে উঠুক। আমাদের মানসিক অন্ধত্ব দূর হোক। আমরা অন্ধ ভাবে কোন কিছু গ্রহন করে নেবার আগে একটু মস্তিষ্ক খাটাব। ঘাড়ের উপরে যে জিনিসটা আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াই, সেইটা শুধু শুধু বসিয়ে না রেখে একটু ব্যবহার করব।

প্রবাসে যারা আছেন, তাদের সাহায্য দরকার সবার আগে। তারা এক অন্ধকূপে আটকে আছেন। তারা কোন এক উপায়ে থমকে দিয়েছেন সময়ের চাকা। ব্রিকলেনে নামিয়ে এনেছেন সপ্তদশ শতাব্দীকে। বিলেতে সিলেটিরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মোকাবেলা করছেন আরো গোঁড়া কুসংস্করাচ্ছন্ন মানসিকতা কে লালন করে। পরবর্ত্তি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এক আত্ম পরিচয় হীন প্রজাতী হিসেবে। তাদের বাবা মা চাইছেন তারা হয়ে উঠূক সপ্তদশ শতাব্দীর মাদ্রাসা পড়া হাফেজ-আলেম, তারা চাইছে এই নিগড় থেকে মুক্তি, একটু নিশ্বাস নেবার স্থান। এই দু'টোর টানাপোড়েনে আমরা পাচ্ছি আরো পশ্চাদপদ অন্ধ এক প্রজন্ম।

অন্ধকার থেকে শুধু সিলেটিদের না, আমার সারা দেশের মানুষের বেরিয়ে আসার সময় হয়েছে। আমাদের সময় হয়েছে সুরমা-আতর সরিয়ে রেখে জীবনের উদার মুক্ত হাওয়ায় নিশ্বাস নেবার। ছোট্ট একটা দেশ। তার মাঝে আমরা দাবী করছি , এ ওর চাইতে ভালো, এ জেলার লোক ঐ জেলার চেয়ে গাইয়া। কি হাস্যকর!

এইটা কেমন দেশ যে শুধু জন্ম দিয়ে যাবে পঞ্চেন্দ্রীয়হীন অন্ধ শাবকের?

শেষ করতে চাইছি, আমার সিলেটেরই এক উদার আত্মার কিছু কথা দিয়ে। প্রকৃত পক্ষে, সিলেট যে অনেক মহৎ পুরুষের জন্ম দিয়েছে এবং এখনো দিয়ে যাচ্ছে সেইটাই সব চাইতে আশার কথা।শুভাশুভের দ্বন্দ্ব চলছে অনাদিকাল হতে। কিন্তু যতক্ষন পর্যন্ত অনেক খারাপের মাঝে একটাও ভালো মাথা উঁচু করে থাকে-----ততক্ষন আমি হাল ছাড়তে রাজী না।

নীচের কথা গুলো মরমী কবি শাহ আব্দুল করিমের---- ফেলে আসা এক স্বর্নময় অতীতের স্মৃতিচারণ নয়, আশায় ভরা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহীঃ

'আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গেরামের নওজোয়ান, হিন্দু মুসল্মান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম............'


মন্তব্য

উদাস এর ছবি

ভালো লাগলো লেখাটা। প্রতিটা কথার সাথে সহমত। আপনার মত করে যেদিন আরো আনেকে ভাবতে শিখবে, সেদিন সত্যিই একটা রেনেসা হবে আমাদের দেশে।

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

আমি বিশ্বাস করি যে, আমাদের সময় খুব বেশি আর নেই। যা করার আমাদের খুব দ্রুত করে নিতে হবে।

রাবাব এর ছবি

তা ভাই সিলেটিরা সিলেট শহরকে পৃথক দেশ ঘোষণা করছে কবে?দেঁতো হাসি

অনিকেত এর ছবি

হা হা হা .........

ভালো প্রশ্ন করেছেন। আমার ধারনা তারা অপেক্ষা করছে স্বাধীনতার ডাকের। চোখ টিপি
কেউ জোরে সোরে ডাক দিলেই হল। আমরা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা, আমাদের গ্যাস, আমাদের চা আর আমাদের কমলা নিয়ে 'স্বাধীন সিলোট' (সিলেট বানানটা লক্ষ্যনীয়) ঘোষনা করব।

নন্দিনী এর ছবি

পারলে ঠিকই ঘোষণা করত ! মনে মনে অনেকেই আলাদা দেশ ভাবে ...

নন্দিনী

মির্জা এর ছবি

ভাই অনিকেত আমার ‘‘কইলজার’’ কথাগুলো লেখার জন্যে ধন্যবাদ! সেই সাথে একটু সাবধান বাণী...... মনে করেন আপনার লেখাটাতো সিলেটি সমাজে ছড়িয়ে পড়তেই পারে তাইঃ
১) জ্যাকসন হাইটের দিকে কয়েকদিন যাইয়েন না... ‘‘মানে মনে করেন যদি কেউ ধরেন আপনাকে একটা থাপ্পড় মেরে দেয় মানে মনে করেন যদি দুই একটা চড়-থাপ্পর মেরে ঠেরে দেয় আর কি তখন কেমন একটা শরমের ব্যাপার হয়ে যাবে না!’’
২) মনিকা আলিকে যখন ব্রিকলেইন-এ নিষিদ্ধ-অবাঞ্ছিত ঘোষনা করা হল, বলা হল তিনি আসলে তাকে জীবন দিয়ে রুখে দেওয়া হবে (আসল কথা হয়ত ছিল মনিকা আলির জীবন-ই রুখে দেয়া হবে) তখন একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে আমি সবাইকে অনুরোধ করেছিলাম যারা মনিকা আলির লেখার প্রতিবাদ করতে চান, তারা লেখনি দিয়ে প্রতিবাদ করুন, গঠনমুলক সত্যনির্ভর সমালোচনা করলে ব্রিটিশ প্রিন্ট মিডিয়া সেটা অবশ্যই ছাপাবে।
এরপর পরই একদিন ব্রিকলেন যাই এবং তখন এককাপ চা, দেশি ষ্টাইলে সিঙ্গাড়ার সাথে সাথে আমাকে বলা হল এই যে আপনি এইসব আজে বাজে কথা বললেন টিভিতে এতে করেত মুরুব্বিরা আর ‘‘ইয়োং’’ ছেলেরা খুব মাইন্ড করেছে। আমরা মুরুব্বিরাতো আথা ঠান্ডা রাখতে পারি তো মনে করেন ‘‘ইয়োং’’রা তো পারে না,...মানে মনে করেন যদি কেউ ধরেন আপনাকে একটা থাপ্পড় মেরে দেয় বা দু চারটা কিল ঘুষই দিয়েই দেয় আমরাতো আর সবসময় আটকাতে পারব না!!!

অনিকেত এর ছবি

আপনার সাবধান বানীর জন্য ধন্যবাদ, মির্জা ভাই।
আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের এত সময় কোথায় যে বসে বসে লিখে প্রতিবাদ জানাব? এর চেয়ে ভালো রাস্তা ঘাটে পেলে দু'একটা চড় থাপ্পড় মেরে দেয়া। লোকে বলে, লেখনীর চেয়ে নাকি পিটুনী অনেক বেশি কার্যকর। হে হে হে

হীরক রাজার দেশে'র একটা দৃশ্য মনে পড়ে গেল

হীরক খনির শ্রমিকঃ হুজুব, পেটে খেলে তবে তো পিঠে সয়

রাজাঃ কে কয়?

শ্রমিকঃ আজ্ঞে?

রাজাঃ যে কয় পেটে খেলে পিঠে সয়
তার কথা ঠিক নয়
এইবার শোনো, রাজা কি কয়.........

নন্দিনী এর ছবি

হুম ...!

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

লেখাটা পড়তে পড়তে অস্বস্তি হলো খুব। শুধু সিলেট কেন, আমার ধারণা সারা বাংলাদেশের ছবিই কমবেশি একরকম।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অনিকেত এর ছবি

হয়ত তাই।

কিন্তু জুবায়ের ভাই, আমাদের পরিত্রানের উপায়টা কি?

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

সিলেটের তো একটা নিজস্ব ভাষাও ছিলো? তাইলে তো আর স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করতে কোনও বিরোধ নাই?
ভালোইছে...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

ovaga এর ছবি

বলতে কষ্ট হচ্ছে, এখন প্রবাসেও বোধহয় ভাল আছি সিলেটে কাটানো তিন বছরের চেয়ে। সূর্যের চেয়ে বালি গরম। তার চেয়ে গরম হলেন ধনবান প্রবাসী(লোন্ডোনী) আত্মীয়ের রেমিট্যান্স-গর্বে আকাশে ওঠা স্বদেশী। প্রবাসী সিলেটী অন্য জেলায় বাড়ী এমন প্রবাসীকে বলেন "বেঙ্গোলি" (নিজেরা সিলেটী)। আর তাঁদের লোকাল কাউন্টারপার্টরা আমাদের মতো দুর্ভাগা, যারা জীবিকার তাগিদে সিলেটে থাকতে বাধ্য হয়, তাদের বলেন "আবাদী"। এই অ্যাড্রেসিংগুলোতে কতটা যুক্তিহীনতা, নিষ্ঠুরতা আর তাচ্ছিল্য থাকে তা ভুক্তভোগীই বোঝে। শিক্ষা-বংশগর্ব নির্বিশেষে অধিকাংশ, দুর্ভাগ্যজনকভাবে অধিকাংশ, সিলেটী এই নীচতায় আক্রান্ত। আমার অসংখ্য পুনরাবৃত্ত অভিজ্ঞতার কয়েকটি বলি।

"পশ" শহর সিলেটে দোকান-বাজার অনেক। উচ্চারণে "আবাদী"ত্ব বোঝা মাত্র অবিশ্বাস্য উচচমূল্য হাঁকা। দর কষার সযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে উদ্ধত জবাব- আবাদী মনে করছে বিক্রির দায়ে দোকান দিছি! সত্যিই তো, অমুক স্টোর্সের প্রোপ্রাইটার- এই কার্ডটা ছাপানোর জন্যই তো তার দোকান খুলে বসা। উনি তো তবু কিছুটা দয়া করলেন, অনেকে সোজা বলে দেন আফনি ওউদিকে চোখ দিয়েন না, ওগু আফনের লাগি না। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষকবন্ধুকে লিটারালি কাঁদতে দেখেছিলাম এমন এক ঘটনায়।

অর্থগর্বে স্ফীত মুরুব্বী এসেছেন ফটোকপি "অ্যাঠাক" করাতে। কাজ শেষে দুখানা বড় নোটবাড়িয়ে প্রত্যাখ্যাত হবার পর বলেন- গরিব মানষের ফোয়া মাজিষ্টর অইছ, খতো আর বেতন ফাও, একশোত ফাউন্ডওতো অয়না...

সাইফুর রহমান মন্ত্রী হিসেবে বক্তৃতা কম দেননি। নেতার আগে ভাষণ দেয় পাতিনেতা। ছাত্র তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও তাতে বলতে শুনেছি শুধুমাত্র সিলেটবাসীই সিলেটে পড়তে ও পড়াতে পারবে- এমন পরিবেশই তাঁরা চান।

বিশেষ একটি দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে দেশব্যাপী সুনাম অর্জনকারী বিদ্যালয়। অধ্যক্ষার পরিবার জাতীয় পর্যায়ের বিশিষ্ট বিদ্বজনে আলোকিত। অতিথি হিসেবে তাদেরই একজন এসেছেন শিক্ষার্থীদের মাঝে আলো ছড়াতে। কোনো কারণে বসতে হয়েছে তাঁদের কাছাকাছি। ক্লাস এইট পড়ুয়া মেধাবী কিশোরী ভাষা বিষয়ে বলছে । ক্লাসে "বইয়ের ভাষা"য় অর্থাৎ আঞ্চলিক প্রভাবমুক্ত পাঠদানের গুরুত্ব বিষয়টি যখনই এল, আমাকে হতবাক করে অধ্যক্ষা আর অতিথি "আবাদীর বেটী"র গুিষ্ট উদ্ধার করলেন।

বর্ণনা আর না বাড়াই। আমার সবচেয়ে পুরনো বন্ধুটির আদিবাড়ী সিলেটে। "সিলেট থেকে" শব্দোবন্ধ সহ অসংখ্য আলোকরশ্মিতে উজ্জ্বলতর হতো নতুন প্রজন্মের কলমকে অনন্য উচ্চতায় তুলে নেয়া সেই পাঠক ফোরাম। সচলায়তনকেও সমৃদ্ধতর করছেন তাঁরা, সঙ্গে আছেন আরো অনেকে। তারপরও সিলেট কিংবা সিলেটী- অনেকের জন্যই অপমানজনক অনভূতির অস্বস্তিরই যেন অন্য নাম। মহৎপ্রাণ অথবা নিছক স্বাভাবিক চিন্তার অধিকারী সিলেটীরা ক্ষমা করবেন। পনের হাজার দুর্বৃত্তের জন্য পনের কোটির জননী যেখানে দুর্নামী, সেখানে আপনারা তো বিপন্ন প্রজাতি!

পুনশ্চ- বিভ্রান্ত খিচুড়ি সংস্কৃতির লন্ডনী তরুনীর সপরিবারে সিলেটে এসে বিয়ে করা নিয়ে বিবিসির এক ডকুনির্মাতা অনুপুংখ চিত্রায়নে বড় দৈর্ঘের এক দ্রষ্টব্য নির্মাণ করেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় আমরা বহু বাংলাদেশী এটা দেখে লজ্জ্বা পেয়েছি। অন্যদেশী পরিচিতদের প্রশ্নের উত্তরে পরিবারটির সব ক্রুড কার্যকলাপকে নির্মাতার বানানো কাহিনী বলে নিশ্চ্য়তা দিয়েছি। বিষয়টা দেশের জন্যই লজ্জ্বার মনে হয়েছিল আমাদের সবার। না, সবার না, অনেকের। কারণ সেসময় একদিন কোনো জমায়েতে কয়েকজনকে বলতে শুনি, "কী বিশ্রী জিনিস দেখাল, ছি ছি আবাইদ্যারা কী মনে করল সিলেটীদের নিয়ে..."

আরিফ জেবতিক এর ছবি

এইটা মিস করলাম কিভাবে ?
জট্টিল সিলেটি বিশ্লেষন ।

দাড়াও , অনিকেতরে একদিন পাইয়া নেই । কীনব্রীজের উপর থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব । হাসি

----------------------------
কালের ইতিহাসের পাতা
সবাইকে কি দেন বিধাতা?
আমি লিখি সত্য যা তা,
রাজার ভয়ে গীত ভনি না।

অনিকেত এর ছবি

আরিফ ভাই,

প্লীজ, দয়া করে জানান কবে, কখন আমাকে কীন ব্রীজে থাকতে হবে। নিতান্ত সাহসের অভাবে কীন ব্রিজ থেকে লাফ দিতে পারছি না। কেউ যদি দয়া পরবশ হয়ে করে দেয়---আমি যারপর নাই রকমের কৃতজ্ঞ হব।

আলমগীর এর ছবি

অনিকেত দা
পড়েছিলাম আগে, আজ আরিফের মন্তব্য দেখে আমারও কিছু লেখার সাধ হলো।

আফনে আমরার নিজেরার মানুষ হইয়া ঈ খিতা করলায়! আবাদী বেঙ্গলীর লগে আমরার তুলনা অয় নি? আফনে কইন আমরার নাই খিতা? অত কিচ্ছু লইয়া আমরার খিতার বারচাইতাম?

আফনেরে লাগে যেন ধরিয়া এখটা কুদাম দিতে অইব।

বহুদিন সিলটি চর্চা নাই, কিছু মনে না করলে ভাল লাগবে। সমাজ পরিবর্তন সহজ নয়।

আরিফ:
সুরমা ব্রিজ খিতা, হামাদান লইয়া অখান ঠেলা দিলেই অইব!

আলমগীর

অনিকেত এর ছবি

হা হা হা.........

আলমগীর ভাই, ইতা 'নিজ'র মাঝে' মাত কতা বা---বুঝলায় নি?
আমরা তো রাজ বাদশার জাত। ইতা আবাদী হকলে কিতা বুঝত আমরার 'মরতবা'।

কীন ব্রিজ তাকি কুনদিন আমারে 'ক্লীন' করা অইব, জানাইলে বালা অয়। আগে তাকি ছুটি লইয়া রাখমু নে।

আলমগীর এর ছবি

আমি কিন্তু ভাই সিলেটি না হাসি
পড়াশোনা আর কাজ মিলিয়ে বছর দশেক বাস, এই যা।

অনিকেত এর ছবি

যাহ, আপনি তো আমাকে ভালোই ঘোল খাইয়েছেন !!!

আলমগীর এর ছবি

স্যাবোটাজ করলাম। আর্মি আইসা এই শব্দটা কত দিন শুনি না!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমার বোকাসূত্র গল্পে সিলেট সম্পর্কে কিছু কথা ছিল

মনে হয় সেগুলোই এখানে কমেন্ট হিসেবে দেয়া যেতে পারে-

''সিলেট শহর একটা আত্মঘাতী শহর। এ শহরের ইতিহাস মানুষকে বেশিদূর যেতে দেয় না। যে মানুষ বেশিদূর যাবার ক্ষমতা রাখে তাকে হয় পির না হয় সন্যাসী বানিয়ে ফেলে এই শহর। এজন্য সিলেট থেকে আমলা বের হয় কিন্তু রাজনীতিবিদ বের হয় না। কবিতা চর্চা হয় কিন্তু কবি হয়ে উঠতে পারে না কেউ। এর কারণ হয়তো সিলেট শহর এখনও নিজেকে যে দুই মানুষের নামে পরিচয় করায় তারা দুজনই সন্যাসী। শ্রী চৈতন্য আর শাহ জালাল। একজন বাড়ি ছেড়ে গিয়ে আর আসেননি নিজের বাড়িতে। আর আরেকজন বাড়ি ছেড়ে এসে আর ফিরে যাননি নিজের বাড়িতে। একজন সিলেট থেকে সন্যাসী হয়ে বের হয়ে গেছেন। আরেকজন সন্যাসী হয়ে এসে ঢুকেছেন সিলেটে। সন্যাসবাদের মূল চরিত্র দাবি ছেড়ে দেয়া- জীবনের সব রং ছেড়ে দেয়া। অনর্থক আত্মমগ্নতায় ডুবে জীবনের সব স্ট্রাগলকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। জীবনকে আত্মসমর্পন করানো অনর্থক কোনো কিছুর কাছে। সন্যাসবাদ একজনকে সন্যাসী বানিয়ে যতটুকু ক্ষতি করে তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করে সন্যাসীর ভক্তসংখ্যা বাড়িয়ে। সন্যাসীরা নিজের জীবন ছেড়ে দেয় শূন্যে। আর ভক্তরা ধরে বসে থাকে সন্যানসীর শূন্যতাকে। এ এক আজব আনুগত্য। এরকম সারেন্ডার অন্য কোথাও নেই। সিলেটের তরুণরা এখনো বড়োদেরকে দীর্ঘ দীর্ঘ সালাম দিয়ে যত সময় নষ্ট করে; অত সময় বাংলাদেশের অন্য কোনো অঞ্চলের কোনো তরুণ সারা জীবনেও নষ্ট করে না। এই আত্মঘাতী শহরে যে একটু কিছু প্রমাণ করে সেই হয়ে উঠে পির। আর পির হয়ে গেলে তার কাজ হয় কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে দুনিয়াশুদ্ধ লোককে মুখে মুখে উদ্ধার করা'

অনিকেত এর ছবি

চমৎকার!

একে বারেই আমার মনের কথা।

'বোকাসুত্র' টি পড়ে দেখতে হবে। ইন্টারেষ্টিং।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।