রঙ্গিলা রঙ্গিলা

অনিকেত এর ছবি
লিখেছেন অনিকেত (তারিখ: বুধ, ১৫/০৫/২০১৩ - ৭:৫৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"এ্যাঁলো--আজিজ সা'ব আছোইন নি?"

বশর চাচা আমাদের বাসায় ফোন করে সব সময়ে এই কথাটা বলতেন।

বশর চাচা--মানে আবুল বশর, আমার বাবার প্রাণের বন্ধু। একই কলেজে দুইজনে পড়াতেন। বাবা অর্থনীতির, বশর চাচা বাংলার। দীর্ঘ শাল-প্রাংশু গড়ন। তাঁর স্ত্রী, 'বশর চাচী', আবার আমার মায়ের অনেক দিনের বন্ধু। দুইজনে মিলে গীটার শিখতে যেতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাবা-মা ছিলেন সিলেটে। বাবা ছিলেন সিলেটের এম সি কলেজে অধ্যাপক এবং সেই সাথে কলেজের হোস্টেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট। যুদ্ধের সময়ে বাবা মা-কে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন গ্রামে। বাসা অরক্ষিত পড়ে ছিল। রাজাকার আর পাকবাহিনী এসে সমস্ত কিছু তছনছ করে দিয়েছিল। আমাদের ঘরের অনেক জিনিস ভেঙ্গে চুরে দিয়ে গিয়েছিল, অনেক জিনিস চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে ফেলে রেখে গিয়েছিল আমার মায়ের সাধের গীটারটি। বাকী সকল কিছু ভুলতে পারলেও আমার মা কখনো তার শখের গীটারটা ভাঙ্গার শোক ভুলতে পারেন নি। পরে আর কখনো গীটার কিনতেও চাননি।

বশর চাচার অনেক গুন। ভাল ছবি তোলেন। চমৎকার লেখার হাত। আমাদের কাছে তাদের আলাপ-আলোচনা তেমন ইন্টারেস্টিং না লাগলেও বাবা আর বশর চাচা দুইজনেই ঘন্টার পর ঘন্টা দেশ-জাতি-সাহিত্য নিয়ে আড্ডায় মশগুল থাকতেন।

বশর চাচার মূল সমস্যা ছিল--তার কথা বলা। না, কথায় কোন জড়তা ছিল না। উচ্চারণেও সমস্যা নেই (সিলেটি হলে উচ্চারণে যে কমলালেবুর গন্ধ লেগে থাকে সেইটা বাদে)। সমস্যা হল অন্য জায়গায়। তার কন্ঠ। কন্ঠটা শুনলেই ঘুম পেয়ে যেত আমাদের। তার কথা বলার ভঙ্গির মাঝে কোন তাড়াহুড়ো ছিল না---কোন Urgency ছিল না। খুব ঢিলে ঢালা ভাবে কথা বলতেন। ভাবটা এমন ছিল--কথাটা শুরু করেছি বটে--তবে শেষ করার আমার কোন তাড়া নেই। আমাদের যাদের এম্নিতেও কোন কিছুতেই তাড়া ছিল না----তার কথা শুনলেই কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগত। মনে হত সব সময় আমাদের শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার কথা বলার দ্বিতীয় সমস্যা ছিল---ফোন করে কখনো নাম বলতে চাইতেন না। নাম জিজ্ঞেস করলে ক্ষেপে যেতেন! আমি মাঝে মাঝেই ক্ষেপানোর জন্যে জিজ্ঞেস করতাম, 'কে বলছেন?' ব্যস! ক্ষেপে বোম! বলতেন, 'এতদিনেও গলা শুনে বুঝতে পারো না আমি কে?' আমি ততধিক নিরীহ কন্ঠে জানাতাম,' জ্বি না, ঠিক চিনতে পারছি না, আপনি কে বলছেন?'--এত করেও কখনো উনার নাম বলাতে পারিনি। উনি রাগে গজগজ করতে করতে বলেছেন,' না চিনলে নাই। তোমার বাবাকে দাও, উনি চিনবেন!!'

বশর চাচার কাছে আমার একটি স্মৃতিময় ঋণ রয়েছে।

নজরুল পুত্র কাজী সব্যসাচীর আবৃত্তির একটা রেকর্ড উনি আমাদের এনে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম মন্দ্রিত কন্ঠের আবৃত্তি শোনা 'কে সেই মানুষ?'। তাঁর জন্যে প্রথম শোনা হয়েছিল শম্ভু মিত্রের গলায় 'আট বছর আগের একদিন'। এখনো কানে বাজে শম্ভু মিত্রের কন্ঠে 'চমৎকার, ধরা যাক দু'একটা ইঁদুর এবার'! ছোট ছিলাম। ছোট মাথায় 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটির অস্তিত্ত্ববাদী সংসয়টা ঢুকতে পারেনি। ছোট্ট আমি গালে হাত দিয়ে অবাক হতে ভাবতাম লাশকাটা ঘর নিয়ে লোকটা কবিতা বলছে কেন? কবিতার মাঝে ইঁদুর আসছে কেন? এইটা কি হাসির কবিতা? তাহলে বাবাটা হাসছে না কেন?

বশর চাচা আমাদের আরো একটি জিনিসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন---শচীন কত্তা। আমাদের গ্রামোফোনে শচীন কত্তার খনখনে গলায় যখন সুর লাগত--'কই গেলা রে বন্ধু কই রইলা রে/ আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই রইলা রে' --মনে হত নদীর তীরে একলা বসে কেউ আকুল হয়ে গানটি গাইছে।

সেই তখন থেকে 'বন্ধু রঙ্গিলা রঙ্গিলা' গানটা আমার খুব প্রিয়।

গত বছর হঠাৎ করে ইউ টিউবে দেখতে পেলাম গ্রামীন ফোনের একটা এডভার্টাইজমেন্ট--এই 'রঙ্গিলা' গানটি নিয়েই করা। এডভার্টাইজমেন্টটির দৃশ্যায়ন, সঙ্গীত সবকিছুই খুব ভাল লেগেছিল। মাঝে মাঝেই এড-টা ঘুরে ফিরে দেখা হত। ততদিনে আমার জানা হয়ে গেছে--এই গানটার রচয়িতা আমাদের পল্লীকবি জসিমউদ্দীন। আমার বাবা তার কলেজ লাইফে জসিমউদ্দীনের ছেলে-মেয়েদের বাসায় পড়াতেন। বাবা মাঝে মাঝেই কথা প্রসঙ্গে বলতেন কী চমৎকার নিপাট ভাল মানুষ ছিলেন আমাদের পল্লীকবি।

গত মাসে হঠাৎ করে ফেবুতে আমাদের তাসনীম ভাই নক করলেন। দেখা গেল তারও গ্রামীনফোনের রঙ্গিলা এড-টি খুব পছন্দ হয়েছে। উনি আমাকে বললেন যে তাঁর স্ত্রী, আমাদের মারিয়া ভাবী, নববর্ষের অনুষ্ঠানে গানটা গাইতে চাইছেন। তাসনীম ভাই বেশ কাঁচুমাচু মুখ করে জানতে চাইলেন, আমি এই গানটার কোন মিউজিক ট্র্যাক তৈরী করে দিতে পারব কি না। আমি এইসব ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই নাচুনী বুড়ি--কেবল কোন প্রকারের ঢোলের বাড়ির অপেক্ষায় থাকি। 'আরে ব্যাপার্না, দিতাসি খাড়ান' বলেই ট্র্যাক বানাতে বসে গিয়েছিলাম। প্রথম দুইঘন্টার চেষ্টায় একটা কঙ্কাল তৈরি হল। সেইটা তাসনীম ভাই শুনে 'ওকে' করলেন। তখন বাকী সপ্তাহে তৈরী করেছিলাম পুরো ট্র্যাকটা।

সব তৈরী হবার পরে দেখা গেল সঙ্গীতায়োজনটা আমি যেমন চেয়েছিলাম তেমনটা হয়নি। একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। তাসনীম ভাইয়ের তারপরেও এইটে পছন্দ হওয়ায় তাকে দিয়ে দিয়েছিলাম। এই ট্র্যাকে আমাদের মারিয়া ভাবী কন্ঠ দিয়েছেন, চমৎকার করে দরদ দিয়ে গেয়েছেন। তাসনীম ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে তাঁর গাওয়া গানটা এইখানে শেয়ারে দিচ্ছিঃ

যখন 'রঙ্গিলা'-র মতন কালোত্তীর্ণ কোন গান থাকে, তখন সবাই ভালবেসে সেই গান গায়। একই গান--অথচ একেকজনের গায়ন-ভঙ্গীতে একেক মুর্চ্ছনা একেক রূপ পায়। আমার স্থির বিশ্বাস--শচীন কত্তার রঙ্গিলা-র আমেজ আনা প্রায় অসম্ভব। তারপরেও আমরা সকলে এই গানটা ভালবেসে গাই--আমাদের সবার কন্ঠে অনাদিকালের বিরহ বেদনা ঝরে পড়ে--

"কই গেলা রে বন্ধু, কই রইলা রে
আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই গেলা রে"

----------------------------------------------------------------------------------

এই গানটির নিজের গাওয়া ভার্সনটিও এইখানে জুড়ে দিলামঃ

গানটির কথাঃ পল্লীকবি জসিমউদ্দীন
সুরঃ শচীন দেব বর্মণ
যন্ত্রানুষঙ্গ আয়োজনঃ অনিকেত


মন্তব্য

ত্রিমাত্রিক কবি এর ছবি

চমেৎকার।

_ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _ _
একজীবনের অপূর্ণ সাধ মেটাতে চাই
আরেক জীবন, চতুর্দিকের সর্বব্যাপী জীবন্ত সুখ
সবকিছুতে আমার একটা হিস্যা তো চাই

অনিকেত এর ছবি

ধন্যেবাদ প্রিয় কবি--
শুভেচ্ছা অফুরান

মেঘা এর ছবি

গানের জন্য এমন লেখার আবহ তৈরী হওয়াটা আসলেই চমৎকার ছিলো! লেখা পড়তে বেশ লাগছিলো মনে হচ্ছি আরও কিছু স্মৃতিচারণ হোক না!

মারিয়া ভাবীর গান খুব ভাল লেগেছে তবে আপনার ট্র্যাকটা মুগ্ধ করেছে!

--------------------------------------------------------
আমি আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পরা
আলোর আধুলি কুড়াচ্ছি,
নুড়ি-পাথরের স্বপ্নে বিভোর নদীতে
পা-ডোবানো কিশোরের বিকেলকে সাক্ষী রেখে
একগুচ্ছ লাল কলাবতী ফুল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছি

অনিকেত এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ মেঘা

শুভেচ্ছা অহর্নিশ

মইনুল আজিজ এর ছবি

সচীনদেব বর্মনের গাওয়া এতো সুন্দর গানটি যে আমাদের পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের লেখা, তা জানা ছিলো না। লজ্জিত।

স্মৃতিময় লেখাটি পড়ে মজা পেলাম।

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ মইনুল আজিজ

শুভেচ্ছা নিরন্তর

তারেক অণু এর ছবি

আপনি প্রতি সপ্তাহে গান দিবেন। মিয়া বড় ভাই বলে কিছু বলি না, এত দিন পরপর গান দেন, মস্করা নাকি ! রেগে টং

অনিকেত এর ছবি

হা হা হা ----
অনেক ধন্যবাদ বস--
শুভেচ্ছা নিরন্তর

স্যাম এর ছবি

ভোট দিলাম চোখ বন্ধ করে

তিথীডোর এর ছবি

আম্মো দিলাম। দেঁতো হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

tokkhok এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই। অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। গুরু গুরু

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকেও তক্ষক ভাই

তাসনীম এর ছবি

আমি গানের "গ" ও জানি না। কিন্তু রঙ্গিলা গানটার ভেতর যেই সরল আকুতি আছে সেইটা খুব খুব কাছে টানতো। কোন জটিলতাতে না গিয়ে বিরহের এই সার্বজনীন প্রকাশ একদম মনকে নাড়া দিয়ে দেয়।

ট্র্যাকটা অসাধারণ হয়েছে। কোন ধন্যবাদই এর সমতুল্য নয়।

________________________________________
অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে...

অনিকেত এর ছবি

কোন জটিলতাতে না গিয়ে বিরহের এই সার্বজনীন প্রকাশ একদম মনকে নাড়া দিয়ে দেয়।

এইটেই হল সারকথা--

অনেক ধন্যবাদ তাসনীম ভাই। ভাবীকেও অপার কৃতজ্ঞতা আমার ট্র্যাকটাতে কন্ঠ দেয়ার জন্যে।
ভাল থাকুন সকল সময়ে--

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

মাত্রই শুনলাম। চমৎকার! ভাবী দারুণ গান করেন। আরও নতুন প্রজেক্ট আসুক এরকম। শুভকামনা থাকল। হাসি

অনিকেত এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অপ্র।
অনেক দিন পর তোমাকে এই পাড়ায় দেখলাম--সব মঙ্গল তো?

শুভেচ্ছা অফুরান

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ অনিকেত। চমৎকার উদ্যোগ।

মারিয়া আপার গান খুব ভাল লাগলো। তাসনীম দেখছি মহা ভাগ্যবান। আরো এমন গান যেন পাই আমরা।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

অনিকেত এর ছবি

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ জোহরা'পা।
ভাল থাকুন সকল সময়ে, সকলকে নিয়ে---

অর্ক রায় চৌধুরী এর ছবি

দাদা কেমনে কি!!! আপনে কেমনে পারেন কন তো দেহি!!!!
আমার তো মনে হয় পেত্যেক দিন আপনার একটা করে গান দেয়া উচিত। হাসি

অনিকেত এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ বস! আপনার নামটা দাদা আমার খুব পছন্দ হয়েছে---
শুভেচ্ছা নিরন্তর

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ভাবি তো দারুন গান! হাততালি

আপনার কম্পোজিশান ও যন্ত্রানুষঙ্গ বরাবরের মতোই দারুন।

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ রাতঃদা---
শুভেচ্ছা অহর্নিশ

অমি_বন্যা  এর ছবি

চলুক উত্তম জাঝা!

অনিকেত এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

ওহ্, দারুণ ! গান ও লেখা, সবই।

অনিকেত এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ প্রৌঢ় ভাবনা---
শুভেচ্ছা অফুরান--

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

দুজনেই ফাটাফাটি।
আপনার ট্র্যাকটার শুরুতে যে জলের শব্দটা আছে সেটা দারুউউন ।

অনিকেত এর ছবি

অশেষ ধন্যবাদ প্রদীপ্ত'দা
শুভেচ্ছা নিরন্তর

ইমা এর ছবি

চমৎকার গান।

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ ইমা
ভাল থাকুন সকল সময়ে---

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

দারুণ... দুটোই...
এতো ভালো একজন গায়িকা শুধু কথা বলে পার হয়ে গেলো? ঢাকায় আবার আসুক ভাবী...

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অনিকেত এর ছবি

ধন্যবাদ নজু ভাই--
ভাল থাইকেন--

কৌস্তুভ এর ছবি

গ্রামীণের অ্যাডটায় তো কথা ভুল!

আপনার ইনস্ট্রুমেন্টাল ট্র্যাকটাও দিন তো, ডাউনলোড করব...

অনিকেত এর ছবি

কোন ঠিকানায় দেব কৌস্তুভ'দা?

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি জলে ভাসলাম আবারো !‌‌

আফরিন আহমেদ

অনিকেত এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ আফরিন আহমেদ
শুভেচ্ছা নিরন্তর--

সুমিমা ইয়াসমিন এর ছবি

অন্যরকম ভালো লাগা একটি গান। গুরু গুরু

অনিকেত এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সুমিমা'পু

শুভেচ্ছা অহর্নিশ--

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।