মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?

অভিজিৎ এর ছবি
লিখেছেন অভিজিৎ (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৪/০৯/২০০৮ - ৮:৩৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

auto
ছবিঃ কার্ল মার্ক্স

কার্ল মার্ক্স সম্বন্ধে মনে হয় নতুন কিছু বলার দরকার নাই এই ব্লগে। এই শস্রু-গুম্ফ পরিবেষ্টিত লোকটা উনবিংশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞ। শ্রেণীহীন শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিল একসময় বিশ্বের বহু মুক্তিকামী মানুষকে। মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার তত্ত্ব নিয়ে থেকে সুস্থ আলোচনা আজো তাই প্রাসঙ্গিক বলে এই অধম মনে করে। আর তাছাড়া আজকের এই দিনটি্তে আলেকজান্দার সলঝনেৎসিনের মৃত্যুর এক মাস পুর্তি হল। এই দিনে এই প্রবন্ধটি হয়ত পাঠকদের মাঝে ব্যতিক্রমধর্মী আলোচনার খোরাক যোগাবে।

মার্ক্সের দর্শনে তিনটি সমকালীন ধারণার প্রভাব ছিলো। একটি হচ্ছে হেগেল, কান্ট এবং ফয়েরনেখের জার্মান দর্শন – যা মার্ক্সকে দিয়েছিলো তার দ্বন্দিক বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তি, অন্যটি হচ্ছে উনবিংশ শতকের ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডোর অর্থনৈতিক তত্ত্ব – যা মার্ক্সকে অনুপ্রাণিত করেছিলো তার অর্থনৈতিক তত্ত্ব সাজাতে আর সর্বোপরি ফরাসী বিপ্লবের চিন্তাধারা তাকে দিয়েছিলো তাকে বাৎলে দিয়েছিলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তত্ত্ব নির্মাণের পথ। মার্ক্স বলতেন, 'এতদিন ধরে দার্শনিকেরা পৃথিবীকে কেবল ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল একে পরিবর্তন করা।' মার্ক্স তার জীবদ্দশায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আর্থসামাজিক বিন্যাস লক্ষ্য করেন। এই পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শোষণমূলক এবং মানবতাবিরোধী রূপ দেখে তিনি ব্যথিত হন –আর এ থেকে সাধারণ বঞ্চিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন। তার জীবদ্দশায় পৃথিবীর আর্থ সামাজিক বিন্যাসের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করে মানব ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ভিত্তি খুঁজে নেন, এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের শোষণ মুক্ত সমাজ গঠনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন মার্ক্স। মার্ক্স ধারণা করেছেন, ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একদিকে যেমন শোষিত শ্রেনী নিদারূণভাবে শোষিত এবং নিপিড়ীত হবে, তেমনি তাদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তারা যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে সামিল হবে, আর তাতে তাদের বিজয় হবে অনিবার্য। জনগন প্রবেশ করবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। তিনি মনে করেন এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমগ্র উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানায় পরিচালিত হবে এবং তাই এই উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যে উদ্বৃত্ত মূল্য বা 'সারপ্লাস' ভ্যালু তৈরি হবে, তা সমাজের স্বার্থেই পুনর্বিয়োগ করা হবে। এর পরবর্তী পর্যায়ে 'বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী' সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যা মানব সমাজের সর্বোচ্চ রূপ। কার্ল মার্ক্স তার এই চিন্তাধারাকে প্রয়োগ সম্পর্কিত দর্শন বা 'ফিলোসফি অব প্র্যাক্টিস' বলে চিহ্নিত করেছেন। এই উপলব্ধিটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান বলে অনেকেই মনে করেন। আর সেজন্যই একটা সময় মার্ক্সের ধারণা সারা বিশ্ব জুড়ে অগনিত চিন্তাশীল মানুষকে আকৃষ্ট করেছিলো।

তারপরও কিছু জিনিস আমাদের সবসময়ই মাথায় রাখতে হবে। মার্ক্সের প্রতিটি কথাই কিন্তু অভ্রান্ত নয়। এক সময় তার তত্ত্বের অনুরাগীরা কিন্তু সেভাবেই মার্ক্সকে দেখতেন। তারা ভাবতেন, এই মতবাদ এমন এক ‘সত্যের’ উপর প্রতিষ্ঠিত যা থেকে পদস্খলন কখনোই সম্ভব নয়। ঢালাওভাবে তাঁর সমস্ত বানীকে 'বৈজ্ঞানিক' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো। কিন্তু রাশিয়া, পূর্ব ইউরোপ এবং পরবর্তীতে সারা বিশ্বজুরে কমিউনিস্ট বিশ্বের পতনের পর সে সমস্ত বাণীর অভ্রান্ততা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগেই। পৃথিবী জুরে পুঁজিবাদ বা ধণতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্রের উত্তরোণের যে 'আমূল ভবিষ্যদ্বানী' মার্ক্স করেছিলেন, আজকের বিশ্বের প্রেক্ষাপট বিশ্ল্বেষণে মনে হয় পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি সেভাবে যায়নি। মার্ক্স মনে করেছিলেন যে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনী বুঝি কেবল শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হবে এবং এর ফলে শ্রমিক শ্রেনীর পিঠ 'দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ায়' তারা ধণতান্ত্রিক সিস্টেমের পতন ত্বরান্বিত করবে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু জায়গায় সফলতা এলেও ধনতন্ত্রের পতন হয়নি, বরং বলা যায় ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদি ব্যবস্থা নিজস্ব সিস্টেমের দুর্বলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে বিবর্তিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের 'ওয়েল ফেয়ার স্টেট' গুলো শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে আজ অনেক বেশী মনোযোগী। বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী বা শ্রমিকেরা আজ কোম্পানির স্টক কিনতে পারছে, ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যমে শ্রমিকেরা নিজের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারছে অনেক ভালভাবে - এই পুঁজিবাদী সমাজেই। তারা কিন্তু বিপ্লবের পথে যাচ্ছে না।
auto
ছবিঃ 'দেয়ালে পিঠ' ঠেকে গেলেই যদি বিপ্লব হয়ে যেত, তাহলে বিগত শতকের ত্রিশের দশকে সারা দুনিয়া জুরে অর্থনৈতিক মন্দার সময় কেন পশ্চিমে কেন কোন বিপ্লব হল না?
পুঁজিবাদী শোষণের কারণে 'দেয়ালে পিঠ' ঠেকে গেলে যদি বিপ্লব হয়ে যেত, তাহলে বিগত শতকের ত্রিশের দশকে সারা দুনিয়া জুরে অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ নেমে এসেছিল তখন কেন পশ্চিমে কোন বিপ্লব হল না সে ব্যাপারটি মোটেই বোধগম্য নয়। এরকম উদাহরণ আছে বহু। মার্ক্স তার তত্ত্বে আদর্শবাদী দৃষ্টিকোন থেকে পুঁজিবাদী সমাজের ধংসের ভবিষদ্বানী করেছিলেন, কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে পুঁজিবাদি ব্যবস্থা ধ্বংস না হয়ে যে টিকে গেছে – সেই টিকে থাকার পেছনে 'অন্তর্নিহিত বিবর্তন'টি গোনায় ধরেন নি, কিংবা ধরতে চাননি।

মার্ক্স আরো মনে করেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজে 'ক্লাস পোলারাইজেশন' তীব্র থেকে তীব্রতর হবে এবং শোষক -শোষিতের (মার্ক্সের ভাষায় বুর্জোয়া এবং প্রলেতারিয়েত) মধ্যে শ্রেনীবৈষম্য প্রবলতর হয়ে উঠবে। কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমরা দেখছি, নানান ধরণের সমস্যার শিকার হয়েও সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর ক্রয় ক্ষমতা ও দৈনন্দিন জীবনের মান উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে এবং সর্বোপরি মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে মধ্যবর্তী শ্রেণীভুক্ত মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত আধুনিক বিশ্বের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু সনাতন শ্রমিক এবং কাঁচামালের সংজ্ঞা এবং সম্পর্কই পালটে দিয়েছে। এপ্রসঙ্গে কলকাতার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিক ড. রামকৃষ্ণ মুখার্জির বক্তব্য প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তিনি মনে করেন, ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিশীলিত রূপ গ্রহণ করার ফলে শ্রমশক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ কায়িক শ্রম দানের পরিবর্তে বুদ্ধিজনিত শ্রমদান (মেন্টাল লেবার) করছে এবং তারাই মধ্যবিত্তসূলভ জীবন জাপন করছে। প্রতিবছরই তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে এইচ ওয়ান ভিসায় আমেরিকায় আসছে আজার হাজার 'মেন্টাল লেবারের' দল, যারা তৈরি করেছে এক দৃশ্যমান বলিষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেনী। বলা বাহুল্য, এই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর বুদ্ধিমত্তা ও মানসিকতা আপামোর জনগণের কাছে সাধারণ মানদন্ড হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এবং সমাজে তাদের আধিপত্য বিস্তৃত হবার মধ্য দিয়ে তাদের স্বার্থ অনুযায়ী সামাজিক কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। মার্ক্সের সনাতন ধারণায় সমগ্র উৎপাদিকা শক্তিকে কেবলমাত্র কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমিকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেছিলেন – যা আজকের দুনিয়ার সাপেক্ষে অনেকটাই বাতিলযোগ্য।

এ ছাড়া মনে রাখতে হবে, শুধু শ্রেনীগত কিংবা অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, আজকের দুনিয়ার জটিল সমাজে আরো নানা ধরণের দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত (যেমন, জাতিগত, লৈঙ্গিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় সঙ্ঘাতের কথা বলা যায়) রয়েছে যা পৃথিবীর গতিপথ নির্ধারণে অনেক সময়ই নিয়ামক ভুমিকা পালন করেছে - মার্ক্স সেগুলো তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি, তার তত্ত্বে তিনি শুধু 'ক্লাস কনফ্লিক্ট'কেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। 'কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো' মার্ক্স শুরুই করেছিলেন এই বলে:

The history of all hitherto existing society is the history of class struggle.

শ্রেনী সঙ্ঘাতের উপস্থিতি রয়েছে, প্রবলভাবেই রয়েছে কিন্তু শুধু শ্রেনীগত দ্বন্দ্ব দিয়ে দুনিয়ার সবকিছুকে ব্যখ্যা করাকে আধুনিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এখন 'অতি সরলীকরণ' কিংবা 'অসম্পূর্ণ' বলেই মনে করেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত 'ভারতে শ্রেণীবিভাগের তাৎপর্য' শীর্ষক লেখায় মন্তব্য করেছিলেন,

শ্রেণী ছাড়াও আসলে অসাম্যের অনেক উৎস আছে; অসুবিধা আর বৈষম্যের সমস্ত কিছু কেবলমাত্র শ্রেনী দ্বারাই নির্ধারিত হবে - এই ধারণা ত্যাগ করতে হবে।

auto
ছবিঃ বিজ্ঞানের দার্শনিক কার্ল পপার তার 'ফলসেফায়াবিলিটি' তত্ত্বের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, মার্ক্সিজম এক ধরনের ছদ্মবিজ্ঞান।

এ ছাড়া মার্ক্সের দর্শনের বেশকিছু জায়গায় আছে পরীক্ষণযোগ্যতার অভাব। শ্রেনীহীন সমাজ গড়বার মাধ্যমে স্বপ্ন চিরন্তন আবেগী মানসিকতাকে যতটা তুলে ধরে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণযোগ্যতার মাপকাঠিতে ততটা উত্তীর্ণ হতে পারে কি? বিজ্ঞানের দার্শনিক কার্ল পপার (১৯০২-১৯৯৪) তার 'ফলসেফায়াবিলিটি' বা 'ভুল প্রমাণেয়তা' তত্ত্বের মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, মার্ক্সিজম এক ধরনের ছদ্মবিজ্ঞান (pseudoscience)। পপারের ভাষায় –

বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার অস্তিত্ব ততক্ষণই থাকবে যতক্ষণ তত্ত্বগুলোকে কঠিন প্রায়োগিক পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে চালানো হবে। যখন কোন তত্ত্বকে পরীক্ষণের চেয়ে বরং সুরক্ষিত করে রাখার চেষ্টা করা হয়, তখন বুঝতে হবে এর মধ্যে গলদ রয়েছে।

মার্ক্সের তত্ত্বের বিরুদ্ধে এটি একটি গুরুতর অভিযোগ সবসময়ই। যখন মার্ক্সের অনুরাগীরা দেখলেন পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি মার্ক্সের দেখানো পথে যাচ্ছে না, তখন তাদের দরকার ছিল এই তত্ত্বকে বাতিল করে নতুন তত্ত্বের খোঁজ করা। তা না করে তারা পুরোন তত্ত্বকেই তারা আঁকড়ে ধরে রইলেন, এবং তত্ত্বকে জোড়া তালি দিয়ে একধরণের যথার্থতা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। পপারের মতে এ ধরণের কর্মকান্ড বিজ্ঞানমনস্কতার পরিপন্থি। সত্যি বলতে কি, এ ধরনের মনোভাবই তৈরি করে অন্ধ স্তাবকের এবং একটি তত্ত্বকে ঠেলে দেয় বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞানের দিকে (বিস্তৃত আলোচনার জন্য দেখুন : 'মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান? কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যা'-প্রবন্ধটির ফলসিফিকেশন অংশ)। কার্ল পপার ছাড়াও মার্ক্সের 'লেবার থিওরী অব ভ্যালু'র সমালোচনা রয়েছে একাডেমিয়ায়। আধুনিক অর্থনীতিতে তার তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে 'মার্জিনাল ইউটিলিটি' তত্ত্ব দিয়ে। এছাড়া উইলিয়াম স্ট্যানলি জেভোন, কার্ল মেঞ্জার কিংবা বোম ব্যাওয়ার্কের সমালোচনাগুলো পড়া যেতে পারে।

লুইস ফুয়ের, বার্ট্রান্ড রাসেল, গিবন প্রমুখ দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী, এবং ঐতিহাসিকেরা সময় সময় দেখিয়েছেন মার্ক্সের তত্ত্বের সাথে বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মের সাযুজ্যই বেশী। যে ভাবে কমিউনিজম সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত ঈশ্বর কর্তৃক পরকালে স্বর্গের স্বপ্নময় আবেদনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ধার্মিকরা যেমন কোরান, বেদ, বাইবেল, হাদিস প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের মধ্যে মহাসত্য খুঁজে পান, এবং মুহম্মদ, যীশু এবং অন্যান্য ধর্মপ্রচারকদের বানীকে শিরোধার্য করে রাখেন, এবং তাদের দেখানো পথেই নিজেদের চালিত করতে চান- ঠিক সেভাবেই কমিউনিস্টরা অনেকটা মার্ক্স, লেলিন, স্ট্যালিন, ট্রটস্কি, মাও এবং তাদের লেখা লাল বইগুলোকে দেখতেন। Das Capital ছিল যেন তাদের কোরাণ কিংবা বেদগ্রন্থ আর Communist manifesto তাদের হাদিস; মার্ক্সবাদ ছিল তাদের 'রাষ্ট্র ধর্ম' - 'Opium of the proletariats', যে ব্যবস্থায় পুরোহিতগিরি করেন স্ট্যালিন, মাও, চওসেস্কুর মত 'পয়গম্বরেরা' ! ধর্মের অনুসারীরা যেভাবে নিজ নিজ ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে ঢালাওভাবে বিধর্মীদের উপর অত্যাচার করেছে, ঠিক তেমনি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা এবং বিপ্লবেরর নামেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, গুলাগে প্রেরণ করা হয়েছে অনেক প্রগতিশীল মানুষকে, 'শ্রেনীশত্রু' কিংবা 'পুঁজিবাদের দালালের' তকমা এঁটে নির্যাতন করা হয়েছে কিংবা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদদের নির্যাতন, নির্বাসন, কারাগারে নিক্ষেপ, শ্রমশিবিরে প্রেরণ, মস্তিস্ক ধোলাই ইত্যাদি সেই মধ্যযূগীয় ধর্মের কৃষ্ণ ইতিহাস ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। 'কাফের নিধন', কিংবা 'নির্যবন করো সকল ভুবন'-এর মত 'বুর্জোয়াদের খতম কর' ধ্বনি দিয়ে শ্রেনীহীন সমাজ গড়বার প্রেরণা ছিলো কমিউনিজমের অপরিহার্য শ্লোগান। ক্রুসেড, জ্বিহাদ ধর্মযুদ্ধের মতই ছিলো তাদের এই শ্রেনীসংগ্রামের লড়াই। লেলিনের সময় আমাদের 'র‌্যাব' বা 'রক্ষীবাহিনীর' মত যে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী CHEKA গঠন করা হয়েছিলো, যার ফলশ্রুতিতে ১৯২৩ সালের মধ্যে বলি হয়ছিলো ৫ লক্ষ লোক। এই হত্যা আর নির্যাতন আরো প্রকট আকার ধারণ করে স্ট্যালিনের জামানায়। 'কুলাক' নামে একটি সম্ভ্রান্ত কৃষক শ্রেনীকে 'শ্রেনী শত্রু' হিসবে আখ্যায়িত করে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। এক সন্দেহবাতিকগ্রস্ত প্রবল ক্ষমতাশালী স্বৈরশাসকে পরিনত হন স্ট্যালিন। রাস্তা ঘাট শহর বন্দরের নাম স্ট্যালিনের নামে নামাঙ্কিত করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় গড়ে তোলা হয় বিশাল বিশাল স্ট্যালিনের মূর্তি। চারিদিকে কেবল 'পশ্চিমা চর' আর 'বুর্জোয়া দালাল' খুঁজে ফিরতেন স্ট্যালিন। নিজের সামান্য সমালোচনাও সহ্য করতেন না তিনি। যে কোন জায়গায় কারো ব্যর্থতা মানেই তার কাছে 'বিশ্বাসঘাতকতা'। নির্দয়ভাবে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করতেন তিনি একের পর এক। তার এই সীমাহীন নিপিড়ন, নির্যাতন আর অত্যাচারের সময়টুকু (১৯৩৬-১৯৩৯) আজ ইতিহাসে কলঙ্কিত হয়ে আছে 'দ্য গ্রেট টেরর' (The Great Terror) হিসেবে। একই ধরনের ধর-পাকড়, নির্যতন-নিপীড়ন আর হত্যাকান্ড চলেছিলো চীনে 'চ্যায়ারম্যান মাও' এর শাসনামলেও। পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে (১৯৫৮) তথাকথিত 'গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড' (Great Leap Forward) -এর সময় মাওয়ের নানা ধরনের অপ্রমাণিত এবং অবৈজ্ঞানিক ধ্যান-ধারনা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার শিকার হয়ে চীনের কৃষিক্ষেত্রের বারোটা বেজে যায়। ফলে ১৯৫৯ সালে সারা চীনে শতকরা পনের ভাগ ফসল ঘাটতি দেখা দেয়, ১৯৬০ সালে আরো দশ ভাগ ঘাটতি, ১৯৬১ তেও অবস্থা তথৈবচ। সারা চীন জুরে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। চীনের 'সরকারী হিসেবে'ই দুর্ভিক্ষে মৃত্যু সংখ্যা উল্লেখ করা হয় এক কোটি চল্লিশ লাখ। বেসরকারী হিসেবে দুই কোটি থেকে প্রায় চার কোটির কাছাকাছি বলে বিভিন্ন গবেষোনাপত্রে উল্লেখ করা হয়। সমগ্র মানবেতিহাসেই সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ এটি।
auto
ছবিঃ সাংস্কৃতিক বিপ্লব - চ্যায়ারম্যান মাও এর প্রোপাগান্ডা পোস্টার

লীও শাওকি, দেং জিয়াও পিয়াং, লীন বিয়াও এবং মাওএর স্ত্রী জিয়াং চিং-এর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রাণ হারায় লক্ষ লক্ষ লোক। এই লখো মানুষের মৃত্যুকে মাওয়ের শাসনামলে মহিমান্বিত করা হয়েছিলো 'সাংস্কৃতিক বিপ্লব'-এর ধুঁয়া তুলে। 'Mao: The Unknown Story' নামের সাম্প্রতিক বইয়ে গবেষক জুয়ান চ্যাং এবং জন হ্যালিডে উল্লেখ করেছেন যে, তথাকথিত 'সাংস্কৃতিক বিপ্লবে' মৃত্যুর সংখ্যা সম্ভবত ৩০ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। 'The Black Book of Communism' বইয়ের পরিসংখ্যানে উল্লিখিত হয়েছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়নে ২ কোটি লোক, সাড়ে ৬ কোটি লোক চীনে, ১০ লাখ লোখ ভিয়েতনামে, ২০ লাখ লোক উত্তর কোরিয়ায়, ২০ লাখ লোক কম্বোডিয়ায়, ১০ লাখ লোক পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে, দেড় লাখ লোক পূর্ব ইউরোপে, ১৭ লাখ লোক আফ্রিকায়, ১৫ লাখ লোক আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনামলে নিহত হয়। এছাড়া ক্ষমতার বাইরে থাকা 'সর্বহারা বাহিনী', 'নকশাল' টাইপের দলগুলোর কমিউনিস্ট মুভমেন্টে সাড়া দুনিয়া জুড়ে মারা গেছে অন্ততঃ ১০ হাজার মানুষ। গণহত্যার গবেষক রুমেলের মতে সোভিয়েত রাশিয়া প্রায় ছয় কোটি লোককে কমিউনিজমের নামে হত্যা এবং নির্যাতন করা হয়েছিলো, চীনে ১৯৪৯ সাল থেকে 'সাংস্কৃতিক বিপ্লবের' সময় দশ লক্ষ লোক নিহত হয়েছিল। কম্বোডিয়ায় পলপটের সৈন্যবাহিনীর হাতে চার বছরে নিহত হয় প্রায় বিশ লক্ষ লোক। এ সমস্ত গবেষকের সঠিক সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা যেতে পারে সহজেই কিন্তু তারপরও বলা যায়, একটি 'বৈজ্ঞানিক' সমাজব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য ঢালাওভাবে এত মানুষের প্রাণহানি কেন ঘটাতে হবে সে প্রশ্ন উত্থাপন মোটেই অসমীচীন নয়। আসলে 'কমিউনিজম নিজেই একটি ধর্ম' কিনা ঢালাওভাবে এ বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় এর মধ্যে ধর্মের উপাদান রয়ে গেছে, প্রচ্ছন্নভাবেই। মনবতাবাদী লেখক শফিকুর রহমান তার 'হিউম্যানিজম' (১৯৯৭) গ্রন্থে 'আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়া' শিরোনামে একটি প্রবন্ধ সংকলিত করেছিলেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণের পর ১৯৮২ সালে লিখিত তার এ প্রবন্ধটির কিছু কথা এ প্রসঙ্গে আজও প্রাসংগিক -

মার্ক্সবাদকে ধর্মবিরোধী মতবাদ বলা হলেও ধর্মের যাবতীয় জঘন্য বৈশিষ্টগুলোকে কম্যুনিস্ট দেশগুলো ঠিকই গ্রহণ করেছে। গোঁড়ামি, অসহিষ্ণুতা ও মত বা বিশ্বাসের জন্য বলপ্রয়োগ ধর্মের জঘন্য, নিকৃষ্ট, নিন্দার্হ, অগনতান্ত্রিক ও অমানবিক দিক আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো আজকের হ্রস্বদীর্ঘ ধর্মের চেয়ে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ঢের বেশি রপ্ত করতে পেরেছে। ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গিবন খ্রীস্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠায় খ্রীস্টানদের যে সব ঘৃণ্য বৈশিষ্ট্যগুলো কাজ করেছিলো বলে মনে করেন, তার সবগুলোই কমিউনিস্টরা আয়ত্ব করেছে।

আরো কিছু নমুনা পেশ করা যাক। মার্ক্সিজমের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেলিন উপংহার টেনেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ বা 'ইম্পেরিয়ালিজম' হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজের উপঢৌকন। পুজিবাদী বিশ্ব যে সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি করে না তা নয়, বহুলাংশেই করে (তা না হলে আজকের বুশ-ব্লেয়ারের মত সাম্রাজ্যবাদী দানব তৈরি হল কিভাবে!) কিন্তু, কথা হচ্ছে, মার্ক্সীয় ধারণায় যেমন মনে করা হয়েছে 'স্যোশালিস্ট' দেশ গুলো যেহেতু পুঁজিবাদ থেকে মুক্ত থাকবে, সে বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ থাকবে না।

auto
ছবিঃ চেকোশ্লাভাকিয়ায় ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত বাহিনীর আগ্রাসন
কিন্তু আমরা দেখেছি সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ছিলো পুঁজিবাদী বিশ্বের মতই সমান আগ্রাসী। পোল্যান্ড (১৯৩৯), হাঙ্গেরী (১৯৫৬), চেকোশ্লাভাকিয়া (১৯৬৮), আফগানিস্তান (১৯৭৯)-এর উপর রাশিয়ার নির্লজ্জ আগ্রাসনের ইতিহাস কারো অজানা নয়, অজানা নয় তীব্বতের প্রতি চীনের মনোভাবও। কাজেই সাম্রাজ্যবাদ কেবল পুঁজিবাদী বিশ্বের একচেটিয়া ভাবলে ভুল হবে।

রাশিয়া একসময় জেনেটিক্সের গবেষণায় শীর্ষস্থানে ছিলো, অথচ স্ট্যালিনের আমলে রাশিয়ায় 'জেনেটিক্স' এর উপর গবেষণার লালবাতি কিভাবে জ্বলে গিয়েছিল আমরা তা সবাই আজ জানি। বাম ঘরণার অনেকেই একটা সময় জেনেটিক্স বা বংশগতিকে পাত্তা না দিয়ে কেবল পরিবেশ নির্ণয়বাদকে আদর্শ হিসেবে করতেন, কারণ তা তাদের 'সাম্যবাদের বাণী' প্রচারে সহায়তা করে। আর এ কারণেই মার্ক্স কিংবা তার পরবতী তাত্ত্বিক কমিউনিস্টরা তাদের অনেক বাণীতেই এটাই জোরের সাথে বলেছিলেন যে মানুষের সকল বৈশিষ্ট্যই পরিবেশের ফল, এর সাথে বংশের কোন যোগ নেই। লেলিন এবং তার সমসামিয়ক নেতারা ভাবতেন, সাহিত্য, বিজ্ঞান সব কিছুই ‘মার্ক্সিজমের ছাকুনি'র মধ্য দিয়ে যেতে হবে, নইলে পরিশুদ্ধ হবে না! এ প্রসঙ্গে লেলিনের 'মার্ক্সবাদী' নির্দেশ ছিল -

Literature must become party literature... Down with non partisan literatures! Literature must become the general cause of the proletariat, “a small and a small screw” in the social democratic mechanism, one and individual – a mechanism set in motion by the entire conscious vanguard of the whole working class. Literature must become the integral part of the organized, methodical and unified labors of the Social Democratic Party. (Novaia Jizn, Movember, 1905)

এ নির্দেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়েছে পূর্বতন রাশিয়ার কমিউনিস্ট জামানায়। ধর্মান্ধ এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের মত কমিউনিস্ট রাস্ট্রে সাহিত্যরচনার গৎ বাঁধা ছক বাৎলে দেওয়া হয়েছিলো, এর অন্যথা হলে তাদের 'কমিউনিস্ট ধর্মানুভুতিতে' আঘাত লাগত। 'মুহম্মদ বিড়াল' নিয়ে নির্দোষ কৌতুকেও যেমন ইসলামের অনুসারীদের পিত্তি জ্বলে যায়, তেমনি স্ট্যালিনকে নিয়ে ব্যংগ-বিদ্রুপে কমিউনিস্ট অনুসারীদের গায়ে লাল লাল ফোস্কা পড়তো। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্যাঙ্গাত্মক রচনার জন্য স্ট্যালিনীয় জামানায় সিন্যভস্কি-দানিয়েলের বিচারের প্রহসনে। জেলখানায় সাত বছর বন্দি রাখা হয়েছিলো সিন্যভস্কিকে, দানিয়েলের কপালে জুটেছিলো পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড। সলঝনিৎসনের উপন্যাস 'ফার্স্ট সার্কেল' (First Circle)-এ দেখানো হয়েছিলো কিভাবে উপন্যাসের নায়ক শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিনের শ্রমশিবিরে নিজেকে খুঁজে পায়। সলঝনিৎসনকে সে সময় দেশ ত্যাগ করতে কিংবা নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। আঁদ্রে শাখারভকে গোর্কিতে নির্বাসন দেওয়া হয়। পশ্চিমা বিশ্বে তো প্রতিবাদ হয়েছিলোই এমনকি পূর্ব ইউরোপের খোদ কমিউনিস্ট ব্লকেও সে সময় এ নিয়ে যথেষ্ট সমালোচনা হয়। যেমন, নরওয়েজিয়ান কম্যুনিস্ট পার্টির Friheten পত্রিকায় খ্যাতনামা কমিউনিস্ট মার্টিন নাগ বলেন,

সোভিয়েত রাষ্ট্রের সাহিত্য-শিল্প বোঝার ক্ষমতা নেই। ব্যাঙ্গাত্মক রচনা তারা বোঝে না। শিল্প সাহিত্যের শত্রু স্ট্যালিন এ অবস্থা তৈরি করেছে। সোভিয়েত শিল্প-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের নিকট রাষ্ট্রের দেওয়া স্ট্যাম্প থাকে, তারা শুধু বিভিন্ন স্থানে সে স্ট্যাম্প দিয়ে সিল মারেন। ভবিষ্যতে মুক্ত সোভিয়েত সাহিত্যে সিন্যভস্কির ব্যাঙ্গাত্মক রচনা সম্পুর্ণ আকারে প্রকাশিত হবে।

মার্টিন নাগের ভবিষ্যদ্বানী ফলে গিয়েছে অক্ষরে অক্ষরে। অথচ সে সময় মার্টিন নাগ সমালোচিত হয়েছিলেন ‘কমিউনিজম বিরোধী’ এবং ‘পশ্চিমা দালাল’ অভিধায়।

auto
ছবিঃ লাইসেঙ্কো নামক এক ঠগ বিজ্ঞানীকে স্ট্যালিন প্রমোট করেন বংশগতিবিদ্যাকে ঠেকাতে যা জেনেটিক্সে রাশিয়ার লালবাতি জ্বালিয়ে দেয়।
পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়ায় স্ট্যালিন মার্ক্সসীয় মতবাদের সংগে সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে বংশাণুবিদ্যাকে বিকৃত করতেও পিছপা হননি । এই উদ্দেশ্যে তিনি লাইসেঙ্কো নামক এক ঠগ বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করেন। যখন ভাভিলভ প্রমুখ বিজ্ঞানীরা লাইসেঙ্কোর তত্ত্বের ভুল ধরিয়ে দেন তখন স্ট্যালিন তাদেরকে গুলগে পাঠিয়ে দেন। তারপর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। স্ট্যালিনএর প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে আরো প্রাণ হারান কার্পেচেঙ্কো, সালমোন লেভিট, ম্যাক্স লেভিন, ইস্রায়েল আগলের মত বিজ্ঞানী। শুধু লাইসেঙ্কো নয়, স্ট্যালিন জামানায় লেপিশিঙ্কায়া নামের আরেক ঠগ বিজ্ঞানীকে প্রমোট করা হয়েছিল - সেই 'পুঁজিবাদী' জেনেটিক্স' সরাতে। বিজ্ঞানকে অবশ্যই শ্রমজীবী বা প্রলেতারিয়েতের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, তা নইলে চলবে না- এটাই বিজ্ঞান সম্পর্কে কমিউনিস্টদের 'বৈজ্ঞানিক থিওরী'। আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রদান করার পর, ব্যাপারটা 'মার্ক্সিজমের সাথে সংগতিপূর্ণ' মনে না করায় 'সোভিয়েত এন্সাইক্লোপিডিয়া' প্রকাশ করা হয় রিলেটিভিটিকে 'নস্যাৎ' করে। রাশিয়ার একজন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী দার্শনিক তার তখনকার লেখায় বলেছিলেন -

Einstein’s theory of relativity cannot be considered accepted since it was not accepted by the proletariats.

এই নির্বোধ মন-মানসিকতার প্রতিবাদ করায় পদার্থিবিদ জর্জ গ্যামোকে পালাতে হয়েছিলো রাশিয়া ছেরে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী আঁদ্রে শাখারভ এবং সলঝনিৎসনের কপালেও জুটেছিল স্ট্যালিনীয় জামানার অত্যাচার আর নির্যাতন । পাস্তারনাক 'ডক্টর জিভাগো' রচনা করে ১৯৫৭ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন; স্ট্যালিন চাপ প্রয়োগ করে এই মহান কবিকে দিয়ে স্ট্যালিনের স্তুতি করাতে চেয়েছিলেন। পাস্তারনাক অবশ্য রাজী হননি। স্ট্যালিন বিরোধী ব্যঙ্গ সাহিত্য লেখার 'অপরাধে' সিন্যভস্কি এবং দানিয়েলের মত চিন্তাশীল লেখকদেরকে প্রহসনমূলক বিচারে কারাদন্ড দেওয়া হয় - এ তো আগেই বলেছি।

auto

ছবিঃ স্ট্যালিনের শাসনামলে বহু মানুষকে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প কিংবা কঠিন শ্রম শিবিরে নিয়ে মারা হয়।

লিভ কিতকো এবং পেরেটস মারাকিশকে অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়। ব্রুনো, জাসিনস্কি, আইভান কাতায়েভ, মিখাইল কোলস্তভ, সার্গি ত্রেতায়াকভ, ওসিপ ম্যানদেলস্তম, মেয়েরহোলদ প্রমুখ চিন্তাবিদদেরকে কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প কিংবা কঠিন শ্রম শিবিরে নিয়ে মারা হয়। মিখাইল লেভিদভ, আইজ্যাক নুসিনভ প্রমুখকে গায়েব করে ফেলা হয়। হত্যা করা হয় পোস্তিশেভ, ব্লুচার, কোসিওর, গামারনিক, ইয়াকির, তুখাচেভস্কি প্রমুখ নেতাদের। নির্বাসন দেয়া হয় নিকোলাস বার্দায়েভ, মেসিং, মন্তসেভ, ওলিমনস্কি, স্তেকলভ, স্কভর্তসভ, প্রমুখ ব্যক্তিকে। অলিক গিঞ্জবুর্গকে তিনবার কারারুদ্ধ করা হয়। পিয়তর সাদায়েভকে পাগল হিসবে ঘোষণা করা হয়। গলোমশতক, জোশেনকো, আকমাতোভা, ভ্যালরী তারতিস, ইলিয়াইলভ, এভগেনি পেত্রভ, নাতালি লাস্কোভা, আলেকজান্দার গিনযবুক, ইউরি গালান্সকভ, ভ্যালিন্তিন খ্রোমভ – সকলকেই শাস্তি দেয়া হয়। এই দৃষ্টান্তগুলো আসলে বহুল প্রচারিত 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' শ্লোগানের বিরুদ্ধেই যায় বলে মনে হয়।

'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' কথা বলা হলেও সত্যিকার বিজ্ঞানের সাথে সমাজতন্ত্রের মাত্রাগত পার্থক্যটুকু এ প্রসঙ্গে পরিস্কার না করলে অন্যায় হবে। যে কোন 'ইজম' আসলে বৈজ্ঞানিক সার্বজনীনতার অন্তরায়। একজন পদার্থবিদ কখনোই নিজেকে 'নিউটোনিস্ট' কিংবা 'আইনস্টাইনিস্ট' হিসেবে পরিচিত করেন না। কারণ নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র কিংবা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানেরই অংশ। কাজেই আলাদা করে কারো 'আইনস্টাইনিজম' চর্চা করার কিছু নেই। একই কথা জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও খাটে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ কিংবা মেন্ডেলের বংশগতির তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে এগুলো জীববিজ্ঞানেরই অংশ। সে হিসেবে প্রতিটি জীববিজ্ঞানীই কিন্তু বিবর্তনবাদী। ল্যামার্কের মতবাদ ভুল প্রমাণিত হওয়ার ফলে সেটা জীববিজ্ঞানের অংশ হতে পারেনি, সেটা অপাংক্তেয় হয়ে আছে 'ল্যামার্কিজম' অভিধায় অভিসিক্ত হয়ে। কাজেই সোজা কথায় যে কোন ধরণের 'ইজম' বৈজ্ঞানিক ধারণার পরিপন্থি। অথচ মার্ক্সিজম বা কমিউনিজমে সব কিছু ছাপিয়ে 'ইজম'টাই যেন বড় হয়ে উঠে। একে তো সকল পদার্থবিজ্ঞানীই যেমন 'আইনস্টাইনিস্ট', সেরকম সকল অর্থনীতিবিদদের সবাই যে 'মার্ক্সিস্ট' তা কিন্তু বলা যাবে না। বহু বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ আছেন যারা মার্ক্সিজমকে ভ্রান্ত মনে করেন। কাজেই এটি বৈজ্ঞানিক মতবাদ হিসেবে সার্বজনীনতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি কখনোই। আবার একই মার্ক্সিস্টদের মধ্যেও আমরা দেখি শতভাগ। কেউ লেলিনিস্ট, কেউ স্ট্যালিনিস্ট, কেউ ট্রটস্কিস্ট, কেউবা মাওইস্ট। সবাই যে যার মত নিজেদের আবার 'সত্যিকার মার্ক্সিস্ট' মনে করেন। বাংলাদেশে ভাসানী, ন্যাপ, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, সর্বহারা পার্টি, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি- এরকম নানা নামের বৈধ, অবৈধ কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব রয়েছে। এদের অনেকেই একসময় সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে ঘোট পাকিয়ে শ্রেণীশত্রু মেরেছেন, কখনো ড. হুমায়ুন কবিরের মত বরেণ্য বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করেছেন, কখনো বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে আখ্যায়িত করেছিলেন 'দুই কুকুরের লড়াই' বলে। এমনকি একাত্তরে কোন কোন গ্রুপ পৃথক সায়ত্বসাসিত 'সরকার' গঠণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্তও হয়েছিলেন বলে সাক্ষ্য পাওয়া যায়। তারা এগুলো যখন করছিলেন, তারা মার্ক্সীয় দৃষ্টিভংগীর মাধ্যমেই এগুলো জায়েজ করতেন। পরে যখন তাদের এই সমস্ত গণবিরোধী কর্মকান্ড দিনের আলোয় উঠে এসেছে, তখন তারা সাফাই গেয়েছেন এই বলে – 'মার্ক্সের তত্ত্বে কোন ভুল নেই - এটা স্রেফ পার্টির লাইনগত ভুল'! কিন্তু ইতিমধ্যেই এই লাইনগত ভুলের বলি হয়ে গেছে শত সহস্র নিরপরাধ প্রাণ। 'খতমের লাইনের' কারণে নিঃশেষ হয়েছে অগণিত 'শ্রেনী শত্রু'। অবশ্য সব কমিউনিস্টই যে এই 'খতমের লাইন'কে সব সময় সঠিক মনে করতেন তা নয়, সিপিবির মত কিছু 'মডারেট কমিউনিস্ট' দলের কর্মীদের দেখেছি খতমের লাইনে না গিয়ে বরং গণতান্ত্রিক পথেই আন্দোলন করতেন। এখানেও ধর্মবাদীদের সাথে মিল লক্ষ্যনীয়। চরম্পন্থি ইসলামের অনুসারীরা বিন লাদেনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে 'জিহাদ' হিসেবে আখ্যায়িত করে কোরান হাদিসের আলোকে অনেকেই বৈধতা দেন, আবার অনেক 'মডারেট মুসলিমেরা' এ ধরণের চরমপন্থি কার্যকলাপকে দেখেন ঘৃণার চোখে; বলেন, এদের কর্মকান্ডের সাথে 'শান্তিপূর্ণ ইসলামের' কোনই সম্পর্ক নেই। ধর্মবাদীদের মতই কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যে চরমপন্থি, মডারেটপন্থি, মধ্যপন্থি সব ধরণের অনুসারীই আছেন। এজন্যই ড. ফজলুর রহমান তার 'ইসলাম' (১৯৬৬) গ্রন্থে বহু আগেই বলেছিলেন, 'ইসলাম স্বভাবে কমিউনিজমের মতই'। কথাটা ঘুরিয়ে বলেও সমানভাবেই প্রযোজ্য। আবার এর পাশাপাশি আমরা পেয়েছি 'ধর্মেও আছি জিরাফেও আছি' গোত্রের ঈদ, পুজো, মিলাদে অংশ নেওয়া এবং এগুলোতে বিশ্বাস করা মার্ক্সবাদী। জ্যোতিষীদের রত্নপাথর হাতে পরা, ভুত-ভবান-শয়তান, রাশিফল, উদৃষ্টে বিশ্বাসী মার্ক্সবাদীরাও সংখ্যায় বিরল নয়। এদের অনেকেই গণেশের দুধ খাওয়া নিয়ে সারা ভারতে গণহিস্টেরিয়ার সময় বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার পক্ষে না থেকে বরং গনেশের অলৌকিকতার সাফাই গেয়েছেন। এদেরই একাংশ মুসলিমদের ভোটব্যাংক অক্ষুন্ন রাখতে তসলিমা নাসরীনের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। এগুলো সবই আবার তারা করেছেন মার্ক্সবাদের দোহাই দিয়ে- 'দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে' সমাজ বিশ্লেষণ করে। কাজেই, এদের তত্ত্ব এবং কর্মকান্ড আসলেই কতটুকু 'বৈজ্ঞানিক' তা সঠিক বিশ্লেষণের দাবী রাখে।
auto
আলেকজান্দার সলঝনেৎসিনের মার্ক্সবাদ এবং সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে কয়েকটি লাইন খুবই প্রণিধানযোগ্য -

Marxism, a primitive superficial economic theory, is not only inaccurate, not only unscientific, has not only failed to predict a single event in terms of figures, quantities, time-scales or locations (something that modern economic theory with complex mathematical model using computers today do with laughable ease in the course of social forecasting although never with the help of Marxism) -is absolutely astounds one by economic and mechanistic crudity of its attempts to explain the most subtle of creatures, the human beings, and that even more complex synthesis of millions of people of the society. Only the cupidity of some, the blindness of others, and a craving of faith on the part of still others can serve to explain this grim humor of the twentieth century.

এই সেই সলঝেনিৎসিন - সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার যে তথাকথিত 'বৈজ্ঞানিক' শ্রেনী সাম্যের মহত্ব তার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। সুদীর্ঘ বিশটি বছর তিনি অতিবাহিত করেছিলেন স্টালিনের বানানো 'গুলাগে'- দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের সমাধি ক্ষেত্র। জেল, শ্রম শিবির, নির্বাসন, নির্যাতন কোন কিছুই তাঁর জীবনে বাদ পড়েনি। ১৯৭০ সালে তিনি নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন, কিন্তু তাকে নোবেল পুরস্কার গ্রহন করতে দেয়া হয়নি বরং তাকে দেশ থেকে নির্বাসিত হয়। এর পর দীর্ঘদিন তিনি রাশিয়ায় ফিরতে পারেননি। ফিরতে পেরেছিলেন 'কমিউনিস্ট জামানার' পতনের পর ১৯৯৪ সালে। সলঝেনিৎসিনকে নিয়ে সুবিনয় মুস্তফীর একটি চমৎকার পোস্ট আছে সচলায়তনে। (সলঝেনিৎসিন মারা গেছেন গত তেসরা আগাস্ট। আজকের প্রবন্ধটি সলঝেনিৎসিনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত)।

এত কিছুর পরও, মার্ক্সবাদের তাৎপর্য এখনো অনেকের কাছেই প্রাসংগিক। সনাতন মার্ক্সবাদের পরবর্তী মার্ক্সবাদীরা, যেমন - গ্রামস্কি, এলথুজার কিংবা দেরিদা যে সমস্ত পোস্ট মডার্নিস্ট ব্যাখ্যা হাজির করেছেন সেগূলো আমাদের জানা প্রয়োজন। এ ছাড়া ভুলে গেলে চলবে না যে, সমগ্র তৃতীয় বিশ্ব সহ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে যে সমস্ত মানুষ মুক্তিসংগ্রামে সামিল, তাদের অনেকের কাছেই মার্ক্সবাদ এখনো আলোকবর্তিকা। সম্প্রতি নেপালে মাওবাদীরা যেভাবে দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্রকে উতখাৎ করেছে তা অনেক মার্ক্সিস্টকেই উদ্দীপ্ত করেছে। যুগে যুগে সেই উদ্দীপনা এবং সতত শোষণ মুক্তির আকাঙ্খাকে আমাদের কারো পক্ষেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। সাম্যবাদ আর শোষন মুক্তির স্বপ্ন মানুষের মজ্জাগত। তাই মার্ক্সের বহু আগে গ্রীক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের লেখায় আমরা সাম্যবাদের উল্লেখ দেখি। সাম্যবাদের উল্লেখ আর মানব মিলন আর শোষনমুক্তির স্বপ্ন আছে যীশুখ্রীষ্ট, চার্বাক, বুদ্ধ, সেইন্ট সিমন, চৈতন্য আর বিবেকানন্দের অনেক বানীতেই। সেই একই স্বপ্ন আছে মার্ক্সবাদেও। সেই চিরন্তন মুক্তির স্পৃহা, আকাঙ্খা, আর তা বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ 'কমরেড' রা অবশ্যই আমাদের নমস্য। কিন্তু এটাও তো ঠিক 'শোষন মুক্তি'র স্বপ্ন আর 'মহান বিপ্লবের' মাহাত্ম্যকে পুঁজি করে এই কমরেডরাই যখন ক্ষমতায় গেছে তারা নিজেরাই বনে গেছে একেকজন 'প্রতিবিপ্লবী'। তাদের রচিত ব্যবস্থায় তথাকথিত 'সর্বহারাদের শাসন' বলবৎ হয়নি, বরং বলবৎ হয়েছে এক পার্টির একনায়কতন্ত্র, রাষ্ট্র পরিণত হয়েছে 'পার্টি স্টেটে'। পার্টির লিডাররাই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে সর্বেসর্বা। তাদের মতের বিপরীতে গেলেই করেছেন খুন, হত্যা আর নির্যাতন। জর্জ বার্ণারড শ সেজন্যই বোধহয় বলেছেন -

Revolutions have never lightened the burden of tyranny; they have shifted it to another shoulder.

নিরঙ্কুশ ক্ষমতা যে শেষ পর্যন্ত নিরঙ্কুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়, তা পুঁজিবাদী, সাম্যবাদী - সব সমাজের জন্যই বোধ হয় খাটে। সেজন্যই এত আদর্শ আর শোষণ মুক্তির কথা বলবার পরও কমিউনিস্ট বিশ্ব থেকেই যুগে যুগে পয়দা হয় স্ট্যালিন, পলপট কিংবা চওসেস্কুর মত নির্দয় স্বৈরশাসকের কিংবা দুর্নীতিবাজের।

তবে আমাদের মত আদার ব্যাপারীদের জন্য তাহলে তাত্ত্বিক সমাধানটা কি? বাংলাদেশের মানুষ কি তবে 'এশিয়া এনার্জি'র মত রক্তপিপাসু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানির ক্রীড়নক হয়ে রইবে? ইলা মিত্রের মত মহীয়সী নারী এক সময় সংগ্রাম করেছেন তেভাগা আন্দোলনে। আমরা জানি ময়মন সিংহের হাজং বিদ্রোহের কথা, তেলেঙ্গনা বিপ্লবের কথা, কাক-দ্বীপ-সোনাপুর-ভাংগরের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস। ব্রিটিশ ভারতবর্ষে সন্ন্যাস বিদ্রোহ (১৭৬৩-১৮০০), বারানসী বিদ্রোহ (১৭৮১), ওহাবী বিদ্রোহ (১৮২৪-১৮৭০), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৬-১৮৫৮), নীল বিদ্রোহ (১৮৫৯-৬১), মোপলা বিদ্রোহ (১৮৭৩-১৯২১), পাবনার কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭০ ও ১৮৮০), দাক্ষিনাত্যের কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৫), মাদ্রাজের রূম্পা বিদ্রোহ (১৮৭৮-৮৯), উরিষ্যার খোন্দ বিদ্রোহ (১৮৬২-৯৪), বীরসা ভগবানের নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৯৫-১৯০০) প্রভৃতি ঔপনিবেশিকতাবিরোধি বিদ্রোহে বরাবরই সাধারণ মুক্তিকামী মানুষেরা আশার আলো খুঁজে পেয়েছে শ্রেনী সংগ্রামের মধ্যে। প্রতিটি বিদ্রোহই ছিল সামন্ততন্ত্র বিরোধী, ঔপনিবেসিকতা বিরোধী, এবং সর্বোপরি ব্রিটিশ শাসন বিরোধী। ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল এ সমস্ত বিদ্রোহ। ব্রিটিশ শাসকেরা এবং তাদের তল্পিবাহক পুলিশেরা নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে এ বিদ্রোহগুলো দমন করার প্রয়াস পায়। তারপরও কৃষক, আদিবাসী এবং জনগণ আবারো বিদ্রোহ করেছে, আবারো পরাস্ত হয়েছে, তারপর আবারো নিজেদের সংগঠিত করে ফুঁসে উঠেছে পুনর্বার। সাঁওতাল বিদ্রোহের মহান নেতা কানুকে ইংরেজ ঔপনিবেসিকরা ফাঁসি দেয় ১৮৫৬ সালের ২৩ এ ফেব্রুয়ারী। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কানু নির্ভিক চিত্তে ঘোষণা করেছিলেন –

আমি আবার আসব, আবার সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব।

কানুরা যে বার বার ফিরে আসে ব্রিটিশদের তাতে কোনই সন্দেহ ছিল না। কখনো এরা আসে তীতুমীর, কখনো গিরিজন, কখনো ক্ষুদিরাম, কখনো যতীন মুখার্জি, কখনো বা আসে সূর্যসেন কখনো বা তারকেশ্বরের রূপ ধরে। চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পর ধৃত মাস্টারদা সূর্যসেন ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারী কানুর মতই ঠিক একইভাবে বিপ্লবী সংগীত গেয়ে হাসিমুখে উঠে গিয়েছিলেন ফাঁসির মঞ্চে – পুর্ণতা দিয়েছহিলেন কানুর বলে যাওয়া – ‘আমি আবার আসবো, আবার সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব’ নামের অমর মহাকাব্যের। এভাবেই বিদ্রোহী ভারতবর্ষ প্রতিটি যুগে, প্রতিটি শতাব্দীতে স্বপ্ন দেখেছে শোষন মুক্তির, সোচ্চার হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে, নিশান উড়িয়েছে স্বাধীনতার। এমনকি অতি সাম্প্রতিক সময়েও আমরা দেখেছি ফুলবাড়ি বা কানসাটে প্রান্তিক মানুষেরা কিভাবে ফুঁসে উঠেছিলো। মার্ক্সবাদ সবময়ই তাদের কাছে এক ধরনের আলোকবর্তিকা। যে সমস্ত সমাজব্যবস্থায় শ্রেনী বৈষম্য এবং শ্রেনী নিপিড়ন বিদ্যমান সে সমস্ত ব্যবস্থায় মার্ক্সের শিক্ষা এবং তত্ত্ব যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ তা নিঃসংশয়ে বলা যায়। আমার প্রবন্ধের উপসংহার আসলে সেই অবস্থান থেকেই। আমি মনে করি ‘বৈজ্ঞানিক’ নয় বরং আধুনিক মানবতাবাদী দৃষ্টিকোন থেকেই আজকের দিনে মার্ক্সিজমের গুরুত্ব এবং আরোপযোগ্যতা বিবেচনা করা উচিৎ। কারণ সমাজতন্ত্রের অবস্থান এশিয়া এনার্জর মত রক্তপিপাসু মুনাফালোভী বহুজাতিক কোম্পানির হীন উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধে এখনো প্রচন্ড ভাবেই মানবিক – অন্ততঃ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে তো বটেই। এটাকে অস্বীকার করা বোকামী। পোস্ট মডার্নিস্ট মার্ক্সিস্ট দেরিদা তার Specters of Marx (1994) বইয়ে বলেন, তিনি মার্ক্সের তত্ত্ব নয়, মার্ক্সিজমের এই মুক্তিকামী ‘স্পিরিট’টিকে তিনি সমর্থন করেন।
auto
ছবিঃ দেরিদা মার্ক্সিজমকে 'সায়েণ্টিফিক সিস্টেম' থেকে আলাদা করে 'মরাল সিস্টেমে' এর প্রয়োগ চান।
তিনি মার্ক্সিজমকে বিজ্ঞান নয়, বরং 'লিঙ্ক অব এফিনিটি, সাফারিং এন্ড হোপ' হিসবে এখন দেখতে চান। অনেকটা স্টিফেন জে গুল্ড যেমন দর্শনে 'স্বতন্ত্র বলয়' প্রবর্তন করে ধর্মকে বিজ্ঞান থেকে আলাদা রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, ঠিক তেমনি, দেরিদা মার্ক্সিজমকে 'সায়েণ্টিফিক সিস্টেম' থেকে আলাদা করে ‘মরাল সিস্টেমে’ এর প্রয়োগ চান। তিনি মনে করেন আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে তার এই প্রস্তাবনা মার্ক্সিস্টদের মেনে নেওয়া উচিৎ। মার্ক্সবাদ সম্পর্কে আমার দার্শনিক অবস্থানও অনেকটা দেরিদার মতই। মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞান হবার তার দরকারও নেই। কিন্তু মার্ক্সবাদ থাকুক হাজারো নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ে মুক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে।

ডিসক্লেমার - আমার 'মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?' প্রবন্ধটি 'Is Marxism Scientific?' - এই শিরোনামের বাংলা হিসবে পড়তে অনুরোধ করছি। শুরুতে এর বাংলা করেছিলাম - 'মার্ক্সবাদ কি বৈজ্ঞানিক?'। কিন্তু বাংলায় বৈজ্ঞানিক শব্দটা অনেক সময় 'বিজ্ঞানী' অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাই বদলে শিরোনাম করেছি - 'মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?', কিন্তু প্রবন্ধে মূল সুরটি 'সায়েন্টিফিক' হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।


আপডেট- সচলায়তনের এই ব্লগটি বহু মন্তব্য এবং উত্তর প্রত্যুত্তরের কারণে দীর্ঘ হয়ে গেছে। আপলোড হতে অনাবশ্যক দেরী হয়। লেখাটির একটি কপি মুক্তমনা ওয়েবসাইটে রাখা আছে। মুক্তমনা থেকে লেখাটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে

এ লেখাটির কিছু দিক আরো বিস্তৃত করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করেছি পরবর্তীতে, তাই এর কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাখ্যা হাজির করেছি। এ ব্যাখ্যাগুলো দেওয়া হয়েছে নীচে উল্লিখিত প্রথম লিঙ্কটিতে। এছাড়া, এ লেখাটির জন্য প্রশংসার পাশাপাশি বামপন্থি ব্লগারদের কাছ থেকে কিছু সমালোচনাও পেয়েছি বিভিন্ন জায়গায়, যেগুলোর উত্তর আমি দিয়েছি নীচের শেষ লিঙ্কটিতে-


মন্তব্য

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

প্রিয় অভিজিৎ, অসম্ভব শ্রমসাধ্য এবং প্রয়োজনীয় লেখাটার জন্য ধণ্যবাদ। ছোট-খাট মন্তব্য দিয়ে লেখাটা মূল্যায়ণ করা সম্ভব নয়। সম্ভব হলে স্বতন্ত্র-বিস্তারিত পোস্ট দেবার চেষ্টা করব।

===============================
তোমার সঞ্চয় দিনান্তে নিশান্তে পথে ফেলে যেতে হয়


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

অভিজিৎ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। আমি অবশ্যই চাইবো আপনি এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করুন। সেটা এখানে হতে পারে, হতে পারে স্বতন্ত্র পোস্টে। আপনার আলোচনার অপেক্ষায় রইলাম।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

গৌতম এর ছবি

ষষ্ঠ পাণ্ডবের সাথে একমত।
.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

ব্লগস্পট ব্লগ ::: ফেসবুক

.............................................
আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল - জীবনানন্দ দাশ

অভিজিৎ এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

মাহবুব লীলেন এর ছবি

ভয়ানক পরিশ্রমী একটা লেখার জন্য ধন্যবাদ

আমি কার্ল মার্ক্স্ সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে দুই ভাগ করে দেখি
এক. মার্ক্সীয় কনসেপ্ট
দুই. মার্ক্সবাদী শাসন ব্যবস্থা

মার্ক্সীয় কনসেপ্ট

দর্শন কিংবা বিজ্ঞান বলার চেয়ে মার্ক্সবাদকে আমি একটা কনসেপ্ট হিসেবেই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করি
এবং কনসেপ্টটা নিয়ে আলাপের সময় কয়েকটা জিনিস অবশ্যই মাথায় রাখি। তা হলো

কনসেপ্টটা মার্ক্স কোনো 'কী হওয়া উচিত' মডেলকে সামনে রেখে তৈরি করেননি বরং 'কী হওয়া উচিত না' মডেলগুলোকে বিশ্লেষণ করে ' কী হওয়া উচিত' মডেল সাজেস্ট করেছেন কিংবা পথ বাতলেছেন

০২

মার্ক্স রাজনীতিবিদ ছিলেন না ছিলেন রাজনীতি বিশ্লেষক
ফলে লিখিত আকারে উল্লেখযোগ্য নয় এমন অনেক কিছুই তার নজর এড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল সব সময়ই
বিশেষ করে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সংশ্লিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিষয়গুলো

০৩

তাত্ত্বিক হিসেবে ব্যক্তিগত অপছন্দনীয় অপ্রিয় বাস্তবতাগুলো তার গাইড লাইন কিংবা রোডম্যাপ থেকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা বাদ দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এড়িয়ে দেয়া যায় না তার কনসেপ্ট থেকে
(এসব ক্ষেত্রে উদাররা 'পরে দেখা যাবে' কিংবা 'সময়ে দেখা যাবে' জাতীয় সান্ত্বনাবাক্য ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু সচেতনভাব্ই এড়িয়ে যান)

০৪

মার্ক্স তার কনসেপ্টটার ফিল্ড টেস্টের পরে কোনো রিভিউর সুযোগ পাননি। ফলে তার দিক থেকে মাক্সবাদটা পুরোটাই রয়ে গেছে একটা হাইপোথিসিস
যা বাস্তবায়নযোগ্য বলে তিনি মনে করতেন
কিন্তু আমরা এটাও জানি যে তিনি যেখানে তার তত্ত্ব বাস্তবায়ন হবে বলে মনে করেছিলেন সেখানে এখনও সেই তত্ত্ব বাস্তবায়ন হয়নি

হয়েছে অন্য জায়গায়

০৫

ফিলোসফি এবং বিজ্ঞানের মূল স্টেটমেন্টটা হয় - 'সত্য পাওয়া গেছে' সুতরাং এই সত্য 'অবশ্য মান্য' কিংবা 'অবশ্য পালনীয়'

ফলে যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনো ফিলোসফি কিংবা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে অন্য কোনো ফিলোসফি কিংবা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বাতিল কিংবা চ্যালেঞ্জ না করছে ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্বতন তত্ত্বগুলো সম্পূর্ণভাবে 'অবশ্যমান্য এবং অবশ্য পালনীয়' আকারেই বিবেচিত হয়

আর ফিলোসফি কিংবা বৈজ্ঞানিক কেনো তত্ত্বকে মতামত দিয়ে দিয়ে বাতিল করার কোনো সুযোগ নেই
এগুলোকে বাতিল করতে হলে কিংবা চ্যালেঞ্জ করতে হলে এর বিপক্ষে দাঁড় করাতে হয় আরেকটা তত্ত্ব
আর যতদিন পর্যন্ত না কোনো চ্যালেঞ্জিং তত্ত্ব কেউ দাঁড় করাতে পারছে ততদিন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্বতন তত্ত্বকেই ধরে নিতে হয় সত্য সঠিক এবং অবশ্য মান্য তত্ত্ব হিসেবে

মার্ক্সবাদকে দর্শন কিংবা বিজ্ঞান বললে এই বিপত্তিটাতে পড়তে হয় সবার
এবং এ পর্যন্ত সবগুলো বিপত্তির মূলই হলো মার্ক্সবাদকে দর্শন এবং বিজ্ঞান হিসেবে ধরে নিয়ে 'অবশ্য পালনীয়' পর্যায়ে গণ্য করা

কিন্তু মার্ক্স মূলত কী করেছেন?
তিনি পূর্বতন এবং তার সমসাময়ীক চিন্তা ও অবস্থাকে বিশ্লেষণ করে কিছু সমীকরণ দাঁড় করিয়েছেন এবং একটা 'আদর্শ মার্ক্সবাদ অবস্থা' কল্পনা করেছেন
তার সেই কল্পনাতে সেই বস্তুগুলোই পক্ষ কিংবা বিপক্ষ ইলিমেন্ট হিসেবে উপস্থিত ছিল যা তার সময়ে এবং তার পূর্ববর্তী সময়ে বর্তমান ছিল
(অনেকটা স্বর্গের বিভিন্ন উপাদানের মতো। যে প্রফেটের দেশে যে জিনিস সবচে ছিল না তার বর্ণিত স্বর্গেও সেই জিনিস নেই)

০৬

দার্শনিক হিসেবে এবং তাত্ত্বকে হিসেবে তার কনসেপ্টকে তিনি অবশ্যই তার মতো করে উপসংহারে নিয়ে গেছেন
তার দিক থেকে ওটা ছিল তার কল্পনা কিংবা সমীকরণ কিংবা হাইপোথিসিসের চূড়ান্ত কিংবা পরিপূর্ণ রূপ
অথবা বলা যায় শেষ বিন্দু

কিন্তু তার যেখানে শেষ সেখানেই তো আর মানবজাতির শেষ না

মানব জাতির অনেক কিছুরই শুরু মার্ক্সের শেষ বিন্দুরও পরে থেকে
যেখানে মার্ক্স ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আর অগ্রসর হতে পারেননি

সমস্যাটা এখানেই তৈরি হয়
যখন মার্ক্সের দিক থেকে শেষ হয়ে যাওয়া মার্ক্সকে ক্রম অগ্রসরমান মানবজাতি এবং মানবজাতির সমস্যার ক্ষেত্রেও চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করার প্রবণতা দেখা যায়

এবং এটাকে কনসেপ্ট না ভেবে দর্শন কিংবা বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করে সাধারণ মতামত ও সাধারণ এডজাস্টমেন্টের উর্দ্ধে গণ্য করা হয়

তখনই এটা হয়ে উঠে আরেকটা ধর্ম
কিংবা ধর্মীয় রীতি

মার্ক্সবাদী শাসন ব্যবস্থা

পৃথিবীর কোথাও মার্ক্সবাদী শাসন ব্যবস্থার সাথে মার্ক্স নিজে যুক্ত ছিলেন না
(কোথাও কি মার্ক্সবাদী শাসন হয়েছে?)

রাশিয়ার লেনিনবাদী চীনের মাওবাদী কিংবা কিউবার ক্যাস্ত্রোবাদী শাসন কতটুকু মার্ক্সবাদী আর কতটুকু ট্রাডিশনাল শাসন?

মার্ক্সবাদী শাসন ব্যবস্থাগুলো শাসনকার্যের জন্য যতটুকু না মর্ক্সকে অনুসরণ করেছে তার থেকে বেশি অনুসরণ করেছে পূর্বতন বিশ্ব শাসন ঐতিহ্যকে

লংকায় গিয়ে মূলত সবাই-ই হয়ে উঠেছে একেকটা অভিন্ন রাবণ
শুধু তাদের পোশাক আর চেহারা হয়তো ভিন্ন
হয়তো কিছু কিছু ভিন্ন তাদের কৌশল

০২

খলিফা হারুনুর রশীদের শাসনের সাথে স্ট্যালিনের শাসনের মৌলিক পার্থক্য কী?
কিংবা কমিউনিস্ট স্ট্যালিনের শাসনের সাথে মুসলিম আইয়ুব খানের শাসনের পার্থ্ক্য কী?

কার শাসন ব্যবস্থায় প্রজাদের (শ্রমিক/জনগণ...) মার কম খাওয়ার সুযোগ ছিল?
কিংবা কী পার্থক্য ছিল স্ট্যালিনের সাথে ইরানের আয়াতুল্লা খামেনির?

মানুষ কতটুকু স্বাধীন ছিল?
কতটুকু পথ ছিল পিঠ বাঁচানোর?

০৩

বিভিন্ন তত্ত্বের কারণে ভিন্ন ভিন্ন দেশের অবস্থার উন্নয়নে হয়তো তারতম্য দেখা যায় কিন্তু প্রজাশাসন ব্যবস্থা (জনগণের অধিকার। শাসক-জনগণ সম্পর্ক) আদৌ কোনো পরিবর্তন হয় বলে আমার মনে হয় না

অন্তত মার্ক্সবাদী দেশগুলো তার উদাহরণ হতে পারে না

তাহলে মার্ক্সবাদের প্রয়োগ কিংবা প্রয়োজনীয়তা গিয়ে কোন জায়গায় দাঁড়াল?
বঞ্চিত মানুষের ভাগ্যে মার্ক্সবাদ কী অবদান রাখল?

০৪

তানজানিয়াতে জোসেফ নায়ারে উজামা নামে একটা তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন
উজামা ছিল মার্ক্সবাদরে তানজানিয়ান কিংবা আফ্রিকান ভার্সন

তাজনাজিনয়াতে দরিদ্র ব্যক্তি কিংবা ধনী ব্যক্তি কিংবা শোষক ব্যক্তি শোষিত ব্যক্তি বলতে কিছু নেই
ওখানে আছে ধনী পরিবার- দরিদ্র পরিবার- শোষক পরিবার শোষিত পরিবার

কারণ তানজানিয়াতে সম্পদের মালিক ব্যক্তি না পরিবার
নায়ারে মার্ক্সের ব্যক্তি ও ব্যক্তির মধ্যে সংঘাত ও সম্পর্ককে পরিবার-পরিবার সংঘাত ও সম্পর্কে রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন

তিনি সেখানকার শাসক ছিলেন
হয়তো শাসন ব্যবস্থায় তিনি মার্ক্সীয় কনসেপ্টকে প্রয়োগ করতে পারতেন

কিন্তু তিনি বেশিদূর আগাতে পারেননি
আমাদেরও জানা হয়নি মার্ক্সের কনস্টেকে শাসন ব্যবস্থায় ঢাললে কী রকম চেহারা দেখায়

০৫

মার্ক্সবাদের বর্তমান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে মার্ক্সের সময়ের শ্রম- শ্রমিক- শোষণ- শোষক আর শোষিতের ধরন আকাশ পাতাল পাল্টে যাওয়া

এখন ব্যক্তি ব্যক্তিকে যতটা না শোষণ করে তার থেকে বেশি করে একটা দেশ আরেকটা দেশকে
এখন শোষিত ব্যক্তির চেয়ে বরং প্রকট হলো শোষিত দেশ কিংবা জাতি
কার্ল্ মার্ক্স সরাসরিভাবে এইখানে নেই

০৬

বর্তমানের শ্রমিকদেরকে কিন্তু কেউ চাবুক পেটা করে কাজ করায় না
কেউ তার উপর খবরদারীও করে না

বর্তমান ব্যবস্থায় শ্রমিক নিজেই তার প্রশাসক
সে একই সঙ্গে শোষকপক্ষ এবং শোষিতপক্ষ
কর্পোরেট ব্যবস্থা কাউকে জোরশ্রম করায় না
বরং প্রসেসটা এমনভাবে তৈরি করে যে শ্রমিক আর শ্রম ছেড়ে উঠে যেতে পারে না

শ্রমিক চাইলেই তার বিলাস কিনতে পারে
কর্পোরেট ব্যবস্থা অধিকারগুলোকে সুযোগে রূপান্তরিত করে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়
কিন্তু সেই সুযোগ পেতে হলে তোমাকে বিনিময় করতে হবে শ্রম

কিন্তু তোমাকে কেউ শ্রম দিতে বলবে না

এই পদ্ধতিতে কর্পোরেট সিস্টেম সবচে বেশি যে কাজটা করে তা হলো প্রতিটা ব্যক্তিকে একা করে দেয়া
ভোগ একা একাই হয় সবচে ভালো
আবার অন্যদিকে একা একা রাগ দেখানো যায় কিন্তু বিপ্লব করা যায় না....

০৭

তাহলে মার্ক্সবাদের অবস্থানটা কোথায় গিযে দাঁড়াল?
বাতিল?

না

মার্ক্সবাদের মূল হাইপোথিসিসটা কিন্তু বাতিলও না কিংবা বর্জনীয়ও না
সবার জন্য মিনিমাম কিছু ব্যবস্থার নিশ্চয়তা
(এই অর্থে ওয়েলফেয়ার দেশগুলোই কিন্তু মৌলিক মার্ক্সবাদী)

এই ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দায়িত্ব একেকটা দেশের পলিসি মেকার এবং শাসকদের

এবং এক্ষেত্রে শাসন ব্যবস্থা মার্ক্সবাদী হওয়ার কোনো দরকার নেই
দরকার শাসন এবং পালনের দৃষ্টিভঙ্গি

০৮

তবে এই মুহূর্তে মার্ক্সবাদকে বিশ্লেষণ কিংবা গ্রহণ বর্জনের ক্ষেত্রে সবার আগে যেটা করা দরকার তা হলো
রাশিয়া চীন কিউবাকে মার্ক্সবাদ থেকে আলাদা রেখে তাকে বিচার করা

০০০০০০০০০০০০

হাবিজাবি অনেক কথা বোধহয় বলে ফেললাম

আপনার বিশ্লেষণটা সত্যিই অসাধারণ

অভিজিৎ এর ছবি

'ভয়ানক পরিশ্রমী' কমেন্টের জন্য আপ্নাকেও ধন্যবাদ। হাসি যা বলার আপনার কমেন্টেই বলে দিয়েছেন,আমার আর কিছু বল্বার নেই। আপনি ঠিকি বলেছেন -

মার্ক্সবাদকে দর্শন কিংবা বিজ্ঞান বললে এই বিপত্তিটাতে পড়তে হয় সবার
এবং এ পর্যন্ত সবগুলো বিপত্তির মূলই হলো মার্ক্সবাদকে দর্শন এবং বিজ্ঞান হিসেবে ধরে নিয়ে 'অবশ্য পালনীয়' পর্যায়ে গণ্য করা

ঠিক কথা। সে দিক থেকে দেরিদোর এপ্রোচটা আমার কাছে অনেক গ্রহনীয়। তিনি মার্ক্সিজমের এই মুক্তিকামী ‘স্পিরিট’টিকে সমর্থন করেন, কিন্তু তত্ত্বটিকে বিজ্ঞান বলে মনে করেন না। আর সব কিছু বিজ্ঞান হইতেই হইবো ক্যান?



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আর সব কিছু বিজ্ঞান হইতেই হইবো ক্যান?

ধর্মগ্রন্থ ও তো নিজেকে 'বিজ্ঞানময়' দাবী করে । এই জায়গাতেই বোধ করি বিজ্ঞান এগিয়ে থাকে, তার নিজেকে ধর্ম কিংবা দর্শন দিয়ে সার্টিফায়েড হতে হয়না ।
-------------------------------------
"শিয়রের কাছে কেনো এতো নীল জল? "

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অভিজিৎ এর ছবি

হ্যা, ঠিক কথা। বিজ্ঞানের কারো কাছে দারস্থ হতে হয় না। উলটে ধর্মগ্রন্থ, জ্যোতিষশাস্ত্র, কমিউনিজম... সবাই নিজেকে বিজ্ঞানময় প্রমাণ করতে চায়। কারণ 'বিজ্ঞানময়' ব্যাপারটা 'ওজনদার'। হাসি



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

হিমু এর ছবি

"দেরিদো" নয়, আপনি সম্ভবত দেরিদা-র কথা বলতে চাইছেন। নাকি ভুল বুঝলাম?


হাঁটুপানির জলদস্যু

অভিজিৎ এর ছবি

অরিজিনাল ফ্রেঞ্চ প্রোনান্সিয়েশনটা নিয়ে আমি কনফিউজড। হ্যা, বাংলায় দেরিদাই মিন করেছি। আমার লেখাটা্র বানাও পরিবর্তন করলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

হিমু এর ছবি

JACQUES DERRIDA। এই ফরাসী J এর জন্যে বর্ণ বাংলায় নেই। উচ্চারণটা জ আর তালব্য শ মিশ্রিত। আর যে র-টা আছে, সেটার উচ্চারণ হ্র এর মতো অনেকটা। বলা যেতে পারে ঝাক দেহ্রিদা। আইপিএ অনুযায়ী উচ্চারণটা এমন

[ʒak dɛʁida]

তবে ফরাসীতে A কখনোই "ও" উচ্চারিত হয় না। AU, AUX, ... এমনটা থাকলে ও আর ঔয়ের মাঝামাঝি কিছু উচ্চারণ হয়ে থাকে। A এর উচ্চারণ দ্রুত বা বিলম্বিত হতে পারে বড়জোর।

গায়ে পড়ে এই বানান নিয়ে ক্যাচাল করার উদ্দেশ্য একটাই, গুগলে কেউ দেরিদা লিখে সার্চ করলে আপনার লেখা খুঁজে পেতো না। এখন হয়তো পাবে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

অভিজিৎ এর ছবি

ঝাক দেহ্রিদা।... হুমম। ফ্রেঞ্চটা শেখা উচিৎ ছিলো। আপনার সব্যসাচীপনায় আমি বরাবরের মতই মুগ্ধ। ভাগ্যিস 'বানান নিয়ে ক্যাচালটা' করছিলেন। ধন্যবাদ আপনাকে আরেকটিবার।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

হাসান মোরশেদ এর ছবি

তানজানিয়াতে জোসেফ নায়ারে উজামা নামে একটা তত্ত্ব দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন
উজামা ছিল মার্ক্সবাদরে তানজানিয়ান কিংবা আফ্রিকান ভার্সন

শেখ মুজিবের 'বাকশাল' ধারনা জোসেফ নায়ারে থেকে প্রভাবিত- শুনেছিলাম ।
-------------------------------------
"শিয়রের কাছে কেনো এতো নীল জল? "

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অভিজিৎ এর ছবি

আরেকটা কথা ...লেখাটা একটু বড় হইয়া গেছে মনে হয়। কি কি কারণে মার্ক্সবাদরে আমি বিজ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত মনেকরি না,তার একটা সারাংশ দিলে ভাল হইত মনে হয়।

তয় তার আগে সুমন চৌধুরী,ফারুক ওয়াসিফ কিংবা সুবিনয় মুস্তাকী- যারা এ ধরনের বিষয়ে আগে লিখেছেন, তাদের মতামত পেলেভাল লাগত। মাহবুব লীলেন তার মতামত দিয়ে সত্যই আমার অনেক উপকার করেছেন।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

আমি এতক্ষণে বিরাট একটা কমেন্ট লিখে আঙুলের ভুল চাপে হারিয়ে ফেললাম, কেউ জানেন কীভাবে ওটা ফেরত পেতে পারি? জানলে দ্রুত জানান।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

অভিজিৎ এর ছবি

ম্যাসেজটা পোস্ট না করে দিলে এতক্ষনে CTRL + Z চাপতে বলতাম।
এখন পোস্টের পর আর কিছু করার নাই মনে হয়। মডুদের জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর সবচেয়ে ভাল হয় কষ্ট করে আরেকটি বার টাইপ করে ফেললে। হাসি



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

দেবোত্তম দাশ এর ছবি

এতো সুগভীর লেখা, মন্তব্য নিস্প্রয়োজন
------------------------------------------------------
স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছি বলেই আজো বেঁচে আছি

------------------------------------------------------
হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন’রা কি কখনো ফিরে আসে !

সবজান্তা এর ছবি

মার্ক্সবাদ সম্পর্কে আমার তর্ক কিংবা আলোচনা কিংবা মন্তব্য করার মত জ্ঞান নেই। আপাতত শুধুই পড়ছি আর জানছি।

ধন্যবাদ অভিজিৎদাকে বিপুল পরিশ্রম করে এতো ওজনদার, তথ্যবহুল লেখাটা লিখে ফেলবার জন্য।


অলমিতি বিস্তারেণ

স্নিগ্ধা এর ছবি

অভি - মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান হতে যাবে কেন? মার্ক্সবাদ একটা দর্শন, একটা এ্যানালিটিকাল ফ্রেইমওয়ার্ক - কিন্তু তত্ত্ব নয়। যে হিসাবে একটা তত্ত্বের পরীক্ষিত হওয়ার ক্ষমতা বা প্রেডিক্টেবিলিটি দেখা হয়, তাতে মার্ক্সবাদকে আঁটানোর চেষ্টা করলে অবশ্যই মার্ক্সবাদ সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারবে না। এটা কখনোই বিজ্ঞান ছিলো না, হওয়ার কথাও ছিলোনা - মার্ক্সবাদীরা যত কায়মনোবাক্যেই এর প্রতিটা স্টেপ মেনে চলে থাকুন না কেন।

আর 'বিজ্ঞান' বললেই সাধারণতঃ যে খুব একটা ধ্রুব/মীমাংসিত/নিরপেক্ষ সত্যের কথা মনে হয়, পোস্টমডার্নিস্ট, ডিকন্সট্রাক্সনিস্টরা সেটাকেই বার বার চ্যালেঞ্জ করে দেখিয়েছেন যে 'ধ্রুব সত্য' বলে কিছু নেই - সবকিছুই আপেক্ষিক। আসলে, এমনকি, এই কথাটাও আপেক্ষিক! বিজ্ঞানের কিছু সত্য বা তত্ত্ব অবশ্যই ধ্রুব - পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান এবং আরো ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সোশাল সায়েন্সের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞান, কি অর্থনীতি এগুলো কিন্তু বারবারই আগেকার প্যারাডাইম বদলে, কিংবা বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপট নতুন করে পর্যালোচনা করে নতুন 'সত্যে' উপণীত হয়। একসময় মনে করা হতো, একজন র‌্যাশনাল কনযিউমার তার অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে সর্বোচ্চ ইউটিলিটি নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে, এবং সেটাই হবে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রধাণ মাপকাঠি। এখন, অনেক 'সামাজিক' ভ্যারিয়েবল ও ওই সমীকরণে যোগ করা হচ্ছে, কারণ দেখা গেছে পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব, পার্থিব বা মেটেরিয়ালিস্টিক প্রভাবের চাইতে খুব কম নয়। আর বিজ্ঞানের সবচাইতে বড় অপকর্ম বোধহয় একসময়ের বহুল প্রচারিত আর ইদানিং তৃতীয় বিশ্বে পাচারকৃত সব পেস্টিসাইড। আর জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড হরমোন দেয়া খাবারের কথা আর কি বলবো! সবসময়ই জ্ঞান এবং ক্ষমতা হাতে হাত ধরে চলে!

মার্ক্সবাদ নামক দর্শনে অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞানের যে আঙ্গিকগুলো ছিলো সেগুলোকে একেবারে 'আক্ষরিকভাবে' বাস্তবায়নের নাম করে একনায়কতন্ত্র চালানোর খুব সুবিধা আছে, কারণ দর্শনটার ভিত্তি খুব মানবিক। কিন্তু দেরিদা, ফুকো, চ্যাটার্জি, কি ভাবা - আমার মনে হয় না আজকে এদের কেউই মার্ক্সবাদকে একটা থিওরি বা এমনকি ইম্পলিমেন্ন্টেশনাল টুল হিসেবে দেখে। বরং মার্ক্সবাদে যেমন ঐ সময়ের এক্সিস্টিং প্যারাডাইম - অর্থাৎ পূঁজিবাদকে, চ্যালেঞ্জ করে একটা অল্টারনেট দর্শন বা দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেছিলো, এখনকার মার্ক্সবাদকেও সেরকম একটা মূলধারার বাইরে চিন্তা করার সহায়ক হিসেবে দেখা উচিত।

মার্ক্সবাদের মূল কথা এখনো শ্রেনী সচেতনতা, কিন্তু শ্রেনী সংগ্রাম বোধহয় আর নেই। যেহেতু যে কোন সমাজব্যবস্থায় শ্রেণীবৈষম্য আছে, অতএব শ্রেণীগত এ্যাডভান্টেজ বা ডিযএ্যাডভান্টেজ নিয়ে সচেতন হওয়াটা যে কোন বিশ্লেষণের জন্যই খুব জরুরী (আমার মতে), অতএব মার্ক্সবাদের প্রয়োজনীয়তা সেদিক থেকে দেখতে গেলে চিরকালীন।

এটাকে তাই শুধু মানবিক স্পিরিট হিসেবে দেখতে পারছি না। সেভাবে দেখতে গেলে অচিরেই মার্ক্সবাদ 'এককালের সাড়া জাগানো কিন্তু বর্তমানে অবসলিট' দর্শন হিসাবে যাদুঘরে ঠাঁই পাবে। এটার প্রয়োজনীয়তা এখনো আছে - চিন্তার অবকাঠামো হিসাবে, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিত হিসাবে।

বন্যা এর ছবি

আর 'বিজ্ঞান' বললেই সাধারণতঃ যে খুব একটা ধ্রুব/মীমাংসিত/নিরপেক্ষ সত্যের কথা মনে হয়, পোস্টমডার্নিস্ট, ডিকন্সট্রাক্সনিস্টরা সেটাকেই বার বার চ্যালেঞ্জ করে দেখিয়েছেন যে 'ধ্রুব সত্য' বলে কিছু নেই - সবকিছুই আপেক্ষিক। আসলে, এমনকি, এই কথাটাও আপেক্ষিক! বিজ্ঞানের কিছু সত্য বা তত্ত্ব অবশ্যই ধ্রুব - পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান এবং আরো ইত্যাদি ইত্যাদি।

স্নিগ্ধা, বিজ্ঞানেও কিন্তু ধ্রুব সত্য বলে কিছু নেই, পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান ... কোথায় নয়। বিজ্ঞানের সব কিছুই ফলসিফায়াবল, তুই যদি এখন এসে প্রমাণ করতে পারিস যে পৃথিবী ফ্ল্যট, তাহলে কোপার্নিকাস এর ভুতকেও সেটা মেনে নিতে হবে। আর একটা জিনিষ আমি কখনই বুঝি না যে, সমাজ বিজ্ঞানকে কেন বিজ্ঞান বলা হয়। যাই হোক সে আলোচনা না হয় পরে করা যাবে।
আর বিজ্ঞানের সবচাইতে বড় অপকর্ম বোধহয় একসময়ের বহুল প্রচারিত আর ইদানিং তৃতীয় বিশ্বে পাচারকৃত সব পেস্টিসাইড। আর জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড হরমোন দেয়া খাবারের কথা আর কি বলবো! সবসময়ই জ্ঞান এবং ক্ষমতা হাতে হাত ধরে চলে!

পেস্টিসাইড পাচার করাটা কিভাবে বিজ্ঞান হয় তাও ঠিক বুঝলাম না কিন্তু। এই পেস্টিসাইড বানানোটা হচ্ছে বিজ্ঞানের একটা আপ্লাইড দিক ছাড়া আর কিছু নয়, আর তা কোথায় পাঠানো হবে সেটা তো একেবারেই বাজারগত দিক যার সাথে কিছু রাজনৈতিক দিক থলে্লেও থাকতে পারে। বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানের প্রয়োগ এ দুটো বোধ হয় আলাদা করা দরকার।
মার্ক্সবাদের মূল কথা এখনো শ্রেনী সচেতনতা, কিন্তু শ্রেনী সংগ্রাম বোধহয় আর নেই।

তুই কি আসলেই বলতে চাইছিলি যে শ্রেনী সংগ্রাম আর নেই? নাকি আমি ভুল বুঝলাম। তোর পরের কথাটাই কিন্তু অন্যরকম শোনাচ্ছে।

স্নিগ্ধা এর ছবি

পেস্টইসাইড পাচার করাটা কেন বিজ্ঞান হতে যাবে, 'বৈজ্ঞানিক' রিসার্চের বরাত দিয়ে ওইসব পেস্টিসাইডের ব্যবহারের যৌক্তিকতা দেখানো হয়, কত উপকারী সেটা প্রমাণ সহ হাজির করা হয়। বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানের প্রয়োগ কখনো আলাদা করা যাবে কিনা সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে, তার কারণ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা যেখান থেকে আসবে বিজ্ঞানের প্রয়োগও সেখানকার নীতিমালা মেনে চলবে - অন্ততঃ বহুলাংশে তো বটেই।
আর যে যুক্তিতে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানের প্রয়োগ আলাদা করা দরকার সেই যুক্তিতে তো মার্ক্সবাদ আর মার্ক্সবাদের প্রয়োগকেও আলাদা করে দেখা দরকার।

আমি মনে করি না, এখন 'শ্রেনীসংগ্রাম' বা মার্ক্সের যেটা class struggle, সেটার মাধ্যমে কোন বিপ্লব বা বদল আসার সম্ভাবনা আছে। প্রত্যক্ষ 'শ্রেনীসংগ্রাম' অল্প কয়েকটা জায়গা ছাড়া আর কোথাও আছে কি? আর পরোক্ষ ভাবে শ্রেনীসংগ্রামের যে ভিত্তি, অর্থাৎ শ্রেনীসচেতনতা, সেটা অন্য ব্যাপার, সেটার দরকার আছে। এই দুটা জিনিষ আলাদা। তাহলে আমার পরের কথায় কনফ্লিক্ট মনে হচ্ছে কেন বুঝলাম না?

বিজ্ঞানের সংজ্ঞা উইকিপিডিয়া অনুযায়ী - Science is the effort to discover, and increase human understanding of how the physical world works. Through controlled methods, scientists use observable physical evidence of natural phenomena to collect data, and analyze this information to explain what and how things work. Such methods include experimentation that tries to simulate natural phenomena under controlled conditions and thought experiments. Knowledge in science is gained through research.
Contents

তাহলে, সমাজবিজ্ঞান বিজ্ঞান না হবে কেন?? উপরের সবগুলা শর্তই তো পূরণ হচ্ছে?

বন্যা এর ছবি

- সমাজ বিজ্ঞান বিজ্ঞান কিনা এটা নিতান্তই তোকে ক্ষেপানোর জন্য বলসিলাম।
- তুই নীচে অভির উত্তরে যেভাবে পেস্টিসাইডের ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলি তা তে আমার কোন আসুবিধা নাই। বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের প্রয়োগ অবশ্যই আলাদা। বিজ্ঞান ব্যাবহার করে বোমা বানানো যেতে পারে, কিন্তু তা কোথায় ফেলা হবে সেটা রাজনৈতিক এবং এখনকার বিশ্ব-বাজারনীতির উপর নির্ভর করে, বিজ্ঞানের উপর না।

আর যে যুক্তিতে বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানের প্রয়োগ আলাদা করা দরকার সেই যুক্তিতে তো মার্ক্সবাদ আর মার্ক্সবাদের প্রয়োগকেও আলাদা করে দেখা দরকার।

অবশ্যই, মার্ক্সবাদ আর মার্ক্সবাদের প্রয়োগ তো আলাদাই। আমি এক্ষেত্রে অভির লেখার সাথে আসলে দ্বিমত পোষণ করি, বাসায় এটা নিয়ে তর্ক করতে করতে হাপায় গেছি, তাই আর ব্লগে তর্ক করলাম না অভির সাথে ঃ)। আর মার্ক্সবাদকে মার্ক্স নিজে বিজ্ঞান বলে গেছেন কিনা সেটা নিয়েও আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। দ্বান্দিক বস্তুবাদের মত বৈজ্ঞানীক তথ্যের উপর ভিত্তি করে মার্ক্সবাদ লেখা হয়েছে এটা বলা এক কথা আর পুরো তত্ত্বটাই 'বিজ্ঞান' কিনা সেটা বলা আরেক কথা।
- আরেকটা কথা তোকে বলতে চাচ্ছিলাম যে, আমি আসলে সরাসরি যুদ্ধে যেয়ে সংগ্রামটাকেই শুধু শ্রেনী সংগ্রাম হিসেবে দেখি না। কালকে বোয়িং এর কর্মচারীরা স্ট্রাইক ঘোষনা করেছে, কিংবা ধর আমাদের দেশের গার্মেন্টসের শ্রমিকরা যখন আন্দোলন করে বেতন বাড়াবার জন্য, কানসাট এ যখন গণ-অভ্যুত্থান হয়... এসবই শ্রেনী সংগ্রাম। এই সমাজে শ্রেনী সংগ্রাম অনবরতই চলছে। আর অভি যেভাবে বলছে যে মার্ক্সিজমে শ্রেনী-সংগ্রাম ছাড়া আর কিছুকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, এটাও ঠিক নয়, জেন্ডার ডিস্ক্রমিনেশান, স্বাধীণতা সংগ্রাম, ইত্যাদি অনেক কিছুকেই মার্ক্সবাদে ফ্যাক্টর হিসেবে ধরা হয়েছে।
যাউকগা, এখন ভাগি আমি, তোর সাথে পরে ফোনে বাকি ঝগড়াটা সারুম নে...

স্নিগ্ধা এর ছবি

যাউকগা, এখন ভাগি আমি, তোর সাথে পরে ফোনে বাকি ঝগড়াটা সারুম নে...

যা ভাগ্‌, মাফ করে দিলাম ...... রেগে টং

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের প্রয়োগ অবশ্যই আলাদা।

অনেক কাল আগে আমি আমার এক বামপন্থি বন্ধুর সঙ্গে তর্কে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম এই পয়েন্টে যে, মার্কসবাদকে বিজ্ঞানের সার্টিফিকেট না নিলেও চলবে, কারণ বিজ্ঞান নিজেই কোনো শ্রেণী বা ভ্রান্তি নিরপেক্ষ জ্ঞান নয়। বৈজ্ঞানিক ধারণা নিজেই পরিবর্তনশীল এবং তার এই পরিবর্তনশীলতায় দেশ-কাল ও পাত্র তথা শ্রেণীগত মতাদর্শের প্রভাব থাকে। সামন্ত যুগে বিজ্ঞানের দর্শন সামন্তবাদ প্রভাবিত ছিল, বুর্জোয়া যুগের বিজ্ঞানে বুর্জোয়া মতবাদ ও স্বার্থের প্রভাব থাকবে, তা তো স্বাভাবিক ব্যাপার।
যেমন ধরেন, বিজ্ঞান একাধারে প্রকৃতির নিয়ম আবিষ্কারের প্রচেষ্টা হতে গিয়ে এখন প্রকৃতি বিরোধী জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। এতে ধরেই নেয়া হয় প্রকৃতির বিরোধিতা করে প্রকৃতিকে পরাজিত করাই বিজ্ঞানের লক্ষ্য। এটা যে ভুল, প্রকৃতির প্রতিশোধে আজ তা প্রমাণিত হয়েছে। আজকের চিকিতসা বিজ্ঞান রোগের কারণ দূর করার থেকে রোগের প্রতিষেধকের দিকেই বেশি ব্যস্ত, প্রযুক্তিগুলো এমনভাবে গড়ে উঠছে যাতে তা বৈষম্য বজায় রাখে এবং পণ্যায়নে সুবিধা দেয়। এগুলো বিজ্ঞানের ব্যবহার বলতে পারেন আবার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে বর্তমান অবস্থায় রেখে এর বিপরীত ব্যবহার কিন্তু সম্ভব নয়। যেমন ধরেন, আজকে মানুষের দুর্দশা মুক্তির প্রযুক্তির থেকে দুর্দশা বাড়ানোর (সমরাস্ত্র, বিকৃত ভোগের উপকরণ, ব্যক্তিগত ভোগের সরঞ্জাম, মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বায়োকেমিক্যাল উপকরণের ছড়াছড়ি ইত্যাদি) পথেই বিজ্ঞান গিয়েছে। এটা বৈজ্ঞানিক সূত্রের সমস্যা নয়, তার ব্যবহারের সমস্যা ঠিক। কিন্তু যারা আজ বিজ্ঞানের এ ধরনের ব্যবহার করে, তাদের হাত থেকে বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলিকে মুক্ত করা না গেলে বিজ্ঞানের ধ্বংসাত্মক ব্যবহার কমবে কীভাবে?
হিটলার পদার্থবিদ্যা ও জেনেটিকসে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। এ দুইয়ের বিকাশ ঘটেছিল নাৎসি বিজ্ঞানীদের হাতে। জেনেটিকস থেকে তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, আর্যরাই বিশুদ্ধ মানবজাত। এও দেখাতে চেয়েছিলেন যে, জিনবিদ্যা ব্যবহার করে উন্নত মানবজাত সৃষ্টি সম্ভব। এই মতবাদের নাম ইউজেনিক্স। রকফেলার পরিবার অদ্যাবধি এর পৃষ্ঠাপোষক। তারা হিটলারকেও বিপুল সহযোগিতা করেছিল। আজে আমেরিকাতেও অন্যান্য দিক বাদ দিয়ে পদার্থবিদ্যা ও জেনেটিক্স-এর প্রসার বেশি হওয়ার কারণ মার্কিন শাসকদের বিজ্ঞান সম্পর্কে খণ্ডিত ধারণা। এ দিক থেকে নাতসিদের সঙ্গে মার্কিনেদের অনেক মিল।
অন্যদিকে, ধরে নেয়া হয় বিজ্ঞান সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক। কোয়ান্টাম ফিজিসিস্টরা দার্শনিক পাসকালের মত করে দেখিয়েছেন পর্যবেক্ষকের অবস্থান অনুযায়ী কোয়ান্টামের নড়াচড়া পাল্টে যায়। আবার পাসকাল তার গণিত বিষয়ক সূত্রে দেখিয়েছেন, সত্য মানব চেতনা নিরপেক্ষ নয়। কারণ গণিতে ধ্রুবকের উপস্থিতি ছাড়া সত্য মেলে না। ওই ধ্রুব হলো মানবীয় চৈতন্য। সুতরাং বিজ্ঞানের বিশুদ্ধ নৈর্ব্যক্তিকতার দাবি তাহলে ধোপে টেকে না।

এহেন বিজ্ঞান দিয়ে দর্শনকে কেন পরীক্ষা দিতে হবে? বিজ্হান ও দর্শন যেখানে সহযাত্রী সেখানে তত্ত্বের মধ্যে একটা ভারসাম্য আনা সম্ভব। নইলে অনেক বৈজ্ঞানিক থিওরি ভাববাদকেই সমর্থন যোগাতে পারে, যেমন কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে অনেকে তা করতে চাইছেন। বরং বিজ্ঞান ও দর্শনের দ্বান্দ্বিক ঐক্য ও বিরোধের মধ্যে দিয়েই আপাত সত্যের যাচাই সম্ভব। সেক্ষেত্রে আমি স্নিগ্ধার মতের সঙ্গে শতভাগ একমত।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

অভিজিৎ এর ছবি

স্নিগ্ধা, তোমার এই মন্তব্যের উত্তর দেই নাই আগে। তোমার লাস্ট দুই প্যারা একটু কন্ট্রাডিক্ট করছে। তুমি শেষ প্যারায় বলেছ,

শুধু মানবিক স্পিরিট হিসেবে (মার্ক্সবাদকে) দেখতে পারছি না।

অথচ এর আগের প্যারাতেই কিন্তু আভাস দিয়েছ কিভাবে মার্ক্সবাদকে দেখো-

মার্ক্সবাদের মূল কথা এখনো শ্রেনী সচেতনতা, কিন্তু শ্রেনী সংগ্রাম বোধহয় আর নেই। যেহেতু যে কোন সমাজব্যবস্থায় শ্রেণীবৈষম্য আছে, অতএব শ্রেণীগত এ্যাডভান্টেজ বা ডিযএ্যাডভান্টেজ নিয়ে সচেতন হওয়াটা যে কোন বিশ্লেষণের জন্যই খুব জরুরী ...

শ্রেনি সংগ্রাম বাদ দিলে মার্ক্সবাদের আর রইলোটা কি? হাসি আমি বুঝতে পারি, ফারুক ওয়াসিফ কেন আপত্তি করেছেন তোমার মন্তব্যে। চিন্তা করে দেখো, শ্রেনীসংগ্রাম বাদ দিয়ে ...শ্রেণীগত এ্যাডভান্টেজ বা ডিযএ্যাডভান্টেজ নিয়ে সচেতন হওয়াটা ... কিন্তু অনেকটা মানবিক অধিকার সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখা, তাই না?। দেরিদার থিসিসটা সেখান থেকেই এসেছে - 'Marxism as an ethical programme' - অধিকার সচেতন হওয়া, দুঃস্থ, নিপীড়িতদের পাশে এসে দাঁড়ানো। আমার মনে হয় দেরিদার - মার্ক্সিজমের এই শিফিট - সায়েন্টিফিক সিস্টেম থেকে মরাল সিস্টেমে - ব্যাপারটা চিন্তা করার মতই । দেখো - মার্ক্সিজমের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব, আবেদন কোনটাই কিন্তু অস্বীকার করা হচ্ছে না এতে - কেবল বলা হচ্ছে জিনিসটাকে বিজ্ঞান বানিয়ে ফেলো না বাবা।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

স্নিগ্ধা এর ছবি

শ্রেনি সংগ্রাম বাদ দিলে মার্ক্সবাদের আর রইলোটা কি? হাসি আমি বুঝতে পারি, ফারুক ওয়াসিফ কেন আপত্তি করেছেন তোমার মন্তব্যে। চিন্তা করে দেখো, শ্রেনীসংগ্রাম বাদ দিয়ে ...শ্রেণীগত এ্যাডভান্টেজ বা ডিযএ্যাডভান্টেজ নিয়ে সচেতন হওয়াটা ... কিন্তু অনেকটা মানবিক অধিকার সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখা, তাই না?।

অভি, ফারুক ওয়াসিফ আর পি মুনশীকে লেখা আমার মন্তব্যগুলো পড়ে দেখো, ওখানে এই কথাগুলারই উত্তর দেয়া আছে। এটা মানবিক অধিকারের ব্যাপার না, এটা চিন্তার/বিশ্লেষনের একটা বিশেষ পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া। হাসি

অভিজিৎ এর ছবি

পড়লাম। তয় মনে হচ্ছে তোমার 'চিন্তার/বিশ্লেষনের একটা বিশেষ পদ্ধতি'টার কোন আলাদা নাম নেই, পোস্টমডার্নিস্ট মার্ক্সিজমেরই যাষ্ট একটা রূপ। শ্রেণীগত এ্যাডভান্টেজ বা ডিযএ্যাডভান্টেজ নিয়ে সচেতন হওয়াটা থেকেই কিন্তু পরের ধাপে (দেরিদার) যাওয়া যায়। সচতন না হইলে অধিকার নিয়ে কাজ করবা কেমনে! আমগো তর্কটাও অনেকটাই semantics নিয়েই মনে হইতেছে। মার্ক্সিজমকে বাতিল করা হইতেছে না, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দেয়া হইছে।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

স্নিগ্ধা এর ছবি

পড়লাম। তয় মনে হচ্ছে তোমার 'চিন্তার/বিশ্লেষনের একটা বিশেষ পদ্ধতি'টার কোন আলাদা নাম নেই, পোস্টমডার্নিস্ট মার্ক্সিজমেরই যাষ্ট একটা রূপ।

বুঝি নাই ...

শ্রেণীগত এ্যাডভান্টেজ বা ডিযএ্যাডভান্টেজ নিয়ে সচেতন হওয়াটা থেকেই কিন্তু পরের ধাপে (দেরিদার) যাওয়া যায়।

পরের ধাপ - দেরিদা মানে কি? দেরিদা মার্ক্সিজমের পরের ধাপ, এটা বলতে চাচ্ছো? সেটা কিন্তু না।

আমগো তর্কটাও অনেকটাই semantics নিয়েই মনে হইতেছে।

উহু - এটা semantics নিয়ে না, conceptualization নিয়ে হাসি

মার্ক্সিজমকে বাতিল করা হইতেছে না,

ঠিক, ঠিক - একদম ঠিক! হাসি

অভিজিৎ এর ছবি

কি বুঝলা না তাই বুঝতাম না। আমি কইতাছি, তোমার 'শ্রেনি সচেতনতার' বিশ্লেষন পোস্ট মডার্নিস্ট মার্ক্সিজমেই আছে। ফ্রাঙ্কফুট স্কুলের পোলাপাইনগুলা অনেক আগেই এই বিশ্লেষণটা হাজির করছে। দেরিদা শুধু সচেতন হওয়া পর্যন্ত গিয়ে থাইমা যায় নাই, এথিকাল আর মরাল সিস্টেমে প্রয়োগের কথা কইছে। হেইটাই কইবার চাইছিলাম।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

কোনোভাবেই কমেন্ট করতে পারছি না কেন? দেখায় ইন্টারনাল এরর। এটা যদি যায়, তাহলে আমার আস্ত কমেন্টটা যাচ্ছে না কেন?

(বিশেষ ব্যবস্থায় মডু কর্তৃক সংযোজিত হইল):

এই শেষ চেষ্টা। এটা না গেলে মার্কসবাদের ভবিষ্যত আপনাদের জিম্মাতেই রেখে বাড়ি যেতে হবে। নইলে যার জিম্মাদারিতে থাকি, তিনি ঝ্যাঁটাহস্তেন সংস্থিতা হবেন। আপাতত যা বলার তা আবার সংক্ষপেই বলছি।

১. মার্কসবাদ বিজ্ঞান হতে যাবে কোন দুঃখে। বিজ্ঞান বলে কি কোনো অভ্রান্ত অপরিবর্তনীয় জিনিষ আছে? আছে একটা পদ্ধতি যা দিয়ে আমরা জগত সম্পর্কে এবং বিভিন্ন বিষয়ের জ্ঞান অর্জন করতে পারি। খেয়াল করবেন আমি ‘সত্য’ বলিনি। এবং বিভিন্ন যুগে বিজ্ঞান বিভিন্ন পর্যায় পার করে গ্রিকদের হাতে, আরবদের হাতে, ভারতীয়দের হাতে এবং ইউরোপীয়দের হাতে। এমনকি আদিম সমাজেরও সামান্য আকারের বৈজ্ঞানিক বোধ রয়েছে। আবার তেমনি আজকের বুর্জোয়ারা যেভাবে বৈজ্ঞানিক ধারণার আদল নির্মাণ করছে পরের যুগ হয়তো এর অনেকটাই বাতিল করে সারাংশটা রা করবে। দর্শনের মতো বিজ্ঞানও শ্রেণী নিরপেক্ষ মানবীয় চেতনা নিরপেক্ষ বিষয় নয়।

মার্কসবাদ প্রথমত একটা দর্শন। যার মধ্যে বহু তত্ত্ব, মতাদর্শ এবং বৈজ্ঞানিক ধারণার সমবায় রয়েছে। এই দর্শনকে অবলম্বন করে রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজত্ত্ব মায় বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপ সম্ভব। এটা বললাম থিওরেটিক্যালি। প্র্যাক্টিক্যালি ভাল মন্দ দু ধরনের উদাহরণই পাওয়া যাবে। দর্শনের অর্থ জগতবীক্ষা। মার্কসবাদ একটা জগতবীক্ষা। মানি বা মানি এটা তাই দর্শন। হতে পারে তা ভুল, তা অন্য আলোচনা।

২. মার্কস দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য নয়, সেসময় নবীন উত্থিন বিপ্লবী শ্রেণী এবং তাদের পুঁজির সম্ভাবনাকে বিকশিত করে তিনি কমিউনিজমে মানবমুক্তির পথরেখা দেখাতে গিয়েছেন। এবং সেটা পুঁজিকে গালি দিয়ে নয়, তার গতিপ্রকৃতি ও স্বভাবের বিশ্লেষণ করে। সেকারণে পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম এরকম কোনো জীব ও জড় মার্কা পার্থক্যের বৈপরীত্যের থেকে কমিউনিজমকে পুঁজির দ্বন্দ্বের লজিক্যাল কনসিকোয়েন্স হিসেবে দেখা হয়েছে। মোটেই এর সঙ্গে নৈতিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই দেরিদা মার্কসবাদের জন্য নৈতিকতার যে কোটারি ঠিক করেছেন সেটা সঠিক নয়। চমস্কি এক জায়গায় দেরিদার এইসব তত্ত্বাগুচ্ছ অফ গ্রামাটোলজি ইত্যাদিকে এককথায় ফালতু বলেছিলেন। যদিও আমার মত তা নয়। ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসার মার্কসবাদকে বিজ্ঞান বলার কাছাকাছি গিয়েছিলেন, তবে একেবারেই ভিন্ন ভাবে। আর কার্ল পপার কিন্তু আজ পশ্চিমা একাডেমিয়াতেও তেমন গণ্য হন না, তাঁর চিন্তার দূর্বলতার কারণে। এরকম আরেকজন মার্কসবাদের ঘোরতর সমালোচক হলেন ভারতীয় ভাববাদী স্যার রাধাকৃষ্ণন। এঁরা দুজনই নতুন ভাবে ভাববাদের চাষাবাদে নেমেছিলেন, কিন্তু পালে বাতাস পাননি। দেরিদা এই কাজটি শক্তির সঙ্গে করেছেন। তিনি যেভাবে ভাষার কাঠামোকেই মানবীয় কাঠামোর সার ধরেছেন, খেয়াল করে দেখেছেন তা আসলে আরেকভাবে নিরাকারের সাধনা। কর্মকাণ্ডময় বস্তবিশ্বকে আমি ভাষাসর্বস্বতায় রিডিউস করে আনায় রাজি নই। কারণ এ নিছক ঊনিশ শতকীয় ভাববাদেরই নতুন আবির্ভাব।

৩. মার্কস পুঁজির মধ্যে বিরাট গতি দেখেছিলেন আবার একইসঙ্গে ব্যক্তিমালিকানার কারণে তার মধ্যে বিকৃতি ও অবিকাশও দেখেছিলেন। পুঁজি গোটা সমাজকে উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে নিয়ে আসে, যেমন কারখানা, দোকান, বাজার, বিনোদন, প্রার্থণাত্রে, খেলার মাঠ ইত্যাদি সবই পুঁজির আওতায় এসে পুঁজির সংবর্ধনে ভূমিকা রাখে এবং এসব জায়গায় আমরা শ্রমিক, মধ্যস্বত্বভোগী বা মালিকের ভূমিকার কোনো না কোনো পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাই। এভাবে পুঁজি উৎপাদনকে সামাজিক রূপ দিলেও পুঁজির মালিকানা ও মুনাফার ভোগটা ব্যক্তিমালিকানায় থাকার ফলে একটা সংকটের সৃষ্টি হয়। আজকের পু*জিবাদী বিশ্বকে দেখুন, সেখানে শিল্প উৎপাদন নীচের দিকে নামছে ওপরে উঠছে ভোগের আয়োজন, নেশার আয়োজন, এবং ফটকা পুঁজির দৌরাtto সবখানে। মার্কস এর সমাধান দিয়েছিলেন, সামাজিক উৎপাদনের সঙ্গে মানানসই সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এরই বিকৃত ও প্রতারণাপূর্ণ রূপ হচ্ছে আজকের কর্পোরেট এবং শেয়ার বাজার। সেখানে ছদ্মমালিকানার বোধ দেয়া হয় শেয়ার ক্রেতা ও কর্মচারিদের। কিন্তু এটাও অগ্রগতি, এর অর্থ পুঁজি সামাজিক হচ্ছে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এর বিনাশ এভাবে হবে না। তার জন্য শ্রেণী সংগ্রাম চাই।

৪. শ্রেনী সংগ্রাম সবখানেই আছে। তবে আমেরিকায় সবচে বেশি। সেখানে গোড়া থেকেই শ্রেণী বিভাজনের বদলে কমিউনিটি বিভাজন ও ইউনিটারিয়ান ফিলিং প্রবল থাকায় শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি গড়ে ওঠেনি। এর ফলে সেখানকার শ্রেণী সংগ্রামে মালিকরাই একচেটিয়া বিজয়ী হয়েছে তাদের নিজস্ব শ্রেণী সংগ্রামে। তবে ব্যাঙ যেমন বিবর্তন না জেনেই ব্যাঙ, তেমনি আজকের যুগের অনেকানেক ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক ও গোষ্ঠীগত সংগ্রামও শ্রেণী সংগ্রাম। যেমন, ঔপনিবেশিক বাংলায় হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্ব আসলে জমিদার বনাম কৃষকের শ্রেণী দ্বন্দ্ব। কিন্তু বুর্জোয়াদের হাতে তা উল্টে গিয়ে হিন্দু বনাম মুসলমান দ্বন্দ্বে পরিণত হয়। এটা শ্রেণীসংগ্রামেরই ধর্মের আয়নায় দেখা উল্টানো রূপ। একে সোজা করে দিলে তা কৃষক-শ্রমিকের সংগ্রামে পরিণত হতো। এরকম বস্তিতে নোয়াখালী সমিতি বা ইঞ্জিনিয়ারদের ইঞ্জিনিয়ার্স সমিতিও আসলে অবিকশিত শ্রেণী ঐক্য। আবার জাতীয় বনাম উপনিবেশবাদের সংগ্রামও কিন্তু ছিল জাতির ভেতরে নিপীড়িত শ্রেণীগুলোর সঙ্গে বিদেশি বুর্জোয়াদের শ্রেণীসংগ্রাম।

শ্রেণী সংগ্রাম যেমন দেশের ভেতরে ঘটে, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিসরেও ঘটে। ঘটে বুর্জোয়াদের নিজেদের মধ্যেও। যেমন মহাযুদ্ধগুলো বা আজকের রাশিয়া ও মার্কিন দ্বন্দ্বে। আবার জাতিসংঘের মধ্যে দিয়ে দেশসমূহের শ্রেণীসংগ্রামের লাগামকে পুঁজিবাদীদের হাতে ধরে রাখার বন্দোবস্তও শ্রেণী সংগ্রাম থাকারই প্রমাণ। তিরিশের মহামন্দার সময় শ্রেণী সংগ্রাম ছিল না যে তা নয়। ছিল কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকলেই বিপ্লব হবে এমন কথা মার্কসবাদের কোথায় পেলেন? এটা অনেকটা নৈরাজ্যবাদীদের কথা। শোষণ যত তীব্রই থাক, বিপ্লব নাও হতে পারে যদি তার বস্তগত প্রস্তুতি না থাকে। অর্থাৎ পুঁজির বিচলনের গভীরতম সংকট, উৎপাদনব্যবস্থার ভাঙ্গন ইত্যাদি না থাকে। এবং যদি তার সাবজেকটিভ বা আÍগত সংকট যেমন শাসকশ্রেণীর ভাঙ্গন আদের মতাদর্শের প্রভাব হ্রাস অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণী নিজের কর্তব্য ও শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে বুর্জোয়া মতাদর্শের খপ্পর থেকে বেরিয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক সংগ্রাম চালানোর অবস্থায় না আসে। লেনিন একে সহজ করে বলেছিলেন যে, যখন শাসকরা আর আগের কায়দায় শাসন করতে পারবে না এবং শোষিতরা আর আগের কায়দায় শোষিত হতে রাজি থাকবে না। আমেরিকায় তিরিশের দশকে কিন্তু এই লণগুলো উপস্থিত ছিল না। সেখানে ওয়ার্কাস পার্টি না থাকাও একটা বড় কারণ।

৫. ব্যক্তিমালিকানার আধেক বিলোপ কিন্তু আজকের পুঁজিবাদ করে রেখেছে। বিশ্বব্যাংকের বর্তমান রিপোর্টই বলছে, এখন দারিদ্র্যের হার বিশ শতাংশ বেড়েছে গত এক দশকে। অর্থাৎ বিশ্বের আশি ভাগ লোকই বর্তমানে ব্যক্তি মালিকানা বঞ্চিত। কমিউনিষ্টদের কেড়ে নিতে হয়নি, পুঁজিবাদই দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষকে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আপনি বলছেন, মধ্যবিত্তের আকার আয়তন বেড়েছে। একটু তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বলবেন কী? আমেরিকায় শ্রমিকও ভাবতে ভালবাসে যে, সে মধ্যবিত্ত। ঋণের বহর বৃদ্ধি দেখে না, মজুরির ক্রমহ্রাস দেখে না, কেবল সাংস্কৃতিকভাবে প্রাপ্ত সম্মানই তাকে ভাবাচ্ছে সে মধ্যবিত্ত। বাংলাদেশেও অজস্র বস্তিবাসী নিজেকে ভূমিহীন বলে না। সে ভাবে গ্রামে বন্ধক দিয়ে আসা জমি সে আবার ফেরত পাবে।

অন্যদিকে শেয়ার বাজারের শেয়ার ক্রয়, কর্পোরেটের অংশীদারিত্বের বোধ, বাজারে মতায়ন ইত্যাদির মাধ্যমে সমস্যাটার একটা ছদ্ম সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সেটা আখেরে টিকবে না কারণ সম্পদের ন্যায্য পুনর্বন্টন বিনা উৎপাদন চলবে না। কারণ লোকের ক্রয়মতা না বাড়লে কে কিনবে? তাই তারা ঋণের আওতা বাড়িয়ে সাময়িকভাবে ক্রয়মতা দেয়ার চেষ্টা করছে। আন্তর্জাতিকভাবেও পুঁজি শিল্প উৎপাদন থেকে সরে ভোগের বাজার, নেশার বাজার, অস্ত্রের বাজার আর পুঁজি সুদে ভাড়া দেয়ার বাজার চালিয়ে মুনাফা নিশ্চিত করতে চাইছে। এসবই পুঁজির সংকটের লণ।

অন্যদিকে ওয়েলফেয়ার স্টেটও সেসব দেশে হয়েছে যেখানে শ্রেণীসংগ্রাম একসময় তীব্র ছিল। তার ফলে বুর্জোয়ারা শ্রেণী সমন্বয়ের ধারায় আসতে বাধ্য হয়েছে। আরেকদিকে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের চাপেও ওটুকু আপস করাই তারা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করেছিল। পশ্চিম ইউরোপে যে তীব্র শোষণ নাই, তার একটা কারণও কিন্তু ওই একদা শ্রেণী সংগ্রামের শক্তিশালী উপস্থিতি।

৬. আপনার লেখায় মার্কসের অরজিনাল টেক্সটের বদলে তার নানান ইন্টারপ্রিটেশন এসেছে, যেগুলো মার্কসের নামে চালানো কঠিন। মার্কস কদাচ নিজেকে মানবতাবাদী বলেননি। বরং মানবতাবাদের নামে শ্রেণী সংঘাতকে আড়াল করার শান্তি শান্তি ভাবের তিনি সমালোচক ছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর প্র্যাক্সিসের দর্শন তথা কর্মকাণ্ডের দর্শন। এবং সেটা পরিবর্তনশীল। এবং যেহেতু মার্কসবাদই জগতের একমাত্র র্যাডিকাল দর্শন নয়, সেহেতু মার্কসবাদের মধ্যে সমস্ত সৃজনশীল চিন্তাকে গ্রহণ করবার কাঠামো উপস্থিত। কিন্তু বাম বালখিল্য রণশীলতার জন্য তা হতে বিলম্ব হচ্ছে। হ্যাঁ, পুঁজিবাদ যেমন মৌলবাদের জন্ম দিয়েছে, যেমন ধর্ম তা দিয়েছে, মার্কসবাদেও তা হয়েছে।

তবে মোদ্দা কথা, আপনি যদি মার্কসীয় রাজনীতির মৌল প্রত্যয়: সর্বহারার একনায়কত্ব, পার্টি পরিচালনার গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা, ইতিহাসে নিরন্তর প্রগতির ধারণা, একরৈখিক ইতিহাসবোধ এবং অনিবার্যতার তত্ত্ব ইত্যাকার প্রশ্নগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন তাহলে বেশি আগ্রহ পেতাম। আমি এগুলিকে মার্কসবাদের প্রব্লেমেটিক জোন মনে করি।

আপনার শ্রমসাধ্য আলোচনার জন্য অভিনন্দন।

শ্রেণী আর নেই সেটা কীভাবে বলা যায় @ স্নিগ্ধা? শ্রমিক কৃষকের শ্রেণী সংগ্রাম নীচু তালে চলে এসেছে ইউরোপে। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকায় তা তুঙ্গে। আবার আরব-আফ্রিকায় তা নিচ্ছে ইসলামী মোড়। সেটা এখনো রিঅ্যাকশনারি লেবাসে আছে সত্য, কিন্তু এসবই তো শ্রেণী সংগ্রামেরই লক্ষণ। অন্যদিকে বুর্জোয়া শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্য তো তাদের শ্রেণী সংগ্রামেরই প্রমাণ। যাহোক, মার্কসবাদের নবায়ন বিনা তা জাদুঘরেই যাবে এটা ঠিক। আর এ কাজে মার্কস মহাশয়ের শরণই বেশি লাগবে। কারণ তাঁর নামে শিষ্যরা যা বলেছেন, করেছেন তার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক সামান্যই। পাশপাশি শ্রেণী বৈষম্যের পাশাপাশি লিঙ্গবৈষম্য, সাংষ্কৃতিক বৈষম্যের মতো বিষয়গুলোকেও ধারণ ও ব্যাখ্যা করাও আজকের মার্কসবাদীদের কর্তব্য। এ কাজ অনেকে করছেনও। সেসব নিয়ে আলোচনা হতে পারে, তাহলে কিছু নতুন বিষয় জানতে পারি। ধন্যবাদ।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

স্নিগ্ধা এর ছবি

শ্রেণী নেই আমি তো কোথাও বলিনি? আমি তো বরং শ্রেণী সচেতনতার প্রয়োজনীয়তার কথাই বললাম।

কিন্তু এসবই তো শ্রেণী সংগ্রামেরই লক্ষণ।

মার্ক্সিজমের একটা খুব জানা সমালোচনাই হচ্ছে যে এটা প্রধানত ইকোনমিক শ্রেণী দিয়ে সবকিছু নির্ধারন করে। সে হিসেবে ওগুলোকে শ্রেণী সংগ্রাম বলা যায় কি? সংগ্রাম ঠিকই, কিন্তু মার্ক্সীয় ধরনের শ্রেণি সংগ্রাম?

আর

এ কাজ অনেকে করছেনও।
- অবশ্যই, করছেন তো বটেই। মার্ক্সবাদী ফেমিনিস্ট, পোস্টকলোনিয়ালিস্ট্, ডিকন্সট্রাকশনিস্ট, পোস্টমডার্নিস্ট, পোস্ট স্ট্রাকচারালিস্ট, সাব অল্টার্নিস্ট -এঁরা ঐসব বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের বিশ্লেষণই করছেন - এবং অনেকেই করেছেন একটা মার্ক্সীয় দৃষ্টিকোন থেকে।

যদিও অনেকসময়ই পো মো বা ডিকন্স... বাদীরা মার্ক্সের বড় সমালোচক এবং মার্ক্সবাদীরা তাদের হাসি

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

দুঃখিত, আমি বলতে চেয়েছিলাম শ্রেণী সংগ্রাম নেই, তা কীভাবে দেখা যায়?
আপনি হয়তো দেখেছেন বিশিষ্ট সাবঅল্টার্নিস্ট থিওরিস্ট দীপেশ চক্রবর্তী তাঁর রিথিংকিং ওয়ার্কিং ক্লাস হিস্টরিতে দেখিয়েছেন ব্রিটিশ মার্ক্সিস্ট ই পি থম্পসন যেভাবে ব্রিটেনে ওয়ার্কিং ক্লাসের গঠন ও স্ট্রাগল দেখেছিলেন, সেটাকে উপনিবেশিক ভারতে সেভাবে দেখা সম্ভব নয়। কারণ এখানকার পুঁজির কলোনিয়াল চরিত্র, ফলত এর অ্যান্টিথিসিস হিসেবে শ্রমিকও আদর্শ শ্রমিক হবে না। তার দেশের সংস্কৃতির প্রভাবে সে তৃতীয় পথ নেবে। সুতরাং শ্রমিকের ক্লাস স্ট্রাগল একেক বাস্তবতায় একেক পথ নিতে পারে। কখনো তা উচ্চে অবস্থান করতে পারে যেটা ঊনিশ শতকের ইউরোপে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকের রাশিয়া ও চীনে এবং কিছুটা পশ্চিম ইউরোপে।
প্রশ্ন হলো আপনি জানেন, মার্কস শ্রমিকদের দুই ভাগে বুঝেছিলেন: এক " ক্লাস ইন ইটসেল্ফ' এবং ক্লাস ফর ইটসেল্ফ'। আজকে বেশিরভাগ রাজনৈতিক ভাবে অসংগঠিত শ্রমিক কিন্তু সুপ্ত শ্রেণীবোধ নিয়ে মাঠে আছে। তাদের রাজনৈতিক শক্তির প্রকাশ ঘটবে তখনই যখন মাথার ওপর থেকে অধিপতি শ্রেণীর মতাদর্শিক আধিপত্য তারা ঝেড়ে ফেলতে পারবে। এর বাইরে তাদের ডেইলি রেসিস্ট্যান্সকেও হিসেবে নিতে হয়।
পুরো বিষয়টি যেহেতু ঘটে বিরাট কালপর্ব জুড়ে, তাই আমাদের জীবতকালের দশা দেখে বলা যায় না যে, ক্লাস ইন ইটসেল্ফ দশা থেকে শ্রমিকরা আবার ক্লাস ফর ইটসেল্ফ এ যেতে পারবে না।

এ প্রসঙ্গে অভিজিতের উদাহরণটি আনতে চাই: তিনি দেখিয়েছেন যে, একজন একইসঙ্গে বর্ণগতভাবে কালো, শ্রেণীতে শ্রমিক এবং লিঙ্গে নারী হলে কোনটা প্রধান? কোনটা প্রধান তা তিনি সাব্যস্ত করেননি। আমি মনে করি, দেশ-কাল বাস্তবতায় একেকসময় একেকটা প্রধান হতে পারে। নীপিড়িতের কাছে এই তিনটি পরিচয় পরস্পরবিরোধী নয় বরং নৈকট্যকামী। বাইরের হস্তক্ষেপে এ তিনের মধ্যে সাময়িক বিরোধ দেখা দিতে পারে। কিন্তু দার্শনিক ভাবে এই তিনটি পরিচয় কী কারণে মিউচিয়ালি এক্সক্লুসিভ, তা যতক্ষণ না প্রমাণ হচ্ছে ততক্ষণ বলা যাচ্ছে না, বর্ণ ও জাতি পরিচয় শ্রেণী পরিচয়কে ক্নট্রাডিক্ট করে।
প্রশ্ন হচ্ছে কোন ধরনের বৈষম্য তাকে বেশি পীড়িত করছে এবং কোন ধরনের চেতনা তার মধ্যে ক্রিয়াশীল। ধনী বুর্জোয়া নারীও তো নারী হিসেবে শোষিত। কিন্তু জগতে তাঁর সুবিধাভোগ নির্ধারিত হয় নারী সত্ত্বা দিয়ে নয়, তাঁর বৈষয়িক শ্রেণীগত অবস্থা দিয়ে। শ্রমিক নারীর বেলাতেও বুনিয়াদী সমস্যা হচ্ছে তার শ্রমিকতা। কারণ শ্রমিকতার অবসান না হলে বাকি দুটো পরিচয়ের কারণে নিপীড়ন মোটেই কমে না। এখানে শ্রেণী অবস্থানই তাকে সূচিত করে। তার মানে আবার এই নয় যে, শ্রেণী উত্তরণ ঘটলেই তার অন্যান্য বঞ্চনার কারণ লোপ পাবে। সেগুলো থাকবে। কারণ সেগুলোর উতস ভিন্ন। তাই আমার কাছে শ্রেণী তার নিপীড়িত হওয়ার এবং নিপীড়ন মুক্তির মুখ্য কারণ ও উপায়। কিন্তু শ্রেণী সংগ্রামী মাত্রই পুরুষতন্ত্র ও বর্ণবৈষম্য মুক্ত নয়। তার জন্য তাকে সাম্যবাদের পরেও লড়াই করে যেতে হবে। কিন্তু বৈষম্যের বৈষয়িক ভিত্তি লোপ করা গেলে সেই লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এই সরল কথাটি ভুল মনে করেলে অভিজিতকে প্রমাণ করতে হবে যে, আজকের বুর্জোয়া কালো বা শাদা নারী সম্পূর্ণভাবে জাতিবৈষম্য ও লিঙ্গবৈষম্য থেকে মুক্ত হতে পারেন।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

স্নিগ্ধা এর ছবি

শ্রেণী উত্তরণ ঘটলেই তার অন্যান্য বঞ্চনার কারণ লোপ পাবে। সেগুলো থাকবে। কারণ সেগুলোর উতস ভিন্ন। তাই আমার কাছে শ্রেণী তার নিপীড়িত হওয়ার এবং নিপীড়ন মুক্তির মুখ্য কারণ ও উপায়।

এই কথাটাই আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম, শ্রেণীসচেতনতার প্রয়োজন আছে এবং যে কোন সমাজবিজ্ঞানীয় বিশ্লেষণের জন্য সবসময় থাকবে, বলে। কিন্তু, শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমার ধারনাটা আলাদা।

এটা ঠিক যে -

সুতরাং শ্রমিকের ক্লাস স্ট্রাগল একেক বাস্তবতায় একেক পথ নিতে পারে।

অবশ্যই, যে কোন প্রসেস বা ডিসকোর্স তাই নেয়। কিন্তু, আমার সমস্যাটা হচ্ছে, সুপ্ত শ্রেণীবোধ থাকা মানে কিন্তু সম্ভাব্য শ্রেণীসংগ্রামের অবিকশিত বা অসংগঠিত আয়জন থাকা নয়। আমার ধারনা এখন যদি কোন সংগ্রাম হয়ও, তার কারণ এবং অনুঘটক এবং পুরো প্রক্রিয়াটা এতোই মিশ্রিত (convoluted) হবে যে তাকে আর ঠিক শ্রেণীসংগ্রাম বলে দেখা যায় কি না তাতে আমার সন্দেহ আছে। আর সংগ্রামের ধারণাটা বা কন্সেপ্টটার মধ্যে অন্য যে গুলো বৈষম্যের কথা বলা হচ্ছে, যেমন লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি ইত্যাদি সেগুলোকে আসলে আমি social category হিসেবে দেখি, social or economic class নয়।

খুব সম্ভবত আমার তর্কটা অনেকটাই semantics নিয়ে হয়ে গেলো হাসি

হিমু এর ছবি

ফারুক ভাই, মনে হচ্ছে টাইমআউট হয়ে যাচ্ছে। আপনি কমেন্টটা লিখে শেষ করে একবার কপি করে রাখুন। তারপর যদি পোস্ট না হয়, তাহলে রিফ্রেশ করে আবার পেস্ট করে সাথে সাথে পোস্ট দিন।

আমাদের বর্তমান সার্ভিস কিছুটা সমস্যা দিচ্ছে ডেটাবেজ নিয়ে। আপগ্রেডের সময় এ সমস্যাগুলো থাকবে না।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সুমন চৌধুরী এর ছবি

আমি খানিক ফুরসৎ ম্যানেজ করতে করতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা হয়ে গেছে দেখা যাচ্ছে। ভালোই হলো। আমার শ্রম কমে গেল। এমনিতেও বিষয়টা এখনো তেমন বুঝি না। তাই সিদ্ধান্ত দেবার মতো মন্তব্যের দু:সাহস করি না। যা করতে পারি তা নিতান্তই সবার সাথে আমার দুপয়সা যোগ করতে।

পোস্টের শিরোনামকেই প্রসঙ্গ ধরি। গবেষণা পদ্ধতিতে যাকে রিসার্চ কোশ্চেন বলে। মার্কসবাদ কী বিজ্ঞান? এই সরল শব্দসমন্বয়ের জবাব দুটি। প্রথম জবাবে বলতে হয়, না। দ্বিতীয় জবাবে বলতে হয়, সমাজবিজ্ঞানের একটা তত্ত্বই কি করে বিজ্ঞান হবে? বিজ্ঞান তো আর স্থির এবং সমাধান হয়ে যাওয়া কোন বিষয় না। বিজ্ঞান একটি প্রক্রিয়া। আলোচ্য অনুসারে তাঁর নানান প্রশাখা। সমাজবিজ্ঞান তার একটি। বিজ্ঞানের সব শাখাতেই প্রসঙ্গ সাপেক্ষে নানান তত্ত্ব নানাভাবে বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন অনুসন্ধানে ব্যবহৃত হয়। সমাজ বিজ্ঞানেও সেইভাবে সুনির্দিষ্ট সময়ে বস্তুগত প্রাসঙ্গিকতা অনুসারে বিভিন্ন তত্ত্বের ব্যবহার রয়েছে।

আপনার প্রশ্নটা যদি হতো মার্কসবাদ কি বর্তমান সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত একটি তত্ত্ব? সেক্ষেত্রে জবাব দিতাম, অবশ্যই। সমাজবিজ্ঞানে বর্তমানে ব্যবহৃত প্রধান দুইটি ধারার একটি। বিশেষত: রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে। মার্কসীয় স্কুল আর লিবারেল স্কুল এই দুটি প্রধাণ স্কুলের ধারা-উপধারাগুলির দ্বন্দ্ব সংঘর্ষই এখনো পর্যন্ত রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের আলোচ্য। সমাজতত্ত্ব বা সোশিওলজিতে মূলধারা দুটি। মার্কসীয় এবং ভেবারীয়। অন্যধারাগুলি সবই কোন না কোনভাবে এই দুটি ধারার উপধারা। নৃবিজ্ঞানে এবং দর্শনে, বিশেষত নৃবৈজ্ঞানিক দর্শনেও অ্যাকাডেমিক দৃশ্যপট মোটামুটি একই রকম। দর্শন আর সমাজবিজ্ঞান ফ্যাকাল্টি থেকে মার্কসবাদ চট করে বিদায় নেওয়া কঠিণ। এই তত্ত্বের সমর্থক সমাজবিজ্ঞানীরা যে সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করছেন সেগুলি অপ্রাসঙ্গিক হবার আগ পর্যন্ত সেখানে মার্কসের উপস্থিতি মেনে নিতে হবে।

আপনার ট্যাগে সমাজতন্ত্র দেখে মনে হলো এই বিষয়েও কিছু বলা দরকার। সমাজতন্ত্র বলতে আমাদের সামেন যে ঐতিহাসিক রেফারেন্স আছে সেটা মূখ্যত মার্কসবাদ প্রয়োগে লেনিনবাদী ইন্টারপ্রিটেশানের প্রয়োগ প্রচেষ্টা। লেনিন-স্ট্যালিন, মাওসেতুং, হোচিমিন থেকে ক্যাস্ট্রো পর্যন্ত সকলেই শিল্পায়নভিত্তিক পুঁজিবাদের বৈশ্বিক মনোপলির বিরুদ্ধে পাল্টা শিল্পোন্নয়নের স্টেট মনোপলিকে মডেল ধরে নিয়েছিলেন। বিষয়টা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটেনি। মাও, হোচিমিন, কাস্ট্রো অনেকাংশে এর বিরোধিতা করেছেন বা স্ট্যালিন আমলের ঢালাও শিল্পায়নের বাইরে ভিন্ন ধরণের নিরীক্ষার দিকে গিয়েছেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মডেলের বাইরে যারা ভোটের রাজনীতির দিকে গেছেন তারাও নিরীক্ষা চালিয়েছেন কিভাবে ধীর গতিতে হলেও সমাজতন্ত্রের সংস্কারগুলি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে করা সম্ভব। এই মডেলের সাফল্য ব্যর্থতা বা প্রাসঙ্গিকতা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। বিষয়টা অনুশীলন হয় কি না এই প্রশ্নের জবাবে ইতিবাচক জবাব দিতে অ্যাকাডেমিশিয়ান হিসেবে আমি বাধ্য।



অজ্ঞাতবাস

অভিজিৎ এর ছবি

আলোচনা মনে হয় জমে উঠেছে। আমি স্নিগ্ধা, ফারুক ওয়াসিফ এবং সুমন চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাদের মতামত জানানোর জন্য। তাদের মতামত নিয়ে আলাদা আলাদা আলোচনা করতে গেলে মহাকাব্য লিখতে হবে। দেখি মহাকাব্য না লিখে কোথায় যাওয়া যায়।

স্নিগ্ধা, ফারুক ওয়াসিফ এবং সুমন চৌধুরী সবাই 'মার্ক্সিজম কি বিজ্ঞান?' -এ শিরোনামে আপত্তি করেছেন। মার্ক্সিজম বিজ্ঞান হতে যাবে কেন।

এর উত্তর হচ্ছে তাদের তত্ত্বের 'বিজ্ঞানময়তার কথা মার্ক্স নিজেই বলেগিয়েছিলেন। যেমন মার্ক্স তার ইকোনমিক থিওরী সম্বন্ধে বলেছেন,

"The sicentific nature of my economic theory distinguished it from all other vaugue utopian ideas about a future 'better world' that existed in my time"

এঙ্গেলসও মার্ক্সের তত্ত্বের বিপ্লবের ধারনাকে সায়েন্টিফিক মনে করে লিখেছেন,

"Marx claimed to identify fundamental underlying laws of a scientific nature that made revolutionary transition inevitable"

আমরা বাংলাদেশে বামপন্থি দলগুলোকে 'বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের' শ্লোগান দিতে অহরহই দেখেছি। কাজেই তাদের তত্ত্ব সত্যই বৈজ্ঞানিক কিনা সেটা অবশ্যই বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করা যেতে পারে। সেজন্যই মূলতঃ এ লেখার অবতারণা। পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্র এবং পরিশেষে সাম্যবাদে উত্তোরণের ভবিষ্যদ্বানী 'বৈজ্ঞানিক'ভাবেই করা হয়েছে বলে দাবী করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন।

যে কারনগুলোর জন্য আমি মার্ক্সের তত্ত্বকে 'বৈজ্ঞানিক' মনে করি না তা সংক্ষেপে বললে এরকম দাঁড়াবে।

১) 'ফলসায়েবিলিটির' অভাব- যেটা যে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্ধারণের অন্যতম সফল মাপকাঠি। 'ভুলপ্রমানেয়তার' ছাকুনির মধ্য দিয়ে না গেলে কোন তত্ত্বই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হয়ে উঠে না - এটা মোটামুটি একাডেমিয়ায় স্বীকৃত। ফারুক ওয়াসিফ বলেছেন," আর কার্ল পপার কিন্তু আজ পশ্চিমা একাডেমিয়াতেও তেমন গণ্য হন না, তাঁর চিন্তার দূর্বলতার কারণে"। ফারুক ওয়াসিফ কোন রেফারেন্স বা ডেটা উল্লেখ করেননি। আমি একাডেমিয়ার সাথে সংশ্লিষ্টতার কারনে জানি, কার্ল পপারের ফলসাইফায়েবিলিটি এখনো খুব ভাল ভাবেই প্রাসঙ্গিক - অন্ততঃ বেসিক সায়েন্সে।

২) শুধু শ্রেনী সংগ্রাম দিয়ে সব কিছু বিচার করলে চলবে না। 'ক্লাস'কে এখন কোন বেসিক ইউনিট হিসেবে দেখা হয় না। একই ক্লাসের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিভিন্ন মানুযের চাহিদা এবং সংগ্রাম ভিন্ন ভিন্ন হয় তা দেখা গেছে। আবার সঙ্ঘাতই বলুন, আর কনফ্লিক্ই বলুন এগুলো একই মানুষে অবস্থাভেদে পরিবর্তিত হয়। যেমন, আমেরিকার একজন 'ব্ল্যাক ওয়ররকিং ক্লাস ওম্যান' এর উদাহরণ দেওয়া যায়। এর মধ্যে এন্টাগনিজম তিনটি - ব্ল্যাক, ওয়ররকিং ক্লাস, এবং ওম্যান। কোনটাই কোন্টার চেয়ে যে কম তা বলা যায় না। যেমন একই শ্রেনীগত অবস্থায় থেকেও যাচাই বাছাই এর ধরণ ধারন এবং সিদ্ধান্ত অবস্থাভেদে পরিবর্তিত হয়। কেউ ওবামার দিকে ঝুকে, কেউ বা হিলারীর দিকে - কোন এন্টাগোনিজম কখন কার কাছে বড় হয়ে উঠে তার উপর ভিত্তি করে - অনেকাংশেই আবার ওগুলো বয়ক্তিগত অভিজ্ঞতাসঞ্জাত। আর তাছারা শ্রেনি ছারাও ধর্ম, বর্ণ, জাতিগত বিভিন্ন সঙ্ঘাত তো আছেই। অমর্ত্য সেনের উদ্ধৃতিটা আবারো দেই -"‘শ্রেণী ছাড়াও আসলে অসাম্যের অনেক উৎস আছে; অসুবিধা আর বৈষম্যের সমস্ত কিছু কেবলমাত্র শ্রেনী দ্বারাই নির্ধারিত হবে – এই ধারণা ত্যাগ করতে হবে’।

৩। মার্ক্স কথিত 'ইনএভিটেবল' বিপ্লব অনেক ক্ষেত্রেই হয় নি (যেমন তিরিশের দশকের মন্দার সময়), কিংবা অনেক ক্ষেত্রে খুব বাজে ভাবে শেষ হয়েছে। বিপ্লবের 'অলটারনেটিভ' হিসবে 'গনতান্ত্রিক ট্রাঞ্জিশন' অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকরী প্রমানীত হয়েছে এই বিশ্বে।

৪। ফারুক ওয়াসিফ সফটওয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত বিপুল সঙ্খ্যক 'মধ্যবিত্ত' শ্রেনীর অস্তিত্বই অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ সমস্ত ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত হাজার জাহার মানুষ চিরায়ত শ্রমিকের ধারনাই পালটে দিয়েছে।

৫) যে কোন ধরনের 'সেন্ট্রাল প্যানিং' - যেমন 'পার্টির একনায়ক্তন্ত্র' কিংবা 'সর্বহারার একনায়কতন্ত্র' পরিশেষে দুর্নীতি আর স্বৈরশাসনেত্র জন্ম দেয়। এখন মানুষ বরং গন্তান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর অনেক আস্থাশীল। অন্ততঃ পৃথিবীর গতি প্রক্ক্রিতি দেখলে তাই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার 'The end of History and the last man" সাম্প্রতিক বইটা পড়া যেতে পারে - যেখানে বলা হয়েছে 'সমাজতান্ত্রিক' বা এ ধরণের কোন 'আদর্শবাদ' নয় - বরং লিবারাল ডেমোক্রেসিকে মানব সভ্যতার শেষ পরিণতি বলা হয়েছে। দেখা যাক কারকথা সত্যি হয় ফারুক ওয়াসিফের নাকি ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার।

৬) শেয়ার বাজারের শেয়ার ক্রয়, কর্পোরেটের অংশীদারিত্বের বোধ, বাজারে মতায়ন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মাধ্যেম পশ্চিমা বিশ্বে শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ, ওয়েল ফেরা শটেটের উত্থান ইত্যাদিকে 'ছদ্ম সমাধান' বলেছেন। বলেছেন এগুলো 'কিন্তু সেটা আখেরে টিকবে না'। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই ছদ্মসমাধানকেই মানুষেরা আজগ্রহন করেছে। বিপ্লবে যাচ্ছে না। আমি কিন্তু তার 'আখেরে টিকবে না'র পক্ষে কোন শক্ত প্রমাণ য়ামি কিন্তু পাইনি।

৭) 'ডায়লেক্টিক'যদি একটি ডায়নামিক প্রক্রিয়া হয় তবে তা সবসময় বজায় থাকার কথা - এমনকি মার্ক্সের কথিত এর ‘বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী’ সমাজব্যবস্থা কায়েম হবার পরো, যাকে তিনি মনে করেছেন মানব সমাজের সর্বোচ্চ রূপ। কিন্তু মার্ক্স নিজেই বলেছেন সেই ব্যবস্থায় 'dialect will cease to operate' এবং ধারনা করেছেন -
'In good time, the dictorship of proletariat will wither away and the sunlit uplands of true socialism will be reached'

আজকের সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন মার্ক্সের এ ধারনা অবৈজ্ঞানিক। সমস্ত কনফ্লিক্ট দূর হয়ে গেলে তা হবে 'সায়েন্সদিকশন নাইটমেয়ার'। আসলে সমাজের সব কনফ্লিক্ট কখনোই ডূর হয় না, হবে না। এক জায়গার কনফ্লিক্ট রিজল্ভ হইলে আরেক জায়গায় নতুন কনফ্লিক্ট দেখা দেবে। এটাই সভ্যতার বাস্তব রুপ। এটা কিন্তু ভালই, কারণ সব কনফ্লিক্ট দূর হয়ে গেলে সমাজ হয়ে যাবে স্থবির - ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত 'বেহেস্তের' মত।

৮) ইম্পেরিয়ালিজম পুঁজিবাদের একচেটিয়া ছিল না। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বও আগ্রাসন এবং আক্রমনের ভালই খেলা দেখিয়েছে এক সময়।

৯) 'solidarity' ব্যাপারটা গ্রুপে গ্রুপে ভালই, কিন্তু এই 'solidarity'তে উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রেনীশত্রু খতমের লাইন কতটা বৈজ্ঞানিক? অনেক মার্ক্সিস্টরাই কিন্তু এই লাইনকে ঠিক মনে করে, এখনো।

১০) মার্ক্সের ইকোনমিক থিওরী অনেক সরল - সেই রিকার্ডোর 'লেবার থিওরী ভ্যালুর' উপর নির্মিত। আজকের সমাজ অনেক জটিল। আধুনিক অর্থনীতিতে মার্ক্সের তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে ‘মার্জিনাল ইউটিলিটি’ তত্ত্ব দিয়ে। আসলে গানিতিক মডেল, গেম থিওরী ইত্যাদি অন্ত্ররভুক্ত না করলে আজকের গ্লোবালাইড ওয়ররল্ডের বাস্তবতা ঠিকভাবে উঠে আসবে না।

আপাততঃ এখানেই খ্যামা দেই। পরে আরো কমু নে।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

স্নিগ্ধা এর ছবি

আর বিজ্ঞানের সবচাইতে বড় অপকর্ম বোধহয় একসময়ের বহুল প্রচারিত আর ইদানিং তৃতীয় বিশ্বে পাচারকৃত সব পেস্টিসাইড।

আমার এ বাক্যটা ঠিকভাবে গঠন করা হয় নি, যার ফলে আমি যা বোঝাতে চেয়েছিলাম তা বোঝাতে পারিনি। 'বিজ্ঞান' নিজে কিছুই নয়। সমস্যাটা হয় যখন বিজ্ঞান/ বৈজ্ঞানিক রিসার্চের ফলে আহরিত জ্ঞান/ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এসবকে 'ব্যবহার' করা হয়, যেমনটা করা হয়েছে ক্ষতিকারক ঐসব পেস্টিসাইড তৃতীয় বিশ্বে পাচার করে - ওগুলোর উপকারীতা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক যুক্তি এবং তথ্য দিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করে। আমার বক্তব্য ছিলো সেটাই।

আপাততঃ এখানেই খ্যামা দেই। পরে আরো কমু নে।

@ অভি - আরো আছে?!

শিক্ষানবিস এর ছবি

অসাধারণ। মার্ক্সবাদ নিয়ে এ ধরণের একটা লেখার খুব দরকার ছিল। যেকোন ধরণের গোঁড়ামির বিরুদ্ধেই আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। সবাইকে নিজের মত করে কথা বলতে দেয়া উচিত। আর একটামাত্র সিদ্ধান্তে আসার জন্য তো গণতন্ত্র রয়েছেই। আপনার এ লেখা সেক্ষেত্রে গোঁড়া মার্ক্সবাদীদের জন্যও খুব কাজে লাগবে।

আমি মার্ক্সের বস্তুবাদ নিয়ে কিছু জানতে চাচ্ছিলাম। মার্ক্স কি বস্তুবাদের মাধ্যমেই তার যাত্রা শুরু করেননি? তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল "প্রকৃতি সম্বন্ধে দেমোক্রিতোসীয় এবং এপিকুরোসীয় দর্শনের মধ্যে পার্থক্য"। তার মানে উনি গ্রিক পরমাণুবাদ দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেই পুরনো গ্রিক বস্তুবাদকে আবার চাঙ্গা করে তোলায় মার্ক্সের অবদান কি অনেক ছিল না? যদি এক্ষেত্রে তার বিশেষ কোন অবদান থাকে তাহলে এটাই মার্ক্সের অন্যতম সেরা অবদান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

কয়েকদিন আগে কসমিক ভ্যারিয়েন্স ব্লগে শন ক্যারল লুক্রেতিওসকে পৃথিবীর প্রথম কোয়ান্টাম বিশ্বতত্ত্ববিদ আখ্যা দিয়ে একটি ব্লগ লিখেছেন। সেখানে মন্তব্যে একজন লিখলেন,

Karl Marx’s doctoral dissertation was about the swerve.

এই সোয়ার্ভ-ই বোধহয় বস্তুবাদের জন্ম দিয়েছে। এপিকুরোস বলেছিলেন, পরমাণুর স্বাভাবিক গতি নিম্নমুখী এবং তারা সরলরেখায় চলে। তার মানে তারা অকস্মাৎ নতুন কিছু সৃষ্টি করে ফেলতে পারবে না। কিন্তু সোয়ার্ভ বলতে তিনি বুঝিয়েছিলেন,
an occasional, unpredictable deviation from regular atomic behavior

তার মানে পরমাণুরা নিজেই কখনও কখনও স্বাভাবিক চলন পথ থেকে বিচ্যুত হয়, এভাবেই নতুন কিছুর সৃষ্টি হয়। এভাবেই নিছক বস্তু থেকে নতুন কিছুর সৃষ্টি হতে পারে যা বস্তুবাদকে নির্দেশ করে। পরবর্তীতে লুক্রেতিওস এই সোয়ার্ভকে সকল মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার উপর প্রয়োগ করেন।

এসব নিয়েই যদি মার্ক্স গবেষণা করেন তাহলে আধুনিক যুগে বস্তুবাদের উত্থানের পেছনে তো তার বিশাল অবদান আছে বলে মনে হয়। আপনি কি বলেন? মার্ক্সের পিএইচডি অভিসন্দর্ভ ও এর পরবর্তী গবেষণা নিয়েও বাংলায় কিছু লেখা প্রয়োজন।

হাসিব এর ছবি

আমি হেডিঙেই আকটায় গেছি । বিজ্ঞান মানে আসলে কি বুঝবো ? আমি যেইটা বুঝি সেইটা হলো নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সন্নিবেশ যখন একটা সিদ্ধান্ত দেয় তখন সেইটাই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত । একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ক্ষেত্রবিশেষে ভুল সিদ্ধান্তও দিতে পারে । উদাহরন, গণিতে কনফিডেন্স ইনটার্ভাল অনেক সময় ১০০% না রেখে একটু কমিয়ে ধরা হয় । আপনার এক্সপেরিমেন্টের রেজাল্ট ঐ ইনটার্ভালের বাইরে পড়লেও পড়তে পারে । তখন কি আপনি পুরো সিদ্ধান্তটা অবৈজ্ঞানিক বা ভুল বলবেন ? আবার ধরুন নতুন করে চিন্তাভাবনার সন্নিবেশ ঘটিয়ে যদি আমরা ঐ পুরানো সিদ্ধান্তটারে ভুল প্রমান করতে পারি তখন কিন্তু আগের সেই সিদ্ধান্তটা অবৈজ্ঞানিক হয়ে যায় না । ওটা একটা বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত হিসেবেই থাকে । তখন নতুন পাওয়া সিদ্ধান্তটাকে আমরা পুরনো সিদ্ধান্তের এক্সটেনশন হিসেবেই দেখি । এইরকম চিকিতসা বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞানে, সমাজবিজ্ঞানে ভুরি ভুরি সিদ্ধান্ত আছে যেইগুলা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয় । মার্ক্সবাদও এরকম একটা নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার ফসল যেখানে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে নিয়মতান্ত্রিকভাবেই আশা হৈছে । আমি সেইটার সাথে দ্বিমত আনতে পারি কিন্তু সেইটারে অবৈজ্ঞানিক বলতে পারি না ।

পুনশ্চ: (এই মন্তব্যটা মার্ক্সবাদ বিষয়ে আপনার সুবিশাল প্রবন্ধে কার্ল পপারের উদ্ধৃতি আসার আগ পর্যন্ত অংশটুকুর ভিত্তিতে করা । পৃথিবীতে অনেক সমস্যাই আছে (ভালো উদাহরন পদার্থবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র) যেগুলো শুধু খাতা কলমে প্রমান করা যায়, বাস্তব প্রয়োগ যেখানে অসম্ভব । কার্ল পপার সেইগুলোকেও কি সিউডোসায়েন্স বলবেন কিনা সেটা জানতে আগ্রহ হচ্ছে । পরে সময় করে আরোও মন্তব্যের আশা রাখি । )

অভিজিৎ এর ছবি

আমি হেডিঙেই আকটায় গেছি । বিজ্ঞান মানে আসলে কি বুঝবো ? আমি যেইটা বুঝি সেইটা হলো নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সন্নিবেশ যখন একটা সিদ্ধান্ত দেয় তখন সেইটাই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত । একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনা ক্ষেত্রবিশেষে ভুল সিদ্ধান্তও দিতে পারে ।

লেখাটার হেডিং নিয়ে উত্তর এর আগের কমেন্টে দিয়েছি। নতুন করে এখানে কিছু আর বলবার নেই।

আসলে সত্যি বলতে কি, নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সন্নিবেশ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিলেই তা বিজ্ঞান হয়ে উঠে না। চিন্তা করুন - জ্যোতিষশাস্ত্র, কিংবা প্যারা সাইকোলজির বিভিন্ন বিষয় আশয় যারা চর্চা করেন -তারাও কিন্তু বলেন তারা নিয়মতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার সন্নিবেশ থেকে একটা সিদ্ধান্ত নেন, এবং আপনার মতই বলেন, সেই চিন্তাভাবনা (ধরুন কোন জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বানী) ক্ষেত্রে বিশেষে ভুল সিদ্ধান্ত নেয় - তা হলে বিজ্ঞান হবে না কেন?

আসলে এখানেই কার্ল পপার খুব প্রাসঙ্গিক । বিজ্ঞানের সাথে অপবিজ্ঞান, পরাবিজ্ঞান ইত্যাদির পার্থক্য নিরূপন করেন
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দার্শনিক স্যার কার্ল পপার(১৯০২-১৯৯৪)। সেটাই বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গ্রহনযোগ্য সংজ্ঞা - "If something is scientific, it must be logically possible to find evidence that can falsify, refute or show it is wrong". মার্ক্সবাদ কেন
বিজ্ঞানের সংজ্ঞাভুক্ত হবে না, সেটা পপারের বিজ্ঞানের
পদ্ধতির সাথে লিমিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে। 'শ্রেনীহীন সমাজ গড়বার স্বপ্ন' , 'দুনিয়ায় মজদুর এক হও', শ্রেনিশত্রু খতম' ইত্যাদি চিরন্তন আবেগী মানসিকতাকে যতটা তুলে ধরে, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণযোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয় না। এমনকি 'ডায়লেক্টিক্স' ব্যাপারটাও অনেকের কাছে 'মিস্টিকাল'। বিজ্ঞান 'ডায়লেক্টিক' নিয়ে কাজ করে না, মূলতঃ কাজ করে cause and effect নিয়ে। মার্ক্স 'value'র যে ধারনা হাজির করেছিলেন, এবং ধারনা করেছিলেন, শ্রমিকের সাপ্লাই সবসময়ই চাহিদার চেয়ে বেশি থাকবে, এবং তার সাপেক্ষেই 'increasing miseary'কে ব্যাখ্যা করা যাবে - এগুলো পরীক্ষণযোগ্যতার মাপকাটিতে ফেলা যায় না। আর সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি গুলোতে শ্রমিক এবং কাঁচামালের সনাতন ধারনাই পালটে দিয়েছে।

মার্ক্সিয়তত্ত্বে থিসিস এন্টি থিসিস থেকে সিন্থেসিস-এ উত্তোরণের কথা বলা হয় বটে কিন্তু মিথ্যে বলে ধরা হয় না। এর ফলে কোন পরীক্ষা (বা ইতিহাস) মার্ক্সীয় ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে গেলে, সেই মার্ক্সিজমের মধ্যে থেকেই আরো কিছু পুর্বনির্ধারিত মার্ক্সীয় প্রকল্প ঢোকানো হয়। সেই প্রকল্পকে বাতিল করা হয় না। আমি আমার প্রবন্ধে বলেছি, "যখন মার্ক্সের অনুরাগীরা দেখলেন পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি মার্ক্সের দেখানো পথে যাচ্ছে না, তখন তাদের দরকার ছিল এই তত্ত্বকে বাতিল করে নতুন তত্ত্বের খোঁজ করা। তা না করে তারা পুরোন তত্ত্বকেই তারা আঁকড়ে ধরে রইলেন, এবং তত্ত্বকে জোড়া তালি দিয়ে একধরণের যথার্থতা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। পপারের মতে এ ধরণের কর্মকান্ড বিজ্ঞানমনস্কতার পরিপন্থি। "

The Marxist account of history too, Popper held, is not scientific, although it differs in
certain crucial respects from psychoanalysis. For Marxism, Popper believed, had been initially scientific, in that Marx had postulated a theory which was genuinely predictive. However, when these predictions were not in fact borne out, the theory was saved from
falsification by the addition of ad hoc hypotheses which made it compatible with the facts. By this means, Popper asserted, a theory which was initially genuinely scientific degenerated into pseudo-scientific dogma.

কোন তত্ত্ব বিজ্ঞানসম্মত হওয়ার প্রাথমিক শর্ত
হচ্ছে, সেই তত্ত্বকে বাতিলযোগ্য হতে হবে। সেটাই আধুনিক বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের সংজ্ঞা।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ভালো লাগলো। আপনার জয় হোক।

সুবল দাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

এইসব তত্ত্বপ্রচারকদের পুজা করে স্বাধীন বাংলাদেশে শুরু থেকে উন্নয়নের রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে। যেখানে যা প্রজোজ্য সেখানে সেটাই ঠিক। নতুন ব্যবস্থার একসপরিমেন্ট করার বিলাসীতা গরীবদের পোষায় না।

P Munshe [অতিথি] এর ছবি

একটা পর্যবেক্ষণ দিয়ে শুরু করবো।
১। মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান কী না আপনার এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে আপনি মার্ক্সের চেয়ে স্টালিনের রাশিয়ার কারাগারে থাকা লেখকদের বক্তব্যের দারস্ত হয়েছেন বেশী। উত্তরটা মার্ক্সের নিজের লেখার ভিতরে খুজলে বেশী যর্থাথ হোথ না কী?
২। মার্ক্স আর মার্ক্সবাদে একটা ফারাক তো আছেই। আবার মার্ক্সবাদ ব্যবহারিকভাবে রাষ্ট্রে চর্চা করতে গিয়ে এর একটা রূপ দাড়িয়েছে,সেই অর্থ এর প্রথম ব্যবহারিক মার্ক্সবাদী রূপ হলো স্টালিনিজম। সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সলঝেনিতসিন এর সমালোচনাকে কতটুকু মার্ক্সের,কতটুকু মার্ক্সবাদের বা কতটুকু স্টালিনবাদের সমালোচনা হিসাবে গ্রহণ করবেন সেই বিচারবোধ আগে নিজের ভিতের তৈরী করতে হবে। নইলে এই আলোচনার কোন মানে হবে না।
৩। আলেকজান্দার সলঝনেতসিনের মার্ক্সবাদকে unscientific বলার কারণে আমাদেরকেও মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান কী না - এভাবে প্রশ্ন তুলতে হবে এটা কোন কাজের কথা না। বিশেষত আলেকজান্দার সলঝনেতসিনের মার্ক্সবাদ সম্বন্ধে ধারণা - যখন আপনার বরাতে, Marxism, a primitive superficial economic theory,- এরকম। মার্ক্সের অর্থশাস্ত্র (পলিটিক্যাল ইকনমি)বা পুঁজি - ধারণাকে আলেকজান্দার সলঝনেতসিনের যদি নেহায়েতই economic theory বলে বুঝে থাকেন এর দায়দায়িত্ত্ব মার্ক্সের কাঁধে সওয়ার করানো কী ঠিক হবে? তবে হতে পারে আমাদের ব্যবহারিক মার্ক্সবাদের ভিতরেও একে economic theory বলে বুঝার ধারাই প্রধান।
৪। বিজ্ঞান,দর্শন আর রাজনীতি - এই তিনের মধ্যে সম্পর্ক কী? এসম্পর্কে মার্ক্সেরই বা ধারণা কী? এটা আগে পরিষ্কার না করলে মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান কী না - জানা যাবে না। মার্ক্সও কখনও যেখানে বিজ্ঞান শব্দ ব্যবহার করেছেন কেন কী এর অর্থ - তাও জানা যাবে না।
৫। একইসাথে জ্ঞান ও ইজম (আইডিওলজি)তফাত কী? আগে জানতে হবে।মার্ক্স কোন মতবাদ ফেরি করেননি বা মতবাদ দিয়ে যাননি। চিন্তা করার একটা পদ্ধতির কথা বলছিলেন। এই প্রথম একটা চিন্তা বলেছে এটা শেষ নয় একে চর্চা (প্রাক্সিস) করে বাস্তবায়নের ভিতর এর সত্যতা প্রমাণের পথে হবে। আপনিই মার্ক্সকে উদ্ধৃত করে বলছেন, 'এতদিন ধরে দার্শনিকেরা পৃথিবীকে কেবল ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল একে পরিবর্তন করা।'। এটা ফয়েরবাখ সম্পর্কে মার্ক্সের ১১ নম্বর থিসিস। দেখুন তো, বুঝতে পারেন কী না - দার্শনিকের সাথে রাজনীতিকের তফাত তিনি কী দিয়ে করছেন? যদি বুঝতে পারেন তবে মার্ক্সের তত্ত্বের ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের সাযুজ্যই খুজা বন্ধ করবেন।
৬। আপনি লেখায় মার্কসকে "শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞ" বলে পরিচয় করিয়ে কথা শুরু করেছেন।
কী পড়ে মার্কসের কোন লেখা পড়ে আপনার মনে হলো মার্কস মানবতাবাদী? এর উপর আবার শ্রেষ্ঠত্বের বরমাল্যও চাপিয়ে দিয়েছেন। এটা ঠিক সোনার পাথরের বাটির মত মানবতাবাদী-কমি্উনিষ্ট ধারা আছে, বাংলাদেশেও আছে। পার্টী অফিসে সভাপতির চেয়ারের পিছনের দেয়ালে UN Human Rights Charter বান্ধায় টাঙিয়ে রাখছে। এদের কারবার দেখে মনে হলেও এর দায় মার্কসের উপরে চড়ানো কী ঠিক হবে? তবে আপনি যেভাবে লিখেছেন, "এই পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শোষণমূলক এবং মানবতাবিরোধী রূপ দেখে তিনি ব্যথিত হন –আর এ থেকে সাধারণ বঞ্চিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন" - মার্কসের নামে এর চেয়ে মিথ্যা আবেগী কথা আর হয় না। অনেকের মত আপনার মতে পারে মার্কস প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিককে গুরুত্ব দিয়ে উপরে তুলে ধরার কারণ এরা শোষিত, এই বঞ্চিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য তাঁর যত বিয়োগ-ব্যাথা। এই চিন্তাটা আশ্রমবাসী মানবতাবাদীদের। এর সাথে মার্কসের কোনই সম্পর্ক নাই। তাঁর চিন্তার লজিকে আসন্ন যে কোন সামাজিক বিপ্লবী বদলে সবচেয়ে আপোষহীন লড়াকু হওয়ার সম্ভাবনা একমাত্র প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিকের,তাই তিনি প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিকের কথা বারবার বলছেন। তবে এটা বিপ্লবে গণসমর্থক (Mass) অর্থে, তত্ত্বের সূত্রে যারা বিপ্লবের আসবেন সেই পার্টি ভ্যানগার্ড নয়। তাঁর মানে বিপ্লবের তত্ত্বে যুক্তির সিদ্ধান্ত উল্টা হতেও পারতো। তখন আমরা মার্কসকে পেতাম হয়তো কোন অবস্হাপন্ন শ্রেণীর পক্ষে কথা বলতে।

আরও অনেক পয়েন্ট থাকলে সময়াভাবে আজ এখানেই শেষ করছি।

অভিজিৎ এর ছবি

মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান কী না আপনার এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে আপনি মার্ক্সের চেয়ে স্টালিনের রাশিয়ার কারাগারে থাকা লেখকদের বক্তব্যের দারস্ত হয়েছেন বেশী। উত্তরটা মার্ক্সের নিজের লেখার ভিতরে খুজলে বেশী যর্থাথ হোথ না কী?

আমার মুল প্রবন্ধে মার্ক্সের উদ্ধৃতি একেবারে দেইনি তা নয়। শ্রেনী নিয়ে আলোচনায় কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো থেকে সরাসরি উদ্ধৃতি দিয়েছি। আরো দিয়েছি আমার পূর্ববর্তী কিছু রেস্পন্স-এ। মার্ক্স, এঙ্গেলস সাবার বক্তব্যই। আশা করি সেগুলো দেখেছেন।

মার্ক্স আর মার্ক্সবাদে একটা ফারাক তো আছেই। আবার মার্ক্সবাদ ব্যবহারিকভাবে রাষ্ট্রে চর্চা করতে গিয়ে এর একটা রূপ দাড়িয়েছে,সেই অর্থ এর প্রথম ব্যবহারিক মার্ক্সবাদী রূপ হলো স্টালিনিজম। সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সলঝেনিতসিন এর সমালোচনাকে কতটুকু মার্ক্সের,কতটুকু মার্ক্সবাদের বা কতটুকু স্টালিনবাদের সমালোচনা হিসাবে গ্রহণ করবেন সেই বিচারবোধ আগে নিজের ভিতের তৈরী করতে হবে। নইলে এই আলোচনার কোন মানে হবে না। আলেকজান্দার সলঝনেতসিনের মার্ক্সবাদকে unscientific বলার কারণে আমাদেরকেও মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান কী না - এভাবে প্রশ্ন তুলতে হবে এটা কোন কাজের কথা না। বিশেষত আলেকজান্দার সলঝনেতসিনের মার্ক্সবাদ সম্বন্ধে ধারণা - যখন আপনার বরাতে, Marxism, a primitive superficial economic theory,- এরকম।

মার্ক্স আর মার্ক্সবাদের মধ্যে ফারাক যে আছে তা আমি জানি। মার্ক্স তার ক্যাপিটাল এবং কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোতে কি বলেছিলেন তা জানার পাশাপাশি মার্ক্সবাদের প্রয়োগ সারা বিশ্বে কিভাবে করা হয়েছিলো সেটাও দেখতে হবে। মার্ক্সবাদের প্রয়োগ কেমন হয়েছিল – সেটা বাদ দিলে কোন আলোচনাই সম্পূর্ণ হতে পারে না। প্রয়োগের ব্যাপারটা আসবেই। এটা ধর্ম, দর্শন সবকিছুর জন্যই খাটে। ইসলামের আলোচনায় কোরান হাদিস নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি কোরান এবং সুন্নাভিত্তিক রাষ্ট্রের নমুনা হিসেবে সৌদি আরব, আফগানিস্তান, ইরান প্রভৃতি রাষ্ট্রের অবকাঠামো এবং সেখানে মানুষের জীবনযাত্রা আর সামাজাকি অধিকার কিরকম দেওয়া হচ্ছে, নারীদের কেমন ভাবে দেখা হয় - সে আলোচনা কি অপ্রাসংগিক? আমার তো মনে হয় না। আমি জানি স্ট্যালিনের’গ্রেট টেরর’ বা মাওয়ের ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’-এর সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন আপনি বোধগম্য কারণেই আলোচনায় আনতে চান না। কিন্তু আলোচনার স্বার্থে সেগুলো তো আসবেই।

আলেকজান্দার সলঝনিৎসিনের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে মার্ক্সবাদকে unscientific বলা হচ্ছে না। মার্ক্সের দর্শনই এ জন্য যথেষ্ট। আমি উপরে আমার রেসপন্সে অন্ততঃ ১০ টি পয়েন্ট উল্লেখ করেছি। আরেকবার দেখে নিন।

তবে সলঝনিৎসিন কেন মার্ক্সের থিওরীকে primitive superficial economic theory বলেছিলেন তা সামান্য একটি দৃষ্টান্ত দিলেই বোঝা যাবে। তার ‘জার্মান আইডিওলজি’ থেকেই উদ্ধৃত করি । মার্ক্স আদর্শ সাম্যবাদী রাষ্ট্রের উদাহরণ এবং উপমা দিতে গিয়ে বলেছিলেন –

In communist society, where nobody has one exclusive sphere of activity ... society regulates the general production and thus makes it possible for me to do one thing today and another tomorrow, to hunt in the morning, fish in the afternoon, rear cattle in the evening, criticize after dinner, just as I have a mind, without ever becoming hunter, fisherman, herdsman or critic.

দেখাই যাচ্ছে কি সরলভাবে চিন্তা করেছিলেন মার্ক্স। আদর্শ কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে এক্সপার্টিসের কোন গুরুত্বই নেই – আমি সকালে শিকার করব, বিকালে মাছ মারব, সন্ধ্যায় গরু চরাব, আর ডিনারে সমালোচনায় নরকগুলজার করব! আধুনিক বিশ্বের জটিলতা একেবারেই স্পর্শ করেনি। আজকের বিশ্ব মূলত এক্সপার্টিসের যুগ। বিল গেটসকে দিয়ে লাইটনিং বোল্টের পাশে অলিম্পিকে নামিয়ে দিলে কি অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। ঠিক একই অবস্থা হবে আমাকে দিয়ে ম্যারাডোনার মত ফুটবল খেলাতে চাইলে। সলঝনিৎসিন খুব একটা ভুল কিছু বলেননি।

একইসাথে জ্ঞান ও ইজম (আইডিওলজি)তফাত কী? আগে জানতে হবে।মার্ক্স কোন মতবাদ ফেরি করেননি বা মতবাদ দিয়ে যাননি। চিন্তা করার একটা পদ্ধতির কথা বলছিলেন। এই প্রথম একটা চিন্তা বলেছে এটা শেষ নয় একে চর্চা (প্রাক্সিস) করে বাস্তবায়নের ভিতর এর সত্যতা প্রমাণের পথে হবে। আপনিই মার্ক্সকে উদ্ধৃত করে বলছেন, 'এতদিন ধরে দার্শনিকেরা পৃথিবীকে কেবল ব্যাখ্যাই করেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল একে পরিবর্তন করা।'। এটা ফয়েরবাখ সম্পর্কে মার্ক্সের ১১ নম্বর থিসিস। দেখুন তো, বুঝতে পারেন কী না - দার্শনিকের সাথে রাজনীতিকের তফাত তিনি কী দিয়ে করছেন? যদি বুঝতে পারেন তবে মার্ক্সের তত্ত্বের ধর্ম বা ধর্মতত্ত্বের সাযুজ্যই খুজা বন্ধ করবেন।

তাই নাকি? আপনাদের ওই এক পুরোন অভ্যাস – কে কি করবে আর কে কি না খুজবে তা নিয়ে অনাবশ্যক জ্ঞান দেওয়া। আমি যদি আপনাকে বলি আপনাদের প্রিয় ‘লাল বই’ গুলো পড়বার পাশাপাশি লুইস ফুয়ের, বার্ট্রান্ড রাসেল, গিবনদের থিসিসগুলোও পড়ুন, তাহলেই বুঝবেন ধর্মের সাথে মার্ক্সিজমের সাযুজ্য কতখানি। উদাহরণ স্বরূপ বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেই –

"In our day, a new dogmatic religion, namely, communism, has arisen. To this, as to other systems of dogma, the agnostic is opposed. The persecuting character of present day communism is exactly like the persecuting character of Christianity in earlier centuries. In so far as Christianity has become less persecuting, this is mainly due to the work of freethinkers who have made dogmatists rather less dogmatic. If they were as dogmatic now as in former times, they would still think it right to burn heretics at the stake. The spirit of tolerance which some modern Christians regard as essentially Christian is, in fact, a product of the temper which allows doubt and is suspicious of absolute certainties. I think that anybody who surveys past history in an impartial manner
will be driven to the conclusion that religion has caused more suffering than it has prevented."

আপনি অবশ্য বলতে পারেন রাসেল লুইস ফুয়েরা কিছুই জানেন না। কে জানে আর কে জানে না তা আমার প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। আমি আমার প্রবন্ধে বলেছি, যে ভাবে কমিউনিজম সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল তা ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত ঈশ্বর কর্তৃক পরকালে স্বর্গের স্বপ্নময় আবেদনের কথা মনে করিয়ে দেয়। ধার্মিকরা যেমন কোরান, বেদ, বাইবেল, হাদিস প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের মধ্যে মহাসত্য খুঁজে পান, এবং মুহম্মদ, যীশু এবং অন্যান্য ধর্মপ্রচারকদের বানীকে শিরোধার্য করে রাখেন, এবং তাদের দেখানো পথেই নিজেদের চালিত করতে চান- ঠিক সেভাবেই কমিউনিস্টরা অনেকটা মার্ক্স, লেলিন, স্ট্যালিন, ট্রটস্কি, মাও এবং তাদের লেখা লাল বইগুলোকে দেখতেন। Das Capital ছিল যেন তাদের কোরাণ কিংবা বেদগ্রন্থ আর Communist manifesto তাদের হাদিস; মার্ক্সবাদ ছিল তাদের ‘রাষ্ট্র ধর্ম’ - ‘Opium of the proletariats’, যে ব্যবস্থায় পুরোহিতগিরি করেন স্ট্যালিন, মাও, চওসেস্কুর মত ‘পয়গম্বরেরা’ ! ধর্মের অনুসারীরা যেভাবে নিজ নিজ ধর্ম প্রতিষ্ঠার নামে ঢালাওভাবে বিধর্মীদের উপর অত্যাচার করেছে, ঠিক তেমনি কমিউনিজম প্রতিষ্ঠা এবং বিপ্লবেরর নামেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, গুলাগে প্রেরণ করা হয়েছে অনেক প্রগতিশীল মানুষকে, ‘শ্রেনীশত্রু’ কিংবা ‘পুঁজিবাদের দালালের’ তকমা এঁটে নির্যাতন করা হয়েছে কিংবা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিক এবং রাজনীতিবিদদের নির্যাতন, নির্বাসন, কারাগারে নিক্ষেপ, শ্রমশিবিরে প্রেরণ, মস্তিস্ক ধোলাই ইত্যাদি সেই মধ্যযূগীয় ধর্মের কৃষ্ণ ইতিহাস ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। ‘কাফের নিধন’, কিংবা ‘নির্যবন করো সকল ভুবন’-এর মত ‘বুর্জোয়াদের খতম কর’ ধ্বনি দিয়ে শ্রেনীহীন সমাজ গড়বার প্রেরণা ছিলো কমিউনিজমের অপরিহার্য শ্লোগান। ক্রুসেড, জ্বিহাদ ধর্মযুদ্ধের মতই ছিলো তাদের এই শ্রেনীসংগ্রামের লড়াই। এর প্রতিটি বাক্যই ঠিক। পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে একটু মুখ তুলে তাকান। আপনি ইচ্ছে করলে Daniel G. Jennings এর Communism is Religion প্রবন্ধটিও পড়ে দেখতে পারেন।

আপনি লেখায় মার্কসকে "শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী দার্শনিক, রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিশেষজ্ঞ" বলে পরিচয় করিয়ে কথা শুরু করেছেন। কী পড়ে মার্কসের কোন লেখা পড়ে আপনার মনে হলো মার্কস মানবতাবাদী?

মানবতাবাদী বলা হয়েছে 'Humanist' শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে। উইকিপেডিয়ায় কার্ল মার্ক্সের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে এভাবে-

Karl Heinrich Marx (5 May 1818–14 March 1883) is the nineteenth-century philosopher, political economist, sociologist, humanist, political theorist, and revolutionary, who is the Father of Communism.

মানবতাবাদী শব্দটির অনেক অর্থ আছে। 'Marxist humanism' নামে মার্ক্সিজেমের একটা স্বীকৃত শাখাই আছে। এই লেখাটিও আপনি পড়তে পারেন। আমি সেই অর্থে 'মানবতাবাদী' শব্দটি ব্যবহার করেছি যে অর্থে দিদেরা প্রয়োগ করার কথা বলেন। আমি আমার প্রবন্ধে তা ব্যাখ্যা করেছি।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

P Munshe [অতিথি] এর ছবি

আমি যদি লিখি অভিজিত একজন ছাগল। আবার কেউ একজন আমাকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করল অভিজিতের কোন লেখা পড়ে আমার এটা মনে হয়েছে, জানাতে। অভিজিত সম্পর্কে অন্যের, অন্য এক লেখকের লেখা উদ্ধৃতি করে এবার আমি উত্তর দিলাম, অভিজিত একজন ছাগল।
এতে আসলে ব্যাপারটা দাড়ালো আমি নিজেই একটা ছাগল।
এখন পাঠক বলেন, এই তর্কের পরিণতি কী হতে পারে। কেউ কী এরপর এই তর্কে সামিল হতে চাইবেন। এটা কমপিউটার রিসোর্স আর সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কী?
কোন লেখকের লেখা পড়ে অভিজিতের প্রথমে মনে হতেই পারে মার্কস একজন মানবতাবাদী। এই মনে হওয়াটাই শেষ কথা নয়। একে যাচাই করতে হবে। প্রথমত দুজায়গা থেকে। এক, ঐ লেখকের যুক্তি কী ছিল তা অনুসরণ করে। দুই, মার্কসের মূল লেখা পড়ে। দুজায়গাতেই অভিজিতকে নিজেই বিচার করে দেখতে হবে; তবেই ওটা নিজস্ব অবস্হান বলে অভিজিত দাবী করবে। কে কোথায় কার সম্পর্কে কী বললো সেটা নিয়ে দৌড়াদুড়ি শুরু করার আগে নিজে এই বিচার করে রাখতে হবে। বিচারের ক্ষমতাও অর্জন করতে হবে। যদি মনে হয় এটা সম্ভব হচ্ছে না তাহলে বুঝতে হবে এটা তাঁর কাজ না।
এমনকি আবার নিজের ঐ বিচার পরবর্তী অবস্হানও একধরণের উন্মুক্ত অবস্হান হিসাবে নিতে হবে। নতুন কোন চ্যালেজ্ঞমূলক ধারণার খবর মিললে আবার যাচাই এর পথ ধরতে হবে। টিকে গেলে ওটাই তাঁর অবস্হান। নিজের চিন্তা আগিয়ে নেয়া, একে সবসময় স্বচ্ছ রাখার পথ -এটাই বলে আমি মনে করি।
মার্কস কেন মানবতাবাদী নয় এর স্বপক্ষে ব্লগের সংক্ষিপ্ত পরিসরের কথা মনে রেখে মার্কসের বরাতে বলবার চেষ্টা করেছি। এটাকে একজামিন না করে উইকিপিডিয়ার কিংবা 'Marxist humanism' এর ধারা উল্লেখ করে একে মোকাবোলার রাস্তাটা ঠিক কিনা পাঠক বিচার করবেন। আমি মনে করি এটা ব্লগে যারা সময় দেই তাদের প্রতি অবিচার। ব্লগকে মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রদল-ছাত্রলীগের ঝগড়া-বিতর্কের লেভেলে নামাতে চাইলে আমি সত্যি অসহায়।
আমি বলেছিলাম, "মার্ক্স আর মার্ক্সবাদে একটা ফারাক তো আছেই। আবার মার্ক্সবাদ ব্যবহারিকভাবে রাষ্ট্রে চর্চা করতে গিয়ে এর একটা রূপ দাড়িয়েছে,সেই অর্থ এর প্রথম ব্যবহারিক মার্ক্সবাদী রূপ হলো স্টালিনিজম। সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সলঝেনিতসিন এর সমালোচনাকে কতটুকু মার্ক্সের,কতটুকু মার্ক্সবাদের বা কতটুকু স্টালিনবাদের সমালোচনা হিসাবে গ্রহণ করবেন সেই বিচারবোধ আগে নিজের ভিতের তৈরী করতে হবে। নইলে এই আলোচনার কোন মানে হবে না"।
আপনি উত্তরে বললেন, "মার্ক্স আর মার্ক্সবাদের মধ্যে ফারাক যে আছে তা আমি জানি"।
আপনি কী জানেন অথবা জানেন না - এটা আমার বিষয় ছিল না। মার্কসবাদ বিজ্ঞান কী না - এই ছোট পরিসরে তা আলোচনা শুরু করার আগে আলোচনাকে আমাদের সবার জন্য বেশী ফলদায়ক, কাজের করার জন্য কোন ফ্রেম আগে ঠিক করে নিতে পারি কীনা, এটাই ছিল আমার বলার উদ্দেশ্য। যাতে একটা গঠনমুলক গুছানো আলোচনা আমরা সবাই অংশগ্রহণ করতে পারি। এজন্য বলেছিলাম, একটা "বিচারবোধ আগে নিজের ভিতের তৈরী করতে"। ধরা যাক, "মার্কসবাদ বিজ্ঞান কী না" এই আলোচনাটা আমরা সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সলঝেনিতসিন এর সমালোচনাগুলোর দিক থেকে করবো - এটাই আমাদের বিষয়, বিচার্য বিষয়। এরপর ঠিক করে ফেলতে চাই; এই মার্কসবাদ বলতে এই বিচারটা কাকে কেন্দ্র করে করবো? মার্কসের মুল পাঠ্যকে অথবা মার্কসের মৃত্যুর পর সাধারণভাবে যা মার্কসবাদ নামে চর্চা হয়েছে তাকে অথবা স্টালিনের হাতে চর্চায় যে মার্কসবাদের রূপ দাঁড়িয়েছে যাকে আমি স্তালিনিজম বলেছি তাকে - কোনটা? এক্ষেত্রে আমার যুক্তি ছিল প্রথমটা অর্থাৎ খোদ মার্কস মূল পাঠ্য। তবে, একে কেন্দ্র করে কখনও চর্চার-মার্কসবাদ সাব-রেফারেন্স হিসাবে আসবে হয়তো। এজন্য বলছিলাম এই ভাগগুলো মেনে না নি্যে আগাতে, "নইলে এই আলোচনার কোন মানে হবে না"।
কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে, ভুল জায়গায় এসে পড়লাম কী না? পাঠকরা আমাকে আস্বস্ত করবেন।
সত্যি বলতে কী আজ সকালে আরিফের লেখা পড়বার পরে আমি কিছুটা আলো দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হয়েছে।

এখন উঠতে হবে। পোষ্টে এসে গেছে এমন বিস্তর বিষয় এখানে আমি টাচ করতে পারলাম না - এটাকে অভিজিতের মত কেউ "আপনি বোধগম্য কারণেই আলোচনায় আনতে চান না" অভিযোগের বিষয় করবেন না - আশা রাখি।

অভিজিৎ এর ছবি

আপনার এত উত্তেজিত হবার তো কোন কারণ দেখছি না। ধর্মবাদীরা যেমন ধর্মের সামান্যতম সমালোচনাই নিতে পারেন না, আপনার অবস্থা হয়েছে তেমনি। আমি বুঝি আপনার উষ্মার কারণটুকু।

আপনি যে প্রশ্নগুলো করেছেন সেগুলোর জবাব আমি দিয়েছি। আর তার উত্তরে আপনি শুরুই করেছেন "ছাগল" প্রসঙ্গ টেনে এনে। আমি এর জবাব দেওয়ার আদৌ প্রয়োজন দেখছি না। আপনি "ভাগগুলো মেনে না নি্যে আগাতে" চান তো আগান, সবাই আপনার মত বিশ্লেষন করবে তাও ত সমীচীন নয়। আমি এইব্লগে সুস্থ বিতর্ক প্রত্যাশী, অনাবশ্যক উষ্মা নয়।

আপনার কল্যান হোক।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

স্নিগ্ধা এর ছবি

তাঁর মানে বিপ্লবের তত্ত্বে যুক্তির সিদ্ধান্ত উল্টা হতেও পারতো। তখন আমরা মার্কসকে পেতাম হয়তো কোন অবস্হাপন্ন শ্রেণীর পক্ষে কথা বলতে।

প্রিয় P Munshe,

এ কথাটা একটু ব্যাখ্যা করবেন কি? তৎকালীন ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে (মার্ক্সের) যুক্তি অনুযায়ী সামাজিক বিপ্লবে প্রলেতারিয়েতদের জয়ী হওয়ার কথা - যদি প্রেক্ষাপট অন্যরকম হয় বা হতো, তাহলে সেটার জন্য যথাযথ যুক্তি অনুসরণ করে ধনিক শ্রেণী বা পূঁজিবাদী শ্রেণী জয়ী হতে পারে, এটা বলতে চাইছিলেন কি?

এই প্রথম একটা চিন্তা বলেছে এটা শেষ নয় একে চর্চা (প্রাক্সিস) করে বাস্তবায়নের ভিতর এর সত্যতা প্রমাণের পথে হবে।

আমি এর আগে এক মন্তব্যে লিখেছিলাম - মার্ক্সবাদ একটা এ্যানালিটিকাল ফ্রেইমওয়ার্ক, আপনিও বোধহয় তাইই বলছেন। কিন্তু আপনি এই বাক্যে "এটা শেষ নয়" বলতে ঠিক কি বুঝিয়েছেন ?

ধন্যবাদ।

P Munshe [অতিথি] এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। এত দ্রুত স্পষ্ট করার সুযোগ দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেবার জন্য।
যদি প্রশ্নটা এভাবে করি, শ্রমিকরা খুব (বা সবার চেয়ে) দু:খ কষ্টে আছে, অবহেলিত, শোষিত - সে বিবেচনা থেকে মার্কস কী তাদের পাশে দাঁড়িয়ে মুক্তির দলিল লিখতে গিয়ে বারবার প্রলেতারিয়েত বা শ্রমিকের কথা বলেছিলেন? না ব্যাপারটা দু:খ কষ্ট কীনা - সেটা তাঁর বিবেচনার বিষয়ই ছিল না? আবার, অন্য কোন বিবেচনা ওখানে যদি থেকে থাকে তবে সেই বিবেচনাটাই বা কী?
আমার মনে হয় এর উত্তরটা দিতে পারলে আমার কথা পরিষ্কার করতে পারব।
উত্তর হলো - না, সেটা বিবেচনার বিষয় ছিল না। আর সমাজে কারো দু:খ কষ্টে কিছু করার কর্তব্যবোধ - এখান থেকে তিনি কখনই তাঁর চিন্তা, কাজ ও তৎপরতা শুরু করেন নাই। এখন তাহলে প্রশ্ন হলো, তাঁর বিবেচনার ভিত্তি তাহলে কী ছিল? আবার এটা কী আমার দাবী না উনি নিজেই পরিষ্কার করে গেছেন?
তখনকার ইউরোপীয় সমাজে ১৮৪৮ সালে কমিউনিষ্ট মেনিফেষ্টো প্রকাশের এর পর থেকেই মার্কস মূলত দুটো বিষয় বিবেচনা করে শ্রমিকের (কমিউনিষ্ট মেনিফেষ্টোর ভাষায় ওয়ার্কিং ক্লাস) গুরুত্ত্ব বুঝাবার, বুঝাবার চেষ্টা করে গেছেন: ১। পুঁজির স্বভাব চরিত্র এই ফেনোমেনার দিক থেকে, ২। আসন্ন বিপ্লবে কোন শ্রেণী আপোষহীন লড়াকু (radical) হয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য ঐ কালে সম্ভাবনাময় (potential) হয়ে উঠছে - সেদিক থেকে।
প্রথমটার প্রসঙ্গে বলা যায়, মার্কসের জার্মান ভাবাদর্শ থেকে শুরু করে পুঁজির তৃতীয় খন্ড পর্যন্ত সবখানেই একই সূর - পূঁজি বিকশিত হওয়া মানে একই অনুপাতে প্রলেতারিয়েতের হাজির ও বিকাশ - এই ধারণার উপর দাঁড়িয়ে কথা বলে গেছেন। এখানে কমিউনিষ্ট মেনিফেষ্টো থেকে একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি। বলছেন, But not only has the bourgeoisie forged the weapons that bring death toitself; it has also called into existence the men who are to wield those weapons -- the modern working class -- the proletarians. In proportion as the bourgeoisie, i.e., capital, is developed, in the sameproportion is the proletariat, the modern working class, developed -- a class of labourers, who live only so long as they find work, and who find work only so long as their labour increases capital.
একই বইয়ে আর এক জায়গায় বলছেন,
Society as a whole is more and more splitting up into two great hostilecamps, into two great classes, directly facing each other: Bourgeoisie andProletariat.
প্রথম উদ্ধৃতিতে শেষে আমার করা বোল্ড লাইনটা দেখুন, পুঁজি ও শ্রম প্রসঙ্গে - পুঁজি বলতে এখানে, ক) সম্পত্তির বিশেষ রূপ, খ) সমাজে নির্ধারক সম্পর্কের রূপ, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক, গ) নিজের পুঞ্জিভবন ও আত্মস্ফীতিকরণ স্বভাব - এই সবদিক থেকে বুঝতে হবে, পুঁজি মানে কেবল টাকা বা সম্পত্তি বুঝলে হবে না। আর ওই সম্পর্কের মধ্যে শ্রম মানে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরীর উপায়, নিরবিচ্ছিন্ন পুঁজির (সব অর্থেই) পুর্নজন্ম ও স্ফীতি।
কাজেই এটা গরীব বা শ্রমিকের সবার চেয়ে দু:খ কষ্টে থাকা দেখে মমতার কোন বিষয়ই নয়। এটা কোন বিবেচনার বিষয় নয়।
এই হলো প্রথমটার প্রসঙ্গে কথা। এর চেয়ে অল্প কথায় বলার ক্ষমতা আমার হলো না। তবু মুলকথাটা বুঝাতে পারলাম কী না জানি না।
দ্বিতীয়টার প্রসঙ্গে সংক্ষেপে সারবো। মুল কথা আগেই বলে ফেলেছি, - আসন্ন বিপ্লবে কোন শ্রেণী আপোষহীন লড়াকু (radical) হয়ে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার জন্য সম্ভাবনাময় (potential) হয়ে উঠছে- সেই দিক থেকে এই বিবেচনা। তবে এই শ্রমিক আবার as it is যেভাবে উঠে আসছে তাতে হবে না - বলে আরও কথা তাঁর ছিল। (শ্রেণী নিয়ে বিস্তর উদ্ধৃতি দিয়েও পোষ্টের মুল লেখক অভিজিত কূলকিনাড়া করতে পারেননি। এখানে তবু সংক্ষেপে কিছু প্রশ্ন তুলে আজ বিদায় নেব।) কেউ এদের জন্য কিছু না করতে এলেও এরা দল বাঁধবে। মার্কস এঁদেরকে ওয়ার্কিং ক্লাস পার্টিও বলে ফেলেছেন। আবার কমিউনিষ্ট মেনিফেষ্টো থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ওর তৃতীয় ভাগের শিরোনাম: প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিষ্ট। এর প্রথমেই আছে,
The Communists do not form a separate party opposed to other workingclass
parties.
এখন কমিউনিষ্টরা আবার কে? আবার দেখা যাচ্ছে, শিরোনামই ভাগ করে বলছেন, প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিষ্ট। এবং কমিউনিষ্টরা যেন ওয়ার্কিং ক্লাস পার্টির বিরোধী কোন পার্টি না করে এই প্রস্তাবই বা রাখছেন কেন? মার্কস শ্রেণী বলতে কী বুঝতে বলেছেন তাঁর উত্তর ওখানে আছে।

আজ এখানেই শেষ করছি।

স্নিগ্ধা এর ছবি

আমার আসলে আরো দু'একটা প্রশ্ন ছিলো, কিন্তু বোকার মত প্রশ্ন করে ছাগল টাগল হিসেবে আখ্যায়িত হবার ভয়ে আর করছি না। আমি ভয়ানক কা-মানুষ হাসি

P Munshe [অতিথি] এর ছবি

অত্যন্ত দু:খিত। খারাপ লাগছে। আমি তো আমাকেই ছাগল বলেছি! তাই না কী? ভেবে দেখুন।
তবু আপনার কথা শুনার পর মনে হচ্ছে, ওটাও বোধ হয় না বললে চলতো।
আমি কোন প্রশ্নকে বোকার প্রশ্ন হিসাবে নেই না। বরং মনে করি, মেধাবী না, আপাত সরল প্রশ্নের ভিতরেই আসল প্রশ্ন আছে। ঐ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হলেই নিজের কাছে প্রমাণ হয় আসলে যা বলছি তা কতখানি ঠিক বলছি।
আমি আপনার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চাই। আপনি নির্দ্ধিধায় প্রশ্ন করুন, আপাত বোকার মত প্রশ্ন মনে হলেও।
আমার আগের কোন লেখার/আচরণের কারণে আপনাকে আহত করে থাকলে মাফ করে দিয়েন। আপনি আমাকে একটা শিক্ষা দিয়েছেন। আমি গ্রহণ করেছি।
আপনি লিখেন নাই, আমার আগের উত্তরে অসন্তোষজনক ছিল কী না।

স্নিগ্ধা এর ছবি

পুঁজি বলতে এখানে, ক) সম্পত্তির বিশেষ রূপ, খ) সমাজে নির্ধারক সম্পর্কের রূপ, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক, গ) নিজের পুঞ্জিভবন ও আত্মস্ফীতিকরণ স্বভাব -

পূঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক মানে কি re/organization of social relations (economic and others as well) within capitalism, এটা বোঝালেন?

সমাজে নির্ধারক সম্পর্কের রূপ তাহলে কি? আলাদা কিছু?

প্রলেতারিয়েত - একটা শ্রেণী, আপোষহীন এবং র‌্যাডিকেল, সর্বোচ্চ পোটেনশিয়াল সম্পন্ন, আর কমিউনিস্ট - একটি পার্টি, র‌্যাডিকেল, রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন, প্রতিনিধি, পূঁজিবাদের পুনর্বিকাশের প্রতিবন্ধক... ?

মার্ক্স 'শ্রেণী' বলতে কি বুঝিয়েছেন? কি বৈশিষ্ট্য তার?

But not only has the bourgeoisie forged the weapons that bring death toitself;

পোলানিও ক্যাপিটালিজমের পুঞ্জীভূত হবার প্রবণতা এবং তা থেকে আত্মধ্বংসী/ কন্ট্রাডিকটরি বৈশিষ্ট্যের কথা বলে গিয়েছেন।

সময় নিয়ে এসব naive প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য আগেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি হাসি

p munshe [অতিথি] এর ছবি

চার পাচ ঘন্টা ধরে লেখার পর সব গায়েব। মেল করেছি, উত্তরের অপেক্ষায়।

P Munshe [অতিথি] এর ছবি

"পূঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক মানে কি re/organization of social relations (economic and others as well) within capitalism, এটা বোঝালেন?"
হ্যা তাই। আপনি আমার ইঙ্গিতটা ঠিকই ধরেছেন।
তবে, তবে বলে কিছু সাবধানতামুলক কথা বলবো।
১। দুনিয়াতে কেউ আগে থেকে জেনে বুঝে সচেতন পরিকল্পনা করে re/organization of social relations ঘটায় নাই; কমিউনিষ্টরাই সর্বপ্রথম এই উদ্যোগর উদ্যোগী। এতে ভুলত্রুটি, ব্যর্থতা অবশ্যই আছে,হয়েছে,সাফল্যও আছে।

২। ইউরোপের সামাজিক বিকাশ প্রেক্ষিতে মার্কস যখন এই উদ্যোগ নেবার তাগিদ দিচ্ছেন তখন তাঁর সামনে ওখানকার ইতোমধ্যে নির্ধারক সামাজিক সম্পর্ক হিসাবে পূঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বিকশিত। এর মানে আমি বলছি,পূঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক-মূলক উৎপাদনই দুনিয়ায় মানুষের উৎপাদনের ইতিহাসে একমাত্র রূপ নয়। সবসময় এটা একরকম ছিল না,ফলে সামাজিক সম্পর্কও সবসময় একরকম নয়।
৩। আমার নির্ধারক বলার বা শব্দ ব্যবহারের পিছনে দুইটা কারণ আছে। সমাজে উৎপাদন কীভাবে সংগঠিত হচ্ছে এর ধরণই প্রত্যক্ষে অপ্রতক্ষে নির্ধারণ করে দেয় বাকী সব সামাজিক সম্পর্ক কেমন হবে। মার্কসের ষ্টাডির বিষয় ছিল,তাঁর সময়কালসহ পিছনের সময়কালে সামাজিক উৎপাদন সম্পর্ক কেমন ছিল। সামাজিক উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে তার ফোকাস ছিল সম্পত্তি-সম্পর্ক,তিনি সম্পত্তির রূপের বদলের মধ্যে একে ধরার চেষ্টা করছিলেন। যেমন শেয়ার মার্কেটের একখানা কাগজ কখন কী পরিস্হতিতে উৎপাদন সম্পর্কের কী বৈশিষ্টের কারণে আজ সম্পত্তি বলে গণ্য হয়।
মোটা দাগে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পত্তির আগে তিনি পিতৃতান্ত্রিক,দাস,এষ্টেট বা সামন্ত -মূলক সম্পত্তির রূপ তিনি দেখিয়েছিলেন। এইসব সম্পত্তি রূপগুলো করসপনডিং যে সামাজিক উৎপাদন সম্পর্ক তৈরি করেছিল যেটা প্রকারন্তরে অন্য সব সম্পর্কের নির্ধারক হয়ে বিরাজ করত - এগুলোর দিকেই তিনি আমাদের নজর নিয়ে গেছেন। এই হচ্ছে নির্ধারক বলার একটা অর্থ। দ্বিতীয় অর্থটা হলো:সম্পত্তি বিভিন্ন রূপ ও সে মোতাবেক সামাজিক উৎপাদন সম্পর্কের কথা যা উপরে বললাম - এগুলো discrete অর্থে ছাড়াছাড়া কমপারমেনটালাইজড একটার শেষে আর একটা এভাবে কোন একটা সমাজে ঘটা উৎপাদন সম্পর্ক নয়। সবসময়ই একটা উৎপাদন সম্পর্ক নিঃশেষ হবার আগেই পরেরটার আবির্ভাব ও যাত্রা শুরু হয়েছে।এষ্টেট বা সামন্ত-মূলক সম্পত্তির রূপের সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই পুঁজিতান্ত্রিক সামাজিক সম্পর্কের আবির্ভাব ও যাত্রা শুরু হলেও সে তখনও নির্ধারক (dominant) নয়। পরে সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়ে নিজেকে নির্ধারক জায়গায় বসানোর ঘটনাটা ঘটে। আবার লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো নতুন উৎপাদন সম্পর্ক এসে যাওয়ার মানে এই নয় যে পুরানো উৎপাদন সম্পর্ক আর তার প্রভাবে গড়ে উঠা সব সামাজিক সম্পর্ক আচার সাংস্কৃতি সব সহসাই উধাও হয়ে যায়। সময় লাগে বরং আন্ডার কারেন্ট বা অ-মুখ্য স্রোতধারা হিসাবে অনেক কাল সমাজ বয়ে বেড়ায়। বিশেষত পুরানো সাংস্কৃতিক প্রভাব যা দাগ সহজে মিটে না, সচেতনভাবে ভাবাদর্শগত লড়াই না চালালে তা ক্ষতির কারণ হতে পারে। আপনি প্রশ্ন রেখেছিলেন,"সমাজে নির্ধারক সম্পর্কের রূপ তাহলে কি? আলাদা কিছু?"। আশা করি এখনকার মত একটা উত্তর এবার হয়েছে।
পরের প্রসঙ্গ:
মার্ক্স 'শ্রেণী' বলতে কি বুঝিয়েছেন? কি বৈশিষ্ট্য তার?
বেশীর ভাগ মানুষ মার্কসের শ্রেণী বলতে যা বুঝেছে ওটা ইকোনমিক অর্থে। এর আর এক এবং মূল অর্থ রাজনৈতিক অর্থে শ্রেণী। মার্কসও তার লেখায় কোথাও কোথাও আপাত ইকোনমিক অর্থে বলছেন। তবে ওর ভাবগত অর্থও রাজনৈতিক। কথাটা এবার স্পষ্ট করি।

নিজের জন্য শ্রেণী বনাম যা তাঁর ভিতর দিয়ে সম্ভাবনা হয়ে উঠছে- সেই শ্রেণী (class in itself Vs class for itself)।

পুঁজিতন্ত্রের উৎপাদন সম্পর্কের ফলাফলে যে শ্রমিক উঠে আসছে, সে একই স্বার্থের অন্য শ্রমিকের সাথে সংহতি প্রকাশ করবে, নৈকট্যবোধ করবে - শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত হবে। এই শ্রেণী তখনও অর্থনৈতিক অর্থেই শ্রেণী। কারখানা মালিকের পণ্যের মত মূলত তাঁর পণ্য শ্রম ও এর মজুরী নিয়ে বার্গেন বা দরদাম করবে,মজুরি বাড়ানোর সংগ্রাম করবে। এই সংগ্রামের কোন শেষ নাই। কোনদিনই সে জিততে পারবে না।
এবার কমিউনিষ্টের সাথে তার দেখা হলেই অগ্রসর চিন্তা ভাবনা, সমাজের সামগ্রিক হালহকিকতের খবর যার কাছে আছে (ধরে নিচ্ছি এমন অগ্রসরের দল একটা ভ্যানগার্ড পার্টি ওখানে আছে)সে তাঁকে শ্রেণী সচেতন করে তুলবে, ফলে সে রাজনৈতিক শ্রেণী হবে, ক্ষমতা নেবার যোগ্যতা সম্পন্ন এবং উপস্হিত ক্ষমতাকে যে চালেজ্ঞ করতে পারে।
এখন এই কমিউনিষ্ট কারখানার ভিতর থেকে আসবে না, সমাজের অন্য অগ্রসর অংশ থেকে আসবে। আপনার আমার এই আলোচনাটা আসরের মধ্যে ঐ ইঙ্গিতটা আছে।একাডেমিক জায়গাটা যদি কখনও ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেই। এর ফলে সমাজের অন্য অগ্রসর অংশকেও শ্রেণী হয়ে উঠতে হয়, হয়ে নাই। সচেতনতাটা গুরুত্ত্বপূর্ণ।
এখানে প্রলেতারিয়েত আর কমিউনিষ্ট এর সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বোঝানোর একটা চেষ্টা করলাম মাত্র।
মার্কসবাদের চর্চায় এধারা আছে যারা কেবল ইকোনমিক অর্থে শ্রেণী বুঝে অনেক ঝামেলা পাকিয়েছে। যেমন কোন কারণে আমি বাক্য লিখলাম " এই সরকার গরীব শ্রেণীর সরকার নয়"। এতে আপনি চাইলে ইকোনমিক অর্থে শ্রেণী বুঝতে পারেন। আবার আপনার ক্ষমতা থাকলে আর আমি যদি ঐ বাক্যে আসলেই রাজনৈতিক শ্রেণী বুঝিয়ে থাকি- আপনি বুঝবেন।

তৃতীয় প্রসঙ্গ:পুঁজির এ্যকুমুলেশন
আপনিও যে উদ্ধৃতিটা দিয়েছেন, "পোলানিও ক্যাপিটালিজমের পুঞ্জীভূত হবার প্রবণতা এবং তা থেকে আত্মধ্বংসী/ কন্ট্রাডিকটরি বৈশিষ্ট্যের কথা বলে গিয়েছেন"। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে;;;;;;;;;

রণদীপম বসু এর ছবি

অভিজিৎ দা,
গতকাল কিছুতেই মন্তব্য পোস্ট করতে না পেরে, তাও ঘণ্টা দেড়েক বিফল চেষ্টার পর সমস্যা জানিয়ে মডারেটরকে মেইল করেছিলাম। এবং মেইলের কপি আপনাকে দিয়েছিলাম। কেননা, মেইলে আমার ওই মন্তব্যটার একটা সারসংক্ষেপও লিখে দিয়েছিলাম। এখন এ ব্যাপারে আরো মজার ও চিন্তাশীল অনেক মন্তব্য এসে গেছে।
এখন তা লিখছি মূলত সিস্টেম কাজ করছে কি না পরিক্ষা করে দেখার জন্য।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

রণদীপম বসু এর ছবি

আচ্ছা, মার্কস কি কখনো বলেছিলেন এটা বিজ্ঞান ? তিনি একটা সম্ভাব্য প্রয়োগ উপযোগী তত্ত্বীয়দর্শন তৈরি করেছেন। এবং তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সমকালীন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহার করেছেন। হাইপোথিসিস আকারে একটা ধারণা তৈরি করেছিলেন। সম্ভাব্যতাগুলো চিহ্ণিত করার চেষ্টা করেছিলেন। মোট কথা পূর্ববর্তী দর্শনগুলো থেকে অগ্রবর্তী চিন্তাশ্রয়ী এই আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক দর্শনের কারিশমায় অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই তৎপরবর্তী প্রয়োগবাদী চিন্তাবিদ তথা বিপ্লবী রাজনীতিক বুদ্ধিজীবীরা প্রভাবিত হয়ে তারা আবার নতুন করে কৌশলগত অবস্থান নিয়েছিলেন। অর্থাৎ বিরাট একটা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার জন্য এই দর্শনসঞ্জাত একটা তত্ত্ব এরা উপস্থাপন করেন। যাকে আমরা লেনিনবাদ, মাওবাদ ইত্যাদি বলছি।
এখানে মার্কসবাদ হচ্ছে একটা দর্শন। স্থান কাল পাত্র ভেদে এর ব্যাখ্যার ভিন্নতা আসতে পারে, পরিবর্তিত অনুঘটকের প্রভাবে এর ফলাফল পাল্টে যেতেই পারে। হয়তো লক্ষ্যাভিমুখীনতাও হারাতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। এটাই তো দর্শন। ফলে আরো অগ্রবর্তী দর্শনের আবির্ভাবের সম্ভাবনা চলে আসে।
সমস্যা হচ্ছে সম্ভবত লেলিনবাদ মাওবাদ এগুলোকে বিজ্ঞান অভিধা লাগিয়ে রক্ষণশীলতার বেড়ি পরিয়ে দেয়া হয়েছে। ধর্ম আর অবতারবাদের মতো অপরিবর্তনশীলতার মোড়ক দিয়ে উৎকৃষ্ট আরো মতবাদের সম্ভাবনাকে আটকে দিয়ে স্বতসিদ্ধ বানানোর বালখিল্য চেষ্টা করা হয়েছে।
কোনকিছুর সাথে বিজ্ঞান শব্দটি বসিয়ে যখন সাজ সাজ রব ওঠানো শুরু হয়, তখনই ধরে নিতে হয় যে ওখানে বিজ্ঞানের ঘাটতি রয়েছে। এজন্যেই বোধকরি ধর্মের ধ্বজাধারীরাও এ কাণ্ডটা সাধ্যমত করে যাচ্ছেন।
অতএব মার্কসবাদকে বিজ্ঞান বলা মানে মার্কসকে অপমান করা। এটাকে একটা দর্শন হিসেবেই আমরা অভিহিত করলেই লেঠা চুকে যায়। হেগেল থেকে যেমন মার্কস, তেমনি মার্কস থেকে আরো অগ্রবর্তী কোন দর্শনের উৎপত্তি না হওয়াতক আমরা একে আপাত চর্চার সদর্থক বিষয় হিসেবে নিতে পারি।

সত্যি কথা বলতে কি, আপনার অসম্ভব পরিশ্রমী এই চমৎকার লেখাটা
খুব ভালো লেগেছে।সাথে সাথে মন্তব্যগুলোও। আশা করছি এ প্রেক্ষিতে আরো অনেকের অনেক চিন্তাশীল ও আকর্ষণীয় মন্তব্য এতে যোগা হবে।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

এই বিতর্ক থেকে দূরেই থাকতে চেয়েছিলাম। তবে অভিজিৎ-দার অনুরোধে দুই-একটা লাইন লিখতে হয়। আমি মার্ক্স নিয়ে আলাদা করে পড়াশোনা করিনি, তাই আমার ধ্যান-ধারণায় ভূল থাকতেই পারে। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

অল্পের মধ্যে যতোটুকু বুঝি তা হলো মনুষ্য-চরিত্রকে অগ্রাহ্য করে কোন দর্শন, শাসনব্যবস্থা বা সমাজব্যবস্থা বেশীদিন চলতে পারে না। চললেও চলতে পারে ঢের জুলুম আর জবরদস্তির মাধ্যমে। মনুষ্যচরিত্র বলতে এখানে প্রতিটি মানুষের স্বার্থান্বেষণ, বা স্বার্থপরতার কথা বলছি। খেয়াল রাখবেন যে আমি 'স্বার্থান্বেষী' শব্দটা একেবারেই নেগেটিভ অর্থে বলছি না। এটা মানব-চরিত্রের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই বলছি।

শুধুমাত্র বৈরাগী বা বিশাল মনের মানুষ ছাড়া - যারা ব্যতিক্রম, কখনোই নিয়ম নন - আমরা সবাই কম-বেশী আমাদের নিজের ভালোটা আগে বুঝি, এবং আগে চাই। নিজেরটা হয়ে গেলে ভাইয়েরটা, কাজিনেরটা, আত্মীয়েরটা আর বন্ধুরটা। ব্যক্তিজীবন সংসারজীবন কর্মজীবনে এভাবেই কাটে অধিকাংশ মানুষের।

মার্ক্সের যেই বড় আইডিয়া - সামষ্টিক মালিকানা, বা কালেক্টিভ ওনারশিপ - সেটা এখানেই মার খায় বলে আমার মনে হয়। যেই কারখানা সবার, সেই কারখানা কারোরই নয়। যেই খামার সবার, সেই খামার কারোর নয়। যেখানে পাশের মানুষের থেকে ডবল খেটেও আমি একই বেতন পাবো, একই পরিমাণ চাল ডাল পাবো, সেখানে ডবল খাটুনি করার কোন ইন্সেন্টিভ আমার নেই। মার্ক্সের একটা মূল কথা - from each according to his abilities, to each according to his needs - সেটা একদমই ভ্রান্ত। বাস্তব বিচারে দেখা যায় যে নিজের এবিলিটি খসিয়ে অচেনা লোকের নীড মেটাতে খুব বেশী লোক পারে না, বা পারতে চায়ও না।

মূল গলদটা এখানে। মার্ক্স আর তার অনুসারীদের একটা বড় এসাম্পশান যে একটি প্রকৃত কমিউনিস্ট দেশে প্রতিটি মানুষ প্রলেতারিয়ের জন্যে অকাতরে কাজ করে যাবে, সমষ্টির সুখ ও সমৃদ্ধির জন্যে খুশী-মনে সবাই ত্যাগ বিসর্জন মেনে নেবে - সেই এসাম্পশানটার সত্যতা নিয়ে মার্ক্সিস্টরা কি ভাবেন? আমার কাছে এই এসাম্পশানটা একেবারেই অবাস্তব মনে হয়। বরং ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন, হাট-বাজার - এইসব মানুষ করে আসছে সভ্যতার শুরু থেকে, খ্রীস্টের জন্মেরও কয়েক হাজার বছর আগে থেকে, প্রায় প্রতিটি দেশে এবং প্রতিটি সমাজে। এটাই কি বলা ঠিক না তাহলে যে ব্যক্তি মালিকানা, ব্যক্তি প্রচেষ্টা, entrepreneurship (যেগুলোকে ঘৃণ্য পুঁজিবাদী সিস্টেমের ভিত্তিও বলা যেতে) - এগুলোই মানুষের কাছে আরো বেশী সহজাত?

স্বীয় স্বার্থান্বেষী মানুষকে প্রকৃত অর্থে selfless করতে পারাটা একটা অসাধ্য সাধণ করার মতোই। এটা সম্ভব নয়। আর যেই সিস্টেম মানবচরিত্রের এই জাতীয় perfectibility-র উপর নির্ভর করে, সেই সিস্টেম বাস্তবে আদৌ কাজ করবে না। Perfect behaviour বা perfect mindset বা perfect motivations - এইসব জোর জবরদস্তি করে আরোপ করতে গেলে কি হয়, তা আমরা যুগে যুগে দেখেছি, ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে কদিন আগের আফগানিস্তানে তালেবান শাসন পর্যন্ত।

p.s. মুস্তাকী না দাদা, মুস্তফী!
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

অভিজিৎ এর ছবি

ধন্যবাদ ভাই, অনুরোধে 'ঢেঁকি' গিলবার জন্য হাসি
আর হ্যা... মুস্তফী! আগেই ঠিক করছিলাম আপনের আর্টিকেলের লিঙ্কটা।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

দিগন্ত এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে গেম থিয়োরীর একটা টুকরো থিয়োরী মনে পড়ে গেল - যাকে পরিভাষায় বলা হয় ট্র্যাজেডি অফ কমনস। মানে একদল লোককে যদি একটা সামষ্টিক মালিকানা দিয়ে একটা নির্দিষ্ট রিসোর্স দেওয়া হয় তাহলে সবাই চাইবে যত বেশী পারা যায় সেই রিসোর্স ব্যবহার করতে। যেমন রেস্টুরেন্টে গিয়ে যদি একদল বন্ধু খেতে বসে আর ঠিক করা হয় যে যা বিল হবে সেটা সবাই সম-অনুপাতে ভাগ করে দেবে তাহলে সবাই বেশী বেশী করে খেতে চাইবে। কারণ, বেশী খাবার পেছনে খরচা ভাগ হয়ে যাবে সবার মধ্যে। স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গীতে এটাই স্বাভাবিক।

এবার যদি আদর্শগতভাবে সত্যিই সবাই উদ্বুদ্ধ হয়ে যান তাহলে অনেক আলাদা ব্যাপার। সেই নিয়েই এক্সপেরিমেন্ট হল কমিউনিসম। এক্সপেরিমেন্টটা সফল হয়নি ঠিক কথা কিন্তু অনেক পরিবর্তন এনেছে পৃথিবীতে যেটা হয়ত অন্যভাবে আনা সম্ভব হত না।


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

প্রতিচিন্তার লোকের জন্য আপনি অনেকটা জায়গা রেখে কথা বলেন, এ জন্য ধন্যবাদ। আমি মার্কসবাদের কয়েকটি ঘোষিত অবস্থানের বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইব এখানে,

মনুষ্য-চরিত্রকে অগ্রাহ্য করে কোন দর্শন, শাসনব্যবস্থা বা সমাজব্যবস্থা বেশীদিন চলতে পারে না। চললেও চলতে পারে ঢের জুলুম আর জবরদস্তির মাধ্যমে। মনুষ্যচরিত্র বলতে এখানে প্রতিটি মানুষের স্বার্থান্বেষণ, বা স্বার্থপরতার কথা বলছি। খেয়াল রাখবেন যে আমি 'স্বার্থান্বেষী' শব্দটা একেবারেই নেগেটিভ অর্থে বলছি না। এটা মানব-চরিত্রের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই বলছি।

আমিও বলেছি, পি মুনশিও বলেছেন যে, মার্কসবাদ নৈতিক বা হিতবাদী উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে না। এখানেই মার্কসপূর্ব ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মার্কস প্রবর্তিত ধারার মৌলিক তফাত। মার্কসবাদে পুঁজির সংকটের সমাধান হিসেবে, সভ্যতার উত্তরণ হিসেবে পরবর্তী ব্যবস্থাকে দেখা হয়ে থাকে। বিপুল মানুষ শোষিত হলেই বা বিপুল মানুষ বিদ্রোহ করলেই যদি নয়া ব্যবস্থা আসতো তাহলে স্পার্টাকাসই হতেন প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনক আর খ্রিষ্টীয় আশ্রমবাদী বা মুসলিম সুফীরাই হতেন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা। মার্কস পুঁজিবাদের বৈষয়িক বিকাশের বাস্তবতায় (অর্থাৎ যখন প্রযুক্তি, জ্ঞান আর শোষিতের সংগ্রামী সচেতনতা একটা উঁচু মাত্রায় উঠবে) মানুষের সচেতন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপ্লবের রূপরেখা দেখেছেন। এখানে নৈতিকতার মতো বিমূর্ত, দেশ-কালে বন্দি প্রবণতার ওপর আস্থা রাখা কঠিন।

এইসব মানুষ করে আসছে সভ্যতার শুরু থেকে, খ্রীস্টের জন্মেরও কয়েক হাজার বছর আগে থেকে।

একইভাবে উল্টোটাও তো সত্যি প্রমাণ করা যায় যে, চিরকালই মানুষ পরস্পরকে ভালবেসেছে, আশ্রয় দিয়েছে, দুর্গতের মুক্তির জন্য কাজ করেছে। সভ্যতার ইতিহাসই এই মিলনেরও ইতিহাস। কিন্তু স্বার্থপর বা পরার্থবাদী কোনো প্রবণতাকেই আসলে অ্যাবসলিউট বা পরম বলে ধরে নেয়া যায় না। বরং এ দুইয়ের দ্বন্দ্বের মধ্যেই মানুষের ইতিহাস আবর্তিত হয়েছে। ধর্মের সত্য একমুখী, ইতিহাসের সত্য বহুমুখী। তাই আমাদের বলতে হবে যে, দ্বিমুখী প্রবণতার দ্বন্দ্বই সকল মানুষের মধ্যে কম বা বেশি হারে বিরাজ করে। আপনি যে লিংকটা দিয়েছেন, সেটা কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্যের ইতিহাস বিষয়ে। এটাই তো আমরা বলতে চাইছি, বণিকদের কাজের পরোক্ষ ফল সভ্যতা পেলেও বণিকদের মুখ্য প্রবণতা হলো স্বার্থপর মুনাফামুখীনতা। তার জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহ-ছলনা কোনোটাতেই তাদের বাধে না। মার্কস বলেছিলেন, কোনা দেশ যখন বণিকদের নিয়ন্ত্রণে থাকে তখন তার পতন অনিবার্য। আপনি আজকের বাংলাদেশের দিকে দেখেন, প্রমাণ পাবেন। এরা যদি পুঁজিপতি শিল্পমালিকও হতো, সমাজে এত নৈরাজ্য আমরা দেখতাম না। যাহোক, একটি গোষ্ঠী বা শ্রেণীর প্রবণতা দিয়ে মানবজাতির প্রবণতাকে গড় করে মিলিয়ে দেয়ায় আমার সায় নাই।

আপনি ঠিকই ধরেছেন যে, ব্যক্তি মানুষ বা গোষ্ঠী মানুষকে মন্ত্রণা দিয়ে বা তাবলিগি ওয়াজের পদ্ধতিতে পাল্টানো যাবে না। সেটা জোর করে করতে যাওয়াও ব্যর্থ হতে বাধ্য। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ স্বভাবগত ভাবেই স্বার্থপর, এমন সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছলাম কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে? সত্য যে, দৃশ্যমান জগতে এটারই নজির বেশি। মার্কস এটাই বলছেন যে, যখন ব্যক্তিগত মালিকানাই হয়ে দাঁড়ায় টিকে থাকা ও নিরাপত্তার একমাত্র কবচ, এবং যখন বৈষম্য থাকে, তখন মানুষ পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। বৈষম্যের ভিত্তি দূর করা গেলে অপরেরটা আর কেড়ে খাবার প্রয়োজন পড়বে না।

মানুষের কোনো স্থায়ি রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ঠ্য নেই, যাকে বলা যায় প্রবৃত্তি। মানুষ মূলত আত্মরক্ষা প্রবণ এবং তার প্রজাতির রক্ষাপ্রবণ। তাই দেখা যায় যখন সবার সঙ্গে থেকে আত্মরক্ষা সম্ভব, তখন মানুষ তা-ই করে। আবার যখন সবার সঙ্গে মিলে লাভ নেই, তখন নিজের রাস্তা দেখে। মানবীয় বৈশিষ্ঠ্য বলে যা বুঝি, তা আসলে যে আর্থ সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা ও ঐতিহ্যের মধ্যে দিয়ে সে বেড়ে ওঠে, এটা তার ফল। ঐ বাস্তবতা বদলালে মানুষও বদলাবে। সে কারণে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন বাস্তবতায় ভাল-মন্দের বোধ পাল্টে যায়। মধ্যযুগে যা ছিল পাপ, আজ তা ন্যায্য আচরণ। তাহলে কি বলবো আজকের মানুষ পাপী মানুষ। আবার যুদ্ধে মানুষ মানুষকে হত্যা করে, তাই বলে বলব যে, মানুষ মূলত হন্তারক?
বরং উল্টোটাই তো দেখা যায়, সমাজে এত অপশক্তির পরও মানুষ তার মধ্যে শুভবোধ, সামাজিকতা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে, তার জন্মগত কালেক্টিভ চরিত্রের কারণে। এবং সেটা সে শেখে সমাজ থেকে। নইলে সভ্য মানুষের সন্তানকে বনে ফেলে এলে সে পশু হয়ে যায় কীভাবে?

এর পরে আপনি বলেছেন,
from each according to his abilities, to each according to his needs. এটা কি একটা ভ্রান্ত প্রস্তাব? আপনি এটা বলেছেন, মানুষকে স্বার্থতাড়িত ধরে নিয়ে। মানুষ সম্পর্কে আমার আগে বলা পর্যবেক্ষণ যদি মানেন, তাহলে এই কথা খাটে না। তাছাড়া মার্কস ওই নীতির কথা বলেন সাম্যবাদী সমাজের জন্য, (বর্তমানে ওটা প্রযোজ্য নয়) যেখানে সম্পত্তির ওপর সবার অধিকার থাকবে, যেখানে রাষ্ট্র-রাজনীতি-উতপাদনে আমাদের আওতার বাইরে ক্ষমতাবানদের করায়ত্ত থাকবে না। তর্কের খাতিরে বলতে পারেন সেই অবস্থা কখনো সৃষ্টি হবে না। আবার তর্কের খাতিরে বলা যায়, যদি বৈষম্য দূর ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হয়, তাহলে ওই নীতি অবশ্যই প্রযোজ্য হবে। এখনো কোনো কোনো আদিবাসী সমাজে যেখানে শ্রেণী বিভাজন কম, সেখানেও কিন্তু এজমালি সম্পত্তি, ব্যক্তির থেকে গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রাধান্য বেশি। আমাদের পাবর্ত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যেও কিন্তু ব্যক্তিমালিকানা নেই বা ছিল না। সেখানে কিন্তু স্বার্থ নিয়ে আমাদের মতো সংঘাত দেখা যায় না। দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, কিন্তু দ্বন্দ্ব আর সংঘাত তো এক নয়, তাই না?
মার্কসবাদ মানুষকে জাগতিক সমাজবদ্ধ সত্তা মনে করে। ফলে পারফেক্টিবিলিটির কোনো প্রস্তাব তা মানুষের জন্য রাখে না। ওটা ধর্মের কাজ। সেকারণেই ধর্মের প্রস্তাবের সঙ্গে মার্কসবাদের এত বিরোধ। মার্কসের মানুষ নিরন্তর হয়ে ওঠা, বিকাশমান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পরিবর্তনের ধারার মধ্যে থাকা মানুষ। এই হয়ে ওঠার চিরায়ত প্রক্রিয়ার কোনো এক মুহূর্তের মানষের স্বরূপকে চিরায়ত করে দেখাটাই অবৈজ্ঞানিক এক কুসংস্কার। বরঞ্চ পরিবর্তনশীলতার মধ্যে মানুষের মুক্তিকামী মানবিক প্রবণতাতেই মার্কস আস্থা রাখতে চেয়েছেন। আপনাকেও আহ্বান, সেই মানুষে ইমান আনি, যেই মানুষ ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য, নিজেকে আরো উচ্চতর রূপে উপভোগ করবার জন্য পরিপার্শ্বের সঙ্গে সংগ্রামে নিয়োজিত এবং তা বদলানোর জন্য সক্রিয়। ধন্যবাদ।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

ফারুক ভাই,

তত্ত্ব বাদ দিয়া দুইটা সহজ প্রশ্ন করি -

১) ব্যক্তি মালিকানা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্য়ক্তি প্রচেষ্টা, entrepreneurship- এই জিনিসগুলার কি স্থান আছে মার্ক্সবাদী সিস্টেমে? এইগুলো কি চিরকালই খারাপ জিনিস, বর্জ্য? entrepreneur-রা, এমনকি সত্ হইলেও, কি বাই ডেফিনিশন শ্রেণী-শত্রু?

২) মানুষে মানুষে সব সময় সমান না। শ্রেণী বৈষম্য আপাতত বাদ দেন। কিন্তু সম্পূর্ণ একই রকম পরিবার, বিত্ত, শিক্ষা, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দুইজন মানুষের উদ্য্ম, আগ্রহ, নিষ্ঠা, মেধা, পরিশ্রমের মধ্যে প্রচুর ফারাক থাকতে পারে। যেই লোক মেধাবী, উদ্যমী, নিষ্ঠাবান, সে যদি তার জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে চায়, তার জন্যে কি সুযোগ? সে যদি বড়লোকই হইতে চায় (exploitation ছাড়াই, নিজ গুণে), তাইলে তার কি সুযোগ? তাকে কেমনে ঠেকাবেন, এবং কি বিচারে? একইভাবে, যার উদ্যম নাই, নিষ্ঠা নাই, এক কথায় যে অলস - সে কি অন্যায্য রিওয়ার্ড পেতে থাকবে? মানুষে মানুষে প্রতিযোগিতা কি বরাবরি জঘন্য জিনিস?

এইসব ধাঁধার সমাধান থাকলে জানাইয়েন। আমার মনে হয় মার্ক্সিস্টরা সামষ্টিক চিন্তা করতে করতে 'ব্যক্তি'কে পুরাই অগ্রাহ্য করে। ম্যাক্রো দেখতে দেখতে আর মাইক্রো চিনতে চায় না। হয়তো এই কারনেই টিকে নাই।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

ভাইরে কোথায় আমি দুঃখ পাইতেছি জানেন? আমাদের তর্কের দশাটা হচ্ছে গিয়ে সূচের ডগায় কয় হাজার পরী নাচতে পারে, এমন ধরনের মধ্যযুগীয় পাদ্রিদের বিতর্কের মতো। গ্যালিলিওকে যখন বাইবেল বিরোধী তথা টলেমীয় ব্যাখা খণ্ডন করার জন্য বিচার চলছিল, তখন তিনি বারবার বলছিলেন, ওগো তোমরা একবার আমার এই টেলিস্কোপ দিয়ে তাকাও, সত্যটা চাক্ষুষ করো, তারপর যে রায় দেবে মেনে নেব। কিন্তু হুজুরেরা কেবল বাইবেল দেখছিল আর বলছিল, না তুমি ঈশ্বরদ্রোহী, তুমি নাফরমান। এই হইলো অবস্থা।

আপনার প্রশ্নের আন্তরিকতা নিয়ে আল্লার কসম আমার বিন্দুমাত্র সংশয় নাই। কিন্তু কথাটা একটু কমনসেন্সিকাল হয়ে গেল না? সাঈদীও এইসব প্রচার করে মার্কসকে ধসায়। আমি চাইছি গুড সেন্স। মার্কসের টেক্সট বা মার্কসবাদীদের বিরাট ঐতিহ্যে কিন্তু কোথাও সমাজের রেজিমেন্টেশন বা ব্যক্তির বিকাশে বাধা সৃষ্টির কথা বলা হয় নাই। কিন্তু আমরা দেখেছি সোভিয়েতে কীরকম কড়াকড়ি করা হতো। এটাকেই আমাদের মতো দেশের পাতি মধ্যবিত্ত সমাজতন্ত্রীরা ধর্ম বানিয়ে এমন কথা পর্যন্ত বলা শুরু করলো যে, মার্কসবাদের ধর্মের থেকে বড় ধর্ম। এগুলো ঘটেছে। যাহোক আপনার কথায় আসি,
ব্যক্তি মালিকানা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্য়ক্তি প্রচেষ্টা,

entrepreneurship- এই জিনিসগুলার কি স্থান আছে মার্ক্সবাদী সিস্টেমে? এইগুলো কি চিরকালই খারাপ জিনিস, বর্জ্য? entrepreneur-রা, এমনকি সত্ হইলেও, কি বাই ডেফিনিশন শ্রেণী-শত্রু?

ব্যক্তিগত উদ্যোগ আর ব্যক্তিগত মালিকানা এক নয়। আমাদের ধারণা কমিউনিজমে সকলকেই সর্বহারা হতে হয়। তা ঠিক নয়, বরং সকলকেই মালিকানা দেয়া হয়। রাষ্ট্রের মালিক, ক্ষমতার মালিক, নিজ জীবনের মালিক। যেখানে সকলেই মালিক সেখানে আর আলাদা করে ব্যক্তিমালিকানার প্রয়োজন পড়ে না। অনেক আদিবাসী সমাজে ব্যক্তি মালিকানা নাই, তাই বলে কি সেখানে ব্যক্তির অধিকার কারো থেকে কম? কেউ বড়লোক হতে চাওয়া মানে অন্যের ভাগে ভাগ বসানো। এটাই সম্পত্তি ব্যবস্থার মূল কথা। তাই কেন একজনকে আলাদা করে বড়লোক হতে দেয়া হবে। সম্পত্তি দিয়ে মানুষ বিচারের পদ্ধতি মানুষের যে মহান অর্জন ইতিহাসে ও প্রকৃতিতে তার মৌল চেতনা বিরোধী। রাশিয়ায় পেরেস্ত্রয়কায় এই সুযোগই দেয়া হয়েছিল, আজ তার ফল দেখুন। আর সত অসতের মাপকাঠি কী আসলে? কোন সময়ের কোন দেশের কোন আইনে তা সাব্যস্ত হবে? এগুলো আপেক্ষিক ব্যাপার। তাই সত-অসতের নৈতিক বিচার মার্কসবাদ ব্যবহার করে না। নৈতিকতা হচ্ছে যুক্তির উদ্বৃত্ত, যা যুক্তিতে টেকে না। মুনাফাও তেমনি শ্রমের উদ্বৃত্ত, যা ন্যায্যভাবে আত্মসাত করা যায় না, তা-ই তা উদ্বৃত্ত।
মানুষে মানুষে অধিকারের সাম্য, সুযোগের সাম্য থাকার বিরোধী কেন হচ্ছেন তা বুঝতে পারছি না। মার্কসের মূল কথা হলো মানুষে মানুষে এবং জগতের সঙ্গে মানুষের বিচ্ছিন্নতা (এলিয়েনেশন) ঘোচানো। আমার কাজের ফল চিন্তার ফল যখন অন্যে ভোগ করে, তখন সেই কাজের সঙ্গে সেই সমাজের সঙ্গে আমার যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, তা জন্ম দেয় বহু ধরনের বিকৃতির ও বিচ্যুতির। তা-ই তখন বাইরে থেকে পুলিশ দিয়ে ম্যানেজার দিয়ে আইন দিয়ে আমাকে ঠেলতে থাকে। এরই ফল ধর্ম থেকে শুরু করে যাবতীয় কাল্পনিক মিলনের আকাঙ্ক্ষা। মার্কস দেখলেন যে, বাস্তবে ঐ বিচ্ছিন্নতা দূর করার ম্যাটেরিয়াল কন্ডিশন পুঁজিবাদ নিজের অজ্ঞাতেই সৃষ্টি করেছে। কিন্তু মুশকিল হলো ক্ষুদ্র একটি শ্রেণীল একচেটিয়া সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত হতে দিতে চাচ্ছে না। এটাই শ্রেণী দ্বন্দ্বের গোড়ার কথা।

আজ মালিকের চাপে বা মুনাফার চাপে আমরা যেভাবে ছূটি, তা-ই কি আমাদের ব্যক্তিগত বিকাশকে ধ্বংস করছে না? কী মনে হয় আপনার। পঞ্চাশ হাজার বছরের মানবসভ্যতা আজ যে কোন দোজখ বানিয়ে রেখেছে, এটাই ইতিহাসের শেষ ধাপ, এটাই মানবজাতির পরিণতি? এমন মন্ত্রনা কে দিল আপনাকে? এই চিন্তার থেকে অনৈতিহাসিক ও অবৈজ্ঞানিক আর মানববিকাশ বিরোধী আর কী হতে পারে?
দুঃখিত অনেক কথা বলে ফেললাম, ক্ষমা কইরা দিয়েন।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

পি মুন্সী এর ছবি

১) ব্যক্তি মালিকানা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্য়ক্তি প্রচেষ্টা, entrepreneurship- এই জিনিসগুলার কি স্থান আছে মার্ক্সবাদী সিস্টেমে? এইগুলো কি চিরকালই খারাপ জিনিস, বর্জ্য? entrepreneur-রা, এমনকি সত্ হইলেও, কি বাই ডেফিনিশন শ্রেণী-শত্রু?

একটা নতুন ভাবনা। আমি জানি না নতুন কী নাম হবে তার, ধরলাম তার নাম হবে "লোকভাব"। এর মধ্যে থাকবে, ১। চর্চায় মার্কসবাদ যে ভুলগুলো করেছে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় - সেগুলোর একটা নির্মোহ মূল্যায়ন করতে হবে। ২। দার্শনিক মার্কস "পুঁজি"র লিখক হয়ে যাবার পর আমাদের কাছে মার্কসের কমিউনিষ্ট বিপ্লবের জন্য তত্ত্বকার পরিচয়টা মুখ্য হয়ে গেছে; দার্শনিক মার্কসসহ "পুঁজি"র লিখক মার্কসকে আবার ঘেঁটে দেখতে হবে, ফাঁকফোকড় থাকলে সর্তক হতে হবে। ৩। ধর্মের পর্যালোচনার কাজে হাত দিতে হবে যাতে একদিকে আল-কায়েদা রাজনীতিও মোকাবোলার যোগ্য হওয়া যায় আবার "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের" বিরোধী হবার তৌফিক লাভ করা যায়। ৪। মার্কসের ঘাটতি মোকাবোলা করতে লেনিন সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব দিয়ে একে আপডেট করেছিলেন। এরপর আর আপডেট হয়নি। এখনকার পুঁজির হালহকিকতের খবর নিতে আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ডাবলুটিও এর ভুমিকা সম্পর্কে সম্মকজ্ঞান উপলব্দি জোগাড় করে ফেলতে হবে। অর্থাৎ আবার আপটুডেট হতে হবে। ৫। চিন্তার দিক থেকে ইতোমধ্যে বড় বড় যেসব দিকে নজর ঢালতে হবে তাহলো;
ক) পরিবেশ: পুঁজিতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয়ই পরিবেশ-অ-জ্ঞান থেকে দুনিয়ায় রাজত্ত্ব করে গেছে। এবার উৎপাদন কাঠামো সাজাতে অবশ্যই দার্শনিক জায়গা থেকে মানুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক অনুধাবন করে পরিবেশ ভাবনা দাঁড় করাতে হবে। মাটির নিচের উপরের সম্পদ রক্ষার উপায় কৌশল রপ্ত করতে হবে।
খ) নারী: পুঁজির বাজার বিস্তারে পণ্যের নারীমুক্তি নয়, সত্যিকার নারীমুক্তি কী হতে পারে তা ভেবে বের করতে হবে।
গ) বিশ্ববাণিজ্য: যেকোন বাণিজ্যের আলোচনার কৌশল কী হতে পারে তার জন্য হোমওয়ার্ক করে রাখতে হবে।
এগুলো করতে পারলে "লোকভাব" বলে কিছু একটা দাঁড়াবে, যেটা কেবলমাত্র গরীব তৃতীয় বিশ্ব থেকেই প্রথম পতাকা উড়াবে।

এরকম এক "লোকভাব" হাজির করাতে পারলে অবশ্যই আপনার "ব্যক্তি মালিকানা", বিশেষত "ব্যক্তিগত উদ্যোগ", "ব্যক্তি প্রচেষ্টা", "entrepreneurship" - কে তা জায়গা করে দিবে। এগুলো কোন "ডেফিনিশন শ্রেণী-শত্রু" গণ্য হবে না। শ্রেণী-শত্রু বা খতম - এগুলো শ্রেণী ধারণার সবচেয়ে অধঃপতিত অর্থ। আমার ধারণা এ ব্যাপারটা আমাদের যথেষ্ট শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যেই দিয়ে ফেলেছে।

আশা করি "লোকভাব" এ কিছু বাদ পড়ে নাই। কারো মনে হলে মনে করিয়ে দিয়েন।

তরিকুল হুদা এর ছবি

অভিজিত সাহেবের আলোচনার জবাবে পি মুন্সী এবং ফারুক ওয়াসিফের সুন্দর আলোচনার পর আর কি তাতে যোগ করা যায় তা নিয়ে একটু সময় নিয়ে ভাবতে হবে। যদিও সর্টকাট মারতে গিয়ে মাউসে স্ক্রল করতে করতে আমার আণ্গুল ব্যথা হয়ে গেছে তবুও অভিজিত সাহেবের উদ্দেশ্য পরিস্কার।
আমি আপাতত পি মুন্সীর আলোচনায় একবিন্দু শিশির যোগ করি।

একটা উদ্ধৃতি:
"১) ব্যক্তি মালিকানা, ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ব্য়ক্তি প্রচেষ্টা, entrepreneurship- এই জিনিসগুলার কি স্থান আছে মার্ক্সবাদী সিস্টেমে? এইগুলো কি চিরকালই খারাপ জিনিস, বর্জ্য? entrepreneur-রা, এমনকি সত্ হইলেও, কি বাই ডেফিনিশন শ্রেণী-শত্রু?"

মার্ক্স পুজির আলোচনায় খারাপ ভালমন্দ সৎ অসৎ ইত্যাদি নৈতিক বিচার করেন নাই।পুঁজির ইতিহাসের ভিতর মানুষের নৈতিকতার বিচার কিভাবে হবে?পুঁজি যদি
মানুষের সামাজিক রাজনৈতিক সম্পর্কের এক বিশেষ ইতিহাস হয় তাহলে এর মধ্যে নৈতিকতা বসবে কোথায়?

তারপরও কেউ যদি মার্ক্সের চিন্তার ধরন না বুঝে এই রকম প্রশ্ন করেন তার মানে উনি আগে থেকেই নিজের মত মার্ক্সের উপর চাপালেন।আমি মনে করি একটা বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার স্বার্থে এদিকগুলি আমাদের মনে রাখা দরকার।
তাই পুরা আলোচনা দেখে আমার মনে হছ্ছে মার্ক্স পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে একটু যদি বলেন তাহলে অনেকের উপকার হয়।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍এই সিরিয়াস লেখায় বেমানানভাবে কয়েকটি সোভিয়েত কৌতুক তুলে দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।

০১.
- দর্শন, মার্কসীয় দর্শন এবং মার্কসীয়-লেনিনীয় দর্শন বলতে কী বোঝায়?
- দর্শন হলো অন্ধকার ঘরে বেড়াল ধরা। মার্কসীয় দর্শন হলো বেড়ালহীন অন্ধকার ঘরে বেড়াল ধরা। আর মার্কসীয়-লেনিনীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য হলো বেড়ালহীন অন্ধকার ঘরে বেড়াল ধরেছে বলে বেড়াল-শিকারীর সার্বক্ষণিক চিত্কার।

০২.
- মার্কসের কাছ থেকে জার্মানি কী পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে?
- পূর্ব জার্মানি পেয়েছে "কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তেহার", আর পশ্চিম জার্মানি পেয়েছে "ক্যাপিট্যাল"।

০৩.
- সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য কী?
- সাধারণ চেয়ার আর বৈদ্যুতিক চেয়ারের মধ্যে যে-পার্থক্য।

০৪.
- কমিউনিস্ট আখ্যা দেয়া যায় কাকে?
- মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ক্ল্যাসিকগুলো যে পড়ে।
- আর অ্যান্টি-কমিউনিস্ট কে?
- লেখাগুলো পড়ে যে বুঝতে পারে।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। - হুমায়ুন আজাদ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অভিজিৎ এর ছবি

চিনছি সোভিয়েতস্কি !!!

হেঃ হেঃ আপনার কমেন্টের জবাব নাই! এর পরে আর কিছু লেখাই বৃথা।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍‍আরে, আপনার টপিকের সঙ্গে সবচেয়ে সংশ্লিষ্ট কৌতুকটিই তো দেয়া হয়নি!

- মার্কসিজমকে কি বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করা যায়?
- অবশ্যই না! মার্কসিজম বিজ্ঞান হলে আগে তা প্রয়োগ করে দেখা হতো গিনিপিগের ওপরে!

গুরুগম্ভীর বিষয় এবং আলোচনায় আমার লঘু মন্তব্যের জন্য দুঃখিত।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পাকিস্তানিদের আমি অবিশ্বাস করি, যখন তারা গোলাপ নিয়ে আসে, তখনও। - হুমায়ুন আজাদ

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

বজলুর রহমান এর ছবি

কোনটা বিজ্ঞান সেটা প্রমাণ করা অসম্ভব, কিন্তু কোনটা বিজ্ঞান নয় সেটা নানাভাবে বোঝা যায়। পপারের Falsifiability তত্ত্বে বলে : কি ভুল সেটা প্রমাণ করা যায়, কি সত্য সেটা প্রমাণ অযোগ্য (বিজ্ঞানেও) । সব তথাকথিত বৈজ্ঞানিক 'সত্য'ই দেখা যায় একটা সীমার পরে আর কাজ করছে না। গ্যোডেলও বিজ্ঞানের অসম্পূর্ণতার কথা বলে গেছেন।

মার্ক্সের সব চেয়ে আকর্ষণীয় মতবাদ ঃ From each according to ability, to each according to need. বিজ্ঞানসম্মত কি না সেই প্রশ্নে না গিয়ে, এটা একটা গ্রহণ যোগ্য আদর্শ হতে পারে কিনা, সেটা বিবেচনা করে দেখা যায়। 'সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে' এটা কি সমাজতত্ত্বের ভিত্তি হতে পারে না?

মার্ক্সের অপর বিখ্যাত উক্তি ঃ ' Religion is the opium of the people' - এটাও আমার কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য একটা বক্তব্য মনে হয়।

হেগেলের দ্বন্দ্ববাদ নাম না জেনেও, বা অবচেতনভাবে হলেও, সব বিজ্ঞানীই অনুসরণ করেন নিজেদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে। বুদ্ধিমান অবিজ্ঞানীরাও।

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন বলাবলি করতাম - ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র চারটি সায়েন্স বিষয় পড়ানো হয় - পলিটিকাল সায়েন্স, সয়েল সায়েন্স, লাইব্রেরী সায়েন্স, এবং ক্যাডেটদের জন্য মিলিটারী সায়েন্স। আশা করি আভিজিৎ বাবু সব বিজ্ঞানের স্বরূপ উদঘাটন করবেন।

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

আলোচনা সত্যিই জমে উঠেছে। পি মুনশির দুটি উত্তরের পর অভিজিত যদি তাঁর আর্গুমেন্টের দূর্বলতা বুঝে উঠতেন এবং বিষয়টা বিজ্ঞান-অপবিজ্ঞানের জায়গা থেকে সরিয়ে রাজনৈতিক দর্শন ও অর্থনৈতিক তত্ত্বের জায়গা থেকে দেখতেন, তাহলে অনেক আগেই বিতর্কটি থেমে যেত। তা তিনি না করায় আমাদের জন্য সুযোগ থাকলো আরো কিছু বলার। আশা করি দ্রুতই বলা যাবে। আজ এ পর্যন্ত, আবারো অভিজিতকে অভিনন্দন বিষয়টা তোলার জন্য।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

অভিজিৎ এর ছবি

পি মুনশির দুটি উত্তরের পর অভিজিত যদি তাঁর আর্গুমেন্টের দূর্বলতা বুঝে উঠতেন ...।

পি মুনশি যে উত্তরটি আমার প্রতি ধাবিত হয়েছিলো, তার যথার্থ উত্তর আমি দিয়েছি, রেফারেন্স উল্লেখ করেই দিয়েছি। অপরটি যেহেতু স্নিগ্ধার সাথে হচ্ছে সেখেনে আমি আপাতত ঢোকার কারণ দেখছি না।

আমরা সবাই মনে হয় যে যার কথা বলে ফেলেছি। কার আর্গুমেন্টের দুর্বলতা আছে তা বরং আমরা পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দেই, কি বলেন হাসি



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

শ্রমসাধ্য ও চিন্তাশীল পোস্টটার জন্য ধন্যবাদ। সময়াভাবে না পারলাম পোস্টের খুঁটিনাটি নিয়ে জিজ্ঞেস করতে, না পারলাম মন্তব্যগুলো নিয়েও কিছু বলতে। তবে শিখলাম অনেক কিছুই। ধন্যবাদ সবাইকে। বেশ ধাঁরালো সব আলোচনা দেখছি।

দিগন্ত এর ছবি

একটা অন্য প্রসঙ্গেও কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে। সেটা হল 'জোর করে কারও ভাল করে দেওয়া' (যেটা কমিউনিসম দাবী করে ন্যায্য বলে) বনাম 'স্বেচ্ছায় ভাল করা'(যেটা গণতন্ত্রের দাবী)।

কথা হল যে সব জাতি স্বেচ্ছায় উন্নতি করেছে (ডেভেলপমেন্ট বাই কনসেন্সাস) তাদের মধ্যে আগে থেকেই একটা সাম্য-ভাব প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই তাদের উন্নতি করার জন্য কোনো সাম্যবাদ দরকার পড়েনি। এর সবথেকে ভাল উদাহরণ আমেরিকা - যে দেশটা সম্পূর্ণ বহিরাগতদের নিয়ে তৈরী। তাই সেখানে আগের দেশের ক্লাস বয়ে আনেনি মানুষ, সরাসরি গণতন্ত্র থাকায় সাম্যবাদটা ভোটের মাধ্যমে বারবার প্রতিষ্ঠিত থেকেছে।

উল্টোদিকে যদি কমিউনিসমকে দেখতে হয়, তারা অনেক লোক মেরেছে ঠিক কথা, কিন্তু অনেক জাতিকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে যারা আজকে এই অবস্থায় আসতেই পারত না যেখানে তারা আছে। দুটো ভাল উদাহরণ হতে পারে চিন আর মধ্য এশিয়া। আমি কেস স্টাডি হিসাবে মধ্য এশিয়ার তাজিকদের নিলাম।

তাজিক জনসংখ্যা মোটামুটি দুটো দেশে আছে - আফগানিস্তান আর তাজিকিস্তান। তাজিক দেশে সাক্ষরতা প্রায় ১০০% যেখানে আফগান তাজিকদের সাক্ষরতা ৫০%এরও কম। কিভাবে এই তফাত? বলশেভিক সোভিয়েতরা এককালে রক্ষণশীল তাজিকদের রক্ষণশীলতা ভেঙে তাদের একরকম আধুনিক শিক্ষার আলোয় এনেছিল বলেই কিন্তু এত তফাত। আর এই রক্ষণশীলতা ভাঙা কিন্তু একদিনে হয় নি, বিনা রক্তপাতেও হয় নি। তাজিক সহ মধ্য এশিয়ার বিপ্লবের কথা পড়ে দেখতে পারেন। এই বিপ্লব যদি সফল হত, তাহলে কি তাজিকরা আজ বেশী ভাল থাকত? না, বলশেভিকরা বিপ্লব কড়া হাতে দমন করতে পেরেছিল বলে আজ একশ্রেণীর তাজিকরা অনেক উন্নত হতে পেরেছে।

আমি নিজেও উত্তরটা ঠিকঠাক জানি না আসলেই ...


হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

বজলুর রহমান এর ছবি

http://www.sciencedaily.com/releases/2007/06/070625085134.htm

Human-like Altruism Shown In Chimpanzees
ScienceDaily (June 25, 2007) — Experimental evidence reveals that chimpanzees will help other unrelated humans and conspecifics without a reward, showing that they share crucial aspects of altruism with humans.
------------------------------------

Debates about altruism are often based on the assumption that it is either unique to humans or else the human version differs from that of other animals in important ways. Thus, only humans are supposed to act on behalf of others, even toward genetically unrelated individuals, without personal gain, at a cost to themselves.

Studies investigating such behaviors in nonhuman primates, especially our close relative the chimpanzee, form an important contribution to this debate.

Felix Warneken and colleagues from the Max Planck Institute for Evolutionary Anthropology present experimental evidence that chimpanzees act altruistically toward genetically unrelated conspecifics.

In addition, in two comparative experiments, they found that both chimpanzees and human infants helped altruistically regardless of any expectation of reward, even when some effort was required, and even when the recipient was an unfamiliar individual--all features previously thought to be unique to humans.

The evolutionary roots of human altruism may thus go deeper than previously thought, reaching as far back as the last common ancestor of humans and chimpanzees. In a related article, Frans de Waal discusses the issues brought out by this discovery.

Citation: Warneken F, Hare B, Melis AP, Hanus D, Tomasello M (2007) Spontaneous altruism by chimpanzees and young children. PLoS Biol 5(7): e184. doi:10.1371/journal. pbio.0050184.

যাঁরা বলতে চান বিবর্তন আমাদেরকে পিঁপড়ে, মৌমাছি বা বানরের চাইতেও অধম করে দিয়েছে, আমি সে দলে নই।

mosharrof এর ছবি

মার্কসবাদ একটি বিজ্ঞান। যারা মার্কসবাদী আন্দোলনে যুক্ত তাদের সবাই এ ধারণা সঠিক মনে না করলেও আমার মতো আরও অনেককে যে পাওয়া যাবে এটা নিঃসন্দেহ। লেখকের একটা উদ্দেশ্য হতে পারে আমরা যারা একে বিজ্ঞান বলি তাদের ভ্রান্ত(?) ধারণা থেকে সঠিক ধারণায় নিয়ে আসা। অনেকেই সমাজ বিজ্ঞান আদৌ বিজ্ঞান কি না সে প্রশ্নও রেখেছেন?
আচ্ছা আমরা যে আলোচনা করছি সে সম্পর্কে অভিজিৎ বাবু শেষ দিকে বলেছেন যে সবার একই মত থাকবে তা নয়। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময়ে সত্য একটাই থাকে, এটা বিজ্ঞানের কথা। আপনি যা বলছেন তা যদি সত্য হয়ে থাকে তবে আমরা যা বলছি তা সত্য নয়। আবার, এটা ও হতে পারে আমরা উভয়ে ভুল। কিন্তু সেটাও কাউকে না কাউকে প্রমাণ করতে হবে। এখানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে যুক্তি-তর্ক হতে হবে।
এটা হলো বিজ্ঞান। এখন মার্কসবাদ বলে আমরা যা বলি তার নাম নিশ্চয় আপনার জানা, তা হলো দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। ফলে মার্কস যা বলেছেন তা মার্কসবাদ এভাবে যারা বোঝেন তারা ভুলভাবে মার্কসবাদ বুঝেন। আর যারা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে জীবন জগতের নানা রহস্যের উন্মোচন করবেন তারা যদি ভুল করেন তা মার্কসবাদের অন্তর্ভুক্ত হবে না কিন্তু যা সঠিক বলে প্রমাণিত হবে তা মার্কসবাদী ধারণার অর্ন্তভুক্ত হবে। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল এবং তা ছিল মার্কসবাদী বিজ্ঞান প্রয়োগ করে মানব ইতিহাসে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দীর্ঘ যাত্রাপথের অভিজ্ঞতা থেকে আজ আমরা কি পেতে পারি তা সঠিকভাবে উদঘাটিত করতে পারি শুধু মার্কসবাদী জ্ঞান সঠিকভাবে আয়ত্ত্ব করার মধ্য দিয়েই।
আর সমাজতন্ত্রে ধারণা প্রথম মার্কস আনে নাই। মার্কসের জন্মের বহু আগেই এ ধারণা এসেছিল এবং এ ধারণা নিয়ে অনেকেই সমাজ প্রগতির কথা চিন্তা করেছেন এবং তার প্রয়োগ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মার্কস প্রথম বিজ্ঞানসম্মতভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ কোন ঐতিহাসিক কারণে শ্রমিক শ্রেণী প্রতিষ্ঠা করবে তা ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং খুব সম্ভবত লেনিন সমাজতন্ত্র যে বৈজ্ঞানিক তা নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন। আশা করি, লেখকের সেটা পড়া আছে।
এখন লেখক যদি ধরেই নেন যে একইসাথে একাধিক মত সত্য হতে পারে তাহলে তার সাথে যুক্তি-তর্ক বৃথা। যদিও এ রকম কোন ধারণা নিয়ে কেউ আর যাই হোক অন্যদের আলোচনায় ডাকতে পারেন না। সেই ভরসাতেই সাধারণ কয়েকটি কথা তুলে ধরলাম।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

কার্ল পপারের ফলসিফায়েবিলিটি থিওরীটি আরেকটু পরিস্কার করে ব্যাখ্যার দাবী রাখে। "একটা থিওরী তখনই বিজ্ঞানসম্মত যখন একে রিফিউট করা বা ভুল প্রমাণ করা যায়" -- একথাটি হঠাৎ শুনলে মনে হবে, তার মানে যাবতীয় সঠিক থিওরীগুলো কি তবে বিজ্ঞানসম্মত না?
যেমন, ত্রিভুজের তোনকোণের সমষ্টি ১৮০ ডিঃ, এটা চিরায়ত সত্য (সরলরেখার সংজ্ঞা মেনে নিয়ে), এটা কি তবে বিজ্ঞান নয়? এই প্রশ্ন করলে একটু দমে যেতে হয়।

তাই থিওরীটাকে এভাবে বলা যায়, এমন কোন অনুসিদ্ধান্ত যদি থাকে যেটা দিয়ে একটা থিওরীকে চ্যালেঞ্জ করা যায়, তাহলে সেটা বিজ্ঞানসম্মত।
যেমন, আমরা যদি এমন একটা ত্রিভুজ আঁকতে পারি যেটার তিন কোণের সমষ্টি ১৮০ ডিঃ না, তাহলেই ত্রিভুজের তিনকোণের সমষ্টি ১৮০ ডিঃ -- একথাটাকে রিফিউট করা যাবে। কাজেই এটা বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু এ্যাস্ট্রোলজিস্টরা যখন বলতো, মহামারী লাগে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে, তখন এটাকে চ্যালেঞ্জ করার কোন উপায় থাকেনা, এমনকি আপনি জীবাণু-টিবাণু নিয়ে একদম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও সে হয়তো বলতো যে এটাও একটা কারণ, ওটাও একটা কারণ। কাজেই এটা বিজ্ঞানসম্মত না।

এখন আসি পোস্টের আলোচনায়,
কার্ল পপারের ফলসিফায়েবিলিটি থিওরীর আলোকে আপনি কেন মার্কসবাদকে বিজ্ঞানসম্মত বলতে পারছেননা?
আপনি নিজেই তো নিজের লেখায় "১৯৩০ এর অর্থনৈতিক মন্দা সত্বেও বিপ্লব হয়নি" বলে মার্কসের থিওরীকে রিফিউট করেছেন। মার্কসবাদের মূল ভিত্তি অর্থাৎ সমাজ পরিবর্তনের মার্কসীয় মডেল অনুযায়ী যে একটা ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় সেটাই তো একে রিফিউটাবল করে দিয়েছে। মানে, ভবিষ্যদ্বাণীটা মিথ্যে এমন একটা উদাহরণ দিলেই তো রিফিউট করা হয়ে গেল। কাজেই এটা কার্ল পপারের শর্ত পূরণ করে।
পপার বলেছেন, মার্কসবাদ যখন তৈরী হয় তখন এটার বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য ঠিকই ছিল, একটা নিয়মতান্ত্রিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই সেটা তৈরী হয়েছে, সেটাকে রিফিউট করা যায় এমন অনেক প্রপোজিশনও তৈরী করা যেত (যেমন উপরের উদাহরণ, চরম অর্থনৈতিক মন্দার দরিদ্র শ্রেণী দ্বারা বিপ্লব সংঘটিত না হলেই মার্কসবাদকে রিফিউট করা যায়)।
পপার যেটা বলেছেন সেটা হলো মার্কসবাদের অন্ধ অনুসারীরা প্রতিবারই যখন মার্কসবাদকে রিফিউট করা হয় তখন বাড়তি কিছু ব্যাখ্যা জুড়ে দিয়ে (ad hoc) সেই রিফিউটেশনকে নাকচ করে দেয়, যা কিনা আদতে মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিকতাকে দূর্বল থেকে দূর্বলতর করে তোলে। একথাটাও ঠিক আছে, যখন একটা থিওরীকে রিফিউট করার মতো উদাহরণের সংখ্যা কমতে থাকে, তখন থিওরীটা ফোকাসড থেকে ধীরে ধীরে ব্লারড স্টেটমেন্টে পরিণত হয়।

এখন কথা হলো, উগ্র মার্কসবাদীরা হয়ত সেভাবেই মার্কসবাদের যাবতীয় দূর্বলতাকে নাকচ করে দেয়, কিন্তু এখানকার আলোচনায় যে মার্কসবাদী বা মার্কসের পক্ষে বলা ব্লগারদের দেখা যাচ্ছে, তারা কিন্তু কেউ দাবী করছেননা মার্কসবাদ নির্ভুল। তারা কিন্তু কেউ দাবী করছেননা সমাজের যাবতীয় পরিবর্তনকেই মার্কসবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সবাই দাবী করছেন, মার্কসবাদের তাত্বিক/প্রায়োগিক সবধরনের দূর্বলতাই থাকতে পারে, কিন্তু এটার সৃষ্টি হয়েছিলো নিয়মতান্ত্রিক গবেষণার মধ্য দিয়ে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে। সেটাকে কিন্তু কার্ল পাপরও অস্বীকার করেননি, বস্তুতঃ কেউই অস্বীকার করছেননা।

আবার উগ্র মার্কসবাদীদের পক্ষেও বলা যায়, রিফিউট করার স্কোপ যদি থাকে তাহলে রিফিউট করবনা কেন। আমি মনে করি এখানে দার্শনিক কার্ল পপারের চিন্তার একটা সীমাবদ্ধতা বোঝা যায়।
এভাবে বলতে পারি যে,
"একটা থিওরীর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত যতগুলো কন্ট্রাডিকশন উপস্থাপিত হয়েছে তার সবগুলোকে রিফিউট করার অর্থ কোনভাবেই এটা নয় যে থিওরীটাকে রিফিউট করা সম্ভব না।"

যেমন কার্ল পপারকেই উল্টো প্রশ্ন করা যেতে পারে, একটা থিওরী যে রিফিউটাবল না, এটা প্রমাণ করতে হলে মোট কতগুলো কন্ট্রাডিকশনকে নাকচ করতে হবে? এটার কি কোন লিমিট উনি দেখাতে পারবেন?

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

মোশাররফ এর ছবি

''এখন কথা হলো, উগ্র মার্কসবাদীরা হয়ত সেভাবেই মার্কসবাদের যাবতীয় দূর্বলতাকে নাকচ করে দেয়, কিন্তু এখানকার আলোচনায় যে মার্কসবাদী বা মার্কসের পক্ষে বলা ব্লগারদের দেখা যাচ্ছে, তারা কিন্তু কেউ দাবী করছেননা মার্কসবাদ নির্ভুল। তারা কিন্তু কেউ দাবী করছেননা সমাজের যাবতীয় পরিবর্তনকেই মার্কসবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সবাই দাবী করছেন, মার্কসবাদের তাত্বিক/প্রায়োগিক সবধরনের দূর্বলতাই থাকতে পারে, কিন্তু এটার সৃষ্টি হয়েছিলো নিয়মতান্ত্রিক গবেষণার মধ্য দিয়ে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে।''
আপনার লেখাটির আগে মার্কসবাদ একটি বিজ্ঞান এটা সমর্থন করে কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা আমি করেছিলাম। সেখানে মার্কসবাদ বলতে আমরা যারা মার্কসবাদের সমর্থক তারা কি বুঝি তা খানিকটা বলতে চেয়েছি। তার পরেই আপনি মার্কসবাদীদের মাঝে ‌‌‌‌যারা 'উগ্র' তাদের কাউকে এখানে পান নি বলেছেন। অর্থাৎ মার্কসবাদে ভুল থাকতে পারে তা আমরা সকলে মেনে নিয়েছি, এমনটা বলতে চেয়েছেন। কিন্তু মার্কসবাদ একটা এপ্রোচ, এটা কোন নির্দিষ্ট সময়ে সত্য কি তা একটা বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের নিরিখে নির্ধারণ করা যায়, এ রকমই বলে। মার্কসবাদ মানে র্মাকস যা বলেছেন তা যে মার্কসবাদ নয় সেটা মার্কসবাদী মাত্রেরই মানতে হবে। কিন্তু তাই বলে আমি বা আমাদের যে কেউ নিজেকে মার্কসবাদী দাবি করে বর্তমানের কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে কোন প্রকল্প হাজির করলে তা মার্কসবাদ নাও হতে পারে, কারণ সততাই একমাত্র মানদন্ড এক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। মার্কস এর মৌলিক কিছু বিষয় আছে যা স্বীকার করে যখন একটা শ্রেণী সংগ্রামে একটা দল কাজ করে তখন তাদের সাথে যুক্ত মানুষেরা মার্কসবাদী বলে দাবি করতে পারে। তবে সঠিক মার্কসবাদী চিন্তা যেহেতু একটা নির্দিষ্ট দেশের বিপ্লব প্রশ্নে একাধিক থাকতে পারে না, সেহেতু সঠিক মার্কসবাদী চিন্তার সাথে যুক্ত না হয়ে প্রকৃত মার্কসবাদী কেহ হতে পারেন না। পুঁজিবাদী দর্শণের প্রচার যারা জেনে বুঝে করেন তাদের বিরুদ্ধে মার্কসবাদীদের আপোষহীন অবস্থানকে যে কেহ উগ্রতার দোষে দুষ্ট করতে পারেন কিন্তু এটা অনিবার্য। আবার শ্রেণীগতভাবে শোষিত শ্রেণীর অংশ হয়ে এবং তাদের প্রতি যথেষ্ট মানবিক বোধ থাকা সত্ত্বেও যারা মার্কসবাদের বিরোধিতা করেন তাদের সাথে মার্কসবাদীদের দ্বন্দ্ব কখনো ব্যক্তিগত বিরাধের পর্যায়ে নেয়ার কিছু নেই বরং একটা সঠিক চেতনার ভিত্তিতে আদর্শগত ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষেই এ বিতর্ক পরিচালিত করে থাকে মার্কসবাদীরা। এবং মার্কসবাদী আন্দোলন যতোটা বিজ্ঞানাশ্রয়ী হবে তা ততোটা বিকশিত হবে, এটাই মার্কসীয় চিন্তার মূলকথা। ফলে সমাজের যাবতীয় বিষয় মার্কসবাদী বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী এপ্রোচেই একমাত্র ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তা না হলে তা ভাববাদী ধারণার কবলে পড়তে বাধ্য।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

তারমানে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী এপ্রোচ নিয়ে যেকোন সমস্যাকে সমাধান করার প্রয়াসই মার্কসবাদ, নাকি যেকোন সমাজবিজ্ঞানের সমস্যাকে সমাধান করার প্রয়াসটা মার্কসবাদ।

তাহলে কি আপনি চরম পুঁজিবাদী গেম থিওরীকে মার্কসবাদের একটা অফস্প্রিং হিসেবে মেনে নিতে রাজী আছেন?

তবে আমি মনে করি কোন থিওরী হোক, মেথড হোক (আমি জানতাম মার্কসবাদ একটা থিওরী, কিন্তু আপনার কথায় মনে হচ্ছে এটা একটা সিস্টেমেটিক এ্যাপ্রোচ বা মেথড) সেটার পুরোপুরি নির্ভুল হবার কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারেনা। সেই নিশ্চয়তা দেয়াটাই বরং বস্তুবাদ থেকে ভাববাদে ট্রানজিট নিয়ে নেয়া। আমি বলছিনা, ভাববাদ মানেই বাতিলযোগ্য, তবে দুটো প্যারাডাইম পুরোপুরি আলাদা।

এখন আপনি যদি বলতে চান মার্কসবাদ নির্ভুল, তাহলে আপনাকে মার্কসবাদের সাথে কন্ট্রাডিক্ট করে এমন সম্ভব যাবতীয় প্রপোজিশনকে মিথ্যে প্রমাণিত করতে হবে।

সেটা কেউ করেছেন কি না আমি জানিনা (যদিও তাত্বিকভাবে এটা অসম্ভব), তবে না করে থাকলে কেউ যদি করতে পারেন, তাহলে শুধু এটাই বলা যায় যে তখন মার্কসবাদ আর বিজ্ঞান থাকেনা, চিরন্তন সত্য বা টটোলজিতে পরিণত হবে।

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

mosharrof এর ছবি

আপনার মতামতের সাথে কন্ট্রাডিক্ট করতে হবে শুধুমাত্র এ ভাবনা থেকে কিছু লিখতে সমস্যাই বোধ করছিলাম। কারণ, আপনার বক্তব্যে একটা সত্যানুসন্ধানী, অনুসন্ধিৎসু মন স্পষ্টভাবে আছে এটা আমাকে নতুনভাবে ভাববার ব্যাপারে উৎসাহিত করছে। কারণ, মার্কসবাদ একটি বিজ্ঞান, এ লেখায় অভিজিৎ যে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন তাতে তার জানাশোনার পরিধি যে ব্যাপক তা নিয়ে কোন সন্দেহই আমার ছিল না এবং অন্যান্য যারা এখানে লিখছেন প্রায় সবার ক্ষেত্রেই মনে হয় এ কথাটি প্রযোজ্য।
সে যাই হোক, মার্কসবাদ একটি এপ্রোচ এটা যেমন সত্য আবার মার্কসবাদ একটা তত্ত্বও। ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌'চরম পুঁজিবাদী গেম থিয়োরীকে মার্কসবাদের একটা অফস্প্রিং' - এ কথাটি আমার কাছে স্পষ্ট না। অফস্প্রিং এবং চরম পুঁজিবাদী গেম থিয়োরী এ দু'টি বিষয় আগেও কয়েকবার মন্তব্যসমূহে এসেছে। এর যথার্থ অর্থ আপনার কাছ থেকে জানার আগ্রহ রইলো।
তবে কার্ল মার্কস ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী ও ইটালী এ চারটি শিল্পোন্নত দেশে পুঁজিবাদের চরম উন্নতির ধারাবাহিকতায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে বলে উল্লেখ করেছিলেন। যা সংগঠিত হয় নি। এ বিষয়টিকে কেউ কেউ মার্কসবাদী তত্ত্বের ভুল হিসেবে দেখে থাকেন। বাস্তবে বিশ্বের দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর এখনো বিরাজ করছে। এ কথাটার মানে এটা নয় যে এখন বিপ্লব সংগঠিত হবে। আর অনেকে শ্রমিক শ্রেণীর দেয়ালে পিঠ থেকে গেলে বিপ্লব ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই, কিংবা পুঁজিবাদ নিজেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে - এ সব কথাকে বিচ্ছিন্নভাবে গ্রহণ করে বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার বিষয়কে একটা স্বতঃস্ফূর্ত বিষয় হিসেবে দেখে থাকেন। এভাবে দেখলে মার্কসবাদী যে জ্ঞান তাকে সম্যকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। কারণ, বিপ্লবের জন্য সমাজ অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব প্রধান নিয়ামক হলেও একটা দেশে বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার একটি সঠিক বিপ্লবী তত্ত্ব ও তার ভিত্তিতে একটি বিপ্লবী দল গড়ে ওঠা ও তার বিকাশের পর্যায়, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিসহ আরো বহু বিষয়াদি বিশ্লেষণ জরুরী। তাই মার্কসের কোন কথা কিংবা মার্কসবাদী চিরায়ত সাহিত্যের কোন একটি বিশেষ অংশকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখে তার সঠিকতা বেঠিকতা নিরুপণের প্রশ্নটি আমার কাছে অবান্তর। জানি না আপনার প্রশ্ন বুঝেই আমার মতামত আমি রাখতে পেরেছি কিনা তবে অনেক মন্তব্যে এ বিষয়ক যে ধারণাসমূহ এসেছে তার সাথে মার্কসবাদের ধারণার পার্থক্যকে আমি এভাবেই ধরতে পেরেছি।
মার্কসবাদ সম্পর্কে আপনি যে বলেছেন যে মার্কসবাদের সাথে কন্ট্রডিক্ট করে এমন সকল বিষয়ে মার্কসবাদী জ্ঞান দ্বারা সেগুলোকে ভুল প্রমাণ করতে হবে, এটা মার্কসবাদী চিন্তার মোদ্দা কথাই বটে।
আর একটি বিষয় নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করে আজ শেষ করবো। সেটা হলো এখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি - এ দু'টি বিষয়কেই অনেকে এক করে ফেলেন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারকে অনেকে বিজ্ঞান হিসেবে দেখে থাকেন। কিন্তু বিজ্ঞান বলতে আমরা প্রকৃতিবিজ্ঞানের অনুসন্ধানের মাধ্যমে তার নিয়ম জানাকে যদি বুঝে থাকি তাহলে তা আমাদের চিন্তা নিরপেক্ষভাবেই প্রকৃতিতে অবস্থান করে বলে তাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু যখনি প্রকৃতিজগতের কোন নিয়ম জেনে তাকে ব্যবহারের প্রশ্নটি আসছে তা প্রযুক্তি হিসেবে আসছে এবং বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে তা যে আজ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মুনাফা বৃদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট। ফলে বিজ্ঞান কি সেটা বুঝতে হলে মৌলিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা পদ্ধতি দিয়েই তাকে বুঝতে হবে। অনেকে মনে করেন বিজ্ঞান আজ যা সত্য বলে কাল তা নিজেই নাকচ করে দেয় ফলে বিজ্ঞানের ধারণা অভ্রান্ত নয় এটাই বিজ্ঞানের কথা। কিন্তু কথাটা এভাবে বুঝলে বিজ্ঞান সঠিকভাবে বোঝ হলো বলে আমার মনে হয় না। ধরুন, পৃথিবী সমতল বলে যে ধারণা ছিল তার কারণ হলো মানুষের কাছে এ বিষয়ক সঠিক জ্ঞান অর্জনের কোন হাতিয়ার তখন ছিল না। কিন্তু এ ধরনের বদ্ধমূল ধারণা থেকে বিজ্ঞানসম্মত ধারণায় আসতে কিছু যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়েই তা এসেছিল। এখন পৃথিবী গোলাকার এ ধারণার বিকষিত রূপ হিসেবে এর সঠিক আকার আয়তন জানা তখনই সম্ভব হয়েছে যখন একে জানাবার পর্যাপ্ত হাতিয়ার তথা প্রযুক্তি মানুষ আবিষ্কার করতে পেরেছে। এখানে আপেক্ষিকভাবে পৃথিবী গোলাকার এ ধারণা ভুল প্রমাণ হয়েছে এভাবে না বুঝে তা আরো বিকষিত রূপে আমরা বুঝতে পারছি, এভাবে বোঝাটাই বিজ্ঞানসম্মত। আবার কিছু কিছু বিষয় আছে যাতে নতুন সত্য আসার বিষয় থাকতে পারে না। যেমন অক্সিজেন পরমাণুর গঠন, ধর্ম, বৈশিষ্ট্য যা তা পৃথিবীর যে কোন স্থানের জন্যই সত্য। এটা ভুল বলার কোন সুযোগ নেই। অর্থাৎ এটা মৌলিক স্বীকার্য। তেমনিভাবে আরো অনেক উদাহরণ দিয়ে বিজ্ঞানের বিষয়টি যে কেউ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন। এখন প্রশ্ন দাঁড়াবে বিজ্ঞানের এ ধারণা নিয়ে মার্কসবাদকে আমরা বিজ্ঞান বলতে পারি কি না?

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

গেম থিওরী একটা পুঁজিবাদী থিওরী (আমি এটার বিরাট ফ্যান) যেটা অবশ্যই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী এ্যাপ্রোচে তৈরী হয়েছে। স্পেসিফিক প্যারামিটারে লাভক্ষতি হিসেবের মাধ্যমে একটা াপটিমাল সল্যুশনে পৌঁছা হয় এ তত্বে।

আপনার কাছে আমার প্রশ্নটা ছিলো, আমি যতটুকু বুঝি, এই যে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী এ্যাপ্রোচ, এটাতো মার্কসের আবিষ্কৃত না। তিনি তাঁর সমাজবিজ্ঞানের থিওরী প্রণয়নে এই মেথডে এগিয়েছেন, তাই নয় কি?

এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছি
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ব্লগার অভিজিৎকেই উল্টো প্রশ্ন করা যায়,
১. কার্ল মার্কস যখন তার সমাজপরিবর্তনের থিওরী তৈরী করেন, তখন কি তিনি পর্যাপ্ত এ্যানালাইসিস/যুক্তি/তথ্যের সাহায্য নিয়ে করেছেন বলে মনে করেন, নাকি ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে যা মনে হয়েছে তাই লিখে ফেলেছেন?
২. আপনি কি মনে করেন, এমন কোন প্রস্তাবনা (বাস্তবে থাকুক বা না থাকুক) কি দাঁড় করানো যায়না যেটা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে মার্কসবাদ ভুয়া?
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

অভিজিৎ এর ছবি

আপনার ফলসিফিকেশন বিষয়ক প্রশ্নের জবাব আমি দিয়েছি ফারুক সাহেবের ব্লগে। আমি এখানেও কিছু দিচ্ছি।

কার্ল মার্কস যখন তার সমাজপরিবর্তনের থিওরী তৈরী করেন, তখন কি তিনি পর্যাপ্ত এ্যানালাইসিস/যুক্তি/তথ্যের সাহায্য নিয়ে করেছেন বলে মনে করেন, নাকি ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে যা মনে হয়েছে তাই লিখে ফেলেছেন?

ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে লিখেছন তা বলব না। তবে কিছু জায়গায় 'পরীক্ষনযোগ্যতার' অভাব ছিলো। এই পরীক্ষনযোগ্যতা এবং তার ভিত্তিতে আহৃত ‘ফলসিফিফায়াবিলিটি’ বা ‘বাতিলযোগ্যতা’ একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের অন্যতম গুন। এটা যে কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মাণের অপরিহার্য শর্ত। মুলতঃ এই গুনটিই বিজ্ঞান থেকে অপবিজ্ঞানকে পার্থক্য করে দেয় পরিস্কারভাবে। আমি আগে উদাহরণ দিয়েছি। যেমন, 'এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে কোন অপার্থিব সত্ত্বা আছেন' - এটি একটি টটোলজিকাল স্টেটমেন্ট - ফলসিফায়াবেল নয়। কারণ আমরা কোনভাবে পরীক্ষা করে এর যথার্থতা নির্ণয় করতে পারি না। কিন্তু ‘ইলেক্ট্রন প্রটোনের চেয়ে ভারী’ –এটি একটি ফলসিফায়েবল স্টেটমেন্ট। কারণ পরীক্ষা করে আমরা এর সত্যমিতথ্যা যাচাই করতে পারি। কার্ল পপার তার 'দ্য লজিক অব সায়েন্টিফিক ডিস্কভারি'তে পরিস্কার করে বলেছেন - 'A theory is scientific to a degree to which it is testable.'

মার্ক্সের তত্ত্বের বেশ কিছু জায়গায় ফলসিফায়াবেলিটির অভাব রয়েছে বলে পপার মনে করা হয় । যেমন মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্ত্বে যেভাবে শ্রমিকদের 'increasing misery' পরিমাপের কথা বলা হয়ছে তা ফলসিফায়াবেল নয়। এ প্রসঙ্গে রুপার্ট য়ুডফিন বলেন, 'Increasing misery can be explained without reference to value. We don’t know if it is significant and have no way to finding out.'। একই ধরনের কথা মার্ক্সের এলিনেশন থিওরীর জন্যও খাটে, যেখানে মার্ক্স বলেছেন - 'We have only the illusion of happiness, because it is an essential part of our nature to be in a proper relationship to these things.'। এখানেও সমস্যা- 'আমরা সুখে আছি নাকি এটা ইল্যুশন অব হ্যাপিনেস' - এগুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে নির্ণয়ের কোন উপায় নেই। 'ডায়েলেক্টিক্স' ব্যাপারটাও ফলসিফায়েবল কিনা তা বিবেচনার দাবী রাখে। পপারের মতে এটি 'mystical, unverifiable nonsense'।

আপনি কি মনে করেন, এমন কোন প্রস্তাবনা (বাস্তবে থাকুক বা না থাকুক) কি দাঁড় করানো যায়না যেটা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে মার্কসবাদ ভুয়া?

আমি আমার প্রবন্ধে অনেকগুলো পয়েন্ট উল্লেখ করেছি। মার্ক্সের অনেক ভবিষ্যদ্বানীই বাস্তবতার সাথে মেলেনি। সেই পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্র এবং তা থেকে সাম্যবাদ - সেই ফেমাস প্রফেসি তো আছেই, এছাড়া - মার্ক্স এবং এঙ্গেলস যেভাবে 'ক্লাসলেস' সোসাইটি গঠনের সভ্যতার শেষ দেখেছেন - "With this social development, the prihistory of society ends" কিংবা 'স্টেট উইল উইদার এওয়ে' - কোন কিছুই বাস্তবতার সাথে মিলেনি। তারচেয়েও বড় কথা হল যে দ্বান্দ্বিকতাকে তারা 'গতিশীল' এবং সর্বদা চলমান বলে মনে করেন, এই 'উইদার এওয়ে' তা তাদের থিসিসের সাথে যায় না। মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বানীর আরেকটি বড় বিপর্যয় হল' মার্ক্স ভেবেছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিল্পব এডভান্সড পুঁজিবাদি রাষ্ট্রগুলোতে আগে হবে ' কারণ সে সমস্ত দেশেই শ্রমিকেরা হবে 'সবচেয়ে শোষিত'। কিন্তু সে সমস্ত দেশে বিপ্লব আগে হয় নি। এগুলো নিয়ে আমি অন্য জায়গায় লিখেছি।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

দুঃখিত, অনেকদিন ব্লগে আসিনি। এখন হয়তো আলোচনাটা আর চলছেনা চোখ টিপি

মার্কসবাদ সম্পর্কে আমার ডিটেইলড পড়াশোনা নাই। এটুকু বুঝি যে মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল বইয়ের প্রতিটি বাক্যই তো আর বৈজ্ঞানিক তত্ব না, পুরো আলোচনা থেকে মার্কস যেসব প্রস্তাবনা করেছেন আর তার সপক্ষে যেসব কারণ তুলে ধরেছেন সেগুলোর সামারীকে মার্কসের তত্ব বলা উচিত, তাইনা? সেহিসেবে আমার তো মনে হয় মার্কস Misery বলতে অর্থনৈতিক দৈন্যতাকেই বুঝিয়েছেন, কারণ হ্যাপিনেসকে ইলিউশন হিসেবে দেখিয়ে তিনি কিন্তু মিজারির ভাববাদী অংশটাকেই বরং নাকচ করে দিয়েছেন।
ডাইলেক্টিক্স কি? এটাকে কেন পপার মিনিংলেস বলেছেন? -- প্রশ্ন গুলো মনে জাগলো।

আমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হবার মানেই কি এটা নয় যে মার্কসবাদে ফলসিফায়েবিলিটি আছে? যার ফলসিফিকেশন সম্ভব হয়েছে, তারই ফলসিফায়েবিলিটি ছিলো -- এটাই তো মূল কথা, তাইনা? সেজন্যই বলতে চেয়েছিলাম (আসলে গুলিয়ে ফেলিনি চোখ টিপি ) যে একটা তত্বের ফলসিফিকেশন প্রেজেন্ট করাই যথেষ্ট; সেটাকে বেশী দূর্বল দেখানোর জন্য একই সাথে সেটার ফলসিফিকেশনের উদাহরণ দেয়া আবার সেটার ফলসিফায়েবিলিটি নেই বলাটা কেমন কেমন জানি লাগলো। মনে পড়ে গেলো, পরীক্ষার উত্তরে যত পয়েন্ট বেশী দেখানো যাবে তত বেশী নম্বরের নিশ্চয়তা চোখ টিপি

আর এখানে যেটা প্রাসঙ্গিক, সমাজবিজ্ঞানের বেলায় তত্বগুলোর ফলসিফায়েবিলিটি একটু কম লেভেলেই থাকবে, কারণ এখানে অনেক প্যারামিটারের সংজ্ঞাই আপেক্ষিক। যেমন আপনি উদাহরণ দিলেন, মিজারি বা হ্যাপিনেস। আবার মজার ব্যাপার দেখেন, ইদানিং ব্রেইনের আলফা-বিটা-গামা আর অন্যান্য ওয়েভের রিসার্চ কিন্তু ধীরেধীরে এসব মানবিক বিষয়গুলোর একটা প্রমাণ পরিমাপকের তৈরী হবার ইঙ্গিত দিচ্ছে, কাজেই তখন মার্কসের তত্বের ফলসিফায়েবিলিটি বা বিজ্ঞানভাব আরো বেড়ে যেতে পারে।
এর ফলে ন্যাচারাল সাইন্স আর সোশ্যাল সাইন্স আরো কাছে চলে আসবে হয়ত।
হয়ত তখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা কতটা বিজ্ঞানসম্মত সেটা নিয়েও আমরা (না হই, অন্ততঃ আমাদের নাতী-নাতনীরা)আলোচনা করতে পারবো চোখ টিপি

ধন্যবাদ আপনাকে
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

জাতিশ্বর এর ছবি

আমার মনে হয় মার্ক্সিস্টরা সামষ্টিক চিন্তা করতে করতে 'ব্যক্তি'কে পুরাই অগ্রাহ্য করে। ম্যাক্রো দেখতে দেখতে আর মাইক্রো চিনতে চায় না। হয়তো এই কারনেই টিকে নাই।

সুবিনয় মুস্তফী,
আপনার এরকম সরলীকরণ ব্যাখ্যা নিয়ে এ আলোচনায় তেমন কিছু বলার নেই।মার্কসের হোক বা অন্য কারো হোক সামষ্টিক চিন্তার সুত্রপাত হয় ব্যক্তি থেকেই।ব্যক্তিকে যদি অস্বিকারই করা হতো তাহলে তার বিপরীতে সমষ্টি আসত না।মার্কসের দর্শনে বলা হয়েছে ইন্ডিভিউজ্যুয়াল মাইক্রো বা ব্যক্তি সমাজতান্ত্রীক সমাজে সমষ্টির রূপ পরিগ্রহ করে। "হয়তো এই কারনেই টিকে নাই।"
এই মন্তব্যটি একেবারেই বালখিল্য চিন্তাদুষ্ট। কি টিকেছে বা টিকে নাই সে প্রসঙ্গে আলোচনা হচ্ছে না, আলোচনা হচ্ছে মার্কসবাদ কি ,তা নিয়ে। আর টেকার ক্ষমতা দিয়ে যদি সিদ্ধান্তে আসতেই চান তাহলে অন্য উপমা দিতে হয় :
স্বর্গ বা বেহেস্তে যাবার জন্য কি কি ত্বরিকা দরকার হয় তার সবই তো খ্রীষ্টান,বৌদ্ধ,হিন্দু,ইহুদী ধর্মে বলা ছিল, তার পরও কেন ইসলামকে জন্ম নিতে হলো?টিকে থাকাই যদি দর্শন বা মতবাদেরসঠিকত্ব বোঝায় তাহলে আপনার ত্বত্ত্ব অনুযায়ী সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নয়,তেলাপোকা ! কারণ সেই জুরাসিক কাল থেকেই এই প্রাণীটা অবিকৃত অবস্থায় টিকে আছে !

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

নতুন ভাইসাব, এইসব তেলাপোকা জাতীয় বিচিত্র উপমা দিয়া কি প্রমাণ করতে চান জানিনা। হয়তো আপনের ফিলোসফি-রে ডিফেন্ড করতে গেলে এইসব উপমাই টানবেন, যদ্দিন না আপনের পেয়ারের মার্ক্সিস্ট স্বর্গ এই ধরায় তৈরী হইতেসে। তবে নিশ্চিত জাইনেন যে আরো হাজার বছর ওয়েট করবেন এইরকম বাস্তবতা-বিবর্জিত স্বর্গের অপেক্ষায়। আমার মজা লাগতেসে যে মার্ক্সবাদের গন্ধ পাইয়া নানান নতুন লোক জাইগা উঠছে ব্লগে, যাগো জীবনে আগে দেখি নাই। হয়তো এরপরে আবার নাই হইয়া যাইবো। কলেজ ভার্সিটির সব তাত্ত্বিক ডিবেটগুলা এই চান্সে আরেকবার ঝালাই কইরা নেন, কারন রিয়েল লাইফে কেউ আর শুনবো না। Bloggers of the world, unite...

-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

জাতিশ্বর এর ছবি

সুবিনয় মুস্তফী ভাইসাব, আমার নাম 'নতুন ভাইসাব' নয়,জাতিশ্বর ।
তেলাপোকা বিষয়ক বিচিত্র উপমা এমনি আসেনি।পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটা যে দর্শনের অনুসারিরা শাসন করেছিল/করছে, সেই দর্শন কে ফুত্কারে উড়িয়ে বলে দিলেন-'যে কারণে টিকে নাই'।আবারো বলি,এই ধরণের বালখিল্য সিদ্ধান্তের জন্য তেলাপোকা ছাড়া আর কিছু মানানসই হচ্ছিল না।

যদ্দিন না আপনের পেয়ারের মার্ক্সিস্ট স্বর্গ এই ধরায় তৈরী হইতেসে। তবে নিশ্চিত জাইনেন যে আরো হাজার বছর ওয়েট করবেন এইরকম বাস্তবতা-বিবর্জিত স্বর্গের অপেক্ষায়।

না ভাই,আমাদের পেয়ারের মার্ক্সিস্ট স্বর্গ এ জনমে আমাদের দরকার নেই। ওসব স্বর্গ-নরক নিয়ে আপনারা ভাবুন। আমরা স্বর্গ-নরকেই বিশ্বসী নই।
আরো হাজার বছর ওয়েট করব ? বেশ তো,ওই হাজার বছর ধরে না হয় আপনারাই শাসন চালিয়ে যান !আপনার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক। মাত্র হাজার বছর পরই তাহলে 'মার্ক্সিস্ট স্বর্গ' পাওয়া যাচ্ছে ?!

"আমার মজা লাগতেসে যে মার্ক্সবাদের গন্ধ পাইয়া নানান নতুন লোক জাইগা উঠছে ব্লগে, যাগো জীবনে আগে দেখি নাই।"

আপনার যে মজা লাগতেসে না সেটা বুঝেই আমার মজা লাগতেসে।
আমরা বাইরে থেকে আপনাদের ব্লগ পড়তে আসি।কিছু সার্বজনীন বিষয় ছাড়া মন্তব্য করি না।আর নতুন লোক জাইগা উঠছে ব্লগেবলে যেটা মিন করেছেন সে কথাটা আমি কর্তৃপক্ষের নয় ধরে নিচ্ছি,তাই এ নিয়ে কথা বাড়ালাম না।আমরা জানি ব্লগ সবার জন্য উন্মূক্ত।তার পরও আপনাকে চিনতে ভুল হবে কেন? কয়েকদিন আগে আপনিই তো বোধহয় অতিথি লেখক(সুশান্ত)কে কূয়োর ব্যঙ বলেছিলেন !আহা কি 'বিনয়' আপনার সুবিনয় !

P Munshe [অতিথি] এর ছবি

বিজ্ঞান ও মার্কস প্রসঙ্গে আমার আরও মন্তব্যের জন্য দেখুন:

http://www.somewhereinblog.net/blog/pmunshe/28841762

অনুপম সৈকত শান্ত এর ছবি

এই পোস্ট চোখে পড়ে অনেক পরে, তার উপরে মোবাইল খোয়া যাওয়ায় বাসা থেকে নেটেও ঢুকতে পারছিলাম না, ফলে এমন সময়ে লিখতে বসছি- যেসময়ে আলোচনা অনেক দূর গড়িয়েছে। তারপরেও কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।

অনুপম সৈকত শান্ত এর ছবি

প্রথমত লেখাটি পুরো মনোযোগ দিয়ে পড়ে হতাশ হয়েছি এবং পড়ার সময়েও প্রচণ্ড হতাশা বোধ করছিলাম। পোস্ট লেখকের যুক্তির করার ধরণ খুবই হতাশাজনক- এই হতাশা লেখকের সম্পর্কে পূর্ব উচ্চ ধারণা থেকেই উৎসারিত। যিনি মুক্তমনার মত একটি ওয়েব সাইট চালান- ধর্মীয় গোড়ামি-কুসংষ্কারের বিরুদ্ধে যিনি যুক্তিযুদ্ধে নিয়তই অবতীর্ণ হন, তার কাছে এমন বালসুলভ আলোচনা তাই আমার মধ্যে হতাশাই তৈরী করেছে।

মানুষের মধ্যে মত-পথের হাজারো পার্থক্য থাকতেই পারে, একজনের সাথের আরেকজনের মতের অমিল হতেই পারে, কিন্তু একাধিক ভিন্নমতের মধ্যে কোনটি সঠিক এটা নির্ণয়ের জন্য যুক্তিই হওয়া উচিৎ মূল হাতিয়ার। অন্তত অভিজিত যেখানে নিজেকে একজন যুক্তিবাদী বলেই ভাবতে ভালোবাসেন- সেহেতু ওনার কাছে সেরকম আলোচনাই আশা করেছিলাম। কিন্তু ওনার পুরো আলোচনা পড়ে মনে হচ্ছিল, এটা কেমনতরো যুক্তি!!

মূলত, তিনি মার্ক্সের বরাদ দিয়ে কিছু আলোচনা এনেছেন সেটা আসলেই মার্ক্সবাদ কিনা তা আলোচনা করা দরকার (ধীরে ধীরে দেখানো যেতে পারে)। নিজের মত করে মার্ক্সের বরাদ দিয়ে আলোচনা নিয়ে এসে সেগুলোকে খারিজ করা কোন ধরণের যুক্তি-তর্কের মধ্যে পড়ে বোঝা মুশকিল (কেননা তিনি অসৎ নন বলেই বিশ্বাস)। এবং পুরো পোস্ট জুড়ে যে বিষয়টি সবচেয়ে দৃষ্টি কাড়ে তা হলো- অসংখ্য ব্যক্তির উল্লেখ করে (কখনও নাম সহকারে অথবা কখনো নাম না বলেই- যেমন ইতিহাসবিদেরা, একাডেমিয়েনরা, সমাজবিজ্ঞানীরা----) মার্ক্সবাদের বিভিন্ন বিষয়কে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা। আসলেই এটা অবাক তথা তাক করার মতোই একটি পদ্ধতি!
আগে কিছু নমুনা দেখিঃ
#মার্ক্সের 'লেবার থিওরী অব ভ্যালু'র সমালোচনা রয়েছে একাডেমিয়ায়। আধুনিক অর্থনীতিতে তার তত্ত্বকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে 'মার্জিনাল ইউটিলিটি' তত্ত্ব দিয়ে।
#এছাড়া উইলিয়াম স্ট্যানলি জেভোন, কার্ল মেঞ্জার কিংবা বোম ব্যাওয়ার্কের সমালোচনাগুলো পড়া যেতে পারে।
# লুইস ফুয়ের, বার্ট্রান্ড রাসেল, গিবন প্রমুখ দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী, এবং ঐতিহাসিকেরা সময় সময় দেখিয়েছেন মার্ক্সের তত্ত্বের সাথে বিজ্ঞানের চেয়ে ধর্মের সাযুজ্যই বেশী।
#শ্রেনীগত দ্বন্দ্ব দিয়ে দুনিয়ার সবকিছুকে ব্যখ্যা করাকে আধুনিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এখন 'অতি সরলীকরণ' কিংবা 'অসম্পূর্ণ' বলেই মনে করেন।
#প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত 'ভারতে শ্রেণীবিভাগের তাৎপর্য' শীর্ষক লেখায় মন্তব্য করেছিলেন,
শ্রেণী ছাড়াও আসলে অসাম্যের অনেক উৎস আছে; অসুবিধা আর বৈষম্যের সমস্ত কিছু কেবলমাত্র শ্রেনী দ্বারাই নির্ধারিত হবে – এই ধারণা ত্যাগ করতে হবে।
#'ভুলপ্রমানেয়তার' ছাকুনির মধ্য দিয়ে না গেলে কোন তত্ত্বই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হয়ে উঠে না - এটা মোটামুটি একাডেমিয়ায় স্বীকৃত।
#মার্ক্স নিজেই বলেছেন সেই ব্যবস্থায় 'dialect will cease to operate' এবং ধারনা করেছেন -
'In good time, the dictorship of proletariat will wither away and the sunlit uplands of true socialism will be reached'
আজকের সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন মার্ক্সের এ ধারনা অবৈজ্ঞানিক। সমস্ত কনফ্লিক্ট দূর হয়ে গেলে তা হবে 'সায়েন্সদিকশন নাইটমেয়ার'।
#পাশাপাশি লুইস ফুয়ের, বার্ট্রান্ড রাসেল, গিবনদের থিসিসগুলোও পড়ুন, তাহলেই বুঝবেন ধর্মের সাথে মার্ক্সিজমের সাযুজ্য কতখানি। উদাহরণ স্বরূপ বার্ট্রান্ড রাসেলের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দেই –
"In our day, a new dogmatic religion, namely, communism, has arisen. To this, as to other systems of dogma, the agnostic is opposed. The persecuting character of present day communism is exactly like the persecuting character of Christianity in earlier centuries. In so far as Christianity has become less persecuting, this is mainly due to the work of freethinkers who have made dogmatists rather less dogmatic. If they were as dogmatic now as in former times, they would still think it right to burn heretics at the stake. The spirit of tolerance which some modern Christians regard as essentially Christian is, in fact, a product of the temper which allows doubt and is suspicious of absolute certainties. I think that anybody who surveys past history in an impartial manner
will be driven to the conclusion that religion has caused more suffering than it has prevented."
আপনি অবশ্য বলতে পারেন রাসেল লুইস ফুয়েরা কিছুই জানেন না। কে জানে আর কে জানে না তা আমার প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়।
#Daniel G. Jennings এর Communism is Religion প্রবন্ধটিও পড়ে দেখতে পারেন।
#'ডায়েলেক্টিক্স' ব্যাপারটাও ফলসিফায়েবল কিনা তা বিবেচনার দাবী রাখে। পপারের মতে এটি 'mystical, unverifiable nonsense'

কোন তত্তকে, বা কোন মত-পথকে ভুল প্রমাণ করার এই পদ্ধতিটি নিসন্দেহে চমকপ্রদ এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ। কেননা, এরকমের আলোচনা পড়লেই পাঠকদের মধ্যে লেখকের জ্ঞানের বিষয়ে নিসন্দেহ হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না- এক ঝলক দেখেই বোজা যায়- এই লেখক মার্ক্সবাদ সম্পর্কেই শুধু ব্যাপক জানেন না- মার্ক্সবাদের বিভিন্ন বই-ই শুধু পড়েননি, তিনি আরো অনেক জানেন, পড়েছেন। তিনি মার্ক্সের লেবার তিউরি অব ভ্যালুও যেমন জানেন- তেমনি মার্জিনাল ইউটিলিটি থিউরিও জানেন; উইলিয়াম স্ট্যানলি জেভোন, কার্ল মেঞ্জার, বোম ব্যাওয়ার্কের সমালোচনাগুলো তার পড়া-জানা, লুইস ফুয়ের, বার্ট্রান্ড রাসেল, গিবন এনাদের আলোচনাও তার ভালো পড়া। ফলে, স্বভাবতই এহেন পণ্ডিত মানুষের পাণ্ডিত্যে সকলেই মুগ্ধ। মুগ্ধতা কমেন্টগুলোর দেখলেই পরিষ্কার হয়। শ্রম সাধ্য কাজ, পরিশ্রমী কাজ এ ধরণের কমপ্লিমেন্টের পাশাপাশি বিপরীত মতের মোশাররফকেও তাই বলতে দেখি "এ লেখায় অভিজিৎ যে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন তাতে তার জানাশোনার পরিধি যে ব্যাপক তা নিয়ে কোন সন্দেহই আমার ছিল না"।

কিন্তু আমার মনে হয় এ ধরণের পণ্ডিতের এমন পাণ্ডিত্য- সঠিক যুক্তিকে তুলে ধরতে পারে না, যা পারে তা হলো বাগাড়ম্বর করতে- যাকে বড়জোর বলতে পারি পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাগাড়ম্বর।
মার্জিনাল ইউটিলিটি থিউরি কি, মার্ক্সের লেবার থিউরিই বা কি, কেমন করে প্রথমটি মার্ক্সের লেবার থিউরি অব ভ্যালুকে প্রতিস্থাপন করে? ঢালাও ভাবে বলে দেয়া একাডেমিয়ানরা, সমাজবিজ্ঞানীরা, ইতিহাসবিদেরা কারা এবং কোন সমালোচনার দ্বারা মার্ক্সবাদকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছেন- নামোল্লেখ করা মানুষ কোন যুক্তিতে কি বলেছেন, এসমস্ত সম্পর্কে কিছু না বলে, যে যুক্তির পাহাড় গড়ে তুলেছেন- তা কি একবারো ফাঁপা মনে হয় নি? অমুক অমুক কি কিছুই জানেন না বা ওনারা কি কম জানেন এই প্রশ্ন তুলে ওনারা যা বলেছেন তাই সঠিক এ ধরণের যুক্তিকে আসলে যুক্তি বলা যায়?? এক পপারের বরাদ দিয়েই ডায়ালেক্টিকসকে 'mystical, unverifiable nonsense প্রমাণ যিনি করে ফেলেন- তার যুক্তি করার ক্ষমতা সম্পর্কেই কি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নয়?

মনে পড়ে যায়, মুক্তমনার এক লেখকের সাথে এক ধার্মিকের ডিবেটের কথা- যে ধার্মিক ইসলামের পক্ষে যুক্তি হিসাবে একগাদা জ্ঞানি-গুনীর নাম সামনে এনে হাজির করেছিলেন এবং এটাই বলার চেষ্টা করেছিলেন, ওনারা কি কিছুই জানেন না?

"আল্লাহ যে আছেন তার প্রমাণ কি?- আল্লাহর রাসুল বলেছেন; এবং তিনি যে আললাহর রাসুল এর প্রমান কি?- আল্লাহ বলেছেন"। মাঝেমধ্যেই এমন যুক্তির মুখোমুখি দাঁড়ানো অভিজিৎ বাবুর নিজেই এহেন জাকির নায়েক বা আহমদ দীদাতীয় ঘরানায় যুক্তি করাটা মুক্তমনার লেখক-পাঠক সকলের জন্যেই হতাশাকর।

তদুপরি তিনি পণ্ডিত মানুষ, পাণ্ডিত্য প্রচারযোগ্য- বাহবা ওনার যথেস্ট প্রাপ্য, পেয়েছেনও বটে; তবে আমরা যারা ওনার মত পণ্ডিত নই, পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাগাড়ম্বর বাদ দিয়ে সোজা সাপ্টা কিছু বিষয়ে দুটো কথা বলতে চাই-----------

অনুপম সৈকত শান্ত এর ছবি

আগের মন্তব্যে বলেছিলাম, পোস্ট লেখক মার্ক্সের বরাদ দিয়ে যেসব কথা বলেছেন- সেগুলো আসলেই মার্ক্স বলেছেন কি না, বা সেগুলো মার্ক্সের বক্তব্য কি না বা সেগুলো মার্ক্সবাদ কিনা- সেটি যাচাই করা দরকার। একইভাবে মার্ক্স কোন প্রেক্ষিতে কি করেছেন সেটাও পোস্ট লেখক বলার সময় কতখানি সঠিক তথ্য দিতে পেরেছেন- তাও দেখা দরকার। লেখক এই কাজটির পরে যেটি করেছেন- সেটি হলো তার নিজের মতো করে মার্ক্সের কথা (কখনো কাল্পনিক, কখনো খণ্ডিত এবং কখনো বিকৃত ভাবে) তুলে দেয়ার পরপরেই সেই কথার ভ্রান্তি ধরিয়ে দিয়েছেন, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত আকারে মার্ক্সবাদের ভুলময়তা তুলে ধরেছেন (কখনো নিজেই সিদ্ধান্ত টেনেছেন, কখনো কিছু ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন- কখনো ঢালাওভাবে সমাজবিজ্ঞানীদের, অর্থনীতিবিদের নাম করে)।

প্রথমে এ ধরণের কিছু বক্তব্য দেখিঃ
১#মার্ক্স তার জীবদ্দশায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আর্থসামাজিক বিন্যাস লক্ষ্য করেন। এই পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শোষণমূলক এবং মানবতাবিরোধী রূপ দেখে তিনি ব্যথিত হন –আর এ থেকে সাধারণ বঞ্চিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য উদ্বেলিত হয়ে ওঠেন।
২#মার্ক্স মনে করেছিলেন যে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনী বুঝি কেবল শোষণ আর বঞ্চনার শিকার হবে এবং এর ফলে শ্রমিক শ্রেনীর পিঠ 'দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ায়' তারা ধণতান্ত্রিক সিস্টেমের পতন ত্বরান্বিত করবে।
৩#পুঁজিবাদী শোষণের কারণে 'দেয়ালে পিঠ' ঠেকে গেলে যদি বিপ্লব হয়ে যেত, তাহলে বিগত শতকের ত্রিশের দশকে সারা দুনিয়া জুরে অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ নেমে এসেছিল তখন কেন পশ্চিমে কোন বিপ্লব হল না সে ব্যাপারটি মোটেই বোধগম্য নয়।
৪#শুধু শ্রেনীগত কিংবা অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, আজকের দুনিয়ার জটিল সমাজে আরো নানা ধরণের দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত (যেমন, জাতিগত, লৈঙ্গিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় সঙ্ঘাতের কথা বলা যায়) রয়েছে যা পৃথিবীর গতিপথ নির্ধারণে অনেক সময়ই নিয়ামক ভুমিকা পালন করেছে – মার্ক্স সেগুলো তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি, তার তত্ত্বে তিনি শুধু 'ক্লাস কনফ্লিক্ট'কেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো’ মার্ক্স শুরুই করেছিলেন এই বলে:
উদ্ধৃতি
The history of all hitherto existing society is the history of class struggle.
৫#শ্রেনী সঙ্ঘাতের উপস্থিতি রয়েছে, প্রবলভাবেই রয়েছে কিন্তু শুধু শ্রেনীগত দ্বন্দ্ব দিয়ে দুনিয়ার সবকিছুকে ব্যখ্যা করাকে আধুনিক অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা এখন 'অতি সরলীকরণ' কিংবা 'অসম্পূর্ণ' বলেই মনে করেন।
----------- ইত্যাদি।

১==>>মার্ক্স পুঁজিবাদের মানবতাবিরোধী রূপ দেখে ব্যথিত হয়ে সাধারণ বঞ্চিত মানুষকে উদ্ধারের নিমিত্তে উদ্বেলিত হন- একি পোস্ট লেখকের মনোকল্পনা, নাকি উইকিপেডিয়া থেকে আহরিত জ্ঞান, না-কি মার্ক্স সম্পর্কে বিভিন্নজনের করা আলোচনা/সমালোচনা থেকে নেয়া সিদ্ধান্তের ফল? (যেমনটি পুরো পোস্ট দেখে বুঝা যায়, মার্ক্সবাদ সম্পর্কে তার ধারণা সম্পূর্ণটাই মার্ঢবাদের সমালোচনা পড়ে!)

২,৩==>>মার্ক্স কোথায় বলেছেন যে, শ্রমিকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পতন ঘটবে? ২ এর পতন ত্বরান্বিত হওয়া থেকে ৩ এর প্রশ্নটি কি যৌক্তিক হলো? ধনতন্ত্রের পতনের শর্তগুলোর মধ্যে তিনি আর কি কি বলেছেন? সেগুলো কি আপনার সেই কথিত মন্দার সময়ে ছিল? অবজেকটিভ কণ্ডিশন আর সাবজেকটিভ কণ্ডিশন দুটোর প্রয়োজনীয়তার কথা কি তিনি বলেন নি? অবজেকটিভ কণ্ডিশনের মধ্যেও কি মার্ক্স শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্ছনার কথাই শুধু বলেছেন????

৪, ৫==>>মার্ক্সের উদ্ধৃতি হচ্ছে, "আজতক মানব সমাজের ইতিহাস শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস", এই কোটেশন উল্লেখ করে ৫ এর বক্তব্যটি কি যৌক্তিক হয়? সমস্ত ব্যাপার কোথা থেকে আসে? এই কোটেশন যদি কেউ বেঠিক মনে করে, তবে মানব সমাজের ইতিহাস যে, শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস নয়- সেটা দেখিয়ে দেয়াই কি শ্রেয় নয়? মার্ক্স যেমন ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপ ধরে ধরে দেখিয়েছেন- কোথায় কোন অবস্থা ছিল, কোন ব্যবস্থায় মোড অব প্রোডাকশন কি ছিল, প্রোডাকশান রিলেশন কি ছিল এবং শ্রেণী সংগ্রাম কি ছিল- সেগুলোকে ধরে ধরে আলোচনা করাই কি উচিৎ নয়?
আর, মার্ক্স আজকের দুনিয়ার জটিল সমাজে আরো নানা ধরণের দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত (যেমন, জাতিগত, লৈঙ্গিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় সঙ্ঘাতের কথা বলা যায়) কে তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি, তার তত্ত্বে তিনি শুধু 'ক্লাস কনফ্লিক্ট'কেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন- এই ধারণা কি পোস্ট লেখকের আবিষ্কার?
মার্ক্সের বেইস আর সুপারস্ট্রাকচার নিয়ে না জেনে, না পড়েই একজন এরকম ঢালাও মন্তব্য করতে পারে, তা সত্যিই অবাক করার মত। কিছু কোট করছিঃ
1."In the social production of their life, men enter into definite relations that are indispensable and independent of their will, relations of production which correspond to a definite stage of development of their material productive forces. The sum total of these relations of production constitutes the economic structure of society, the real foundation, on which correspond definite forms of social consciousness. The mode of production of material life conditions the social, political, and intellectual life process in general."
-Preface to 'A contribution to the critique of Political Economy' (1859)

2. According to the materialist conception of history, the determining element in history is ultimately the production and reproduction in real life. More than this neither Marx nor I have ever asserted. If therefore somebody twists this into the statement that the economic element is only the only determining one, he transforms it into a meaningless, abstract and absurd phrase. The economic situation is the basis, but the various elements os the superstructure - political forms of the class struggle and its consequences, constitutions stablished by the victorious class after a successful battle etc- forms of law- and then even the reflexes of all these actual struggles in the brains of the combatans: political, legal, and philosophical theories, religious ideas and their further development into systems of dogma- also exercise their influence upon course of the historical struggles and in many cases perponderate in determining their form."
-Joseph Bloch কে 1890 সালে লেখা Engels এর পত্র

অনুপম সৈকত শান্ত এর ছবি

একটা সংশোধনী (টাইপিং মিসটেক):
অবজেকটিভ কণ্ডিশন আর সাবজেকটিভ কণ্ডিশন দুটোর প্রয়োজনীয়তার কথা কি তিনি বলেন নি?=====>>>>>> এর বদলে হবে ====> অবজেকটিভ কণ্ডিশন আর সাবজেকটিভ প্রিপারেশন দুটোর প্রয়োজনীয়তার কথা কি তিনি বলেন নি?

আর, সাবজেকটিভ প্রিপারেশনের বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে, প্যারী কমিউন নিয়ে মার্ক্সের আলোচনা পড়লে। সেখানে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সমস্ত অবজেকটিভ কণ্ডিশন থাকার পরেও সাবজেকটিভ প্রিপারেশন না থাকলে- কিভাবে একটা বিপ্লবের মত ঘটনাও ব্যর্থ হয়ে যায়।

অনুপম সৈকত শান্ত এর ছবি

পোস্ট লেখকের আরেকটি লেখায় মার্ক্সের ধারণা সম্পর্কে জানিয়েছেন,
৬#মার্ক্সের সনাতন ধারণায় সমগ্র উৎপাদিকা শক্তিকে কেবলমাত্র কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমিকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেছিলেন – যা আজকের দুনিয়ার সাপেক্ষে অনেকটাই বাতিলযোগ্য।

৬==>> এমন ধারণা যে মার্ক্স পোষণ করতেন এই ধারণা পোস্ট লেখক কোথা থেকে পেল জানি না। শ্রমিক বলতে সমাজে যে ধারণাটি বলবদ আছে- সেখান থেকেই তিনি ধারণা লাভ করে সেটা মার্ক্সের উপর চাপিয়ে দিলেন। মালিকানা দিয়েই শ্রমিকের ডেফিনেশন মার্ক্স দিয়েছিলেন- সে সময় আজকের মত সফটওয়ার ইণ্ডাস্ট্রি না থাকলেও যে মেন্টাল লেবার ছিল সেটা কি অস্বীকার করবেন? মার্ক্স তাদেরও শ্রমিক বলেছিলেন। তবে শ্রমিকদের এই ডিভাইডেশনটি খুব ভালো করে উপস্থাপন করেন লেনিন।
কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমিকের মাধ্যমে উৎপাদিকা শক্তিকে মূল্যায়ন করার বিষয়টি বিকৃত উপস্থাপন ছাড়া কিছুই না। তবে, এটা যে পোস্ট লেখকেরই ভাবনা থেকে এসেছে সেটা পাওয়া যায় তার পরবর্তী আলোচনা থেকে- যেখানে এই মেন্টাল লেবার দানকারীদের শ্রমিক না বলে "মধ্যবিত্ত" বলতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করেছেন!!

===========

আজ পর্যন্তই, এখন বাসায় যাবো- কাল আবার দেখা হবে--------

kallol এর ছবি

অভিজিৎ সাহেবের এই পোস্টটিতে এত দিন পরে এবং এত দেরিতে অংশ নিচ্ছি বলে বেশ আফসোস হচ্ছে, কেননা মার্ক্সিজমকে আনসাইন্টিফিক প্রমাণে চেষ্টারত অভিজিৎ সাহেবের উপস্থাপিত যুক্তিগুলোর অসারতা নির্ণয় করে ইতিমধ্যেই অনেক কিছুই বলা হয়ে গেছে। তার পরও কিছু বিষয় রয়ে গেছে যে সব বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলবার প্রয়োজন মনে করছি।
অভিজিৎবাবু তার এই আলোচনায় মার্ক্সিজম সম্পর্কে যেসব মতামত রেখেছেন কিংবা মার্ক্সিজমকে বিভিন্ন সেময় যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সেগুলো পড়তে গিয়ে বারবারই মনে হয়েছে তিনি পরের মুখে ঝাল খেয়ে ঝাল! ঝাল! বলে চিৎকার করেছেন। যেমন: তিনি তার লেখারশুরুর দিকে মার্ক্সিজমকে অবৈজ্ঞানিক প্রমাণ করতে গিয়ে বলেছেন:
“মার্ক্সের প্রতিটি কথাই কিন্তু অভ্রান্ত নয়। এক সময় তার তত্ত্বের অনুরাগীরা কিন্তু সেভাবেই মার্ক্সকে দেখতেন।তারা ভাবতেন, এই মতবাদ এমন এক ‘সত্যের’ উপর প্রতিষ্ঠিত যা থেকে পদস্খলন কখনোই সম্ভব নয়। ঢালাওভাবে তাঁর সমস্ত বানীকে 'বৈজ্ঞানিক' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো।.....”

অভিজিৎ সাহেব, আপনি মার্কসের কোন কোন এবং কেমন অনুসারীর লেখা বা বক্তব্য থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসলেন? আপনি কি মার্কসের ইন্টারপ্রিটেশান সম্পর্কে লেনিনের লেখা পড়ে তারপর এই কথাগুলো বলছেন নাকি আপনার অন্য আরও সিদ্ধান্তের মত এ সিদ্ধান্তটিও আপনি টানছেন লুইস ফয়ের, উইলিয়াম ষ্ট্যানলি, কার্ল মেঞ্জার, বার্টান্ড রাসেল, গিবন এমন কোন বিখ্যাত ব্যাক্তির লেখা পড়ে? যুক্তি যদি বা নাই দিলেন, সূত্র তো দিতে পারতেন!

লেনিন বা অন্য মার্কসবাদীদের কথা বাদই দিলাম, আচ্ছা, আপনি কি, যার বাণীর ভ্রান্ততা/অভ্রান্ততা নিয়ে কথা তুলেছেন, সেই মার্কস তার নিজের এ বিষয়ে মতামত কি সে বিষয়ে একটু খোঁজ খবর করে দেখেছিলেন?দেখেননি, তাহলে সহজেই দেখতে পেতেন কমিউনিষ্ট মেনিফেস্টো প্রকাশের ২৫ বছর পর কার্ল মার্কস ১৮৭২ সালে প্রকাশিত সংস্করণের মুখবন্ধে বলেছেন::

The practical application of the principles will depend, as the Manifesto states,
everywhere and at all times, on the historical conditions... for that reason, no
special stress is laid on the revolutionary measures proposed at the end of
section two. That passage would, in many respects, be very differently worded
today. In view of the gigantic strides of Modern Industry in the last twenty five
years, and of the accompanying improved and extended party organisation of
the working class, in view of the practical experience gained, first in the
February Revolution, and then, still more, in the Paris Commune, where the
.proletariat for the first time held political power for two whole months, this
programme has in some details become antiquated. One thing especially was
proved by the Commune, viz., that ‘the working class cannot simply lay hold
of the ready-made State machinery, and wield it for its own purposes’.

Quoted by Dr Raj Sehgal, Philosophy Department, Roehampton University
সবচেয়ে বড় কথা, আপনাকে কে বলেছে কিংবা কোন মার্কসবাদীর লেখায় পেয়েছেন যে মার্ক্সিজম কতগুলো "অভ্রান্ত বাণী সমষ্টি" যার কোন একটি 'ভ্রান্ত' প্রামাণিত হলে পুরো মার্ক্সিজমই ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়ে যায়?
(চলবে)

kallol এর ছবি

অভিজিত সাহেব মার্কসের কল্পিত 'ভবিষ্যত বাণী'র কথা এবং সেই ভবিষ্যত বাণীর ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন:
" পুঁজিবাদী শোষণের কারণে 'দেয়ালে পিঠ' ঠেকে গেলে যদি বিপ্লব হয়ে যেত, তাহলে বিগত শতকের ত্রিশের দশকে সারা দুনিয়া জুরে অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ নেমে এসেছিল তখন কেন পশ্চিমে কোন বিপ্লব হল না সে ব্যাপারটি মোটেই বোধগম্য নয়। এরকম উদাহরণ আছে বহু। মার্ক্স তার তত্ত্বে আদর্শবাদী দৃষ্টিকোন থেকে পুঁজিবাদী সমাজের ধংসের ভবিষদ্বানী করেছিলেন, কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে পুঁজিবাদি ব্যবস্থা ধ্বংস না হয়ে যে টিকে গেছে – সেই টিকে থাকার পেছনে 'অন্তর্নিহিত বিবর্তন'টি গোনায় ধরেন নি, কিংবা ধরতে চাননি।"

'ভবিষ্যত বাণী' কথাটি বোধ হয় ইচ্ছাকৃত ভাবে ব্যবহৃত যেন মার্কসকে সহজে ধর্ম নেতা বা নবী রাসূলের সাথে তুলনা করা যায়। মার্কস যেটা করেছিলেন সেটা হলো প্রেডিকশান, কোন দিনক্ষণ ঠিক করে গণকের মত ভবিষ্যত বাণী নয় । তাও আবার মোটেই কোন আদর্শ বাদী দৃষ্টি ভঙ্গিতে নয়, যেমনটি অভিজিত দাবী করেছেন। আর সে প্রেডিকশান এর শর্ত যে কেবল শোষণের ঠেলায় শ্রমিকের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া নয়.... মার্কসের মনোযোগী পাঠক মাত্রই তা জানেন।
মার্কস তার সময়ে পুজিঁবাদকে যেভাবে এবং যে মাত্রায় বিকশিত হতে দেখেছেন এবং সে বেড়ে উঠার মাঝে যেসব অর্ন্তদ্বন্দ্ব দেখেছেন তার বিশ্লেষণের মাধ্যমেই পুজিঁবাদের বিনাশের একটি প্রেডিকশান করেছিলেন।
কিন্তু তা মোটেই শর্তহীন কোন বেদবাক্য ছিলনা কিংবা তার ভিত্তি কেবল দেয়ালে পিঠ ঠেকা নয় ।তিনি পুজিঁবাদের অন্তর্দ্বন্দ্বজাত কতগুলো প্রবণতা চিহ্ণিত করেছিলেন সেগুলো হলো:
১)ক্রমশ হ্রাসমান মুনাফার হার
২)পুজিঁর ক্রমাগত কেন্দ্রীভবন
২) সর্বহারার সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি
মার্কসের দৃষ্টিতে এই প্রবণতার ফলে পুজিঁবাদ প্রতিনিয়ত সংকটের জন্ম দিতে থাকে।এই সংকটের অনেক গুলো প্রকাশের একটা হলো শ্রমিকের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাওয়া । এই সংকটগুলো পুজিঁবাদ বিনাশের অবজেক্টিভ সম্ভাবনা তৈরী করে কেবল, নিজে থেকেই বিনাশ করে দেয় না। এরজন্য প্রয়োজনীয় সাবজেক্টিভ প্রিপারেশানগুলো সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন ক্যাপিটালের ভলিঅম ১, অধ্যায় ৩২ এ Historical Tendency of Capitalist Accumulation অংশটিতে।তাছাড়া তিনি The Civil War in France লেখাটিতে পারি কমিউনের শিক্ষা নিয়ে বলেন:

The working class did not expect miracles from the Commune. They have no ready-made utopias to introduce par decret du peuple. They know that in order to work out their own emancipation, and along with it that higher form to which present society is irresistably tending by its own economical agencies, they will have to pass through long struggles, through a series of historic processes, transforming circumstances and men.
সুতরাং অবজেক্টিভ কন্ডিশান এবং সাবজেক্টিভ প্রিপারেশান যথোপযুক্ত না হলে তা সে যতই সংকট বা মন্দার জন্ম দিক না কেন পুজিঁবাদ বহাল তবিয়তেই থাকবে।
আবার মার্কসের জীবদ্দশায় ঘটা পুজিঁবাদের কোন্ অন্তর্নিহিত পরিবর্তনকে মার্কস 'গোনায় ধরেন নি, কিংবা ধরতে চাননি' বলে অভিযোগ করেছেন অভিজিত সে বিষয়টি পরিস্কার নয়। নাকি তাঁর জীবদ্দশার পরবর্তীতে পুজিঁবাদের সাম্রাজ্যবাদের স্তরে রুপান্তর এবং তার ফলশ্রুতিতে বিশ্ব পুজিঁবাদের নব অবস্থানের প্রেক্ষিতে কেন মার্কস এর 'ভবিষ্যত বাণী' সফল হলো না সে জন্য তার এই ক্ষোভ!
ক্ষুব্ধ হওয়ার কিছু নেই অভিজিত, মৃত মার্কস ধ্বংস না হয়ে টিকে থাকা পুজিঁবাদের টিকে থাকার অন্তর্নিহিত বিবর্তনটি গোনায় না ধরলেও মার্কসের একজন উত্তরসূরী লেলিন তার Imperialism, the Highest Stage of Capitalism গ্রন্থে এবিষয়টি আলোচনা করেছেন। আসুন দেখি আপনার ব্যাবহৃত Wikipedia এর লেনিনিজম বিষয়ক ভূক্তিটি এ বিষয়ে কি বলছে:

Lenin developed a theory of imperialism aimed to improve and update Marx's work by explaining a phenomenon which Marx predicted: the shift of capitalism towards becoming a global system (hence the slogan "Workers of the world, unite!"). At the core of this theory of imperialism lies the idea that advanced capitalist industrial nations increasingly come to export capital to captive colonial countries. They then exploit those colonies for their resources and investment opportunities.This superexploitation of poorer countries allows the advanced capitalist industrial nations to keep at least some of their own workers content, by providing them with slightly higher living standards.

For these reasons, Lenin argued that a proletarian revolution could not occur in the developed capitalist countries as long as the global system of imperialism remained intact. Thus, he believed that a lesser-developed country would have to be the location of the first proletarian revolution. This was an open revision of Marx's thesis that such a revolution could only occur in a developed capitalist country. A particularly good candidate, in his view, was Russia - which Lenin considered to be the "weakest link" in global capitalism at the time. At the time, Russia's economy was primarily agrarian (outside of the large cities of St. Petersburg and Moscow), still driven by peasant manual and animal labor, and very underdeveloped compared to the industrialized economies of western Europe and North America.(emphasis মন্তব্যকারীর)

এখন দেখুন আপনার উল্লেখিত ধর্মপ্রচারক মার্কস সাহেবের একজন প্রধান সাহাবা কেমন করে তার মূল বাণীকে improve and update করছে এমনকি উল্টো কথাও বলছে!!!!!!!!
(চলবে)

অভিজিৎ এর ছবি

উইকি খুঁজবার আগে মার্ক্সের তত্ত্বটার নির্যাস যদি আয়ত্ব করা যেত, তবে আর এই সমস্যা হত না। মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বানী নিয়ে একটা সুন্দর উদাহরণ দেই। মার্ক্স তার তত্ত্ব দেখিয়েছিলেন, সমাজতান্ত্রিক বিল্পব এডভান্সড পুঁজিবাদি রাষ্ট্রগুলোতে আগে হবে। কিভাবে এই উপসংহারে মার্ক্স পৌঁছিয়েছিলেন বলুন তো? কারণ, মার্ক্স তার তত্ত্বে 'প্রফিট'কে দেখেছিলেন 'ভ্যারিয়েবল ক্যাপিটাল এবং লেবার এক্সপ্লোইটেশন'-এর ভিত্তিতে। প্রফিট ছাড়া ক্যাপিটালিজম বেঁচে থাকতে পারে না। আর প্রফিট অর্জিত হয় শ্রমিককে নায্যমূল্য না দেয়ার ফলে যে 'সারপ্লাস ভ্যালু' তৈরি হয় তা থেকে। যেহেতু ফিক্সট ক্যাপিট্যাল থেকে কোন মুনাফা অর্জিত হয় না, অর্জিত হয় কেবলমাত্র ভ্যারিয়েবল ক্যাপিটাল থেকে। কাজেই অধিক মুনাফা অর্জনের জন্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো অধিকহারে শ্রমিকদের কায়িক শ্রমে বাধ্য করবে। আবার অন্যদিকে নতুন নতুন মেশিন এবং নতুন টেকনোলজি ব্যবহারের ফলে বহু শ্রমিক ক্রমাগত চাকরী হারাবে, কারণ শ্রমিকের কায়িক শ্রমকে সুলভে মেশিনের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা হবে। ঠিক একইভাবে ছোট খাট পুঁজির ব্যাবসাপ্রিষ্ঠান গুলো যেহেতু পুঁজির অভাবে ওই সমস্ত নতুন নতুন মেশিন বা টেকনোলজি ব্যবহার করতে পারবে না, সেহেতু তারা প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ধ্বংস হয়ে যাবে আর সে সমস্ত ব্যবাসাপ্রতিষ্ঠানের নিঃস্ব মালিকেরা প্রলেতারিয়েতদের খাতায় নাম লেখাবে। কাজেই পুরো সমাজব্যবস্থা 'Shrinking capitalist class' এবং 'massive Proletariat'-এ বিভক্ত হয়ে যাবে। প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর দুঃখ দুর্দশা অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে এবং ক্রাইসিস পয়েন্টে যখন এও অবস্থা একেবারেই অসহনীয় হয়ে উঠবে, তখন আসবে সতঃস্ফুর্ত বিপ্লব। এই হল মার্ক্সের বিপ্লব-তত্ত্বের মোদ্দাকথা। এখন নিঃসন্দেহে এই ক্লাস পোলারাইজেশন পশ্চিমের এডভান্সড পুঁজিবাদী সমাজেই প্রবলভাবে দৃশ্যমান হবে, কাজেই সেখানেই বিপ্লব হবে আগে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। শুধু এটি নয়, আমি বার বার উল্লেখ করেছি - কার্ল পপার, David Prytchitko, ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা সহ অনেকেই তাদের বইয়ে দেখিয়েছেন যে, মার্ক্সের অনেক ভবিষ্যদ্বানীই ভুল প্রামণিত হয়েছে। কেন? কারণ মার্ক্স যেভাবে তত্ত্ব সাজিয়ে বিপ্লবের প্রস্তাবণা করেছিলেন তার ভিতরেই ত্রুটি ছিলো, ছিলো অসম্পুর্ণতা। এ প্রসঙ্গে পপার লেখেন –

‘It has been predicted revolution would happen first in the technically highest developed countries, and it is predicted that the technical evolution of the ‘means of production’ would lead to social, political, and ideological movements, rather than other way round… But (so-called) socialist revolutions came first in one of the backward countries.’।

এমনকি রাশিয়ায় যখন বিপ্লব হয়েছিলো, তখন রাশিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়ালি ডেভেলপ্ট ছিলো না মোটেই। তাদের ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি হয়েছে বিপ্লব-পরবর্তী যুগে। সমাজতন্ত্রের পতনের পর ব্যাপারটা আরো বেশি দৃশ্যমান। সমাজতন্ত্রে আঁকড়ে পড়ে থাকা তার্কিকেরা 'সমাজতন্ত্রের পুনরুত্থানের' নিদর্শন হিসবে যে দেশ গুলোর - নেপাল, ভেনিজুয়ালা প্রভৃতি দেশের উদাহরণ হাজির করেন সেগুলো কোনটিই কিন্তু 'শীর্ষ পুঁজিবাদী' দেশ নয়। আসলে আমি বার বারই বলেছি আমার প্রবন্ধে 'বাস্তবতা' হচ্ছে কট্টর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে বিপ্লব হচ্ছে না -হবেও না। কারণ সেখানে পুজ়িবাদী সমাজের বিবর্তন হয়েছে। ধণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরিশীলিত রূপ গ্রহণ করার ফলে শ্রমশক্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ কায়িক শ্রম দানের পরিবর্তে বুদ্ধিজনিত শ্রমদান (মেন্টাল লেবার) করছে এবং তারাই মধ্যবিত্তসূলভ জীবন জাপন করছে। তাদের ক্রয় ক্ষমতা ও দৈনন্দিন জীবনের মান উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে এবং এটা সত্য সত্যই বলা চলে যে, সর্বোপরি মালিক এবং শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে মধ্যবর্তী শ্রেণীভুক্ত মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। 'চাইল্ড লেবার' নিন্দিত হয়ে বাতিল হয়েছে অনেক আগেই। শ্রমিকেরা আট ঘন্টার কাজের অধিকার এবং সাপ্তাহিক ২ দিন ছুটি-ছাটা আদায় তো করেছেই, তারা কোম্পানির স্টক কিনতে পারছে, এডভান্সড বেনিফিট পাচ্ছে, কোম্পানির কো-ওনার হতে পারছে। কাজেই পশ্চিমে শ্রমিকদের 'সাম্যবাদী' বিপ্লবের সম্ভাবনা এখন সুদূর পরাহতই বলা চলে।

যখন দেখা গেল পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি মার্ক্সের দেখানো পথে যাচ্ছে না, তখন সেই তত্ত্বকে বাতিল না করে নানা ধরনের 'এড-হক' হাইপোথিসস হাজির করে এর একটা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হল। এটাই মুলতঃ বিজ্ঞান-মনস্কতা পরিপন্থি। লেলিনিজম, ট্রটস্কিজম, মাওইজম- এগুলো হচ্ছে সম্যক উদাহরণ। এগুলো মার্ক্সের মূল বাণীকে improve and updateকরেনি বরং এক ধরনের গোঁজামিল দিয়ে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা ছিল। যেমন মাও কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত কৃষকদের নিয়ে বিপ্লবের কথা বলেছেন, কারন চীনে কারখানার শ্রমিক নিতান্তই কম। এখন মুশকিল হল, এই ধরণের 'মাওবাদী' বিপ্লব মার্ক্সের অরিজিনাল ক্ল্যাসিকাল থিসিসের বিরোধী - কারণ এখানে শ্রমিকেরা কিভাবে চাকরী হারিয়ে, কিংবা ক্ষুদ্রপুঁজির ব্যবসায়ীরা কিভাবে ব্যাবসা হারিয়ে প্রলেতারিয়েতদের খাতায় নাম লিখিয়ে বিপ্লবে যাবে - তা 'মাওয়ের বিপ্লবের' বিরোধি। কাজেই এই সমস্ত 'এড হক' হাইপোথিসিসগুলো মার্ক্সিজমকে বাঁচানোর ছদ্ম-প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু ছিলো না । এ ধরনের বিপ্লব হতে পেরেছে মার্ক্সিজমের সাফল্যের জন্য নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রেই কিছু 'কাল্ট ফিগার' দের কারিশমায় । দুর্ভাগ্যক্রমে , রোমান্টিক মার্ক্সবাদীরা তা বুঝেও বুঝতে চাইছেন না। ধর্মের অনুসারীদের মতই মার্ক্সিজমকে ডিফেন্ড করতে নেমেছেন ।

অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

kallol এর ছবি

আপনিও যদি কার্ল পপার, David Prytchitko, ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা পড়ার পাশাপাশি মার্কসবাদের নির্যাসটুকু সঠিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করতেন তাহলে হয়তো আপনি একদিকে একবার মার্কসবাদকে ধর্মগ্রন্থের মতো অপরিবর্তনীয় বলে দাবী করতেন না আবার অন্যদিকে যখন মার্কসবাদীরা বিভিন্ন ঐতিহাসিক বাস্তবাতায়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মার্কসবাদকে improve and update করেছে তখন আবার সেটাকে 'জোড়াতালি' 'এডহক হাইপোথিসিস' ইত্যাদি বলে বাতিল করতে চাইতনে না।
আপনি বোধহয় মার্কসবাদের মতো সামাজিক সামাজিক বিজ্ঞানকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন যেকারনে বিভিন্ন অবজেক্টিভ কন্ডিশানে এবং বিভিন্ন সাবজেক্টিভ প্রিপারেশানে যে ভিন্ন ধরনের ফলাফল হতে পারে সে বিষয়টি বুঝতে চাইছেননা। "মার্ক্সের অরিজিনাল ক্ল্যাসিকাল থিসিস" আসলে কি? মার্কসের বাক্য বাণীর সমষ্টি নাকি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট কৈাশল? মার্কসের বাক্যবাণী যদি শুনতে চান তাহলে চলুন দেখি রাশিয়ার মত পশ্চাতপদ দেশে বিপ্লব(যেটাকে মার্কসের ত্বত্তের বিপরীত উদাহরণ মনে করেছেন) এর সম্ভাবনা নিয়ে মার্কস কি বলেছেন:

"Theoretically speaking, then, the Russian “rural commune” can preserve itself by developing its basis, the common ownership of land, and by eliminating the principle of private property which it also implies; it can become a direct point of departure for the economic system towards which modern society tends; it can turn over a new leaf without beginning by committing suicide; it can gain possession of the fruits with which capitalist production has enriched mankind, without passing through the capitalist regime, a regime which, considered solely from the point of view of its possible duration hardly counts in the life of society."(1881 letter to Vera Zasulich)

দেখেন মার্কস কিভাবে নিজেই নিজের ত্বত্তকে জোড়াতালি দিচ্ছে!!!!!!! আপনার দেখানো "সুন্দর উদাহরণের" "পশ্চিমের এডভান্সড পুঁজিবাদী সমাজেই প্রবলভাবে দৃশ্যমান হবে, কাজেই সেখানেই বিপ্লব হবে আগে" এইটার বিপরীতে একেবারে পুঁজিবাদে না গিয়েও রাশিয়ার সমাজতন্ত্রে ধাবিত হওয়ার কথা(it can gain possession of the fruits with which capitalist production has enriched mankind, without passing through the capitalist regime) বলেছেন!!!!!!

অনুপম সৈকত শান্ত এর ছবি

পোস্ট লেখকের এই কমেন্ট পড়ে অভিভূত হতে হয় বৈকি!

উইকি না পড়ে মার্ক্সের তত্ত্বের নির্যাস আয়ত্ব করার উপদেশ (!) দিয়ে (না-কি মার্ক্সের তত্তের নির্যাস আয়ত্ব না করে শুধু উইকি পড়ার সমস্যা?) শুরু করা বক্তব্যে এটাই পরিষ্কার হয় যে পোস্ট লেখক অন্তত মার্ক্সের তত্তের নির্যাস ধরতে পেরেছেন! স্বভাবতই আশায় থাকি- আমরা যারা সেই নির্যাস আয়ত্ত করতে পারিনি- তারা হয়তো ওনার কাছ থেকে এ ব্যাপারে সহযোগীতা পাবো। অপেক্ষা করতে থাকি, একসময় অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটে, কেননা তিনি আমাদের সেই জ্ঞান দিয়ে বাধিত করেন। পোস্ট লেখকের আলোচনায় ফুটে মার্ক্সের বিপ্লব তত্তের মোদ্দা কথা। আমরা অভিভূত হই, মুগ্ধ হই। - কৃতজ্ঞও হতে চাই- কিন্তু পারি না। তার মানে আবার এই না যে, আমরা অকৃতজ্ঞ। ঘটনা যে অন্যখানে----

ওনার দেখানো মার্ক্সের বিপ্লব তত্ত কয়েকবার পড়ি, বারবার পড়ি, খুটে খুটে পড়ি। ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। মার্ক্সের তত্ত্বের নির্যাস কি এই? দেখি পোস্ট লেখক মার্ক্সের বিপ্লব তত্তের মোদ্দা কথা (এটাই কি মার্ক্সের তত্তের নির্যাস??) বলতে কি বুঝিয়েছেন? পোস্ট লেখকের ভাষায়ঃ

"---------------- কাজেই পুরো সমাজব্যবস্থা 'Shrinking capitalist class' এবং 'massive Proletariat'-এ বিভক্ত হয়ে যাবে। প্রলেতারিয়েত শ্রেনীর দুঃখ দুর্দশা অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে এবং ক্রাইসিস পয়েন্টে যখন এও অবস্থা একেবারেই অসহনীয় হয়ে উঠবে, তখন আসবে সতঃস্ফুর্ত বিপ্লব। এই হল মার্ক্সের বিপ্লব-তত্ত্বের মোদ্দাকথা। এখন নিঃসন্দেহে এই ক্লাস পোলারাইজেশন পশ্চিমের এডভান্সড পুঁজিবাদী সমাজেই প্রবলভাবে দৃশ্যমান হবে, কাজেই সেখানেই বিপ্লব হবে আগে।"

এই যে সতঃস্ফূর্ত বিপ্লবের কথা, ক্রাইসিস পয়েন্টে অবস্থা যখন অসহনীয় হয়ে উঠবে তখন সতঃস্ফূর্ত বিপ্লব করবে শ্রমিক শ্রেণী (দেয়ালে পিঠ ঠেকার আলোচনা আগেই করেছিলেন!!), - এটা মার্ক্সের বিপ্লব তত্তের মোদ্দা কথা? !!!! আসলেই কি তাই??

অবাক হতেই হয়! অভিভূত ও মুগ্ধ না হয়েই যায় না, জাকির নায়েক গোষ্ঠীদের এই পদ্ধতি সম্পর্কে আগে থেকেই জানা ছিল বলে বিমূঢ় হইনি। জাকির নায়েকরা কোরআন-হাদীসকে নিজের মত ব্যাখ্যা এমনকি বিকৃতও করে, ইসলামকে বিজ্ঞানময় প্রমাণ করার জন্য, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য। আর পণ্ডিত অভিজিৎ মার্ক্সের কথাকে বিকৃত করে উপস্থাপন করছেন, মার্ক্সবাদের ভ্রান্তি আবিষ্কার করার জন্য। এই যা পার্থক্য!! তাছাড়া উভয়ের কাজের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যাহোক, এই পণ্ডিতের বাগাড়ম্বর তো পোস্ট পড়তে গিয়েই বুঝেছি, এটা নতুন নয়, কমেন্টেও তার ধারাবাহিকতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক! আমি দুটো বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছিঃ

মার্ক্সবাদের তত্ত্ব আসলে কোনটি? তত্ত্ব আর তত্ত্ব অনুযায়ী কোন প্রেডিকশন - দুটোর পার্থক্য কি? তত্ত্ব সঠিক না বেঠিক এটা কি প্রেডিকশন ঠিক হলো না ভুল হলো তা দ্বারা নিরূপিত হয়?

মার্ক্সের দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ, লেবার থিওরি অব ভ্যালু, থিওরি অব সার্প্লাস ভ্যালু, ওনার ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, ওনার পুঁজি সংক্রান্ত আলোচনা - এসমস্তের কোথায় কি ভুল একটু ধরিয়ে দিবেন কি? (হ্যা, আপনি একজায়গায় বলেছেন- মার্জিনাল ইউটিলিটি থিওরি লেবার থিওরিকে প্রতিস্থাপন করেছে- সে প্রসঙ্গে আলোচনা পরে করা যাবে!!)। সেটা না করে মার্ক্সের প্রেডিকশন (আপনার ভাষায় ভবিষ্যদ্বানী) ভুল হয়েছে, সেটা বলার মাধ্যমে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন? উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে পুঁজিবাদী দুনিয়ার হাল হকিকত দেখে মার্ক্স-এঙ্গেলস ৪টি শিল্পোন্নত দেশে আগেভাগে বা অল্প সময়ের মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হওয়ার যে সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন- সে ব্যাপারেই পরবর্তীতে এঙ্গেলসকে ভিন্নসুর অবলম্বন করতে দেখা যায়। আরো পরে লেনিন এসে অনুন্নত রাশিয়ায় বিপ্লব করেন। লেনিন মার্ক্সবাদের তত্ত্বকে কাজে লাগিয়েই রাশিয়ায় বিপ্লব করেন, শ্রমিক শ্রেণী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কাজ করেন। মার্ক্সবাদ বা মার্ক্সের তত্ত মানে যদি আপনার দেখানো প্রেডিকশনকেই বুঝে থাকি- তবে সেই প্রেডিকশন তত্ত দিয়ে কি করে লেনিনের বিপ্লব সাধিত হয়?

কোন একটি সূত্র বা তত্ব জানা থাকলে, সেটি দিয়ে প্রকৃতির বা বস্তুজগতের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, তেমনি ভবিষ্যতের অনেক কিছুও প্রেডিক্ট করা যায়। সেটাকে কি ভবিষ্যদ্বানী বলা যায়? ধরেন এ মুহুর্তে একটি নির্দিষ্ট গতিবেগে চলমান কোন বস্তু নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌছতে পারবে কত সময়ে পরে সেটা এখনই কেউ যদি হিসাব করে বলে দেয়, সেটাকে কি ভবিষ্যদ্বানী বলবেন? মহাকাশযান পাঠানোর পরে কবে কোথায় কখন পৌছবে সেটাও হিসাব করে বলে দেয়া হচ্ছে, এই যে ভবিষ্যতের কথা আগে থেকেই হিসাব করে বের করে দেয়া- সেটা কি ভবিষ্যদ্বানী? আবহাওয়ার পূর্বাভাস কি ভবিষ্যদ্বানী? না-কি, সূত্র/তত্তের প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন ফ্যাক্টর হিসাব করে করা প্রেডিকশন? ঘুর্ণিঝড় নার্গিসের ব্যাপারে প্রথমে বলা হচ্ছিল এটি বাংলাদেশের উপর দিয়ে যাবে, কিন্তু পরে দেখা গেল সেটার গতিমুখ পরিবর্তন হয়ে বার্মায় আঘাত হানে। প্রথমে পুর্বাভাস খাটেনি জন্য শুরুর অবস্থায় যে হিসাবাদি করা হয়েছে যেসব সূত্রগুলো দিয়ে সেগুলো কি ভুল বলা যাবে? নাকি বলতে হবে, আরেকটি বিশেষ অবস্থা তৈরী হয়ে ঝড়টির গতিমুখ পরিবর্তিত হওয়ায় এমন টি হয়েছে- যে বিশেষ অবস্থাটি পূর্বে উপস্থিত ছিল না।

মার্ক্স-এঙ্গেলস পুঁজিবাদকে ধরে ধরে বিশ্লেষণ করে, এর অভ্যন্তরীন বিবর্তনকে দেখেই- সমস্ত কিছু দাঁড় করিয়েছেন, সেকারণে পুঁজির বিকাশটি তাঁরা সফলভাবে দেখিয়েছেন, মনোপলি পর্যন্ত ব্যাখ্যা করে গিয়েছেন- এমনকি সাম্রাজ্যবাদের দিকে এর টার্ণের সম্ভাবনার কথাও বলে গিয়েছেন, যে সম্পর্কে পরবর্তীতে লেনিন বিস্তারিত ব্যাখ্যা দাঁড় করেন। এটাকে কি ডেভলোপমেন্ট বলে না? কোথায় পেলেন গোঁজামিল? সায়েন্সের ইতিহাস, মানব সমাজের ইতিহাস তো এই ধারাবাহিক ক্রমান্বয়তার। সেটা গোঁজামিল হবে কেন? কোথায় গোঁজামিল পেলেন? মাও এর উদাহরণটিও হাস্যকর! মার্কস কোথায় বলেছেন, এমন একটি আধা সামন্তীয়- আধা উপনিবেশ রাষ্ট্রে বিপ্লব করা যাবে না- কৃষকদের বিপ্লবে অংশ নেয়া যাবে না- কেবল কারখানার শ্রমিকদেরই বিপ্লবে অংশ নিতে হবে?? আর, এই প্রায়োগিক জায়গাটি তত্ত হতে যাবে কেন? সেটি মার্ক্সের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, লেবার থিওরি অব ভ্যালু বা সারপ্লাস থিওরি অব ভ্যালুর কোন জায়গায় বিপরীত? এসব গালগল্পের অভিযোগ কোথায় পেলেন?

মার্ক্সের আগে থেকে সকলেই জানে- আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবে কৃষক শ্রেণীর ভূমিকা কতখানি। পশ্চাদপদ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে কৃষকশ্রেণীর সংগ্রামের ভূমিকা কতখানি, এবং মার্কস কখনো বলেননি যে, সামন্তীয় সিস্টেম উৎখাতের জন্যও কারখানার (কায়িক) শ্রমিকদের ছাড়া চলবে না!!!! আশ্চর্য সব আলোচনা!! এই লোক বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করেন, বিজ্ঞানকে ভালোবাসেন, এটা বিশ্বাস করাই কঠিন হয়ে পড়েছে!!!

অভিজিৎ এর ছবি

এই কমেন্টে ব্যক্তি-আক্রমনের প্রাবাল্য এতই প্রবল যে এর যথার্থ উত্তর দেওয়াই সঙ্গীন। পুরো লেখায় বিশেষণের ছড়াছড়ি। অনাবশ্যকভাবে 'জাকির নায়েক' প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন, লেখাও শেষ করেছেন, 'এই লোক বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখি করেন, বিজ্ঞানকে ভালোবাসেন, এটা বিশ্বাস করাই কঠিন হয়ে পড়েছে'। এগুলো বললেই যদি তর্কে যেতা যেত, তবে আর লজিকে 'Argumentum ad hominem' বলে কিছু আর থাকত না। সমাজে আসলেই কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হওয়ার কোন কমতি নেই। ব্যক্তিআক্রমনাত্মক এবং খিস্তি খেউর করার পরও তারা শ্রমিক-দরদী হন, সমাজের ভালর জন্য উচাটন হন। গালাগালির ঘুর্নীঝড় সৈকত প্লাবিত করলেও তাদের নাম হয় 'অনুপম' কিংবা 'শান্ত'!

ভদ্রলোক আমার নামটি জানবার পরও আমাকে সম্বোধন করেন 'এই লোক' বলে। মার্ক্সিস্ট বলে না কথা। তিনি মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বানীর সাথে বিজ্ঞানের ভবিষ্যদ্বানী কিভাবে মিলিয়েছেন তার নমুনা দেখুন -

কোন একটি সূত্র বা তত্ব জানা থাকলে, সেটি দিয়ে প্রকৃতির বা বস্তুজগতের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, তেমনি ভবিষ্যতের অনেক কিছুও প্রেডিক্ট করা যায়। সেটাকে কি ভবিষ্যদ্বানী বলা যায়? ধরেন এ মুহুর্তে একটি নির্দিষ্ট গতিবেগে চলমান কোন বস্তু নির্দিষ্ট দূরত্বে পৌছতে পারবে কত সময়ে পরে সেটা এখনই কেউ যদি হিসাব করে বলে দেয়, সেটাকে কি ভবিষ্যদ্বানী বলবেন? মহাকাশযান পাঠানোর পরে কবে কোথায় কখন পৌছবে সেটাও হিসাব করে বলে দেয়া হচ্ছে, এই যে ভবিষ্যতের কথা আগে থেকেই হিসাব করে বের করে দেয়া- সেটা কি ভবিষ্যদ্বানী? আবহাওয়ার পূর্বাভাস কি ভবিষ্যদ্বানী? না-কি, সূত্র/তত্তের প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন ফ্যাক্টর হিসাব করে করা প্রেডিকশন?

অনুপম সাহেব বুঝছেনই না যে, পদার্থবিজ্ঞানএর মূল নীতির উপর নির্ভর করে তত্ত্বের যে ভবিষ্যদ্বানি করা হয়, তার সাথে মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বানীর পার্থক্য আসলেই আকাশ-পাতাল। বিজ্ঞান 'দ্বান্দ্বিকতা' নিয়ে কাজ করে না, কাজ করে cause and effect নিয়ে। আর বিজ্ঞানের তত্ত্বের সাহায্যে যে ভবিষ্যদ্বানী করা হয় তা শুধু নিঁখুত ফলাফলই দেয় না, তার শুদ্ধতা অশুদ্ধতা একদম নিঁখুতভাবে পরিমাপ করা যায়। যেমন ২০ গ্রাম ওজনের একটি বস্তুতে ২ নিউটন বল প্রয়োগ করা হয়, তবে বস্তুটার কতটুকু সরণ হবে, তা স্কুলের ছাত্ররাও হিসেব করে বের করতে পারবে। ঘুর্নিঝড় কবে আঘাত করব, কততূকু জায়গা জুইড়া তান্ডব চালাইবো, সবই এখন আগে ভাগে বইলা দেওয়া যায়। এইবার যে ঘুর্নিঝড় নিউ অরলিন্সে আঘাত করলো সেইটার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া গুলা দেখেন। সবই নিয়ম মতই হইছে। অথচ, মার্ক্সের বিপ্লবের তত্ত্ব তার ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী কার্যকরী না হওয়ার পরও সেটা 'নিঁখুত বিজ্ঞান'! পৃথিবী নাকি ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র আর তা থেকে সাম্যবাদে যাইবো। রাশিয়া, পূর্বইউরোপের দেশগুলো, চায়না সবাই এই ভবিষ্যদ্বানীরে কাঁচকলা দেখাইয়া কমিনিজমের মোহ থেইকা ফিরা গেছে পুঁজিবাদের রাস্তায়। সমাজতান্ত্রিক দেশ খুঁজতে গেলে আইজকা বাটি চালান দেওন লাগে। আর তারপরো শান্ত সাথেব 'অনুপম' ভঙ্গিতে মার্ক্সরে বিজ্ঞান বইলা পুজ়া কইরাই যাইতাছেন, আর চোক্ষা বাঁশের আগায় লাল পতাকা বাইন্ধ্যা আকাশে 'বিপ্লবের' লাল ঝান্ডা উঠায়াই রাখছেন।

পুজা করতাছেন করেন, যারা হেইটা অস্বীকার করে তাগো গাইল পাড়লেই যদি মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান হইয়া যায়, তা হইলে বলনের কিছু নাই। গালাগালির উৎকর্যতার ভিত্তিতে য়ার অন্ধ পুজার ভিত্তিতে কোন তত্ত্বের বৈজ্ঞানিকতা কোথাও গৃহীত হয় নাই।



পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)


পান্ডুলিপি পোড়ে না। -- বুলগাকভ (মাস্টার এন্ড মার্গেরিটা)

kallol এর ছবি

অভিজিত সাহেব দাবী করেছেন:
"মার্ক্সের সনাতন ধারণায় সমগ্র উৎপাদিকা শক্তিকে কেবলমাত্র কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমিকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেছিলেন – যা আজকের দুনিয়ার সাপেক্ষে অনেকটাই বাতিলযোগ্য।"

মার্কস উতপাদিকা শক্তিকে কেবল কায়িক শ্রমদানকারী শ্রমিকের মাধ্যমে মূল্যায়ন করেছিলেন এমন কথা আপনি কোথায় পেলেন?????

মার্কসের মতে যে শ্রম পুজিঁপতিদের উদ্বৃত্ত মূল্য বা সারপ্লাস ভ্যালু তৈরীতে নিয়োজিত হয় তাই হলো প্রডাক্টিভ লেবার বা উতপাদিকা শ্রম।এ শ্রম কায়িক বা মানসিক যে কোন ধরনেরই হতে পারে। তিনি তার Theories of Surplus Value (TSV) Vol.1.p158 তে বলেছেন:

"A writer is a productive labourer not in so far as he produces ideas, but in so far as he enriches the publisher… The use value of the commodity in which the labour of a productive worker is embodied may be of the most futile kind… It is a definition of labour which is derived not from its content or result, but from its particular social form."

তিনি শিল্পীর শ্রম সম্পর্কে বলেছেন:

"It is the same with enterprises such as theatres, places of entertainment, etc. In such cases the actor’s relation to the public is that of an artist, but in relation to his employer he is a productive labourer."

কাজেই মার্কস কেবল কায়িক শ্রমকে উতপাদিকা শক্তির মাঝে অন্তর্ভুক্ত করেছেন আপনার এদাবী স্রেফ ভুয়া!
একই ভাবে আপনি যে দাবী করেছেন "আধুনিক বিশ্বের সফটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু সনাতন শ্রমিক এবং কাঁচামালের সংজ্ঞা এবং সম্পর্কই পালটে দিয়েছে।"--- এটাও অমূলক কেননা 'সনাতন শ্রমিকের' মত সফ্টওয়ার ইন্ডাষ্ট্রিতে যারা কাজ করেন তারাও অর্থের বিনিমযে তাদের শ্রম বিক্রি করছেন যে শ্রমের আউটপুট ব্যবহার করে পুজিঁপতি বিরাট মুনাফা অর্জন করে অর্থাত সনাতন শ্রমিকের মত আধুনিক শ্রমিকের শ্রমও সারপ্লাস ভ্যালু তৈরী করছে এবং শোষিত হচ্ছে ।
Christian Fuchs এর কথা ধার করে বলা যায়:
"Does a software engineer produce surplus value? Let us reconsider the definition Marx gave us: "This increment or excess over the original value I call 'surplus-value'" (Marx 1867, 165). According to this definition software engineers produce surplus value because the capitalist buys labour power and the necessary means of production and the piece of software is sold at a value which is higher than the capital invested. The value of a software does not amount to its sum of constant and variable capital. So surplus value must have been produced. Programmers work more than they are being paid for; hence, they perform surplus-labour and produce surplus value. "

এখানে যা পাল্টিয়েছে তা হলো শ্রমের ধরন, শ্রম শোষণের মাত্রা(শোষনের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে কেননা কেবল এককালীন শ্রমের মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে পুজিঁপতি যে সফটওয়ারটির মালিক হয় তা বার বার স্রেফ কপি করে বিক্রি করে যে মুনাফা অর্জন করে তা ক্রমশ বাড়তে থাকে) কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিন্তু সে শোষিত শ্রমিকই ; তারা তুলনামূলক বেশী মজুরী পাওয়ার সুবাধে মধ্যবিত্ত সুলভ জীবন যাপন করলেও মধ্যবত্তি মোটেই নয় ।

kallol এর ছবি

কাল মার্কস জাতিগত, লৈঙ্গিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় সঙ্ঘাতকে গুরুত্ব না দিয়ে কেবল 'ক্লাস কনফ্লিক্ট'কেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন এ কথা বলে জনাব অভিজিত অর্থনীতিবিদ অমর্ত সেন কে উদ্ধৃত করে বলেছেন:
"শ্রেণী ছাড়াও আসলে অসাম্যের অনেক উৎস আছে; অসুবিধা আর বৈষম্যের সমস্ত কিছু কেবলমাত্র শ্রেনী দ্বারাই নির্ধারিত হবে – এই ধারণা ত্যাগ করতে হবে।"

মার্কসবাদীদের বিরুদ্ধে ক্লাস রিডাকশনিজম বা শ্রেনী সর্বস্বতার এই অভিযোগ নতুন নয়।বিষয়টি একটু ব্যাখ্যার দাবী রাখে। ক্লাস বলতে মার্কসবাদীরা আসলে কি বোঝে-স্রেফ অর্থের হিসাবে উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত ? এভাবে বুঝলে এদের মধ্যকার কনফ্লিটকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজের সমস্ত দ্বন্দ্ব সংঘাতের ব্যাখা করাটা মেনে নিতে সমস্যা হয়। মার্কসবাদীরা কোন একটি সমাজের উতপাদনের উপকরনের উপর মালিকানা সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে সমাজে মূলত তিনটি শ্রেনীর অস্তিত্বের কথা বলে থাকেন। পুজিঁবাদী সমাজে মালিক শ্রেনী বা শোষক শ্রেনীর হাতে থাকে উতপাদনের উপকরনের মালিকানা যা ব্যবহার করে তারা উতপাদনের উপকরনের উপকরনের উপর মালিকানা নেই এমন শ্রমিক শ্রেনীকে শোষন করে আর এ দুটি শ্রেনীর মাঝে থাকে পেটি বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত শ্রেণী যাদের উতপাদনের উপকরনের উপর মালিকানা থাকে না কিন্তু এরা মালিক ও শ্রমিক শ্রেনীর মাঝে থেকে মালিক শ্রেণীকে সহায়তা করে থাকে। একই ভাবে দাস যুগে দাস মালিক ও দাস এবং সামন্ত যুগে সামন্ত প্রভু ও ভুমি দাস ।

এখন কথা হলো সমাজে এধরনের অর্থনৈতিক শ্রেনী ছাড়া কি অন্য কোন ধরনের বিভাজন থাকেনা? থাকে। মার্কস বাদীরা কখনও জাতিগত, লৈঙ্গিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক কিংবা ধর্মীয় বিভাজনকে একবারে অস্বীকার করেনা। তারা যা করে তা হলো এধরনের বিভাজনকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত তৈরী হয় কিংবা তৈরী করা হয় তার প্রকৃত রুপটি উন্মোচন করার চেষ্টা করে। সমাজে সবসময়ই তো বিভিন্ন ভাষা, জাতি, বর্ণ কিংবা ধর্মের মানুষ বসবাস করে। তাদের মধ্যে কি সবসময়ই সংঘাত লেগে থাকে নাকি কোন বস্তুগত কারন ছাড়া স্রেফ ভাষা, জাতি, বর্ণ কিংবা ধর্মের মত সাংস্কৃতিক ভিন্নতা কোন সংঘাতের কারণ হতে পারে?? তাহলে যখন সংঘাত লাগে তখন কি কারনে লাগে?
অন্যদিকে জীবন ধারনের জন্য মানুষকে সবসময়ই কোন কোন না কোন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নিয়োজিত থাকতে হয়। আর শ্রেনীবিভক্ত সমাজে শ্রমিক শ্রেণী যেহেতু সর্বদাই মালিক শ্রেণী দ্বার শোষিত হয় সেহেতু শোষনের ধরণ উচ্চ, তীব্র, মধ্যম যাই হোক না কেন কিংবা শোষিত ব্যাক্তিটি দাস, ভুমি দাস, কারখানার শ্রমিক, সফ্টওয়ার ইন্ডাস্ট্রির হোয়াইট কালার শ্রমিক যেই হোক না কেন মালিক শ্রেনীর সাথে স্রেফ অর্থনৈতিক কারনেই তার সাথে একটি এন্টাগনিজম কাজ করে। Jean Belkhir বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে:

"Class relations -- whether we are referring to the relations between capitalist and wage workers, or to the relations between workers (salaried and waged) and their managers and supervisors, those who are placed in "contradictory class locations," (Wright, 1978) -- are of paramount importance, for most people's economic survival is determined by them. Those in dominant class positions do exert power over their employees and subordinates and a crucial way in which that power is used is through their choosing the identity they impute their workers. Whatever identity workers might claim or "do," employers can, in turn, disregard their claims and "read" their "doings" differently as "raced" or "gendered" or both, rather than as "classed," thus downplaying their class location and the class nature of their grievances. To argue, then, that class is fundamental is not to "reduce" gender or racial oppression to class, but to acknowledge that the underlying basic and "nameless" power at the root of what happens in social interactions grounded in "intersectionality" is class power."

যেমন রেসিজমের কথাই ধরা যাক। কোন একটি রাষ্ট্র যখন রেসিষ্ট হয় তার কারণ এই নয় যে একটি নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সেই রাষ্ট্রের এক রহস্যময় কারনে স্যাডিস্টিক ঘৃণা কাজ করে, বরং রেসিষ্ট হওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের শাষক শ্রেণীর একটি vested interest কাজ করে( মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের হঠাত করে আরব কিংবা মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে উঠার কারন যে কোন ভাবেই ধর্ম নয় বরং বিপুল তেল সম্পদের উপর অধিকার, ডলার হেজিমনি কিংবা মিলিটারী ইন্ডাষ্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স এ বিষয়টি ইতিমধ্যেই সবার কাছে পরিস্কার)। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শাষক শ্রেণী তার সেই vested interest কে গোপন রেখে স্বার্থ হাসিলের জন্য এসবের উপর একটি ভিন্ন আবরন দেয়ার চেষ্টা করে । এর সুবিধা হল এর মাধ্যমে শোষিত শ্রেণীকে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিবাদ মান বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করে প্রতিরোধের সম্ভাবনা নস্বাত করে দেয়া যায়।

মার্কস এ বিষয়টি লক্ষ করে ১৮৭০ সালে তার নিউইয়র্কের দুই বন্ধুকে লেখা এক চিঠিতে লেখেন:
"Every industrial and commercial center in England now possesses a working class divided into two hostile camps, English proletarians and Irish proletarians. The ordinary English worker hates the Irish worker as a competitor who lowers his standard of life. In relation to the Irish worker he regards himself as a member of the ruling nation and consequently he becomes a tool of the English aristocrats and capitalists against Ireland, thus strengthening their domination over himself. He cherishes religious, social, and national prejudices against the Irish worker. His attitude towards him is much the same as that of the "poor whites" to the Negroes in the former slave states of the U.S.A. The Irishman pays him back with interest in his own money. He sees in the English worker both the accomplice and the stupid tool of the English rulers in Ireland. This antagonism is artificially kept alive and intensified by the press, the pulpit, the comic papers, in short, by all the means at the disposal of the ruling classes. This antagonism is the secret of the impotence of the English working class, despite its organization. It is the secret by which the capitalist class maintains its power. And the latter is quite aware of this."

আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের মাঝে যে কনফ্লিক্ট সেটার মূলকারণ কি বর্ণ নাকি উতপাদনের উপকরনের উপর একদলের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার? যদি বর্ণ হয় তাহলে কৃষ্ণাঙ্গ এলিট শ্রেণীর উপস্থিতির কি ব্যাখ্যা?
AMY CHUA তার WORLD ON FIRE বইতে লিখেছেন:
“In addition to wealthy white former colonialist Africa is also full of successful & in some case market-dominated African minorities….. Kenya’s kikuyus, who are concentrated in the fertile central province and the capital Nairobi, provide a typically complicated example…..while the country was still under british rule the Kikuyu emerged as a disproportionately urban, capitalist elite among Kenya’s indigenous tribes.”(পৃষ্ঠা ১০৪)

ল্যাটিন আমেরিকার বলিভিয়ার দিকে তাকালে দেখা যায়:

" … whites make up 5 to 15% of population , mestizos make up 20 to 30 % and Indians 60 to 65 %..... wealth can turn a mestizo or even an Indian into a white. As the bolivian intellectual Tristan Marof wrote decades ago, ‘ Whites are all that have fortune in Bolivia, those that exercise influence and occupy high positions. A rich mestizo or Indian, although he has dark skin, considers himself white"(AMY CHUA ,পৃষ্ঠা ৫৪)

যেকারনে ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের কাছে Race কিংবা ethnicity এর appeal সামান্য, ফলে বলিভিয়া, ভেনিজুয়েলা সহ ল্যাটিন আমরিকার প্রায় সব দেশেই শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে নতুন ধরণের সমাজ গঠনের আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠেছে।

ইনসিডেন্টাল ব্লগার [অতিথি] এর ছবি

অভিজিত রায়কে ধন্যবাদ বিষয়টি নিয়ে সাহস করে লিখবার জন্য।

১.
সহজ বোধে মার্কসবাদের মূলত তিনটি দিকই বুঝি বা বোঝার চেষ্টা করি। প্রথমতঃ মার্কস এবং এঙ্গেলস মিলে যে তত্ত্ব বা স্বতসিদ্ধ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন, তা গবেষণার মাপকাঠিতে কতটা গ্রহণযোগ্য? অর্থাৎ আমি জানতে চাইবো, আর দশটা সাধারণ সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা যে সব মানদন্ডের কষ্টিপাথরে যাচাই হবার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্যতার threshold পার হয়, মার্কসবাদ কি সে সব সফলভাবে পার হতে পেরেছে কিনা? এখন মার্কসবাদ কি 'বিশুদ্ধ বিজ্ঞান', নাকি 'অশুদ্ধ বিজ্ঞান', 'সমাজ বিজ্ঞান' নাকি 'অপবিজ্ঞান' এ নিয়ে আমরা বছরের পর বছর তর্ক করে যেতে পারি এখানে, কিন্তু সন্দেহ আছে সে তর্কের আদৌ কোন শেষ আছে কিনা। তাই, যারা এখানে মার্কসবাদ তত্ত্বের বৈজ্ঞানিকতা বা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে এত কথা লিখেছেন, তাদের কাছেই সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইবো কিছু জিনিস:

ক) মার্কস এঙ্গেলসের গবেষণার স্যাম্পল কারা ছিল? কতটা বিস্তৃত ছিল সে স্যাম্পল?
খ) কি কি তথ্যসূত্র ব্যবহৃত হয়েছে সে গবেষণায়? কতটা বিস্তৃত ছিল সে সব সূত্র?
গ) কোন সীমাবদ্ধতা থেকে থাকলে (যা থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ গবেষণা মানুষ করে, ফেরেশতা নয়!), সে সবের কি মেথডলজিক্যাল ডিফেন্স মার্কস-এঙ্গেলস দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন?
ঘ) সে সবের সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা কি ছিল তখন এবং এখনকার একাডেমিয়ার মাপকাঠিতে?
ঙ) সবচেয়ে যেটা জরুরী, সে সব সূত্রের ভিত্তিতে যে সাধারণীকরণ করা হয়েছে তা গবেষণার মাপকাঠিতে কতটা গ্রহণযোগ্য?

উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা নেই, তাই জানতে চাইলাম যাঁরা জানেন তাদের কাছে। এ প্রশ্নগুলোর সহজবোধ্য কোন উত্তর কেউ যদি দেন তাহলে আমরা পড়ে জানতে পারবো এবং বাধিত হব।

২.
দ্বিতীয়টি হল এই তত্ত্বটি যাদের জীবনাদর্শ, তাদের আচরণ বা এটিচিউড কতটা বিজ্ঞানমনষ্ক? এ ধরণের কোন ক্রিটিক্যাল আলোচনার সূত্রপাত হলেই যেভাবে মার্কসবাদের ধারক বাহকদের অন্যদেরকে "ছাগল", "বকলম", "সমাজতন্ত্রের শত্রু", "লোভী", "ষড়যন্ত্রকারী" "এই লোক" ইত্যাদি নানা বিশেষ্য ও বিশেষণে ভূষিত করতে দেখি তাই এ প্রশ্নটি করতে বাধ্য হলাম। কারণ, এ ধরণের অসহনশীল, গোঁড়া, এমনকি সাধারণ বিচারেও অসৌজন্যপূর্ণ আচরণ করতে সাধারণত আমরা মোল্লাদের বা মৌলবাদীদেরই দেখে থাকি কিনা! (কিছুদিন আগে এমনই আরেক বিতর্কে আমারও অভিজিৎ বাবুর মত এসব বিশেষ্য/বিশেষণে ভূষিত হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এখানে এবং এখানে দেখুন।) যে তত্ত্ব এত প্রগতিশীল, তার সমর্থকদের অভিব্যক্তি কেন এতটা প্রতিক্রিয়াশীল হবে? এখন কেউ কেউ যুক্তি দেখাবেন - তত্ত্বানুসারীদের গোঁড়ামী (বা চারিত্রিক সীমাবদ্ধতা) দিয়ে কি তত্ত্বের উৎকর্ষ মূল্যায়ন করা যায়? হয়তো যায়না। কিন্তু আবার যুক্তিটা অনেকটা গোঁড়া মোলভীদের লম্ফঝম্পকে ডিফেন্ড করতে যাওয়া মডারেট মোল্লাদের এপলজির মতোই শোনায়। কারণ তারা দাবী করে থাকেন, কোরাণ হাদিস থেকে বিন লাদেন মওদুদীরা তৈরী হননি, এসবের অপব্যাখ্যা থেকে তৈরী হয়েছেন। সুতরাং, যে তত্ত্বের ভেতর এতখানি ভুল বোঝাবুঝি, ভুল ব্যাখ্যা আর ভুল প্রয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা নিহিত, তার বৈজ্ঞানিকতা নিয়ে বা ঐতিহাসিক অনিবার্যতা নিয়ে যুক্তিতর্ক করার সময় অন্যকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে সে তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক সুপিরিয়রিটি কতটা প্রতিষ্ঠিত করা যায় তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে।

৩.
তৃতীয় দিকটি মার্কসবাদকে ভিত্তি করে রাষ্ট্রীয় বা দলীয় কাঠামোতে তার প্রায়োগিক দিক। সে আলোচনা এখানে মনে হয়না খুব একটা প্রাসঙ্গিক। সুতরাং সোভিয়েত পতন মার্কসবাদের পতন নির্দেশ করে কিনা, সে ধরণের কুটিল তর্কে যাবার মানে হয়না এখন।

৪.
@মোশাররফ#৭৩
আপনি আপনার আলোচনা শুরুই করেছেন এই বলে: "মার্কসবাদ একটি বিজ্ঞান।" পরে অনুচ্ছেদে আবারও পুনরাবৃত্তি করেছেন - "এটা হলো বিজ্ঞান।" এ থেকে মনে হচ্ছেনা এর পর আর কোন আলোচনার অবকাশ আপনি রেখেছেন। মার্কসবাদ যে বিজ্ঞান নাও হতে পারে, সে সংশয়ের অবকাশ কি কোথাও রেখেছেন আপনার আলোচনায়? যদি রাখতেন, তবে আপনার দিক থেকে সেটি হতে পারতো বিজ্ঞানমনষ্কতার একটি দৃষ্টান্ত (কারণ, এটুকু সংশয় মনে হয় বিজ্ঞানমনস্কতার জন্য জরুরী ছিল)। কিছু মনে করবেন না, এভাবে মোল্লারা কথা বলেন। আর এই যদি হয় আপনার ভাষায় "বিজ্ঞানসম্মতভাবে যুক্তি-তর্ক", তাহলে আর কি বলবো! আরেক জায়গায় অবশ্য বলেছেন: "আবার, এটা ও হতে পারে আমরা উভয়ে ভুল। কিন্তু সেটাও কাউকে না কাউকে প্রমাণ করতে হবে।" কেউ কিছু ভুল প্রমাণ করতে না পারলেই তা সঠিক হয়ে যায় - এ ধরণের যুক্তিপদ্ধতির সাথে গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসীদের যুক্তিপদ্ধতির যে খুব মিল আছে, তা নিশ্চয়ই আপনিও খেয়াল করেছেন। এটা বৈজ্ঞানিক যুক্তিপদ্ধতি নয়। বরং আপনার যুক্তি ধার নিয়েই আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি - তত্ত্ব হিসেবে মার্কসবাদ যে সমাজে নিহিত অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ঐতিহাসিক অনিবার্যতার কথা বলে, তা কোথায় বৈজ্ঞানিকভাবে (আপনার ভাষায়) "প্রমাণিত" হয়েছে বলতে পারেন? কিছু empirical evidence এর রেফারেন্স দেবেন প্লীজ যাতে করে আমরা সে সব পড়ে উপলদ্ধির একটা জায়গায় পৌঁছাতে পারি।

৫.
@পি মুনশী:
আপনি আপনার বক্তব্য শুরুই করেছেন অভিজিত রায়ের বিরুদ্ধে সুকৌশলে "ছাগল" এনালজি দিয়ে (মন্তব্য#৪৫)। একটি আলোচনায় এসে এধরণের ভাষার প্রয়োগ অসৌজন্যমূলক। আর যে কৌশলে তা প্রয়োগ করলেন, তা-ও একটু সস্তা হয়ে গেল। এই আক্রমণটুকুতে অভিজিত বাবুকে পাঠকরা যতটা চিনেছে, তার চেয়েও বেশী চিনেছে কিন্তু আপনাকে আর আপনার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে। কথাটা মনে রাখবেন। বিষয়টা স্নিগ্ধা (মন্তব্য#৪৯ - "বোকার মত প্রশ্ন করে ছাগল টাগল হিসেবে আখ্যায়িত হবার ভয়ে আর করছি না") উত্থাপন করার পর আপনি অবশ্য মধুর ভাষায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্নিগ্ধার কাছে (মন্তব্য#৫০ ‌- "অত্যন্ত দু:খিত। খারাপ লাগছে।")। ক্ষমা চেয়েছেন, তাও ভালো! কিন্তু কার কাছে চাইলেন সেটা? স্নিগ্ধার কাছে না চেয়ে অভিজিত বাবুর কাছে ক্ষমা চাওয়াটাই কি অধিক যুক্তিযুক্ত হোতোনা? বিষয়টা একটু গোলমেলে এবং কৌতুককর!

আরেকটি বিষয়। আপনার মন্তব্য#৪৩ এ জনৈক সমাজতন্ত্রী পার্টি সভাপতির চেয়ারের পেছনে UN Human Rights Charter ঝুলিয়ে রাখা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বিষয়টা পরিস্কার হলনা। UN Human Rights Charter বলে কোন কিছুর নাম শোনার সৌভাগ্য হয়নি কখনো। তবে একটি দলিল আছে UN Charter নামে (যেটির ভিত্তিতে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত) এবং আরেকটি দলিল আছে যেটির নাম Universal Declaration of Human Rights বা সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা। আপনি মনে হয় পরেরটিই বোঝাতে চেয়েছেন। মানবতাবাদের আলোচনায় মানবাধিকারের উল্লেখ মাত্রই কেন আপনার এমন গাত্রদাহ হবে, বিষয়টা একটু প্রহেলিকাই মনে হচ্ছে। আপনি হয়তো জানেন না, সার্বজনীন মানবাধিকারের এই ঘোষণার দলিলটি পাবার পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরাট ভূমিকা ছিল। বিশেষ করে (রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারগুলোর পাশাপাশি) অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারগুলোকে এই সার্বজনীন ঘোষণায় অন্তর্ভূক্তির পেছনে তাদের নিরলস পরিশ্রম এবং কূটনৈতিক তৎপরতা দায়ী ছিল, যার জন্য চিরঋনী থাকবে মানব সভ্যতা। এখানে, এখানে, এবং  এখানে দেখুন।

৬.
সমাজতন্ত্রের কোন কোন তথাকথিত ধ্বজাধারীর গোঁড়া একরোখামীর সামনে পড়ার দুর্ভাগ্য হয়নি জীবনে একবার কি দু'বার, এমন মানুষ বোধ করি আমাদের মধ্যে আজ আর খুব বেশী নেই। এসব দেখে আমার মনেও মাঝে মাঝে প্রশ্ন জেগেছে। যে তত্ত্বের বৈজ্ঞানিকতা নিয়ে এত কথা, সে বিজ্ঞানমনষ্ক মুক্ত সরল মানুষের উদাহরণ তো এঁরা (অন্তত এদের বেশীর ভাগই) নন। কি জানি হয়তো একারণেই এমনকি মার্কসকেও এঙ্গেলসের চিঠির জবানীতে আমরা বলতে শুনি: “All I know is that I am not a Marxist”। (এখানে এবং এখানে দেখুন)। কি জানি, হয়তো একারণেই প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন: "প্রতিটি মার্কসবাদী তাত্ত্বিকের ভেতরেই একজন মৌলবাদী বাস করেন"।

বি.দ্র.: আমার বক্তব্যের প্রত্যুত্তর দিতে চাইলে এই পোস্টেই (এখানেই) তা দেয়ার অনুরোধ করবো। অন্য কোথাও এই আলোচনার সূত্র ধরে প্রত্যুত্তর দিলে আমার পক্ষে মনে হয়না অংশগ্রহণ করা সম্ভব হবে।

সচলায়তন এর ছবি

এই থ্রেডে অংশগ্রহণকারী সকল সচল ও অতিথিদের ধন্যবাদ জানাই। তবে এ বিষয়ে তর্কে প্রায়শই বক্তব্যের লড়াইয়ের পরিবর্তে বক্তার লড়াই চোখে পড়ছে। পোস্টের বক্তব্যের পক্ষে ও বিপক্ষের তার্কিকদের অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি অনুরোধ রইলো, এ চর্চাটি ভবিষ্যতে অব্যবহারে জীর্ণ করার।

এই পোস্টে কমেন্ট এখানেই বন্ধ করে দেয়া হলো। ধন্যবাদ।

_________________________________
সচলায়তন.COM কর্তৃপক্ষ

_________________________________
সচলায়তন.COM কর্তৃপক্ষ